ডাকপাড়ি #পর্ব_৫৩,৫৪

0
190

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৫৩,৫৪
#আফনান_লারা
৫৩
________
ফারাজ বই পড়া শেষ করে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখে দাদাজান আর আজিজ দাদু ওর দিকে তাকিয়ে আছেন সোফায় বসে।বিশেষত তাদের চাহনি বলে দিচ্ছে ফারাজ তাদের আশার বাইরের কিছু একটা করেছে যার কারণে তারা এমন করে ওকে দেখছে।তবে সেটা কি হতে পারে?তাদের কথামত সে তো বিয়েটা করেই নিয়েছে তবে তাদের অগ্নি চাহনিতে চাওয়ার মানে আর কি?
ফারাজ হাতের বইটা ঝুলিয়ে ধরে সোজা হেঁটে উপরের তলার দিকে চলে যাচ্ছিল ওমনি দাদাজান তার নাম ধরে ডাকলেন।
ফারাজ থেমে যায়।চোখ বন্ধ করে আরও একবার ভাবে কি ভুল সে করে থাকতে পারে।ভাবতে ভাবতে দাদাজানের কাছে এসে দাঁড়ায় ফারাজ।দাদাজান মুখটা গোমড়া রেখে বললেন,’কাল রাতে তোমরা আলাদা রুমে থেকেছিলে?’

‘না তো।এক রুমেই ছিলাম।আনাফ ভাই বাইরে দিয়ে দরজা লাগিয়ে রেখেছিল।সেই দরজা মতিনকে দিয়ে সকাল সকাল খুলিয়েছিলাম আমি।’

‘তাহলে পূর্ণতা তার রুমে কেন?’

‘আমি কি করে জানবো?’

‘তুমি ছাড়া আর কে জানবে?আমরা জানবো?সে তোমার কি হয়?’

‘বউ’

‘তাহলে তুমি জানবে না তো কি রাস্তার ওপাশের দোকানদার জানবে?বউয়ের ভাললাগা,খারাপ লাগা সব যেন তোমায় জিজ্ঞেস করলে জানতে পারি এরপর থেকে।বিয়ে করেছো তার মানে এই না যে সব শেষ।বরং বিয়ে থেকেই সব শুরু। আমি তোমার উপর আশাবাদী। আশা রাখি তুমি পূর্ণতাকে অনেক খুশি রাখবে ‘

ফারাজ মাথা নাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল,দাদাজান আবারও ওকে থামতে বলে বললেন,’সোজা পূর্ণতার কাছে যাও।কথা বলো ওর সাথে।আর তোমাদের নাকি রুমের খাটটা ছোট?
ছোট হবারই কথা।তুমি যখন ক্লাস সেভেনে উঠেছিলে তখন এই খাটটা আমি চাঁদপুর থেকে আনিয়েছিলাম।খাঁস সেগুন কাঠের খাট।কে জানতো চোখের পলকে এতগুলা বছর কেটে যাবে।এখন তোমার বউ এসেছে ঘরে।সিঙ্গেল খাটে তো নতুন বউ শোবেনা।আমি অর্ডার দিয়ে দিছি।কদিনের মধ্যেই এসে যাবে, ততদিন তুমি পূর্ণতার রুমে থাকবে ওর সাথে’

ফারাজ মাথা নাড়িয়ে হেঁটে চলে গেলো।আজিজ খান বেলায়েত হোসেনকে বললেন,’একটা কথা বলবো বেলু??তোর নাতিটা একেবারে সেকেলে।রষকষ কিছুই নাই।শুরু থেকে দেখতেছি।ব্যাকডেটেড ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি’

‘ও এমনই।ছোট ঠেকেই ভবঘুরে।ওর মাথার ভেতর কি চলে তা কেউ জানেনা।সারাদিন ভাবে,সেটা আবার আঁকে।কে জানতো ওর এই ভাবনা একদিন টাকা পয়সা আনবে ঘরে।এত ভাবতে গিয়ে নিজেকে একটা বেরসিক মানুষ তৈরি করে নিয়েছে।কবে যে ঠিক হবে কে জানে!!’
——-
ফারাজ পূর্ণতার কাছে না গিয়ে নিজের রুমে এসে বইটা রেখে মেলায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।গায়ের পাঞ্জাবিটা বদলে অন্য পাঞ্জাবি পরে এসে বোতাম লাগাতে লাগাতে তার চোখ গেলো সাজানো বাসরের দিকে।একটা মিনিটের জন্য ও সে কাল বাসর ঘরটা দেখেনি।
সে মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র নতুন বর যে বাসর ঘরে বাসরঘরের ফুল না দেখে পরেরদিন দেখে।
ফুলে হাত ছুঁয়ে ফারাজ হাসলো।এই বাসর ঘর নিয়ে তার অনেক অনেক প্ল্যান ছিল।সব প্রতিমাকে ঘিরে।কে জানতো পাশা এভাবে উল্টে যাবে?একেবারে মন থেকেই উঠে গেছে এই বাসর ঘর।
‘যার কারণে বাসর ঘর যে এত সুন্দর করে কাল সাজানো হয়েছিল সেটা জানলামই না আমি!’

