মায়াডোর-১১,১২

0
251

মায়াডোর-১১,১২

(১১ পর্ব)
.
ইতির দিনকাল এভাবেই কাটছিল৷ ব্যতিক্রম যা ছিল, তা হলো পড়ালেখায় প্রবল মনযোগ৷ চঞ্চলতা, দুরন্তপনা একটুও কমেনি।
পড়াতে গিয়ে স্যার-ছাত্রীর সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা কল্পের জন্য ছিল প্রায় যুদ্ধের মতো। অন্যদিকে নিজের পড়ালেখা, কোচিং সহ সবকিছু ঠিকঠাক মতো চালিয়ে গেছে সে। মেধা, চেষ্টা আর ভাগ্যগুণে সাস্টে পরীক্ষা দিয়েই চান্স পেয়ে যায়। চারদিক থেকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসে সে। ইতিদের বাড়িতে রীতিমতো হিরো। ফরিদ সাহেব কল্প বলতেই অজ্ঞান। কথায় কথায় বাড়িতে তার উদাহরণ টানেন। ততদিনে সেও এ বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছে। ইতির সঙ্গে পড়তে আসে মিলন আর নিয়নও। পরিবারটির সাথে এতটাই মিশে গেছে যে, তার নিজের কাছেও এই পরিবারের মায়া কাটিয়ে ভার্সিটি হোস্টেলে যাওয়াটাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদিকে ইতি দিনকে দিন প্রবল প্রেমের সাগরে তলিয়ে গেলেও কল্পকে বলতে পারে না। প্রকাশ যা পায় তা কেবলই ভালোবাসার মানুষকে যন্ত্রণা, জ্বালাতন ছাড়া কিছুই নয়। ধীরে ধীরে পড়ালেখারও চাপ বাড়ে। টেস্টেও মোটামুটি ভালো রেজাল্ট হয়। কিন্তু আজ হচ্ছে ইতির বাঁধ ভাঙার দিন৷ ভেতরের সব কথা বলে ফেলার মোক্ষম সময় এসেছে। কারণ আজ ইতির এসএসসি ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে সে জিপিএ ফোর পয়েন্ট সেভেন সিক্স পেয়েছে। বাড়ির সবাই প্রচণ্ড খুশি। খুশি কল্পও। এখন সন্ধ্যা। ইতি শাড়ি পরেছে। হাতে নীল চুড়ি। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। এক হাতে একটা ভ্যানিটিব্যাগ আর কাপড়ের ব্যাগ। গুটি-গুটি পায়ে কল্পের রুমের সামনে এসেছে৷ পর্দা ফাঁক করে বললো,

– ‘আমি কি আসতে পারি স্যার, ভাইয়া, ভাইজান, ভাবের দোকানদার।’

কল্প হাসতে হাসতে বললো,

– ‘আসো, আজ কি তোমার জন্য কোনো দরজা বন্ধ থাকবে? তুমি তো ইতোমধ্যে বিশ্ব জয় করেই ফেলেছো।’

ইতি ভেতরে গেল। কল্প তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললো,

– ‘তুমি আসলেই বড়ো হয়ে গেছো। তা অসময়ে এত সাজগোজ কেন?’

চেয়ার টেনে বসে ইতি। তারপর কাপড়ের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে আদেশের মতো বলে,

– ‘পাঞ্জাবিটা পরেন।’

– ‘কিসের পাঞ্জাবি? আর এখনই পরতে হবে কেন?’

– ‘পাঞ্জাবি আমার থেকে গিফট। এইযে পরীক্ষায় আমার মতো গাধা ছাত্রী পাস করলো সেই উল্লাসে।’

– ‘গাধা না, তুমি পড়ালেখায় মনযোগী ছিলে না বলেই এমন ছিলে।

– ‘আচ্ছা হইছে, এখন চট করে পাঞ্জাবি পরেন, বাইরে যাব।’

– ‘বাইরে, এখন?’

– ‘হ্যাঁ, সন্ধ্যায় বাইরে যাওয়া কোনো অষ্টম আশ্চর্যের মতো কিছু না।’

– ‘কিন্তু তোমার সামনে পাঞ্জাবি পরবো কিভাবে?’

