#চক্রব্যুহ,২০,২১
মোহাম্মদ মনোয়ার
[বিশ]
‘রাত একটা দশ। চক্রব্যুহ অফিস। মিরপুর ডিওএইচএস।‘
আরিফের ঘুম টুটে গেছে উত্তেজনায়। হাসিবের সাথে বসে সমস্ত কল লিস্ট, এই কদিনের নোটস আর থানার কাগজপত্র নিয়ে বসেছে খাবার টেবিলে। এর মাঝে দুই মগ কড়া করে এক্সপ্রেসো কফি শেষ করে তৃতীয় মগ নিয়ে বসেছে। হঠাৎ হঠাৎ দুই একটা প্রশ্ন করেছে হাসিব। অতি সাধারণ প্রশ্ন। তদন্তের মোড় কোনদিকে ঘুরে যাচ্ছে বুঝার চেষ্টা করছে আরিফ। এমন সময়ে নিকুঞ্জ থানার ইনস্পেক্টর হাবিবের ফোন। হাসিব মনে হয় ফোন কলটির জন্য উদগ্রীব ছিলেন। সাথে সাথে ফোন রিসিভ করলেন।
-হাবিব! জিসান আহমেদকে পাকড়াও করেছেন?
-স্যার, সেটার জন্যই ফোন দিয়েছি। ওয়ারেন্ট বের করে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আপনি কি ক্রসচেক করতে চাচ্ছেন? প্রচুর ফোন আসছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। সকালের আগেই ব্যাটাকে ছেড়ে দিতে হবে মনে হয়। পুলিশের হেড অফিস থেকে ফোন এসেছে। সচিবালয় থেকে ফোন এসেছে। এমনকি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী স্যার নিজে ফোন করেছিলেন। ওসি স্যার চাপ নিতে পারছেন না। উনি আপনার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।
-হুম, জানতাম। ওসি সাহেব আছেন এখনো?
-না স্যার।
-আমি আসছি। দশ মিনিট। এমনিতেও একে ছেড়ে দিতে হবে। আবরার হোসেনের নিখোঁজের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত নয় সে। কিন্তু আমার কিছু ইনফো প্রয়োজন। আমি আসছি।
খুব নিরুবেদ্দ্বেগ কণ্ঠস্বর হাসিবের। যেন কিছুই হয়নি। ফোন কেটে দিয়ে তাড়া দিলেন আরিফকে। “ভোরের দিকে গাজীপুর যেতে হবে। তার আগেই কিছু ইনফো দরকার আরিফ। যাবে আমার সাথে? নাকি একটু ঘুমিয়ে নেবে?”
-অসম্ভব স্যার। ঘুম আসবে না আমার। চলুন বের হই।
…
‘রাত পোনে দুই। নিকুঞ্জ থানা।‘
-স্যার। আপনাকে এখানে দেখে সত্যিই খুব দুঃখিত। আমাকে চিনতে পেরেছেন স্যার?
হাসিব উদ দৌলাকে স্যার ডাকতে শুনে খুব অবাক হয়েছে আরিফ। জিসান আহমেদ তার পূর্ব পরিচিত?
-মিঃ হাসিব! আপনি এখানে! আপনাকে মনে না রাখার কোন কারণ নেই। পরিচয় পর্বটা খুব সুখকর কিছু ছিল না যদিও। আপনি কি এখনো গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করছেন?
হাত বাড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে জিসান আহমেদ। ইনস্পেক্টর হাবিব অবাক দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন। নিশ্চয় কোন বাজে তদন্তে হাসিব স্যারকে পেয়েছিলেন এই ভদ্রলোক। গোয়েন্দা বিভাগের চাকরির ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন হাসিব।
-ইমতিয়াজ ভাই কেমন আছেন? আমার ওপর রাগটা খুব সম্ভবত আর নেই তার? শত হলেও বিশাল কেলেঙ্কারি থেকে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম!
