তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান পর্ব_২২,২৩

0
265

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২২,২৩
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
২২

২৭.
সোফায় বসে বাটি হাতে আয়েশ করে কমলা খাচ্ছি। ফ্রিজ থেকে মাত্র নামানো বলে মুখে দিতেই ভেতর চিনচিন করে ওঠলো। একের পর এক কমলার কোটা উদরে স্থান নিয়ে উদরপূর্তি করতে পারলেও মন ভর্তি করতে পারছে না। মন ভরানোর জন্য প্রয়োজন সোয়ামীর গরম গরম চুম্বন।
সতর্ক চোখে ভ্রু নাচিয়ে এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলালাম। কোথায়, কার খাটের তলায় পড়ে আছে কে জানে।
তখন ফাহাদ তার ছোট্ট দেহটা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথা নিচু অবস্থায় চোখে মুখে সংকোচিত ভাব।
আমি চমকে ওঠলাম। এমন কুণ্ঠিত দৃশ্য খুব পরিচিত বোধ হচ্ছে।
আমি আমার বাটি সামনে বাড়িয়ে সেধে বললাম,
“খাবে নাকি ফাহাদ ভাই?”
“না ভাবি।”
বাড়ানো অবস্থাতেই আমার হাত স্থির হয়ে গেলো। চোখ দুটো অক্ষিগোলক থেকে বের হয়ে ফাহাদকে একবার প্রদক্ষিণ করলো।
আমি ভুল শুনেছি ভেবে জিগ্যেস করলাম,
“কি?”
ফাহাদ একই কুঞ্চিত ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
“আপনি খান ভাবি।”

ঝনঝন করে কিছু পড়ার শব্দ পাওয়া গেলো।
মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, ফাহাদের মায়ের হাত থেকে খাবার সহ কাচের বাটি পড়ে গেছে। সেই শব্দে আম্মু, মানসুরা খালা, আব্বু-চাচ্চুও ছুটে এলো। সেইসাথে তারা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি মেকি হাসি দিয়ে জিগ্যেস করলাম,
“তুমি আমাকে ভাবি ডাকছো কেন ভাই?”
সে উত্তর দিলো,
“ভাই হিসেবে তো বোন ডাকা উচিত। কিন্তু আমার অনেক ইচ্ছা।”
মোজাম্মেল চাচ্চু তৎক্ষণাৎ দূরে দাঁড়ানো থেকে জিগ্যেস করলেন,
“কি ইচ্ছা?”
ফাহাদ সেইদিকে তাকালো না। আমার দিকে মনোযোগ রেখে বললো,
“আপনাকে আমার ভাবি বানাবো, ভাবি। আমি স্বপ্ন দেখেছি, ভাবি। খুব গভীর স্বপ্ন, ভাবি। আপনাকে ভাবি না বানালে আমি বানর হয়ে যাবো, ভাবি। তা-ও আবার মেয়ে বানর, ভাবি।”
আমি মাথা হালকা কাত করে পেছনে তাকালাম। সবার বিস্ফোরিত দৃষ্টি ফাহাদের দিকে নির্দিষ্ট!
বিস্ফোরণ ঘটিত দৃষ্টি আমারও। তবে তাতে একাধিক কারণ নিহিত বলে।
দাঁত বের করে অনুচ্চ গলায় বললাম,
“নাইস তো।”

