মায়াডোর-০৯,১০

0
276

মায়াডোর-০৯,১০

(৯ম পর্ব)
.
পড়া শেষে ইতি বই রেখে প্রথমেই লতিফার খুঁজে গেল। রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে বললো,

– ‘লতিফা আপু এদিকে আসো।’

লতিফা এলো। তাকে নিয়ে গেল সিঁড়ির কাছে। তারপর ফিসফিস করে বললো,

– ‘আপু কল্প ভাইয়াকে আর ভয় দেখানোর দরকার নাই। আমার রুম দখল করেছে তো। তাই প্রথমদিন একটু রেগে ছিলাম।’

লতিফার মুখ মলিন হয়ে গেল। তার ভেতরে পুরোটা দিন একটা উৎসব উৎসব ভাব ছিল। নিমিষেই সেই উৎসবের আনন্দ ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

– ‘ইতি লতিফ যখন এতদূর থাইকা আইছে। একবার ভয় দেখাইলে কি হয়। দেখি মাস্টার ভয় পাইয়া কি করে।’

– ‘না আপু দরকার নাই৷ বেশি ভয় পাইতে পারে। জানো তো ভয় থেকে মানুষ অসুস্থও হয়ে যায়।’

– ‘কি যে কও। ব্যাটা মাইনষের অবার ভয় কিসের? ভয় পাইলে বুঝবা মাস্টার কোনো পুরুষই না।’

কথাটা বলে ফিক করে হাসলো লতিফা।
রাগে গা জ্বলে উঠলো ইতির। রূঢ় গলায় বললো,

– ‘ওকে নিয়ে ফালতু কথা একদম বলবে না। অনেক সাহসী মানুষও আছে কিছু কিছু বিষয়ে অনেক ভীতি থাকে৷ কেউ কুকুরকে প্রচণ্ড ভয় পায়। একেবারে নিরীহ তেলাপোকা বা মাকড়সাকে দেখেও অনেকে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। কেউ পানিটা পর্যন্ত ভয় পায়৷ সে ভূ*ত-প্রে*ত ভয়ে পেয়ে তো ঘর ছেড়ে দেয়নি। ভয় দেখানোর পরও নতুন জায়গায় একা থেকেছে।’

লতিফা মুখ বাঁকিয়ে যেতে যেতে বললো,

– ‘বাবা আইজকা দরদ উথলে উঠছে দেখি।’

ইতি পিছু থেকে ডেকে বললো,

– ‘দাঁড়াও আমি আসছি।’

ইতির কাছে দাদাভাইয়ের টাকা ছাড়াও এক হাজার টাকা ছিল। বইয়ের ভাঁজ থেকে এনে ওর হাতে দিয়ে বললো,

– ‘এই নাও, তোমার ভাইয়ের ভাড়ার টাকা হিসাবে দিচ্ছি৷ এখন আমার কাছে টাকা নাই। পরে একদিন আরও পাঁচশো তোমার কাছে দিয়ে দিব।’

লতিফা টাকা হাতে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

– ‘দিলে দাও না দিলে নাই। আমরা এত টাকার কাঙাল না।’

ইতি রুমে এসে টেবিলে বসলো। লতিফার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কল্পের কথা ভাবছে। কেন যেন নিজেকে ভীষণ শান্ত-স্নিগ্ধ লাগছে। ভেতরের কোনো একটা উত্তপ্ত মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ শীতল হাওয়া বইছে। মনে কেমন প্রশান্তির ভাব। কল্প তাকে কিছু অংক দিয়েছে আগামীকাল করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। না পারলে সে বুঝিয়ে দেবে। তবে চেষ্টা করেছে যে তার প্রমাণ দেখাতে হবে। ইতির মনে হচ্ছে পারাই লাগবে, না পারলে ব্যাপারটা ভীষণ লজ্জার হবে। সবগুলো ঠিকঠাক মতো করে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। ভাবের দোকানদার চমকে যেত। ইতি সমাধান বের করে একা বুঝার চেষ্টা করলো। ক্লাসে গণিত স্যারের করানোও ছিল। সেই খাতাতেও চোখ বুলিয়ে একা একা করার চেষ্টা শুরু করেছে। খাওয়ার সময় হুস্না বেগম এসে মেয়েকে পড়ার টেবিলে দেখে ভীষণ খুশি হলেন। পিছু থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেন ইতি খাতায় কাটাছেঁড়া করতে ভীষণ ব্যস্ত। পিঠে হাত রেখে বললেন,

– ‘খেতে আয় মা। তারপর এসে বসবি।’

ইতি মাথা না তুলে বললো,

– ‘ওদের খাওয়া শেষ?’

– ‘খাচ্ছে ওরা, শেষ হয়ে যাবে।’

– ‘আচ্ছা যাও আসছি।’

হুস্না বেগম প্রচণ্ড খুশি মনে চলে গেলেন। পড়ালেখার প্রতি উদাসীন মেয়েটাকে পড়তে দেখলে বড়ো ভালো লাগে।
ইতি খানিক পর রান্নাঘরে এলো। সেখানেই একপাশে তাদের খাওয়ার টেবিল। ইতিকে দেখে ফরিদ সাহেব বললেন,

– ‘ইতি কাল দুপুরে তুমি উপস্থিত থাকবে। প্রয়োজনে স্কুল বাদ। বাড়ি শিশু থেকে বুড়ো সকলের উপস্থিতি চাই।’

ইতি ভ্রু-কুঁচকে বললো,

– ‘কেন দাদাভাই? তোমার আরেকটা বিয়ে হবে না-কি কাল?’