– ‘মহিলাদের মতো কথা বলেন কেন? পরলে সমস্যা কি?’

– ‘গেঞ্জি খুলতে হবে তো।’

– ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি করেন, আমি বারান্দায় আছি।’

ইতি বারান্দায় চলে গেল। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশে তাকায়৷ সন্ধ্যার আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলছে। আজ সে কোনো দ্বিধা বা শঙ্কাকে প্রশ্রয় দেবে না৷ আজ মন খুলে সব কথা বলে ফেলার দিন৷ পিছু ফিরে বললো,

– ‘আপনার কি শেষ হয়েছে?’

কল্প ভেতর থেকে বললো,

– ‘হ্যাঁ।’

ইতি ভেতরে এসে খানিকক্ষণ তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল। নীল পাঞ্জাবিতে বেশ মানিয়েছে কল্পকে।

‘কি দেখছো এমন করে?’ কথাটি বলে কল্প উল্টো হাতে পাঞ্জাবির কাঁধের স্টিকার খোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু মুঠোয় কাগজ ছিঁড়ে এলেও প্লাস্টিকের সেই আংটা রয়ে গেছে। ঘাড়ে খোঁচা লাগায় টেনে ছিঁড়তে গিয়েও পারলো না সে৷ ইতি আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘পরার আগে খুলতে পারলেন না?’

– ‘খেয়ালই ছিল না।’

– ‘আমি হেল্প করি?’

– ‘আচ্ছা দেখো তো।’

কল্পের চেয়ারায় কেমন শিশুসুলভ ভাব ফুটে উঠেছে। তাকিয়ে ইতির ভীষণ মায়া লাগে। বিমূঢ় হয়ে কল্পের হাতটা ধরে ফেললো। যেন সামনে দাঁড়ানো মানুষটি তার ভীষণ আপন, ব্যক্তিগত কেউ। তারপর টেনে নিয়ে বললো,

– ‘চেয়ারে বসুন। আপনি যা লম্বা নাগালই পাব না হয়তো।’

কল্প স্মিত হেঁসে চেয়ারে বসলো। ইতি আঙুল দিয়ে পাঞ্জাবির কলার উলটে ধীরে ধীরে মাথা নুইয়ে একেবারে কাঁধে নামিয়ে আনলো। কল্প অবাক হয়ে বললো,

– ‘আরে কাঁচি আনলেই হতো।’

ইতি এ কথার জবাব দিতে পারে না। সে কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। বাঁ হাত রেখেছে কল্পের কাঁধে। চুলগুলো ওর ওপর গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতি প্লাস্টিকের আংটায় দাঁত রাখলো। নাক লেগে আছে কল্পের ঘাড়ে। পুরুষালি একটা মাতাল ঘ্রাণ ভেতরে গিয়ে যেন রক্তে ঝংকার তুলে ফেলেছে। অনুভূতিগুলোতে আলোড়ন উঠেছে। বুকে শিরশির করে। চোখ ঘোরলাগা আবেশ। খানিক্ষণ এভাবেই রইল। বুকের ভেতর এত প্রেম নিয়ে আংটায় হিংস্র দাঁত চালাতে যেন মন সায় দেয় না। কল্প তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘আরে এতক্ষণ লাগে না-কি? এদিকে তোমার চুলের ঘ্রাণে আমার ঘুম এসে যাবে মনে হচ্ছে।’

ইতি খিলখিল করে হেঁসে মাথা তুলে ফেললো। কল্প উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বললো,

– ‘আরে আবার খোঁচা লাগছে তো।’

ইতি মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,

– ‘ছিঁড়তে পারিনি। আপনি তো তার আগেই হাসিয়ে ফেলেছেন।’

– ‘যাও তো কাঁচি নিয়ে আসো।’

– ‘এই সামান্য কাজের জন্য এখন গিয়ে কাঁচি নিয়ে আসতে পারবো না। আপনি আবার বসুন। কেটে দিচ্ছি।’

কল্প ওর দিকে তাকিয়ে বসে গেল। ইতি পুনরায় মাথা নুইয়ে দাঁত দিয়ে কেটে দিল স্টিকারের আংটা। কল্প উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল চালিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিল। ইতি কেমন একটা ঘোর লাগা পুরুষালি গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশ সামনে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে যদি ওর চুলগুলো ঠিক করে দিতে পারতো? এতদিন হয়ে গেল মানুষটা কি কিছুই বুঝে না? একটু নিজ থেকেই তো কিছু বলতে পারে।

– ‘চলো এবার যাই।’

ইতি ভাবনা থেকে বের হয়ে ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ চলুন।’

কল্প উঠানে এসে বললো,

– ‘কি হলো আর কেউ নাই?’