“এই ফাহাদ কি বলছিস এসব!”
আন্টির চিৎকারে ফাহাদ থতমত খেলো। গাল চুলকিয়ে হাঁসফাঁস করে বললো,
“যা শুনছো তা-ই বলছি।”
প্রিয়ল তখন শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়ালো। আমি প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।
আন্টি তেতে উঠে বললেন,
“তুই কি কিছু খেয়েছিস? মাতাল হয়ে গিয়েছিস? ফাবলীহাকে তুই ভাবি ডাকবি কেন? তোর ভাবি নাই!”
ফাহাদ আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বললো,
“সম্ভব হলে তো ভাবিকে আমার ভাবিই বানাতাম। এখন আমার নিজের ভাই দ্বারা যেহেতু সম্ভব নয়..”
ফাহাদ প্রিয়লের দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাত চেপে ধরে বললো,
“ভাইয়া, আপনি তো আমার আপন ভাইয়ের মতো। আপনি ভাবিকে বিয়ে করবেন?”
প্রিয়ল থতমত খেয়ে হাত গুটিয়ে নিতে চাইলো। থেমে থেমে বললো,
“আমি কিভাবে? মানে.. কি বলছো ফাহাদ..”
ফাহাদ আকুতি ভরা কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“প্লিজ প্লিজ ভাইয়া, প্লিজ! প্লিজ আপনি ফাবলীহা ভাবিকে বিয়ে করুন।”
মিহি আন্টির পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,
“ফাহাদকে তো গাজাখোর ভাবিনি মামী। আচও করতে পারিনি। সে কবে থেকে এসব সেবন করছে?”
আন্টি তখন চিৎকার করে ওঠলেন,
“ফাহাদ!”
ফাহাদ ওসবে পাত্তা না দিয়ে প্রিয়লকে রাজী করানোর চেষ্টায় লেগে থাকলো। তাকে টেনে এনে আমার পাশাপাশি বসিয়ে দিলো। অশ্রুসিক্ত গলায় বললো,
“মাশাল্লাহ! কি সুন্দর লাগছে। কারও নজর না লাগুক।”