– ‘আমার সাথে রসিকতা করবি না। আমি তোর রসিক বন্ধু না। লতিফ কবিরাজকে জানিয়েছে৷ কবিরাজ তার দলবল নিয়ে দুপুরের দিকে আসবে।’

ইতি প্রচণ্ড খুশি হয়ে বললো,

– ‘ওয়াও, কালই হবে তাহলে।’

ফরিদ সাহেব রাগান্বিত চেহারায় বললেন,

– ‘খুশিতে লাফানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটে নাই। বাটি চালান কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান না৷ কেউ একজন লোক সম্মুখে চো*র হবে৷ বুঝতে পারছো বিষয়টা কত গুরুতর?’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ইতি তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। টাকাটা সরিয়ে ফেলা দরকার। বইয়ের ভাঁজ থেকে টাকা নিয়ে রেখে এলো ফরিদ সাহেবের অন্য একটা পাঞ্জাবির পকেটে।
অংক করতে করতে অনেক রাত করে ঘুমালো ইতি। পরেরদিন কেউ স্কুলে গেল না। বাড়ির সবাই প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। ঘটনা কি হয় দেখা লাগবে। লতিফ কল পেয়ে এগারোটার দিকে গেল কবিরাজকে নিয়ে আসতে। বাড়ির সবাই বারান্দায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষায়। কারও মনে ভয়-ডর নাই দেখে ফরিদ সাহেব বারবার রেগে যাচ্ছেন৷ বিদ্যুৎ না থাকায় তিনি আম গাছের নিচে বসে আছেন। মাঝে মাঝে অন্যদিকে তাকিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলছেন ‘বাটি চালানে কাজ না হলে চাউল পড়া খাওয়ানো হবে। তারপরও এ বাড়ির চো*র কে বের করা লাগবে।’

ইতি নীলাকে ফিসফিস করে বললো
‘আন্টি চাউল পড়া ব্যাপারটা কি?’

নীলা ঠোঁট উলটে বললো ‘জানি না।’

হুস্না বেগমও বারান্দায় বেঞ্চে বসে আছেন। ভালোই লাগছে সবকিছু। শহরে কখনও এগুলো হয় না৷ বিয়ের আগে বাপের বাড়ি একবার দেখেছিলেন। তাও স্পষ্ট মনে নেই। ইতি হুস্না বেগমের কাছে ছুটে গিয়ে বললো,

– ‘মা চাউল পড়া বিষয়টা কি?’

তিনি হেঁসে বললেন,

– ‘চাউল পড়া আবার কি, চাউল পড়া তো চাউল পড়াই।’

ইতি আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। তখনই লতিফ দু’জন লোক নিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকলো। নিয়ন আর নিলয় আজ ভয়ে অস্থির। মায়ের কাছ থেকেই যাচ্ছে না। লোক দু’টাকে দেখে আরও কাছ ঘেঁষে বসলো। ইতি বারান্দার গ্রিল ধরে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। দু’জন লোকই দেখতে অদ্ভুত। একজনের চুল আর গোঁফ অনেক লম্বা। কপালে হলুদ রুমাল বাঁধা। গলায় ঝুলছে লাল চাদর। পরনের শার্ট এবং লুঙ্গি দুটাই ধবধবে সাদা। আঙুলে বড়ো বড়ো আঙটি। দ্বিতীয়জন খাটো স্বাস্থ্যবান মধ্যবয়সী লোক। তার গোলগাল মাথা ন্যাড়া করা। ফরিদ সাহেব তাদের নিয়ে বারান্দায় এলেন। হুস্না বেগম নীলা আর ইতিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। এখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। লতিফকে দেখা যাচ্ছে সাদা পোশাক পরা লোকটিকে ভীষণ সমীহ করছে। চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওস্তাদ বসেন।’

এদিকে লতিফা নিজেই ব্যস্ত হয়ে হুস্না বেগমকে বললো,

– ‘চাচি চা-নাশতার ব্যস্ত করি গিয়ে।’

হুস্না বেগম অনুমতি দিলেন।

লতিফ গিয়ে কল্পকে বললো,

– ‘ভাই আপনে দরজার সামনে থেকে কি দেখছেন? আচানক কারবার হইব এখন। আমাদের ওস্তাদ মানেই আচানক কারবার। আমিও মাঝে মাঝে ওস্তাদের লগে পোগ্রামে যাই।’

কল্প মুচকি হেঁসে তার সঙ্গে বাইরে এলো। বাজার থেকে তখন মুজিব উদ্দিনও ফিরেছেন। তিনিও হাসি হাসি মুখে এসে বেঞ্চে বসলেন। সাদা পোশাকের লোকটি পানি চাইল। লতিফ দৌড়ে গিয়ে গ্লাসে করে পানি এনে দিল। কবিরাজ প্রথম চুমুক পানি কুলি করে উঠানে ফেললেন। সুপারির দানা সহ লাল টকটকে পানি গিয়ে পড়লো আছড়ে পড়লো। পানি খেয়ে লতিফের কাছে গ্লাস দিয়ে কবিরাজ বললেন,

– ‘তুলারাশিকে ছাড়নের আগে একটা কথা বলে রাখা দরকার। বাটি যদি আশেপাশের বাসার দিকে চলে যায় তখন কি করবেন? আটকাবে না-কি যেতে দিবেন।’

ফরিদ সাহেব এবং মুজিব উদ্দিন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। মুজিব আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘বুঝি নাই ব্যাপারটা।’

কবিরাজ আবার বললো,

– ‘মনে করেন আপনার পাশের বাসার কেউ টাকা চু*রি করছে। এখন বাটি পাশের বাসায় চলে গেল। তখন ওদের ইজ্জতে লাগলে ঝামেলা করবে না? আপনাদের কি সেই ক্ষমতা আছে ওই বাড়িতে বাটি নিয়ে ঢোকার।’

ফরিদ সাহেব মাছি তাড়ানোর মতো বললেন,

– ‘সেই চিন্তা আপনার করা লাগবে না।’

– ‘না চিন্তা করা লাগবে। আপনি না করলে বাটি কারও গেইটের কাছে গেলেই আঁটকে ফেলবো।’

মুজিব উদ্দিন আমতা-আমতা করে নাক টান দিয়ে বললো,

– ‘মানুষের গেইটের সামনে না। ব্যাপারটা যা হয় আমাদের গেইটের ভেতরে থাকলেই ভালো হয়। লোক হাসানোর দরকারটা কি?’

