মনের_ক্যানভাসে-০১

0
1000

#মনের_ক্যানভাসে-০১
#লাবিবা_আল_তাসফি

‘এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হন রাশেদ ভাই। আপনাকে এক মুহূর্তের জন্যেও সহ্য করতে পারছিনা আমি।’

আমার কথায় সামনে থাকা মানুষটির ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। কথাটা যেন সে শুনতে পায়নি এমন ভাবেই বিছানায় আয়েশি ভঙ্গিতে আধশোয়া অবস্থায় সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। আমি মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে দু চারটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। সিগারেটে লাস্ট টান দিয়ে সেটা রুমের মেঝেতে ছুড়ে ফেলে সোজা হয়ে বসলো রাশেদ ভাই। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তুইকি আমায় কিছু বললি মিনি?”

বিরক্ত চোখে তাকালাম আমি। একটা মানুষ এতটা ছেচড়া কেমনে হয়? আমি যে তাকে এতকিছু বললাম তা শুনেও সে না শোনার ভান করছে। তার উপর আবার সেই মিনি! বলি আমি কি তার পোষা বিড়াল? মিনি এটা আবার কেমন ডাক? অসহ্য। এই লোকটা পুরোটাই একটা অসহ্য।

‘আমাকে দ্বিতীয়বার আর এই নামে ডাকবেন না রাশেদ ভাই। আমার অপছন্দের শীর্ষে আছে আপনার ডাকা এই নামটা।’

