মায়াডোর-২৭,২৮

0
379

মায়াডোর-২৭,২৮

(২৭ পর্ব)
.
ইতি চলে যাওয়ার পর কল্প রুমে ফিরে আসে। তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে টিউশনিতে যায়। মেসে রাত করে ফিরে। ঘুমানোর আগে ইতির সঙ্গে চ্যাটে কথা হয়। এরকম বাসায় আসতে নিষেধ করে দেয় ইতিকে। এরপর মাঝে মাঝে কেবল বেলকনি থেকে নয়নভরে দেখা। ইতি বেপরোয়া প্রেমিকের মতো ফার্নিচারের দোকানের সামনে এসে কল দেয়। কল্প বেলকনিতে গিয়ে হাত নাড়ে। একে অন্যের দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। এভাবেই কয়েক মাস চলে যায়। এর ভেতরে শ্রেয়ার সঙ্গে কথা হয় কল্পের। কথা হয় সুপ্তির সঙ্গেও। মা কিংবা মামার সঙ্গে কোনো কথা হয় না। পরিবারের সঙ্গে নিপা ইংল্যান্ড চলে যায়। কল্প নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে বিদায় করতেও যায় না। তবে নিপার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়। কিছুদিন পর তার পড়ালেখা আর টিউশনির সঙ্গে যুক্ত হয় চাকরির ইন্টারভিউ। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে ছোটাছুটি। কোনোভাবেই কিছু হয় না। প্রায় ছয় মাস পর একটা জব পায়। মোটামুটি ভালো। প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে মার্কেটিং অফিসার। পরীক্ষা আর পড়ালেখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ছুটিই পাবে সে। বেতন প্রথমে বারো হাজার। ধীরে ধীরে বাড়বে। জব টাইম দশটা থেকে পাঁচটা অবধি। কল্প জয়েন করার পর দেখেছে টাইম ঠিক থাকে না। কখনও সাতটা আটটাও হয়। আরও এক বছর চলে যায় জব করে। এর ভেতরে ইতির ইন্টারও শেষ হয়ে গেছে। পুরো দেড় বছরই তাদের চ্যাট আর মাঝে-মাঝে দেখা সাক্ষাৎ করে কেটে যায়। কল্পেরও বেতন বাড়তে বাড়তে ততদিনে ১৮ হাজারে এসেছে৷ এছাড়াও প্রতিদিনের বোনাস, ওভার টাইম সহ একুশ হাজারের কাছাকাছি হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড়ো ব্যাপারটা হচ্ছে, দীর্ঘ দেড় বছরের চাকরি জীবন কল্পকে অনেকটাই পালটে দিয়েছে। চরিত্র থেকে অতি বিনয়ী ভাব একেবারে খসে পড়েছে। সরলতা উধাও হয়ে কথাবার্তায় রূঢ় ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রায়ই এখন মামা-চাচাদের সঙ্গে কথা হয়। মায়ের সঙ্গে কথা হয়। সবার সঙ্গেই রূঢ় আচরণ করে। পরোক্ষভাবে নিজের অধিকারের বিষয়ে কথা বলে। আজকাল ইতিও তাকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি কর‍তে শুরু করেছে। সেও বিয়েটা করে ফেলতে চায়। তবুও যেন সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারছে না৷
আজ অফিসে থাকতেই কিছু বিষয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে। সেসব বিষয়ে মায়ের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলবে সে। গরমের দিন। বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় গোসল করলে আরাম পায়। আজও গোসল করে বের হয়েছে। শরীর মুছে একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বিছানায় গা হেলিয়ে মা’কে কল দেয়। ওপাশ থেকে রিসিভ করেন মুনিয়া বেগম। কল্প সালাম দেয়। তিনি জবাব দিয়ে বললেন, ‘কি করছিস বাবা?’

– ‘এইতো অফিস থেকে এলাম।’

– ‘পড়ালেখা কেমন চলছে।’

– ‘ভালো না। চাকরি-টাকরির সঙ্গে পড়ালেখা ভালো হবে কিভাবে। আচ্ছা শ্রেয়া কি করে? কেমন আছে?’

– ‘ভালো, ওর তো এসএসসি পরীক্ষা সামনে।’

– ‘ও, আচ্ছা শোনো মা, তোমাকে একটা দরকারে কল দিয়েছি।’

– ‘কি?’

– ‘আমাদের গ্রামের রহমত মিয়াকে চেনো? ওইযে অন্যের বাড়ি থাকে।’

– ‘না, কেন?’

