মায়াডোর,৩১ পর্ব (শেষাংশ)
দু’জন বাসে এসে উঠেছে। চারপাশে মানুষে গিজগিজ করছে৷ ইতির গরম লাগছে, মাথা ব্যথাও করছে। জানালা খুলে দিলে ভালো হতো৷ কিন্তু বাইরে প্রচুর ধুলোবালি উড়ছে। বিরক্ত হয়ে কল্পকে বললো,
– ‘বাস কখন ছাড়বে?’
– ‘এইতো ছেড়ে দেবে।’
– ‘মাথা ব্যথা করছে আমার। বাসস্ট্যান্ড এত বিরক্তিকর জায়গা। মানুষ গিজগিজ করবে। রাস্তা ভাঙা থাকবে। ধুলোবালি উড়বে আর সবাই চেঁচামেচি করবে। এই নাম হলো বাসস্ট্যান্ড।’
কল্প হেঁসে এক হাতে ইতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে মাথা টিপে দিতে দিতে বললো, ‘এত রেগে যাচ্ছ কেন? এইতো বাস ছেড়ে দেবে।’
– ‘আপনি বুঝতে পারছেন কিছু? বাবা দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে নিশ্চয়। আর ওরা প্রথমেই রেলস্টেশন আর বাসস্ট্যান্ডে আসবে।’
– ‘হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক বলেছো। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই। এলে আর কি করার। সিনেমার নায়কদের মতো ফাইট করে নায়িকাকে নিয়ে পালাতে হবে।’
– ‘রসিকতা করছেন কেন? ভয় লাগছে না? আপনি না অনেক ভীতু ছিলেন?’
– ‘কে বললো ভীতু ছিলাম? আমি সব-সময়ই সাহসী ছেলে।’
ইতি পেটে চিমটি দিয়ে বললো, ‘এহ, ভূ*তের ভয়ে একেবারে মিলিয়ে যাচ্ছিলেন মনে আছে? শেষে দয়া করে আর ভয় দেখাইনি।’
কল্প হেঁসে বললো, ‘তোমার কি গরম লাগছে? জড়িয়ে ধরায় অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
ইতি বুকে আরও নিবিড় হয়ে ‘ওম-ওম’ গলায় বলে, ‘উহু, আপনার বুক অনেক ঠাণ্ডা।’
– ‘তাই?’
– ‘হ্যাঁ।’
কল্প কপালের পর ঘাড় টিপে দিতে দিতে বললো, ‘ভালো লাগছে? মাথা ব্যথা কি বেশি করছে?’
– ‘সারাদিনই অল্প অল্প ছিল, এখানে এসে বেড়েছে।’
– ‘ওষুধ আনি গিয়ে?’
– ‘বকবক করবেন না তো, এভাবে ধরে বসে থাকুন।’
– ‘আচ্ছা।’
বাস চলতে শুরু করেছে। সিলেট নগরী পেছনে ফেলে বাস এসে উঠেছে মহাসড়কে। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি গাছ। এরপর আদিগন্ত খোলা সবুজ মাঠ, একটা সাদা গাভীর কাঁধে কাক এসে উড়ে বসেছে। দূরে কোথাও থেকে বয়স্ক গলার আজানের সুর ভেসে আসছে। আছরের আজান। সূর্যের আলোর হিং*স্রতা ক্রমশই কমতে শুরু করেছে, পৃথিবী এখন কোমল আলোয় আলোকিত। কল্প এক হাত বাড়িয়ে জানালা খুলে দেয়। বাতাসগুলো যেন অপেক্ষায়ই ছিল ইতির চুল এলোমেলো করে দেয়ার জন্য। হুড়মুড় করে এসে ওর চুল উড়িয়ে এনে তার মুখ ঢেকে দিল। কল্প ইতির চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে বাইরে তাকায়। নীল আকাশে ছোপ-ছোপ শুভ্র মেঘ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ইতি বুক থেকে বললো, ‘ইয়ারফোন আছে আপনার সঙ্গে?’
– ‘তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?’
– ‘কেন?’
– ‘ঘুম ঘুম গলায় কথা বলছো যে।’
– ‘এতদিন ঘুম আসেনি। এখন আসবে।
– ‘এতদিন আসেনি কেন?’
– ‘আমার ‘ঘুম ভাঙানিয়া’ আমারে কয় এতদিন ঘুম আসেনি কেন?’
কল্প হাসতে হাসতে বললো, ‘এত সুন্দর সুন্দর বিশেষণ তোমার মাথায় কোত্থেকে উদয় হয়?’
– ‘শব্দটা রবীন্দ্রনাথের একটা গানের। আর ওই গানটা এতদিন আমার সঙ্গে ভীষণ মিলতো।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ গানের “ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া” কিংবা “ওগো দুখজাগানিয়া” তো আমার জন্য আপনিই।’
– ‘আমি তাহলে দুঃখও দিয়েছি?’
– ‘সীমাহীন।’
– ‘তাই না-কি? জানতাম না তো।’
– ‘জানতে হবে না৷ এখন গান শুনি। আমার কানে ইয়ারফোন দিয়ে ওগো ঘুম ভাঙানিয়া গানটা ছাড়ুন।’
– ‘আচ্ছা ছাড়বো একটু পর। তুমি আগে একটা কথা বলো তো। অনেক্ষণ থেকেই ভাবছি। আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা হিসাবে ভাগ্যবান না-কি, দুর্ভাগা। তোমার কাছে কি মনে হয়?’
– ‘এখন বলতে পারি ভাগ্যবান।’
– ‘কেন?’
