#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১২,১৩
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১২
১৪.
রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পিছনে পাতিহাঁসের মতো লাইন ধরে আরও দুজন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ ভাবলে শিউরে ওঠি। আমি বিবাহিত। জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আরও কত কি ভাবনা মাথায় খেলে যায়।
চাঁদনী আমার পিঠে গুঁতো মেরে বললো,
“ভ্রমরার মতো খাড়য় খাড়য় কোমর নাচাইস না। ভেতরে গেলে যা।”
আমি ঘাড় কাত করে বললাম,
“তোরা এখানে কেন। লজ্জা করে না বান্ধবীর সোয়ামীকে ড্যাব ড্যাব করে দেখার জন্য ছুটে এসেছিস?”
তুশিরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললো,
“আচ্ছা! এতোক্ষণ দোস্ত আয়, দোস্ত আয়। আর এখন আপা আমাদের যেনো চিনেই না।”
আমি ভেঙচি কাটলাম।
তুশিরা বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা চলে যাচ্ছি।”
চাঁদনী কপট রাগান্বিত হয়ে বললো,
“হ, জামাইয়ের লগে হাগাহাগি কইরা সুখবর লইয়া আইস। মিষ্টি নিয়া আবার দেখতে আসমু।”
আমি নাক কুঁচকে বললাম,
“হাগাহাগি মানে? ছিঃ, এতো খারাপ তোর মন!”
চাঁদনী কোমরে হাত রেখে দাঁত খিচিয়ে বললো,
“ওই ছেরি, হাগ চিনোস না হাগ? কোলাকুলি? ঢঙ কইরা তো ঠিকই সারাদিন কও, দোস্ত আয় তোমারে হাগ দেই, আমারে হাগ দাও। তখন কি বুঝাস আমি তোর উপর পায়খানা আর তুই আমার উপর পায়খানা কইরা দিবি? পাতলা-পাতলা ঝোলের মতো পায়খানা?”
আমি বমি করার ভান করে দৌঁড়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে আবার বের হয়ে হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
“দোস্ত প্লিজ যাস না। আমি যাওয়ার দুই মিনিট পরে আয়। নাহলে বিয়ের আগে বিধবা হবি।”
বলেই আমি চলে গেলাম।
ভেতরের সিঁড়ি ভেঙে দুই তলায় উঠে কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলাম। চতুর্দিকে চোখ বুলালে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দৃষ্টিগোচর হলো। প্রিয়ল! কি মিষ্টি একটা নাম। ফ প্লাস প। মেয়ে বাবু হলে নাম রাখবো প্রিয়ম। আর ছেলে বাবু হলে ফাতিহ, নাভিদ ফাতিহ। আরও দুইয়ের অধিক হলে..
“এই ছেরি সং ধরে খাড়য় আছস কেন? ভিত্তে ঢুক!”
পিছন থেকে চাঁদনীর অমর্ষিত গলা শুনে হুশ এলো। আমি বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কেন ভাবছি? শরীরটাকে একটা ঝাঁড়া দিলাম।
প্রিয়লের দিকে তাকাতে দেখলাম সে-ও আমার দিকে তাকিয়েছে। মুহূর্তে তার অধরে হাসির রেখা অঙ্কিত হতে দেখা গেলো। হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকলো।
আমি ধীর পদে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
উনি মুখে হাসি রেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে জিগ্যেস করলেন,
“কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচ ছিলেন কেন?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“কই না তো, আমি তো জামাকপড় ঝাড় ছিলাম।”
আড়চোখে চাঁদনী আর তুশিরার দিকে তাকালাম। সিট খালি না পাওয়ায় দুই বেচারি আমার কাছাকাছি বসতে পারেনি। কোণায় গিয়ে স্থান নিতে হয়েছে।
আমি উনার সামনাসামনি হয়ে বসলাম। উনি তখন উনার জায়গা থেকে উঠে এসে আমার পাশে এসে বসলো।
আমি কি নেব জিগ্যেস করে নিজেই খাবার অর্ডার করলো। আমাকে এটা সেটা জিগ্যেস করতে লাগলো। এমন ভাব যেন আমাদের কত দিনের পরিচয়। আমি একবার পুলকিত হচ্ছি আর একবার আঁতকে ওঠছি। পুলকিতই বেশি হচ্ছি।
হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল, অজানা একটা ছেলের সঙ্গে এভাবে কথাবার্তা। লোকে কি বলবে। পরে নিজেকেই নিজে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিলাম। অঘটন তো ঘটেই গিয়েছে। এখন লোকে বেশি কিছু হলে সাজেক হানিমুনে পাঠাতে পারে। এর বেশি আর কি করবে?
