মায়াডোর-১৭,১৮

0
260

মায়াডোর-১৭,১৮

(১৭ পর্ব)

কল্পের পুরো সময়টা কাটছে একরকম অস্থিরতায়৷ মায়ের সঙ্গে দেখা হবে৷ কত বছর পর দেখা। মা অসুস্থ ছিলেন। খবরটা শুনে তার ভেতরে ভেতরে ভীষণ পুড়ছিল। কিন্তু চাইলেই দেখা করা যায় না৷ সে সত্যি বোধহয় কাপুরুষ। গর্জে উঠতে পারে না৷ দ্বিধা, শঙ্কার দুয়ার লাত্থি মে*রে ভাঙার মতো বিদ্রোহী, প্রতিবাদী সত্তা তার ভেতরে নেই৷ সে সবকিছু সয়ে যাওয়া লোক৷ প্রবল ধৈর্যশক্তি দিয়ে তাকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। এই পৃথিবীও একটা উপন্যাসের মতো। একেকজন মানুষের চরিত্র একেক রকম। যে যার যার জায়গায় অভিনয় করবে। এটাই স্রষ্টার নিয়ম। তাইতো এই পৃথিবী বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। তাকে দেয়া হয়েছে সয়ে যাওয়ার চরিত্র। নিজের সঙ্গে সংগ্রাম করার চরিত্র। পৃথিবীর সকল যুদ্ধের থেকে এই যুদ্ধ কঠিন। নিজের সঙ্গে যুদ্ধের অসহ্যকর যন্ত্রণা তার মতো আর কাকে সইতে হয় কে জানে? তার মা কি এমন? মায়েরও কি এমন হয়? বিরহবিধুর মনকে বিড়ালের মতো আদর করে ঘুম পাড়িয়ে কি তিনিও রোজ নিদ্রায় যান? হয়তো যান। অথবা না। এই বিশাল বিস্তৃত বিশ্বচরাচরে কত মানুষ, সবার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে৷ কে কিসে কষ্ট পায় সে তার কি জানে? মা হয়তো তাকে ছাড়া ভালোই আছেন। বড়োলোক স্বামী। স্রষ্টার দেয়া মাতৃত্বের প্রবল মমতা ঢেলে দেওয়ার মতো সে ছাড়াও সন্তান আছে৷ তার শুধু মা নেই, উনার তাকে ছাড়াও সন্তান আছে। তার জন্যই কেবল এই বিষাদ। সেই শিশুকাল থেকে আজও মায়ের বিরহ যন্ত্রণা গিলে নিয়ে কবি হেলাল হাফিজের মতো বেদনার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে হয়েছে ‘কেঁদো না’।

সকাল সাড়ে আটটায় সিদ্দিক সাহেব পত্রিকা হাতে সোফায় বসে আছেন৷ মুনিয়া চা এনে দিয়ে বললেন, ‘আজ আমার একটু বাইরে যেতে হবে।’

সিদ্দিক সাহেব ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোথায়?’

– ‘বলেছিলাম না আমার এক মামাতো বোন আছে ঢাকায়। ওর বাসায়।’

– ‘আচ্ছা, যাও।’

– ‘শ্রেয়াকে নিয়ে যাব।’

– ‘ওর স্কুল আছে না?’

– ‘আজ না হয় না গেল৷’

– ‘এভাবে যাওয়ার জন্য উথলা হওয়ার কারণ কি?’

– ‘ও বলছিল তাই। বাবার বাড়িও যাই না কত বছর হলো। ওর সঙ্গে দেখা হলে একটু ভালো লাগতো।’

– ‘ঠিক আছে যাও।’

মুনিয়া বেগম ফিরে এলেন। শ্রেয়া আড়াল থেকে শুনে অসম্ভব খুশি হয়েছে। মা রুমে ঢুকতেই আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো ‘আগে তো জানতাম না উনি আমার ভাই হয়, এবার জানি, ভাইয়ার সঙ্গে অনেক কথা বলবো মা।’

মুনিয়া বেগম চারদিকে তাকিয়ে তাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন ‘চুপ, কোনোভাবে যদি তোর বাবা জানেন তুই জেনে গেছিস এগুলো। তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

– ‘না মা জানবে না। কখন বের হব আমরা?’