পূর্ণতার হাতে হলুদ রঙের একটা শাড়ী ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছেন মিসেস সায়না।শাড়ীটা পরে নিচে পিঠা বানাতে আসতেও বলে গেছেন।
পূর্ণতা শাড়ীটা পরে যেমন আদেশ তেমন মতন নিচে চলে আসে।ফারাজকে কোথাও দেখলোনা।না দেখলেই ভাল।দেখলেই মেজাজ গরম হবে।কালকের সুন্দর ঘুমটা নষ্ট করেছিল সে।রাগ এখনও ঠিকমত ঝাড়তে পারেনি পূর্ণতা।
———
ওয়েটার মেনুকার্ড দিয়ে যাবার পর আনাফ সেটা ফাইজার দিকে ঠেলে ধরে।মনে মনে ভাবছে কি করে ফাইজাকে কষ্ট না দিয়ে মানা করে দেয়া যায়।যখন সে এটা ভাবছিল তখন সে ফাইজার দিকেই তাকিয়ে ছিল।ফাইজা লজ্জা পেলো তাতে।
“সুদর্শন পুরুষেরা সাধারণত কোনো কারণ ছাড়া নারীদের দিকে তাকান না।”
এখন যখন তাকিয়ে আছে এর মানে কি হতে পারে তাই ভাবছিল ফাইজা।আনাফকে ছবিতে দেখেই পছন্দ করেছিল সে।এখন বাস্তবে দেখা হয়ে ভালোলাগাটা বেড়ে গেলো অনেক।ফাইজা মুচকি হাসছে দেখে আনাফ বললো,’নিন।কি খাবেন অর্ডার করুন’

‘কফি খেতেই তো আসলাম’

আনাফ কফির অর্ডার দিয়ে ফোন বের করলো।সারথি আর কল দেয়নি।ফোনটা সে আবার পকেট ঢোকাতেই ফাইজা বললো,’আমায় আপনার কেমন লেগেছে?’

আনাফ বড় করে দম নিয়ে বললো,’দেখুন ফাইজা ম্যাম,আপনি নিঃসন্দেহে একজন পারফেক্ট নারী।বিউটি উইথ ব্রেইন।যেকোনো পুরুষই আপনার মতন সহধর্মিনী চাইবে।সুন্দরী,শিক্ষিত,পেশায় ডাক্তার।আর কি চাই!!
কিন্তু আমি এসব কিছুই চাইনা।আমি সবসময় সবার থেকে আলাদা ভাবি।আমার ভাবনা ছিল আমি হিসেবের বাইরে বেরিয়ে কাজ করবো।বিয়ের ক্ষেত্রেও তাই।আমি এমন একজনকে বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছি যে পেশায় ডাক্তার না,বরং সে কোনো চাকরিই করেনা। সে অতি সাধারণ।তার পরেও আমি তার কথাবার্তাতে,চালচলনে অসাধারণত্ব দেখেছি।আমি বিয়ে করলে তাকেই করবো, বাবাকে এটা বলার পরেও বাবা জোরপূর্বক আমাকে আজ এখানে পাঠিয়েছেন।আমি কথাটা এতদূর আগাতে চাইনি।যদি ভুল কিছু করে থাকি মাফ করে দেবেন।আপনাকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না’

ফাইজা মুচকি হাসলো।ওয়েটার কফি দিয়ে যাবার পর মগটা নিজের দিকে টেনে বললো,’এজ এ ফ্রেন্ড ডেটটা হোক।সমস্যা তো নেই তাতে তাইনা?’