– ‘আর কে থাকবে?’

কল্প অবাক হয়ে গেইটের বাইরে এসে বললো,

– ‘আমি কিন্তু ভেবেছিলাম তোমার রেজাল্ট বের হয়েছে৷ হয়তো নীলা আন্টিকে নিয়ে বাইরে যাবে, ঘুরবে। আমাকেও সঙ্গে নিচ্ছ।’

– ‘না শুধু আমরা দু’জনই।’

– ‘সত্যি করে বলো তো বাড়িতে কি বলেছো? সন্ধ্যা রাতে এরকম সাজগোজ করে আমার সঙ্গে একা বের হতে দিয়ে দিলেন?’

ইতি মুখ টিপে হেঁসে বললো,

– ‘রিকশায় উঠে বলবো।’

– ‘কেন?’

– ‘এমনিই।’

তারপর একটা রিকশা ডেকে দাঁড় করিয়ে ইতি বললো, ‘উঠুন।’

কল্প ইতি-উতি করে উঠে বসলো। ইতি ডান পা বাড়িয়ে এক হাত সিটে দিয়ে বললো,

– ‘শাড়ি পরেছি তো তাই আমার উঠতে অসুবিধা হচ্ছে। একটু হাতটা ধরেন না।’

কল্প বিব্রত ভঙ্গিতে ওর হাতটা শক্ত করে ধরলো। কোমল নরম হাত। যেন মুঠোয় নিয়ে চেপে ধরলেই ভেঙে যাবে৷ ইতি পাশে এসে বসে তাকিয়ে বললো,

– ‘থ্যাংক ইউ ভাইজান।’

কল্প মুচকি হেঁসে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘তুমি খুব সুবিধাজনক অবস্থায় আছো। ইচ্ছা হলে স্যার, আবার ভাইজান, একবার ভাইয়া।’

ইতিও হাসলো। তারপর ফিসফিস করে বললো,

– ‘পড়ে যাবেন। আরেকটু কাছে এসে বসুন।’

কল্প ওর দিকে খানিক নিবিড় হয়ে বসে। রিকশা চলছে৷ চারদিকে গাড়ি যাচ্ছে, আসছে। শহরের কৃত্রিম আলোয় রাস্তাঘাট ভেসে যাচ্ছে। আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারা। রিকশার টুংটাং শব্দ। ইতি বারবার পাশের মানুষটার দিকে তাকাচ্ছে। যদি ও পেছন দিকে হাতটা নিয়ে একটু ধরে বসতো? কবে ধরবে? কখন তাদের এমন একটা সম্পর্ক হবে। এরকম সন্ধ্যায় হাত ধরে রিকশায় বসবে। নিরিবিলি কোথাও হাত ধরে হাঁটবে। ইতি মাথা ঘুরিয়ে কল্পের দিকে আবার তাকায়। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে মানুষটা। কিন্তু ইতির দৃষ্টি লক্ষ্য করে ফিরিয়ে আনলো চোখ।

– ‘কি দেখছো এমন করে?’

ইতি চোখে চোখ রেখে বলে ফেললো,

– ‘আপনাকে।’

কল্প ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘সারাক্ষণ শুধু ফাজলামি।’

– ‘ফাজলামো না, আজ আপনাকে সত্যিই অনেক সুন্দর লাগছে।’

– ‘ও হ্যাঁ, পাঞ্জাবিটা অনেক পছন্দ হয়েছে, ধন্যবাদ।’

ইতি চোখ ফিরিয়ে নিল। কল্প তারপর বললো,

– ‘এবার বলো কি বলে এসেছো? কারও বাসায় যাবে বা এরকম কিছু?’