বা হাত ঘুরিয়ে তার অতি প্রিয় পাটেক ফিলিপ ঘড়িটির দিকে এক নজর তাকালেন। সময় দেখলেন নাকি কোন অতীত স্মৃতিচারন করলেন বোঝা গেল না।
-না না। ইমতিয়াজ ভাই এর সাথে এইমাত্র কথা হয়েছে। আপনার নাম বলতেই খুব খুশি হয়েছেন। আপনাকে ভাই সালাম বলেছেন।
-ওয়া আলাইকুম। ইমতিয়াজ ভাইয়ের মত মানুষ খুব কম আছে। স্যার, বিশ্বাস করবেন কী না। উনি একমাত্র ক্লায়েন্ট। আমার সঠিক মূল্যায়ণ একমাত্র উনার কাছ থেকেই পেয়েছি।
-জ্বী মিঃ হাসিব।
-স্যার, একটা ব্যাপার মাথায় আসছে না। ইমতিয়াজ ভাই আবার এসবে জড়াতে গেলেন কেন!
-বুঝিনি মিঃ হাসিব!
বিস্ময়ে দুই চোখ গোল গোল করে ফেলেছে জিসান আহমেদ।
-উনার হাতে সামান্য ছারপোকার মৃত্যু অস্বাভাবিক।
-মিঃ হাসিব! আপনি ঠিক আগের মতই আছেন। এক ফোঁটা বদলায়নি আপনার প্রশ্নের ধরণ! চমকে দিতে খুব ভালোবাসেন আপনি।
কাঁধ শ্রাগ করে হাসার চেষ্টা করল জিসান আহমেদ। আরিফ এই প্রশ্নোত্তর পর্বের কিছুই বুঝতে পারছে না। ইনস্পেক্টর হাবিবও নয়। দুজনের চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
-ইমতিয়াজ ভাইয়ের ডান হাত ছিল সাইফ আলি খান। পিলারের ব্যবসাটা সে-ই দেখাশোনা করত। সাইফ খানকে কেন মরতে হলো? কী মনে হয় আপনার স্যার?
ভীষণ চমকে উঠেছে জিসান আহমেদ। লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।
-মানে? কী বলতে চাচ্ছেন মিঃ হাসিব? সাইফ খান মারা গেছে মানে!
-বসুন স্যার। এত চমকানোর কিছু নেই। আমার গ্রীন সিগন্যাল পেলে সংবাদপত্র আর টিভির নিউজে আজ দিনের যে কোন সময়ে তার লাশ দেখতে পাবেন।
-মিঃ হাসিব। ইমতিয়াজ ভাই নিজেও জানেন না এই সংবাদ। সাইফ খান নেই! আশ্চর্য! আপনি নিশ্চিত?
-জ্বী স্যার। আমি নিশ্চিত। ইমতিয়াজ ভাইকে এখুনি জানানোর প্রয়োজন নেই। ভাল কথা। ইমতিয়াজ ভাই এখন দেশে নেই বলেই জানতাম। নয়ত উনার সাথেই কথা বলতাম।
-হ্যা। উনি এখন সুইডেনে আছেন। দেশে কবে ফিরবেন জানি না।
-হ্যা। সেটাই। আপনার কাছেই আমার কিছু প্রশ্ন থাকবে স্যার। প্রশ্নগুলোর পছন্দমত উত্তর পেলে আপনাকে ছেড়ে দেয়া হবে। নাহলে স্যার, ভেরি স্যরি টু সে। আপনি আমাকে ভাল করেই চেনেন। আপনি খুব সহজে এই কেস থেকে ছাড়া পাচ্ছেন না। এখান থেকেও যেতে দেব না।
আবারও বা হাতের কব্জি ঘুরিয়ে পাটেক ফিলিপ ঘড়িটির দিকে এক নজর বোলালেন হাসিব। অভিব্যক্তি ভাবলেশহীন। আরিফ আর ইনস্পেক্টর হাবিব দুজনের চোখে মুখে অবাক ভাব আরো গভীর হয়েছে।
-আপনি চাইলে আমরা দুজন একান্তে কথা বলতে পারি। উনারা এখানে থাকবেন না।
দু হাতে মাথা চেপে ধরেছে জিসান আহমেদ। সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সেই সন্ধ্যায় তাকে ধরে আনা হয়েছে মাদক মামলায় আসামী দেখিয়ে। এতক্ষণ যে আত্মবিশ্বাস ছিল, হাসিব উদ দৌলার প্রশ্নবাণে সেই আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে। নির্ঘুম রাতটা দীর্ঘায়িত হতে চলেছে।
-ঠিক আছে। আমি রাজি। উনারা এখানে থাকতে পারবেন না।
-খুব ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্যার। আই এপ্রেশিয়েট ইউর ভেরি থটফুল ডিসিশন। ইমতিয়াজ ভাইয়ের নাম সামান্য এক ছারপোকার খুনের সাথে জড়িয়ে যাক, তা আপনি যেমন চাইছেন না, আমিও চাচ্ছি না। আপনাকেও আর হ্যাসেল পোহাতে হোক, সেটাও কাম্য হতে পারে না। আরিফ, হাবিব। ভেরি স্যরি ভাই। আপনাদের একটু বাইরে অপেক্ষা করতে হবে। ওসি সাহেব তো নেই আজ রাতে। আমরা উনার খাস কামরায় বসব। দরোজা বন্ধ করে দিয়ে যাবেন। আর কাউকে একদিকে ঢুকতে দেবেন না। দশ থেকে পনের মিনিটে হয়ে যাবে আমাদের। কী বলেন স্যার?