– ‘ওর ছেলে তো আমাদের বাড়িতেই চাকরিতে থাকে।’

– ‘ও আচ্ছা, তো কি হয়েছে।’

– ‘আমি মাঝে একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। রহমত আলীর ছেলেকে একটা অটোরিকশা কিনে দিয়েছি। ছোট চাচাও ছিলেন সঙ্গে। সে মাসে মাসে টাকা পাঠায় ঠিকঠাকমতো।’

– ‘ভালো তো, ভালো করেছিস।’

– ‘আমি অন্যকিছু ভাবছি। আব্বার ভাগের তো অনেক জায়গা-জমি আছে। সেগুলো ছোট চাচা এত বছর থেকে করেন। বাড়িতেও আমার ভাগ আছে।’

– ‘হ্যাঁ তা আছে তো।’

– ‘আমি চাচ্ছি সেগুলো আলাদা করে নিতে। রহমত চাচা বললো প্রায় একশো মন ধান পান চাচা।’

– ‘এখন ভাগ দিয়ে কি করবি তুই? বিয়ে-শাদি করে সংসার কর। তারপর না এগুলো দিবে।’

– ‘আজাইরা কথা বলবে না তো। এত বছর যে করে খাচ্ছে। তুমি ওদের বলেছিলে আমার ধানের টাকা জমাইতে? আমি এখন থেকে রহমত চাচাকে চুক্তিতে সব জমি দেবো। খরচও আমি দেবো। ওরা শুকিয়ে বিক্রি করে টাকা দেবে আমাকে। আর আমি বিয়ে করে সংসার করতে হলে কি বাড়িঘর লাগবে না? ওরা আমার বাড়ি ভাগ করে দিক। আমি তালা মেরে রেখে আসবো। না হয় রহমত আলীকে ঢুকিয়ে দেবো। আমার জমি-জমা দেখবে।’

– ‘তো কর আমি কি করবো? তুই তো নিজের কপাল পুড়িয়ে ফেলেছিস আগেই। এতদিনে ইংল্যান্ড থাকতি।’

– ‘তোমরা সবাই তো এই এক গান পেয়েছো। তোমার ভাইও। আমি ইংল্যান্ড না গিয়ে কি গাঁ*জা খাচ্ছি বসে বসে? পড়ালেখা করছি, জব করছি। তোমার ভাই তো বাড়ি থেকেই বের করে দিছে। এখন আমার বাড়ি-ঘর লাগবে না? তুমি সিলেট আসো, আর তোমার ভাই যদি যায় আমার সঙ্গে তাহলে তো ভালোই। আমি তোমাদের নিয়ে ছোট চাচার সঙ্গে এগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই। এর পরের সিজনেই আমি নিজে আমার জমি করাবো।’

– ‘তোর বড়ো চাচার সঙ্গে কথা বলেছিস?’

– ‘হ্যাঁ বলেছিলাম। উনি বলছে মামাকে নিয়ে যেতে। উনি কলে কথা বলবেন ছোট চাচার সঙ্গে। তুমিও আসো।’

– ‘আমি এসে কি করবো? তোর মামাকে কল দিয়ে বলবো, সে যাবে সঙ্গে। সমস্যা নেই।’

– ‘হ্যাঁ তুমি আসবে কেন! তুমি তো দুনিয়ার আলাদা মহিলা। আর কেউ বাপের বাড়ি আসে না৷ তোমাকে কিনে নিয়েছে একেবারে।’

– ‘কল্প তুই ইদানীং বেশি কথা বলিস। এসব নিয়ে কথা না বলতে নিষেধ করেছি না?’

– ‘কিসের নিষেধ? তোমাকে যে বাপের বাড়িই আসতে দেয় না তার কাছে তুমি কেমন সুখে আছো? এরচেয়ে তো হাজতবাস ভালো। আমার জন্য সিলেট আসতে না দেওয়ার তো কিছু নেই। কল্প তো গিয়ে বাপ ডাকবে না তাকে। আমি কি কখনও বলছি তোমাদের কাছে যেতে? তো এত কাহিনির কি আছে এখানে৷ তোমাকে বলছি না, আমি এখন জব করি। দরকার হয় বাসা নেব। তুমি চলে আসো শ্রেয়াকে নিয়ে।’

– ‘কিসব আবোল-তাবোল কথা বলিস এসব তুই? পাগল হয়েছিস না-কি। তোর কথা শেষ হলে ফোন রাখ।’

– ‘যাইহোক তুমি জমির ব্যাপারে কথা বলতে আসবে কি-না বলো। না হলে তোমার ভাইকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করো যাবে কি-না। না গেলে কেউ লাগবে না আমার। একাই যাব।’

– ‘বেশি কথা বলিস না৷ আমি মোস্তাককে কল দিচ্ছি। দেখি কি বলে।’