কথাটা বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন। ফরিদ সাহেব চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে রইলেন। লতিফা চা এনে দিল। কবিরাজ চা হাতে নিয়ে লতিফকে বললেন,

– ‘তাহলে গেইটের কাছে গেলেই তুই কোমর ধরে আঁটকে দিবি৷’

ফরিদ সাহেব থমথমে মুখে বসে রইলেন। চা খাওয়া শেষ হতেই কবিরাজ ব্যাগ থেকে একটা সোনালি বাটি বের করলেন। তারপর উঠানে গিয়ে লাল চাদর বিছিয়ে সেখানে বাটি রাখলেন। ন্যাড়া মাথার লোকটি এসে ডান হাত বাটিতে রেখে ভর দিয়ে বসলো। পুরুষ সবাই বের হয়ে এলেন উঠানে। মহিলারা বারান্দা থেকে তাকিয়ে দেখছে৷ কবিরাজ একটা বোতল থেকে মুঠোয় পানি নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে ছুড়ে মারলো ন্যাড়া মাথার লোকটির গায়ে৷ সে ক্রমশই কাঁপতে শুরু করলো। অস্বাভাবিক কাঁপন৷ আরও দু’বার লোকটি পানি ছুড়ে দিল। ধীরে ধীরে বাটি সহ লোকটি দ্রুত চলতে শুরু করলো। ইতি বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। সবকিছু কেমন অলিক মনে হচ্ছে। লোকটি উঠানের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেল গেইটের দিকে। লতিফ গিয়ে দৌড়ে কোমরে ধরলো। ন্যাড়া লোকটি ঘেমে একাকার। কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে গেল। কবিরাজ এসে ফরিদ সাহেবকে ফিসফিস করে বললো,

– ‘চো*র তো বাইরের।’

ফরিদ সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,

– ‘অসম্ভব চো*র অবশ্যই বাড়িতে আছে। আবার ছাড়েন দেখি।’

তুলারাশির জ্ঞান ফেরার পর আবার ছাড়া হলো। পুনরায় বাটি চলে গেল গেইটের দিকে। কবিরাজ জোর গলায় বললো,

– ‘চো*র বাইরের। এখন আপনাদের সাহস থাকলে বাটি বাইরে যেতে দিন। না হলে কিছু করার নাই। আমাদের বিদায় দেন।’

ফরিদ সাহেব রেগে গিয়ে বললেন,

– ‘তোমরা ভ’ণ্ড কবিরাজ। চো*র অবশ্যই বাড়িতে আছে। বাইরের লোক আমার রুমে যাবে কিভাবে? তুলারাশির চোখ বেঁধে আবার ছাড়ো।’

কবিরাজ ক্লান্ত হয়ে বললো,

– ‘ঠিক আছে সুপারি আনেব। তুলারাশিরও জিরানো প্রয়োজন।’

সুপারি এনে দেওয়া হলো তাদেরকে। ইতি সবার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। চো*র বাইরের হবে কিভাবে? টাকা সে নিজের হাতেই রেখেছে দাদাভাইয়ের রুমে? তবুও সে এর শেষ দেখতে চায়, প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। পুনরায় তুলারাশির চোখ বেঁধে আয়োজন শুরু করা হলো। মুজিব উদ্দিন খাবার শেষে বাজারে যাওয়ার জন্য হাসি হাসি মুখে উঠানে এলেন। তখন কৌতূহল থেকে আমগাছের নিচে গিয়ে খানিক দাঁড়ালেন। কেঁপে উঠলো বাটি। তুলারাশি পাগলের মতো পুরো উঠানে ঘুরতে শুরু করছে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ছুটে এলো মুজিব উদ্দিনের দিকে। তিনি ভয়ে সরে যাচ্ছিলেন। লতিফ ধরে বললো ‘দাঁড়িয়ে থাকেন ভাইজান।’

বাটি এসে থামলো উনার পায়ের কাছে। বিস্মিত হয়ে নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘এটা কি হলো কিছুই তো বুঝলাম না।’

ফরিদ সাহেব ছেলের কাছে এসে আহত নয়নে বললেন,

– ‘তুই তাহলে চো*র?’

– ‘কি বলেন বাবা? আমি উল্টো তোমার জন্য দোকান থেকে তিন হাজার টানা নিয়ে ফিরেছি। ভাবলাম তোমার যেহেতু মানতের টাকা। তাহলে দেয়া দরকার। এই দেখো আমার পকেটেই তিন হাজার টাকা।’

– ‘তাহলে তুই দিলি না কেন? না দিয়ে চলে যাচ্ছিলে কেন? চো*রের বাপের বড়ো গলা তাই না? এই টাকাই তো আমার তিন হাজার টাকা।’

লতিফা এগিয়ে এসে বললো, ‘দেখলেন তো দাদাভাই নিজের ছেলেই চো*র আর আমারে গিয়ে ধরেছিলেন। আমরা পীর বংশের মানুষ, চো*রের না।’

মুজিব উদ্দিন অসহায় হয়ে চারদিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললেন, ‘বুঝলাম না, আমি কিভাবে ফেঁসে গেলাম!’
কথাটা বলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

…চলবে__

লেখা: জবরুল ইসলাম

মায়াডোর (১০ পর্ব)
.
সবাই ছুটে আসে আমগাছের নিচে। মুজিব উদ্দিনের মাথায় বোতলের পানি ঢেলে দেয় কবিরাজ। লতিফ তাকে ঠেলে বসিয়ে বললো, ‘ভাইজানের কি হইছে? পেরেশান হওনের তো কিছু নাই। দুনিয়ায় মানুষ কত আচানক কুকর্ম করে। আপনে নিজের বাপের সামান্য টাকা চু*রি করছেন। তাতে অসুবিধা কি? বাপের টাকা চু*রি করলে কোনো পাপ নাই। আপনে কি কন ওস্তাদ?’

