মায়াডোর ১ম পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম
কল্প অন্ধকারে মেয়েটির হাতটা ধরে ফেললো। গুপ্তচরের মতো এই হাতটি দু’দিন থেকে তার ললাট ছুঁয়ে থার্মোমিটারের মতো শরীরের উষ্ণতার বার্তা আদান-প্রদান করছে। মেয়েটি কেঁপে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য নিঃশব্দে প্রাণপণে চেষ্টা করছে। কিন্তু কল্প উল্টো নিজের পাঁচটি আঙুল ওর পাঁচটি আঙুলের ফাঁক গলিয়ে বাঁধন আরও শক্ত করে নিল৷ মেয়েটি সতর্কভাবে চারদিকে তাকায়। বুক ‘ধুপ-ধুপ’ করছে। বুকের ওপর থেকে ওড়না টেনে নিজের ঘেমে যাওয়া থুতনি আলগোছে মুছে নিল সে। তারপর পাশে বসে পুনরায় কাঁপা কাঁপা হাতটি বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটির কপালে রেখে ফিসফিস করে বললো,
– ‘জ্বর তো এখনও কমেনি আপনার।’
রোগাক্রান্ত ছেলেটির উষ্ণ শ্বাস ছাড়া কোনো জবাব এলো না। ইতি পুনরায় বললো,
– ‘আমার হাতটা ছাড়ুন প্লিজ, কেউ এসে দেখে ফেলবে।’
কল্প তবু হাত ছাড়ে না৷ কনুই বিছানায় ঠেকিয়ে নিজের মাথা এনে রাখে ইতির কোলে। দুইহাতে জড়িয়ে ধরে ওর কোমর। চমকে উঠে ইতি। পুনরায় সতর্কভাবে অন্ধকারে চারদিকে তাকায়। বুকে ‘ধুপ ধুপ’ শব্দ ক্রমশই বাড়ছে। তার এই মুহূর্তেই এ কামরা থেকে প্রস্থান করা উচিত। কেউ এসে দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে৷ কিন্তু জ্বরে এই মানুষটার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেয়েছে। যাকে রোজ তাড়িয়ে দেয় কল্প৷ তাকেই অন্ধকারে কাছে টেনে নিয়েছে। কিভাবে এখন নিজেকে ছাড়িয়ে নিবে ইতি? গলা শুকিয়ে আসছে ভয়ে। শুকনো ঢোক গিলে মৃদু কাঁপতে থাকা আঙুলগুলো কল্পের ঘন-কালো চুলে ডুবিয়ে দিল। জ্বরক্রান্ত মানুষটির উষ্ণ শ্বাস ইতির কোলে আছড়ে পড়ছে৷ পরম মমতায় চোখে জল এসে যাচ্ছে ইতির৷ এই অন্ধকার আর কোনোদিন না মেলাক, পৃথিবীর মানুষগুলো আর ঘুম থেকে না জাগুক। এই রাত্রি আর দিন না হোক। ইতি এভাবে বসে থাকবে মানুষটার মাথা কোলে নিয়ে। এই প্রথম তার হাত ধরেছে কল্প। এই প্রথম তার কোলে মাথা রাখলো মানুষটা। ইতি মাথা নুইয়ে ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ‘শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?’
কল্প খানিক নড়ে উঠে বললো,
– ‘পুরো শরীরে ব্যথা করছে।’
কথাটির সঙ্গে কল্পের মুখ থেকে হুড়মুড় করে যেন আগুন বের হয়ে ইতির কোলে আছড়ে পড়লো।
সে পুনরায় ফিসফিস করে বললো,
– ‘তাহলে বাড়িতে চলে যান। এখানে এভাবে কে দেখবে আপনাকে।’
সে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে অচৈতন্য ক্লান্ত গলায় নিজেরই ডায়েরির লেখা বিড়বিড় করে বললো,
‘আমার আসলে কোনো বাড়ি নেই
আমাকে একটা বাড়ি দাও
বাড়ির ভেতর মমতাময়ী নারী দাও
যে আমাকে অন্ধকারে বিড়ালছানার মতো পরম মমতায় বুকে আগলে রাখবে। আমাকে একটা ঠিকানা দাও,
যেখানে পাখিদের মতো রোজ আমি গোধূলিলগ্নে ফিরে যেতে পারি।’
ইতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘কিসব বিড়বিড় করছেন। আপনি এত অদ্ভুত কেন? জ্বরের মাঝে এতো রাতেও কাব্য বকছেন?’
