#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৮,১৯
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৮
২২.
বিয়ে বাড়িতে দলবেঁধে আত্মীয়-স্বজন আগমনের আনাগোনা ও প্রতিবেশীদের উৎসাহিত পদাচরণ ঘণীভূত হচ্ছে। চারপাশে নতুন নতুন মুখ, উচ্ছল ছেলেমেয়েদের রঙ-বেরঙের সাজ ও প্রানবন্ত গল্পের বহর।
আমার বয়সী মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছিলাম। আমার সহজ ভঙ্গির ব্যবহার ও তাতে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধে নিগূঢ়তা তৈরিও হয়েছিল।
কিন্তু আমাকেই পিছপা হতে হলো।
বিয়ে বাড়িতে আলোচনার উদ্বোধিত নানা বিষয়বস্তুর সঙ্গে আমি ও ফাহাদ সংযুক্ত হলাম।
ফাহাদের একটা খচ্চর ফুফাতো বোন আছে। মূলত সে-ই সবাইকে বলে বেড়িয়েছে আমার সঙ্গে ফাহাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বাদবাকিরা প্রবল উৎসাহে ফাহাদকে জিগ্যেস করতে সে-ও দ্বিগুণ প্রণোদনায় মাথা নাড়ছে।
মানুষ আমার মেজাজের পিছনে এতো কেন লেগেছে বুঝতে পারছি না। তারা কি চাইছে একটা দুটো খুন করে আমি এই বাসা থেকে বের হই? প্রথম দুজনের মধ্যে ফাহাদ আর তার ফুফাতো বোন মাস্ট থাকবে!
বিরক্ত হয়ে বাড়ির পিছনের দরজার অভিমুখে এগিয়ে গেলাম। দরজার পাশে ছাঁদে যাওয়ার সিঁড়ি। সিঁড়িতে পা রাখবো তখন দ্রুত গতিতে চলা কারও সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লেগে ধাক্কা খেলাম। আমি প্রায় উপুড় হয়ে সিঁড়ির গোড়ায় পরে যাই। চোখে আগুন জ্বালিয়ে পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি প্রিয়ল!
প্রিয়ল আমার মতো হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে ঘাড় কাত করা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
“ফাবলীহা!”
“প্রিয়ল!”
দুজনেই বিস্ময় বিহ্বলে পতিত হলাম।
“আপনি এখানে কি করছেন?”
প্রিয়ল মৃদু হেসে বললো,
“বিয়ে খেতে এসেছি।”
আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।
সে আমাকে ধরে ওঠালো। চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে পেছনের দরজাটি খুলে বাহিরে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রিয়ল আমার বাহুতে হাত রেখে বললো,
“আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। তুমি না বলেছিলি তোমার চাচার বাড়ি যাবে?”
আমি এখনও হতবুদ্ধি হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। মিনমিনে গলায় বললাম,
“মোজাম্মেল চাচ্চুকে চেনেন? উনি আমার বাবার বন্ধু।”
“হ্যাঁ চিনি, চিনবো না কেন? আমি তো ফায়াজের বিয়ে খেতেই এলাম। ও আমার মামীর..”
তখন কয়েকটা বাচ্চা কোথা থেকে যেনো ছুটে এলো। একে অপরকে থাবা মারার উদ্দেশ্যে একজনের পেছনে আরেকজন ধাবমান।
আমাকে আর প্রিয়লকে কয়েকবার প্রশিক্ষণ করে অন্যদিকে ছুটে চলে গেলো।
তখন ভেতর থেকে আমার মায়ের গলা শুনতে পেলাম,
“কেউ ফাবলীহাকে দেখেছো?”
প্রিয়লও আমার মায়ের গলা পেলো।
আমার গাল টিপে বললো,
“আমার শ্বাশুড়ি মা? দেখা করে আসি?”
আমি প্রিয়লের বুকে মৃদু আঘাত করে দৌঁড়ে ছুটলাম সদর দরজার দিকে। আম্মু পিছনের দরজার কাছাকাছি আসতেই তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম।
“উফ ফাবলীহা। ভয় পাইয়ে দিলি।”
আমি মুখে বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি যে নার্ভাস তা কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না।
আম্মু ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
“খেয়েছিস কিছু?”