– ‘এত কথা বলিস না, উনাকে দাঁড় করা।’

মুজিব উদ্দিনকে বগলে ধরে টেনে সে দাঁড় করালো। তিনি দাঁড়িয়ে প্রথমেই স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘বিশ্বাস করো হুস্না আমি চো*র না।’

হুস্না বেগম অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ইতির মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে৷ একই সঙ্গে ভয় এবং বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট। এরকম ঘটনা ঘটবে সে আগে বুঝতে পারেনি। পা টিপে টিপে মুজিব উদ্দিনের হাতে এসে ধরে। তারপর থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মাথা নুইয়ে বলে,

– ‘টাকাটা বাবা চু*রি করেনি।’

কবিরাজ প্রতিবাদ করে বললো,

– ‘উনার কাছে তো টাকাও পাওয়া গেছে। একেবারে হাতে-নাতে প্রমাণ।’

– ‘আপনি একদম কথা বলবেন না। চোখ বাঁধায় আপনার তুলারাশি না দেখে বাবাকে ধরেছে। না হলে বারবার গেইটের দিকেই যেত। কারণ আপনারা জানেন সামান্য টাকার জন্য কেউ অন্যের বাড়ি বাটি নিয়ে ঢুকে ঝামেলা করবে না। মানুষের জিনিস হারালে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ থাকে চু*রিটা কে করলে জানতে। এটা আপনারা ভালো করেই জানেন।’

লতিফ এগিয়ে এসে বলে,

– ‘আপা কি আচানক কথাবার্তা কন আপনে। ওস্তাদরে আমাদের দশ গ্রামের মানুষ ভয় পায়। মানুষ না শুধু, ভূ*ত-প্রে*তও উনারে রাস্তা দিয়া দেখলে খাল বিল হাতড়ে পালায়। হেই ওস্তাদরে আপনে অপমান করতাছেন।’

– ‘তুমিও চুপ করো। টাকাটা দাদাভাইয়ের রুমেই আছে। আমি নিজেই চু*রি করেছিলাম। মানতের টাকা শুনে দিয়েই দিতাম। বাটি চালান হবে শুনে দেখার জন্য আর কাউকে কিছু বলিনি।’

মুজিব উদ্দিন হুস্নার শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘দেখলে তো বাবা, আমি চু*র না।’

– ‘চুপ কর নির্বোধের বাচ্চা। ফরিদ মাস্টারের ছেলে চো*র হবে কিভাবে? দেখ তোর মেয়ে ঠিকই চো*র হইছে।’

হুস্না বেগম মেয়ের দিকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

– ‘এখনই ঘরে আয় তুই।’

ইতি ভায়ার্ত মন নিয়ে মায়ের পিছু পিছু গেল। ফরিদ সাহেব সবাইকে বললেন, ‘আমার রুমে যাওয়া যাক, দেখি টাকা সত্যি আছে কি-না।’

সবাই উনার পিছু পিছু গেল। ফরিদ সাহেব পাঞ্জাবির পকেটগুলো খুঁজতে খুঁজতে তিন নাম্বার পাঞ্জাবিতে টাকাটা পেয়ে গেলেন। টাকা হাতে নিয়ে আহত চোখে কবিরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘আরে শ*য়তানের বাচ্চারা, তোরা তাহলে ভণ্ড?’

মুজিব উদ্দিন নাক টান দিয়ে বললো,

– ‘বাবা দরজা বন্ধ করে পুলিশকে খবর দিব না-কি?’

কবিরাজ তার লাল চাদর ঠিক করতে করতে রহস্য করে হেঁসে বললো,

– ‘শুনুন মুরব্বি। আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেন। ডাক্তার কি তার সব রোগীকে সুস্থ করতে পারে?’

সবাই মাথা নেড়ে বললো,

– ‘না।’

– ‘তখন কি তাদের ভণ্ড বইলা অপমান করেন? পুলিশে দিতে চান? তাইলে আমাদের বেলায় এরকম করেন কেন? আমরা কাজ করি যারা আমাদের বিশ্বাস করে তাদের নিয়ে। বিশ্বাসই আমাদের সম্বল। সব সময় রোগী সুস্থ হয় না, চু*রির মালও বের হয় না৷’

মুজিব উদ্দিন নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘বিশ্বাস করি বইলাই তো আনা হইছে। এখন ব্যখ্যা দেন টাকা ঘরে রাইখা তুলারাশি আমারে ধরলো কেন?’

কবিরাজ মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘দু’জনের ছয় হাজার টাকা দেন আমার হাতে।’

দুজন টাকা বাড়িয়ে দিল। কবিরাজ অন্যদিকে ফিরে টাকা এলোমেলো করে বললো,

– ‘এখন আপনারা পারবেন এই টাকা আলাদা করতে? কার কাছে কোন তিনটা নোট ছিল বলেন। পারবেন? সেম না টাকা?’