কোল থেকে কোনো জবাব এলো না। কিন্তু আচমকা জ্বলে উঠলো রুমের বাতি। হলদেটে আলোয় ভরে গেল কামরা। ইতি বিস্মিত হয়ে পলকেই দাঁড়িয়ে গেল। কল্পের মাথা মমতার নরম উষ্ণ কোল থেকে খসে পড়লো নীরস বিছানায়।
*
ইতিদের বাড়িতে কল্প প্রথম এসেছিল ভার্সিটি কোচিং করার জন্য। বড়ো মামা পাঠিয়েছিলেন তাকে। নানির ভাইয়ের বাসা এটা৷ সেদিন ভোরে বড়ো মামা ডাকলেন তাকে। সে ভয়ে ভয়ে সেদিকে গেল। বড়ো মামাকে দেখলেই ভয় লাগে। ভয়টা তার একার না৷ কল্পের ধারণা সুপ্তি আপু ছাড়া বাড়ির সকলেই মামাকে ভয় পায়। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলেই হইচই বন্ধ করে সবাই চুপ হয়ে যায়। বাচ্চারা টিভি দেখায় থাকলে সুবোধ বালকের মতো বই নিয়ে টেবিলে গিয়ে শরীর ঝাঁকিয়ে পড়তে শুরু করে। দরজায় নক দিয়ে কল্প বললো,
– ‘মামা আমি আসবো?’
মোস্তাক সাহেব মশারির ভেতর থেকে বের হলেন। পরনে হাফহাতা সাদা গেঞ্জি। গোঁফ ছাড়া পুরো মুখ ক্লিন শেভ। ডান চোখের একপাশে বেশকিছু জায়গায় কালো দাগ। জন্মের পর থেকে দাগটা আরও তীব্র হয়েছে। তিনি দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘বৃক্ষের মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে তো ডাকিনি। বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।’
কল্প ধীরপায়ে ভেতরে গিয়ে সোফার পাশে দাঁড়াল। মোস্তাক সাহেব একটা কাগজ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
– ‘এখানে ঠিকানা আছে। ফরিদ সাহেবের নাম্বারও আছে। ফরিদ সাহেবকে চিনিস?’
– ‘না মামা।’
– ‘ফরিদ সাহেব আমার মামা।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘লোকটা কেমন জানিস?’
– ‘জানি না মামা।’
– ‘জানতে হবে। একজনের বাড়িতে গিয়ে থাকবি। আর তাদের সম্পর্কে আগাম কিছু ধারণা থাকবে না, তা কি হয়?’
কল্প জবাব না দিয়ে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে এসে বিছানায় আবার বসে বললেন,
– ‘ফরিদ সাহেব মন্দলোক। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী। খোদাতায়ালার অভিশপ্ত ব্যক্তি।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘তবুও তোরে পাঠাচ্ছি। প্রয়োজনের সময় মন্দ লোকদের কাছেও যেতে হয়।’
– ‘জ্বি মামা।’
– ‘এই কাগজে ঠিকানা আছে। ফরিদ সাহেবের নাম্বারও আছে।’
সুপ্তি হুইলচেয়ারের চাকা ঠেলতে ঠেলতে বাবার রুমে ঢুকে বললো,
– ‘ফরিদ সাহেব তোমার কে হয় বাবা?’
– ‘কেন তুই জানিস না?’
– ‘আমি জানি, তুমি জানো কি-না বুঝতে চাচ্ছি।’
– ‘আমি জানবো না কেন? ফরিদ সাহেব আমার মামা।’
– ‘তাহলে ‘ফরিদ সাহেব ফরিদ সাহেব’ করছো কেন? মামা ডাকলে কি দাঁতে ব্যথা করে?’