আমাদের থেকে দৃষ্টি বিকর্ষণ করে সে আমার আব্বুর কাছে দৌঁড়ে গেলো। তাকে গিয়ে টেনে আমাদের সামনে নিয়ে এলো।
বললো,
“দেখুন আঙ্কেল। কতো সুন্দর লাগছে না? এক্কেবারে মনিকাঞ্চন যোগ। তাই না?”
ফাহাদের এমন লাফ ঝাঁপ মারা দেখে আব্বু বুঝি ভয়ই পেলো। ঢোঁক গিলে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভালো।”
ফাহাদ আবার প্রিয়লের হাত ধরে বললো,
“করবেন ভাই? বিয়ে করবেন? বিয়ে না করলে কিন্তু আমি ছাদ থেকে লাফ দেব।”
প্রিয়ল হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“এতো করে বলছে যেহেতু, তখন আর কি করার।”
আমি চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালাম।
আন্টি এসে ঠাশ করে ফাহাদকে একটা থাপ্পড় লাগালো।
“অসভ্য ছেলে! পাগল হয়ে গিয়েছিস? ফাবলীহা তোর কোন জন্মের ভাবি হয়?”
ফাহাদ হাটু গেড়ে বসে আমার পা ছুঁয়ে নমনীয় গলায় বললো,
“ভাবি নয়, এ তো আমার মায়ের মতো।”
আমি আর প্রিয়ল বাদে বোধহয় উপস্থিত সবাই ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ বলে চিৎকার করে ওঠলো। আমি কান চেপে ধরলাম।
আন্টি ফাহাদকে ধরে লাথি, উস্টা, কনি দিতে লাগলেন।
“কি খেয়েছিস তুই সত্যি করে বল। ওই ক্ষ্যাপাটে রাজুর পাল্লায় পড়েছিস না? ওর দলের সঙ্গে মিশে এটা ওটা গিলছিস না?”
ফাহাদ বুক ফুলিয়ে বললো,
“মেরে আমাকে রক্তাক্ত করো। কিন্তু ফাবলীহা ভাবি আমার ভাবিই রবে।”
“হারামজাদা! এসব ফিল্মি ডায়লগ আমার সাথে মারাস? ছাগলের বাচ্চা!”
ফাহাদের মাথায় ঠুনডা মারতে মারতে আন্টি তাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলেন।
প্রিয়ল তখন আমার পাশ থেকে উঠে নাচতে নাচতে বাহিরের দিকে গেলো। এমন ভাব, সে সত্যিই ফাহাদের আবদার রাখতে আমাকে বিয়ে করতো। আর ফাহাদকে বানর হওয়া থেকে বাঁচাতো।
আম্মু তখন আমার সামনে এসে কোমরে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়ালো।
আমি সন্দিহান গলায় জিগ্যেস করলাম,
“হোয়াট?”
আমি উল্টো সন্দেহবাতি গলায় জিগ্যেস করলেন,
“তোকে সবাই ভাবি ভাবি করে কেন? যেখানে যাস সেখানেই দেখি মানুষ ভাবি ভাবি বলে হোল্লা করে।”
আমি কপট রাগান্বিত গলায় বললাম,
“আশ্চর্য! সুন্দরী এবং বিবাহ উপযোগী মেয়ে। এমন মানুষকে সবাই বিবাহিত হিসেবে দেখতে চাইতেই পারে। অথচ তোমরা, ছ্যাহ! মেয়ের জন্য পছন্দ করো গানজুটি, পাগলাগারদের পাবলিক, ল্যাঙড়া-লুলা। ছ্যাহ, ছ্যাহ! থু!”
আম্মুর ভ্রুকুটি সরে গিয়ে আড়ষ্টতা দৃশ্যমান হলো।
আব্বুর দিকে তাকাতে তিনি কাচুমুচু করে অন্য দিকে তাকালেন।
তাদের মুখভঙ্গি দেখে বললাম,
“কি হলো? এখন মুখের বুলি নিশ্চল কেন? ভাগ্যিস! বরিশালের পাগল অন্তত ধরে এনেছিলে। কয়দিন পর তো দেখা যাবে হিজড়া ধরে এনে বলতে, নে মা। নম্র-ভদ্র ছেলে। ফুফুর সঙ্গেও চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। সুন্নত পালনে বিছানায় ঘুমায় না, ডাইনিং টেবিলে ভাত খায় না। কিন্তু তলে তলে একটু পর্ণ এডিক্টেড।”
আম্মু বলে ওঠলো,
“ছিঃ, ছিঃ, নির্লজ্জ মেয়ে! এসব কি ধরণের ভাষা?”
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,
“খারাপ ভাষা? তওবা পড়বো? তোমাদের পায়ে ধরে সালাম করবো মাতা-পিতা?”
আম্মু চোখ রাঙালে আমি উল্টো চেঁচিয়ে ওঠলাম,
“বিয়ে দেবে, সংসার করবে অথচ আমি এইটিন প্লাস কিছু জানতে পারবো না? বলি, জামাইয়ের সঙ্গে কি ধানক্ষেতে ধান বানবো? মাটিতে ষোলো ঘর কেটে এক্কাদোক্কা খেলবো?”
আব্বু মুখ কালো করে চলে গেলেন।
আমি গলা উঁচিয়ে ডেকে ওঠলাম,
“এই এই, মহাশক্তিধর পিতা! খাড়য় তুমি!”
আম্মুও যেতে নিলে আমি তার হাত ধরে আটকালাম,
“সিমরানের আবেগী বাপের বউ! তুমি দাঁড়াও।”
আম্মু মুখ গম্ভীর করে দাঁড়ালেন।
আমি আফসোস করে বললাম,
“সিমরানের আসল বাপ তো সিমরানকে বিয়ে শাদি দিতে চায়নি। আর আমার নকল সিমরানের বাপ মেয়েকে দেওয়ার জন্য অস্থির। এইজন্য নকল জিনিস ডেঞ্জারাস। আবার এক নকলের মাল আরেক নকল পছন্দ করে এনেছে।”
“হয়েছে? তর্কাতর্কি শেষ?”
আম্মুর কথায় মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“নোপ! তুমি এখন আমার দেবর ওরফে ফাহাদকে আমার সামনে নিয়ে এসো।”
মানসুরা খালা এসে হাসলেন। পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
“মা-মেয়ে ঝগড়াঝাটি পরে কর তো দেখি।”
আমার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনি একটু আমার সঙ্গে আসুন আপা।”
আম্মু তখন খালার সামনেই বললো,
“শোন, তোর বাপের নাচুনির জন্য আমি মত দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নাহলে আমার এই ফাহাদ ছেলেকে একদম পছন্দ না! এই বাড়িই পছন্দ না। আপা আপনি রাগ করতে পারেন। কিন্তু আমি এই ঘরে আমার মেয়েকে দিতে চাই না।”
আমি ভেটকি মেরে বললাম,
“এখন আমার ইমোশনাল হয়ে চিৎকার করে মাটিতে মোচড়া-মুচড়ি করতে ইচ্ছে করছে। তুমি রাজি না। আবার নিজের পতীকে খুশি করবার জন্য মেয়েকে কেটে ভাসিয়ে দিতে উদ্যত। তোমাগো পাদের লজিক!”