দু’জন মাথা নেড়ে বললেন,

– ‘না, পারবো না। একই রকম লাগে।’

কবিরাজ হেঁসে বললো,

– ‘ঘটনা হইছে গিয়ে এই জায়গায়। মানুষ হইছে সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের বুদ্ধির কাছে সবকিছুই ছাগলের বাচ্চা। আপনারাই টাকা আলাদা করতে পারেন নাই। তুলারাশি তো বিভ্রান্ত হইবই। শুরু থাইকাই হইছে বিভ্রান্ত। দুই জায়গায় সমপরিমাণ সেম টাকা থাকায় কোথায় যাইব কোথায় না বুঝতে পারছিল না। তাই সে প্রথমে বাইরে যেতে চাইছিল৷ চারদিকে ঘুরে-ফিরে চিন্তা করে আবার ফিরে আসতো বাড়িতে৷ কিন্তু আমরা ভুল-বুঝে তারে বারবার গেইটে আঁটকে দিছিলাম। এরপর যখন এই ভাই সাহেব পকেটে তিন হাজার টাকা নিয়ে কাছে আসছেন। সে ভাবছে এটাই হইতে পারে। সকলে বুঝলেন তো এবার? ভুল সবারই হয়। তুলারাশিরও হইছে। এখন আপনারা হাদিয়া দিবেন কি-না আপনাদের ব্যাপার। আমরা গেলাম। এই চলো।’

লতিফ আর ন্যাড়া মাথার লোক পিছু পিছু বের হলো। ফরিদ উদ্দিন পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘কিরে নির্বোধের বাচ্চা, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা ওদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় কর।’
মুজিব নাক টান দিয়ে সেদিকে চলে গেল।

ইতি বিছানায় বসে দুইহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। হুস্না বেগম আবার কপালে আঙুল দিয়ে ঠেলা দিয়ে বললেন,

– ‘কারবারি এদিকে থাকা। আমাকে বল তুই বড়ো হবি কবে? আজ কত বড়ো ঘটনা ঘটিয়েছিস বুঝতে পারছিস তুই? বল আমাকে, জবাব দে। চুপ করে থাকবি না।’

ইতি প্রতিবারের মতোই কোনো জবাব দেয় না। তিনি গালে মুঠো করে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠোকর দিয়ে বললেন,

– ‘বুঝিস তো সবই। তর্ক করার সময় তো দেখি খুবই যুক্তিবাদী হয়ে যাস। সব তো খেয়াল করি। তখন বুদ্ধি কোত্থেকে আসে? আর যখন ছেলেমানুষি করিস তখন বুদ্ধি কই থাকে? বল কথা বলিস না কেন?’

ইতি কোনো জবাব না দিয়ে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। ফরিদ সাহেব এসে ঢুকলেন রুমে। তারপর অবাক হয়ে বললেন,

– ‘আরে কাঁদছে কেন? কাঁদার কি হয়েছে। কি গো বউমা তুমি ওকে কি করছো? যাও তো, সরো এখান থেকে।’

হুস্না বেগম কোনো জবাব না দিয়ে হন-হন করে চলে গেলেন রান্নাঘরে। ফরিদ উদ্দিন ওর পাশে বসে চোখ মুছে দিতে দিতে বললেন,

– ‘কান্না বন্ধ কর তো ইতি। দাদার পকেট থেকে চু*রি করবি না তো কোথা থেকে করবি? তোর তো আর জামাই নাই।’

ইতি কাঁদতে কাঁদতে হেঁসে ফেললো। হুস্না বেগম দরজার কাছে এসে বললেন,

– ‘শুরু হয়ে গেছে দাদা-নাতনির পিরিত। এভাবেই ও আদর পেতে পেতে বাদর হয়েছে৷ কত বড়ো কাণ্ড করেছে সেদিকে খেয়াল নাই কারো।’

– ‘সবার বোধ-বুদ্ধি এক না বউমা। কেউ তাড়াতাড়ি বুঝে, কেউ দেরিতে। সেও একদিন দেখবা শান্ত হয়ে যাবে।’

– ‘আপনার কি মনে হয় ও বুঝে না? যখন ঝগড়া করে, তর্ক করে তখন দেইখো উদাহরণ আর যুক্তি দিয়ে মাস্টারনি হয়ে যায়। কিন্তু কাজের বেলায় বাচ্চামি। বুঝি তো, এগুলো ন্যাকামি করে৷ বুইড়া মাইয়া দিন দিন ন্যাকা হচ্ছে।’

ফরিদ সাহেব খ্যাকখ্যাক করে হেঁসে বললেন,

– ‘মেয়ে মানুষ একটু ন্যাকা তো হয়ই। তাই নারে বইন? পুরুষ মানুষ হবে ত্যাড়া, মাইয়া মানুষ ন্যাকা। এটাই জগতের নিয়ম।’

হুস্না বেগমের গা জ্বলে উঠলো। তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন। ফরিদ সাহেব ইতির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

– ‘কান্না বন্ধ করে পড়তে বস বইন। স্কুলে যাসনি বসে বসে পড়।’

ইতি সত্যি উঠে পড়ার টেবিলে বসে।

কল্পের কোচিং এর টাকা এসেছে। বড় মামা ফোন করে বলেছেন একটা বিকাশের দোকানে গিয়ে নাম্বার দিতে। ব্যাংক থেকে তিনি বের হয়েই বিকাশে ছেড়ে দেবেন। মামাকে নাম্বার দিয়ে সে এখন দোকানের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছে। আজকের অদ্ভুত মজার ঘটনাটা সুপ্তি আপুকে বলতে তার ভীষণ ইচ্ছা করছে। কিন্তু কল দিতে গিয়ে আবার আঁটকে গেল। মামা যদি কোনো কারণে কল দিয়ে ওয়েটিং এ পান তাহলে বেকুবের বাচ্চা বলে গালাগাল শুরু করবেন। সে চুপচাপ বসে রইল। প্রায় মিনিট তিরিশেক পর কল দিলেন বড় মামা। যে নাম্বার থেকে ছেড়েছেন সেটা বললেন তাকে। সে টাকা তুলে রুমে এলো। কল দিল মামীর ফোনে। ভালোমন্দ কথা হওয়ার পর সুপ্তির কাছে দিতে বললো। সুপ্তি মোবাইল কানে নিয়েই গাল ফুলিয়ে বললো,

– ‘কিরে হারামি আজ বুঝি আপুর কথা মনে পড়লো তোর? আর আমার বই কবে পাঠাবি?’