– ‘আমাদের বিপদ-আপদ যাইই এসেছে। কিভাবে যেন সবই সহজে কেটে গেছে। আর ফাইনালি আমরা একে অন্যকে পেতে চলেছি।’
– ‘তাই?’
– ‘হ্যাঁ, আপনার জবরুল ইসলামের দেশলাই পড়েছিলাম আমি। ইলি আর রাফসানের ভাগ্যটা দেখুন। কি দুর্ভাগা দু’জন। এত ভালোবেসেও কেউ কাউকে পেল না। গল্পেও এরা বাস্তবতার বেরসিক বাঁধা থেকে রেহাই পায়নি। লেখক তার কল্পনার রঙ তুলিতে এসব জটিল, কঠিন সমস্যা মুছে সুন্দর জীবন দিতে পারেনি। আর আমরা? আমরা এই বাস্তব জীবনের মানুষ হয়েও, কঠিন পৃথিবীতে থেকেও পেয়ে গেছি গল্পের মতো সুন্দর রঙিন জীবন।’
– ‘তা অবশ্য ঠিক বলেছো। এইযে বাসস্ট্যান্ডে ছিলাম। তখন হুট করে তোমার বাবা চলে আসতে পারতেন। এসে ধরে নিয়ে যেতে পারতেন। আমরা যত সমস্যায় পড়েছি সবকিছু কিভাবে যেন সহজভাবে সমাধান হয়ে গেছে।’
– ‘আপনারর জবরুল ইসলামের গল্প হলে ঠিকই এই ঝামেলাটা হতো। এই ব্যাটা নিরাশাবাদী লোক। এরকম মানুষ খুবই বিরক্তিকর৷ এরা ইতিবাচক চিন্তা করতেই পারে না৷ তাদের চোখে এই পৃথিবী খুবই জটিল। সবাই ব্যর্থ, সবাই দুঃখী। ব্যাটার গল্প পড়ে ভয় পেতাম৷ তোমাকে পাব কি-না এই ভয়।’
– ‘বারবার ‘আমার জবরুল ইসলাম’ বলছো কেন? আমার হলো কিভাবে?’
– ‘তোমারই তো। সব লেখা পড়ো।’
– ‘তা তুমিও পড়ো, তাহলে কি তোমার?’
– ‘ধ্যাৎ।’
তখনই কল্পের মোবাইলটা বেজে উঠে। পকেট থেকে বের করে দেখে নিপা। কল্প আমতা-আমতা করে বলে, ‘এতক্ষণ কি খুশিই না ছিলাম। এখন কল রিসিভ করতে ভয় লাগছে৷ যদি নেগেটিভ কিছু হয়?’
– ‘নেগেটিভ কি?’
– ‘ধরো পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছি শুনে চাচা রেগে গেলেন। বললেন তাদের বংশের মান-ইজ্জত ন*ষ্ট করে দিচ্ছি৷ তোমাকে নিয়ে যেন বাড়িতে না যাই। তাহলে তো ঝামেলায় পড়ে যাব।’
– ‘ভয় দেখান কেন। আর কোনো ঝামেলা সহ্য করতে পারবো না। পেয়ে গেছি ভাবতে ভালো লাগছে।’
– ‘একটু আগে ওই লেখককে বকাঝকা করেছো। যদি ওর উপন্যাসের মতো ঝামেলা হয় চিন্তা করো। পেতে পেতে যদি হারিয়ে ফেলি?’
– ‘ধ্যাৎ আপনি কি ফাজলামো করছেন? ভয় দেখাচ্ছে না-কি?’
– ‘আরে না, আমারও ভয় করছে। কারণ চাচার মেনে নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। উনি মেনে নিলে আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। ছোটচাচা সবকিছু দায়িত্ব নিয়ে করবেন৷ আমরা আপাতত বাড়িতে থাকতে পারবো।’
– ‘আচ্ছা রিসিভ করেন আল্লাহর নাম নিয়ে।’
কল্প কল রিসিভ করলো। ইতি চোখ বুঝে মোনাজাতের ভঙ্গিতে মুখ ঢেকে আছে। ফিসফিস করে বলছে, ‘আল্লাহ ওই ব্যাটা লেখককে বকাবকি করে ভুল করেছি৷ আমাকে মাফ করে দাও। এই ব্যাটার ছায়া যেন আমাদের জীবনে না পড়ে। আমাদের সবকিছু যেন সুন্দরভাবে হয়।’
কল্প তাকে ধাক্কা দিতেই ইতি চমকে উঠে তাকিয়ে বলে, ‘কি?’
– ‘নিপা তোমার সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলতে চায়।’
ইতি তাড়াতাড়ি ওড়না টেনে মাথায় দিয়ে সম্মতি দেয়। কল্প ওর কানে একটা ইয়ারফোন গুঁজে দিল। নিপা ভিডিও কলে সালাম দিয়ে মুখ টিপে হেঁসে বললো,
‘কেমন আছেন পিচ্চি ভাবি?’
ইতি লজ্জা লাল হয়ে মোবাইল কল্পের কাছে দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। কল্প হাসতে হাসতে বলে, ‘নিপা লজ্জা পেয়েছে ভাবি ডাকায়। তাও পিচ্চি ভাবি বলেছো।’
– ‘ও আচ্ছা বুঝেছি, থাক পরে কথা হবে। আর আমি ছবি দেখেছি, না দেখেই বলেছিলাম না কিউট হবে অনেক? আমার ধারণাই ঠিক।’
– ‘তাই?’