শেষ প্রশ্নটা জিসান আহমেদের দিকে তাকিয়ে করলেন হাসিব। হাবিব আর আরিফ উঠে দাঁড়িয়েছে। বিস্ময় আর বেদনাহত চেহারা দুজনের। কিন্তু কিছু করার নেই। হাসিব উদ দৌলাকে দুজনেই কমবেশি বেশ ভাল করেই চেনে।
…
‘ভোর সাড়ে ছয়টা। এসপি সাহেবের বাংলো। গাজীপুর।‘
সারাটা পথ হাসিব একটা কথাও বলেনি। খুব নিবিষ্ট মনে নিসান এক্সট্রেইল এসইউভি চালিয়ে চলে এসেছে। ফাঁকা রাস্তা ছিল। এক ঘণ্টার মত লেগেছে বারিধারা ডিওএইচএস থেকে আসতে। নিকুঞ্জ থানা থেকে বের হয়ে অফিসে গিয়েছিল ওরা। ফ্রেশ আপ হয়ে এক মগ করে কফি খেয়েছে। তারপর বেরিয়ে এসেছে।
আরিফের বিস্ময় কাটছে না। হাসিবের সাথে দীর্ঘদিন হয়ে গেল কাজ করছে। একজন মানুষ ঠিক কতটুকু নিবেদিতপ্রান হতে পারেন, কতটুকু প্রানচঞ্চল হতে পারেন, কাছে থেকে তাকে না দেখলে বুঝতে পারবে না। একই রকম বিস্ময় সেই প্রথম দিনের মতই। পথে একটু ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল। নানা প্রশ্ন মাথায় এসে ভিড় করে আঁকড়ে ধরে। খুব আশা করছে আজ কালকের মধ্যে কিছু একটা উত্তর পেয়ে যাবে। অয়োকার সাথে কথা হয়েছে। কোমরের ব্যথায় পুরোপুরি শয্যায়। ভাগ্যিস শাশুড়ি এই সময়ে বাড়িতে আছেন। নয়ত ইচ্ছে করলেও এই অভুতপুর্ব তদন্তের সাক্ষী হতে পারত না সে।
-স্লামু আলাইকুম স্যার। এই এত ভোরে আপনাকে বিরক্ত করেছি।
দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। এসপি হামিদুল্লাহ বাশার এখনো রাত্রিকালীন পোশাক ছাড়েননি। ডান হাতে আধ খাওয়া সিগার ধরে রাখা, আগুন নেভানো। দুই ঠোঁটে চেপে ধরে ইশারা করলেন বসার জন্য। আরিফ ইতস্তত করছিল। বসবে কিনা বুঝে উঠতে পারছে না। হাসিবের ইঙ্গিতে অবশেষে সোফাসেটের এক কোণায় কাঁচুমাচু হয়ে বসে পড়ল।
-স্যার। একটা সুখবর দিতে এসেছি। লাশের পরিচয় পাওয়া গেছে। এখন আপনার ডিসিশনের উপর নির্ভর করছে খুনটা কীভাবে দেখাব।
বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আগুন ধরালেন সিগারে এসপি হামিদুল্লাহ বাশার । একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকালেন হাসিবের দিকে।
-বুঝিনি হাসিব। খুলে বল।
-স্যার। রাজনৈতিক কোন্দল অথবা ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিদের হাতে খুন। যে কোনভাবেই দেখান সম্ভব। যিনি খুন হয়েছেন তার নাম শুনলে বুঝতে পারবেন স্যার। সাইফ আলি খান। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক। গত বারে যিনি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
দাঁড়িয়ে পড়েছেন এসপি হামিদুল্লাহ বাশার। ভাষাহীন হয়ে পড়েছেন। তোতলাতে লাগলেন।
-স্যার। আমাকে জিজ্ঞেস করলে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিদের হাতে মৃত্যু দেখানোর কথা বলব।
