এ_কেমন_ভালোবাসা #পর্ব_১৪

0
1265

#এ_কেমন_ভালোবাসা
#পর্ব_১৪
#মাসুরা_খাতুন

রঙিন স্বপ্নে জাল বোনা তরুণ তরুণীদের আনাগোনায় ভরপুর কলেজের বিশাল ক্যাম্পাস।প্রত্যেকে নিজেদের স্বপ্নে বিভোর।ঝলমলে জীবনের আকাংখায় যে যার মতো নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যস্ত।পাশের কোন বন্ধুমহল থেকে যৌথ গানের সুর ভেসে আসছে,সাথে কোন উচ্ছল যুবক গিটারের টুং টাং ধ্বনিতে তাল মেলানোর চেষ্টা করছে।আজ কলেজে যাওয়ার পর থেকেই ছোঁয়ার মাঝে আলাদা পরিবর্তন লক্ষ্য করে কেয়া।ক্ষণে ক্ষণে যেন মেয়েটার মুখের রং বদলাচ্ছে। কখনো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে আবার কখনো আনমনা, পাশেই যে কেয়া আনলিমিটেড বকরবকর করেই যাচ্ছে তা যেন ওর কানেই যাচ্ছে না।

“কিরে ছোঁয়া, তোর হয়েছেটা কি আজ বলতো? তখন থেকে লক্ষ্য করছি আজ যেন তুই কেমন অন্য রকম বিহেভ করছিস?কি হয়েছে রে?”
ধাক্কা দিয়ে ছোঁয়া কে ধামকি দিয়ে বলে কেয়া।

“আরে না,কি হবে আমার? কিচ্ছু হয়নি।”

“দেখ আমার সাথে মিথ্যে বলিস না,কি হয়েছে বলবি তো? বলনারে দোস্ত, আজ তোর মনে এতো রং লেগেছে কেন?এই এক মিনিট, তুই আবার প্রেমে টেমে পড়ে যাসনি তো আবার?”
কৌতুহল নিয়ে বলে কেয়া।

“বিশ্বাস কর দোস্ত, তেমন কিছুই না।তবে,,,”

“তবে টা কিরে? বলবিতো?”

“আচ্ছা একটা কথা বলতো? সাইকোলজির কোন চ্যাপ্টারে আছে চুমু দিলে যেকোনো ব্যথা চলে যায়? ”

“চুমু দিলে ব্যথা চলে যায়! কি বলছিস কি? কে বলেছে তোকে?”
অবাক হয়ে বলল কেয়া।

“আরে বলেছে একজনে।আর যে বলেছে,সে সাইকোলজি নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছে।অনেক জানে সাইকোলজি সম্পর্কে। ”

“বনু,আগে এইটা বল,সে ছেলে না মেয়ে? ”

“ছে ছেলে রে।তাও যুবক ছেলে।”

“এ্যা!যুবক ছেলে! তারমানে কি তুই ব্যথা সারানোর জন্য চুমুটা দিয়ে দিয়েছিস?”
চোখ দুটো বড়বড় করে তাকিয়ে বলল কেয়া।

“না মানে,, মানে হ্যাঁ।আমি তো দিয়ে দিয়েছি।তারমানে ব্যথা সারেনা?”

মাথায় হাত দিয়ে বলে কেয়া,

“কি করেছিস তুই! যেমন বলল আর ওমনি একটা ছেলেকে চুমু টুমু দিয়ে বসলি?”

“কি করবো বল? উনার নাকি মাথা ব্যথা করছিল, মেডিসিন নিয়েেও কিছু হচ্ছিল না,তো বলল, চুমু দিলে নাকি পঁচাত্তর পারসেন্ট ব্যথা কমে যায়, তায় আরকি,,”
ছোট ছোট করে বলল ছোঁয়া ।

“বোন,তোর কথা শুনে আমার ও পায়ে ব্যথা করছে,দেনা একটা চুমু,ব্যথাটা সেরে যাক।”
একপা উপরে তুলে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল কেয়া।

“হেয়ালি করিস নাতো।আমি আছি এক টেনশনে আর তুই আছিস মজা নিয়ে,,,তবে বিষয়টা মনে হয় সত্যি রে।এমনি একজনে বললে বিশ্বাস করতাম না,কিন্তু যে বলেছে,সে মোটেও ওমন নয়, তার ওপর তিনি আবার সাইকোলজির টিচার।তায়তো বিশ্বাস করে,,,”

“সাইকোলজির টিচার? এই কোন টিচারের কথা বলছিস বলতো তুই? ”

“তুই অতো চিনবি না।দোস্ত শোননা,আমার একটা কাজ করে দিবি প্লিজ?”

