#এ-কেমন_ভালোবাসা #পর্ব_২৯,৩০

0
1125

#এ-কেমন_ভালোবাসা
#পর্ব_২৯,৩০
#মাসুরা_খাতুন
২৯

পড়ন্ত বিকেলে ছাদে গাছে পানি দিচ্ছে ছোঁয়া। সূর্য টা দিনের পাট চুকিয়ে আজকের মতো অস্ত যাচ্ছিল।চারদিক একটা ঠান্ডা ঠান্ডা পরিস্থিতি বিরাজমান। নিশব্দে গাছে পানি দেওয়ার সময় ছোঁয়া হটাৎ হটাৎই একবার করে পুরনো দিনের সিনেমার কোন একটা গান গুনগুন করে উঠছে।চুপচাপ ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বাধীন আবিষ্কার করলো গানের কথা গুলো,
“আমি একদিন তোমায় না দেখিলে,তোমার মুখের কথা না শুনিলে,পরান আমার রয় না পরানে,অন্তর আমার রয় না অন্তরে।”
এমনই ছিলো গানের কথা গুলো। এমন সুন্দর একটা গোধূলি লগ্ন কারই বা না ভালো লাগে? প্রিয়তমা যখন এতোসুন্দর বিকেল উপহার দেয়,এর চেয়ে শান্তিদায়ক কোন বিকেল হতে পারে না। স্বাধীন চুপচাপ গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ছোঁয়া কে। হটাৎ কেউ এমন করে ধরায় ছোঁয়া কিছু টা ভয় পেয়ে চিৎকার করতে যায়।আর তখনই প্রিয় মানুষের গন্ধ টা নাকে আসে।এই গন্ধ সে কখনোই ভুলতে পারেনা।এটা সেই গন্ধ, যেটা হাজারবার স্বাধীনের টিশার্ট থেকে নিয়েছে ছোঁয়া। এতো মিষ্টি একটা গন্ধ যা বারবার বিমোহিত করে ছোঁয়া কে।এমন মা*দকময় গন্ধে ছোঁয়া হাজারবার ডুবতে চায়।পানি দেওয়ার ঝাঝারি টা নীচে রেখে ছোঁয়া অযথায় গোলাপ গাছের একটা পাতা ছিঁড়ে হাতের মধ্যে নিয়ে মোচড়ায়।স্বাধীনের স্পর্শে ও কতোটা কাতর,এ যেন তারই বহিঃপ্রকাশ।

“কি হলো থামলি কেন? এইতো,আমায় একদিন না দেখলে নাকি ভালো লাগে না।এবার আমি অনেক কাছে এসেছি এবার গা।”

“এটাতো গায় স্বাধীন ভাই।আর আপনি কখন ছাদে আসলেন? ”

“কিছুক্ষণ আগেই এসেছি। ”
বলেই স্বাধীন গোলাপ গাছ থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে ছোঁয়ার কানে খোঁপায় গুঁজে দেয়।ছোয়ার সৌন্দর্য যেন হাজার গুন বেড়ে যায়। ঠিক বোঝা যায় না, ঐ লাল টকটকে গোলাপ টা সুন্দর? নাকি পাশেই দাঁড়ানো লাজুকলতার মতো কিশোরী টা?
স্বাধীনের মনে হয় এই কিশোরী টায় বেশি সুন্দর। কারণ একটা গোলাপ ততক্ষণই সুন্দর, যতোক্ষন একে সুন্দর জায়গায় প্রতিস্থাপন করা যায়। কিন্তু কিশোরী টা সর্বক্ষন সুন্দর। সব পরিবেশে,সব জায়গায়ই সমান ভাবে নিজের জৌলুস ছড়ায়।

“এই ছোঁয়া, আমরা আর কতোদিন রে এমন লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করবো? মাকে তুই বলছিস না কেন? আর সময় তো খুব বড়মা বড়মা করতে পারিস,আর আমার বেলায় খালি চুপ? আমি যে কতোটা কষ্ট পাচ্ছি,তা তো দেখছিস না?”