ইতি মুখ টিপে হেঁসে বললো,

– ‘বলেছি রেজাল্ট বের হওয়ায় সন্ধ্যায় বান্ধবীরা একটা রেস্টুরেন্টে মিলবো।’

– ‘আম্মু বললো একা যাবি না-কি?’

– ‘আমি বললাম কল্প ভাইয়াকে তাহলে নিয়ে যাই। মা তাতে রাজি হয়ে গেল৷ ব্যস।’

কল্প আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘তাহলে আমি এখন একদল মেয়েদের কাছে যাচ্ছি? একা একা খুবই নার্ভাস হব।’

ইতি মুখ টিপে হেঁসে বললো,

– ‘আপনি একদল মেয়েদের কাছে যাচ্ছেন না। ওদের কথা মিথ্যে বলেছি। শুধু আমরা দু’জনই একটা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি। অসম্ভব সুন্দর মনোরম পরিবেশ। খাব আর দু’জন অনেক্ষণ বসে গল্প করবো।’

কল্প বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললো,

– ‘তোমার কি মাথা খারাপ! মিথ্যে বলে আমাকে নিয়ে বের হয়েছো কেন? আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল। এখন ওরা যদি এগুলো জানে কি মনে করবে তুমি জানো?’

– ‘আরে ধুরো, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? সিম্পল একটা বিষয়।’

– ‘সিম্পল মানে? তুমি জাস্ট আমার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয়ার জন্য সন্ধ্যা-রাতে মিথ্যে বলে বের হয়েছো এটা কেমন কথা? আমাদের কি কোনো গোপন সম্পর্ক চলছে?’

ইতি আহত নয়নে তাকায়। তারপর ব্যগ্র গলায় হাত ধরে বলে,

– ‘প্লিজ শান্ত হন। আপনার সঙ্গে আমার আজ কিছু কথা আছে তাই নিয়ে যাচ্ছি।’

কল্প এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

– ‘তোমার মাথা খারাপ। কথা বলতে এভাবে আমাকে পাঞ্জাবি পরিয়ে, নিজে শাড়ি পরে বের হতে হয়? আমি তো প্রথমে ফ্যামিলি সহ কোনো প্রোগ্রাম ভেবে পরেছি। না হলে তোমার মতো পাগল না আমি।’

– ‘আচ্ছা এখন তো বের হয়ে গেছি। আর রাগ করে কি হবে। বাদ দিন।’

– ‘দেখো ইতি। আজ তোমার রেজাল্ট বের হয়েছে। ভালো রেজাল্ট হওয়ায় আমি অনেক খুশি হয়েছি। বাজে কিছু বলে তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। এখনই বাড়িতে চলো।’

– ‘না আমি এখন আর ফিরবো।’

– ‘ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি মামা রিকশ রাখেন।’

রিকশা থামতেই কল্প নেমে গেল। ইতি রিকশা থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ ভরে এসেছে জলে। ভ্যানিটিব্যাগে একটা ছোট্ট কাগজ। সেখানে সব কথা লেখা আছে। ভেবেছিল মুখে বলতে লজ্জা লাগবে। তাই রেস্টুরেন্টে কাগজ হাতে দিয়ে সামনে বসে থাকবে মানুষটার। ইতি ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে ছলছল চোখে তাকায়,