– ‘তোর বাবা অফিসে চলে যাক।’

মা-মেয়ে বারোটার দিকে এসে তাহিদদের কলিংবেলটা চাপলেন। ইতি গোসল করে রুমে এসেছে৷ চুল মুছতে মুছতে গিয়ে দরজা খুলে দিল। মধ্যবয়সী রূপবতী মহিলাকে দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো ইতির। চেহারা দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না উনিই কল্পের মা। পেছনে একটা বারো-তেরো বছরের মেয়ে। ইতি সালাম করে বললো ‘আসুন।’

তারা সিটিং রুমে এসে বসলেন। তাহিদ আর মালিক সাহেব বাইরে। মরিয়ম বেগম ততক্ষণে বের হয়ে এসেছেন। দেখেই খুশি হয়ে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।

– ‘তুমি এসে গেছো আপা।’

– ‘তুই কেমন আছিসরে?’

– ‘ভালো আছি, তোমার শরীরের অবস্থা কেমন এখন?’

– ‘ভালো।’

– ‘এই মেয়েটা কে?’

– ‘মুজিবের মেয়ে।’

– ‘বাহ তাই না-কি?’

মুনিয়া বেগম ইতিকে টেনে কাছে বসালেন।

– ‘তোমাদের বাড়ির সবাই কেমন?’

– ‘ভালো আন্টি।’

– ‘বাহ তুমি তো অনেক মিষ্টি দেখতে৷ আচ্ছা মুজিব কি এখনও নাক টানে?’

ইতি হেঁসে ফেললো। মরিয়ম বেগম ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমার ছেলেটাও মাশাল্লাহ, অনেক সুন্দর হয়েছে। দাঁড়াও আমি ডেকে আনি।’

কল্প রুমের ভেতরে পায়চারি করছে। বুঝতে পারছে মা এসে গেছেন। কিন্তু সামনে যেতে কেমন সংকোচবোধ করছে। আগেও এমন হতো। তার মা বছর কয়েক পর গ্রামে যেতেন। সৎ বাবার ভয়ে প্রথমদিন মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়েই নানা-নানি মামাকে দিয়ে তাকে চাচার বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন৷ ওরা চলে গেলে আবার নিয়ে আসতেন মামা৷ দেখা করাটা তার ভীষণ আরাধ্য হলেও, মায়ের সামনে যেতে বরাবরই ভীষণ লজ্জা লাগতো। মা’কে গিয়ে প্রথমে কি বলবে কখনও ভেবে পায় না সে৷ ‘আপনি’ করে কথা বলবে না-কি ‘তুমি’ করে? অন্যরা মা’কে ‘তুমি’ বলে জানে। কিন্তু সেও কি তুমি বলবে? সামনে গেলে তো অচেনা লাগে মানুষটিকে। মুনিরা বেগম এসে বললেন ‘কল্প আসো, তোমার মা এসেছেন।’

কল্প বিব্রত বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে গেল। মুনিয়া বেগম তাকে সোফায় বসতে বললেন। সে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বসে গেল। কিছুই বললো না৷ খানিক পর মনে হলো সালাম করা দরকার ছিল৷ এখন সালাম করলে কি অসুবিধা হবে? না-কি বেশি দেরি হয়ে গেছে। চারপাশে এক অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করছে। মুনিয়া বেগম মুচকি হেঁসে বললেন, ‘শ্রেয়া তোমার কথা সব জানে। কি যে পাগল তোমার সাথে দেখা করার জন্য। বাবার ভয়ে বলে না কিছু।’

কল্প মাথা তুলে বললো ‘ও আচ্ছা।’