‘একদম’

‘আমারও হয়ত আপনার মতন ভাবা উচিত।চাহিদা কমিয়ে সাধারণের দিকে চোখ বুলালেই আমি অসাধারণ কাউকে পেয়ে যাবো’

আনাফ মাথা নাড়ালো।ফাইজা কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,’একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’

‘হুম’

‘ও কি আমার চাইতে বেশি সুন্দরী? ‘

আনাফ নিজের কফিটা শেষ করে হাসলো।তারপর হাসিটাকে দমিয়ে বললো,’হ্যাঁ।অনেক বেশি সুন্দরী ‘

‘এটাই কি সেই কারণ যে ডাক্তার বিয়ে না করে সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করার?’

‘ধরুন আপনি একটা ছেলের প্রেমে পড়লেন।ছেলেটা খুব সুন্দর।পরে জানতে পারলেন সে বিবাহিত। তখন আপনি কি করবেন?’

‘প্রেম শেষ করে চলে আসবো’

‘কিন্তু আমি পারি নাই।কারণ আমি প্রেমে পড়ি নাই।আমি ভালবেসেছি।এখন যদি সেই মেয়েটির মুখে মেছতার দাগও বাসা বাঁধে তাও আমি তারে ছাড়তে পারবোনা।কারণ আমি প্রেম করিনি,আমি ভালোবেসেছি”

ফাইজা মুগ্ধ চোখে আনাফকে দেখতে লাগলো।এই টাইপের একটা ছেলে যদি তার কপালে থাকতো তার জীবনটা কত সুন্দর হতো।যে মেয়েটা আনাফকে পাবে সে সত্যিই অনেক লাকি
——-
সজীব বিচ থেকে ফিরে যে শুয়েছিল তার আর কোনো খবর নেই।ওর কথা মতন লেভেন ওকে কল দেয়নি আর।
ঘুম থেকে সে উঠতোনা কিন্তু কাজের লোকেরা ওকে এমন করে ঘুমাতে দেখে ভয় পেয়ে বাধ্য হয়ে ওকে জাগিয়ে তোলে।ঘুম ছেড়ে উঠে সজীব পুরা উন্মাদের মতন করছিল।ওর শরীর এত খারাপ ছিল যে কাজের লোকেরা লেভেনকে কল করে।কিন্তু সজীবের সাথে রাগ করে লেভেন তার ফোন বন্ধ রেখেছিল।এবার তারা সজীবের বাবার নাম্বারে কল করলো।তিনি রিসিভ করলেন।তারা সজীবে শরীরের ব্যাপারে সব জানালো ওনাকে।
শেষে চিন্তিত হয়ে তিনি কাজ ফেলে মালেশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন।
সজীবের হুশ তেমন ছিল না। বাবা মালেশিয়ার পাশের একটা দেশেই ছিলেন।তাই আসতে তার সময় লাগেনি বেশি।তিনি দ্রুত সজীবকে হাসপাতালে নিয়ে যান।ওখানের ডাক্তার জানায় সজীব অতিমাত্রায় ড্রিংকস করায় তার এই অবস্থা হয়েছে।বাবা রাগ দেখালেন শুরুতে।সজীব কিছুই বলছেনা।সে কেবল চুপ করে বাবার দিকে চেয়ে আছে বেডে শুয়ে।
বাবা নার্স ডাক্তার চলে যাবার পর ধমকের সুরে বললেন,’আমার সাথে আগামীকাল সকালে বাংলাদেশ ফিরবে।দু পরিবার বসে যে সিদ্ধান্ত হবে সেটাতেই শেষ হবে।আমি আর কিছু শুনতে চাইনা।বিদেশী মেয়েটার সাথে থেকে থেকে নিজের কি হাল করেছো তা তো দেখতেই পারছি।’
———
পূর্ণতা অন্যদিকে ফিরে বসে বসে পিঠা বানাচ্ছিল।যে শাড়ীটা মিসেস সায়না দিয়ে গেছিলেন ওকে সেটা ওনারই শাড়ী ছিল।ফারাজ রেডি হয়ে রান্নাঘরে এসে বললো,’কাকি জলদি করে নাস্তা দাও।আমার একটা কাজে যেতে হবে।’

পূর্ণতা অমনি চমকে পেছনে ফিরে দেখে ফারাজ হাতের ঘড়ি পরছে দাঁড়িয়ে।

‘আমি আপনার কাকি?’

পূর্ণতার কণ্ঠ শুনে ফারাজ মাথা তুলে চেয়ে দেখে তার সামনে পূর্ণতা বসা।

‘আমি ভাবলাম সায়না কাকি’

‘আমার বডি তার মতন?’

‘এই শাড়ীটা কাকির তো।আপনি কি করেন এখানে?’