একটু পর কোমরে সুড়সুড়ি লাগলো। তেলাপোকা ভেবে ভীত হয়ে দ্রুত কোমরে হাত দিলাম। চার-পাঁচটা শুঁড়ের মতো কি যেন হাতে ঠেকলো। মুখ আমার রক্তশূন্য হয়ে ওঠলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে যাবো তখন প্রিয়ল আমার মুখে চামচ ঢুকিয়ে দিলো।
“এটা খেয়ে দেখো। এই রেস্টুরেন্টের স্পেশাল মিট বক্স, গোল্ডেন মিট বক্স।” শুঁড়ের নাড়াচাড়া থেমে উষ্ণ হয়ে কোমরে স্থির হলো। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম..ও মাই গড, এটা আমার সোয়ামীর আঙ্গুল!
“কি হয়েছে ফাবলীহা?”
আমি অবাক নয়নে তার দিকে তাকালাম।
আমি মুখের খাবার দ্রুত গলাধঃকরণ করে মুখ খুলে কিছু বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো শব্দ নির্গত হচ্ছে না।
প্রিয়ল গালে হাত দিয়ে মুচকি হেসে আমার চোখে তার নেত্রযুগল স্থির করলো। ঠোঁট গোল করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আমি ঝটকা মেরে তাকে সরিয়ে দিলাম।
“এসব কি অসভ্যতা!”
উনার মুখের হাসি মুছে গেলো। চোখে মুখে কাঠিন্য চলে এলো।
উনি সোজা হয়ে বসে কাটা চামচ দিয়ে ক্রিসপি চিকেন কাটতে কাটতে নিজে নিজে বললেন,
“এক্সেক্টলি। অসভ্য। তার মানে আমি সঠিক পথেই যাচ্ছি।”
আমি দ্বৈধিভাব নিয়ে জিগ্যেস করলাম,
“মানে?”
উনি খুব মনোযোগী হয়ে খেতে খেতে বললেন,
“আমরা এখানে আলোচনার জন্য এসেছি, তাই তো?”
আমি মাথা নাড়ালাম।
“উকিলের সঙ্গে কথা বলার পর উনি জানালেন, সদ্য বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রী অনন্ত ছয় মাস আগে একে অপরকে তালাক দিতে পারবে না। তাহলে উভয়পক্ষ হতে পাঁচ পাঁচ করে মোট দশ লাখ টাকা অনাথ আশ্রমে জমা দিতে হবে।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
উনি বলতে লাগলো,
“আমি তো জানি, আপনি গরীব। আমি বরাবরই গরীবদের প্রতি খুব সহনশীল। উকিল সাহেবকে বললাম, অন্য কোনো পথ আছে? উনি বললেন অবশ্যই আছে। এরপর বললো, আমার স্ত্রী যদি আমার নামে শক্তপোক্ত প্রমাণ সহ কোনো মামলা করে তবে দুই মাসের মধ্যেই সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে যাবে। নাহলে এভাবে কাটবে ছয়মাস, কাগজপত্র তৈরি হতে হতে আরও ছয়মাস। এরমধ্যে যদি দুই মাস আমরা সাজেক গিয়ে মধুচন্দ্রিমা অতিবাহিত করি আর দশ মাস পেট থেকে বের হয়ে ক্যাসেট বাজানো বেবি বসের জন্য অপেক্ষা করি, তবে পরিপূর্ণ এক সংসার হয়ে যাবে। এবার আপনি বলুন কোনটা গ্রহণ করবেন।”
“হোয়াট দ্যা হেল! আর কোনো উপায় নেই?”
উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“আছে তো। আমার মা-বাবা এবং”
উনি আমার দিকে তাকালেন। থুতনির উপর দুই হাতের আঙ্গুলের ভাঁজ ঠেকিয়ে বললো,
“আপনার মা-বাবাকে একসঙ্গে নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে।”
গর্দভ! আমার মা-বাবাকে নিয়ে করলে এক সপ্তাহ কেন, এক মিনিটেই কাজ তামাম হয়ে যাবে। আমাকে পাঁচ তালা থেকে টোকা মেরে ফেলবে। তখন শুধু স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ নয়, পৃথিবীর সঙ্গেই ডিভোর্স ঘটিয়ে টাটা বাই বাই হয়ে যাবো। কিন্তু উনি এসব কি বলছেন?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
“এক সেকেন্ড, আমি বুঝতে পারছি না।মামলা করবো ঠিক আছে। এরপর? শক্তপোক্ত কি মামলা?”