– ‘এক সঙ্গে দুইটা প্রশ্ন। থাক একটারও উত্তর দেবো না৷ আগে শুনো আজ এ বাড়িতে কত বড়ো কাণ্ড হয়েছে।’

– ‘কি হয়েছে।’

পুরো ঘটনা সে সুপ্তিকে বললো। সব শুনে সুপ্তি অনেক হাসলো। তারপর জিজ্ঞেস বললো,
– ‘মুজিব মামার মেয়ে লুকিয়ে ছিল টাকাটা?’

– ‘হ্যাঁ, ওরা ভাইবোন সব কয়টা পাজি।’

– ‘তুই কি খুব ভালো। এইতো যাওয়ার দিনই আমার টাকা চু*রি করেছিলি।’

– ‘এইটা ফেরত দিয়ে দিব বললাম না।’

– ‘আচ্ছা শোন, তোর চাচা এসেছেন দেশে জানিস তো।’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আব্বার কাছেও কল দিয়েছিলেন।’

– ‘ও আচ্ছা। নীলিমা, নিলয় ওরা কেমন আছে।’

– ‘ভালোই আছে।’

– ‘আর বই আমি পাঠিয়ে দেবো চিন্তা করো না। এখন রাখছি।’

আচ্ছা ঠিক আছে। ফোন রেখে সে পড়ার টেবিলে বসে গেল।

ইতি ছাদে এসেছে। পড়তে বসেছিল। তখন নীলা এসে মোবাইল হাতে দিয়ে বললো,

– ‘মালিহা কল দিয়েছে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে।’

ইতি মোবাইল হাতে নিল। মালিহা ‘হ্যালো, হ্যালো’ করছে। নীলা চলে যেতেই ইতি কল কেটে দিল। মিনিট খানেক যেতেই আবার কল দেয় মালিহা। ফোন হাতে নিয়েই তখন ছাদে আসে। রিং হতে হতেই কেটে যায়। ইতি বসে গিয়ে পিলারে। ডায়াল থেকে ওর নাম্বারে কল দিতেই রিসিভ করে মালিহা এলোপাথাড়ি বকা শুরু করলো,

– ‘এই খা*নকি ওই দিন তুই কল কেটে দিলি। আমি ব্যাক করলাম। এরপর মোবাইল অফ করে দিলি। আমি রাগ করে আর কল দিলাম না। কিন্তু তুই কি আর রাগ ভাঙানোর জন্য কল দিবি না?’

– ‘রাগ ভাঙাতে ইচ্ছা করেনি তাই কল দেইনি।’

– ‘ইচ্ছা করবে কিভাবে। বাড়িতেই তো এখন জামাই পেয়ে গেছিস খা*নকি। তুই আমারে ভাব দেখাস। বড়ো হয়ে গেছিস তাই না? দাঁড়া আমি কয়দিন পরই আসবো তোদের বাড়ি। তখন দেখবো কত বড়ো হইছে তোর বুকের***।”

ইতি ঠাণ্ডা গলায় বললো,

– ‘আপু ওইদিন ক্লাসে কি হয়েছে জানো?’

– ‘ক্লাসে আর কি এমন হবে? কোনো ছেলে কি কোনো মেয়েকে কিস করছে?’

– ‘না আগে শুনে নাও, কয়েকদিন আগে আমার এক বান্ধবীর কাছ থেকে লেসবিয়ান সম্পর্কে জানলাম। ওর এন্ড্রয়েড মোবাইল আছে তো। কোনো একজন স্যার ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেই আমরা গোল হয়ে ওর কাছে গল্প শুনি।
নতুন নতুন কত কিছু শিখি ওর কাছ থেকে। আমি লেসবিয়ান সম্পর্কে শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তোমার মুখটা ভেসে উঠায় ভাবলাম এরকম মানুষ থাকলে থাকতেও পারে।’

– ‘মানে কিরে খা*নকি? আমার মুখ কেন ভেসে উঠবে? তুই এগুলোও শিখে গেছিস। তোর ওই বান্ধবীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিস তো। দেখবো সে আর কি কি জানে৷ আমার থেকে কি বেশি জানে? তুই কি জানতে চাস আমাকে বল। দেখবি আমি সব জানি।’

– ‘না আপু শুনবো না। একটা দরকারি কথা বলবো।’

– ‘কি বলবি বল।’

– ‘আপু তুমি একটা লেসবিয়ান।’

কথাটা বলেই ইতি খিলখিল করে হেঁসে মোবাইল অফ করে দিল। দুপুরের মন খারাপ ভাবটা এখন আর নেই। ছাদে একা একা হাসতে হাসতে নিচে গেল। নীলা তাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,

– ‘এত হাসছো কেন ঘটনা কি?’