– ‘ওর জন্যই আমাকে সিলেট যেতে দেয় না ওর বাবা। তার কথা হলো মেয়ে যেন কোনোভাবে তোমার কথা জানতে না পারে। অথচ দেখো সব জানে। তোমার সঙ্গে অনেক কথাও বলবে বলেছিল।’

কল্প চোখ তুলে বোনকে দেখে। শ্রেয়া অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পানি মুছলো মনে হচ্ছে। হ্যাঁ তাইতো, কাঁদছে। আশ্চর্য ব্যাপার, কাঁদবে কেন! কাঁদার কি আছে? সে তো তার আপন বোন নয়। কিন্তু ওকে তো কিছু বলা দরকার। কি বলবে সে? কিভাবে শুরু করবে। ওর নাম জানে। শ্রেয়া। সুন্দর নাম। এটা কি বলবে? তোমার নামটা সুন্দর? তুমি না-কি তুই করে বলবে? না এটা আরও পরে বলতে হয়। ‘শ্রেয়া তুমি কেমন আছো’ বলে শুরু করা যায়।
ইতি আর মরিয়ম বেগম ‘হা’ করে তাকিয়ে আছেন। এরা একটু চলে গেলে ভালো হতো। কিন্তু তারা যাবে কেন? মা-ছেলের সম্পর্ক তো গোপন কোনো ব্যাপার নয় যে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে চলে যাবে। ইতি বোধহয় ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। কিছু কিছু মেয়েরা অন্যদের মানসিক অবস্থা ভালো বুঝতে পারে। ইতি মরিয়ম বেগমকে ইশারা করে বললো, ‘তারা কথা বলুক ফুপু, আমরা চলে যাই।’

মরিয়ম বেগম আগ্রহ নিয়ে বসেছিলেন। তবুও চলে গেলেন উঠে। আরও খানিক অস্বস্তিকর নীরবতা। কল্প চারদিকে তাকাচ্ছে। যেন জরুরি কিছু খুঁজছে সে। মুনিয়া বেগম নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘শ্রেয়ার সাথে তো তোমার পরিচয় আছে, তাই না?’

– ‘জ্বি আছে।’

– ‘কিরে শ্রেয়া তুই না ভাইয়ার সাথে অনেক কথা বলবি বল।’

শ্রেয়া ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। কল্পের চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছে৷ মুনিয়া বেগম মেয়ের কান্নার দিকে নজর দিলেন না কেন কে জানে। তিনি স্বাভাবিকভাবে বললেন,

– ‘তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে কল্প?’

নামটা যেন বাক্যে তিনি জোর করে ঢোকালেন। কল্প মাথা তুলে বললো,

– ‘জ্বি ভালো।’

– ‘তোমার এইচএসসি রেজাল্ট শুনেছিলাম। অনেক খুশি হয়েছি। এখন না-কি ভালো ভার্সিটিতে পড়ো।’

– ‘জ্বি।’

– ‘আমার অসুখের খবর শুনেছিলে?’

– ‘জ্বি শুনেছি।’

– ‘আমাকে দেখতে ইচ্ছা করেনি?’

কল্প আহত চোখ তুলে তাকালো। মুনিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ইচ্ছা নাও করতে পারে। আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না। তুমি হয়তো ভুলে গেছো। তুমি একটা সময় প্রতিদিন আমার কাছে আসার জন্য কাঁদতে। মা তোমাকে খুবই কষ্টে সামলে রাখতেন।’

কল্পের ইচ্ছা হলো বলতে যে সে অপছন্দ করে না তাকে। তিনিই চান না সে আসুক। তবুও বলতো পারলো না। অনেক কথা এক সঙ্গে গলার কাছে যেন আঁটকে আছে। অনেক কিছু বলতে গেলে মানুষ কেন যেন কিছুই বলতে পারে না। নির্বাক হয়ে যায়। মুনিয়া বেগম আবার বললেন,