– ‘হ্যাঁ তাই, সত্যিই কিউট। তবে তোমার রেকর্ডে যে বলেছিলে বন্দি ছিল। ভিডিও কলে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কেমন রোগা রোগা লাগছে।’
– ‘হ্যাঁ, খুবই প্রেশারে ছিল। ওরা অন্য জায়গায় জোর করে বিয়ে দিতে চাইছিল।’
– ‘ডে*ঞ্জারাস মা-বাবা। রেকর্ড আমি মা’কেও শুনিয়েছি। বাবা এখনও ঘুমে। উনি উঠলে সব বুঝিয়ে বলবো। কোনো চিন্তা করো না ভাইয়া।’
– ‘চাচা রা*গারা*গি করলে কি করবো? আমি তো বাড়িতে যাচ্ছি ইতিকে নিয়ে।’
– ‘হ্যাঁ যাও, বললাম না এসব নিয়ে না ভাবতে। মাও বলেছেন তুমি তোমার মতো জীবন শুরু করতে। আমরা সব সময় তোমার পাশে আছি৷ তুমি নিজেকে একা ভাবো কেন বলো তো। বাবা সব সময় তোমাকে নিয়ে ভাবেন।’
কল্পের চোখ ভিজে আসে। বুকটা ভরে এলো সাহসে। নিপা পুনরায় বলে, ‘আমরা কিন্তু বাংলাদেশের সব খবরও রাখি। তুমি এই বয়সে পডালেখা করে জব করছো৷ নিজের জমি-জমা বুঝে নিয়েছো। শুনেছি কার কাছে অটোরিকশা ভাড়া দিয়েছো। জানো বাবা এসব শুনে ওইদিন একা একা কেঁদেছেন? তুমি না-কি একদম বড়ো চাচার মতো হয়েছো।’
সে ইতস্তত করে বললো, ‘নিপা আমরা এখন বাসে আছি তো৷ বাসায় ফিরে কল দেবো।’
– ‘আচ্ছা, আর শোনো, কোনো চিন্তা করো না৷ বাবা উঠলে তোমার মামাকেও কল দিতে বলবো। চাচিকেও কল দেবে বাবা৷ রেকর্ড আমি শুনেছি। তোমার আম্মুও রাজি না বলেছিলে। বাবাকে বলবো আমি৷ উনি সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করাবেন।’
কল্প কিছু না বলে কল কেটে দেয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। কল্পের চোখ ছলছল করছে। নিপাকে কিছু একটা বলতে ইচ্ছা করছে। কি বলবে? কি বলা দরকার। কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। তবুও হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে টাইপ করে, ‘তুমি এত ভালো কেন নিপা?’
তারপর আবার কেটে দেয়। নিপা বাংলায় কথা বলতে পারলেও পড়তে পারে না।
সে পুনরায় টাইপ করে,
‘tumi Atho valo ken nipa? tumi amar jonno ja korcho tar jonno ami chirokritoggo takbo..”
নিপা ওপাশ থেকে মেসেজ দেয়,
‘sob manush E tar familyr jonno valo hoy vhaiya. Tumi amar uncle er chele. Amar bhai. Amader bodyte ekei blood. Ami tumar jonno egulu korbo na kn? Koratai thoo normal, tai na?’
কল্প আর কিছু বললো না। ওর মেসেজে লাভ রিয়েক্ট দিয়ে ইতির দিকে তাকায়। ইতি আমতা-আমতা করে বলে, ‘ওরা তো অনেক ভালো মনে হচ্ছে, তাহলে নানাবাড়ি থাকতে কেন তুমি?’
কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘মায়া, এখানে মা যখন নিয়ে এলেন। তখন নানা-নানিকে পেলাম। মা’র বিয়ের পর চাচারা নিতে চাইলেও যাইনি ওদের রেখে।’
– ‘তোমার নানি-নানি মারা যাওয়ার পর?’
– ‘সুপ্তি আপু ছিল। কেন যেন নানাবাড়ি থাকতেই ভালো লাগতো।’
– ‘বুঝেছি।’
আবার চেঁচিয়ে উঠে মোবাইল। শ্রেয়া কল দিয়েছে। কল্প রিসিভ করে।
– ‘হ্যালো ভাইয়া, কেমন আছো?’
– ‘ভালো, তোমরা কেমন আছো?’
– ‘ভালো আছি, আচ্ছা ভাইয়া ইতি আপু কোথায়? তোমার সঙ্গে আছে তো?’
– ‘হ্যাঁ, আমরা এখন দরবেশ পুর যাচ্ছি। মানে আমার বাবার বাড়িতে।’
– ‘ও বুঝেছি। আচ্ছা ভাইয়া যাও। তোমরা বিয়ে করবে কবে?’
– ‘আগে যাই, মা তো রাজি হয়নি। মামাও হবে না জানি। এখন দেখি চাচারা কি করেন। তারা মেনে নিলে তাদের কথামতো বিয়ে করবো।’
– ‘মা’র কথা চিন্তা করো না ভাইয়া। আমি তাকে রাজি করিয়েই ছাড়বো। আর হ্যাঁ আমি অবশ্যই সিলেট আসবো।’
– ‘তাই?’
– ‘হ্যাঁ, তোমার বিয়েতে আসবো না আমি?’
– ‘তোমার বাবা কি দিবে আসতে? দিলে তো ভালো।’
– ‘না দিলেও আসব।’
– ‘তাই না-কি? অবশ্য বড়ো হয়ে গেছো তুমি। এবার এসএসসি দেবে৷ আসতেই পারো একা।’
– ‘আচ্ছা ভাইয়া তোমার বাবার বাড়ির লোকেরা আমাকে দেখলে কি করবে?’
– ‘কি করবে মানে কি?’