“কি হয়েছে বল? ”

“প্লিজ দোস্ত, আমার হয়ে একটু সাইকোলজির সাহারিয়ার স্যারকে প্রশ্ন টা করবি তুই? প্লিজ প্লিজ,, ”

“পাগল হয়েছিস তুই? এমনিই সাহারিয়ার স্যার যেই রাগী। তার ওপর এসব আজেবাজে প্রশ্ন করলে একেবারে ক্লাস থেকে বের করে, কান ধরিয়ে সারা ক্যাম্পাস ঘোরাবে।”

“কিচ্ছু বলবেনা,তুই শুধু বলেই দেখনা একবার।প্লিজ দোস্ত। জানাটা আমার খুব দরকার।একজন কে উচিত শিক্ষা দেওয়ার আছে।”

“কিন্তু, তুই ও তো বলতে পারিস?”

“তুই তো জানিসই সাহারিয়ার স্যার আমাকে কতোটা অপছন্দ করেন।এমনেই উনার অর্ধেক ক্লাস আমার দাঁড়িয়ে থেকেই যায় তাতে আবার প্রশ্ন করলে আমারে কি করবে তাতো বুঝতেই পারছিস।তুই একটু আমার হয়ে বলিস বনু। ”

“আচ্ছা ঠিক আছে বলবো।তবে শর্ত একটায়,এই থিওরি টা শুনিয়ে তোর কাছ থেকে চুমু নিয়েছে কোন মহাপুরুষ? এটা বলতেই হবে,নয়লে আমিও ক্লাসে প্রশ্ন টা করবোনা।”
পেটের কথা বের করতে বেঁকে বসে কেয়া।

“সে? সে আমার স্বাধীন ভাই।”
কথাটা বলেই লজ্জায় ছোঁয়া মুখ নীচু করে ফেললো।প্রথম যৌবনে পা দেওয়া সদ্য কিশোরীর গালে ফুটে ওঠা লাজুকতার লাল আভা টা বড়ই মোহনীয় দেখালো।ওর লজ্জা পাওয়া দেখে কেয়াও আর কিছু বললো না।তবে সে বুঝতে পেরেছে, স্বাধীন নামের ছেলেটির ভয়ানক প্রেমে পড়েছে ওর বান্ধবী।

ক্লাসে দ্বিতীয় ব্রেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে ছোঁয়া আর কেয়া।সাহারিয়ার আলম স্বাধীন মাত্রই ক্লাসে এসেছে। এসেই একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিয়েছে ছোঁয়া কে।আজ মনে হয় সকালে মেয়ে টাকে একটু বেশিই লজ্জা দেওয়া হয়েছে।তাতে কি? ওর চেয়ে ঢেড়গুন কষ্ট স্বাধীন প্রতিনিয়ত পায়।ক্লাসে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে লেকচার দেওয়া শেষ হলে ছোঁয়া শুধু উশখুশ করতে থাকে।ডান হাতের কনুই দিয়ে বারবার ঠেলতে থাকে কেয়াকে,বোঝায় তাড়াতাড়ি ওর প্রশ্ন টা করতে।এবার একটু ভয়ে ভয়েই কেয়া দাঁড়িয়ে পড়ে,

“স্যার,একটা প্রশ্ন ছিলো ছোঁয়ার, সরি আমার।”
আমতা আমতা করে বলে কেয়া।

ভ্রু কুঁচকে তাকায় স্বাধীন।
“হ্যাঁ বলো”

“আসলে স্যার বলছিলাম যে,সাইকোলজির কোন চ্যাপ্টারে আছে যে, যেকোন ধরনের ব্যথায় একটা হামি,না মানে ইয়ে স্যার,ঐ ঠোঁট দিয়ে দেয়, ঐটায় পঁচাত্তর শতাংশ ব্যথা কমিয়ে দেয়? এটা কি সত্যিই স্যার?”