– ‘এবার অসুস্থ হওয়ার পর তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছিল। তখন শ্রেয়াকে সব বলে ফেলেছিলাম। গভীর কষ্ট মানুষ কাউকে বলতে চায়। না বলে পারা যায় না…।’

মুনিয়া বেগম চোখের পানি মুছলেন। তারপর আবার বললেন,

– ‘যত বয়স হচ্ছে বাবা। ততই আমি অনুশোচনায় ভুগছি। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার কাছে আমি খুবই অপরাধী।’

কল্পের কান্না গলায় দলা পাকিয়ে এসেছে৷ কপালের রগগুলো আকাশের তারার মতো দপদপ করছে। মুনিয়া বেগম আবার বললেন,

– ‘তুমি তোমার বাবার মতো হয়েছো। তোমার বাবা পৃথিবীর অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি গভীর রাগেও বকতেন না৷ কিন্তু ঠিকই কষ্ট দিতেন। তুমি তার মতো ইচ্ছা করে কষ্ট দেওয়া এই বয়সেই শিখে গেছো..।’

মুনিয়া বেগম আবার চোখ মুছলেন। কল্প রক্তাভ বিকৃত চেহারায় তাকালো। সে কান্না আঁটকে রাখতে পারছে না। মুনিয়া বেগম আবার বললেন, ‘কিভাবে তুমি আমাকে কষ্ট দাও জানো? আমি বিয়ের পর বাপের বাড়ি যেতে পারতাম না৷ অনেক ঝামেলার ব্যাপার ছিল৷ তো বছর কয়েক পর গেলে তুমি আমাকে ‘আপনি’ করে বলতে৷ অচেনা মানুষের মতো আচরণ করতে, লজ্জা পেতে। এগুলো আমার কলিজা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিত। দুনিয়ায় এমন পাপ করলাম যে নিজের ছেলের কাছে আমি অচেনা…।’

থামলেন তিনি, গলা ধরে এলো। মুনিয়া বেগম আবার চোখ মুছলেন। শ্রেয়া দুইহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি খানিক পর আবার বললেন, ‘তুমি হয়তো জানো না বাবা। আমি প্রথমে তোমাকে রেখে বিয়ে বসতে চাইনি। বয়স কম ছিল। সবাই বুঝিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। বাবা বলতেন ছেলের জন্য চিন্তা করো না৷ আমরা আছি। তার কোনো অসুবিধা হবে না। তোমার জীবন তোমার। দীর্ঘ একটা জীবন পড়ে আছে। নিজের মতো করে শুরু করো। বাপের বাড়ি কতদিন থাকবে? কল্প ছেলে মানুষ। চোখের পলকে বড়ো হয়ে যাবে। দুনিয়ায় কুকুরও বেঁচে থাকে৷ সে তো ছেলে মানুষ। পুরুষ মানুষ যেখানে লাথ মা’রে সেখানে ভাত, যেখানে কাত হয় সেখানে রাত। তার চিন্তা বাদ দাও। এরকম সবাই কতকিছু বুঝাইতো। এক সময় রাজি হয়েছি। বিয়ের শুরুর দিকে ভাবতাম দিন গেলে ধীরে ধীরে শ্রেয়ার বাবা তোমাকে মেনে নিবে৷ কিন্তু সে ঠিকই মেনে নেয়নি। উল্টো এমনভাবে সাবধান থেকেছে। যেন তার পরিচিত কেউই তোমার কথা না জানে। সেসব আরও কত ইতিহাস৷ এগুলো বলতেও চাই না। পৃথিবী দুঃখ-কষ্টের জায়গা৷ দুঃখ-কষ্ট বলে বলে চর্চা করার মতো কিছু নয়। তবুও মানুষ বলে। আমার আজকাল বলতে ইচ্ছা করে। শ্রেয়াকে বলি। মেয়েটা শুনে শুধু কাঁদে। ওর মন অনেক নরম। শেষ বয়সে এসে তোমাকেও কত কথা বলতে ইচ্ছা করে। বলার সুযোগ হয় না৷ শুধু এটুকু বলি বাবা, এই অভাগী দুখিনী মা’কে তুমি ক্ষমা করে দিয়ো।’