“আমি বুঝাচ্ছি। আমি আপনার সঙ্গে দুষ্টু দুষ্টু কাজ করার চেষ্টা করবো। আমি হবো ডিপজল, আপনি হবেন মৌসুমি।চার মাস পর আপনি আমার দ্বারা অত্যাচারিত, নির্যাতিত হওয়ার মামলা ঠুকে দেবেন। এতে আমি জেলে গিয়ে দেবদাস হবো, আর আপনি আমজনতার মতো জীবন অতিবাহিত করবেন।”
উনি আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে কাছে আনলো। এরপর বললো,
“সো, এখন থেকে আমি আপনাকে তুমি করে ডাকবো। আর নিষিদ্ধ কর্মকান্ড করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবো। মাঝেমধ্যে একটু চুম চুম দেব। গাঢ় চুম চুম।”
উনি আবারও ঠোঁট গোল করলেন। এবার চোখ বন্ধ করে আমার দিকে মুখ বাড়িয়ে দিলেন। আমিও ঠোঁট করে অপেক্ষা করলাম। মামলা ঠুকতে হবে তো।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার খাবারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বেয়াদপ!
“আপনার উপকারে আমি শুদ্ধ চরিত্রবান হয়েও অসভ্য হতে হচ্ছে যেনো আপনি আমাকে লুচু সাব্যস্ত করতে পারেন। এছাড়া আপনার প্রতি আমার কোনো মোহ-মায়া নেই।”
আমার কান্না পেয়ে গেলো। মোহ-মায়া নেই কেন? হুম, হুম, হুম? ইজ এনিথিং রং ইনসাইড হিম?
(চলবে)
#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৩
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৫.
চারজন ছেলে আর তিনজন মেয়ে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। খুবই অদ্ভুত দৃষ্টি সবার চোখে খেলে যাচ্ছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম প্রিয়ল মুচকি হেসে সবার দিকেই চোখ বুলিয়ে গেলো। আমার ওপর চোখ পড়তে সে আমাকে আশ্বস্ত করা হাসি উপহার দিলো। উপহার গ্রহণ করবো কি-না তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
আমি এখন টিএসসি মোড়ে বসে আছি। প্রিয়লের কিছু বন্ধুবান্ধব আর তার ছোট ভাই ফাতিন ও চাচাতো বোন লিহা আমাকে দেখতে এসেছে। প্রিয়ল আমাকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর থেকেই সবাই আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে কি আমার ভয় পাওয়া উচিত? ভয় পেয়ে কি চিৎকার করে প্রিয়লের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত?
“আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না ভাইয়া!”
প্রিয়লের চাচাতো বোন লিহা বলে ওঠলো।
সে আমার খানিক কাছে এগিয়ে এসে অবাক নয়নে বললো,
“তোমার পছন্দ খুব ভালো জানতাম। কিন্তু মারাত্মক রকমের ভালো তা ভুল করেও ভাবিনি।”
আমি লজ্জা পেলাম। যাক অন্তত তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
প্রিয়লের এক বান্ধবী তার চুল নাচাতে নাচাতে বলে ওঠলো,
“কি আর পছন্দ! সুন্দরী, স্টাইলিশ, মডেলিং আমি কম কিসে? এরপরও তোমার ভাইয়ের পিছনে এতোদিন ঘুরে ফল পাইনি। এর মানে বুঝেছো? গন্ডগোল ছাড়া সম্ভব নয়।”
প্রিয়লের ছোট ভাই ফাতিন বলে ওঠলো,
“জি খালাম্মা, তাবিজ করেছে তাবিজ। ময়লা বাবার পানি পরা ভাবি আমার ভাইকে গিলিয়ে দিয়েছে।”
তার কথা শুনে সবাই হেসে ওঠলো।
সেইসঙ্গে লিহা বললো,
“অবশ্য ময়লা বাবার পানি সবার উপর প্রভাব ফেলে না। যে আনে তাকে কোমর ভাঙা মডেলিং না হয়ে মিষ্টি ভাষী পরি হতে হয়, যেমনটা আমাদের ভাবি।”
মেয়েটি মুখ বাঁকালো। ভেঙচি কেটে বললো,
“এতদিন তোমার ভাই অপমান করেছে এখন তোমরা করো। আমার তো কোনো দাম নেই। ডিসগাস্টিং।”
ফাতিন লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
”ব্যথা পেয়ো না আপু। ভাইয়ার মন ছোট আকারের হলেও তার ভাইয়ের মন বিশালাকার। সেই মনের দরজার কড়া নেড়ে দেখতে পারো।”
লিহা গেয়ে ওঠলো,
“বন্ধু তুই লোকাল বাস, বন্ধু তুই লোকাল বাস।”
পাশ থেকে মেয়েটি জুতা হাতে নিয়ে ফাতিনকে দৌঁড়ানি চালালো।
“তবে রে লোকাল বাস!”
