চক্রব্যুহ,২৪,২৫

0
147

#চক্রব্যুহ,২৪,২৫
মোহাম্মদ মনোয়ার
[চব্বিশ]

আরিফ যখন কলাবাগান বশির উদ্দিন রোডে সামিহা অবন্তিদের বাড়িতে ঢুকতে শেষ গলিটায় পৌছেছে, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত্রি আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। মটর সাইকেল নিয়ে গলির মুখে ঢুকতেই হাসিব উদ দৌলার মাজদা স্পোর্টস কার দেখতে পেল। ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। গাড়ির বাদিকের রাস্তায় অল্প একটু জায়গা আছে, মটর সাইকেলটি পার্ক করার জন্য যথেষ্ট। ইগনিশন কি বন্ধ করে গাড়ির পেছন দিয়ে ড্রাইভিং সিটের দিকে এগিয়ে গেল আরিফ।

-স্যার!

-ওহ আরিফ, তুমি এসে গেছ! একেবারে ঠিক সময়ে এসেছ। সোয়া আটটায় ও বাড়িতে ঢুকব আমরা। তুমি কি সব ভাউচার প্রিন্ট আউট করে নিয়ে এসেছ? ভাউচারের সাথের বিলগুলো?

-জ্বী স্যার।

পেছনের ব্যাক প্যাক থেকে কিছু কাগজ ভরা একটা এনভেলপ এগিয়ে দিল হাসিবের দিকে। এনভেলপ খুলে সবগুলো কাগজ দেখে আরিফের কাছে ফিরিয়ে দিলেন।

-গুড। আশা করি এই কয়টা টাকা ফেরত পাব।

-এই কটা টাকা ফেরত পাব মানে স্যার! রহস্যের সমাধান হয়নি?

-দেখা যাক। সামিহা অবন্তির যদি পছন্দ হয় তদন্তের ফল। সবার নিজস্ব দর্শন থাকে। সামিহার হয়ত নিজস্ব কোন দর্শন আছে যেটা জানি না।

আরিফের মন খারাপ হয়ে গিয়েছে। সাধারণত হাসিব ক্লায়েন্টকে নিজের অফিসে ডেকে নেন। তারপর টাকা পয়সার ফায়সালা করেন। এই প্রথম নিয়ম ভেঙে ওরা স্বয়ং ক্লায়েন্টের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। হয়ত ক্লায়েন্ট নারী বলে এই সুযোগটা পেয়েছে। তবুও। এথিকস বলে একটা ব্যাপার আছে। সামিহার পছন্দের ওপরেই যদি তদন্তের ফল নির্ভর করে, তাহলে এই এত দিনের খাটা খাটুনি করার কী মানে হতে পারে? মাথা নিচু করে শুধু একবার অস্ফুট শব্দে “জ্বী স্যার” বলল আরিফ।

একটু পরে হাসিব বা হাতের কব্জি ঘুরিয়ে তার অতি প্রিয় পাটেক ফিলিপের ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলেন।

-স্যার, কলাবাগান থানা থেকে বা অন্য কোথাও থেকে কেউ আসছেন?

-না না। আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। চল আরিফ। এবার যাওয়া যাক। গাড়ি আর মটর সাইকেল এখানেই থাকুক।

দারোয়ান কবির কলিং বেল শোনার সাথে সাথে দরোজা খুলে দিয়েছে। আজ কুকুরের কোন সাড়া শব্দ শোনা গেল না। আরিফ ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। “কী ব্যাপার কবির, তোমাদের এলসেশিয়ানটা কোথায়?”