কল্প দুইহাতে মুখ ডেকে নিল। সে কোনো কথাই বলতে পারছে না। এই মহিলা না এলেও বরং ভালো হতো। অন্যের বাসার সিটিং রুমে বসে কাঁদার মতো ছেলে সে নয়। তবুও কেঁদে ফেললো কল্প। মুনিয়া বেগম এসে তার পাশে বসে মাথায় হাত রাখলেন। কল্প মায়ের কোলে মাথা রেখে কেঁপে কেঁপে উঠলো কান্নায়। তখনই মোবাইল বেজে উঠলো। শ্রেয়ার বাবার কল। মুনিয়া বেগম চোখের জল মুছে বললেন, ‘হ্যালো।’

– ‘তুমি কোথায়?’

– ‘সকালে বললাম না আমার এক বোনের বাসায় আসবো?’

– ‘তো বললেই কি দুনিয়ার সব ফেলে চলে যেতে হবে? যাওয়ার আগে কি একবারও বাবার রুমে গিয়ে উঁকি দিয়েছো?’

– ‘তাতে এখন কি হয়েছে?’

– ‘মালা কল দিয়ে বললো উনি অশান্তি করছেন। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। ডাক্তার লাগলে ডাক্তার নিয়ো।’

– ‘এত অস্থির হওয়ার তো কিছু নাই। উনার যা বয়স একটু তো অসুখ করবেই। আমি এখন মাত্র এসেছি।’

– ‘আশ্চর্য আমার অসুস্থ বাবার খবর শুনেও তুমি বলছো অসুখ তো করবেই! এইমাত্র এসেছি! উনার অবস্থা তুমি জানো না। যদি মারা যায় একা বাসায়?’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।’

– ‘তোমার কাছে কাঁদে কে?’

মুনিয়া বেগম থমকে গেলেন। শুকনো ঢোক গিললেন। তারপর আমতা-আমতা করে বললেন, ‘বাসার একটা বাচ্চা কাঁদছে।’

– ‘ওকে তাড়াতাড়ি যাও৷ রাখছি।’

মুনিয়া বেগম ফোন রেখে দিলেন। ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে বললেন, ‘মরিয়ম কোথায় তুমি? আমাদের যেতে হবে।’

মরিয়ম বেগম এসে অবাক হয়ে বললেন ‘আরে কি বলো? নাশতা দিচ্ছি৷ এখনই চলে যাবে কেন?’

– ‘আমার শ্বশুর অসুস্থ। প্রচুর বয়স্ক আর অসুস্থ। অনেকদিন থেকে যখন-তখন অবস্থা৷ কল এসেছে যাওয়া লাগবে। আমি বাইরে আর এই অবস্থায় কিছু হলে ননদরা দুনিয়া উল্টিয়ে ফেলবে।’

– ‘কি বলো এসব?’

মুনিয়া বেগম ফিরে কল্পের মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাচ্ছি বাবা।’

কল্প ‘হা’ করে তাকিয়ে রইল। শ্রেয়া আর মুনিয়া বেগম চলে যাচ্ছেন। কল্প বসে আছে। মরিয়ম বেগম বললেন, ‘যাও, তাদের এগিয়ে দিয়ে আসো।’

কল্প উঠে দাঁড়াল। পিছু পিছু এলো গেইটের বাইরে। মুনিয়া বেগম রিকশা দাঁড় করালেন হাত তুলে। তারপর পিছু ফিরে কল্পের দিকে তাকিয়ে ভেঙে পড়লেন কান্নায়৷ গেইটের রট ধরলেন শক্ত করে। কোনোভাবে নিজেকে সামলাতে পারছেন না। রিকশাওয়ালা ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। কল্প অন্যদিকে মুখ ফুরিয়ে আছে তার ঠোঁট কাঁপছে।
একটা কাক মাথার উপর দিয়ে ‘কা-কা’ করে এই বিষণ্ণ দুপুরকে আরও বিষাদময় করে উড়ে গেল। কল্প গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ গাছের পাতা টান দিয়ে এনে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করছে। শ্রেয়া আচমকা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ভাইয়া তুমি চলো আমাদের সঙ্গে।’
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