“কেন? তুমি বলতে পারো না? সমস্যা টা তো সৃষ্টি তুমিই করেছো,তায় সমাধান টাও তুমিই করবে? আমায় বলছো কেন? আর আমি এসব বিষয়ে বড়মা কে কিচ্ছু বলতে পারবো না।”

“আমি কি করে বলবো? আর ভারি দুষ্ট মেয়ে তো তুই! আমাকে জ্বা*লাতে পো*ড়াতে তোর খুব ভালো লাগে না?”

“তোমাকে পো* ড়াতে?ওমা স্বাধীন ভাইয়া তুমি কি বলো? কোথায় পু*ড়েছে তোমার? কই দেখি দেখি?”
স্বাধীন কে আরো রাগাতে বলে ছোঁয়া।

স্বাধীন ও সত্যি সত্যিই শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে বলে,

“এই দেখ।এখানে পোড়ে।এই জ্বা*লা শুধু তোর জন্য, তুইই পারিস আমায় শান্তি দিতে।”

“আমি? আমি তো এতো কিছু জানিনা।”
স্বাধীন কে আরো রাগাতে বাচ্চাদের মতো করে বলে ছোঁয়া।

“তাহলে আায়,কান পেতে শোন,বুকের গহীনে কি দহন! তাড়াতাড়ি মাকে বল প্লিজ লক্ষীটি । তোকে খুব তাড়াতাড়িই কাছে চাই রে।”

ছোঁয়া তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে আরেকটা গাছে পানি দিতে চলে গেলো। স্বাধীন ও পিছু পিছু যেতেই নীচ থেকে সাহানা বেগম ডাকলেন ছোঁয়া কে।সাথে সাথেই ছোঁয়া ঝাঝারি টা রেখে দৌড়ে নীচে চলে গেলো।শুন্য ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন। চোখে প্রেয়সীকে কাছে পাওয়ার তীব্র তৃষ্ণা। কি করে ও বাবা মাকে বলবে এটাও বুঝতে পারে না। আগে যেই আচরণ টা ও ছোয়ার সাথে করেছে, তাতে মাকে বলতেও লজ্জা লাগছে যে ওর ছোঁয়া কে চাই।আর ছোঁয়া টাও হয়েছে বড্ড পাঁজি। ও মাকে বললে কি হবে? ওদের মা মেয়ের তো খুব ভাব! এতোটুকু কথা বলতে পারবে না? শুধু শুধু আমাকে এতোটা জ্বা*লাচ্ছে!এবার যা করার আমাকেই করতে হবে, মনে মনেই বলে স্বাধীন।

দুপুরে খাবারের টেবিলে বসে আছে স্বাধীন,ছোঁয়া, আলম চৌধুরী। সাহানা বেগম খাবার সার্ভ করছেন।দেশি মুরগীর মাংস রান্না করা হয়েছে, সাথে ডাল, করলার ভাজি।এক
টুকরো মাংস পাতে নিয়ে খেতে শুরু করতেই স্বাধীন মুখ কুঁচকে ফেললো। কপালে ভাজ এনে বলল,

“মা,তোমার বয়স হয়ে যাচ্ছে, তাও তুমি রান্না করতে কেন যাও বলতো? তোমার কি আর শরীর আগের মতো আছে? রান্নায় কি দিতে কি দাও না,মনে থাকে না।এই ছোঁয়া তুই রান্না করতে পারিস না?”