কল রেখে দেয় কল্প। পরেরদিন মুনিয়া বেগম জানান মোস্তাক সাহেব যাবেন। কল্প পরের শুক্রবারে মামাকে নিয়ে গ্রামে যায়। বড়ো চাচাও কলে কথা বলেন। সবকিছুই সুন্দরভাবে সমাধান হয়। তাই ছোট চাচা আর মামাকে নিয়েই কল্প রহমত মিয়ার সঙ্গে জমি করার বিষয়ে আলোচনা করে। সে জমির যাবতীয় খরচ দেবে। রহমত আলী জমিগুলো করে একেবারে ধান বিক্রি অবধি করে দিতে হবে। তাতে অর্ধেক ফসলই পাবে রহমত আলী। তাছাড়া বলে এসেছে জমি ঠিকঠাক মতো করলে, গরুও কিনে দেবে প্রতিবছর। লাভের অর্ধেক পাবে তারা। বাড়িও তাকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। কল্প একরাত থাকলো সেখানে। মোস্তাক সাহেব চলে গেলেন বাড়িতে। গ্রামে পাড়া-পড়শীদের সঙ্গে অন্যভাবে মিশলো। সবার বাড়িতে গেল দেখা করতে। ফিরে এলো পরেরদিন বিকেলে। খুবই ফুরফুরে লাগছে তার। এতদিন নিজেকে কেমন পরিচয়হীন, গৃহহীন মনে হতো। এখন কেমন শান্তি লাগছে। বাসে আসতে আসতেই মনে হয় আজ যেহেতু অফিস ছুটি। তাহলে ইতির সঙ্গে দেখা করা যায়। মেসেঞ্জারে গিয়ে মেসেজ দিল, ‘ম্যাডাম কোনো বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বের হতে পারবেন? আমি তিনটার আগে মেসে ফিরবো। তুমি সাড়ে তিনটার আগে চলে আসো।’

ইতি মেসেজ সিন করেছিল দেরিতে৷ তবুও রিপ্লাই দিয়ে বলেছে আসবে। কল্প বেলকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে অপেক্ষা করছে৷ ইতি কল দিল এসে তিনটা চল্লিশে। সে রিসিভ করে বললো, ‘এসেছো?’

– ‘হ্যাঁ কাছাকাছি, আপনি ফার্নিচারের দোকানের সামনে আসুন।’

– ‘আচ্ছা আসছি।’

কল্প তাড়াতাড়ি বের হয়ে নিচে নামে। ফার্নিচারের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইতিকে খানিক পর রিকশাতে দেখা গেল। কল্প এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘নামার দরকার নেই এটাতেই যাই।’

– ‘আচ্ছা আসো।’

– ‘কোথায় যাবে? কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি?’

– ‘তুমি কি কোনোদিন আমাকে আর ভার্সিটিতে নিয়ে যাবে না?’

কল্প হেঁসে বলে, ‘আচ্ছা চলো।’

দু’জন ভার্সিটিতে আসে। চারদিকে হেঁটে হেঁটে শহিদ মিনারের সামনে এসে কল্প বলে ‘ফুচকা নিই?’

ইতি সম্মতি জানায়। কল্প ফুচকা নিয়ে হেঁটে হেঁটে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘পারবে উঠতে?’

ইতি ফিসফিস করে বলে, ‘কোলে নিয়ে উঠুন।’

– ‘চারদিকে মানুষ, তাকিয়ে থাকবে।’

– ‘ওমা তাতে কি হয়েছে।’

– ‘হাত ধরো তো। চলো আস্তে আস্তে উঠবো।’

দু’জন ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে। কল্প ইতির দিকে তাকায়। খোলা চুল। ঠোঁটে লিপস্টিক। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। ভ্রু দিন দিন আরও কালো হচ্ছে। গালের মাঝখানের তিলটায় ভীষণ মায়াবী লাগে ওকে। কিছুটা মোটাও হয়েছে ইতি। চেহারায় লাবণ্যতা আরও বেড়েছে। সিঁড়ি আঁকাবাঁকা হয়ে উঠায় নিচ থেকে মাঝখান দেখা যায় না। কল্প ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কষ্ট হচ্ছে তোমার?’

ইতি কল্পের বাহুতে গাল চেপে ধরে বললো, ‘কষ্ট হলেও তো কোলে নিবেন না।’

কল্প ফুচকা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা একটু নাও।’

ও হাতে নিতেই সে পাঁজাকোলা করে কোলে নেয়। ইতি আঁতকে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘লাগবে না, আমি এমনিতেই বলেছি, নামান।’

– ‘আরও অনেক উঁচুতে তো। একটু হেল্প করি। এরপর একা উঠবে।’

– ‘আচ্ছা কষ্ট হলে নামিয়ে দিয়েন।’

কল্প মাথা নেড়ে উঠতে থাকে। ইতি চারদিকে তাকায়। সবুজ অরণ্যে ঘেরা চারপাশ। বেশ কিছু সিঁড়ি উঠতেই কল্পের শ্বাস ঘন হয়ে আসে। ইতি বুঝতে পেরে বলে, ‘সিঁড়ির দুই পাশে দেয়াল আছে। আমরা চাইলে তো বসতে পারি।’