রাশেদ ভাই সপ্রতিভ সরল হাসলেন। সুন্দর সে হাসি। সে মানুষটা দেখতে পুরোটাই সুন্দর। ঠিক কোন স্বপ্নের রাজকুমারের মতো। তামাটে গায়ের রং। খোঁচা চাপ দাড়ি, চুলগুলো সুন্দর করে ছাটা যার সামনের দিকের চুলগুলো একটু বড়। ফলে কপালের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। সুন্দর জিম করা শরীর। সিগারেট খাওয়ার ফলে টোট দুটো কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। এতে যেন আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগে তাকে। হাসলে গালের মাঝে খাদের সৃষ্টি হয়। দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু এত সুন্দর হয়ে লাভ কি? তার উপরটা যতটা সুন্দর ঠিক তার ব্যক্তিত্ব ততটাই খারাপ। একরুখে বদমেজাজি অবাধ্য বিগরে যাওয়া ব্যক্তিত্ব তার। ভালো মানুষের কোনো গুন তার মাঝে নেই। সম্পর্কে সে আমার চাচাতো ভাই।‌ আমাদের বাড়ি পাশাপাশিই। পাশাপাশি বলতে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যেতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। রাশেদ ভাইরা দুই ভাই। রাশেদ ভাই বড়। রাকিব আমার সমবয়সী। একই সাথে পড়াশোনা করছি। রাকিব পুরোটা রাশেদ ভাইর বিপরীত। পড়াশোনায় খুব সিরিয়াস। নম্র ভদ্র সামাজিক ছেলে। সাথে সবার বেশ আদরের ও বটে। রাশেদ ভাইকে বাড়ির মুরুব্বিরা খুব একটা পছন্দ না করলেও ছোটদের কাছে সে জনপ্রিয় মুখ। রাশেদ ভাইকে ছাড়া ওদের খাওয়াও চলেনা বলতে গেলে। শুধু কাজিনগুলোই নয় এ এলাকার সকল ছোট সদস্যরা রাশেদ ভাইয়ের ভক্ত। ক্লাস টুতে পড়া বাচ্চা থেকে কলেজ পরুয়া ছেলে সকলেই তার অন্ধ ভক্ত। আর মেয়েরা? তাদের কথা নাই বা বললাম। রাশেদ ভাই হচ্ছে মধু আর এলাকার মেয়েরা মৌমাছি হয়ে মধুর পেছনে ছুটতে থাকে। এ পর্যন্ত শ খানেক প্রেমপত্র এসেছে রাশেদ ভাইয়ের নামে আমার কাছে। বলি আমি কি পিয়ন? হুটহাট এক একজন এসে চিঠি হাতে গুজে দিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে বলবে এটা তোমার রাশেদ ভাইয়াকে দিয়ে দিও। তখন ইচ্ছা হয় থাপরে সবকটা দাঁত ফেলে দিতে। অসভ্য মেয়েছেলে কোথাকার! লজ্জার ছিটেফোঁটা এদের মাঝে আছে কিনা সন্দেহ। তার কাজিন হওয়ার সুবাদে স্কুল কলেজেও শান্তি পাইনি আমি। আমার মনে হতো আমি স্কুলে পড়তে না রাশেদ ভাইয়ের বার্তা সকলের মাঝে বিলাতে এসেছি। মানে এই লোকটা প্রতক্ষ পরক্ষ কোনো ভাবেই আমাকে শান্তি দেয়নি আর দিচ্ছেও‌না। আমার জীবনটাকে নরকে পরিণত করতেই যেন তার জন্ম।
বর্তমানে রাশেদ ভাইয়ের প্রেম চলছে মিতু আপুর সাথে। আপু তার আট নম্বর গার্লফ্রেন্ড। মিতু আপু আমাদের একমাত্র ফুপির একমাত্র কন্যা। আপুর সাথে রাশেদ ভাইয়ের সম্পর্ক গুনে গুনে একমাস সতেরো দিন। খুব মাখা মাখা প্রেম তাদের। সারাদিন ফোনালাপ চলতেই থাকে ইভেব টয়লেটে গেলেও ফোনটা সাথে নিয়ে ঢোকে। মিতু আপু কাল আমাদের বাড়িতে এসেছে। এজন্যই আজ সকাল সকাল রাশেদ ভাইয়ের আগমন। আপু আগে মাসে একবার কি দুবার এসে দু একদিন থেকে চলে যেত কিন্তু এখন খুব ঘনো ঘনো আসা যাওয়া করে। কারণ অবশ্যই রাশেদ ভাই!
মা আপুকে সাথে করে বাজারে গেছেন। বাবা ব্যাবসার কাজে কিছুদিন বাইরে আছেন। সকাল হতেই মা টাটকা সবজি কিনার জন্য বেরিয়েছেন। যদিও আমাকে সাথে নিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি নাকোচ করে দেওয়ায় মিতু আপুকে নিয়েই চলে গেছেন। এদিকে এসব কিছু না জানা রাশেদ ভাই তার প্রেমিকাকে এক পলক দেখতে ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে ছুটে এসেছেন। হাহ! কত রঙ যে দেখতে হবে! তবে আমার বেশ মজাই লাগছে রাশেদ ভাইয়ের বিরহ দেখতে। প্রেম কি বিরহ ছাড়া চলে? তাছাড়া এদের এমন মাখা মাখা প্রেম দেখলে মোন চায় কচু গাছের সাথে দুটোকে উল্টো করে ঝুলিয়ে দিতে। পুরোই অসহ্যকর।

‘কড়া করে এক কাপ চা করে দে তো মিনি। মাথাটা বড্ড ধরেছে।’

‘কেটে ফেলুন না মাথাটা! যেটা প্যারা দেয় সেটা রেখে কি লাভ? নিজেও প্যারা খাচ্ছেন সাথে আশপাশ থেকে আরো দু-একজনকে খাওয়াচ্ছেন।’

কথাটা বলেই জিভ কাটলাম। এই যা জোরে জোরে বলে ফেললাম বোধহয়! আড় চোখে তাকাতেই দেখলাম চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে বজ্জাত রাশেদ। ঢুক গিলে হাসার চেষ্টা করলাম কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। ততক্ষণে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রাশেদ ভাই।

‘বড্ড অসভ্য হচ্ছিস দিন দিন। যা চা করে আন। যা!’

আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ ওখান থেকে কেটে পড়লাম। সেদে ঝাড়ি খাওয়ার কোনো মানেই হয়না। কড়া পাতি দিয়ে এককাপ চা বানালাম। সাথে দুপিছ বিস্কুট নিয়ে নিলাম। বজ্জাত মহাশয়ের আবার চায়ের সাথে বিস্কুট না হলে চলেনা। চায়ের ট্রেটা রাশেদ ভাইয়ের সামনে রেখে আমি ওখান থেকে সোজা ছাদে চলে আসলাম। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তার মুখ দর্শন করার কোনোরকম ইচ্ছা নেই।
_____________

মা বাসায় ফিরলে তবেই আমি ছাদ থেকে নামলাম। ঘরে উঁকি দিয়ে রাশেদ ভাইকে কোথাও দেখতে পেলাম না। চলে গেছেন সে। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে রুমে আসলাম। কিন্তু রুমে ঢুকতেই অবাক হলাম। কারণ রাশেদ ভাইকে দিয়ে যাওয়া চি বিস্কুট একই ভাবে রয়ে গেছে। এমনটাতো হওয়ার কথা না। চা-খোরদের লিস্ট বানালে সেখানে প্রথম তালিকায় রাশেদ ভাইয়ের নাম পাওয়া যাবে। সেই মানুষ কিনা চা রেখেই চলে যাবে! এটা অস্বাভাবিক। তবে কি আমার আচরণে রাগ করে চলে গেল? এই মুহূর্তে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সত্যিই তখন আমার ওভাবে চা রেখে চলে যাওয়া উচিত হয়নি। একটু বেশিই করে ফেললাম বোধহয়। মোন খারাপ নিয়েই ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক বসালাম। কিন্তু পরক্ষনেই মুখ থেকে সবটা বাইরে ফেলে দিলাম। ছিঃ এত তিতো মানুষ খেতে পারে? এমন তিতো খেয়েইতো মুখের ভাষার এমন বাজে অবস্থা বানিয়েছে। ছিঃ কি জঘন্য স্বাদ। একদম রাশেদ ভাইয়ের মতো!

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে মিতু আপুকে দেখলাম মাংসের তরকারি একটা বাটিতে তুলছে। তা দেখে আমার কপালের মধ্যখানে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। কাকে দিতে চাচ্ছে সে এই তরকারি? ব্যাপারটা ঘেটে দেখতে হচ্ছে! তাই আমি এগিয়ে এলাম তার দিকে।

‘কারো জন্য নিচ্ছ বুঝি?’

‘হুসস। আস্তে! মামি শুনতে পাবে।’

‘এমা! সেকি? তুমি তাহলে চুরি করছিলে?’

মিতু আপু অসহায় চোখে তাকালো আমার দিকে। তা দেখে আমার মায়া হলো। তাই আর জোরে কথা না বলে ফিসফিসিয়ে বললাম,

‘বেশ! তবে এটাতো বলো কার জন্য নিচ্ছ?’

মিতু আপুর মুখের ভাব এবার বদলালো। এতক্ষণের অসহায়ত্ব ঘুচে এবার লাজুকতা দেখা দিলো। আলগোছে অগুছালো চুল কানের পেছনে গুজে দিয়ে লাজুক কন্ঠে বললো, ‘ রাশেদের জন্য। জানিসতো ওর ভিষন পছন্দ মুরগির মাংস। এজন্যই ওকে একটু দিয়ে আসবো। প্লিজ তুই মামিকে বলিস না প্লিজ।’

যা একটু মায়া হয়েছিল আপুর উপর তার সবটা শেষ হয়ে গেলো মুহূর্তের মাঝে। গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। ইচ্ছা হলো চিল্লায়ে বলতে,’ তুই আর ঐ রাশেদ এই তরকারির ঝোলে ডুবে মর।’
কিন্তু রাগকে কন্ট্রোল করে আমি সেখান থেকে চলে আসলাম। কেন জানিনা এদের এই প্রেম প্রেম খেলা দেখলে আমার জঘন্য রকম রাগ হয়। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব ধ্বংস করে দেওয়ার মতো রাগ। মাথায় ধপধপ করে জ্বলতে থাকা আগুন নিয়েই পড়ার টেবিলে বসে পড়লাম। রাগগুলো বই খাতার উপর দিয়েই যাক!

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here