ক্লাসের অনেকেই মুখ টিপে হাসি শুরু করেছে,স্বাধীন কুঁচকানো চোখ জোড়া দিয়ে আরো একবার মেপে নেয় ছোঁয়া কে।এই মেয়ে কি সত্যিই কিছু বোঝে না? এর শোধ স্বাধীন নেবে।এবার কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

“কি বলবে স্পষ্ট করে বলো? ”

“মানে স্যার চুমু, একটা চুমু দিলেই নাকি পঁচাত্তর শতাংশ ব্যথা কমে যায়? ”

“স্টুপিড! কি সব প্রশ্ন এগুলো? ”
ধমক দিয়ে ওঠে স্বাধীন।

“না মানে স্যার,আমি বলিনি।সব দোষ এই ছোঁয়ার। কোন এক খচ্চর ওকে এই কথা বলে ওর কাছ থেকে ইয়ে মানে নিয়ে নিয়েছে। তায়তো ব্যাপারটা সত্যি নাকি জানার জন্য প্রশ্ন করেছি স্যার।”
ভয়ে থতমত খেয়ে বলে ফেলে কেয়া।

স্বাধীন শুধু বাঁকা চোখে দখলো ছোঁয়া কে।
তারপর ধমক দিয়ে কেয়াকে বসিয়ে দিয়ে ক্লাস থেকে চলে গেলো প্রচন্ড রাগ লাগছে ওর।আরে বাবা, কেমন মেয়ে রে তুই? মানুষের মনের অবস্থা বুঝিসনা? আর আসছিস সাইকোলজি পড়তে?
আজ বাড়িতে নিশ্চিত বড় কোন কান্ড ঘটাবে স্বাধীন। কিছু না বলায় মেয়েটার সাহস বেড়ে যাচ্ছে। নাহলে কি ভরা ক্লাসে স্বাধীন কে অপ্রস্তুত করার সাহস পায়?

“সব দোষ তোর রে ছোঁয়া। তোর জন্য স্যার আমার ওপর রেগে গেলেন। কোথাকার কোন খচ্চর ব্যাটা তোর কাছে মিথ্যে বলে চুমু চাটি নিয়েছে, আর তুই সেই প্রশ্ন আমাকে করতে দিয়ে বকা খাওয়ালি।মন চাচ্ছে, মন চাচ্ছে তোরে কচুরিপানার পুকুরে চুবাই,তোরে কা*ইট্টা টু* করো কইরা বিলাইরে দিয়া খাওয়ায়।খচ্চর মাইয়া। ”
স্বাধীন ক্লাস থেকে যাওয়ার পর থেকে বকবক করেই যাচ্ছে কেয়া।করারই কথা,এমন একটা অবান্তর প্রশ্ন করে ভরা ক্লাসে অপমানিত হতে হয়েছে ওকে।লজ্জায় ওর মাথা কা* টা যাচ্ছিলো।

“প্লিজ জানু আমার,রাগ করিসনা।তুই না আমার গলু মলু।দেখনা,আমি কি জানতাম,ঐ বেটা খচ্চর আমারে মিথ্যা বলে সব সব কিছু নিয়ে নিয়েছে? আমি কি করবো বল? আমার তো সব শেষ।”

“ঐ মাইয়া,বেশি কথা কস না।নিয়েছে তো একটা চুমুই,আর এমন ভাবে বলছিস যেন মহা ভারত অশুদ্ধ করে ফেলছে ”
মুখ বাঁকা করে বলে কেয়া।

“একটা নারে বোন,দুই তিনটা।আরো একটা চেয়েছিল,ঐটা দিলে আমার আর কিছু থাকতোনা।সব শেষ হয়ে যেতো।ভাগ্যিস আমি দেই নাই।”
কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে ছোঁয়া।

“ঐ কোথায় রে? সত্যি করে বল? ”
চোখ বড়বড় করে বলে কেয়া।

দু আঙ্গুল ঠোঁটের ওপর রেখে ছোঁয়া বলে,

“এইখানে বইন।আমি দেইনাই।”

ছোঁয়ার বলার ভঙ্গি দেখে ফিক করে হেসে ওঠে কেয়া।নানা রকম কথা বলে ছোঁয়া কে রাগাতে থাকে। এভাবেই শেষ হয় দুই বান্ধবীর মান অভিমানের পালা।