সিগারে একটানা বেশ কয়েকবার টান দিয়ে ধোয়ায় মুখ ভরে ফেললেন এসপি সাহেব। তারপর অনেকগুলো ধোঁয়ার রিং বানিয়ে ছুঁড়ে দিলেন ছাদের দিকে। নিখুঁত রিং। একের পর এক রিং আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। কিছু একটা টানাপোড়েন চলছে মনের ভেতরে। অবশেষে হাসিবের দিকে তাকালেন।
-তুমি ম্যানেজ করতে পারবে হাসিব? এই বয়সে এসে চাকরিতে আর কোন কালো দাগ দেখতে চাই না আমি।
-পারব স্যার।
(চলবে।)
#চক্রব্যুহ
[একুশ]
-হ্যালো এবাদত?
-জ্বী বলছি। আপনি…
-এবাদত, আমি হাসিব উদ দৌলা বলছি। ওসি সাহেব কোথায়?
-স্লামু আলাইকুম স্যার। স্যরি স্যার। নম্বরটা ঠিক চিনতে পারিনি। স্যার, ওসি স্যার বাড়িতে, বেশ রাত করে গিয়েছেন থানা থেকে। খবর দেব স্যার?
-হ্যা। উনাকে ফোন দিয়ে থানায় আসতে বলে দাও। আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে তোমাদের ওখানে পৌছে যাব। বলবে এসপি হামিদুল্লাহ বাশার স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন।
ফোন কেটে আরিফের দিকে ঘুরে তাকালেন হাসিব। ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। কিছুক্ষণ হলো এসপি হামিদুল্লাহ বাশার এর বাংলো থেকে বের হয়ে এসেছে দুজন। হাসিব উদ দৌলার একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছে আরিফ। যখনই গাড়ি করে কোথাও যেতে হবে, হাসিব গাড়ি স্টার্ট করে এসি ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকে কিছুটা সময়। কোন কথা বলেন না। আরিফ হাতে থাকা এক গাদা কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখছিল। এবাদত নাম শুনে বুঝেছে শ্রীপুর থানার সেকেন্ড অফিসার এবাদতকে ফোন করেছিলেন হাসিব।
-আরিফ। নাসিমের কাছে সাইফ খানের কল লিস্ট চেয়েছিলাম। পাঠিয়েছে?
-জ্বী স্যার। পাঠিয়েছে।
-খুব ভালো করে নম্বর মার্ক করবে। বিশেষ করে গত এক মাসের। এখান থেকে ফেরার পথে তার বনানীর বাড়ি হয়ে অফিসে যাব। তার স্ত্রী এক সময়ের ইডেন কলেজের ছাত্রী নেতা খুরশিদা বেগম। তোমার কি মনে আছে আরিফ? ওই যে ভ্যানিটি ব্যাগে যে নেত্রী পিস্তল নিয়ে ঘুরত! এক হরতালের দিনে মিছিল থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে? ইনফ্যাক্ট, আমিই সেই সাহসী পুলিশ যে তার মত সেলিব্রেটি নেত্রীকে গ্রেফতার করেছিল। হা হা হা! খবরটা কিন্তু খুব চাউর হয়েছিল সেই সময়ে। সব সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলে খুব মাতামাতি হয়েছিল।
হাসিবকে বেশ উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে। নিশ্চয় ভাল কোন কিছু অপেক্ষা করে আছে।
-জ্বী স্যার। স্পষ্ট মনে আছে। আমি সেই সময়ে ঢাকা ভার্সিটিতে সাংবাদিকতায় পড়ছি। কিন্তু আপনিই সেই অফিসার, এটা জানতাম না স্যার।
আরিফের উত্তর দেবার ভঙ্গিটা মজার ছিল। “আপনিই সেই অফিসার” শোনা মাত্রই আবার হো হো করে হেসে উঠেছেন হাসিব। ড্যাশ বোর্ড থেকে পানির বোতল বের করে এক চুমুক পানি খেলেন। তারপর বোতলটা আরিফের দিকে এগিয়ে দিলেন।
-হুম। পিলার ব্যবসা নিয়ে তোমার ধারণা কেমন আরিফ?