‘বিয়ের পরেরদিন সকাল সকাল পিঠা বানাতে হয়।নতুন বউ কিনা।
সয়ং বর নতুন বউ না মানলেও পরিবার তো মানে।তাই পিঠা বানাচ্ছি’

‘আমি আপনাকে মানি না,কে বললো?’

পূর্ণতা আর কিছু না বলে পিঠার প্লেট ফারাজের হাতে ধরিয়ে চলে গেছে।
ফারাজ তখন বললো,’বউ মানেই প্যারা’

মতিন কথাটা শুনে জবাবে বলে,’তাহলে কি আমি বানুকে বিয়ে করতাম না?সে কি আমায় প্যারা দেবে?’

‘আমি কি জানি!’

‘আপনি তো কইলেন বউ মানে প্যারা’

‘সবার বউ এক নাকি!দিলে দিতেও পারে,আবার কম ও দিতে পারে।তবে দিবে এটা সিওর’
———-
সারথি ফোন হাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিল।আনাফের একটা কলের অপেক্ষায় তার সময় চলছে।হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় ব্যস্ত হয়ে রিসিভ করে সে।
কলটা আনাফেরই ছিল।ফাইজাকে বিদায় দিয়ে হসপিটালে ফিরতে ফিরতে সারথিকে ফোন করে সে।

‘কি করছেন ম্যাডাম?’

‘কিছুই না।আচ্ছা তখন কে এসেছিল?’

‘আমার কলিগ’

‘মেয়ে?’

‘হুম’

‘ভালো।’

‘তাকে চিরজীবনের জন্য বিদায় দিলাম।আর কখনও এক অফিসে আসবেনা’

‘আরও ভাল।সকালের নাস্তা করে নিন।বেলা হতে চললো’

‘বাবার সাথে কথা বলে তারপর।অতি চিন্তায় গলা দিয়ে খাবার নামাতে পারিনা আমি’

‘সাবধানে গাড়ী চালাবেন,আপনি গাড়ী চালানোর সময় কাজ করেন সবসময়।এটা ঠিক না’

‘হারানোর ভয় হয়?ভেবোনা। আমি মরার পর আমার ভালবাসা তোমায় দুনিয়ায় থাকতে দেবেনা।ঘুরেফিরে আমার কাছেই নিয়ে আনবে’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৫৪
#আফনান_লারা
________
আনাফ সকালের নাস্তাটা আর করে উঠতে পারেনি।দুপুর গড়িয়ে গেলো বলে বাসায় ফিরে আসে সে।আসতেই দেখে বাড়িতে এক প্রকার আগুন আগুন অবস্থা।তার একমাত্র কারণ হলো আনাফ ফাইজাকে রিজেক্ট করেছে তাও সেই মেয়েটির জন্য যাকে ওর বাবা প্রত্যাখান করেছিলেন।
বাবা সোফায় বসেছিলেন, ওরই অপেক্ষায় ছিলেন।ওকে দেখেই যেন তার রাগ আবার আগের মতন গাঢ় হয়ে গেলো।আগুনে ঘি ঢালার মতন।
ধমকে জানতে চাইলেন সে এমনটা কোন সাহসে করেছে।
আনাফ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।হাতের এপ্রোনটা টেবিলে রেখে দিয়েছিল আগেই।বাবা ওকে নিরব থাকতে দেখে বললেন,’তুমি যে মহারানীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো সে নাকি চোখে দেখতে পায়না?’

‘হুম’

‘তাহলে কিসের ভিত্তিতে তুমি আশা করো যে এই বিয়ে আমি মেনে নিবো?’

‘বাবা বিয়ের পর ওর চোখ আমি ঠিক করিয়ে নেবো ভাল চিকিৎসকের মাধ্যমে’

‘কেন ঠিক করাতে হবে?কেন আগে থেকে ঠিক নেই?’

‘বাবা সবাই তো পারফেক্ট হয়না’

‘তুমি তো পারফেক্ট। তোমার একটা কমতি দেখাও আমাকে,যেটা দিয়ে আমি বলতে পারবো যে তুমি সব দিক দিয়ে ঠিক নেই??’

‘বাবা একজন পারফেক্ট কি আররেকজন ইম্পারফেক্টকে বিয়ে করতে পারেনা?’