-স্যার। ওইটারে বিক্রি কইরা দিছেন ম্যাডাম। আপনারা যেদিন আসলেন তার দুইদিন পরেই বিক্রি কইরা দিছেন।

আরিফ কিছু বলতে চাচ্ছিল। হাসিব ইশারা করে থামিয়ে দিলেন।

লিভিং রুমে ঢুকতেই ছোট একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল। সোফাসেটগুলো এদিক সেদিক করা হয়েছে। বাকি সব কিছু আগের মতই। টেবিলের ওপর কুপারসের কিছু চিকেন প্যাটিস আর চার পিস কেক দেখা যাচ্ছে। সাথে কাচের জগে পানি, দুটি কাচের গ্লাস। আজকের আয়োজন খুবই কম। আরিফ একটু ধাক্কা খেয়েছে।

বেগম গুলজার হোসেন আজ সাদা জমিনে টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি পরেছেন। আঁচল নীল আর সবুজের মিশ্রণ। পাড় বেশ মোটা, সেটাও নীল আর সবুজের মিশ্রণে। বিকেলের পর পর, সন্ধ্যের আগে সমুদ্রের জলে আকাশের নীল যখন মাখামাখি হয়ে থাকে, ঠিক সেই রকম একটা মায়াবী রং শাড়িটির আঁচলে আর পাড়ে। অভিজাত এবং রাজশ্রী একটা ছায়া তার চোখেমুখে।

-বসো বাবারা। আজ আমার শরীরটা বেশি ভালো নেই। বাতের ব্যথায় কদিন ধরে খুব কাবু হয়ে আছি। ঘুম একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। রুনি গতকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ চেঞ্জ করে দিয়েছে। তবুও ঘুম হয় না নানা টেনশনে।

বুড়ির মনে হয় কথা বলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সব বুড়োবুড়িরই কথা বলার প্রবণতা বেড়ে যায়। আরিফের শাশুড়ি মা’র একই সমস্যা। আরিফকে কাছে পেলে তো কথাই নেই। মুরুব্বী মানুষ, মাঝপথে উঠে যাবে, সেই উপায়ও নেই। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

-তোমাদের তদন্তের কতদুর কী হলো বাবারা? অনেক আশায় বুক বেঁধে আছি বাবারা।

-খালাম্মা, সেটা নিয়েই কথা বলতে এসেছি আজ। আর অল্প কিছু তথ্য বাকি। প্রায় গুছিয়ে এনেছি। তবু জানেন তো। যদি বৃহত্তর তদন্তের প্রয়োজন পড়ে, সেক্ষেত্রে আমি আপনাদের জানিয়ে রাখব।

আরিফের খটকা বেড়েই যাচ্ছে। আরো তদন্ত? মানে কী?

-ঠিক আছে বাবা। আমি পোড় খাওয়া মানুষ। খুব সহজে ভেঙে পড়ার সময় আমার সেই কবেই চলে গেছে। নাতি দুটোর দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছি। এ ছাড়া আমার আপন তো আর কেউ নেই এই সংসারে। এই বাড়ির কু নজর ঠিক করার জন্য কম তাবিজ কবজ তো করলাম না। লক্ষ টাকা চলে গেছে হুজুরদের পেছনে। কতবার যে বান মারলাম বাড়িটায়। আল্লাহ পাক আমাকে এই শাস্তি বেঁচে থাকতেই দিতে চান। তার সেই আদেশের বিরুদ্ধে যতই চেষ্টা করি না কেন বাবা, আমরা সাধারণ মানুষ কী আর সেই লীলাখেলা বুঝব? তিনি যেমন চান তেমনই হয়, হবে। মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায় কী বল বাবারা!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বেগম গুলজার হোসেন। সামিহা এই সময়ে মুখ খুলল। সম্ভবত শাশুড়ির দীর্ঘশ্বাস ছাড়াটা তার বিশেষ পছন্দ হয়নি।

-আম্মা, আপনার ঘুমোবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের রিয়েকশন চলে গেলে আর ঘুমোতে পারবেন না।

-ওজু করতে গেলে ঘুম ভেঙে যাবে না?