আনন্দ-আড্ডা শেষে সবাই আবার আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
দূর থেকে করুণ চোখে তুশিরা আর চাঁদনী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাদের কত করে বললাম, আমার ঝামেলায় নিজেদের না জড়াতে। কিন্তু প্রাণের সখীরা আমার আবার আমাকে একা ছাড়তে নারাজ। এই যে আজ, আমার সঙ্গে না এলে কি জানতে পারতো আমার এতো সুন্দর সুন্দর দেবর আছে? এ তো বান্ধবীদের হক মারা। তাই তারা এসেছে বলে এখন খুশিই লাগছে। কিন্তু আমার দেবরদের আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে পারছে না বলে তারা খানিক বিধ্বস্ত। সমস্যা নেই, বাসর রাতে পুষিয়ে নেবে।
প্রিয়ল আমার কাঁধে হাত রাখলো। সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“ভাবিকে দেখা হলে তবে ভাবিকে তার গুহায় রেখে আসি। গুহার একজোড়া পাহারাদার তাকে না পেলে আবার তলোয়ার চালিয়ে আমার গর্দান নেবে।”
আমি চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকালাম।
প্রিয়লের বন্ধু মাহিম ভাই যে আমাকে দৌঁড়ানি দিতে গিয়ে ভুলে জুতার বারি খেয়েছে, বললো,
“দোস্ত ট্রিট!”
বাকি সবাইও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হৈ হৈ করে ওঠলো,
“ট্রিট ট্রিট ট্রিট!”
প্রিয়ল হেসে হাত উঁচিয়ে বললো,
“সঠিক সময়ে প্রদান করা হবে শিষ্যরা।”
১৬.
জ্যামে আটকে থাকা অটোতে আমি আর প্রিয়ল পাশাপাশি বসে ছিলাম। গন্তব্য আমার বাড়ি। প্রথম প্রথম প্রিয়ল আমাকে তার গাড়িতে ওঠতে জোরাজুরি করতো। শত বলা সত্ত্বেও আমি সহজে উঠতে চাইতাম না। একদিন খোঁচা মেরে বললো, আমি তাকে অবিশ্বাস করে তার ইজ্জতে এতো বড় দাগ না লাগালেও পারি। আর আমার বান্ধবীরা তো সঙ্গে আছেই। তখন শান্ত নয়নে কিছুক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করে গাড়িতে উঠে বসলাম। চাঁদনী আর তুশিরা তো খুশি। এসির ঠান্ডা পারলে ব্যাগে ভর্তি করে নিয়ে যায়।
গাড়ি চলতে থাকার কিছুক্ষণ পর আমি চোখ মুখে কিছু দেখছি না। সব কেমন ঝাঁপসা হয়ে এসেছিলো। প্রিয়ল আমাকে লক্ষ্য করে গাড়ি থামিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো। আমার মুখের কাছে এসে বারবার জিগ্যেস করলছিলো, আমি ঠিক আছি তো? প্রত্যুত্তরে হরহর করে বমি করে তাকে ভাসিয়ে দিলাম। বেচারা জবাব পেয়ে হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
এরপর থেকে সে কানে ধরেছে। আর কখনো আমাকে গাড়িতে উঠতে জোর করবে তো দূর, গাড়ির নামই উচ্চারণ করবে না। তাই সে আমার সঙ্গে সাধারণ যানবাহন যাত্রী হয়ে গেলো।
তার যে হঠাৎ এসবে চলাচলে অস্বস্তি হয় আমি তা বুঝতে পারি। আমার উপস্থিতি অনুভব করলে যে সে সেসব ভুলে যায় তা-ও বুঝতে পারি।
আমি আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। সে তাকাতে আমি পাশ ফিরে চাইলাম।
এ কি!