“তুই তো ছোঁয়ার হাতের রান্না খেতে চাস না,মেয়ে টা তো খুব চায় রান্না করতে, কিন্তু তোর ভয়ে পারে না।আর রান্না টা কি খুব খারাপ হয়েছে? খেতে পারছিস না বাবা?”
সাহানা বেগম স্বাধীন কে প্রশ্ন করেন।

“কই বড়মা,রান্না তো খুব ভালো হয়েছে। অনেক মজা হয়েছে খেতে। কে কি বলল তা নিয়ে তুমি মন খারাপ করো না তো।”
আড়চোখে স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে বলল ছোঁয়া।

বেচারা স্বাধীন থতমত খেয়ে গেল মিথ্যে ধরা পরায়।

“এই ছোঁয়া, তুই এতো কথা বলিস কেন? তুই কি ভালো মন্দের বুঝিস? মার কি এটা রান্না করার বয়স! মা তো এই বয়সে নাতি নাতনি নিয়ে খেলবে।”

সাহানা বেগম আলম চৌধুরী দুজনেই অবাক বনে যান।এটা কোন স্বাধীন কে দেখছেন উনারা।যেই স্বাধীন বিয়ে, ছোঁয়া, নাতিনাতনি এসব কথা শুনতেই পারতো না,আর সে বলছে এসব!অবাক হয়ে উনারা তাকান স্বাধীনের দিকে।ছোঁয়া নিজেও লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।
স্বাধীনের কোন ভাবান্তর নেই, সে নিজের ইচ্ছে মতো খেতে থাকে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে স্বাধীন উঠে যাওয়ার সময় আলম চৌধুরীকে বলে,

“একটা সমস্যা হয়েছে বাবা।কলেজে টিচাররা মিলে একটা পার্টির আয়োজন করেছে। যেহেতু বেশীর ভাগ কলিগদের তুমি আমি বিবাহিত বলেছো,তায় কাপল পার্টিতে ওরা আমার ওয়াইফ সহ দেখতে চাচ্ছে,এবার কি করা যায় বলতো? কেমন ঝামেলায় ফেলেছো তুমি? ”

এবার আর ছোঁয়া মাথা তুলে তাকাতে পারেনা।কিসব বলছে,একটুও কি লজ্জা করছেনা? নিজের তো লজ্জা খুইয়েছে,এখন ওকেও লজ্জা দিচ্ছে। আর কিসের পার্টির কথা বলছে? কই কলেজে তো কোন পার্টির কথা ও শুনলো না।

অবাকের চরম সীমায় পৌঁছান আলম চৌধুরী। নিজেকে কিছু টা ধাতস্থ করে বলেন,

“এটা নিয়ে আবার চিন্তা কিসের? তুমি ছোঁয়া কে নিয়ে যাবে।লিগ্যালি ও তোমার ওয়াইফ।ওর সবরকম রাইট আছে তোমার সাথে যাওয়ার। ”

“লিগ্যাল বলতে তুমি কি বোঝাচ্ছ বাবা? ধর্মীয় মতে ও আমার ওয়াইফ,কিন্তু আইন অনুযায়ী নয়,এখন সবকিছু আইনত হতে হয়,শুধু ধর্মীয় মতে হলে অফিস আদালত তা বিশ্বাস করবে না।”
যুক্তি দিয়ে বলে স্বাধীন। বাবাকে আসল পয়েন্টে আনতে আরো একটি চাল দেয়।

“তুমি তো ঠিকই বলেছো,আমার এটা মাথায়ই ছিলো না।তখন তোমাদের বয়স সঠিক ছিলো না, কিন্তু এখন তো আমরা বাকি কাজ টা সম্পর্ন করতেই পারি।খুব তাড়াতাড়ি সেই ব্যবস্থায় করবো।যাতে তুমি আর কখনো ছোঁয়া কে অস্বীকার করতে না পারো।”

মনের কথাটায় যেন স্বাধীন শুনেছে, আর এদিকে ছোঁয়া বিষম খায় ওদের বাবা ছেলের কথা শুনে।সাহানা বেগম ও হা করে তাকিয়ে থাকে স্বাধীনের দিকে।এবার স্বাধীন নিজেও মনে হয় কিছুটা লজ্জা পায়,তায়তো নিজেই রুমের দিকে চলে যায়। যাওয়ার আগে শুধু বলে যায়,

“তোমরা যা ভালো মনে করো।”

কলেজের গেইটে বাঁধনের দেখা।কেয়া দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি, আর ছোঁয়া কথা বলছে বাঁধনের সাথে।