-সে কী! এশার নামাজ পড়ে আসলেন, তার পরেই তো আমি ঘুমের ওষুধ সহ বাকি সব ওষুধ খাইয়ে দিলাম। আজকাল সব ভুলে যাচ্ছেন আম্মা। চলুন, আমি হাত ধরে আপনাকে রুমে দিয়ে আসি।

এরপর ওদের দিকে তাকিয়ে “স্যরি” বলে বেগম গুলজার হোসেনের হাত ধরে উনার রুমে পৌছে দিতে গেল সামিহা। হাসিব নিচু হয়ে আরিফের কানে কানে বললেন, শোন, ইচ্ছে করেই ঠিক এই সময়টা বেছে নিয়েছি। সামিহাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলাম কখন উনার শাশুড়ি মা ঘুমোতে যান। তোমাকে পরে বলছি কারণ।

আরিফ ভাবতেও পারেনি কখন এই বাড়িতে আসবে, এই সামান্য ব্যাপারটাও অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করতে হয়েছে। সামিহা ফিরে এসে সোফায় বসল। চামড়ার ব্যাগ খুলে কিছু কাগজপত্র এগিয়ে দিলেন সামিহার দিকে। কাগজগুলোয় থানার মনোগ্রাম আঁকা। সামিহা খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগল। আরিফ এসবের কিছুই জানে না। কাজেই সে এখানে দর্শক মাত্র। হাসিব সামিহা অবন্তির দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু সেই দৃষ্টি থেকে কিছু পড়া গেল না। একবার উঁকি দিয়ে কী নিয়ে এই কাগজ, তা পড়ে দেখার চেষ্টা করেছিল। হাসিবের ইশারায় সেই চেষ্টায় ক্ষান্ত দিতে হয়েছে। সামিহার চোখে মুখে কিছু একটা খেলা করছে। আনন্দ? বেদনা? হতাশা? অপ্রাপ্তি? সুখ? কষ্ট? আরিফ হাল ছেড়ে দিল।

-তাহলে অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে থানা থেকে এফ আই আর দিয়েছে?

ডান পা বাম পায়ের উপরে তুলে দিয়ে কাগজগুলো সামনের টেবিলের উপর রেখে দিল সামিহা অবন্তি। হাসিব কাগজগুলো গুছিয়ে নিয়ে ফের চামড়ার ব্যাগটিতে ঢুকিয়ে রাখলেন। আরিফ চমকে উঠেছে। বলে কী! এত চমৎকার আলামত সহ এত জটিল কেস এভাবে থেমে গেছে! অমীমাংসিত তদন্ত মানে? দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা এই রহস্য সমাধানের নানা যুক্তি আর পাল্টা যুক্তিতে সময় কাটানো। সব বৃথা? ও নিজেও যুক্তি পাল্টা যুক্তিতে ভালো একটা সমাধানে এসেছে। হাসিবকে অনেকবার তা শোনাতে চেয়েছে। হাসিবের সহকারী হিসেবে আছে তাও আজ দুই বছরের ওপর। আগের সব তদন্তে ওর সাথে আলোচনা করেই হাসিব সিদ্ধান্তে আসতেন। এইবার এমন কী ঘটেছে যে হাসিব তাকে কথা বলার সুযোগটাও দিল না? প্রতিদিনের সব ঘটনায় ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এবং হাসিবকে তদন্তে সব ধরণের সহযোগিতা করেছে। এই প্রথম সে নিজেকে বঞ্চিত মনে করছে।

-হ্যা। ব্যাপারটা অনেকটাই তাই।

-এই এফ আই আর রিপোর্ট তো আমার পাবার কথা নয়, গোপনীয় বিষয়। আর আমি জিডি বা মামলাও করিনি।

-হ্যা। আপনার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে থানা থেকে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। তাদের সমস্ত রিসোর্স ব্যবহার করে তদন্ত করেছে। কিন্তু আপনার হাজব্যান্ডের নিখোঁজের কোন কুল কিনারা তারা করতে পারেনি। এই হলো সারমর্ম। আপনার যদি কিছু প্রশ্ন করার থাকে করতে পারেন।

-এই রিপোর্টের বেশিরভাগই আমার পক্ষে বুঝা সম্ভব নয় মিঃ হাসিব। শুধু জানতে চাইছি, এটার আইনগত কোন ভ্যালু থাকবে কি?