– ‘আহা উনি তো সামনে নাই রে মা। আড়ালেও ডাকতে হয় না-কি।’
– ‘হ্যাঁ ডাকতে হয়। কল্প তো আড়ালে তোমাকে ‘মোস্তাক সাহেব’ বলে ডাকে না।’
কথাটি বলে সুপ্তি পুনরায় হুইলচেয়ারের চাকা ঠেলে ঠেলে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
মোস্তাক সাহেব লাজুক মুখে হেঁসে বললেন,
– ‘সুপ্তি হয়েছে অবিকল তোর নানির মতো। কি বলিস?’
– ‘হ্যাঁ মামা।’
দরজার বাইরে থেকে সুপ্তি বললো,
– ‘কল্পের নানি তোমার কে হয় বাবা?’
মোস্তাক সাহেব বিব্রত হয়ে বললেন,
– ‘এই কথাও শুনে ফেললি মা।’
– ‘হ্যাঁ শুনলাম, আমার পা নষ্ট, কান না।’
মোস্তাক সাহেব হেঁসে ফেললেন। তারপর পুনরায় কল্পকে বললেন,
– ‘এখানে রশিদ মামার নাম্বার আছে বুঝলি? তবুও কল দিবি না। ঠিকানা অনুযায়ী আগে নিজে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবি। পুরুষ মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছিস। একটা বাসাই যদি খুঁজে বের করতে না পারিস৷ তাহলে এই জীবনে আর পারবিটা কি ব্যাটা!’
– ‘হ্যাঁ মামা।’
তিনি বালিশের নীচ থেকে পাঁচশো টাকা বের করে দিয়ে বললেন,
– ‘এই নে ভাড়ার টাকা।’
কল্প মলিনমুখে টাকাটা নিয়ে করিডরে এসে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে আনমনে কিছু একটা ভেবে সুপ্তির রুমে গেল। পুরো ঘর খোঁজাখুঁজি করে ওর বালিশের নিচে ঝকঝকে একটা এক হাজার টাকার নোট পেয়ে তাড়াতাড়ি পকেটে পুরে বের হয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে বাতি জ্বালিয়ে নিল। হাত বাড়িয়ে একটা বালিশ বিছানার কিনারে এনে রাখলো। টেবিল থেকে আয়না এনে সেই বালিশে ঠেকিয়ে রেখে শেভিং ক্রিম আর রেজার নিয়ে মেঝেতে আরাম করে বসলো। মুখে ক্রিম লাগিয়ে ডান গালে এক টান দিতেই দরজায় নক পড়লো।
– ‘কে?’
– ‘আমি, দরজা বন্ধ করে কি করছিস?’
– ‘এ বাড়িতে ‘আমি’ নামে কাউকে চিনি না আমি।’
– ‘ফাজলামো করবি না একদম। দরজা খুল বলছি।’
– ‘ও সুপ্তি আপু মনে হচ্ছে।’
– ‘মনে হবে কেন। আমি সুপ্তি, দরজা এক্ষুনি খুলে দে।’
– ‘এখন খোলা যাবে না আপু। পরে আসো।’
– ‘কেন ভেতরে কি এমন গোপন কাজ চলছে শুনি?’
– ‘গোপন কাজ না আপু। মুখ শেভ করছি।’
– ‘তুই আবার মুখ শেভ কবে থেকে ধরলি।’
– ‘বহু আগে থেকে।’
– ‘তো মুখ শেভ কি দরজা-জানালা বন্ধ করে করতে হয় না-কি? দরজা খুল।’
– ‘না আপু মুখ শেভ করতে কেউ দেখলে আমার লজ্জা লাগে।’
সুপ্তি দরজায় জোরে জোরে চাপড় দিয়ে বললো,
– ‘এক্ষুণি দরজাটা খুলে দে। না হলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না বললাম।’
– ‘আপু এখন বিরক্ত করবে না তো। পরে এসো।’
– ‘মুখ শেভ এতটাও জরুরি কিছু না যে কথা বললে বিরক্ত হবি।’
– ‘অবশ্যই মুখ শেভ জরুরি আপু। কাজটা খুব সাবধানে করতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হলে যদি গাল কেটে বিশ্রী একটা দাগ পড়ে যায় কেউ কি আমাকে বিয়ে করবে?’