– ‘শহিদ মিনার তো উপরে। ওই জায়গাটা সুন্দর।’

– ‘তা বুঝেছি, কিন্তু জিরিয়ে জিরিয়ে যাব। এত তাড়া তো নেই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে কল্প নামিয়ে দিয়ে বললো, ‘বাবা তোমার এত ওজন।’

ইতি খিলখিল করে হাঁসে। বেশকিছু সিঁড়ি পর পর বাঁক নেয়ার আগে কিছুটা বৃত্তাকার পাকা জায়গা। ইতি তাকে টেনে নিয়ে একপাশে বসে। হাতটা বগলি করে ধরে পেশিতে গাল চেপে রেখে আনমনে হঠাৎ কামড় দেয়। কল্প আর্তনাদ করে সরিয়ে নেয়৷ ইতি হাসতে হাসতে মুখ ঢেকে নেয় দুইহাতে।

– ‘এটা কি হলো দাগ পড়ে গেছে?’

– ‘ডিম ভেবে কামড় দিয়ে দিছি স্যরি।’

– ‘আমি দেই একটা?’

– ‘কোথায়?’

– ‘এইযে ডিমের কুসুমের মতো মায়াবী গাল, ঠিক মাঝখানে একটা কালো তিল।

– ‘পরে সবাই কামড়ের দাগ দেখে কি বলবে?’

– ‘লোকের কথা বাদ দাও, তুমি ব্যথা পাবে না?’

– ‘ব্যথা সহ্য করে নেব।’

কল্প মুচকি হেঁসে পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে ইতির গালে একটা চুমু দিয়ে বলে, ‘এবার উপরে যাই।’

– ‘আরেকটু বসি, জায়গাটা নিরিবিলি আছে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘ও হ্যাঁ, আরেকদিন দূর থেকে দেখে আমাকে মেসেজে বলেছিলেন আমি কিছুটা মোটা হয়েছি।’

– ‘হ্যাঁ, হয়েছো তো।’

– ‘খারাপ লাগে?’

– ‘না না ভালোই তো লাগে।’

– ‘আজ আপনার মন ভালো মনে হচ্ছে।’

– ‘হ্যাঁ বাড়ি থেকে এলাম। অনেক ঝামেলা শেষ হয়েছে। জায়গা-জমি ভাগাভাগি হলো। বাড়িও পেয়েছি।’

– ‘ওমা আমি বিয়ের পর কি গ্রামে থাকবো?’

– ‘তা না, তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে। তবুও নিজের বাড়ি থাকতে হবে না? তোমার পরিবার শেষে বিয়ে দিতে চাইবে না।’

ইতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘আমার কাছে কিন্তু একটা দুঃসংবাদ আছে। তবুও আমাকে স্বাভাবিক লাগছে তাই না?’

– ‘হ্যাঁ, স্বাভাবিকই তো মনে হচ্ছে।’

– ‘আমি আপনাকে আজ রাতেই দুঃসংবাদটা দিতাম। আপনি দেখা করতে বলার পর ভাবলাম এসে সামনা-সামনি বলবো। আবার রিকশা থেকে আপনার চেহারা দেখে বলতে ইচ্ছা করছে না।’

– ‘আমার চেহারা আবার কি দোষ করছে?’

– ‘দেখেই বুঝতে পারছি আপনার মন ভালো। এই সংবাদ দিলে খারাপ হয়ে যাবে।’

– ‘কি হয়েছে বলো তো। এত প্যাঁচাচ্ছ কেন!’

ইতি কাতর হয়ে ওর গাল রেখে বললো, ‘প্লিজ অস্থির হইয়ো না। পরে বলি? এখনই তোমার মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছা করছে না।’

– ‘কি দুঃসংবাদ আল্লাহই জানে।’

– ‘আপনাকে অল্প অল্প দাড়িতে অনেক মায়া লাগে।’

– ‘জানি, তবুও শেভ দিতে ইচ্ছা করে। দাড়ি নিয়ে চলাফেরা অশান্তি মনে হয়। শেভ দিলে কেমন হালকা হালকা লাগে।’

– ‘আপনার যেরকম ভালো লাগে সেভাবে থাকুন, আমি এমনিতে বললাম।’

কল্প ইতির হাতটা এনে চুমু খেয়ে বললো, ‘আর শেভ দেবো না। নিজের মতো না, আমি আমার অভিমানী পাখিটার মতো থাকবো।’

ইতি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘ওই দেখুন একটা গাছে হলুদ পাখি। অনেক কিউট না?’

– ‘হ্যাঁ, তোমার মতোই।’

– ‘ধ্যাৎ, আচ্ছা আপনি প্রতিদিন কি এখানে আসেন?’