“ভাইয়া,আপনি আর আমাদের বাসায় যান না কেন? সেই কবে একবার গেলেন, আপনি জানেন বড়মা বড়আব্বু এসেছেন, উনারা আপনাকে,আর কেয়া কে দেখতে চেয়েছেন । ”

“উনাদের বলেছো নাকি? ”

“না না ওগুলো বলিনি,এমনি স্বাধীন ভাইয়ার ফ্রেন্ড হিসেবে আপনার কথা বলেছি,আর কেয়ার কথা তো অনেক শোনে।”

“আমার যেতে আপত্তি কোথায়,শুধু আশেপাশের লোকজন দের নিয়েই সমস্যা। তারা আবার ভদ্র লোকদের সাথে ভালো ভাবে কথা বলতে পারে না,উগান্ডার বাসিন্দা তো।”

সাথে সাথে তেড়ে উঠলো কেয়া,
“এই যে আপনি কাকে কি বলছেন হ্যাঁ?”

“ওমা আপনাকে কখন বললাম, আমি তো বলছি কিছু মানুষের কথা,যে আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে না।ভদ্রলোকের সাথে অভদ্র ব্যবহার করে। ”

“আপনি ভদ্রলোক? ”
চোখ উল্টিয়ে বলে কেয়া।

“কেন কোন সন্দেহ আছে? আমি অবশ্যই একজন ভদ্র সভ্য মানুষ। ”
দুহাত পকেটে পুরে বলল বাঁধন।

“আপনারা থামুন তো।দুজনেই পাগল।খুব তাড়াতাড়িই মনে হয় আপনাদের যেতে হবে আমাদের বাড়িতে। আরেকজন যেমন শুরু করেছে।”

“কে রে ছোঁয়া? কি হয়েছে বলবি তো? ঐ রাগের ডিব্বাটা আবার তোকে কিছু বলেছে নাকি রে?”

“আরে না,আমায় কিছু বলেনি।কিন্তু মানুষ টা এবার খুব চাপে পড়েছে রে”

“মানে? কি হয়েছে? ”
আগ্রহী হয়ে বলে কেয়া,সেই সাথে বাঁধনের ও সমান আগ্রহ।

“আরে আর বলিস না,আমাকে বলে বড়মাকে বলতে,যে উনি আমায় মেনে নিয়েছেন। আমি বলছি পারবো না।তো সেই কথাটা বড়মা বড়আব্বুর সামনে জাহির করতে লোকটার কতো অযুহাত! ”

বলতেই হো হো করে হেসে ওঠে দুই বান্ধবী। মাঝ থেকে বাঁধন ফোঁড়ন কাটে,

“দেখ স্বাধীন ভাইকে নিয়ে এমন মজা করা কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছে না।আমি সব বলে দেব উনাকে।এমনেই কি এটারে উগান্ডা বলি? ”
কেয়াকে ইশারা করে বলল বাঁধন।

“দেখছিস? কত্তোবড় শয়তান! আমাদের সাথে থেকে আমাদের কথায় ফাঁ*স করতে চায়? সাহস কতো? ”

“ছোঁয়া, একজন কে বলে দাও,আর বেশিদিন এখানে থাকছি না।খুব বেশি জ্বা*লাবো না কাউকে।”
বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল বাঁধন।

মুহূর্তেই সবকিছু বিস্বাদ লাগলো কেয়ার কাছে।সাথে সাথেই ওদের আগ দিয়ে ধমধম করে হেঁটে কলেজের ভেতর চলে গেলো। বাঁধন কিছু টা মুচকি হেসে পাগলি মেয়ে টার রাগ দেখলো।আর ছোঁয়া নির্বাক হয়ে দুজনেরই কর্মকাণ্ড দেখে গেলো।বুঝতে পারলো এরাও সেই প্রাচীন কাল থেকে শুরু হয়ে আসা এক ভয়ানক প্রচলন “প্রেমে”মজেছে,,,,,,,,