– ‘তোকে এমনিতেই আর কেউ বিয়ে করবে না। কারণ বিয়ের আলাপ এলেই আমি কনেপক্ষকে নিজে কল দিয়ে বলবো ‘আমি সুপ্তি, বাড়ি মোহনগঞ্জ, আমার বিশেষ পরিচয় আমি একটা চোরের মামাতো বোন, আপনাদের হবু জামাই কল্প একটা চোর, দূর্ভাগ্যবশত ওর বোন হই আমি।’
কল্প রেজার রেখে কপালে হাত দিল। সে ভাবেনি এখনই টাকার খোঁজ পড়ে যাবে। নিজেকে সামলে নিয়ে দরজা খুলে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো,
– ‘কি বললে আপু? আমি চো*র?’
তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুপ্তি খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো। তারপর চাকা ঠেলে ভেতরে এসে বললো,
– ‘মুখে দাড়ির মতো সাদা ক্রিম লাগিয়েছিস। কি অদ্ভুত লাগছে তোকে। যা শেভ কর আমি বসে বসে দেখি।’
– ‘মুখ শেভ কি বিনোদনের কিছু যে দেখতে হবে।’
সুপ্তি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ, আমার বন্দি জীবন। বিনোদনের জন্য আর বিশেষ কি থাকতে পারে?’
– ‘যাও তো আপু, এভাবে ফ্যালফ্যাল করে কেউ তাকিয়ে থাকলে আমি গাল কেটে ফেলবো।’
সুপ্তি মুখ ভেংচি করে চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে বললো,
– ‘চো*রের আবার কত লজ্জা-শরম।’
কল্প পিছু ফিরে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ার ধরে ঘুরিয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা আপু দেখো তুমি।’
সুপ্তি মিষ্টি হেঁসে বসে রইল। কল্প পুনরায় মেঝেতে বসে বললো,
– ‘আপু টাকাটা আমিই নিয়েছি। রাগ করোনি তো।’
– ‘না, কারণ টাকাটা আমি তোর জন্যই রেখেছিলাম। জানি বাবা একেবারে হিসাব-নিকাশ করে টাকা দিবেন।’
কল্প মুচকি হেঁসে এগিয়ে এসে কোলে মাথা রেখে বললো,
– ‘তুমি এত ভালো কেন আপু।’
সুপ্তি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে কান ধরে টেনে তুলে বললো,
– ‘এই বলদ, তুই মুখের সব ক্রিম আমার কোলে লাগিয়ে ফেলেছিস দেখ।’
– ‘হায় হায় সরি আপু।’
– ‘হয়েছে, সর আমার কাছ থেকে। শেভিং ক্রিমের গন্ধ লাগছে। এই গন্ধ নাকে আসলে শরীর রি রি করে।’
কল্প পুনরায় মেঝেতে গিয়ে বসলো। রেজার হাতে নিয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা আপু তোমার কিছু চু*রি হলেই তুমি প্রথমেই আমাকে ধরতে আসো কেন? আমি কি চো*র? এই বাসায় আরও তো বাচ্চা-কাচ্চা আছে।’
– ‘অবশ্যই চো*র। এই বাসার একমাত্র চো*র তুই।’
– ‘এভাবে অপমান করছো কেন আপু। টাকাটা তো আমাকেই দিতে চাইছিলে। নিজের টাকা নিজে চু*রি করেছি। এটা কোনো অপরাধের পর্যায়ে পরে না৷ পড়লেও লঘু অপরাধ।’
– ‘এটা তোর টাকা না৷ এগুলো ধার। তুই রোজগার করে সব কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব করে ফিরিয়ে দিবি।’
– ‘তা তো অবশ্যই। একেবারে শোধে-আসলে সব ঋণ দিয়ে দেবো। এই কল্প কারও কাছে ঋণী থাকার লোক না।’
– ‘চুপ কর। বড়ো বড়ো কথা শুধু।’
– ‘এসএসসি এইচএসসি দু’টাতেই জিপিএ ফাইভ পেলাম। তবুও বলছো শুধু বড়ো বড়ো কথা বলি। কষ্ট পেলাম আপু।’
মুচকি হাসলো সুপ্তি। কল্প পুনরায় বললো,
– ‘তুমি জানো আপু? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাতেগোনা দৃশ্যের মাঝে তোমার হাসি একটা।’
– ‘হইছে ভাবের কথা রেখে শেভ কর।’
– ‘আপু একটা গান শুনাও। বাড়িতে কবে ফিরবো আর ঠিক নাই।’
– ‘এখন?’