-হ্যা হ্যা। আবরার হোসেনের হারিয়ে যাওয়া রহস্য নিয়ে আর কারো কোন প্রশ্ন থাকছে না।

-এখানে সবার নাম এসেছে। আফসানা সাফোয়ানকে দোষী ভেবেছিলাম। রুনিকেও। তৈয়ব শামসকে অতটা দোষী আমি ভাবিনি। তার নামও এসেছে। আমাদের ড্রাইভার, দারোয়ান সবার সাক্ষাৎকার তারা নিয়েছেন দেখছি। এমনকি শাশুড়ি আম্মা যে কয়জনকে সন্দেহ করেছেন, তাদের ব্যাপারেও ডিটেলস লেখা হয়েছে।

-জ্বী। আমি দেখেছি রিপোর্ট। এমনই বলা হয়েছে। আপনি যদি খুশি থাকেন, তাহলে আমার বা আরিফের তরফ থেকে আর কিছু বলার নেই।

কিছুক্ষণ ভাবল সামিহা অবন্তি। ওর এক্সপ্রেশন পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করল আরিফ। কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। একটা বিষয় খুব ভাবাচ্ছে ওকে। কী শান্তভাবে সব কিছু মেনে নিচ্ছেন সামিহা। উনি কি আগেই জানতেন এমন কিছু শুনতে যাচ্ছেন? আগের থেকেই প্রিপেয়ার্ড ছিলেন। শাশুড়ি আম্মাও উঠে চলে গেছেন। শাশুড়ির অনিবার্য প্রশ্ন এড়াতেই কি হাসিব এমন একটা সময়ের জাংশান বেছে নিয়েছেন? কী জানি!

-এই কদিনে আমি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আপনাদের জন্য নাস্তা বানাব, সেই সামান্য শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। কিছু মনে করেননি তো?

হঠাৎ করে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল সামিহা।

-না, না। কিছুই মনে করিনি। সব মানুষের সব দিন তো আর সমান যায় না। আমরা কি আপনাকে আমাদের বিল দেখাব?

উত্তরের অপেক্ষা করলেন না হাসিব। আরিফের দিকে ঘুরে বিলের কপিগুলো বের করতে বললেন। আরিফ তার ছোট চামড়ার সাইড ব্যাগ খুলে ভাউচার আর বিলগুলো এগিয়ে দিল।

-এখানে আমাদের দৈনিক ব্যক্তিগত খরচের হিসেব আছে। সাথে তদন্তের ক্রেডিটের ওপর ভিত্তি করে দুই লক্ষ টাকা চার্জ করেছি। আপনি চাইলে ক্যাশ বা অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আরটিজিএস ট্রান্সফার করে দিতে পারেন।

হাত বাড়িয়ে ভাউচার আর বিলগুলো নিল সামিহা অবন্তি। ছয়টা আলাদা ভাউচার। গাড়ির তেল থেকে শুরু করে রাস্তা বা ব্রিজের টোল, খাবার দাবারের বিল ইত্যাদি ছোটখাটো সব কিছু যুক্ত করা হয়েছে। ভাউচারের সাথে “বিল গুলো”র সিরিয়াল নম্বর দেয়া। একগাদা বিল সাথে দেখা যাচ্ছে। সেগুলোর উপর নম্বর দেয়া। বেশ গোছাল কাজ করেছে আরিফ।

-আমি ব্যাংক ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। দুই লক্ষ বাষট্টি হাজার সাতশ দুই টাকা। আপনাদের কোম্পানির নামে হবে নাকি ব্যক্তিগত একাউন্টে দেব?

-আমাদের কোম্পানির একাউন্টে দেবেন। ভাউচারে চক্রব্যুহের ব্যাংক ডিটেলস দেয়া আছে।

সাথের ছোট ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে অনলাইন ব্যাংকিং এর পেজে ঢুকে কিছুক্ষণ চাপাচাপি করে ফাইনাল স্টেপের আগে থামল সামিহা অবন্তি। হাসিবের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ দুটো ভালো করে খেয়াল করে দেখল আরিফ। বেশ কান্নাকাটি করেছেন ভদ্রমহিলা ওদের আসার আগে আগে। ও অবশ্য ভেবেছিল ওদের সামনেও ভদ্র মহিলা কান্নাকাটি করবেন।

-মিঃ হাসিব। আপনাদের কোন রিপোর্ট যে দেখছি না। আপনাদের তদন্তে কী পেলেন, সেটার কোন রিপোর্ট পাব না?