– ‘না।’

– ‘আপনাদের ভার্সিটি অনেক সুন্দর। মনেই হয় না সিলেটে আছি। কোনো জঙ্গলের ভেতরে মনে হচ্ছে।’

– ‘আচ্ছা উপরে যাই।’

– ‘হুম।’

দু’জন উঠে দাঁড়ায়। ইতি হাঁটছে। কল্প চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো, ‘দাঁড়াও।’

ইতি পিছু ফিরে বললো, ‘কি?’

– ‘সিঁড়ি থেকে নেমে আসো। এখানে সমান জায়গা আছে।’

ইতি নামতে নামতে বললো, ‘কি?’

কল্প আঁজলা করে ওর মুখটা ধরে কপালে চুমু খায়। ইতি প্রতিবারের মতো চোখবুজে গ্রহণ করে এই স্পর্শটুকু। কল্প তারপর বুকে টেনে আনে। একই জড়িয়ে ধরা, একই চুমু, একই অনুভূতি। তবুও বারবারই যেন ইচ্ছা করে। প্রতিবারই দু’জন হারিয়ে যায় কোথাও। কল্প কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘প্রচণ্ড ভালোবাসি ইতি।’

ইতির কথা বলতে ইচ্ছা করে না। চোখ খুলতেও না। সে নিঃশব্দে, নিভৃতে মিশে থাকে বুকে। খানিক্ষণ কেটে যায় এভাবে। কল্প আচমকা আলগোছে কোলে তুলে নেয়। ইতি কেঁপে উঠে। ঘোর লাগা চোখে তাকায়। একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ ইতিকে মাতাল করে রাখে। ঘন জঙ্গলের ভেতরে একটা পাখি ডেকে ডেকে কোথাও ছুটে যাচ্ছে। উপরে উঠে এলো তারা। ইতি মুগ্ধ হয়ে গেল চারপাশে তাকিয়ে। কিছু ছবি তুললো দু’জন। খানিক পর আবার দু’জন একপাশে বসে। কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘এবার ম্যাডামের দুঃসংবাদ দাও।’

ইতি কল্পের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কাঁধে মাথা রেখে বলে,

– ‘প্লিজ শুনে দুশ্চিন্তা করো না। আমি এসব সামলে নেব।’

– ‘আচ্ছা বলো।’

– ‘তাহিদের সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে। ওইযে মরিয়ম ফুপুর ছেলে তাহিদ। আমাকে মোবাইল গিফট করেছিল। ডাক্তার তো সে। বাবা-মা সহ সবাই অস্থির হয়ে গেছে বিয়ে দেয়ার জন্য।’

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

মায়াডোর (২৮ পর্ব)
.
গোধূলিলগ্নে বিষণ্ণ মনে দু’জন ভার্সিটি থেকে ফিরছে। কল্প ফার্নিচারের দোকানের সামনে এসে নেমে যায়। ইতি রিকশা নিয়ে চলে যায় বাসায়। শুক্র-শনিবার কল্পের অফিস বন্ধ থাকে। তাই সপ্তাহে দু’দিন সন্ধ্যায় একটা টিউশনিতে যায়। আজ আর পড়াতে গেল না সে। দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। এই মুহূর্তে কি করা দরকার ভেবে পাচ্ছে না৷ টাকা-পয়সা নিয়ে তার কোনো অসুবিধা হবে না সে জানে। কিছু টাকা জমেছে। চাকরিও আছে। জমি-জমা থেকে ফসল আসবে। এগুলো দিয়ে আপাতত ভালোই চলে যাবে। তাছাড়া বড়ো চাচা তো আছেনই। উনি চান নিজে দেশে এসে দুইহাতে খরচ করে তার বিয়ে দিতে। সাময়িক মনমালিন্য বাবার মন থেকে নিপাই বুঝিয়ে দূর করে দিয়েছে। এখন তার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক। সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাহিদ। ওকে তার কাছে বিয়ে দেবে কি-না কে জানে। ইতি অবশ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরাসরি জানিয়ে দেবে কল্পের কথা। সেও সম্মতি দিয়েছে। এখন দেখা যাক কি হয়। রাত আটটার দিকে ইতি তাকে মেসেজ দিয়ে জানায়, ‘এখন বাবা বাসায় ফিরেছেন, সরাসরি বলে দিতে যাচ্ছি। খুবই ভয় করছে জানো? তবুও বলে দেবো। ওরা যদি কথাবার্তা পাকা করে ফেলে তাহলে আবার বিয়ে ভা*ঙা কঠিন হয়ে যাবে। তাই আগেভাগেই সাহস করে বলে দেওয়াটা ভালো।’

মেসেজ দেখে কল্পেরও ভয়ে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়৷ দুরুদুরু বুকে রিপ্লাই দেয় ‘আচ্ছা বলে দাও, যা হবার হবে। প্রথমেই বলবে এখন বিয়ে করতে চাচ্ছ না, পড়ালেখা করতে চাও, এগুলো বলার পরও যদি চাপাচাপি করে তাহলে আমার কথা বলে দেবে। আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো।’