‘প্রিয় ভাবের দোকানদার
একটু ভাব কমিয়ে কোমল চোখে সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকান। দেখেছেন শাড়ি পরে আপনার সামনে একটা মেয়ে বসে আছে? জানেন মেয়েটা খুবই নির্লজ্জ, বেহায়া। আপনাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে৷ মেয়ে মানুষ হয়েও প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে এসেছে ভালোবাসার কথা বলবে বলে। তাকে দেখে হাসিখুশি লাগছে না? অথচ সে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। এইযে চিঠি পড়ছেন। সে সামনে বসে আছে। তার বুকের ভেতর যে কি ভীষণ তোলপাড় হচ্ছে আপনি জানেন না। নির্লজ্জ এই মেয়েটির হাতটা একবার ধরবেন প্লিজ? দেখুন নিল চুড়ি পরেছে৷ আপনি হাতটা ধরলে একটা শব্দ হবে। এই শব্দ আজীবন আমার কাছে হয়ে থাকবে প্রিয় সংগীত। প্লিজ হাতটা ধরুন। আর কিছুই লাগবে না। আমি বুঝে নিব এই পৃথিবীটা আমার স্বর্গ হয়ে গেছে। আপনাকে পাওয়ার থেকে আমার কাছে এই পৃথিবীতে আর কোনোকিছুই বড়ো নয়। আপনাকে আমার এত ভালো লাগে কেন বলুন তো? কোনো তন্ত্র-মন্ত্র কি আপনি জানেন?
কসম, আমি ঠিকঠাক মতো পড়ালেখা করবো। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবে চলবো, শুধু অনার্স শেষ করে একটা চাকুরি পেলেই বিয়ে করে নিবেন আমায়। নির্লজ্জ মনে হচ্ছে না? একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে বলতে পারলো…।
জানি না কিভাবে বললাম। আমার ভীষণ ইচ্ছা করে আপনাকে ভালোবাসতে। আপনার সামান্য চুলে হাত দেওয়ার আমার কত লোভ। এগুলো কিভাবে পূর্ণ হবে বলুন। তাই বিয়ের কথা বলেছি।
আচ্ছা দেরি করছেন কেন? হাতটা ধরেও তো চিঠি পড়া যায়, যায় না বলো?
আমার খুব ভয় করছে। এই দেখো লিখতে গিয়েও আমি যেন মাতাল হয়ে গেছি। প্রথমে বললাম সামনে একটি মেয়ে বসে আছে। অথচ কখন যে আবার ‘আমি আমি’ বলা শুরু করেছি নিজেই জানি না। জানেন, আপনার কথা ভাবলেই আমি এরকম মাতাল হয়ে যাই। আপনি আমার নেশা হয়ে যাচ্ছেন না তো? হলে, হবেন। পুরো জীবনভর আপনাকে পান করতে করতে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো।

ইতি
একটা নির্লজ্জ মেয়ে (শুনুন মিস্টার, এই “ইতি” মানে আমার নাম না। চিঠির শেষের “ইতি” এটা)

চিঠির দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে সে। দু’ফোঁটা জল গাল বেয়ে আসার আগেই মুছে নিয়ে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে কল্প অনেকদূর চলে গেছে।
চিঠিটা ইতি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল রাস্তায়।

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

মায়াডোর (১২ পর্ব)
.
ইতি বাড়িতে ফিরে মন খারাপ করে শুয়ে রইল। হুস্না বেগম ডেকে তুলে খাওয়াতে পারলেন না। ভাবলেন হয়তো বান্ধবীদের সঙ্গে রাগারাগি করে ফিরেছে। রাতে তিনি স্বামীকে বললেন,

– ‘ইতির তো এখন ছুটি। কিছুদিন ওর নানাবাড়ি থেকে ঘুরে আসলে ভালো হতো না?’

মুজিব উদ্দিন নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘তুমি যেতে চাইলেও যাও। কয়েকদিন থেকে ইতিকে রেখে চলে আসবে।’

হুস্না বেগম ভীষণ খুশি হলেন। এটাই চেয়েছিলেন তিনি। তারপর আমতা-আমতা করে বললেন,

– ‘তুমিও আসো, এক রাত থেকে চলে আসবে।’

– ‘না আমি পারবো না। গাড়িতে তুলে দেবো। তোমরা চলে যাবে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