শূন্য দৃষ্টিতে ঘরের চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন হাসিব। আরিফ হঠাৎ টেন্সড হয়ে পড়েছে। হাসিবের দৃষ্টি বেশ এলোমেলো। সামিহা এক দৃষ্টিতে হাসিবকে দেখছে। টাকা ট্রান্সফার না করেই মোবাইল ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে দিল। হাসিব কাঁধ শ্রাগ করলেন।

-রুনি ম্যাডাম অনেক কিছুই লুকিয়ে রেখেছিলেন। জানি না কেন। আফসানা সাফোয়ানের মধ্যেও রহস্যময় কিছু উপকরণ ছিল। ড্রাইভার বেলায়েতের মৃত্যুবরণ করে নেয়াটা বোধগম্যতার বাইরে ছিল। গাজীপুরের সেই লাশের রহস্যও অনেক গভীরে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের। তবে এটা ঠিক। পুলিশের এফ আই আর রিপোর্ট ক্লিন পেয়েছেন। আপনি আগামী পরশু রাতের কাতার এয়ারওয়েজের এমেরিকাগামী ফ্লাইটের টিকেট কনফার্ম করতে পারেন সামিহা।

“হোয়াট!” বলেই সামিহা এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাসিবের দিকে।

-বসুন সামিহা। আপনার কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা হয়ে গেলেই আমাদের তদন্ত পুরো হবে।

চামড়ার ব্যাগ থেকে এক গোছা কাগজ বের করে টেবিলে মেলে দিলেন হাসিব।

[চলবে।)

#চক্রব্যুহ
চক্রব্যুহ

[পঁচিশ]

হঠাৎ করেই সামিহা অবন্তির ফর্সা মুখ একেবারে কাগজের মত সাদা হয়ে উঠেছে। মুহুর্তে নিজেকে সামলেও নিল। ভয় আর প্রচণ্ড অবাক করা অভিব্যক্তি এত দ্রুত কী অবলীলায় পরিবর্তন করে ফেলল! আরিফ নিজেও কম চমকে উঠেনি!

-বসুন সামিহা। আমি যেভাবে চেয়েছিলাম, থানা থেকে সেভাবেই তদন্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে।

উঠে দাঁড়াতে বুকের কাছ থেকে ওড়না সরে গিয়েছিল, ঠিক করতে করতে সামিহা সোফায় বসে পড়ল।

-আচ্ছা!

সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলল সামিহা। বিস্ময়ের ঘোর পুরোপুরি কাটাতে পারেনি।

কাচের জগ থেকে পানি ঢেলে হাতে তুলে নিলেন হাসিব। বেশ সময় নিয়ে দুই চুমুক পানি খেয়ে গ্লাস টেবিলে রেখে দিলেন।

-আমার দেয়া প্রথম বিলটি শুধুমাত্র আপনাকে একটা ক্লিন চিট পাইয়ে দিতে। যাতে আপনি কোনরূপ ঝামেলা ছাড়া দেশ ছাড়তে পারেন।

হাসিবের এই কণ্ঠ আরিফের খুব পরিচিত। প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে সে কাঠিন্য মেশানো দৃঢ় কণ্ঠ ব্যবহার করে। প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে আলাদা আলাদা করে উচ্চারণ করে। কিন্তু সামিহা অবন্তি এই পর্যায়ে হেসে দিল। মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত। এমন মিষ্টি হাসি খুব কম মেয়েই হাসতে পারে। বিস্ময়ে আর হতাশায় ঘেরা চেহারা এত দ্রুত বদলে ফেলতে পারে কেউ? কৃত্রিম হাসি কি? ভাবল আরিফ। ভালো অভিনয় জানেন তো সামিহা! এতদিন তাহলে ভুল জেনে এসেছিল সে! তবে কোন কথা বলল না সামিহা। আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে। মচকাবে, তবু ভাঙবে না। এমন কিছু মনে হল আরিফের। দেখা যাক। স্বভাবসুলভ হাসিব ফিরে আসছেন, সামিহা অবন্তির মত পাকা অভিনেত্রী তাকে কী করে সামলায় তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে আরিফ।

-আবরার সাহেব নিখোঁজ হয়েছেন পনের তারিখে। রাইট?