সীমান্ত পিলার? সেই মরীচিকা ব্যবসা? শত কোটি টাকা পাবার লোভে অন্ধ বিশ্বাসী কিছু মানুষ তাদের সর্বস্ব খুইয়েছে। এই আছে, অথচ নেই। অনেকটা তক্ষকের মত। গুজবের ডালপালা বাড়তে বাড়তে দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। পুলিশে থাকতে বেশ কিছু সীমান্ত পিলারের উদ্ধারের কথা জেনেছে। কিন্তু ওর নিজের সৌভাগ্য হয়নি দেখার। ভাসা ভাসা জানে। কিছু মাফিয়া গ্রুপ এই বিশাল চক্রের সাথে জড়িত। একটু আগেই হাসিব বলছিলেন ইমতিয়াজ ভাই এর ডান হাত সাইফ খান পিলারের ব্যবসা দেখাশোনা করত। হাসিব কি জানতেন ইমতিয়াজ ভাইদের সিন্ডিকেট পিলার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে? কতদিন আগে থেকে জানতেন? পুলিশে থাকার সময়ে? মনে মনে স্বগতোক্তি করল আরিফ। ইচ্ছে থাকলেও এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা সম্ভব নয় পুলিশের একার পক্ষে। রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই যখন কোন অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে থাকে, পুলিশ বা অন্য কোন প্রশাসনের সেখানে চোখে ঠুলি পরে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকেও না।
-স্যার পিলার ব্যবসা? আমার স্পষ্ট ধারণা নেই স্যার। পুলিশে থাকতে কয়েকবার উদ্ধারের গল্প শুনেছিলাম। আর কিছু চোখে পড়েছিল সংবাদপত্রে। স্যার, তখন বলছিলেন ইতিয়াজ ভাই পিলারের ব্যবসার সাথে জড়িত। তার সেই ব্যবসা দেখাশোনা করত সাইফ খান।
-হ্যা। বলেছিলাম। কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না।
-স্যার বুঝিনি! আপনি তো বেশ আত্মবিশ্বাসীই ছিলেন তাকে বলার সময়ে!
হো হো করে হেসে উঠলেন হাসিব উদ দৌলা। আজ তাকে হাসির রোগে পেয়েছে।
-ইনটুইশন। বুঝলে আরিফ। স্রেফ ইনটুইশন। কবে কোথায় যেন শুনেছিলাম ইমতিয়াজ আহমেদ এই ধরণের কিছু একটার সাথে জড়িয়ে আছেন। সাইফ খানের ব্যাপারটা জাস্ট ধারণা থেকে। দেখলে তো। কেমন ঘাবড়ে দিয়েছিলাম জিসান আহমেদকে!
অনেকক্ষণ ধরে আরিফের মাথার ভেতরে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল। যদিও জানে অন্য অনেক প্রশ্নের মত এই প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া হবে না।
-স্যার, কিছু জানতে পেলেন জিসান আহমেদের কাছ থেকে?