– ‘আচ্ছা এখন বাই, পরে কথা হবে।’

এরপর অন্ধকারে মোবাইল বালিশের পাশে রেখে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে সময় কাটায় তার। কি হচ্ছে এটা ভেবে বারবার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে৷ অন্ধকার হাতড়ে গিয়ে টেবিল থেকে পানি খেয়ে এসে আবার শুয়ে থাকে। এভাবে অস্থিরতার ভেতর দিয়ে দুইঘণ্টা চলে যায়। কিন্তু ইতি কোনো মেসেজ দেয় না। অধৈর্য্য হয়ে সে নিজেই মেসেজ দেয়, ‘ইতি কি অবস্থা? আপডেট কিছু জানাও আমাকে।’

সিন হয় না মেসেজ। ইতিকে অফলাইন দেখায়। কোনো অসুবিধা কি হয়েছে? না-কি এমনিতেই অফলাইনে? কিন্তু পুরো রাত গিয়ে ভোর হয়ে আসে। অনলাইনে আসে না ইতি। পরেরদিন অফিসে যাওয়ার আগে গেইটে দাঁড়িয়ে মুনার জন্য অপেক্ষা করে। হঠাৎ মনে পড়ে ওরা তো ইন্টারের পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছে৷ এখনও ভর্তি হয়নি ভার্সিটিতে। ম্লানমুখে কল্প অফিসে চলে যায়। খানিক পর পর মেসেজ চ্যাক করে দেখে ইতি সিন করেছে কি-না। প্রতিবারই হতাশ হয় সে। এভাবে অপেক্ষা করে তিনদিন। তারপর বুঝতে পারে কোনো অসুবিধা হয়েছে। রোজকার মতোই আজ অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। বাইরে গিয়েই গেইটের সামনে মুনাকে পায়। সে কোথাও যাচ্ছিল। হাত বাড়িয়ে ডাকে কল্প, ‘মুনা একটা কথা ছিল।’

মুনা রিকশা ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসে, ‘কি ভাইয়া?’

– ‘আচ্ছা ইতির কোনো খবর কি জানেন?’

– ‘না তো। বন্ধ হওয়ায় কারও সঙ্গে তেমন কথা হয় না।’

– ‘ও কিছুদিন থেকে অফলাইনে। কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না।’

– ‘তাই না-কি? হঠাৎ এরকম হবে কেন?’

– ‘হওয়ার অবশ্য কারণ আছে। ওর বিয়ের আলাপ এসেছিল। ফ্যামিলিকে আমার কথা যেদিন বলতে গেছে সেদিনের পর থেকেই অফলাইন।’

– ‘তাহলে তো সমস্যা।’

– ‘আচ্ছা আপনি কি একবার ওদের বাসায় যেতে পারবেন?’

– ‘আচ্ছা কাল একবার যাব। রুমকিকে নিয়ে যেতে হবে। আমি চিনি না ওদের বাসা।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। কালই যান তাহলে।’

মুনা মাথা নেড়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। কল্প চলে আসে অফিসে।

এখন ভোর। ক’টা বাজে ইতি জানে না। মা-বাবা তার প্রতি যতটুকু কঠোর হওয়া দরকার, সর্বোচ্চ হয়েছেন। তাদের ধারণা হয়তো মেয়ের চুড়ান্ত কিছু শাস্তি দরকার। তবেই ঠিক হয়ে যাবে৷ প্রেম-পিরিতের ভূ*ত মাথা থেকে নামবে। ইতির কষ্টও হয়, হাসিও পায়৷ জানালা খুলে এখন বাইরে তাকিয়ে আছে। পুরো রাত কেটে গেছে অনিদ্রায়। মা টেবিলে নাশতা রেখে দরজা লাগিয়ে চলে গেছেন। ইতির খেতে ইচ্ছা করছে না। সারাক্ষণ কল্পের কথা ভীষণ মনে পড়ে। আজ তিন-চার দিন হয়ে গেল মানুষটার সঙ্গে কথা বলতে পারছে না৷ সেদিন রাতে মা-বাবা বসে আছেন। ইতি গিয়ে বললো, ‘বাবা আমার কিছু কথা আছে।’

তিনি শার্ট আনলায় রেখে বললেন, ‘কি কথা?’

– ‘আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।’

হুস্না বেগম টিভি অফ করে বললেন, ‘কি বললি?’

– ‘বিয়ে করব না এখন। আমি পড়ালেখা করতে চাই।’

মুজিব উদ্দিন এগিয়ে এসে বিছানায় বসে নাক টান দিয়ে বললেন, ‘বিয়ে করবি না কেন? পড়ালেখার জন্য তাই তো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাহিদ তোকে ঢাকায় ভার্সিটিতে ভর্তি করাবে। বিয়ে করলেও পড়ালেখা করতে পারবি।’

– ‘আমি তাহিদকে বিয়ে করতে চাই না।’

– ‘কেন ওই বেজন্মার সঙ্গে কি এখনও তোর যোগাযোগ আছে?’