আমি মাথা নাড়লাম।
আম্মু চোখ গরম করে আমায় ধমকে ওঠলো,
“একটা থাপ্পড় দেব মিথ্যা কথা বলবি তো আর। আয় তোর আব্বু তোর জন্য কেক আর আইসক্রিম এনেছে।”
আম্মুর পেছনে যাওয়ার আগে একবার পিছনের দরজা দিয়ে বাহিরে উঁকি মেরে দেখলাম। প্রিয়ল নেই। স্বপ্ন দেখিনি তো?
আম্মুর সঙ্গে রুমে গিয়ে দেখলাম। আব্বু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলেন। আম্মুও তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে পরিতোষপূর্ণ হাসি প্রদান করলো।
মহিলাটি আমাকে দেখে হাসি দিয়ে জিগ্যেস করলো,
“এটা আপনার মেয়ে?”
আম্মু জবাবে বললো,
“হ্যাঁ, আমার মেয়ে ফাবলীহা।”
মহিলাটি চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে পরিলক্ষণ করে কাছে ডাকলেন,
“এদিকে আয় তো।”
আমার গালে হাত রেখে বললো,
“কেমন আছিস?”
প্রথম সাক্ষাতেই উনাকে আমার বেশ পছন্দ হলো। উনার আচার-ব্যবহার গুছানো। নিয়মনীতির আওতায় বাধাপ্রাপ্ত সুপরিচালিত সংবিধানের মতো। চোখের পাতা-পল্লবে বিচক্ষণতা ছাপ, ঠোঁটের কোণায় ন্যায়পরায়ণতার সস্মিত।
কিছুক্ষণের আলাপে আমি উনার সঙ্গে একদম মিশে গেলাম। উনি হলেন ফাহাদের মায়ের বোন। কিন্তু আমি উনাকে আন্টি আন্টি বলে আলগা ভাব না দেখিয়ে মানসুরা খালা বলে ডাকলাম।
ফাহাদের মা আমাদের কথাবার্তার মাঝে নাস্তার প্লেট নিয়ে হাজির হলেন। উনার মুখ সেই পূর্বের মতো তিমিরাচ্ছন্ন নিয়ে জাহির।
তিনি আসতেই মানসুরা খালা ধমকে ওঠলো,
“এই মহিলা, তোর সমস্যা কি? যৌতুক দেয়নি বলে মন খারাপ? এতো অভাব হলে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নাম। নতুন থালা আমি কিনে দেব।”
ফাহাদের মা বেজার মুখে জবাব দিলেন,
“আমি কি বলেছি আমার মন খারাপ?”
“তাহলে ছেলেদের বিয়েতে এমন করে থাকিস কেন? তোর এমন চেহারা দেখতে এখানে আসিনি।”
ফাহাদের মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“জিনিসপত্র দেবে না বলে রাগ করিনি, কিন্তু যে সে ছোটলোক বলবে কোন সাহসে!”
“কে ছোটলোক বলেছে?”
ফাহাদের মাতা তখন আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন।
মানসুরা খালা আমাকে একবার দেখে চোখ সরিয়ে নিয়ে আব্বুর উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভাই আপনি বাহিরে যান তো।”
আব্বু গেলে উনি আবার বলতে লাগলেন,
“ছোট লোকের মতো কাজকর্ম করবি কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে যে সে। বলি, আত্মসম্মানে এতো ঘা লাগলে কর্মের পূর্বে তা খেয়াল হয় না? খেয়াল তখন হয়েছে, যখন ফার্নিচারের আশা ত্যাগ করে শূণ্য হস্তে বসতে হয়েছে!”
খালা আমার ধরে টেনে ফাহাদের মায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
“তুই না ওর প্রশংসা করে আনন্দে আটখানা হয়ে গিয়েছিলি? মেয়েটা আসলেই প্রশংসার যোগ্য। নাহলে এতো ছোট বয়সে তোর ছোটলোকী কর্ম বিশ্লেষণ করতে পারতো না। জিনিসপত্রের জন্য তোর রাগ নেই? তোকে আমি চিনি না? তুই আমার বোন। মেয়ের বাড়ির দামি দামি ফার্নিচারের জন্য যে তোর ভেতরের জল শুকিয়ে গেছে তা স্বীকার করবি না। তুই না করেছিলি? বরং এই নেই, সেই নেই বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলি। মোজাম্মেল ভাই থেকে সব শুনেছি। দুইটাই তো আবার এক জাতের! তালে তালে নাচুনি।”
মানসুরা খালা এতগুলো কথা বলে থামলেন। তার বোন প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না।
খালা আবার ধমকে ওঠলেন,
“থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দেব। ছোটলোক কি তোকে শখে বলেছে? তুই আমাকে বুঝ দিস!”