সময় নিল না সামিহা। সাথে সাথেই উত্তর দিল।

-হ্যা। আমাদের ম্যারেজ এনিভার্সারির দিন।

হঠাৎ ওড়নায় মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠল সামিহা। হাসিব ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে। আরিফের অস্বস্তি হচ্ছে। এই মেয়েটির কান্নার রোগ ফিরে আসলে মুস্কিল। কাঁদতেই থাকবে। স্বামীর কোন স্মৃতির কথা হয়ত মনে পড়ে গেছে।

-পিলার বলে কোন কিছুর সাথে আপনি পরিচিত?

এবার একেবারে ঘাবড়ে গেছে সামিহা। কান্না থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল হাসিবের দিকে। হতবিহ্বল এক দৃষ্টি। আরিফ নিজেও চমকে উঠেছে। গাজীপুরে গাড়িতে বসে হাসিব পিলারের গল্প করেছিল। কিন্তু এই নিখোঁজের সাথে পিলারের সম্পর্ক কী? বুঝে উঠল না আরিফ। সামিহার অবাক করা দৃষ্টি তেমনই রইল।

-হ্যা।

এটুকুই শুধু। ‘হ্যা’ বলে আর কিছু বলল না।

-লোভ থাকা ভাল। কিন্তু সীমাহীন লোভ থাকাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কিছু নয়। আপনার মতামত কী এই ব্যাপারে?

বেশ রুক্ষ্ণ শোনাল হাসিবের কণ্ঠ। প্রতিটা প্রশ্নের পর বেশ সময় নিচ্ছেন। প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে কাবু করে ফেলতে চাইছেন। এই ধারার কথোপকথনের সাথে আরিফের পরিচয় আছে। আগ্রহ নিয়ে সে সামিহার দিকে তাকিয়ে আছে।

-হুম।

-হুম বলতে?

এবার সময় নিল সামিহা। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। অথবা দুঃশ্চিন্তায় ঘিরে ফেলেছে তাকে।

-ঠিকই বলেছেন। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল নয়।

-অথচ আপনি বা আবরার, দুজনেই লোভের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।

-কী বলতে চাচ্ছেন!

কথা কয়টি বেশ জোরে উচ্চারণ করল সামিহা। যেন অধস্তন কাউকে ধমকে উঠেছে। হাসিবের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

-পিলারের পেছনে কত টাকা ঢেলেছিলেন আবরার হোসেন? আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি। আপনি চাইলে এইসব কিছু অফ দ্যা রেকর্ড থাকবে। আবারো বলছি, আপনি চাইলে।

“আপনি চাইলে” শব্দদুটোর উপর আলাদা করে জোর দিলেন হাসিব। সামিহার চেহারায় একটা দ্বিধাগ্রস্থ ভাব।

-আমি সঠিক হিসাব জানি না। তবে বেশ মোটা অংকের টাকা সে ঢেলেছিল। আমার সাথে এই নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়েছে।

-আমি জানি।

বলে সামনে রাখা কাগজের স্তুপ থেকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক একাউন্টের স্টেটমেন্ট হাতে তুলে নিলেন হাসিব। হাইলাইট করা অনেকগুলো লাইন দেখা যাচ্ছে তাতে।

-আবরার সাহেব ব্যাংক ট্রান্সফার, চেক এবং ক্যাশ এ পিলার বাবদ খরচ করেছেন তিন কোটি বাহাত্তর লক্ষ টাকা। হাতে হাতে ক্যাশ টাকা উনি দিয়েছেন প্রায় নয়বার। প্রায় বলছি, এর বেশিও হতে পারে। আমি নয়টি হাত বদলের প্রমাণ সংগ্রহ করেছি।