#এ_কেমন_ভালোবাসা
#পর্ব_৩০
#মাসুরা_খাতুন

উৎসবে মেতে ওঠেছে পুরো চৌধুরী পরিবার।সবখানেই সাজসজ্জার আমেজ বিচরণ করছে।ঝলমলে সুন্দর সাজানো গোছানো মঞ্চে বসে আছে ছোঁয়া। পুরো স্টেজ টায় হলুদ সাদা ফুলে সাজানো। আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটছে প্রতিটা কোণায় কোণায়। ছোঁয়ার পরনে সর্ষে হলুদ রঙের লেহেঙ্গা, বিলাসী জরির কাজ করা লেহেঙ্গা টা যে দামের দিক থেকে বেশ চওড়া তা বোঝায় যাচ্ছে। মায়া পরীর মতো দেখতে মেয়েটাকে এমন সর্ষে ফুলের রঙের হলুদ লেহেঙ্গায় যেন হলুদ পরীর মতো লাগছে।পুরো স্টেজের সব আলো নিভিয়ে দিলেও যেন হলুদ পরীটার সৌন্দর্যের আলোয় সবকিছু ঝলমল করবে।চুলগুলো খোলা রেখেই সাজিয়েছে পার্লারের মেয়ে গুলো।যদি ও তারা শুধু যতোটুকু ইন্সট্রাকশন দেওয়া হয়েছে ততোটুকুই করেছে।তার বাইরে একটা কিছু ও নিষিদ্ধ। পুরো সাজের থিম টায় স্বাধীনের।পার্লারের মেয়ে রা আসতেই তাদের নিজ দায়িত্বে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে স্বাধীন। ঠিক কেমন সাজে নিজের প্রেয়সীকে দেখতে চায়।স্বাধীনেরই কথা মতো কোনরকম ভারি মেকআপ ছাড়াই একদম হালকা সাজে সাজানো হয়েছে ছোঁয়া কে।খোলা চুল,চোখে গাঢ় কাজল, আর টকটকে লাল লিপস্টিক। হালকা মেকআপ যা খুবই সামান্য। সর্ষে ফুলের রঙের লেহেঙ্গায় এমনিতেই ছোঁয়া কে অসাধারণ লাগছিল,তাতে আবার সামান্য সাজগোজ যেন দ্বিগুন করেছে।ছোঁয়ার গায়ে শোভা পাচ্ছে গোল্ডেন গার্ডেনিয়া ফুলের গহনা,যা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে ছোঁয়ার সৌন্দর্য! গার্ডেনিয়া ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ সাথে তার হলুদ রঙের সৌন্দর্য যেন ছোঁয়ার রূপের সাথেই পাল্লা দিচ্ছে। স্বাধীন সাজগোজের মধ্যেই একবার ফুল গুলো দিতে এসেছিল,ছেলেটা মনে হয় একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে ছোঁয়া কে দেখতে। গোল্ডেন গার্ডেনিয়া খুব একটা না পাওয়া গেলেও ও জোগাড় করেছে।আসলে কথায় আছে, তুমি যাকে যতো বেশি কষ্ট দেবে,একসময় তুমিই সেই মানুষটির জন্য ততোই পাগল হবে।এটায় মনে হয় হয়েছে স্বাধীনের ক্ষেত্রে ও।যে স্বাধীন ছোঁয়া কে সহ্যই করতে পারতো না,সে এখন ছোঁয়া কে চোখে হারাচ্ছে। কিন্তু শয়তান কেয়া থাকতে সে ভাগ্য ওর হচ্ছে কোথায়! একেবারে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে সবসময় ছোঁয়া কে।কখনো একটু একা হতে দিলে তো! আর স্বাধীন গেলেও একেবারে ধুর ছাই করে বিদায় দিচ্ছে। শুধু ছোঁয়ার বান্ধবী হলে তো কথায় ছিলো না,যেকোনো ভাবে বুঝিয়ে সুজিয়ে একটু সরানো যেতো,কিন্তু ও তো স্বাধীনের ছাত্রী। এখন নিজের এ্যাটিটিউড ভুলে কি করে ঐ একটুখানি মেয়ের কাছে সময় চাইবে? তায়তো বারবার হতাশ হয়ে ফিরে আসছে।ওকে কাবু করতে যে বাঁধন কে দরকার তা ভালো করেই জানে স্বাধীন। তায়তো আবারও বাঁধনের কাছে ফোন দেয়,