– ‘বাজে কথা বলবা না বাবা। ও গালি শোনার মতো এমন কিছুই করেনি।’

হুস্না বেগম চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

– ‘এক থা*প্পড় দিয়ে মুখে মুখে তর্ক বার করে দেবো। কি মনে করেছিস? কিছু বলিনি বলে ভাবিস না কিছুই বুঝে না মা। সব জানি আমি। বেশি বাড়লে ট্যাং ভে*ঙে বাসায় ফেলে রাখবো।’

– ‘মা অযথা চিল্লাচিল্লি করবা না। আমি সোজাসুজি আগেই বলে দিতে এসেছি। তোমরা বিয়ের পাকা কথা বললে অকারণ ঝামেলা হবে। তাই স্পষ্ট বলে দিলাম আমি বিয়ে করবো না।’

মুজিব উদ্দিন উঠে হঠাৎ ওর হাত ধরে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘হুস্না এই নাও এটা, আর দিবে না ওর কাছে।’

হুস্না বেগম মোবাইল মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বললেন, ‘শুধু মোবাইল কেড়ে নিয়ে কি হবে? ওর দিকে তাকিয়ে দেখো কোনো ডর-ভয় কি আছে? বাপ-দাদার মুখে চুনকালি মাখাতে কি এই মেয়ে দ্বিতীয়বার ভাববে মনে করো? দেখবা কালই পালিয়ে চলে গেছে। তাহিদকেই ওর বিয়ে করা লাগবে। ওরে এখনই এখানে বুঝিয়ে রাজি করাও।

– ‘মা আমি সব বুঝেই বলছি এই বিয়ে করবো না। আমাকে বুঝানোর কিছু নেই।’

হুস্না বেগম এসে ‘ঠাস’ করে ওর গালে চ*ড় দিয়ে চুলের মুঠি ধরে মুজিব উদ্দিনকে বললেন, ‘ওদের এতদিন যোগাযোগ ছিল, দেখেছো? তুমি না বলেছিলে কল্প এক ধমকে সোজা হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তাহলে তোমার মেয়ে এখন কেন ডাক্তার জামাই পেয়েও বিয়ে করছে না?’

– ‘শুধু কল্পের দোষ দিলেই কি হবে? তোর মেয়ে কি কম বাড়ছে? দেখলি না কল্পের হয়ে আমার সঙ্গে তর্ক ধরছে।’

‘খবরদার আমার সঙ্গে তুই-তোকারি করবা না’ বলেই হুস্না বেগম ইতিকে টেনে বিছানায় এনে বসিয়ে বললেন, ‘কেন বিয়ে বসবি না বল? কল্পের জন্য, তাই না? ওই ছেলের খবর কিছু জানিস? ওর তো জন্মেরই ঠিক নাই। ওর মাও ন*ষ্টা। তাহিদের মতো ছেলে থাকতে কল্পকে নিয়ে পড়ে আছিস কেন? আগে বয়স কম ছিল। যা ভুল করেছিস, তা অতীত। আমরা কি সেটা নিয়ে কখনও কিছু বলেছি? এগুলো বাদ দে। তাহিদকে বিয়ে কর। সুখে থাকবি।’

ইতি বিছানা থেকে উঠে যেতে যেতে বললো, ‘আমি বিয়ে করলে কল্পকেই করবো।

– ‘বেশি বাড়াবাড়ি করবি না বললাম।’

– ‘আমি শুধু বিয়ে করবো না বলতে এসেছি মা। তোমরাই বাড়াবাড়ি করেছো।’

হুস্না বেগম বিছানা থেকে উঠে আবার মেয়ের হাত ধরলেন, ‘তুই বাড়াবাড়ির দেখেছিস কি? তুই তাহিদকেই বিয়ে করবি। না হলে আমি জন্ম দিয়েছি তোকে। আমিই শেষ করে দিব। ইজ্জত মারবি তুই আর আমরা আঙুল চুষবো মনে করেছিস, তাই না? কল্পের নাম আর মুখে আনবি না কখনও।’

মুজিব উদ্দিন বিছানায় বসে বললেন, ‘ওর পড়ালেখা সব বন্ধ। বাইরে যাওয়াও বন্ধ। ওকে বন্দি করে রাখো৷ তাহিদের সঙ্গেও বিয়ে দেওয়া লাগবে না। ঘরের ভেতরে ওকে খাবার দিবা। দেখি কতদিন নাগরের ভূ*ত মাথায় থাকে।’

হুস্না বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘তাহিদকেই ওর বিয়ে করা লাগবে। ও কি বুঝে দুনিয়ার? আমরা তো ভালোর জন্যই বলছি। তাহিদকেই ওর বিয়ে করা লাগবে, এই কথার হেরফের হবে না।’

ইতি নিজের হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলে,

– ‘তোমরা কি এখন জোর করে বিয়ে দেবে আমাকে?’