‘না পারেনা।ফাইজা তোমার জন্য বেস্ট বলে আমি মনে করি।দেখো আনাফ!!তোমার যথেষ্ট জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে।এইসব তুমি ভালই বুঝবে।
একটা অন্ধ,গরীব,বেকার মেয়েকে বিয়ে না করে পেশায় ডাক্তার,ভাল বংশের,সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করলে তোমার এবং তোমার ফ্রেন্ড সার্কেল,আমাদের আত্নীয় স্বজন সকলের সামনে ইমেজটা ধরে থাকবে।আমি চাইনা আমার পুত্রবধু আসার সময় ঠাট্টা নিয়ে আসুক।’

আনাফের রাগ হলো।বাবার সাথে আর কোনো কথা না বলেই সে তার নিজের রুমে এসে দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয়।
বাবা ও রাগ করে ওনার রুমে চলে গেছেন।
——–
সারথি ছাদে বসে গুনগুন করে গান করছিল সেসময় ছাদে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে গানটা মাঝপথেই থামিয়ে দেয় সে।গায়ের গন্ধ নিয়ে বুঝতে পারে ওটা বাবা।
বাবার গায়ের থেকে সবসময় ধোঁয়ার গন্ধ আসে।এটা কি কারণে হয় সে জানেনা তাও ধোঁয়ার গন্ধ পেলেই সে বুঝে যায় তার পাশে বাবা আছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সারথি বলে,’কিছু বলবে বাবা? ‘

‘তুই কি আনাফকে ভালবাসিস?’

সারথি চুপ করে থাকলো।মানিক সাহেব আবার বললেন,’সজীবের বাবা দেশে আসবেন জানিয়েছেন,সাথে সজীব ও।তিনি দু পরিবারের বৈঠক করতে চান।তুই কি মীমাংসা চাস?’

‘বাবা আর কিসের মীমাংসা? ডিভোর্স হয়ে গেছে।এর পরেও যদি জানতে চাও আমার কি মত।তবে বলবো ওনার সংসারে আমি আর ফিরে যেতে চাইনা।ডিভোর্সের পরে আর কিছু থাকতে পারেনা বাবা’

‘আনাফের কাছে সুখী হবি তো?সজীব ও কিন্তু তোকে পছন্দ করেই বিয়ে করেছিল’

‘আনাফকে যতটা চিনেছি,ভরসা আছে আমায় তিনি কাঁদাবেন না।
যদি এরপরেও কাঁদান তবে বলবো ভাগ্যের দোষ’

মানিক সাহেব সারথির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।সারথিকে আর কোনো কিছুতে তিনি জোর করবেন না।সজীবের বেলায় জোর করে আজ এই দিনটা দেখতে হয়েছে বলে এরপর আর সারথির মতের বিরুদ্ধে যাবার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না।
————-
পূর্ণতা আর ফারাজকে এক করে মার্কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে দাদু আর কাকিরা মিলে।উদ্দেশ্য হলো পূর্ণতা তার পছন্দে শাড়ী কিনবে।শুরুতে দাঁত কেলিয়ে দুজন বেরিয়ে গেলেও এখন রোডে এসে দুইজন দুদিকে চলে গেছে।
রাস্তার এই পাশ থেকে পূর্ণতা বলছে,’শাহেদ ভাইকে বিয়ে করা উচিত ছিল অন্তত নিজেকে বিয়ের পরেরদিন সিঙ্গেল মনে হতোনা’

‘আমি কিছু করছি?কাল থেকে এত খোঁচাচ্ছেন কেন?’

‘আমি হিসেব মিলাতে পারছিনা।আপনি কি কারণে নিজের সম্মতিতে বিয়েটা করলেন?আপনি না আমায় পছন্দ করেন না?’

ফারাজ আবার চুপ।পূর্ণতা পুরো রাস্তায় ঘ্যান ঘ্যান করে গেছে।মার্কেটে এসে একটা শাড়ী নিচ্ছে আর সেই আগের লেকচার শুরু।শেষে বাধ্য হয়ে ফারাজ সবার সামনে ওর মুখ চেপে ধরে বলে,’আপনাকে আমি সব প্রশ্নের জবাব বাসায় গিয়ে দিবো। এবার একটু চুপ করে থেকে আমায় শান্তি দিন।আমার মেলায় যেতে হবে,তাড়াতাড়ি শাড়ী কিনে আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি কাজে চলে যাবো’