– ‘থাক বুঝাতে পারবো না, ফোন রাখি। আমি দেখি ওদের রাজি করাতে পারি কি-না।’
কল্প ‘আচ্ছা’ বলে মোবাইল পকেটে রাখে।
.
সন্ধ্যায় সিদ্দিক সাহেব সোফায় বসে আছেন৷ শ্রেয়া চা নিয়ে গিয়ে সামনের সোফায় বসে বললো, ‘বাবা আমার একটা কথা আছে।’
– ‘কি কথা?’
– ‘তুমি কি জানো তুমি খুবই জ*ঘন্য একটা মানুষ।’
সিদ্দিক সাহেব চায়ের কাপ হাত থেকে রেখে ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কি বলিস মা?’
– ‘বাবা তুমি কাকে কি শর্ত দিয়ে বিয়ে করেছো সেটা তোমার আর তার ব্যাপার, আমার না।’
– ‘মানে কি?’
– ‘তুমি আমার ভাইকে আমার থেকে আড়াল রাখতে পারো না। তোমরা দু’জন আমার থেকে আমার ভাইকে আড়াল করে রেখেছো। এটা কি জ*ঘন্য কাজ না?’
– ‘কি বলছিস এগুলো?’
– ‘কি বলছি তুমি জানো না? কল্প ভাইয়া আর আমি একই মায়ের সন্তান না? বাবা আলাদা হলেও আমরা একই মায়ের গ*র্ভ থেকে এসেছি। তবুও কিভাবে পারলে আমার আপন ভাই থেকে আমাকে দূরে রাখতে? আমার ভাই আছে অথচ আমি জানি না৷ এটা কেমন কাজ হয়েছে?’
– ‘এগুলো তোমাকে কে বলেছে?’
– ‘কে বলেছে তা দিয়ে কাজ নাই তোমার। তুমি মা’কেও বাধ্য করেছো আমাকে এসব না বলতে৷ তোমার মা’র কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত এসবের জন্য। বেচারি সন্তানকে রেখে তোমার সংসার করতে হয়েছে।’
– ‘শ্রেয়া পাকনামি বেশি হচ্ছে কিন্তু। তোমার মা’র সঙ্গে আমি জোরাজুরি করিনি। ওরাই ছেলে গোপন রেখে বিয়ে দিয়েছিল। পরে আমি জানার পর যে তোমার মা’কে ছেড়ে দেইনি এটাই তো অনেক।’
– ‘যাইহোক তোমাদের ক্যাচালে আমি নাই। আমারটা আমাকে বুঝাও। আমার আপন ভাই থেকে আমি দূরে আছি কেন? আমার অপরাধটা কি?’
– ‘ও তোমার আপন ভাই না।’
– ‘ও আর আমি একই মায়ের সন্তান বাবা। তোমাদের ইচ্ছা মতো আমি চলবো না। তোমার প্রতি আমার যে টান, সেটা আমার ভাইয়ের প্রতিও আছে। আমার ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি চাই কাল সিলেট যেতে। এখন মা’কে তুমি সঙ্গে দিবে কি-না ঠিক করো। কারণ তোমরা কেউ না গেলেও আমি ঠিকই যাব। আর তুমি আমাকে আটকাতে পারবে না বাবা৷ জোর করে আঁটকে রাখতে চাইলে রেখে দিয়ো। তাহলে আরও ক্লিয়ার হয়ে যাব আমার বাবা কেমন।’
কথাটা বলেই শ্রেয়া উঠে চলে গেল। সিদ্দিক সাহেব ‘হা’ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
রাত ন’টার দিকে কল্প আর ইতি দরবেশ পুর এসেছে। বাস থেকে নেমে শ্রেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কেনা-কাটাও করেছে। বাড়িতে সিএনজি নিয়ে যখন এলো। তখন ছোটচাচা আর চাচি এগিয়ে এলেন। ইতি দু’জনকে সালাম করে। তারা ইতিকে দোতলায় নিয়ে কল্পের রুমে বসালেন। কল্পের বুঝতে আর বাকি রইল না বড়চাচা সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন। তাদের রুমে বসিয়ে রেখে সবাই চলে গেলেন। মিনিট বিশেক পর কাজের মেয়ে এসে নাশতা দিয়ে যায়। দু’জন নাশতা করার একপর্যায়ে ইতি বললো, ‘এই রুম তোমার?’
– ‘হ্যাঁ, উপর আমার। তিনটা বেডরুম আছে। দু’টা বাথরুম আর একটা কিচেন।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘দিনে এই জানালা খুলে আশপাশ দেখতে পারবে।’
– ‘আমি কি এখানেই থাকবো বিয়ের পর?’
– ‘আরে না, আগে বিয়ে হোক। এরপর আমি গিয়েই বাসা দেখবো। এক সঙ্গেই থাকবো শহরে। জব পড়ালেখা সবই তো আছে। আর তোমারও তো ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হবে না।’
এভাবে গল্প করতে করতে দু’জন নাশতা শেষ করে। কল্প বিছানায় এসে শুয়ে বললো, ‘তুমি চাইলে এখন বাথরুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করতে পারো।’
– ‘থাক একেবারে কাল করবো।’
– ‘চেয়ারে বসে আছো কেন? বিছানায় আসো।’
– ‘পাগল না-কি? বাড়ির মানুষ কি বলবে? আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি।’
– ‘ও হ্যাঁ তাইতো৷ আজ তো আমাদের এক রুমেও থাকতে দেবে না।’
– ‘তা তো দেবে না। আর আমার ভীষণ লজ্জা করছে। সবাই খারাপ ভাবছে নিশ্চয়।’
দরজায় তখনই নক পেল কল্প। ভেজানো দরজা গিয়ে খুলে দেখে তার ছোট চাচি। তিনি আমতা-আমতা করে বললেন, ‘তোমার চাচা ডাকে।’
কল্প নিচে নেমে সিটিং রুমে যায়। মাহফুজ সাহেব তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘বসো, তোমার মামাকে কল দিয়েছিলাম। উনি রাগারাগি করে কল রেখো দিলেন।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘ওরা তোমার মামার আত্মীয় তাই না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘উনাকে ম্যানেজ করো। তাহলে মেয়ের বাপের বাড়ির সঙ্গে কথা বলা যাবে।’
তখনই মাহফুজ সাহেবের ফোন বেজে উঠে। অচেনা নাম্বার। তিনি রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে মেয়েলি গলায় সালাম দিল। তিনি রিসিভ করে বললেন,
– ‘কে বলছেন?’