ভেবেছিলাম আম্মু ধমকে উঠে সপাৎ করে লাগাবেন। কিন্তু তিনি রাগান্বিত হলেন না।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোর বাপকে এবার আমি শায়েস্তা করবো। হিন্দি ছবি দেখতে দেখতে বন্ধুর ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ঢঙ অনুসরণ করছে। ঢঙ আমি ময়লা পানির সঙ্গে মিশিয়ে যদি তোর এই বাপকে না খাইয়েছি।
আর এই বয়সে কোনো বিয়ে ফিয়ে না। করলে একেবারে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে সাত-আট বছর পর।”
আম্মু আমার কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলো।

এতো ভালো হতে কে বলেছে? সাত-আট বছর পর বিয়ে দেবে মানে? স্বামী-স্ত্রী তো দিব্যি আমাকে একা রুমে ফেলে রেখে ঘুমায়। গভীর রাতে একা ঘুমানোর কষ্ট কি তারা বুঝে?
ভূতকে কার্টুন হিসেবে কল্পনা করে, ভেতরে ভয় চেপে রেখে ঘুমানোর যন্ত্রণা তারা জানে! মাঝেমধ্যে তো কোল বালিশকে দেখলেও আঁতকে ওঠি, আল্লাহ এডা কেডা শুইতা আছে!

একজন পছন্দ করে আনে প্রতিবন্ধী, আরেক জনের তো পছন্দ করার সিস্টেমও নষ্ট। প্রিয়লের মতো সুন্দর ছেলেটাকে কি তাদের নজরে পড়লো না? মন চাইলো না এমন ভদ্র একটা ছেলের সঙ্গে নিশ্চিন্তে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়?
আমার বাপ-মা দুজনের টেস্টই ওয়াক ওয়াক, ওয়াক। এইজন্য দুজন দুজনকে পছন্দ করেছে, আবার এতো বছর ধরে সংসার করছে।

(চলবে)

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২৩
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৮.
অলস ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে বাহিরে গিয়ে দাঁড়াই। বাগানের অপর পাশে, উঠোনের শেষ মাথায় প্রিয়ল তার কাজিনদের সঙ্গে অবস্থানরত ছিল। তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসি-ঠাট্টা করছিল। পেছনে হাত রেখে কোমর মৃদু দোলাতে দোলাতে আমি কিছুটা দূরত্ব নিয়ে তাদের পিছনে দাঁড়াই।
ফাতিন ভাইয়া প্রিয়লকে কনুই দ্বারা গুঁতো মেরে পিছনের দিকে ইশারা করে। প্রিয়ল একবার পিছনে তাকিয়ে আবার তার কাজিনদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমার মন খারাপ হয়ে যায়। প্রিয়ল আমাকে পাত্তা দিলো না কেন? আমি কি বিরক্ত করলাম?
করেছিই তো। তার তো ব্যক্তিগত স্পেস প্রয়োজন। ভাইবোনদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। তার মাঝখানে সবাইকে ছেড়ে আমার সঙ্গে প্রেমের আলাপ কেন করতে আসবে। আর আমিই বা কেন এতো লেইম হচ্ছি।
পরক্ষণেই মন আরও খারাপ হলো। আমি তো তাকে বিরক্ত করি না। তার পিছন পিছন তো সর্বক্ষণ ঘুরিও না।

প্রিয়ল আরেকবার আমাকে দেখে ওখান থেকে প্রস্থান নিলো। আমার তখন ঠিক কান্না পেলো। এতো অবহেলা!

আমি চলে যাচ্ছিলাম। ফাতিন ভাইয়া তখন ডেকে ওঠলো,
“ভাবি!”
পিছনে ফিরে তাকালে আমাকে দাঁড়ানোর জন্য ইশারা করে। এরপর গেইটের দিকে তাকায়। তাকে অনুসরণ করে সেইদিকে আমিও দৃষ্টি নিক্ষেপ করি।
প্রিয়লের সঙ্গে ফাহাদ তার বাইক নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ফাহাদ পকেট থেকে বাইকের চাবি প্রিয়লের নিকট হস্তান্তর করে দ্রুত পদে প্রস্থান নেয়।