হুস্না বেগম আরেকটা থা*প্পড় দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আর না দিতে পারলে হাত-পা ভে*ঙে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো৷ তবুও ওই ছেলের কাছে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবো না।’

হইচই শুনে নীলা এবং ফরিদ সাহেব এলেন। মুজিব উদ্দিন বললেন, ‘হুস্না ওকে উত্তরের রুমে তালা মেরে রাখ নিয়ে। ওখানে খাবার দিবি। যদি কোনোভাবে ও বাইরে যায় তোমরা কেউ আর বাড়িতে থাকতে পারবা না। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবা ওরে। সারাদিন কি করো বাসায়? মেয়ে কি করে তার খেয়াল থাকে না।’

ফরিদ সাহেব এসে ইতির হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বললেন, ‘আরে কি হয়েছে? তোমরা মেয়েটার সঙ্গে এমন করতেছো কেন?’

হুস্না বেগম রূঢ় গলায় বললেন, ‘বাবা তোমার প্রশ্রয় পেয়ে ও আরও খারাপ হয়েছে। আর তুমিই যুবতী মেয়ে ঘরে রেখে বাইরের একটা ছেলেকে বাসায় জায়গা দিয়েছিলে।’

– ‘এগুলো কি বলো বউমা!’

মুজিব উদ্দিন বললেন, ‘বাবা তুমি তোমার রুমে যাও তো। এসব বুঝবে না তুমি৷ অকারণ এখানে নাক গলাতে এসো না।’

‘আচ্ছা যা ইচ্ছা কর তোরা। আমার কি, তোদের মেয়ে।’ কথাটা বলে ফরিদ সাহেব চলে গেলেন।

মুজিব উদ্দিন এবার নীলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর নীলা, তোমাকেও একটা কথা বলি। তুমি ইতির চাচি, বান্ধবী না, তাই বলছি চাচির মতো থাকবা। তোমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মেয়ে এতকিছু করেছে। তুমি কি জানতে না।’

হুস্না বেগম সুযোগ পেয়ে বললেন, ‘জানলে কি আর তোমাকে বলবে? পারলে আরও এগিয়ে দিবে। সে নিজেই তো এরকম ছিল। আমার মেয়ে কি এমনি এমনিই নষ্ট হয়ে গেছে? সঙ্গদোষের চাক্ষুষ ফল এগুলো।’

নীলা আহত নয়নে তাকিয়ে রইল। হুস্না বেগম সেদিনই ইতিকে টেনে এনে উত্তরের রুমে রেখে বাইর থেকে দরজা তালা দিয়ে চলে যান। রোজ খাবার এনে দিয়ে একগাদা কথা বলেন, বুঝানোর চেষ্টা করেন। শেষপর্যন্ত ইতির নির্লিপ্ত ভাব দেখে আবার রেগে দরজা তালা মেরে চলে যান।

বিকেলে মুনা এবং রুমকি বিজনতা হাউজের সামনে এসে রিকশা থেকে নামে। গেইট খুলে উঠান পেরিয়ে বারান্দার কাছে আসতেই লতিফার সঙ্গে দেখা হয়। সে দরজা খুলে না দিয়ে বললো,

– ‘কে আপনেরা কাকে চান?’

– ‘ইতির বান্ধবী আমরা। ওর কাছে এসেছি।’

লতিফা ভালোভাবে তাকিয়ে বললো, ‘ও আচ্ছা দাঁড়ান’ বলে হুস্না বেগমকে বললো। তিনি এসে দরজা খুলে নিজের রুমে নিয়ে বসালেন। রুমকি সোফায় বসে আমতা-আমতা করে বলে, ‘আন্টি ইতি কোথায়?’

হুস্না বেগম আন্তরিক গলায় বললেন, ‘কখনও আসো না তোমরা। আজ এলে অথচ ইতি ছুটি কাটাতে গিয়ে বসে আছে ওর নানাবাড়ি।’

মুনা আমতা-আমতা করে বললো, ‘ওকে ফোনেও তো পাই না আন্টি।’

– ‘আর বলো না৷ ফোন হারিয়ে ফেলেছে গিয়ে। তোমরা বসো চা-টা খাও। এই লতিফা তাদের নাশতা দে।’

রুমকি আর মুনা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললো, ‘থাক আন্টি আমরা এখন যাই। অন্যদিন আসবো।’

– ‘কি বলো কিছু খাবে না?’

‘না আন্টি, এখন যাচ্ছি’ বলেই তারা উঠে যায়। হুস্না বেগম গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দেন তাদের।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here