আম্মু বললেন,
“হয়েছে আপা বাদ দিন। দুদিন বাদে বিয়ে। বোনদের মধ্যে এমন করার দরকার নেই।”
ফাহাদের মায়ের চোখে জল দেখা গেলো। তার বোন আবার ধমকে ওঠলেন,
“এই আমার সামনে নাটক করবি না। ভালো না লাগলে বল, চলে যাই। কিন্তু অন্যায় কোনোকাল সহ্য করিনি, বোনের সঙ্গে রসের সম্পর্ক রাখতে এখন করবো ভাবিস না। উনার যৌতুক লাগবে, যৌতুক।”
ফাহাদের মা ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বললেন,
“আমার যৌতুক লাগবে না।”
খালা সঙ্গে সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“ঠিক আছে, কাঁদিস না।”
যেন তিনি তার বোনের উপচে পড়ে আদর চাওয়ার আশাতেই ছিলেন। তাই বোনকে আদরে আলিঙ্গন করে উপুড় করে ভালোবাসা ঢেলে দিলেন।
আমি তাদের দেখে মুচকি হাসলাম।
দুই বোন মিলে এরপর ছুটলো নানা গল্পের আটি বেঁধে বিয়ের অন্যান্য কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে।
তারা চলে গেলে আমি আম্মুকে জিগ্যেস করলাম,
“এমন ভালো মানুষের এমন বেক্কল বোন কিভাবে হলো।”
আম্মু কোমরে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে তাকালো।
আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
“চোখ রাঙিয়ে লাভ নেই। যাহা সত্য তাহা আমি বলিবোই।”
(চলবে)
#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৯
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
২৩.
ভ্রম আক্রান্ত হয়নি তা প্রমাণের প্রয়াসে সারাদিন প্রিয়লকে খোঁজে চললাম। কিন্তু পেলাম না। তখন নিজের মাথায় নিজেই চাপড় মারলাম।
আম্মুর ফোনটা নিয়ে তাকে একটু নক দিলেই তো হয়। আম্মুকে কাজে ব্যস্ত দেখে চুপটি করে তার ফোনটি নিয়ে কেটে পড়লাম। পরে আমার আইডি লগইন করি। অজস্র মেসেজে আমি ভেসে যাচ্ছিলাম! তুশিরা আর চাঁদনীর আইডি থেকে হাজারখানেক মেসেজ।
প্রিয়ল আইডিতে প্রবেশ করে দেখি পানোন্মত্ত বার্তার মেলা।
“কোথায় তুমি, কই তুমি, ভালো লাগে না, ভালোবাসি।”
সে আসলেই এসেছে নাকি আমার ভ্রম ছিল তা জিগ্যেস করতে যাবো; তখন একজন মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটি আমাকে ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চাপা গলায় চেঁচানোর মতো করে বললো,
“ভাবি!”
আমি আরও অবাক হলাম। আমার সামনে প্রিয়লের চাচাতো বোন লিহা। পিছনে ফাতিন দাঁড়িয়ে আছে। সে হেসে এগিয়ে এসে জিগ্যেস করলো,
“ভালো আছো ভাবি? তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমাদের নাজেহাল অবস্থা।”
ফাতিন কপালের ঘাম মুছার ভঙ্গি করলো।
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,
“আপনারা এখানে?”
লিহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“প্রিয়ল ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হয়নি?”
আমি সন্দিহান ভাবে মাথা নাড়লাম
লিহা বললো,
“ভাইয়াই তো বললো তুমি এখানে আছো। তাই তোমাকে খোঁজার অভিযানে নেমে যাই।”
যাক বাবা! তাহলে দিন দুপুরে স্বপ্ন দেখিনি। প্রিয়ল সত্যিই এসেছে। কিন্তু সে কোথায়?
লিহা বললো,
“মায়ের সঙ্গে দেখা করবে?”