ভোরে ইতিকে জানালেন হুস্না বেগম। ইতি খুশিই হলো শুনে। অনেকদিন হয়েছে যাওয়া হয়নি। মামাতো বোন তানিয়ার সঙ্গে ওর মিলে ভালো। সেও এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবার। দুপুরেই তারা বের হয়ে গেল। মুজিব উদ্দিন গাড়িতে তুলে দিলেন। হুস্না বেগমের ভাই রিসিভ করবেন তাদের। কল্পকে কিছুদিন দেখতে পারবে না ভেবে ইতির কষ্ট হচ্ছিল। সেই কষ্টের প্রতিই যেন ইতির প্রচণ্ড ক্রোধ জন্মে গেল। যে মানুষটা তাকে একটুও বুঝে না। বুঝতে চায় ও না৷ তারজন্য কেন এই বেহায়া মন কষ্ট পাবে? এই কষ্টকেই যেন সে শাস্তি দেবার পণ করল। যাওয়ার আগে তাই কল্পের সঙ্গে দেখা করেও এলো না। বাসে তার পাশে নিয়ন আর মায়ের পাশে মিলন বসেছে। ইতি বাইরে তাকিয়ে আছে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। তবুও কিছু করার নেই। হয়তো গতকাল মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলার সুযোগ হয়নি৷ কিন্তু তার আগ্রহ কি কল্প ভাইয়া জানেন না? পড়তে গিয়ে কি সেরকম কোনো ইঙ্গিত সে দেয়নি? কত পাগলামিই তো করেছে। সেগুলোতে কি ভালোবাসা প্রকাশ পায়নি? প্রায়ই পড়ার টেবিলে বসে ইতি ইচ্ছা করেই কলম ফেলে দিতো নিচে। তারপর তুলতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে কল্পের পায়ের পাতা দেখতো। চেয়ারে বসে থাকায় ওর জিন্স প্যান্ট এতটাই টানটান হয়ে থাকতো যে পুরুষালি সুঠাম দু’টো উরু আরও বেশি আকর্ষণীয় মনে হতো। একদিন ভীষণ ইচ্ছা করেছিল ওর পা ছুঁয়ে দিতে। ইতি ওর পায়ের পাতায় আলগোছে নিজের পা রেখে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কেমন ভালো লাগার আবেশে চোখবুজে এলো।
তখনই কল্প ধমক দিয়ে বললো, ‘এটা কি হলো? কোথায় পা রেখেছো?’

ইতি কাতর চেহারায় বললো, ‘স্যরি বুঝতে পারিনি পায়ে রেখেছি।’

তারপর টেবিলের নিচে মাথা নিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে উঠে বললো, ‘এবার হয়েছে তো?’

কল্প বিভ্রান্ত হয়ে বললো,

– ‘বুঝতে পারছি না ঠিক হলো কি-না। যাইহোক পড়ো।’

এইযে এতকিছু করেছে সে এগুলো থেকে কি কল্প ভাইয়া কিছুই বুঝতে পারেনি? আর কত নিজেকে ছোট করলে বুঝবে? আর কত সস্তা হলে বুঝবে? আর কত বেহায়া হলে বুঝবে? তবুও তো কত শখ করে, বিশেষ একটা দিনে দেখে, আয়োজন করে গতকাল বের হয়েছিল মনের কথাগুলো ক্লিয়ার বলে দেয়ার জন্য। সেই সুযোগটাও দিল না। রাতে রিকশায় তাকে একা ফেলে চলে এলো বাসায়। বাসের কেউ দেখে ফেলার আগে ইতি টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে নিল।

নানাবাড়ি বেশ ভালোই দিন কাটছিল ইতির। হুস্না বেগম তাকে রেখে দু’দিন পর চলে এলেন বাড়িতে৷ নিয়ন, মিলনের স্কুল আছে। ইতি একা একা নিজেকে ধরে-বেঁধে এক সপ্তাহ থেকে গেল। কিন্তু তানিয়া প্রতিটি রাতে ওর মুখে কল্পের গল্প শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে যায়। একদিন ইতিকে ধরে বললো,

– ‘শোন ইতি, কল্প ভাইয়া হয়তো তোর ভালোবাসার কথা জানে না। অথবা বুঝতে পারেনি। আমি প্রেম করিনি তাই জানি না ছেলেদের ব্যাপারে। তবে মানুষ হিসাবে যতটুকু বুঝি ছেলেরা মেয়েদের মতো সবকিছু এত খেয়াল করে চলে না। গিয়ে দেখ ভাবছে তুই এরকমই। এমনিতেই এরকম করিস ওর সঙ্গে। তুই এভাবে অভিমান করে থেকে লাভ নাই। সারাক্ষণ ওর কথাই তোর মুখে। কল্প তোর রক্তে মিশে গেছে। তাই হয় ওকে বলে ফেল ভালোবাসার কথা। আর না হয় যেহেতু তোদের বাড়িতেই আছে। ধীরে ধীরে ওর পছন্দমতো চলাফেরা কর। তারপর একদিন বলে দে। তুই দেখতে এত সুন্দর যে, যেকোনো ছেলেরই মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। কল্প ভাইয়ারও হবে৷ বলে দে, অথবা লেগে থাক৷ বাড়িতেই চলে যা।’