“হ্যাঁ বাঁধন, কখন তুমি পৌঁছাবে ইয়ার? এদিকে তোমার বাঘিনীতো আমার হরিনীটিকে একবার ও দেখতেই দিচ্ছে না।তোমার মতো সিআইডি পুলিশ অফিসার ছাড়া এ ত্যাড়া মেয়ে কে আমার মতো সাইকোলজির টিচার সোজা করতে পারবেনা।এ অন্য রকম মেয়ে! একে হিপনোটাইস করাও অসম্ভব! ”

“আরে স্বাধীন ভাই,তুমি চিন্তা করো না। আমি খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছাচ্ছি।আজ আবার ওপর মহল থেকে একটা মিটিংয়ে শহরের বাইরে পাঠানো হয়েছে আমাকে।তায়তো একটু দেরি হচ্ছে, তবে আমি এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবো।তারপর ঐ উগান্ডারে দেখছি, নিজেও আমারে টাইম দিচ্ছে না, আবার আরেক জনরে ও রোমান্স করতে দেয় না?”

“মনের দুঃখ টা বুঝছো ভাই,কতো কষ্ট করে সব কিছু এ্যারেন্জ করছি,আর এরা দুই শয়তান মেয়ে মিলে আমার ইমোশনের বারোটা বাজাচ্ছে । ”

“আচ্ছা ব্রো তুমি চিন্তা করিও না আমি আসছি।”

সাজগোজ প্রায় শেষে ছোঁয়া কে স্টেজে আনা হয়েছে, মেহেদী লাগানো টা বাকী।ওর পার্লারের মেয়ে দুটোর মধ্যে একজন কেয়াকে আর একজন ছোঁয়া কে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে।সবার কাছেই এই বিয়ে টা একটা অন্যরকম বিয়ে মনে হচ্ছে, কারণ এভানে বরযাত্রী নেই, বৌভাত নেই, যারা বরপক্ষ,তারাই কনে পক্ষ। এখানেই যে বরের বাবা মা, সেই কনের বাবা মা। মজাই বটে!
ছোঁয়ার নানা বাড়ি থেকেও কিছু আত্মীয় এসেছে। ছোঁয়ার মামা মামি আর কিছু মামাতো ভাই বোন।যারা প্রায় সবাই ছোঁয়ার ছোট। স্বাধীনের ও নানু বাড়ি থেকে মামা মামি খালারা আসছেন। স্বাধীনের বড় মামার মেয়ে জেমি একটু অহংকারী ধাঁচেরই।সে ও পছন্দ করতো স্বাধীন কে। কিন্তু তখন থেকেই শুনে আসছে ছোঁয়া স্বাধীনের বিয়ে হয়েছে তায় খুব একটা সাহস পায় নি।তারপর ও ছোঁয়া কে কখনোই পছন্দ করতো না জেমি।জেমির ছোট বোন রিমি।সেও এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।দু- বোনের মধ্যেই কেমন অহংকার বিরাজ করে।বাকী সবাই মোটামুটি ভালো।কিন্তু জেমির মাও যে মনে মনে ছোঁয়া কে পছন্দ করে না তা ছোঁয়া জানে।ছোঁয়ার জায়গায় নিজের মেয়ে কে বহুবার দেখতে চেয়েছেন উনি,কিন্তু সাহানা বেগমের কথা প্রতিবাদে তা কখনোই পারেন নি।