প্রশ্নের জবাব পাবে ভেবে পূর্ণতা থামলো।পছন্দ মতন কয়েকটা শাড়ী কিনে ফারাজের সাথে বাসায় ফিরে আসলো আবার।ফারাজ ওকে রেখে কাজে চলে যায়।
———
প্রতিদিন আনাফের সাথে দেখা হতে হতে এখন আজকের দিনটা দেখা না হওয়ায় সারথির ভীষণ খারাপ লাগছে।মন বসছেনা কিছুতেই।বারবার ইচ্ছে করে আনাফের সাথে কথা বলতে।কিন্তু সে তো ব্যস্ত মানুষ।
ফোনটা কোথায় রেখেছিল সারথি ভুলে গেছে।হাতাতে হাতাতে গোটা রুম হাতিয়েও ফোনটা পায়নি।পরে যাচ্ছিল মতিনকে ডাকতে।সে এসে ফোন খুঁজে দেবে,ওমনি দরজার কাছে এসে ঘ্রাণ পেলো সেই আতরের।আনাফের গায়ের গন্ধ এটা।কিন্তু এসময় আনাফ কোথা থেকে আসবে চিন্তা করে সারথি বিষয়টাকে এড়িয়ে বের হয়ে চলে যেতে চাইলো কিন্তু সে বের হতে নিতেই ধাক্কা খেলো আনাফের সাথে।আনাফ মুচকি হেসে ওর দিকে চেয়ে ছিল।

‘কে?’

‘চিনলেনা?’

‘আপনি এসেছেন সত্যি?’

‘ভাল লাগছিল না তোমায় না দেখে।তাই চলে এসেছি।আচ্ছা শুনো,চলো দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।তোমাদের হল রুমে কেউ নেই।কেউ দেখার আগে চলো পালাই’

এই কথা বলে আনাফ সারথির হাত ধরে টান দিলো।দুজনেই সবার নজর এড়িয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়ে গেছে।আনাফের গাড়ীতে সারথিকে উঠিয়ে দুজনে পগারপার।
সারথির বিষন্ন মনটা যেন নতুন জীবন পেয়ে গেলো।হুট করেই খুব করে ওর মনটা ভাল হয়ে গেছে।সে বারে বারে হাসছে।আনাফ ওর হাসি দেখে নিজেও হাসতে পারেনি।বাবার এই বিয়ের প্রতি অমত তাকে প্রতিক্ষণে কষ্ট দিচ্ছে।সে বুঝতে পারছেনা কি করে বাবার মতটা নিবে।
সারথি বাসায় যে শাড়ীটা পরেছিল সেটা আহামরি না হলেও ওকে বেশ দেখতে লাগছিল।আনাফের মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো তখন।গাড়ী থামিয়ে সারথির চুলগুলো ঠিক করে দেয় সে।সারথি তখন জানতে চাইলো কি হয়েছে।আনাফ চুলগুলোকে টেনেটুনে ঠিক করে বললো,’বাবার কাছে যাচ্ছি।বাবা হয়ত তোমার সাথে দেখা হলে বিয়েতে হ্যাঁ বলবে’

‘ তার মানে উনি না করে দিয়েছেন?’

আনাফ চুপ হয়ে যায়।চুপচাপ গাড়ী চালানোই মন দিলো।সারথি ও বুঝে গেছে,পেয়ে গেছে তার উত্তর।
সেও আর কথা বাড়ায়নি।তবে মন খারাপ হলো।আনাফকে নিয়ে সে যে স্বপ্নটা নতুন করে দেখার চেষ্টায় ছিল সেটা যেন পানসে হয়ে গেলো।আসলেই কি তিনি রাজি হবেন নাকি তাকে ফিরে চলে আসতে হবে।
——-
আনাফের বাবা কফির মগ হাতে খবর দেখছিলেন টিভিতে।আনাফ সেসময় বাসায় ঢুকে।তাকে দেখে কফির মগটা সেন্টার টেবিলের উপরে রেখে দিলেন তিনি।সকালের কথা নিয়ে কিছু বলতে যাবেন তখনই আনাফের পাশে দেখতে পেলেন সারথিকে।শুরুতে ওর সৌন্দর্যে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেও এরপরে তিনি আবারও ব্রু কুঁচকে ফেললেন।মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নেন।

‘বাবা,ও সারথি’

বাবা চুপ করে টিভিতে চ্যানেল পাল্টে চলছেন।
আনাফ সারথিকে টেনে এনে বাবার পাশের সোফাতে বসিয়ে দিলো।তারপর টিভিটা বন্ধ করে নিজেও বসে গেলো বাবার মুখোমুখি।

‘কি??’