ইতি যেন তানিয়ার কথায় উজ্জীবিত হলো। এমনিতেই এক সপ্তাহ চলে যাওয়ায় অভিমানের পাহাড়ও ধীরে ধীরে বরফের মতো গলে গেছে। ক্রমশই কল্পকে দেখার জন্য মন ছটফট করছিল। তাই ভোরেই বাবাকে ফোন দিয়ে জানায় এসে নিয়ে যেতে। সেদিনই মুজিব উদ্দিন নিতে আসেন। পরেরদিন তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেন। তানিয়ার কথা মতো পুনরায় নতুন উদ্দামে সে কল্পের পেছনে লাগবে। বাড়িতে এসে উঠে করিডরে এসে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো নীলা আন্টির কাণ্ড দেখে। দুপুরে ফরিদ সাহেব চা খেতে চাইছিলেন। নীলা চা নিয়ে যাবে তখনই ইতিকে দেখে কাপ মেঝেতে রেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। পুরো মুখে চুমু খেতে খেতে কেঁদে দিল। ইতি হাসতে হাসতে বললো,

– ‘আরে কি হয়েছে তোমার?’

– ‘তুমি আজ আসবে জানতাম না তো।’

– ‘কেন বাবা যাচ্ছেন জানো না?’

– ‘না, তুমি এসেছো কি যে আনন্দ লাগছে। খুবই একা একা লেগেছে এতদিন৷ দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।’

ইতি মুচকি হেঁসে জড়িয়ে ধরলো নীলাকে।

– ‘চাঁদনি রাত আছে বুঝলে ইতি। ছাদে বসে আজ অনেক গান শুনাবো তোমাকে।’

– ‘গান না-কি চাচ্চুর গল্প জমে গেছে?’

নীলা লজ্জা পেয়ে বললো,

– ‘চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে আব্বুকে চা দিয়ে আসি।’

নীলা ছুটে চলে গেল। ইতি ঘরে গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করা শেষে কল্পের রুমের দিকে গেল। গিয়ে দেখে ভেতরে কেউ নেই। মনে পড়লো ভার্সিটিতে গেছে। পুরোটা দিন মনে মনে অপেক্ষা করলো। কল্প ফিরে এলো সন্ধ্যায়। ইতি নীলার কাছ থেকে জানলো ভার্সিটি শেষে এখন টিউশনি করায় কল্প। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে। কথামতো রাতের খাবার শেষে নীলা আর ইতি ছাদে গেল। চাঁদ তখন সামনের একটা উঁচু ভবনের উপরে উঠে গেছে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। আমগাছের ছায়া পড়েছে উঠানে। ইতি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এখনও সে যায়নি কল্পের রুমে। খাওয়ার সময়ও সামনে আসেনি। ভেবেছিল ডাকবে তাকে। কিন্তু ডাকেনি কল্প। আচ্ছা এইযে বাইরে জোছনায় চারপাশ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটার কি দেখতে ইচ্ছা করে না? মন উথাল-পাতাল করা এই জোছনার রাতে পড়ার টেবিলে বসে আছে কিভাবে!

মাদুরিতে বসে আছে নীলা।
গুনগুন করে সে চোখবুজে রবীন্দ্র সংগীত গাইছে,

“নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে….”

ইতি পিছু ফিরে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে যায়। দরজায় নক না করেই ঢুকে পড়ে। কল্প পড়ার টেবিলে বসা। ইতিকে দেখেই বললো,

– ‘কি খবর ইতি। তুমি এসেছো শুনেছি, বসো।’

ইতি আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘ছাদে চলুন। সেখানে গিয়ে গল্প করি।’

– ‘কি বলো এসব, রাতের বেলা ছাদে কেন যাবে?’

– ‘রাত মানে? চাঁদনি রাত। জানালা খুলে তাকিয়ে দেখুন দিনের মতো আলো।’

– ‘জানালা খুললে মশা আসবে। চাঁদনি রাত আমি জানি। তাতে কি হয়েছে?’

– ‘আপনি ঘরে বসে থাকবেন?’