– ‘হ্যাঁ এখন, মুখ শেভ করতে করতে শুনলাম। গুনগুন করে গাও।’
– ‘কোন গান?’
– ‘ওইযে রবীন্দ্র সংগীত একটা গাও তুমি প্রায়ই। আমি আঁধারে বন্দিনী।’
– ‘এটা রবীন্দ্র সংগীত না৷ একটা পুরাতন বাংলা সিনেমার গান।’
– ‘ওই হলো। গাও।’
– ‘এই অবেলায় গান গাইব!’
– ‘গানের আবার বেলা-অবেলা কি আপু। গাও তো।’
সুপ্তি চোখ বন্ধ করে গান ধরলো।
“আমি যে আধারে বন্দিনী
আমারে আলোতে ডেকে নাও
স্বপন ছায়াতে চঞ্চলা
আমারে পৃথিবীর কাছে নাও
শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো
তৃষিত হৃদয় মোর জ্বেলেছে আলো…।”
গান শেষ হতেই স্কুল ড্রেস পরনে নীলিমা দরজার কাছে এসে বললো,
– ‘এহ দু’জনের আহ্লাদ দেখলে শরীর জ্বলে।’
কল্প পিছু ফিরে বললো,
– ‘এদিকে আয় শুনে যা।’
নীলিমা এগিয়ে গিয়ে বললো,
– ‘তাড়াতাড়ি বলো স্কুলের সময় হয়ে গেছে।’
– ‘আপুর আহ্লাদ পেতে হলে আমার মতো ভালো রেজাল্ট কর। তুই তো ফেল্টুস৷ এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট কর। আমাকে দেখ, দুইটা পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ।’
নীলিমা মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে যেতে বললো,
– ‘পড়ালেখায় ভালো বলে অহংকারের শেষ নাই।’
কল্প পিছু থেকে বললো,
– ‘আমার চেহারাও ভালো। তাই না সুপ্তি আপু।’
সুপ্তি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ একদম হিরোদের মতো।’
নীলিমা দরজার কাছে ফিরে এসে বললো,
– ‘আসছে আমাদের হিরো, মুখ শেভ যে করছো আয়নায় তাকিয়ে দেখো চো*রের মতো লাগছে।’
– ‘নিলির মা আমারে কি বললো শুনলে তো আপু। ওরে হাতের কাছে পাইলে মাথা ফাটিয়ে দেবো। আমি ওরে পড়াই। ওর স্যার হই আমি। আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে স্কুলে যাবে, তা না৷ উল্টো বলে চো*রের মতো লাগে। এমন বে*য়াদব স্টুডেন্ট তো ফেইল করবেই।’
সুপ্তি মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসছে।
– ‘আসলেই কি চো*রের মতো লাগছে আপু?’
– ‘না, পুরুষ মানুষ সুন্দর হলে, সব রকমই সুন্দর লাগে।’
– ‘এটা ভুল বললে আপু। মেয়েরাও যে সুন্দর, সে যা পরে, যেরকমই সাজে, সুন্দর লাগে৷’
কাজের মেয়ে মতিয়া ঝাড়ু হাতে দরজার সামনে থেকে বললো,
– ‘খাঁটি কথা কইছেন ভাইজান। আমার আম্মা কয় আমারে ছোটবেলায় যা পিন্দাইতো পরীর লাখান সুন্দর লাগতো। আসল কথা হইল যে সুন্দর তারে সবকিছুতেই সুন্দর লাগে। পরে হইছে কি জানেন? পরীর লাখান সুন্দর লাগে বলায় পরীরা মনে হয় আমারে দিছে নজর। এরপর চেহারা-ছবি হইয়া গেছে পে*ত্নীর লাখান।’
কল্প পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো,
– ‘এখন যে বলছিস পে*ত্নীর মতো হয়ে গেছে। পে*ত্নীরা অভিশাপ দিলে বা*ন্দরনীর মতো হয়ে যেতে পারিস। আমরা বা*ন্দরনীর মুখ দেখতে চাই না, দরজার সামনে থেকে সরে যা।’
মতিয়া হনহন করে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বললো, ‘হ তুই তো শাকিব খান, তোরে মতিয়া মুখ দেখাইবার লাগি দরজার সামনে গিয়া দাড়াইয়া শরীর মোচড়ামুচড়ি করবো।’
সালেহা বেগম তাকে দেখে বললেন,
– ‘কি বিড়বিড় করছিস?’