আচমকা প্রিয়লের ভাইবোনেরা হুড়মুড় করে আমার পেছনে এসে জটলা বাঁধে।সব একত্রিত হয়ে অবস্থান নেয়, ফলে বাড়ির মূল ফটক থেকে আমি আড়াল হয়ে যাই। তারা হৈ-হুল্লোড় শুরু করলো। হঠাৎ কেন এমন করছে কিছুই বুঝলাম না।
আমি দ্বৈধিভাব নিয়ে গেইটের নিকট দাঁড়ানো প্রিয়লের দিকে তাকাই। দেখি প্রিয়ল জানপ্রাণ দিয়ে বারবার ইশারা করে আমাকে ডাকছে। আমি ভ্রু কুঁচকে দ্রুত তার দিকে পা চালিয়ে যাই।
তার কাছে যেতেই সে তাড়াহুড়ো করে বললো,
“তাড়াতাড়ি উঠ জান!”
আমি মাথা ঘুরিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে তাকাই।
প্রিয়ল আবারও তাড়া দিলো। এক আকাশসম দ্বিধা আর প্রশ্ন নিয়েই বাইকে উঠি। উঠতেই প্রিয়ল বাইক ছেড়ে দেয়।

মূল রাস্তার পাশ দিয়ে আরেকটি রাস্তা গিয়েছে। ঠিক পরিত্যক্ত নয়। তবে পুরোপুরি মেরামত করাও নয়। ভাঙাচোরা ফাঁকা ব্রিজের পর মাটির শক্ত রাস্তা চলে গিয়েছে। প্রিয়ল ব্রিজের গোড়ায় বাইক নিয়ে থামালো।
বাইক থেকে নেমে মৃদু হেসে বললো,
“এখন মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি প্রেম করছি। একটা জোস ফিলিং আসছে।”
আমি বাইকে পা ঝুলিয়ে বসি। প্রিয়ল আমার দুইপাশে হাত রেখে বললো,
“এখন সুন্দরী বউটাকে কঠিন একটা চুমু খেতে পারলে প্রেমের ষোলো কলা পূর্ণ হবে।”
আমি তার বুকে হাত রেখে খানিক ঠেলে সরিয়ে বললাম,
“নো ভাঁওতাবাজি। আমি রাগ করেছি।”
প্রিয়ল অবাক হয়ে তাকালো।
“কেন? এভাবে নিয়ে এসেছি বলে? আর কিভাবে বলো। তোমার ফাদার-মাদার, সেইসঙ্গে বাড়ির চৌদ্দগুষ্টির সামনে তোমার সঙ্গে কথা বলা যায়? আর আমার শাশুড়ি মা তো সবসময় তোমাকে আচলের তলায় নিয়ে রাখে।”
আমি গম্ভীর গলায় বললাম,
“আমি ফাহাদ না যে মায়ের আচলের তলায় তলায় ইঁদুরের মতো ঘুরবো।”
প্রিয়ল হেসে বললো,
“তোমারই তো দেবর।”
আমি জবাব দিলাম না। মুখ অন্যদিকে আরও ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম,
“আপনি তখন আমাকে ইগনোর করেছেন।”
প্রিয়ল চকিত গলায় আওড়ালো,
“কখন!”
“উঠোনে যখন আমি আপনাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।”
প্রিয়ল তখন হু হা করে হেসে ওঠলো।
হাসি থামিয়ে বললো,
“তোমার এখন মুড সুইং সেশন চলছে। হয়, হয়।”
আমি চোখ রাঙিয়ে জিগ্যেস করলাম,
“হয় হয় মানে? কি হয়?”
প্রিয়ল আমার নিকট আরও খানিক এগিয়ে এসে হালকা গলায় বললো,
“নতুন নতুন বিয়ের পানি পড়লে নতুন বউদের এমন হয়।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
প্রিয়ল হেসে বললো,
“আমি না, বড়রা বলে।”
আমি গুমর মুখে বললাম,
“আমি মোটেও নতুন বউ না।”
“না হলে আবার নতুন করে নতুন বউ হবে।”
আমি কিছু না বলে কনুই ভাঁজ করে ভেঙচি কাটলাম।
“অনেক দিন ধরে তোমার সঙ্গে অসভ্যতা করি না। না করলে মামলা করবে কিভাবে? এই ফাঁকা জায়গায় একটু অসভ্যতা করি?”