আবারও হো হো করে হেসে উঠলেন হাসিব। বেশ মুডে আছেন এটা বুঝা যাচ্ছে। আবরার হোসেনের তদন্ত ভুলে উনি কি সাইফ খানের হত্যা রহস্য উদ্ধারে নেমে গেলেন? কী জানি।
-চলো, তোমাকে এখানকার এক হোটেল থেকে স্পেশাল নাস্তা করিয়ে তারপর শ্রীপুরের দিকে রওয়ানা দেই। একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে। এক কাপ কড়া চা খেলেই দেখবে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছ। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা। জার্নিটা খারাপ লাগার কথা নয়।
গাড়ির গিয়ার ড্রাইভে দিয়ে স্টিয়ারিং ঘোরালেন হাসিব। না, এবারও প্রশ্নটা অন্ধকারেই রয়ে গেল। আরিফ মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাতে রাখা কাগজে ডুবে গেল। বেশি সময় লাগল না, মাত্র মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই গাজীপুর ময়মনসিং হাইওয়েতে একটা আধা পাকা রেস্টুরেন্টের সামনে থামল ওদের নিসান এক্সট্রেল।
-বুঝলে আরিফ। এই হোটেলের মালিক বিশ্বজিৎ সাহা পনের ষোল বছর আগে আমার ইনফর্মার ছিল। চল, চা নাস্তা করতে করতে গল্প করা যাবে।
…
-পিলারের ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে আছে প্রচণ্ড অন্ধ বিশ্বাস এবং বাঙালি জাতির সীমাহীন লোভের ওপর।
চা’য়ের কাপে বড় করে চুমুক দিয়ে নিজের থেকেই শুরু করলেন হাসিব। আরিফ নড়েচড়ে বসেছে। চা’য়ের স্বাদের তুলনা হয় না। বিশেষ কোন যাদু আছে বাবুর্চির হাতে। বিশ্বজিৎ সাহাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে রেসিপি। হাসিবের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ চা’য়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল।
-বৈজ্ঞানিক ভাবে এই পিলারের কোন তুল্যমূল্য নেই। আর্টিফেক্ট ভ্যালু আছে। কিন্তু সেটার মূল্য কোন ক্রমেই পাঁচ দশ কোটি বা একশ কোটি টাকা নয়। সীমানা পিলারগুলো ব্রিটিশ পিরিয়ডে সীমানা নির্ধারনের কারণেই কয়া হয়েছিল। খাজনার সীমানা নির্ধারন করে দেয়া ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য। ছবি দেখেছো নিশ্চয়?
-জ্বী স্যার।
-প্রতারকচক্র খুঁজে খুঁজে ক্লায়েন্ট বের করে। তাদের প্রথম শর্ত টার্গেট প্রচণ্ড লোভী হতে হবে। যাকে একই সাথে ধনী হতে হবে। এই কারণে ব্যবসায়ী বা ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ এদের প্রধান টার্গেট। তৃতীয় শর্ত, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অন্ধ বিশ্বাস আছে কিনা। ধর্মীয় অথবা কুসংস্কারে তাদের বিশ্বাস কতটুকু। তুমি অবাক হবে জেনে আরিফ। এমন ক্লায়েন্টের সাথেও কথা বলেছি, যার বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি পর্যন্ত আছে। কুসংস্কারে বিশ্বাস করা মানুষের অভাব এইদেশে কখনোই ছিল না। এখনো নেই। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। এই ডক্টরেট ভদ্রলোককে মাফিয়া চক্র আচ্ছা মত ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল। উনি বিশ্বাস করেছিলেন এই পিলারে প্রচুর পরিমানে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি ইউরেনিয়াম আছে!
-কী বলেন স্যার! সত্যিই কি এমন ধাতু দিয়ে বানানো?
আরিফ খুবই অবাক হয়েছে। এত কিছু এই এক পিলারের গভীরে!
-আরে না, সব ভাঁওতাবাজি। চলো উঠা যাক। আরেকদিন পুরো গল্প বলব। কী করে ট্র্যাপে ফেলে দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেইলিং করে ক্লায়েন্টদের থেকে টাকা আদায় করে এই চক্র । অমানবিক এক একটা গল্প আরিফ!
সত্যজিৎ সাহাকে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল দুজন।
…
‘শ্রীপুর থানা। ওসির কক্ষ। সকাল সাড়ে নয়।‘
ওসি কামরুজ্জামানে বয়স মধ্য পঞ্চাশের কোঠায়। খাটো মত বেশ মোটা দেখতে। কানের পাশে কিছু চুল। এছাড়া পুরোটাই টাক। চেহারায় তেলতেলে একটা ভাব। কথায় কথায় ‘তা আর বলতে’ বলছেন। মনে হচ্ছে এটা উনার মুদ্রাদোষ। লাশের পরিচয় শুনে ঘাবড়ে গেছেন। ওসিকে দেখে এমপি সাহেবের খুব কাছের লোক বলে মনে হচ্ছে আরিফের। লাশের পরিচয় শুনেই দাঁড়িয়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছেন। আর বারবার বলছেন “এ কী করে হলো।“ হাসিব তাকে বসতে বললেন।
-হাসিব সাহেব। আপনি বুঝতে পারছেন কি এই কেস কতদূর যাবে? এমনিতেই হাজার সমস্যার মধ্যে ডুবে আছি। তারপর এমপি স্যারের পুকুরে লাশ পাওয়া গেছে। এসপি স্যার কত বড় বিপদে পড়েছেন ভেবে দেখেছেন হাসিব সাহেব?