তখন আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। ওহ ম্যান! লিহা আপু আর ফাতিন ভাইয়ার দেখা মিললো মানে প্রিয়ল স্বপরিবার এসেছে। তার মানে আমার শাশুড়িও এখানে উপস্থিত! শাশুড়ির প্রথম সাক্ষাতের চোখ রাঙানো চাহনি আমার এখনও মনে পড়ে। আমাকে দেখলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
আমি উল্টোদিকে ঘুরে দৌঁড় দিলাম।
লিহা ও ফাতিনও আমার পেছন পেছন ছুটলো,
“আরে ভাবি কোথায় যাচ্ছো?”
লিহা আমাকে খপ করে ধরলো। আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিগ্যেস করলো,
“দৌঁড়াচ্ছো কেন? আচমকা কি হলো?”
আমি মুখ কাচুমুচু করে জিগ্যেস করলাম,
“সবাই এসেছে না?”
“সবাই মানে?”
“তোমাদের পরিবারের সব সদস্য?”
“আমরা ভাইবোন আর গার্ডিয়ান বলতে শুধু আমার মা এসেছে। বাবা, বড় জেঠি, মেজো জেঠা-জেঠী তারা এখনও আসেনি। গায়ে হলুদের দিন সবাই আসবে। কিন্তু তাতে কি হয়েছে?”
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ফাতিন সশব্দে হেসে উঠে বললো,
“ভাবি কি আম্মুকে ভয় পাচ্ছিলে?”
ধরে পড়ে যাওয়ায় আমি লজ্জা পেলাম।
খানিক দূরেই ফাহাদের ফুফাতো বোন মিহি দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের দেখে, বিশেষকরে আমাকে দেখে তার সঙ্গে দাঁড়ানো মেয়েদের সঙ্গে ফিসফিস শুরু করে ওঠে। মুখ ভেঙচি কেটে মেঠো ঠুকরার ঠোঁটের মতো বানিয়ে ফেললো।
আমিও মুখ ভেঙচি দিয়ে লিহা ও ফাতিনের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
লিহা আর ফাতিন আমার সঙ্গে খুব ফ্রি হয়ে গেছে। প্রিয়লের বাকি ভাইবোনদের সঙ্গেও আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম সবাই আমার আর প্রিয়লের সম্পর্ক জানে।
আমি তাদের সম্মুখে উপস্থিত হতেই সবাই ভাবি বলে হুংকার ছেড়ে উঠলো।
আম্মু তখন আমাদের রুমের সামনে দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিলো। চলার গতি থামিয়ে মাথা কাত করে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমার উপর দৃষ্টি পড়তে ভ্রুজোড়া আরও কুঞ্চিত হয়ে এলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার নিজের মনে হেঁটে চলে গেলো।
আজকে যে কেন এতো বাঁশ খাচ্ছি!
লিহা আপুর দিকে ফিরে অনুচ্চ গলায় জিগ্যেস করলাম,
“তোমার ভাই কোথায় আপু?”
প্রিয়লের আরেক চাচাতো ভাই বলে ওঠলো,
“ভাবির ভাইকে দরকার? উহুম, উহুম।”
লিহা আপু ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“আপনারজন তো এলিয়েন। আপনাকে প্রতি দশ মিনিটে কল করে না পেলে তার তো শ্বাসরূদ্ধকর অবস্থা হয়।”
“বলেছে তোকে!”
বলতে বলতে ভাইটির ফোন বেজে ওঠলো।
লিহা আপু লাফ দিয়ে বললো,
“বলতে হয় না পাগলা। ক্যাসেট এমনিতেই বাজে।”
তার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো।
লিহা আপু আমার দিকে ফিরে বললো,
“ভাইয়া কোথায় আমিও জানি না, ভাবি।”
ফাতিন বললো,
“বোধহয় ফায়াজ ভাইয়ার সঙ্গে কোথাও গিয়েছে। লাস্ট টাইম তার সঙ্গেই কথা বলতে দেখেছিলাম।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হারিকেন হাতে নিয়ে সোয়ামীকে তন্নতন্ন করে খোঁজলাম। সন্ধ্যার পর দ্বিতীয় দফা খোঁজ অভিযানে খুঁজতে খুঁজতে একটা রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজার ফাঁক দিয়ে সুঠামদেহী এক পুরুষের অবয়ব ফুঁটে ওঠলো। খানিক বিস্তৃত করে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম খালি গায়ের ফর্সা আকর্ষণীয় দেহটি নড়েচড়ে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করছে।
ফর্সা পিঠটাকে নখ দিয়ে আচড় কেটে ট্যাটু আঁকতে ইচ্ছে করছে। পুরুষ মানুষের এতো সুন্দর দাগহীন পিঠ থাকবে কেন?