পাশের সিএনজিতে আব্বু বসে আছে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে কষাটে মুখে কপালের ঘাম মুঝছে। বিড়বিড় করে কাউকে গালিগালাজও বোধহয় করছে। ডান দিকে তাকালেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হয়েও গেলো। কিন্তু আমাকে দেখার পূর্বেই আমি প্রিয়লকে খামচে ধরে তার বুকে মাথা লুকালাম।
তার শরীরের নড়াচড়া যেন স্থির হয়ে গেলো। অজ্ঞান হয়ে গেলো নাকি।
আমি মাথা খানিক উপরে তুলে চোখ দুটো বের করে তার মুখপানে তাকালাম।
আমি তখন ওর নাকের ডগার তিলটা ফের দেখলাম। ফর্সা নাকে লাল তিলটা যেনো আমাকে ডাকছে। ডাকে সাড়া দিয়ে তাতে একটু ঠোঁট ছোঁয়াতে ইচ্ছে করছে।
আমি তার বুক বেয়ে হাতড়ে উঠে গলার দুইপাশ জড়িয়ে ধরলাম। সে হতবুদ্ধি হয়ে আমাকে দেখে চলছে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখের পলক ফেলছেন না।
আমি তার কানের গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
“আপনাকে জোরে একটা চুমু খাই?”
প্রিয়ল আমার গালে হাত রেখে আমার মুখটা তার সম্মুখে ধরলো।
তার দৃষ্টির পথ বিচরণ আমার মুখায়বে বয়ে চললো।
আমার নাকে তার নাক ছুঁইয়ে হেসে বললো,
“এই কথাটা জোরে বলতে পারলে জোরে চুমু খেতে দেব।”
শরীরের ঝাঁকুনিতে বুঝলাম ততোক্ষণে জ্যাম থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে অটো ছেড়ে দিয়েছে।
আমি মুখ গুমর করে তাকে ছেড়ে বললাম,
“সো ইউ আর নট ইনটেরেস্টেড ইন মাই চুমা।”
উনি পূর্বের হাসি মুখে বজায় রেখে বললো,
“তা কখন বললাম?”
আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম,
“তা নয় তো কি। আমি বলার সঙ্গে সঙ্গে আপনার উচিত ছিল ঝাঁপিয়ে পড়ে আমায় জোর করে হলেও চুমু খাওয়া। কিন্তু আপনি একটা শর্ত দাঁড় করিয়ে দিলেন। শর্ত দিলেন, শর্ত! ইউ রিফিউজড মাই চুমা।”
এরপর হাত-পা ছড়িয়ে আয়োজন করে অটোতে কাঁদতে বসলাম। উনি সশব্দে হেসে উঠে আমাকে বিড়ালের মতো তার বলিষ্ঠ বাহুডোরে আগলে নিলো।
আমার গালে তার গাল ঘর্ষণ করে বললো,
“প্রিয়লের প্রেয়সী, নির্লজ্জ বানিও না তাকে। সে যে তার বঁধুয়ার জন্য লজ্জাহীন ভালোবাসার শীর্ষে পৌঁছাতে পারে।”
এরপর থেকে আমি যেখানে, প্রিয়ল সেখানে। বেলা-অবেলা, সূর্যাস্ত-সূর্যাদয়, অপরাহ্ণ কিংবা মধ্যাহ্ন, স্মরণে বা বিস্মরণে সবসময় তার বিচরণ চলে। কখনো আমার কলেজের রাস্তায় কখনো বা আমার কোচিংয়ের সামনে, এমনকি আমার বিল্ডিংয়ের গেইটের আড়ালে তার হাসিমাখা মাথা চুলকানো অবয়ব দেখা যায়। আমি পুলকিত হই। শিহরণে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। বিধ্বস্ত ছারখার হয়ে ধকধক করা বুক নিয়ে শাওয়ারের তলায় দাঁড়াই। আব্বু-আম্মু যদি বুঝে যায়। মারবে খুব!
জানালার পর্দা খানিক টেনে স্বল্প পরিসরে তার হেলেদুলে চলে যাওয়া দেখি। উচ্ছ্বাসিত, প্রাণচঞ্চল তার দেহ ভঙ্গিমা। সুঠাম দেহের বাহু ছড়িয়ে যখন গুনগুন সুর তুলে, বিশ্ব জয় করা শাসিত ভ্রুযুগল তখন তার ফুঁটে ওঠে। আমি অধরে বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দেখি। সামনাসামনি এর বেশি অভিব্যক্তি প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই করিও না। বুক কাঁপার কথাও নয়, মুখ না ফোঁটাবার ব্যথাও নয়। শুধুই দেখি যাই।
তবে মেসেঞ্জারে শুরু হলো আমাদের নতুন সংসার, যেখানে প্রচন্ড লজ্জায় লুকাতে তার বুকেই আড়াল হতে হয় না।
(চলবে)