ইতি বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে হাসছে। খুব আনন্দ হচ্ছে। মালিহা আপু রাগে জ্বলবে। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ পাবে না। নীলা তাকে টেনে সোজা করতে করতে জসীমউদ্দিনের কবিতা বললো,
“এত হাসি কোথায় পেলে
এত কথার খলখলানি
কে দিয়েছে মুখটি ভরে
কোন বা গাঙের কলকলানি|”

ইতির মুখ লাল হয়ে গেছে হাসতে হাসতে। মালিহা আপু রাগ করবে৷ কিন্তু তাকে কিছু বলতে পারবে না। বারবার কল দিয়ে দেখবে মোবাইল অফ৷ মালিহা আপুর মুখটা যে কিরকম হবে কল্পনা করে ইতির ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। নীলা তাকে পেটে কাতুকুতু দিয়ে বললো,

– ‘বলো এত হাসার কারণ কি?’

– ‘তোমার মোবাইল অফ করেছি। এখন অন করো না৷ মালিহা আপুকে খুবই বাজে একটা কথা বলে অফ করে রেখেছি।’

– ‘কি বলেছো এমন? নিজেই হাসতে হাসতে লাল টমেটো হয়ে যাচ্ছ।’

– ‘জীবনেও তোমাকে বলা যাবে না৷ কারণ তুমি হলে আমার চাচি আম্মা।’

নীলা মুখ বাঁকিয়ে অস্ফুটে ‘ঢং’ বলে রান্নাঘরে চলে গেল।

ইতি আবার পড়ার টেবিলে বসে। মন খারাপ ভাবটা কেটে যাওয়ায় ভালোই লাগছে পড়তে।

মাগরিবের আজান হতে না হতেই বইপত্র নিয়ে বের হয়ে গেল ইতি। বারান্দা পেরিয়ে কল্পের দরজার সামনে যেতেই উচ্চ শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনে পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। কল্প খালি গায়ে বুকডন দিচ্ছে৷ ইতি প্রথমেই চোখ সরিয়ে নিল। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। শুকনো ঢোক গিলে আবার চোরা চোখে তাকায়। ফরসা ছিপছিপে শরীর ঘামে চিকচিক করছে। ঘর ভরে গেছে হাঁপানোর মৃদু শব্দে। খানিক পর উঠে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে গেল কল্প। ইতি বই হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। কল্প বের হয়ে শরীর মুছতে মুছতে গেঞ্জি পরছে। ইতি চোখ ফিরিয়ে নিল। গলা শুকিয়ে আসছে। পুরো শরীরে যেন বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। মানুষটাকে এত ভালো লাগে কেন কে জানে!
কল্প গেঞ্জি গায়ে দিয়ে পর্দার দিকে চোখ যেতেই মানুষের ছায়া দেখতে পেল। পর্দা সরিয়ে অবাক হয়ে বললো,

– ‘আরে তুমি কতক্ষণ থেকে এসেছো?’

ইতি নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

– ‘এইতো এখন।’

– ‘তাহলে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন।’

– ‘গেঞ্জি পরছিলেন তাই অপেক্ষা করছিলাম। তা এই সময়ে গোসল করলেন না-কি?’

কল্প চেয়ার টেনে বসে মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘তুমি আমাকে বুকডন দিতে দেখেছো তাই না?’

ইতি লজ্জা পেয়ে প্রথমে হাসলো। তারপর চোখে চোখে তাকিয়ে বললো,

– ‘অসময়ে বুকডন দেয়ার কারণ কি? আমাকে বডি দেখানোর জন্য না-কি।’

কল্প দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো,

– ‘এসব বাজে চিন্তা একদম করবে না। তুমি এত তাড়াতাড়ি আসবে ভাবিনি। আমার টেবিলে বসে কেমন ঘুম পাচ্ছিল। তাই বুকডন দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম। আর বুকডন আমি সব সময়ই দেই। খেলাধূলা কম করা হয় তো। বাইরে হাঁটাহাঁটিও কম। তাই বুকডনই একমাত্র ভরসা।’

– ‘ব্যায়াম না করলেই চলবে আপনার।’

– ‘কেন মোটা নই বলে? মানুষ কি শুধু চিকন হতে ব্যায়াম করে? সুস্থ থাকার জন্যও করতে হয়। এইযে পরিশ্রমে শ্বাস-প্রশ্বাস হয়। ঘামি। রক্ত চলাচল হয়। এগুলোও তো দরকার আছে।’

– ‘বাবা এত স্বাস্থ্য সচেতন।’

– ‘এসেই গল্প জুটিয়ে নিয়েছো। অংক দিয়েছিলাম দেখি।’

– ‘পারিনি।’

– ‘পারবে কিভাবে। সারাক্ষণ তো মাথায় শুধু দুষ্টামি ঘুরে। দেখি চেষ্টা করেছো কোথায়। দেখাও।’

– ‘চেষ্টাও করিনি ভাইজান।’

কল্প কঠিন মুখ করে তাকানোর চেষ্টা করলো। ইতি বই মুখের কাছে নিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘প্রায় সমবয়সী ছাত্রী৷ বয়সের অভাবে রাগটাও কর‍তে পারছেন না, তাই না?’

কল্পের চেহারাটা গম্ভীর করতেই পারলো না। হাসি চলে এলো। তারপর কাতর হয়েই বললো,

– ‘আচ্ছা ইতি এরকম করলে আমার কি করার থাকে বলো? তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?’

ইতি খাতা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতের কনুই টেবিলে ঠেকিয়ে হাতের তালুতে থুতনি রেখে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে বললো,

– ‘দুষ্টামি করলেও, আপনাকে কসম সাহায্য করবো।’

কল্প ওর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কেমন অদ্ভুত চোখের চাহনি। চুলগুলো কপাল বেয়ে সামনে এসে পড়েছে। সে কলমের মুখ লাগিয়ে খুলে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘এরকম করো না ইতি। আর কিসের সাহায্য করবে তুমি? আমি গতকাল বললাম না পারলে বুঝিয়ে দেবো৷ আজ তুমি স্কুলেও যাওনি৷ তবুও চেষ্টাটাও করোনি, কাজটা কি ঠিক করলে?’