বিড়ালের মতো হাত উঁচিয়ে, আঙ্গুলদ্বয় তাক করে উল্লম্ফনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। প্রিয়লটা সবসময় সবকিছু ভেস্তে দেয়!
আমি ঝাঁপ মারার সাথে সাথে সে আমার দিকে ঘুরে যায়। তাই মাথা মাথা বারি খেয়ে দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ি। মেঝেতে পড়ে গিয়ে আমি পা ছড়িয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম।
প্রিয়ল তীর্যকভাবে খাটের উপর পড়লো।
আমি তার দিকে তাকালাম না।
প্রিয়ল উঠে এসে আমাকে তোলার চেষ্টা করে বললো,
“ফাবলীহা! ব্যথা পেয়েছো জান?”
আমি নড়লাম না। শক্ত হয়ে বসে রইলাম।
“জান?”
“কিসের জান? আমি কারও জান টান না। দূরে হাটুন।”
প্রিয়ল হেসে আমার পাশে বসলো।
“ব্যথা পেয়েছো? পেয়ে থাকলে স্যরি। খুব খুব স্যরি। তুমি এভাবে পিছনে এসে দাঁড়াবে আমি একদম বুঝতে পারি না।”
এরপরও আমার নড়াচড়া না দেখে প্রিয়ল গা ঘেঁষে বসলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
“মুখ ফুলিয়ে থাকলে তোমাকে ঠিক রসগোল্লা লাগে। কামড় দিতে মন চায়। ভুলে কামড় খেয়ে গালে দাগ পড়লে আমার কিন্তু দোষ নেই। আমি নির্দোষ ও সহজসরল মানুষ পূর্বেই সতর্কতা প্রদান করেছি।”
আমি মুখ ফুলিয়েই উনার দিকে তাকালাম। পিছনে খানিক হেলে গিয়ে তার পিঠের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বললাম,
“আমি আপনার পিঠে কামড় দেব।”
প্রিয়লও খানিক পিছিয়ে গেলো। ফলে তার পিঠ থেকে আমার দৃষ্টি সরে গেলো।
আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
“তুমি!”
এরপর কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে রইলো। দুষ্ট হাসি দিয়ে বললো,
“বদ্ধ ঘরে আমার পবিত্র দেহে তুমি দাগ লাগাতে চাইছো। ছিঃ, ছিঃ ফাবলীহা। এখনও বউয়ের আদরই পেলাম না, আর তুমি আমাকে অ-ভার্জিন বানিয়ে দিতে চাও!”
আমি হেসে ফেললাম।
এরপর আমিও তার গা ঘেঁষে অভিমানী গলায় বললাম,
“আপনাকে আমি পুরো বাড়ি খুঁজেছি। কোথায় ছিলেন সারাদিন? সুন্দরী মেয়েদের দেখে বউ ভুলে গেছেন?”
প্রিয়ল আমার গাল টেনে বললো,
“আর আপনি? মেসেঞ্জারে শখানেক মেসেজ দিয়েছি। হা হু তো দূর, ভুলবশত সীনও করোনি।”
আমি তখন চোখ পিটপিট করে অপরাধমূলক হাসি দিলাম।
কথা ঘুরানোর প্রযত্নে বললাম,
“আচ্ছা, আপনি এখানে কি হিসেবে এসেছেন? মানে কোন আত্মীয়তার সূত্র ধরে?”
“আমার মা অর্থাৎ তোমার শাশুড়ি।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
“হুম, হুম।”
“মায়ের ভাবি অর্থাৎ আমার মামীর ছোটবোনের ছেলে ফায়াজ। ছোটবেলা থেকেই মোটামুটি এই বাসার সঙ্গে যোগাযোগ। বিশেষভাবে, মামীর জন্যই। মামীর সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক ননদ-ভাবি নয়, ঠিক বোনদের মতো।”
আমি আমোদিত গলায় জিগ্যেস করলাম,
“এক সেকেন্ড, মানসুরা খালা?”
“হ্যাঁ, তুমি চেনো?”