– ‘আমি সুপ্তি। কল্পের মামাতো বোন।’
– ‘ও আচ্ছা, বলো তো মা।’
– ‘মামা, আমি বাবাকে বুঝিয়েছি। উনি কাল যাবেন আপনাদের বাড়িতে। বিয়ের ব্যবস্থা করেন।’
– ‘আলহামদুলিল্লাহ, আচ্ছা উনার কাছে মোবাইল দাও।’
সুপ্তি বাবার কাছে মোবাইল দেয়। মাহফুজ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ‘তালতো ভাই, এত রেগে কি করবেন। এখন তো একটা সমাধান করতেই হবে।’
– ‘বেকুবের বাচ্চা করছে কি মাহফুজ। তারে আমার মামার বাসায় দিলাম পড়তে। সে এখন মেয়ে বাগিয়ে নিয়ে চলে গেছে। আমাকে এখন ওরা কি বলবে?’
– ‘শোনো মোস্তাক ভাই। আমার ভাতিজি নিপা কল দিয়েছিল। সবকিছু শুনেছি। মেয়েকে ওরা বন্দি করে রেখেছিল। জোর করে ডাক্তার এক ছেলের কাছে বিয়ে দেবে। তারপর মেয়ে হুট করে পালিয়ে না-কি কল্পের কাছে এসেছে৷ কিন্তু কল্প তো বিয়ে করেনি। তার মা’কে কল দিয়েছে। নিপার মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এখনও চায় মেয়ের মা-বাবা রাজি হয়ে এসে বিয়ে দিক। তাকে দোষে এখন কি হবে? ভুল যা করার আগেই করে ফেলেছে। সেসব বাদ দাও। ভাইসাব তোমাকে কল দিবেন একবার। আমাকে বলেছেন তোমার সঙ্গে কথা বলতে। মেয়ের বাপের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে।’
– ‘আমি পারবো না ভাই যোগাযোগ করতে।’
– ‘তোমার আত্মীয় হিসাবে করো যোগাযোগ। না-কি আমাকে করতে হবে?’
– ‘আমি ভাই এসবে নাই। আমি কাল আসবো। আমার দায়িত্ব যতটুকু করবো।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
ফোন রেখে দিলেন মাহফুজ সাহেব। তারপর কল্পের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি করবে এখন? নিপা বললো তুমি সবাইকে নিয়ে বিয়ে করতে চাও তা কি সম্ভব? মেয়ের মা-বাবা মানবে মনে হয়?’
– ‘আচ্ছা চাচা আমি দেখছি। আমিই একবার ওদের সঙ্গে কথা বলবো।’
মোস্তাক সাহেব আবার নিজ থেকেই কল দিলেন। মাহফুজ সাহেব রিসিভ করলেন,
– ‘কি ভাই?’
– ‘বে*কুবের বা*চ্চা তো আমারেই বে*কুব বানিয়ে ফেললো।’
– ‘তা তো বানিয়েছেই, এখন কি করবে বলো।’
– ‘আচ্ছা আমি কল দিচ্ছি। আমাকে মেয়ের বাবা আছরের সময় কল দিয়েছিল।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, দিয়ে বললো তাদের মেয়েকে পাচ্ছে না। কল্পের কাছে গেছে। আমি এসব জানি না বলে ফোন রেখে দিছি। আর কল দেয়নি। এখন কল দিব মামার কাছে।’
– ‘ওকে তাই করো। ওরা কেউ এলে আমরা কাজি এনে বিয়ে পড়িয়ে দিলাম।’
– ‘আচ্ছা রাখছি।’
মাহফুজ সাহেব কল রেখে বললেন, ‘এখন দেখি কি হয়। তুমি খাওয়া-দাওয়া করে পূবের ঘরে চলে যাও। মেয়ের কাছে অন্যকেউ থাকবে।’
কল্প মাথা কাত করে। রাতের খাবার ইতিকে রুমে দেয়া হয়েছে। কল্পকে খেতে হয়েছে বাড়ির সবার সঙ্গে। খাবার শেষে উপরে গিয়েছিল। একান্তে কিছু কথা বলে পূবের ঘরে যাবে। কিন্তু রুমে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে ইতির কাছে তার চাচি বসে আছেন। সে মলিন মুখে, বিষণ্ণ মনে চলে গেল পূবের ঘরে। ইতির মোবাইলও নাই, আর কোনো কথাও হলো না। একা রুমে অনেক কিছুই ভেবেছে৷ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো মামা হয়তো নানাভাইকে কল দিয়েছেন। সেও তো দিতে পারে। লজ্জা ভে*ঙে কল দিয়েই ফেললো সে।
.