প্রিয়ল ঠোঁট গোল করে এগিয়ে আসলে আমি চেঁচিয়ে ওঠলাম,
“প্রিয়ল!”
প্রিয়ল চোখ খুলে বিরক্ত ভাবে তাকালো।
“ডিস্টার্ব।”
বলেই আমার গাল চেপে ধরে চুমু খেলো।
আমি তার থেকে ছুটার কপট চেষ্টা করে বললাম,
“বাছাও!”
প্রিয়ল হেসে দিলো।
আমার রাগ সরে যেতে জিগ্যেস করলাম,
“আচ্ছা, এবার বলুন তো কাহিনী কি। ফাহাদ আপনি ভক্ত কিভাবে হলো, তা-ও আমাকে ভাবি হিসেবে গ্রহণ করে?”
প্রিয়ল হাসলো।
তার হাসি দেখে আমি সন্দিহান হয়ে জিগ্যেস করলাম,
“আপনি সত্যি ওকে ন্যাংটা করিয়ে দেননি তো?”
“আসলে, প্রথমে এরকমই চিন্তা-ভাবনা ছিল। ছেলেটাকে আমি ভালোই ভেবেছিলাম। কিন্তু..”
“কিন্তু?”
প্রিয়ল মাথা চুলকে দুষ্ট হাসি দিয়ে বলতে লাগলো,
“ওইদিন ফাহাদকে আমরা কয়েকজন মিলে পাকড়াও করি। সন্ধ্যার পর ঘুরতে বের হওয়ার কথা বলে তাকে এখানেই নিয়ে আসি। বেটা খুব ধুরন্ধর। এই কথা সেই কথা বলে আমাকেই মারপ্যাঁচে ফেলতে চায়। প্রচন্ড রেগে গিয়ে তার তলপেটে লাথি মারি।”
আমি আঁতকে উঠে বলি,
“ওহ শিট!”
প্রিয়ল হেসে বললো,
“তলপেটেই মারি।”
“এরপর?”
“আরও কয়েক ঘা দিয়ে তার মোবাইল কেড়ে নিই। তার মোবাইল দিয়েই তাকে মার দেওয়ার ভিডিও করবো। তোমার পিছন ছাড়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হলে তার আইডি থেকেই আপলোড করা হবে।এটা ছিল প্রাইমারি প্ল্যান।”
“এরপর?”
“তার ফোন নিই। গ্যালারি প্রবেশ করে আমি চারশো চল্লিশ ভোল্টের শক খাই।”
“কেন?”
“তোমার মা-বাবার ঠিক করা সুপাত্র..
আমার লজ্জা লাগছে ফাবলীহা।”
আমি উত্তেজিত গলায় বললাম,
“আরে! আমার কাছে কিসের লজ্জা। আমি তো আপনার বউ-ই।”
“তাই?”
মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“একদম।”
“হি ইজ অ্যা পর্ণ এডিক্টেড।”
আমার মুখ হা হয়ে যায়। আমি কথা বলতেই ভুলে যাই।
“তার গ্যালারি জুড়ে ওসব ভিডিও। এরপর আরও ঘাটাঘঘাটাঘাটি করে বুঝলাম সে ভালো রকমের এডিক্টেড। তাকে ওয়ার্নিং দিলাম, আর ফাবলীহা ফাবলীহা করলাম প্রথমে তাকে ডাক্তার কাছে নিয়ে খোজা করবো। এরপর জিহ্বা কেটে দেব।”
আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,
“রাজি হয়ে গেছে?”
“তার ফোন আমার কাছে। ভিডিও কবে ডাউনলোড করা ডেইট, ডিটেইলস তো সব শো হয়। তোমার মা-বাবা আর ফাহাদের বাবা যথেষ্ট আধুনিক। দেখালে বুঝবে। না হলে, ফায়াজও আছে। সে তো নিশ্চয়ই নিজের ভাইয়ের কর্ম সমন্ধে বুঝবে। আল্লাহ জানে নাকি দুই ভাই-ই এক ক্যাটাগরির।”
আমি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম।
ধীর কণ্ঠে বললাম,
“ফায়াজ ভাইয়া এমন নয়। একদমই নয়।”
প্রিয়ল যেনো খানিক অবাক হয়ে তাকালো। বললো,
“ঠিক আছে। আমি তো নিশ্চিত করে বলিনি। বললাম সেই অনুযায়ী যে, ফাহাদ ছেলেটাকে এতোটা নোংরা ভাবিনি। কিন্তু কি বের হলো?”