“হ্যাঁ, চিনি। চিনি বলতে আজকেই দেখা হলো। এর আগে হয়নি। খুব ভালো মানুষ উনি। অল্প খানিকের কথাতেই বুঝলাম।”
“হ্যাঁ, আসলেই মামী খুব ভালো মানুষ। মামীর দুই ছেলেমেয়ে আছে। অবশ্য তারা আমার থেকে অনেক বড়। মামা কিছু বছর হলো মারা গেছেন।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
“আমার শ্বশুরমশাই?”
প্রিয়ল চুপ করে গেলো। সামনে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো।
এরপর মৃদু হেসে বললো,
“বাবা আমি ছোট থাকতেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ফাতিনের তখন ছয়-সাত বছর ছিলো। আর আমার ছিল বারো কি তেরো। তখন মা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন যেন তার মাঝেই আমরা বাবাকে খুঁজে পাই। মায়ের এই চেষ্টা, পরিশ্রম দেখে খুব ব্যথা হতো জানো। আগে তো মাকে আম্মু ডাকতাম। একদিন হুট করে প্রচন্ড কান্না করতে করতে মাকে মা মা বলে জড়িয়ে ধরি।”
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
প্রিয়ল বললো,
“ফাতিন আম্মু বললেও তখন থেকে আমি মা বলে সম্বোধন করি। এক লহমায় মনে হয়েছিল, মা ব্যতীত আমার জীবনের কোন কিছুর অভাববোধ নেই। মা আছে মানে আমার সব আছে।”
আমি প্রিয়লের কাঁধে মাথা রাখলাম। প্রিয়ল আমার কপালে ঠোঁট মৃদুভাবে ছুইয়ে বললো,
“থাক, মন খারাপ করে না। আমার মা অনেক ভালো। তোমার শ্বশুর মশাইয়ের কষ্ট পুষিয়ে দেবেন।”
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,
“তুমিও মন খারাপ করো না। আমার আব্বু তোমারও আব্বু।”
“কি, কি, আবার বলো!
আমি সোজা হয়ে বসলাম। প্রিয়ল কি রাগ করলো কথাটায়? এভাবে উদ্বেলিত হয়ে জিগ্যেস করলো কেন?
তখন লিহা আপু রুমে উঁকি মেরে বললো,
“আসতে পারি? অনুমতি দিলেও আসবো না। কারণ আমার অনেক লজ্জা। কিন্তু আপনারা যদি আপনাদের লজ্জাময় কর্ম বিরতি দিয়ে খাবার খাওয়ার জন্য আসুন, তবে অনেক উপকৃত হই।”
ডাইনিং টেবিলটি বেশ বড়সড়। বারোজন মানুষ বসার ব্যবস্থা আছে। আমি আব্বু আম্মুর মাঝখানে গিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো বসে পড়লাম। সোফা, মেঝে সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাচ্চা-কাচ্চারা বসে খাবার খাচ্ছে। সবাইকে সার্ভ করার দায়িত্বে আছেন মানসুরা খালা, ফাহাদের মা, আর একজন বুয়া।
বুয়া এমনিতে সবার বাড়ি বাড়ি ছুটা ছুটা কাজ করেন। বিয়ে বাড়ি বা অনুষ্ঠান হলে দীর্ঘ সময়ের জন্য কাজ নেয়।
কিছুক্ষণ বাদে প্রিয়ল এসে আমার বরাবর বসলো। তার দুইপাশে লিহা আর ফাতিন। তাদের মুখ টিপে মিটমিট হাসিতে বুঝলাম পরিকল্পনা করেই এইখানে জায়গা রাখা হয়েছে।
সোফায় বসে অট্টহাসি দিতে দিতে খাবার খাওয়া মিহির উদ্দেশ্যে আন্টি বললেন,
“এই মিহি, যা তো ফায়াজকে খেতে ডেকে আয় তো।”
“ভাইয়া খাবে না। ভাবির সঙ্গে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। এক মিনিট কথা বন্ধ করলে ভাইয়ার শ্বাস আটকে যায়।”
ওর কথায় সবাই হেসে ওঠলো।
পেছন থেকে ফায়াজ ভাই মিহির মাথায় চাপড় মেরে বললো,
“বলেছে তোকে!”
ফায়াজ ভাইয়া এসে বসলো।
মানসুরা খালার ছেলে বিহান ভাই বললো,
“তো প্রিয়ল, আমরা বিয়েশাদি করে বাচ্চা-কাচ্চাও বিয়ের উপযুক্ত করে ফেলেছি। তা তুমি বিয়ে করবে কবে?”