– ‘এই দুনিয়ায় গরিবের চিল্লানিও কেউ শুনে না চাচি। আর আপনে আছেন বিড়বিড় নিয়া।’
– ‘ও আচ্ছা, তাহলে থাক তোর বিড়বিড়৷ নিলয়ের কলমটা খুঁজে দে তো। স্কুলে যাবে, কোথায় রেখেছে এখন পাচ্ছে না না-কি।’
মতিয়া ঝাড়ু হাতে নিলয়কে নিয়ে পুরো বাড়ি খুঁজেও কলম পেল না৷ করিডরে এসে নিলয় বললো,
– ‘আব্বা আম্মাকে গিয়ে বলো কলম হারিয়ে গেছে আমি স্কুলে যাব না।’
কথাটা বলেই সে বল নিয়ে দৌড় দিল উঠানের দিকে।
মতিয়া মোস্তাক সাহেবকে এসে বললো,
– ‘চাচা নিলয়ের কলম হারিয়ে গেছে সে না-কি আজ স্কুলে যাবে না।’
– ‘কলম হারায় কিভাবে? কলম হারায় কিভাবে বল আমাকে? যা তো বেকুবের বাচ্চাটাকে ডেকে নিয়ে আয়।’
মতিয়া ঝাড়ু হাতে বিড়বিড় করে করিডর পেরিয়ে যাচ্ছে, ‘ধুর ব্যাটা, তোর পোলা কলম কই হারাইছে আমি কি জানি? আমি কি ওর মা লাগি? আমার লগে চিল্লাস কেন?’
নিলয় দেয়ালে বারবার বল ছুড়ে মেরে ক্যাচ নিচ্ছিল। মতিয়া গিয়ে বললো,
– ‘চাচা ডাকে তোরে।’
নিলয় ভয়ে ভয়ে বাবার রুমের দরজার সামনে এলো। মোস্তাক সাহেব তাকে দেখে বললেন,
– ‘এদিকে আয়।’
সে বাবার সামনে গিয়ে মাথা নুইয়ে রইল।
– ‘স্কুলে না-কি যাবি না?’
– ‘কলম হারিয়ে গেছে।’
গালে একটা চ*ড় দিয়ে বললেন,
– ‘কলমের কি পা আছে যে হেঁটে হেঁটে গুম হয়ে যাবে। আর বেকুবের বাচ্চা কলম হারিয়ে গেছে বললে স্কুলে যেতে হবে না, এই চিন্তা তোর মাথায় কে ঢুকিয়ে দিছে?’
– ‘কেউ না আব্বা।’
– ‘এই নে টাকা। রেডি হয়ে স্কুলে যা। যাওয়ার পথে কলম নিয়ে যাবি।’
নিলয় গালে হাত দিয়ে টাকা নিয়ে কল্পের রুমে গিয়ে সুপ্তিকে পেয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা আপু, বাংলা স্যার ওইদিন ক্লাসে গল্প করলেন উনি ছোটবেলায় নিজে কলম লুকিয়ে মা-বাবাকে বলতেন হারিয়ে গেছে। সেদিন আর স্কুলে যেতে হতো না। আমাকে বাবা উল্টো মেরে টাকা হাতে দিয়ে স্কুলে পাঠাচ্ছে কেন?’
কল্প হেঁসে ফেললো। সুপ্তি হাসতে হাসতে ভাইকে কাছে টেনে আদর করে বললো,
– ‘স্যারের মনে হয় স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় দোকান ছিল না ভাই।’
কল্প তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বললো,
– ‘তা কলম কোথায় লুকিয়েছিসরে বল্টু?’
– ‘এমন জায়গায় লুকিয়েছি কেউ পাবে না।’
– ‘এখন তুই নিজে খুঁজে পাইলেই হইল। তাড়াতাড়ি কলমটা নিয়ে স্কুলে যা। মাঝখান দিয়ে টাকা পেয়ে গেলি। আইস্ক্রিম খেতে পারবি৷ তাড়াতাড়ি যা।’
.
চলবে…