আমার হাত-পা কেমন যেন অসাড় হয়ে গেলো। কথা বলার রুচি হারিয়ে গেলো। হতাশা ও বিতৃষ্ণাসম্পন্ন একটা অনুভূতি গা ঝমঝম করে সাড়া দিলো।
না ঘটা ঘটনা বারবার মস্তিষ্কে অভিঘাত হানছে। যেমন ফাহাদের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি। কিন্তু এমন একটা বিচ্ছিরি অনুভূতি হচ্ছে যে, ওমন একটা ছেলে আমার জীবনের সঙ্গে জড়িত; আমার নিজের মা-বাবা, জন্মদাতা মা-বাবা আমার সঙ্গে জড়িয়েছে।
আকস্মিকভাবে মুখ দিয়ে বের হলো,
“ছিঃ!”
মুখভর্তি করে থুথু এলো। বিলম্ব না করে শব্দ করে একদলা থুথু ফেললাম।
প্রিয়ল আমার পাশে চুপচাপ বসে আছে।
সে আমার কাঁধে হাত রেখে ডাকলো,
“ফাবলীহা?”
সাড়া দিতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে ওঠলো। কম্পিত গলায় বললাম,
“মেয়েদের জন্য এটা কেমন যন্ত্রণাময় আপনি বুঝবেন না প্রিয়ল। ধরুন আপনার সঙ্গে আমার কখনো সাক্ষাৎ হলো না। কারও এমন ভদ্র সন্তানকে রিজেক্ট করার জন্য হোক কম বয়সী, তবুও একটা মেয়েকে যে পরিমাণ সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়!”
আমি থেমে গেলাম। ঠোঁট কামড়ে পুরো ব্যাপারটা ভাবলাম। সব যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে। সব যেনো ভুলে যাচ্ছি।
প্রিয়ল আমাকে আরেকটু কাছে টেনে বললো,
“বলো। আমাকে সব বলো। আমি তোমার সব কথা শুনতে চাই। আমি আছি তো। আমাকে বলো।”
প্রশ্রয় পেয়ে অমর্ষিত গলায় ঝেড়ে বললাম,
“এখন ফাহাদকে পছন্দ না করার কারণ জানতে চাইলে জোর গলায় বলতে পারবো আমার অন্য কেউ পছন্দ। তখন! তখন আমাকে আমার চরিত্রের মাপজোক প্রধান করতে হতো। এই ফাকাইদ্দা জানোয়ারটাকে আমার প্রথম থেকেই অপছন্দ। চূড়ান্ত অপছন্দ! জানেন, আম্মুকেও আমি অগোচরে বলে ফেলেছিলাম সে একটা পর্ণ এডিক্টেড। অথচ এটা সত্য! চরম রকমের সত্য! অপছন্দ একটা মানুষের সঙ্গে নিজের বাপ-মা যখন বিয়ে দিতে চায় তার অসহ্য যন্ত্রণা, কিড়মিড় করে উঠা রাগ আমি বুঝাতে পারবো না। ইচ্ছে করছে নিজের দেহটাকে ব্লেড দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটি।”
“হেই! ফাবলীহা..”
আমি কেঁদে দেই।
“আপনি না থাকলে ব্যাপারটা তো কখনো খোলাসাই হতো না। কিন্তু কেন না! কেন আমাকে বাবা-মা ব্যতীত অন্যের মুখপানে নিশ্চয়তার আশায় চেয়ে থাকতে হবে? মা-বাবা কেন আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না? কেন, কেন, কেন! আমি কি ভুল সন্তান? ভুল করে আমার মায়ের গর্ভে এসেছি? গর্ভপাত হয়নি বলে জন্ম দিয়েছে? তাই বন্ধুর মন রাখতে আমার বাপ ভদ্রভাবে ভদ্র সমাজে আমাকে বিকিয়ে দিতে চায়?”
প্রিয়ল আমাকে জড়িয়ে ধরে।
“এসব বলে না ফাবলীহা। মানুষের ভুল হয়। তুমি শান্ত হও। আমি আছি তো।”
আমি শান্ত হতে পারলাম না। মেনেও নিতে পারলাম না। হাসিখুশি আমি’র মাঝে লুকিয়ে থাকা অস্পষ্ট ভয়, মা-বাবা সম্পর্কে মনের গহীনে শয়ন করা নিকষ কালো আঁধারময় চিন্তা-চেতন আজ বাষ্পের ন্যায় উড়ে বেড়িয়ে এলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here