ভোরে ফরিদ সাহেব মুজিব উদ্দিনের রুমে গিয়ে দরজায় নক করলেন। দরজা খুলে দিলেন হুস্না বেগম।
– ‘নির্বোধের বাচ্চা এখনও ঘুমাচ্ছে না-কি? রাতে এত বুঝাইলাম। তার মাথায় কি ঢুকে না।’
– ‘বাবা আমরা দরজা বন্ধ করে ঘুমাইনা। মুখ লুকিয়ে থাকি।’
– ‘এসব লুকোচুরি বাদ দাও। ছেলেটা আর কি করবে? তোমার মেয়ে পালিয়ে গেছে। সে এখনও তার মুরব্বি দিয়ে কল দেওয়াচ্ছে। আমাকেও রাতে কি বলেছে জানো?’
– ‘ওর কথা শোনার ইচ্ছা নাই।’
– ‘ইচ্ছা নাই তবুও শোনো, বলেছে তোমরা যদি চাও সে এখনও ইতিকে বুঝিয়ে বাড়িতে দিয়ে যাবে। এরপর দুই পরিবার মিলে বিয়ে হলো।’
‘বাবা এত ভালোমানুষি দেখাতে হবে না তার। যে মেয়ে চলে গেছে তাকে আর লাগবে না আমাদের।’ বলেই দরজা বন্ধ করে দিলেন হুস্না বেগম।
ফরিদ সাহেব আবার দরজায় নক করলেন। মুজিব উদ্দিন দরজা খুলে দিলেন।
– ‘কি হয়েছে বাবা?’
– ‘পড়ে পড়ে ঘুমালেই কি হবে?’
– ‘এখন কি করবো?’
– ‘চল, ওদের বিয়ে দিয়ে আসি।’
– ‘বাবা তুমি চাইলে যাও। আমি যাব না।হুস্না, বাবাকে ইতির কার্ড-টার্ড যা আছে দিয়ে দে। বিয়েতে লাগতে পারে। আমি এই মেয়ের লগে নাই।’
হুস্না বেগম কার্ড এনে দিলেন। ফরিদ সাহেব খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, ‘তাহলে তুই যাচ্ছিস না?’
– ‘না বাবা, তুমি গেলেই তো হবে। তুমি যাও।’
‘আমি তো যাবোই, জামাই এমনিতেই আমার পছন্দ হয়েছে’ বলে ফরিদ সাহেব করিডরে চলে এলেন। নীলা বের হয়ে বললো, ‘বাবা তুমি কি যাবে?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘বাবা ইতি তো বন্দি ছিল। তাই সে জানে না ওর চাচা যে দেশে আসবেন। ওকে বইলেন আপনি।’
– ‘তুমিই চলো আমার সাথে। নিজেই বললে। মা নেই চাচি থাকলো বিয়েতে।’
– ‘না বাবা। ইতিকে বলবেন আমাকে রাতে কল দিতে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে৷’
ফরিদ সাহেব রুমে গিয়ে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরলেন। সাদা দাড়ি আঁচড়ালেন। কালো সু-জুতা পরলেন। দাড়িতে আর বগলে আতর দিলেন। তারপর লাঠি হাতে নিয়ে মুজিব উদ্দিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যে যার কাছে সুখ পায় তার কাছে চইলা গেছে। দুই দিনের দুনিয়ায় সুখ হইল বড়ো কথা। ফরিদ উদ্দিন তোদের মতো দরজা বন্ধ কইরা বইসা থাকার লোক না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। গেলাম।’
তিনি গ্রিলের দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন।
.
সিদ্দিক সাহেব মুনিয়া এবং শ্রেয়াকে ভোরে বাসে তুলে দেয়ার আগে বললেন, ‘তোমরা পারবে তো যেতে?’
মুনিয়া বেগম বাস কাউন্টারের সামনেই স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। সিদ্দিক সাহেব বিব্রত হয়ে বললেন, ‘আরে কি করছো লোকে দেখছে তো।’
– ‘তুমি এত সহজে শ্রেয়াকে সহ কল্পের বিয়েতে যেতে দেবে ভাবিনি। আমি যেতে পারবো সমস্যা নেই৷ মোস্তাককে বাস থেকে নেমে কল দেবো।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। মেয়ে তাকিয়ে আছে, ছাড়ো এবার।’
হুস্না বেগম স্বামীকে ছেড়ে বিদায় নিয়ে বাসে উঠে গেলেন।
.
বারান্দার উত্তর পাশ দিয়ে সিঁড়ি৷ কল্প সিঁড়ি দিয়ে উপরে এলো। উপরে এসে বারান্দা৷ কল্প বারান্দা দিয়ে তার রুমের পর্দা ফাঁক করে দেখে ইতি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখেই চমকে উঠে প্রথমে। তারপর এসে বুকে উপর্যুপরি কি*ল-ঘু*সি দিয়ে বললো, ‘এখন সময় হয়েছে আসার?’
– ‘বাড়ির লোকেরা কি ভাববে? তাছাড়া একা পেলাম কই তোমায়?’
– ‘তাই বলে দশটায় আসবে?’
– ‘ঘুম থেকেই দেরিতে উঠেছি। তা জানালায় দাঁড়িয়ে কি দেখছো।’
– ‘কি আর দেখবো, গাছগাছালি দেখছি।’
– ‘আশেপাশে তোমাকে নিয়ে হাঁটলে ভালোই লাগতো। কিন্তু তুমি তো নতুন বউ বাড়ির। তাই বের হওয়া যাবে না।’
– ‘এখন ছাড়েন, কেউ হঠাৎ চলে আসবে।’
– ‘তোমাকে সুন্দর লাগছে ইতি। এক রাতেই রোগা ভাব চলে গেছে।’
– ‘তাই না-কি।’
– ‘হ্যাঁ, আর ড্রেসটায় ভালোই মানিয়েছে।’
– ‘আচ্ছা এখন বলুন৷ কোনো আপডেট কি নেই? মানে কি হতে যাচ্ছে?’