‘বাবা ও সারথি।’

‘শুনেছি,দেখেছি’

‘কথা বলো ওর সাথে’

‘কথা নেই আমার’

‘কিন্তু আমাদের তো কথা আছে।’

বাবা রিমোট রেখে খবরের কাগজ হাতাতে নিতেই আনাফ কাগজটা সরিয়ে বললো,’সারথি বাবার সাথে কথা বলো’

সারথি সালাম দিলো তখন।বাবা মুখ গোমড়া করে রেখে সালামটা নিলেন।
সারথি তখন বললো,’আমার হাতে কোন রান্না খেতে মন চায় আপনার?’

আনাফের বাবা অবাক হলেন শুরুতেই সারথির এমন কথা শুনে।তারপর বললেন,’যে চোখে দেখতে পায়না সে আবার ডিশ রান্না করবে’

‘কোন উপকরণ কোথায় আছে বলে দিলে আমি ঠিক রাঁধতে পারি’

‘ঠিক আছে।আমার ইচ্ছে হইছে গোলাপজাম খাওয়ার।সব উপকরণ রান্নাঘরে আছে,বুয়াও আছে। গিয়ে বানিয়ে দেখাও।বুয়া কিন্তু জানেনা গোলাপজাম কেমনে বানায়।সে শুধু তোমায় উপকরণ দেখিয়ে দিবে’

কথাটা শুনে সারথি উঠে দাঁড়ায়।আনাফ ওর হাত ধরে রান্নাঘরে দিয়ে আসলো।কিন্তু বাবা ওকে ডাক দিয়ে ওখান থেকে নিয়ে আসলেন।
————
ফারাজ তার কাজ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরে গেলো তখন বাড়ির চেহারা অন্যরকম দেখতে পেলো। এমন সাজ কাল থাকার কথা ছিল অথচ সেই সাজ কিনা আজ??
বিয়েবাড়ি বিয়েবাড়ি অনুভূতি।ফারাজ হাতে কিছু ফল নিয়ে এসেছিল, আজ তার অনেকগুলো ছবি বিক্রি হয়ে গেছে।ভেতরে ঢুকে মতিনকে ডেকে ফলগুলো দিয়ে সে নিজের রুমের দিকে গেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।এসে দেখে তার রুমে তালা ঝুলছে।আর একটা পোস্টার লাগানো সেখানে।সেই পোস্টারে লেখা ‘আমি জানি তুমি পূর্ণতার রুমে থাকতে চাইবেনা,ঘুরেফিরে তোমার এই রুমেই থাকতে আসবে তবে ঘি তুলতে সোজা আঙ্গুল ব্যাঁকা করার জ্ঞান আমার আছে।তাই তালা ঝুলালাম।চুপচাপ নিজের বউয়ের রুমে যাও,ফ্রেশ হও।’