আরিফ ভেবেছিল হাসিব তাকে সান্ত্বনা দেবেন। তেমন কিছুই করতে দেখা গেল না তাকে।
-শুনুন কামরুজ্জামান সাহেব। যেভাবে বলেছি। আপনি শুধু সেটাই ফলো করবেন। যে চারজনের নাম দিয়েছি এরমধ্যে অন্তত দুইজন আপনার এলাকার। আপনাকে মাত্র তিন ঘণ্টা সময় দিলাম। দুপুর একটার মধ্যে আমি তাদের সাথে বসতে চাই। আর যেটা বলেছি। কাক পক্ষীও যেন না জানে আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে। আমার গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত কোন কিছুই করবেন না। এসপি স্যারের সরাসরি আদেশ এটা। মনে থাকবে?
ওসির রুম থেকে বের হয়ে এসে আরিফকে অপেক্ষা করতে বলে ফোন কানে চেপে থানা কমপ্লেক্সের বাইরে চলে গেলেন হাসিব। আবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসলেন।
-চল চল, কামালের ওখানে যেতে হবে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
তাড়া দিলেন হাসিব।
-বুঝলে আরিফ। সাইফুদ্দিনকে একটা কাজ দিয়েছিলাম। দারুণ চালাক হয়ে উঠেছে ছেলেটা।
কী কাজে পাঠিয়েছিলেন সেটা নিয়ে আর কিছু বললেন না। আরিফের কাছে হাসিবকে এই মুহুর্তে খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে। কোথাও যেয়ে বেশিক্ষণ বসছেন না। কিসের যেন এক তাড়া তার মধ্যে। এর আগে যতগুলো তদন্তে সে ছিল, হাসিবকে এত বেশি এলোমেলো কখনোই দেখেনি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না হাসিব পরের পদক্ষেপ কী নিতে যাচ্ছেন। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, লিংক জোড়া দিয়ে দিয়ে চেইন বানিয়ে ফেলেছেন। অথবা চেইন বানানো শেষ। লিংকগুলোর জোড়া ঠিক আছে কিনা সেগুলো পরীক্ষা করে দেখছেন। একটা অস্বস্তিবোধ আরিফের মধ্যে রয়ে গেল। এই চেন কি আবরার হোসেনের তদন্তের চেইন নাকি সাইফ খানের তদন্তের, সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আরিফ।
গাড়ি নিয়ে বেশি দূর যেতে হলো না। থানাকে বা পাশে রেখে কিছুদূর গিয়ে দুইদিকে রাস্তা চলে গেছে। বাঁদিকের রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক চলার পরে বেশ একটা জংগুলে জায়গায় এসে গাড়ি থামালেন হাসিব। দুটো ছেলেকে দেখা গেল গাড়ির দিকে আসছে। দুজনের মধ্যে একজন প্রায় ছয় ফুটের মত হবে। কালো করে, সুঠাম দেহের ছেলে। আরেকজন টেনেটুনে পাঁচ ফিট হবে হয়ত। হ্যাংলা পাতলা। এ ছেলেটিও বেশ কালো মতন। আরিফের হাসি পেয়ে গেছে। স্কুলের ‘গালিভার্স ট্রাভেল’ এর গালিভার আর লিলিপুট যেন বাস্তবে ওর চোখে সামনে। লম্বা করে ছেলেটির হাতে একটি প্যাকেট। ড্রাইভার’স সিটের পাশে চলে গেছে। কেউ কোন কথা বলল না। গাড়ির কাচ নামিয়ে প্যাকেটটি হাতে নিয়ে গাড়ি চালু করে দিলেন হাসিব।
(চলবে।)