– ‘সবকিছু সুন্দরভাবেই হচ্ছে ম্যাডাম। শ্রেয়া আর মা বাসে উঠেছেন। সুপ্তি আপু আর মামাও আসছেন। আর..।
বলে কল্প থামে৷ ইতি তাড়া দিয়ে বলে, – ‘আর কি?’
– ‘আর নানাভাই আসবেন। মানে তোমার দাদা।’
– ‘মানে! সত্যি বলছেন?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘এতকিছু কিভাবে হলো।’
– ‘তোমার বরকে দিয়ে সবই সম্ভব ম্যাডাম। এবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদর করে দাও।’
– ‘যান তো এখান থেকে। দরজা জানালা সব খোলা।’
– ‘বন্ধ করে দেই।’
– ‘পাগল না-কি, বিয়ে হয়নি এখনও।’
‘ভালো ঝামেলায় পড়লাম তো। তাহলে একটা চুমু দিয়ে চলে যাই।’ বলেই সে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিয়ে বাইরে চলে এলো।
বিকেল চারটার আগে সবাই চলে এলেন। সবার আগে এলেন ফরিদ সাহেব। উনাকে সুন্দরভাবে আপ্যায়ন করা হলো। ইতির সঙ্গেও দেখা করলেন। নীলার সঙ্গে কথা বলালেন। কল্প আর একবারও ইতিকে একান্তে পাওয়ার সুযোগ পেল না৷ বিকেল চারটার সময় একটা গাড়িতে এসে উঠানে থামে৷ মোস্তাক সাহেব, সুপ্তি, শ্রেয়া, আর মুনিয়া বেগম এসেছেন। সুপ্তিকে হুইলচেয়ার ধরে ঠেলে নিয়ে এলো শ্রেয়া। কল্পের গায়ে একটা পাঞ্জাবি। এই পাঞ্জাবিটা ইতিই এসএসসি পরীক্ষার সময় তাকে গিফট করেছিল। সুপ্তিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো কল্প। শ্রেয়া অকারণ লজ্জা পাচ্ছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কল্প এগিয়ে গিয়ে মা’কে সালাম করে জড়িয়ে ধরলো। মোস্তাক সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বারান্দায় চলে এলেন। সিটিং রুমে তাদের বসানো হলো। কল্প হাত দিয়ে ইশারা করে শ্রেয়াকে বাইরে আনে। তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি ইতির সঙ্গে দেখা করবে না?’
– ‘হ্যাঁ, সুপ্তি আপুও করবে।’
– ‘সুপ্তি আপু তো উপরে যেতে পারবে না। তুমিই চলো একা।’
– ‘কিন্তু সুপ্তি আপু একটু আগেও বলছিল ইতি কোথায় খোঁজ করতে।’
– ‘তাই না-কি, আচ্ছা তুমি গিয়ে আপুকে এদিকে আনো।’
শ্রেয়া গিয়ে সুপ্তিকে বারান্দায় আনে। কল্প ঠেলে নিয়ে যায় উত্তর পাশে। তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘আপু তোমাকে কোলে করে উপরে নিয়ে যাই? ওইটা আমার রুম। ভাগাভাগির পর আমাকে উপর দেয়া হয়েছে।’
সুপ্তি অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘উঠানে সকলের সামনে জড়িয়ে ধরেছিস বলে কিছু বলিনি। তোর সঙ্গে আমার কোনো কথাই নাই।’
– ‘কেন আপু?’
– ‘তুই আমাকে একবারও কল দিয়ে বলেছিস কিছু?’
– ‘কবে?’
– ‘যেদিন ইতি তোর কাছে এলো আমাকে তো জানাসনি।’
– ‘এতকিছু কি মাথায় থাকে আপু? নিপাকে, মা’কে কল দিয়েছি। অনেক ঝামেলার ভেতর দিয়ে গেছে এই কয়দিন।’
– ‘আমাকে বলবি কেন। আমি তো কিছু করতে পারবো না তাই বলিসনি।’
‘হইছে আপু, আমার বিয়ের দিন কি এখন রাগ করে থাকবে?’ বলে কল্প তাকে টেনে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। শ্রেয়া মুখ টিপে হেঁসে হেঁসে পিছু পিছু আসছে। রুমের পর্দা ফাঁক করে গিয়ে বিছানায় রাখলো সুপ্তিকে। তারা ঢুকতেই ছোট চাচি বললেন, ‘তোমরা কেউ কি মেয়েটাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে পারবে?’
শ্রেয়া মাথা নেড়ে বললো, ‘আমি দিচ্ছি।’
কল্প নিচে এসে হুইলচেয়ার টেনে রুমে এনে দিয়ে আবার চলে গেল৷
তাদের বিয়ে হলো মাগরিবের খানিক আগে। নিপা সন্ধ্যায় ভিডিয়ো কলে কল্প আর ইতির সঙ্গে কথা বলেছে। এরপর নীলা রাতে আবার ফরিদ সাহেবকে কল দিয়ে ইতির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। ইতি কথা বললো। নীলা দীর্ঘ আলাপে বেশ কয়েকবার বললো তোমার চাচা কার্ড পেয়ে গেছে। এখন দেশে আসতে আর সমস্যা নেই। আগামী মাসেই আসবে।
রাতে খাওয়ার পর মোস্তাক এবং ফরিদ সাহেবকে পূবের ঘরে জায়গা দেওয়া হলো। ফরিদ সাহেব বিছানায় উঠে বসেছেন। মোস্তাক সাহেব বিনয়ের গলায় আমতা-আমতা করে বললেন, ‘মামা বেকুবের বাচ্চাটা এই কাজ করবে বুঝতে পারিনি৷ আপনি আমার উপর রেগে নাই তো?’