মায়াডোর (১৮ পর্ব)
.
কল্প গেইট থেকে তাদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে আসে৷ শ্রেয়ার আবেগকে প্রশ্রয় দিলেন না মুনিয়া বেগম। তাকে বুঝিয়ে কল্পের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। তাহিদ রাতে সত্যি সত্যিই স্মার্টফোন নিয়ে এলো ইতির জন্য৷ সিম ঢুকিয়ে সবকিছু সেটিং করে দিল সে নিজেই৷ ইতি মোবাইল পেয়ে বিস্মিত, অভিভূত। বাড়িতে ফোন করেও জানিয়েছে। ওরা প্রথমে খানিক রাগারাগি করলেও তাহিদ সবকিছু সামলে নিল। কেরিয়ারে সফল ছেলেদের আত্মীয়-স্বজন সমীহ করেন। তাহিদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। ফুপুর বাসায় ইতির দিনকাল ভালো কাটলেও চরম বিরক্তিতে কাটছে কল্পের। মায়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে শ্রেয়া। ওর ‘ফ্যাসফ্যাস’ করে কান্না তার হৃদয়টাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে৷ হঠাৎ করে মনে হতে শুরু করেছে পৃথিবীতে তারও একটা বোন আছে। ব্যাপারটা যেমন আনন্দের, তেমনই তার জন্য কষ্টের। পরেরদিন ভোরে তাহিদ বাইরে যাওয়ার আগে এলো তার রুমে।

– ‘কল্প খালা এসেছিলেন শুনেছি। মন খারাপ করো না।’

– ‘না না ঠিক আছি আমি।’

– ‘তোমার তো মনে হয় বোরিং লাগছে বাড়িতে। চাইলে আম্মুকে নিয়ে ইতি আর তুমি বেড়াতে যেতে পারো। আম্মু সবকিছু চিনে।’

– ‘না আমার বেড়াতেও ভালো লাগে না।’

তাহিদ ঘড়ি হাতে লাগাতে লাগাতে হাসলো।

– ‘হ্যাঁ কিছু মানুষ আছে তাদের বেড়াতেও বিরক্ত লাগে। অথচ কেউ বিরক্তি কাটাতে বেড়াতে যায়৷ মানুষ কি অদ্ভুত। আচ্ছা তুমি কি বই পড়ো?’

– ‘হ্যাঁ পড়ি। তাহলে আমার রুমে যেয়ে বই এনে পড়তে পারো। আমি প্রচুর বই পড়ি।’

– ‘বাহ ভালো তো।’

– ‘মানুষ ভাবে ডাক্তাররা বেরসিক হয়। এরা শিল্প-সাহিত্য পছন্দ করবে না। কেন রে ভাই? আমাদের কি মন বলতে কিছু নাই? একদিন এক নবীন লেখক আমার কাছে তার বই দেখে বললো আশ্চর্য আপনি কবিতার বই পড়েন? ভাবো একবার! তুমি জানো সবচেয়ে সাহিত্যের বই কারা বেশি পড়ে?’

– ‘মেয়েরা, পুরো পৃথিবীতেই এটা স্বীকৃত সত্য।’

– ‘ছেলেদের মাঝে কারা পড়ে জানো?’