বাসায় এসে ছোঁয়া হালকা রান্না করেছিলো।আজ কলেজে থাকা কালীন বারবার মনে হয়েছে কে যেন ওকে ফলো করছিলো,কিন্তু শিউর হতে পারে নি।একটু অস্বস্তি ও হচ্ছিল বটে। স্বাধীন কলেজ থেকে এসে অব্দি একটা কথা ও বলেনি ছোঁয়ার সাথে। নিহা আর স্বাধীন শুধু দু একটা কথা বলেছিলো।নিহা হয়তো আরো বলতো,কিন্তু স্বাধীনের এড়িয়ে যাওয়া টা বুঝতে পারে তায় আর কিছু বলেনি।এদিকে ছোঁয়া ভয়ে ভয়ে স্বাধীন কে এড়িয়েই চলে একরকম।

রাত প্রায় এগারোটা।ছোঁয়া বসে বসে পড়ছিলো।কেন জানি রাতে পড়তেই ওর বেশি ভালো লাগে। এমন সময় হটাতই রুমে আসে স্বাধীন, তাও আবার কোন নক ছাড়াই।হকচকিয়ে ওঠে ছোঁয়া। তাড়াতাড়ি করে পাশে রাখা ওড়নাটা গায়ে জড়ায়।স্বাধীনের চোখে যেন হিং* স্রতা ঠিকরে পড়ছে।স্বাধীনের এ দৃষ্টি ছোঁয়ার চেনা।কলিজা কেঁপে ওঠে ছোঁয়ার।ভয়েভয়ে প্রশ্ন করে,

“কিছু বলবে স্বাধীন ভাইয়া? ”

কথায় কোন উত্তর না দিয়ে স্বাধীন ছোঁয়ার দিকে এগোতে থাকে।

“ভাইয়া,কি কি হয়েছে? বলো আমায়।”
ভয়ে ভয়ে বলল ছোঁয়া।

স্বাধীনের মুখে কোন কথা নেই, ও সামনে এগোতে থাকে আর ছোঁয়া পেছোয়।আস্তে আস্তে ছোঁয়া অনুভব করে ওর আর পেছনে যাওয়ার উপায় নেই, পিঠের সাথে দেওয়ালের স্পর্শ অনুভব করে। মুখটা যেন শুকিয়ে ওঠেছে ওর।

স্বাধীন ছোঁয়ার দু হাত বরাবরের মতো পেছনে বাঁকিয়ে ধরে।সমস্ত শক্তি যেন ঐ হাতের মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করে। ব্যথায় জরাজীর্ণ হতে থাকে ছোঁয়ার হাত।চোখে নোনাজল এসে টলমল করছে।

“আ আমার ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া।আর এমন হবেনা।”

“আরে বাহ্! আমি কিছু না বলতেই নিজের ভুল বুঝতে পারলি? অথচ তুই নাকি কিছু বুঝিস না? এখনতো দেখছি অনেক কিছু না বলতেই বুঝে যাচ্ছিস।”

“আর এমন হবেনা ভাইয়া। আমি কাউকে কিচ্ছু বলবোনা।”

“আরে,আমিতো তোকে কোন অন্যায়ের কথা বলিই নি।তাতেই বুঝে গেলি? আর এটা বুঝিস না,যে ঠোঁটের একটা চুমু কখনো শরীরের ব্যথা কমাতে পারেনা? ওটা মনের ব্যথার ঔষধ। ”

স্বাধীনের চোখে মুখে শুধুই কাঠিন্যতা।চোখমুখ শক্ত করে বলে,
“তুই এটা জানিস না? যে একটা চুমু যদি সত্যিই শরীরের ব্যথা কমাতে পারতো,তবে এতো এতো ডক্টর, মেডিসিন কিছুরই দরকার হতোনা?”

“তুই এটা বোঝার ক্ষমতা নেই যে একটা ছেলে একটা মেয়ের কাছে কখন চুমু চায়? কেন চায়? ”
ধমক দিয়ে বলে স্বাধীন।

“তুই এটা বুঝিস না,এই একাকীত্ব জীবনের পীড়াদায়ক প্রতিটি কষ্টের একমাত্র কারণ তুই? একমাত্র উপায় ও তুই।”

“কি বুঝিস তুই?বল উত্তর দে,আনসার মি?”
ধমক দিয়ে ছোঁয়ার হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে ছোঁয়া কে খাটের দিকে ধাক্কা দিয়ে রেখে বেরিয়ে চলে যায় স্বাধীন।

এতোক্ষণের স্বাধীনের বলে যাওয়া প্রতিটি কথা ভাবতে থাকে ছোঁয়া, ওর চোখ দুটো দিয়ে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা অশ্রু, কিন্তু তা কতোটা কষ্টের নাকি সুখের তা বোঝা গেলো না,,,,,,

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here