ইতির খুব মায়া লাগছে ওর অসহায় মুখ দেখে। যদি সত্যি সত্যি অংক না করে আসতো। এই মুখ দেখে ইতির নিজেরই ভীষণ কষ্ট হতো। এখন হচ্ছে না। কারণ খাতাটা বাড়িয়ে দিলেই মানুষটা খুশি হয়ে যাবে। ইতি খাতা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘ স্যরি বাঁ হাত।’

– ‘কি এটা?’

– ‘রাগারাগি না করে আগে দেখুন ভাইয়া।’

কল্প অবাক হয়ে একবার খাতার দিকে আর একবার ইতির মুখের দিকে তাকাচ্ছে। খানিক পর ঝলমলে মুখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

– ‘আরে হয়েছে তো। পারলে কিভাবে?’

ইতি মুখ টিপে হেঁসে বললো,

– ‘ইতিকে এত অপদার্থ ভাবার দরকার নাই ভাইজান।’

– ‘সমাধান দেখে করোনি তো?’

– ‘সমাধান দেখে বুঝেছি, দেখে করিনি।’

– ‘এখন দিলে পারবে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আচ্ছা এই অংকটা করো।’

ইতি মিনিট খানেকের ভেতরে অংকটা করে খাতা বাড়িয়ে দিল। কল্প খাতা দেখে বললো,

– ‘মুখস্থ করোনি তো? মেয়েরা তো আবার মুখস্থ করার জন্য টান। অংক-টংক মুখস্থ করে ফেলে।’

– ‘এত অবিশ্বাস? আচ্ছা এবার কি বুঝিয়ে দিতে হবে আমার?’

– ‘না তা লাগবে না। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। ধন্যবাদ।’

– ‘ধন্যবাদ দেয়া লাগবে না। পুরুষ্কার হিসাবে গল্প করুন কিছু সময়। তাতেই হবে।’

কল্প মুচকি হেঁসে সারল্য গলায় বললো,

– ‘কি গল্প করবো? গল্প তো জানি না আমি।’

– ‘আচ্ছা আমার সঙ্গেই কথা বলুন।’

– ‘বলো কি কথা।’

– ‘আপনি ফেইসবুকে ঢুকেছেন এই দু’দিন?’

– ‘হ্যাঁ কিন্তু কেন?’

– ‘ফেইক নামের একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছিলাম৷ গ্রহণ করেননি কেন?’

– ‘আমি আসলে অপরিচিত কাউকেই ফ্রেন্ড বানাই না।’

– ‘এত ভাব কেন আপনার?’

কল্প হেঁসে ফেললো। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললো,

– ‘আসলে ভাব না। ফেইসবুক ইউটিউব এগুলোতে আমি আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঢুকলেই কিভাবে যেন দিন চলে যেত। ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা চলে যেত হঠাৎ মনে হতো এতক্ষণ কি করলাম আমি ফেইসবুকে? খুঁজেই পেতাম না কি করেছি। এরপর বুঝলাম আসলে ফেইসবুক নিউজফিড এমনভাবে সাজানো। তোমার সার্চ, লাইক এগুলো থেকে ফেইসবুক বুঝতে পারে পছন্দ কি। সেসবই নিউজফিডে পাঠায়। অনেক বেশি ফ্রেন্ড থাকায় নানান চমক জাতীয় জিনিস নিউজফিডে আসে আর আনমনে একটা থেকে আরেকটায় যাই আমরা। এরপর আমি ভাবলাম নতুন আইডি খুলে পরিচিতদের ফ্রেন্ড বানাবো। আর ফেইসবুকে যেহেতু আমার গল্প পড়ার অভ্যাস আছে৷ তাই পছন্দের কিছু লেখক-লেখিকাদের ফলো করে রেখেছি। তাদের গল্প সামনে এলে পড়ি। অথবা খুঁজে গিয়ে টাইমলাইন ভিজিট করি। কিছু নিউজ সাইট আছে ফলো করা। সেগুলো থেকে নিউজ পাই। এভাবে সবকিছু সীমিত করে রেখেছি। জানো তো মানুষের এটেনশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবাই আমাদের এটেনশন চায়। চারদিকে এটেনশন দেওয়া ক্ষতিকর। আমরা যখন অনেকগুলো নাটক মুভি পাই তখন কিন্তু একটাও ভালো লাগে না৷ কোনটা রেখে কোনটা পড়বো এগুলো নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে অনেক সময় কেটে যায়। এরপর এটার অর্ধেক, ওইটার অর্ধেক দেখি। তাই সবকিছু সীমিত ভালো। আমাকে জানতে হবে কার নাটক, কার মুভি ভালো লাগে। কার গল্প, কার উপন্যাস, কার কবিতা ভালো লাগে। সেটা দেখবো মানে পুরোটাই দেখবো। তাকে দরকার হয় খুঁজে নিব। এভাবে আমি ফেইসবুকটাকে সীমিত করে নিয়েছি। অপরিচিত কাউকে বন্ধু বানাই না। যাকে-তাকে ফলো দিয়েও রাখি না।’

ইতি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অস্ফুটে বললো,

– ‘আপনি আসলেই একটা ভাবের দোকানদার।’

– ‘কি বললে শুনিনি।’

– ‘কিছু না।’

– ‘অশ্লীল কোনো গালি-টালি কিছু দিয়েছো মনে হলো।’

ইতি দুই হাতে মুখ ঢেকে খিলখিল করে হেঁসে উঠলো।

__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here