– ‘তো বাইরে বসার কি আছে৷ চাঁদনি রাত কি আশ্চর্যের কিছু। মাসে পনেরো দিনই তো থাকে।’

– ‘এতদিন পর আসলাম। আপনার ইচ্ছা করছে না আমার সঙ্গে গল্প করতে?’

– ‘তাইতো বলেছি বসো। গল্প করি। তাছাড়া এসেছো যেহেতু এখন তো রোজই দেখা হবে। উদযাপন করার মতো তো কিছু হয়নি।’

ইতি দরজা ‘ঠাস’ করে লাগিয়ে আবার ছাদে চলে গেল। নীলা এখনও বসে বসে গুনগুন করছে,
“দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে,
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে ॥
বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী–
এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয়মাঝারে…..।”

ইতি গিয়ে নীলার কোলে মাথা রাখে। খানিকক্ষণ এভাবে শুয়ে থেকে বলে,

– ‘নীলা আন্টি, তুমি চাচ্চুকে ভীষণ মিস করো তাই না?’

নীলা গান বন্ধ করে বললো,

– ‘কেন?’

– ‘গান গাওয়ার সময় প্রায়ই তোমার চোখে পানি আসে। তখন সুর আরও বেশি করুণ হয়ে যায়।’

নীলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতির মাথায় হাত বুলায়। ওর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের সঙ্গেই থাকতো। কিন্তু ভাবি বিশেষ সুবিধার ছিলেন না। বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে তাদের আলাদা সংসার। সে এসএসসি দিতেই বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে ওরা। এদিকে ইতির চাচ্চু মুকিদ উদ্দিন অনার্সে পড়ে৷ বেকার। বয়স কম। সব মিলিয়ে তাকে বিয়ে করা অসম্ভব। কিছুদিন পর আবার তার মাথায় ভূত চাপে কয়েক দেশ হয়ে দালালদের মাধ্যমে ইতালি যাবে। তাইই করলো সে। তখনও মুকিদ ইতালি যায়নি৷ গ্রিস ছিল। যাওয়ার চেষ্টায় আছে। মানসিক অবস্থা ভালো নয়। এদিকে নীলা ভাবির যন্ত্রণা আর বিয়ের চাপ নিতে না পেরে একদিন সোজা চলে আসে এ বাড়িতে। সবকিছু খুলে বলে ফরিদ সাহেবকে। মুকিদ কিছুই জানে না। এ বাড়ির মানুষগুলো তাকে অবাক করে দিয়ে সাদরে গ্রহণ করে নিল। মুকিদকে ফোন করে ধমকালেন ফরিদ সাহেব। সে কেন এই অবস্থায় মেয়েটিকে রেখে বিয়ে না করেই চলে গেল। এ বাড়িতে এত মানুষ থাকতে পারলে, খেতে পারলে, নীলা কি পারতো না? ক’দিনের ভেতরেই ফোনে বিয়ে দেন তাদের। এরপর থেকেই এ বাড়িতে আছে নীলা৷ কিন্তু সমস্যা হলো মুকিদ দেশে আসতে পারছে না। ইতালিয়ান কার্ড না পেয়ে আসা যাবে না। আরও কয় বছর এভাবে অপেক্ষায় থাকতে হবে নীলা জানে না। মুকিদও জানে না।

– ‘আন্টি গান গাও।’

– ‘ভালো লাগছে না ইতি।’

– ‘গাইলে ভালো লাগবে। ওইযে নজরুল সংগীত একটা গাও তুমি। আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়। ওইটা গাও।’

নীলা চোখবুজে গাইতে শুরু করে,

“আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়
আমার কথার ফুল গো
আমার গানের মালা গো
কুড়িয়ে তুমি নিও
আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়….।”

ছাদে কারও পদশব্দ পেয়ে নীলা চুপ হয়ে যায়। রাতের নীরবতা নেমে আসে ছাদে। একদল জোনাকিপোকা ঝলমলে বাতি জ্বালিয়ে উড়ে গেল তাদের মাথার উপর দিয়ে। কল্প সামনে এসে বললো,

– ‘আপনাদের গানের আসরে কি আমি একটু বসতে পারি?’

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here