– ‘এটা নিয়ে ভাবিনি।’

– ‘পাব্লিক ভার্সিটির ছেলেরা এবং মাদ্রাসা ছাত্ররা।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, তুমি এটা খেয়াল করলে বুঝতে পারবে। আচ্ছা যাই এখন। হঠাৎ মনে হলো তুমি বাসায় একা একা দিন কাটাচ্ছ।’

তাহিদ চলে গেল বাইরে। কল্প উঠে ওর রুমে গিয়ে দেখে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। বিছানায় বালিশের পাশে একটা বই রাখা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাগজের বউ’।

নামটা শুনে মোটেও ভালো বই মনে হলো না তার। তবুও নিয়ে এলো। কিন্তু পড়তে শুরু করতেই ডুবে গেল বইয়ে। অসম্ভব ভালো লাগলো বইটা। ভেবেছিল আজই ইতিকে ডেকে বলবে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাহিদের ঘরে তাকভর্তি বইয়ের সংগ্রহ তাকে আঁটকে দিল৷ একের পর এক বই পড়ছিল। কিন্তু দু’দিন যেতেই সে লক্ষ্য করলো ইতি তার রুমে আসে না। তাদের মধ্য কথাও হয়নি। ব্যাপারটা আশ্চর্যের হলেও কল্প এটাই চেয়েছিল। তবুও তার বুকের ভেতর কেমন খচখচানি বেড়ে গেল। রাতে খেতে বসে জানলো দিনে একবার মরিয়ম বেগম এবং ইতি বাইরে বেড়াতেও গিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে কেমন কষ্ট হচ্ছিল কল্পের। ইতির ভালোবাসার সঙ্গে সে পরিচিত, উপেক্ষার সঙ্গে নয়। পরেরদিন দুপুরে কল্প তাকে ডেকে বললো, ‘আমার তো ক্লাস আছে, টিউশনি আছে। আর কয়দিন থাকবে। যাওয়া দরকার না?’

ইতি আমতা-আমতা করে বললো, ‘আচ্ছা কাল চলে যাব তাহলে। আমি ফুপুর সঙ্গে কথা বলে নিব।’

কল্প সম্মতি দিল। ইতি চলে গেল তার রুম থেকে। সবকিছুই কল্পের কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল।

পরেরদিন দুপুরে তারা বের হয়। তাহিদ বাস স্টেশনে এনে দিয়েছে। বিদায়ের সময় বললো, ‘ইতি পড়ালেখা ভালোভাবে করবি। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকিস না। শেষে মামা-মামী আমাকে বকবেন।’

ইতি ফিক করে হেঁসে বললো, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

কল্পের সঙ্গে কথা বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল সে৷ ইতি আর কল্প পাশাপাশিই বসেছে ওইদিনের মতো। বাস চলছে। ইতি কানে ইয়ারফোন গুঁজে বুকে হাত বেঁধে চোখবুজে বসে রইল। তার প্রতি বিশেষ কোনো আগ্রহ আছে ইতির মনেই যেন হচ্ছে না। এই ব্যাপারটা কল্পকে যেন স্বাভাবিক থাকতেই দিচ্ছে না। একপর্যায়ে সে বলেই ফেললো, ‘ইতি।’

ইয়ারফোন খুলে সে বললো ‘কিছু বলবেন?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘কোনো সমস্যা? মাত্র এক সপ্তাহ এই বাসায় থেকেছি আমরা। তুমি অনেক পালটে গিয়েছো মনে হচ্ছে।’

ইতি ফ্যাকাসে মুখে হেঁসে বললো, ‘আপনি তাইই চাইছিলেন।’

– ‘তা অবশ্য ঠিক। তবে অবাক লাগছে আমার।’

– ‘কষ্টও লাগতে পারে। শুনেছি চেনা মানুষের অচেনা রূপ অনেক পীড়াদায়ক।’

– ‘তাহলে তুমি কি আমাকে পীড়া দেওয়ার চেষ্টা করছো?’