ফরিদ সাহেব রেগে গিয়ে বললেন, ‘নির্বোধের বাচ্চা কি বললি তুই? আমার নাতজামাইকে বেকুব বললি কেন? লাঠি হাতে দেখছিস? মাথা ফা*টিয়ে দেবো।’
উপরে তিনটা রুম আছে। এক রুমে শ্রেয়া আর সুপ্তি ঘুমিয়ে। এক রুমে মুনিয়া বেগম। আর এক রুমে বাসর ঘর। কল্প পর্দা ফাঁক করে গলা খাঁকারি দিয়ে ভেতরে গেল। ইতি বিছানার মাঝখানে বউ সেজে বসে আছে। সে রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে নিল৷ ইতি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে কল্পকে পা ছুঁয়ে সালাম করার আগেই ধরে ফেললো সে। ইতির দু’চোখ ভরে আছে জলে। কল্প তাকে জড়িয়ে ধরলো বুকের সঙ্গে। ‘ফ্যাসফ্যাস’ করে কেঁদে ফেললো ইতি। কল্প মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘কাঁদছো কেন বোকা? শুকরিয়া আদায় করো। দেখো আমাদের ভাগ্য কত ভালো। সবকিছু কত সহজে, সুন্দরভাবে হয়ে গেছে।’
ইতি ভেজা গলায় বললো, ‘এজন্যই আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কল্প। আপনাকে আমি সত্যিই পেয়ে গেছি তো? না-কি কোনো স্বপ্ন এটা? সবকিছু কেমন মিথ্যে মিথ্যে লাগছে।’
কল্প কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘হ্যাঁ সত্যিই এখন অভিমানী পাখিটা আমার বিয়ে করা বউ।’
কথাটি বলে ইতিকে কোলে নিয়ে এনে বালিশে রেখে বলে, ‘তুমি কি শাড়ি পালটাবে?’
ইতি মাথা নেড়ে না করে। কল্প পাঞ্জাবি খুলে ব্যাগ থেকে থ্রি-কোয়ার্টার আর গেঞ্জি পরে বিছানায় এলো। রুমে কোমল আলো, মৃদু শব্দে উপরে ফ্যানও চলছে।
কল্প পাশ ফিরে ইতির গালে হাত রেখে চেয়ে থেকে বললো, ‘তুমি জানো তোমাকে দেখলেই আমার গালে কামড় খেতে ইচ্ছা করে?’
– ‘গালে?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কেন?’
– ‘কেমন ডিমের কুসুমের মতো গাল।’
ইতি মুখ ঢেকে নিল। আজ কেমন লজ্জা লাগছে ইতির। কল্প আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘লজ্জা পাচ্ছ কেন? দেই কামড়?’
ইতি মুখ ঢেকে রেখেই বললো, ‘আচ্ছা একটা কাজ করবেন প্লিজ।’
– ‘কি?’
– ‘আপনি চোখবন্ধ করে নিন না।’
– ‘কেন?’
– ‘আগে করুন প্লিজ।’
কল্প চোখ বন্ধ করে বললো, ‘করেছি।’
ইতি চোখ মেলে কল্পের মুখে হাত রাখে৷ অল্প অল্প দাড়িতে কি মায়া লাগছে মানুষটাকে। ইতি ওর কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলে, ‘তাকাবেন না প্লিজ। আমার কেন যেন লজ্জা লাগছে আজ৷ আগে আমি মনভরে আদর করে নিই এরপর তাকাবেন, ওকে?’
কল্পের বুক শিরশির করে। ইতি কল্পের উপরে এসে শক্ত করে ওর গালে নিজের গালটা চেপে ধরে খানিকক্ষণ চোখবুজে থাকে। তারপর কল্পের পরনের গেঞ্জি টেনে খুলে ফেলে।
– ‘ইতি কি করছো? চোখ খুলি?’
– ‘না।’
– ‘তুমি কি জানো তোমাকে দেখলেই আমার আদর করতে ইচ্ছা করতো। আর এখন কাছে পেয়েছি তো চোখবুজে থাকতে হচ্ছে।’
– ‘কথাও বলবেন না আপনি। চুপ থাকুন।’
ইতি ওর বুকে অজস্র চুমু খায়, ঠোঁট ঘষে।
কল্পের পুরো শরীরে গরম স্রোত বয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে ইতিকে। ইতি কানের কাছে ঠোঁট এনে বলে, ‘প্লিজ চোখ খুলবেন না৷ আপনার ঠোঁটে চুমু খাব। চোখ খুললে আমার লজ্জা লাগবে।’
কল্প শুকনো ঢোক গিলে বললো, ‘এটা কেমন শাস্তি। চোখ তো খুলি ইতি। আমার ভীষণ আদর করতে ইচ্ছা করছে।’
– ‘চুপ, কথাও বলবেন না আপনি, চোখবুজে থাকুন। আমি ঠোঁটে চুমু খাওয়ার পর যা ইচ্ছা করবেন।’
কল্প স্মিত হেঁসে বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
ইতি গভীর মমতায় কল্পের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কপালে, গালে, দুই চোখে চুমু খায়। কল্প অসহ্যকর এক অনুভূতিতে দুই হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। ইতি কল্পের নিচের ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে।
___সমাপ্ত____