ফায়াজ ভাইও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললেন,
“হ্যাঁরে প্রিয়ল, তুই তো বলতি আমার আগেই তুই বিয়ে সম্পন্ন করবি।”
গলা নামিয়ে গোয়েন্দার ভঙ্গিতে বললো,
“তুই না কাকে যেন পছন্দ করতি। তাকেই নাহয় বিয়েশাদি করে ফেল।”
আমি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। পছন্দ করতো মানে! আগেই টাংকওয়ালা টাংকি জুটিয়ে নোটন নোটন পায়রা জোড়া খেলতো, আর আমার কাছে এসে প্রেয়সী প্রেয়সী বলে মুখে ফেনা তুলতো।
আমি প্রিয়লের পা আন্দাজ করে জোরে পায়ে আঘাত করলাম।
সে হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার পূর্বে ধাক্কার মতো খেলো।
বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো।
মানসুরা খালা হেসে বললেন,
“বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে তো করবেই। আগে তোরটা শেষ কর। ভুলে যাস না এখনও বিয়ে পেন্ডিং। মুহূর্তেই অনেক কিছু হয়েছে যেতে পারে।”
খালার কথা শুনে সবাই হেসে ওঠলো।
প্রিয়ল কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললো,
“আসলেই মামী। মুহূর্তেই অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে।”
আমি থমথমে মুখে বসে আছি। দৃষ্টি প্রিয়লের দিকে। কিন্তু এমনভাবে তাকিয়ে আছি যেন অন্যরা দেখে মনে করে উদ্দেশ্যহীনভাবে একদিকে তাকিয়ে আছি।
আব্বু জিগ্যেস করলো,
“কি হয়েছে আম্মু? খাও। মুরগি খাবে না? মাছ দিতে বলবো?”
আমি মাথা নাড়লাম।
আম্মু সন্দিহান চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আমার প্লেটটা টেনে নিলো। নিজ হাতে লোকমা তুলে আমার মুখে দিলো।
আচমকা পায়ে সুরসুরি অনুভূত হলো। অনেকটা লাফ দিয়ে ওঠলাম। আম্মু প্রশ্নবোধক চাহনি দিলো। মাথা ঝাঁকিয়ে স্বাভাবিকভাবে মুখের খাবার গিললাম। এবার পায়জামাটা খানিক উঠে খেলো। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রিয়লের দিকে তাকালাম। পা সরাতে যাওয়ার আগে আরেকটা পা এসে যুক্ত হলো। একজোড়া পায়ের মাঝখানে আমার অবলা সরু পাসহ ভোটকা প্লাজুর মতো পায়জামাটা বন্দি হয়ে রইল।
আম্মু ভ্রু কুঁচকে ধমকে জিগ্যেস করলো,
“কি হয়েছে তোর? হা করছিস না কেন?”
সবার দৃষ্টি আমার উপর এলো। মানসুরা খালা জিগ্যেস করলো,
“খারাপ লাগছে ফাবলীহা?”
আমি মুখ কালো করে বসে রইলাম।
আম্মু দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“এতো বড় একটা মেয়ে। অথচ এর জ্বালা-যন্ত্রণায়!”
প্রিয়ল কেশে গলা পরিষ্কার করে মানসুরা খালার দিকে চেয়ে বললো,
“মামী, আপনার পরিচিত কোনো বিবাহযোগ্য কন্যা থাকলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি খুশিমনে তার দায়িত্ব নিয়ে তার মাতাপিতার যন্ত্রণা কমাবো।”
খালা হাসলো এবং আমার আম্মু প্রত্যুত্তরে বললো,
“তাহলে বাবা তুমি আমার এই পাগল মেয়েটাকে নিয়ে যাও। বাসায় ঝাড়ুপেটা করে কাজ করাবে। আর কথায় কথায় গাল ফুলালে তেলাপোকা এনে সামনে ধরবে।”
আম্মুর কথায় সবাই হেসে দিলো।
অবশ্যই কয়েকজন ব্যতীত। কারণ কিছু মানুষের হাসার সিস্টেম যথারীতি বন্ধ, আর সেটা তাদের নিজস্ব সৃষ্টি কারণে।
ফাহাদ ও তার পরিবারকে উপেক্ষা করে আমি প্রিয়লের দিকে চেয়ে রইলাম। চান্দুকে তো আমি এতো সহজে ছাড়ছি না।
(চলবে)