এই লেখা দাদার তা ফারাজ বুঝতে পেরেছে।এখন এখানে লাফালাফি করেও লাভ নেই,চাবি পাবেনা।পূর্ণতার কাছেই যেতে হবে।তা নাহলে আজ আর ফ্রেশ হওয়া হবেনা।কারণ এই বাড়িতে বাড়তি রুম বেশিদিন খালি থাকেনা আর এখন তো নিশ্চিত খালি নেই।
—–
পূর্ণতাকে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেছিলেন মিসেস সায়না।সেই সাজটা হাতে আয়না তুলে দেখছিল পূর্ণতা, সেসময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখে অবিশ্রান্ত ফারাজ দাঁড়িয়ে।তার সারামুখে ক্লান্তির ছাপ।পূর্ণতা তাকিয়েছে দেখে ফারাজ মাথা নিচু করে ভেতরে এসে সোজা ওয়াশরুমের দিকে চলে গেছে,ওর সাথে আর কথা বলেনি।পূর্ণতা একবার নিজের দিকে ফিরে তাকায়।
হালকা গোলাপি রঙের কটনের শাড়ীটা এত সুন্দর,যখন মিসেস সোনালী দিয়ে গেলেন তখন থেকে তার চোখ সরছিল না শাড়ীটা থেকে।শাড়ী পরে তার মনে হচ্ছিল সে আকাশে ভাসছে।আসলেই কি তাকে শাড়ীটা মানায়নি??
তবে ফারাজ একবারও কেন তাকালোনা?তবে এটা বাদে যদি ভেবে দেখা হতো তবে বলা যায় উনি এমনই।কখনওই তাকান না।আজ কেন তাকাবেন?
———
ফারাজ যখন ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয় তখন দেখে পূর্ণতা মেঝেতে বসে বসে নিজের কানের দুল খুঁজছে।চুলগুলো আজ আর খোঁপা করা ছিলনা।পিঠে ছেড়ে দেয়া ছিল।তাতে গাজরা ঝুলছে।
পূর্ণতা ব্যস্ত হয়ে খুঁজছিল কানের দুল আর ফারাজ তার অগোচরে তাকেই দেখছিল।যেটা সে এতক্ষণ চেয়েছিল।
ফারাজ অনেকক্ষণ ওকে দেখে যেই না সে পেছনে ফিরলো ওমনি সে চোখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছে যার কারণে পূর্ণতা জানলোইনা,তাকে ঘিরে এতক্ষণ চিত্রকরের মনে কত চিত্র অঙ্কিত হচ্ছিল।
——–
সারথির বানানো মিষ্টি খেয়ে আনাফের বাবা রীতিমত অবাক।তিনি দূর থেকে দেখছিলেন সারথি কেমন করে কাজ করে।আল্লাহ ওর থেকে একটা জিনিস নিয়ে ওকে বাকি সবদিকে পটু তৈরি করে পাঠিয়েছেন দুনিয়ায়।কি সুন্দর করে সে কাজটা করে ফেললো।দূর থেকে দেখলে কেউ বলবেনা সে চোখে দেখতে পায়না,তার দূর্বলতা আছে।আনাফের মনের ভয়টা তখনও যায়নি।কারণ বাবা অল্প কিছুতে রাজি হবার মানুষ না, এটা সে জানে।
সেটাই হলো।মিষ্টিতে অবাক হলেও তিনি এখনও রাজি হোন নি।সারথিকে ইংরেজীতে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন শুধু।
সারথি একটা সময় বলে দিলো সে ইংরেজী ভাল পারেনা।এরই দোষ ধরলেন তিনি।মুখের উপর বলে দিলেন,’আনাফ তোমার হবু বউ তো ইংরেজী পারেনা’

আনাফ তখন বললো,’বউ হতে হলে ইংরেজী পারতে হবে?’

‘হ্যাঁ,আমার ছেলের বউ হতে হলে গড়গড় করে ইংরেজী পারতে হবে’

সারথির চোখের কোণায় পানি জমা ছিল।এই কথাতে সে ধরে নিলো তাদের বিয়েটা হচ্ছেনা।সেই জমা পানিটুকু বেয়ে পড়ে গেলো তখনই।আনাফের বাবা সেটা দেখে বললেন,’এই টুকুতে কাঁদলে হবেনা।এই যে আমার বন্ধুবান্ধব।সব তো ইংরেজীতে কথা বলে।তাদের সাথে যখন আমারই ছেলের বউ কথা বলতে পারবেনা,আটকে যাবে তখন আমার মানসম্মান কই থাকবে??তুমি কি আসলেই ঘর আলো করতে আসতেছো নাকি অন্ধকার করতে?’

আনাফ অমনি উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।সারথির হাত ধরে ওকেও উঠিয়ে বললো,’বাবা আমার শেষ কথা।আমি বিয়ে করলে ওকেই করবো আর নাহলে আমি বিয়েই করবোনা।তুমি যত ফাইজা,বা আরও যতজনকে আনো, কোনো লাভ হবেনা।আমি ঠিক তোমারই মতন করে সবাইকে রিজেক্ট করে দিবো’

এই কথা বলে আনাফ সারথিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। বাবা আগের মতন সোফায় বসে থাকলেন।আনাফের মা দূর থেকে সব দেখেছেন।আনাফ চলে যাবার পর তিনি আনাফের বাবার কাছে বসে বললেন,’মেয়েটা অতোটাও খারাপ না।রাজি হয়ে যান’

‘ছেলের হয়ে সাফাই গাইতে এসেছো?আমি না বলেছি, মানে না।ব্যস’

‘আপনার জেদের কারণে যে একমাত্র ছেলেকে হারাবেন সেটা জানেন?আনাফ ঐ মেয়েটার জন্য কতটা পাগল তা দেখেছেন আপনি??সে যদি মেয়েটাকে নিয়ে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলে, তখন কি করবেন?’

‘তবে ও ভুলে যাক ওর বাবা আছে’

‘এসব যদি মানতোই তবে সে আপনার মত না থাকার পরেও বিয়ে করার জন্য এত উঠে পড়ে লাগতোনা’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here