__________________
অতীত

স্বাধীন খাবার টেবিল থেকে ওভাবে উঠে গেলে সাহানা বেগম আর আলম চৌধুরী দুজনেই বেশ অবাক হোন।তবে এদের দু’জনার মধ্যে যে কিছু একটা চলছে তা শান্ত প্রকৃতির বুদ্ধিমাতি সাহানা বেগম ভালো করেই বুঝতে পারেন । তায়তো তিনি নিজে ছোঁয়ার রুমে গিয়ে কথাটা তুলেন।কেন স্বাধীন ওসব বলল,আর ওদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক কেমন চলছে তা জানতে চায়।ছোঁয়া ও সবকিছু খুলে বলে সাহানা বেগমকে।তবে কিড*ন্যাপের কথাটা গোপন করে।সবটা শুনে সাহানা বেগম আনন্দে বুকে জড়িয়ে নেন ছোঁয়া কে।এতোদিনে যেন দুটো বয়ষ্ক মানুষের আকাংখা পূর্ণ হয়েছে। তারা এতোদিন ছোঁয়া আর স্বাধীনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় রাতদিন বিভোর থাকতেন,আর আজ ছেলে মেয়ে দুটোর এমন সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরী হওয়ায় তাদের যেন মস্ত বোঝা নেমে গেলো। আর তাড়াতাড়ি চলে যান আলম চৌধুরীর কাছে।খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলেন আলম চৌধুরী কে যা প্রতিফল আজ এই হলুদ সন্ধ্যা।খুব বড় আয়োজন করা হয়েছে চৌধুরী বাড়ির ছেলে মেয়ের বিয়ের এ আয়োজনে। দুজনেই একই বাড়ির হওয়ায় আয়োজন টাও যেন দ্বিগুন হয়ে গেছে। সব আত্মীয় স্বজনদের জন্য হলুদের দিন থেকে ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। সাথে বিভিন্ন হোটেলে রুম বুক করে দেওয়া হয়েছে দূর থেকে আসা আত্মীয়দের জন্য। যথেষ্ট সমারোহের মধ্যে আয়োজিত হচ্ছে স্বাধীন ছোঁয়ার হলুদ সন্ধ্যা।

সাহানা বেগম প্লেটে করে কিছু পোলাও আর মাংস এনেছেন ছোঁয়া কে খাওয়াতে। কিন্তু এসে দেখেন ছোঁয়া হাতে মেহেদী পড়ে বসে আছে। তায়তো তিনি এক লোকমা খাবার ছোঁয়ার মুখে তুলে দেন,পাশেই কেয়াকে ও মেহেদী দেওয়া দেখে উনি কেয়ার মুখের কাছেও খাবার তুলে দেন।

“আন্টি,আপনি আমাকে খাওয়াবেন? ”

“হ্যাঁ মা,তুমিও তো আমার ছোঁয়ার মতোই ছোট্ট মেয়ে, খাইয়ে দিলে সমস্যা কি? নাও হা করো।”

সাহানা বেগমের ভালোবাসা দেখে কেয়ার চোখে অশ্রু কণা ভির করে।অনাথ মেয়ে কেয়া বড়ই হয়েছে চাচা চাচির সংসারে। চাচির অসহনীয় অত্যা*চারে একা একায় গ্রাম ছাড়ে।কলেজে ভর্তি হয়ে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় চাচির সাথে। নিয়মমতো টিউশনি আর মাধ্যমিকে পাওয়া বৃত্তির টাকায় নিজের খরচ চালায়।এখন আর ওর কোন পিছুটান নেই। জীবনে সব দুঃখ ভুলে যেতে চায় ও।তায়তো নিজের জীবন টা নিজের মতো পার করতে চায় ও।ভেতরে আকাশ সমান কষ্ট রেখেও সবসময় হাসি খুশি ভাবে জীবন পার করতে চায়।কলেজে প্রথম প্রথম কোন বন্ধু না থাকলেও যখন জানলো ছোঁয়ার ও বাবা মা নেই তখন ও নিজে থেকেই বন্ধুত্ব করে ছোঁয়ার সাথে। সবকিছু শেয়ার করে ছোঁয়ার সাথে। ছোঁয়া অনেক বার চেয়েছে ওকে সাহায্য করার,বিশেষ করে ওদের বাড়িতে থাকার রুমের তো অভাব নেই, যদি কেয়া কে ওদের বাসায় এনে রাখা যেত তাও অন্তত ওর মেস ভাড়া টা বাঁচত। কিন্তু ওর রাগী স্বাধীন ভাই যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল তাতে আর এ প্রস্তাব করে সাহস পায়নি।