– ‘মোটেও না। আমি শুধুমাত্র একটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো আচরণ করছি৷ এতদিন করিনি৷ আর এখন করছি কারণ আপনিই চেয়েছিলেন।’

– ‘তা ভালো, দেখবে খুব দ্রুত তুমি ভুলে যাবে আমাকে৷ তোমার বয়সটাই এমন।’

– ‘আপনি কিন্তু বারবার ভুলে যান আপনি আমার মাত্র দুই বছরের বড়ো।’

কল্প হেঁসে বললো ‘তা অবশ্য ঠিক।’

– ‘শুনুন ভুলে যাব বা আপনাকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি এরকম কিছুই না৷ আমার বয়স কম, এই বয়সে এরকম হয়ই, মোহ কেটে যাবে এসব বুঝদারি চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমি শুধু অন্যের বিরক্তিকর কারণ হতে আর চাইছি না৷ আরেকটা কথা মনে রাখুন। অনেক জ্ঞানী জ্ঞানী কথা তো বলেন। এটা বুঝেন কি-না কে জানে। দু’জন একেবারে চুপ হয়ে গেলে কেউ কাউকে ভুলতে পারবো না। এর চাইতে স্বাভাবিকভাবে থাকাই ভালো। আমরা পরিচিত মানুষ। আমি আপনার কাছে পড়েছি। এই হিসাবে যতটুকু সম্পর্ক থাকে সেটা থাকাই ভালো। না হয় আরও বেশি কষ্ট হবে দুজনেরই। আপনার জন্য আমার দুয়ার খোলা। কিছু বলতে চাইলে বলবেন। সব সময় পাশে পাবেন আমাকে। আমিও চাই নিজের মতো পড়ালেখা শেষ করে বিয়ের প্রস্তাব দিন।’

কল্প আমতা-আমতা করে বললো, ‘তা অবশ্য দেবো, কিন্তু সেটাও আট-দশটা বিয়ের প্রস্তাবের মতো। দুই পরিবার মানলেই তবে বিয়ে হবে। এর ভেতরে ধরো তোমার কোনো ভালো বিয়ের সম্মন্ধ এলো। তুমি বিয়ে বসে যেও। ভুলেও বলতে যেও না আমার কথা। আমাদের মাঝে সেরকম কোনো প্রণয়ের সম্পর্ক নেই।’

ইতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ইয়ারফোন কানে গুঁজে দিল। কল্পও ফেইসবুকে যায় সময় কাটাতে, গিয়ে দেখে ইতির ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট। গ্রহণ করে নিল সে। দু’জনের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। ইতি নজরুল সংগীত শুনছে ‘আলগা করো গো খোপার বাঁধন..।’
বাইরে তাকিয়ে আছে। একটা ব্রিজে উঠেছে বাস। নিচে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা নদী। আকাশে ঝকঝকে রোদ। পাশে কে? তার অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ। যার জন্য এরকম কয়েকটা নদীর থেকেও বেশি ভালোবাসা ছোট্ট বুকটিতে পুষে রাখে ইতি। এত ভালোবাসা এখন থেকে গোপন রাখতে হবে। চোখের ভেতরে নদীটা ফুসে উঠলো বোধহয়, চোখ ছলছল করছে।
পুনরায় গানটিতে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো ইতি ”বিনোদ বেনির জরিন ফিতায়
আন্ধা ইশক মেরা কাস গায়ি॥
আলগা করো গো খোপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি…।”

বাড়িতে ফিরে এলো তারা সন্ধ্যার সময়। এরপর ক্রমশই ইতি পালটে যেতে শুরু করলো। পড়ালেখা, মোবাইল, বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে আলাদা একটা ভুবন তৈরি করে নিল সে। মাঝে মাঝে কল্পের অচেনা মনে হতো ইতিকে। হঠাৎ করে যেন বড়োও হয়ে গেছে অনেকটা। তার জীবনও স্বাভাবিকভাবেই যাচ্ছিল। পড়ালেখা, টিউশনি। সমস্যাটা শুরু হলো বছর খানেক পর। যখন তার চাচা ফ্যামিলি সহ দেশে এলেন। ইতি যেটুকু আশার আলো বুকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। সেই আশাও ভেঙে যেতে দেখছিল চোখের সামনে।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here