এত টাকা! বলে কী! আরিফের মনে পড়ল হাসিব তাকে পিলার নিয়ে প্রতারণার গল্প বলেছিল। আবরার সাহেবও যে সেই প্রতারিতদের একজন, সেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। সামিহা এবার ভেঙে পড়েছে। চোখে মুখে উদ্ভ্রান্ত এক ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। ওড়না চেপে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।

-আপনি উনিশ তারিখে হঠাৎ সন্দেহ করেছেন আপনার স্বামী সত্যি সত্যি বড় কোন বিপদে পড়েছেন। পিলারের গল্প নিয়ে আইনের কাছে আপনার যেতে সাহস হয়নি। আপনি তিনটি কারণে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছেন। প্রথমটি বলেছি। আপনার একটা ক্লিন চিট চাই দেশ ছেড়ে চলে যেতে। আর দুটো কারণ শোনার মত অবস্থায় আপনি আছেন কি?

হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল সামিহা অবন্তি। “আমি আর বাঁচতে চাই না। অনেকবার আত্মহত্যা করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছি। এই কলঙ্কের জীবন আমি আর টানতে পারছি না মিঃ হাসিব। আমি জানি না কেন আমার ভাগ্যে এত কিছু ঘটেছে।“

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সামিহা। বেশ শব্দ করে। আরিফের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ওর অবাক চাহনি হাসিব উদ দৌলার দৃষ্টি এড়াল না। মুখ নিচু করে ডান পাশে বসা আরিফের বা কানের খুব কাছে চলে আসলেন।

-শোনো আরিফ। এত বিচলিত হয়ো না। নাটকের এই দৃশ্যায়নের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবেই ঠিক আটটা পনেরতে এই বাড়িতে ঢুকেছি। বেগম গুলজার হোসেনকে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে, কাজেই সহজে উঠছেন না উনি। আর হেল্পিং হ্যান্ড রানুকে ছুটি দেয়া হয়েছে। তুমি এগিয়ে যেতে পিস্তল দেখিয়ে নিশ্চিত করেছি দারোয়ান গেটের কাছ থেকে সরে আসবে না। নিচের আর উপরের সব দরোজা বন্ধ। কেউ এই কান্নার শব্দ শুনে উঠে আসবে না। সামিহার দুটো মোবাইল সীম অকেজো করে রাখা আছে। তুমি নিশ্চিত থাকতে পার!

উফ! স্যার একজন মানুষ বটে! এমন তুখোড় গোয়েন্দা রহস্যভেদের কাহিনী গল্প উপন্যাসেই এতকাল পড়ে এসেছে। মুভিতে দেখেছে। হাসিবের সাথে এই এত দীর্ঘ বছরে তার প্রতিটা রহস্য উন্মোচন খুব কাছে থেকে দেখেছে আরিফ। প্রতিবারই ভেবেছে এর থেকে জটিল রহস্যের দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ নতুন সবগুলো রহস্যই আরো রহস্য নিয়ে হাজির হয়েছে। এবার মনে হচ্ছে, রহস্যের চরম মুহুর্তের সাক্ষী সে হতে যাচ্ছে।

সামিহা অবন্তি ফোঁপানো থামিয়েছে। তবে কিছু পর পর হেঁচকির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কলাবাগানের বাশিরুদ্দিন রোডের ঘটনাবহুল বাড়িটিতে নিরবে বসে আছে। অনেক অমীমাংসিত ঘটনার সাক্ষী রহস্যময় এই বাড়িটি। হয়ত এই বাড়িটির এবারের রহস্যটা শেষ রহস্য, যার সমাধান হাসিব উদ দৌলার মত একজন ধীমান গোয়েন্দার হাত ধরে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। সামিহা অবন্তি উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেন। আরিফ ওর এই হাঁটাহাঁটি নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে মনে মনে বিশ্লেষণ করল। একজন ক্লান্ত রমনী। মানসিক চাপে বেশ খানিকটা কুঁজো হয়ে আছেন। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। সেই অজানা অচেনা ভবিষ্যত তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। রহস্য সমাধানের শেষ প্রান্তে এসে আরিফের কাছে অনেককিছুই এখন দিবালোকের মত পরিষ্কার। যদিও ঘটনার ঘনঘটার বিস্তারিত সে জানে না। একসময়ে হাঁটাহাঁটি থামিয়ে খুব আলতো করে ওদের সামনের সোফায় বসে পড়ল সামিহা অবন্তি।