“কি মা,কাঁদছো কেন? আজ তো আনন্দের দিন,আমাদের ছোঁয়ার বিয়ে! ছিহ্ মা কেঁদো না।”

“আন্টি,আমার চাচি ও কেন আপনার মতো হলো না? তাহলে তো আমার জীবন টাও এমন কষ্টের হতো না।ছোঁয়ার খুব ভালো ভাগ্য, আপনার মতো বড়মা পেয়েছে। ”

“সব মানুষ এক হয়না মা।আমি তো তোমার ও বড়মা।নাও এবার খাবার খাও।”

সাহানা বেগম দুজনকেই খাওয়াচ্ছিলেন,এমন সময় কোথা থেকে আসে স্বাধীন। তারপর সাহানা বেগমকে বলে,

“কি ব্যাপার মা,তুমি এখানে, বাবা তোমায় কখন থেকে ডাকছে,তাড়াতাড়ি যাও,কি একটা খুঁজে পাচ্ছে না।”

“আরে স্বাধীন দেখছিস তো,আমি এদের খাওয়াচ্ছি, মেয়ে দুটো হাতে মেহেদী পড়ে বসে আছে,না খাওয়ালে খাবে কি করে?”

“মা,এদের তো পরেও খাওয়াতে পারবে,আগে বাবার কাছে যাও,তুমি তো জানোই বাবা হাতের কাছের জিনিস খুঁজে না পেলে কেমন রেগে যায়। ”

“আচ্ছা বাবা,মা ছোঁয়া কেয়া,তোরা একটু থাক,আমি আসি।”

“আমি আর খাবোই না বড়মা।আপনি যান।”
কেয়া বলে ওঠে ।

“কিন্তু আমি তো খেলামই না,বড়মা তুমি গিয়ে তাড়াতাড়ি শুনে আসো তো।”
ছোয়া আড় চোখে স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে বলে।

“আরে মা তুমি যাও তো,আমি ওদের খাওয়া দেখছি।”
আবারও তাড়া দেয় স্বাধীন।

সাহানা বেগম খাবারের প্লেট রেখে হাত ধুয়ে চলে যান আলম চৌধুরীর কাছে।
এদিকে স্বাধীন ও সুযোগ নিয়ে নেয় চলে যাওয়াটার।

“এবার দেখি কতো খেতে পারিস।আমি খাইয়ে দিচ্ছি। নে হা কর।”

“আমি আর খাবোনা স্বাধীন ভাইয়া। খাওয়া হয়ে গেছে। ”
বিরস মুখে বলে ছোঁয়া।

“থাপড়িয়ে গাল লাল করে দেবো।না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি,আর খাওয়া নিয়ে এতো বাহানা কেন তোর? ”

“আমি সত্যিই খাবো না ভাইয়া,আর আজকেও তুমি আমায় বকবে?”
ছোঁয়ার অসহায় মুখে বলা কথাটায় খানিকটা হেসে ফেলে স্বাধীন।
মুগ্ধ হয়ে হাসিটা দেখে ছোঁয়া। এই ছেলেটার হাসিটা এতো সুন্দর কেন? ভেবে পায়না ও।

“ভাইয়া শুধু আমায় খাওয়াবে? কেয়া ও তো খাচ্ছে। ”

“কেয়া কে খাওয়ানোর জন্য বাঁধন চলে আসছে।ছেলেটাও খায় নি,একেবারে সুন্দর করে খাওয়ায় দেবে। ”

মুচকি হাসি দিয়ে বলে স্বাধীন। সাথে সাথেই কেয়ার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে তাকায় স্বাধীনের দিকে,

“এ্যাঁ,,,,,,”

চলবে,,,,,,,৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here