-আপনি চাইলে…

কাঁধ শ্রাগ করে এটুকু বলেই থেমে গেলেন হাসিব। জবাবের অপেক্ষা করে আছেন। সামিহা অবন্তির দুই চোখ জবা ফুলের মত লাল হয়ে আছে। এখনো চোখের কোনে অশ্রুজল টলমল করছে।

-আমি চাইলে?

-হ্যা। আপনি শুনতে চাইলে বাকি দুটো কারণ আমি বলব। টেবিলে আমার করা তদন্তের পুরো রিপোর্ট তৈরি করা আছে। আমি জানি আপনিও জানেন এখানে কী লেখা আছে। আপনি চাইলে এগুলো ধ্বংস করে ফেলা হবে।

-বিনিময়ে? যদি রাজি না হই?

-বিনিময়ে?

যেন প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নেই দেয়া হল। টেনে টেনে “বিনিময়ে” উচ্চারণ করলেন হাসিব। চোখেমুখে হাসি ছড়িয়ে আছে।

-আপনি বেশ বুদ্ধিমতি। আপনাকে শুধু একটা ছবি দেখাই। এটা দেখার পর বাকি সিদ্ধান্ত আপনার!

পকেট থেকে মোবাইল বের করে গ্যালারি থেকে একটি ছবি বের করে জুম করলেন হাসিব। একজোড়া সোনালি রঙয়ের হাইহিল জুতো। ব্রান্ডের নাম দেখা যাচ্ছে “ওয়াকার”। “ফ্যালফ্যাল” দৃষ্টি বলতে যেটা বোঝায়। পলকহীন চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সামিহা অবন্তি।

-আপনার দ্বিতীয়, কিন্তু আসল মোবাইল নম্বর পেতে আমাকে একটু চালাকি করতে হয়েছিল। বিকাশে টাকা নেবার নাম করে আপনার সেই মোবাইল নম্বর নিয়েছিলাম। যেই মোবাইল নম্বর আপনি “বিশেষ” কাজে ব্যবহার করতেন। বেশিভাগ সময়ে যেই নম্বর অফলাইনে রেখে দিতেন আপনি। আপনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ সব লোকের যোগাযোগ সেই মোবাইল নম্বর থেকেই হত।

-কী চান বিনিময়ে? আপনার করা তদন্ত রিপোর্ট যদি ধ্বংস করতে বলি? এই এখন? আমার সামনে? এবং আমার দেশের বাইরে যাবার ব্যাপারে আপনি লিখিত নিশ্চয়তা দেবেন। যদিও জানি আপনি কথা রাখার মানুষ!

হাসিবকে এই পর্যায়ে বেশ তৃপ্ত দেখা গেল। একটি তদন্তের সফলতা প্রশ্নাতীত এখন।

-একটিই জীবন। এই চমৎকার পৃথিবীতে একবারই এসেছি। আর ফিরে আসা হবে না। আমিও চাই আপনি নতুন জীবনে আনন্দময় সময় কাটান। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করুন প্রথম জীবনের ভুল এবং অপ্রাপ্তি দূরে ঠেলে দিয়ে। খুব বেশি বড় চাওয়া নেই আমার। রাজি?

-আমি যে কোন মূল্যে নতুন জীবন চাই। আপনার কাছে আমার এবং আবরারের ব্যাংক হিসেবের সব তথ্যই আছে। ইউএস এ তে আমার ভবিষ্যত নিরাপদ আর আনন্দময় জীবনের শুরুর জন্য কত টাকার প্রয়োজন, সেটা আপনার মত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে বুঝাটা অসম্ভব নয়। তারপর বিবেচনা করে যা চাইবেন আমি রাজি!

[চলবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here