#সখি,২য় পর্ব ও শেষ পর্ব
সন্ধ্যার পর সাবের বাড়ি ফিরলো।
বাড়িতে পা দিয়েই মনে হলো আজকে বাড়িটা কেমন চুপচাপ হয়ে আছে।
এমনিতেও ওদের বাড়িটা চুপচাপই থাকে আজকে আরও বেশি মনে হচ্ছে।
বসার রুমে নেলি বসেছিল।
সাবেরকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
যেন সে কোন অদ্ভুত বস্তু।
সাবের বলল – কি ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
নেলি মৃদু কন্ঠে বলল – কোন ব্যাপার না এমনিই তাকালাম। তোমার দিকে তাকালে কোন সমস্যা আছে? সমস্যা হলে বল আর তাকাবনা।
সাবের অবাক হল! কি হলো নেলির?একেবারে সাবেরের মতো করে কথা বলছে। সকালেও তো বেশ ভালোই ছিল।
– যতো ইচ্ছে তাকাও সমস্যা নেই, তাকানো শেষ হলে আনুর মাকে বল কড়া করে চা দিতে। সাথে যেন কিছু দেয় ক্ষিধে লেগেছে। আমি গোসলে যাচ্ছি।
নেলি বলতে চাইল- আনুর মা নেই, মা-বাবাও নেই। বুবুকে নিয়ে হসপিটালে গেছে।
একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে এসব বলা ঠিক না।
তাই সে বলল – তুমি ফ্রেস হও আমি নাস্তা দিচ্ছি।
চা খেতে খেতে সাবের হঠাৎ প্রশ্ন করল – বাসায় কি কিছু হয়েছে?
নেলি সে কথায় উত্তর না দিয়ে বলল – তোমরা বাসায় এতোজন সুস্থ মানুষ সবাই মিলে বুবুর মতো একজনকে ভালোবাসা দিয়ে ভালো রাখতে পারোনা?
সাবের চুপ করে রইল।
নেলি ভেজা গলায় বলল – বুবুকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে, দুপুরে খায়নি বলে সেন্সলেস হয়ে গেছে বুবু। আমি সত্যিই বুঝিনা কারা অসুস্থ তোমরা না কি বুবু?
নেলি ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে। সত্যিই কতদিন বুবুকে সে ঠিক করে খেয়াল করেনা, কথা বলা তো দূরে থাক।
বুবুর অসুখ ধরা পড়ার পর ডাক্তার বার বার করে বলেছিলেন সিজোফ্রেনিয়ার পেশেন্টকে আদর, ভালোবাসায় রাখতে হয়।
এই বুবুকে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সে তার প্রথম প্রেম, ক্যারিয়ার সব ছুড়ে ফেলেছিল ।
সাবের প্যান্ট পরে আবার বেরিয়ে পড়ল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
বের হওয়ার মুখেই দেখে বাবা, মা ফিরে এসেছেন বুবুকে নিয়ে।
– কি হয়েছে বুবুর? সাবের উদ্বেগের সাথে বলল।
– যা হয় আর কি, আমার মেয়ে তো ভড়ং করে। সেলিনা শান্ত কিন্তু অভিমানের সুরে বললেন।
– চুপ করো তো সেলিনা, আগে ঘরে গিয়ে বস। কামাল সাহেব বলে উঠলেন।
ঘরে যেয়ে বসলেন সেলিনা। ক্লান্ত গলায় বললেন- প্রেসার, সুগার দুটোই কমে গিয়েছিল, তেমন সিরিয়াস কিছুনা। তোমরা ব্যস্ত হয়োনা।
মেহেরজান সাবেরকে দেখে বলল – তুই আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলি ভাই? মুখটা কি শুকনো লাগছে। ও সখি ভাইকে খেতে দে তো।
মেহেরজানের মনেই নেই বিকেলের কথা।
সাবের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবল – আহারে, আমার বোনটা কি মায়াবতী!
সাবের থেকে মাত্র দেড় বছরের বড় বুবু। দু’জন একসাথেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। বুবু এক ক্লাস উপরে । প্রাইমারি স্কুল, একগাদা স্টুডেন্ট। ভীতু সাবেরের ভরসা ছিলো বুবু। তার ক্লাসে এনে সাবেরকে বসিয়ে রাখতো বুবু। মাত্র দেড় বছরের বড় তবুও কিভাবে সাবেরকে তখন থেকেই আগলে রাখত। বুবু যখন ক্লাস নাইনে তখন থেকেই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দিল।
প্রথম দিকে মা বিরক্ত হয়ে মার লাগাতো। আস্তে আস্তে বুঝা গেলো এটা একটা মানষিক রোগ।
কতো কবিরাজ, ডাক্তার দেখানো হলো! শেষে মেন্টাল থেরাপি ইলেক্ট্রিক শকও দেয়া হলো। কাজের কাজ কিছুই হলোনা। বুবু আর আগের বুবু হয়ে উঠলোনা। কি কষ্ট আর মন খারাপ করা দিন যে গেছে! কেউ বললো বিয়ে দিলে ঠিক হবে। মা রাজি হলেন না। এমন অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে দিলে সেটা আরও খারাপ হতে পারে ভেবে।
আস্তে আস্তে সাবেরদের হাসিখুশি বাড়িটা কেমন মরে গেল। মা চুপচাপ হয়ে গেলেন। বাবাও কেমন দূরে সরে গেলেন। ভাইয়া বিয়ে করলো ঠিকই কিন্তু মিথি ভাবি এসে বাড়িটাকে জাগিয়ে তুলতে পারলোনা। সারাক্ষণ বিরক্ত হয়ে থাকে মিথি ভাবি। বুবু একটু উলটা পালটা কিছু করলেই কপাল কুঁচকে ফেলেন। বহুদিন পর নেলি এসে বাড়িটাকে আস্তে আস্তে জাগিয়ে তুলছে। বুবু ঠিক নাম দিয়েছে নেলির। কি মিষ্টি নাম সখি! বুবুর সখি তবে সাবেরের কেন নয়? প্রথম থেকেই ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল সাবের। কিন্তু ও কিভাবে যেন মনের এতো কাছে চলে এসেছে সাবের নিজেই জানেনা।
সাবেরর বুকটা কেমন ভারী হয়ে আছে। অনেক দিন পর সেই ছোট বেলার মতো বুবুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
**********
রাতের খাওয়ার পর কামাল সাহেব সবাইকে নিয়ে বসলেন।
কোন ভনিতা না করে ছেলেদের বললেন- দেখ তোমাদের যার যার সংসার হয়েছে এখন তোমাদের মা-বাবাকে প্রয়োজন নেই। তোমার মা আর আমি ঠিক করেছি মেহেরকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাব।
সাবের বিষন্ন গলায় বলল- বাবা, এটা ঠিক না। মা-বাবা তো সন্তানের আত্মার সাথে মিশে থাকে।
– তোমার কথা শুনে খুশি হতাম সাবের, যদি তুমি নিজের দিকে তাকাতে আগে। আত্মার সাথে মিশে থাকার কথা বললে? বলতে পারবে আমি রাতে কখন খাই, কখন ঘুমাই?
– বাবা, তুমি তো জান আমি রাতে দেরি করে বাসায় আসি। এসে দেখি তোমরা ঘুমিয়ে গেছ।
– কেন দেরি করে আস? কি কাজ কর তুমি? ইচ্ছে করেই তুমি এমন কর। এসব করে নিজের জীবনকে কোথায় দাড় করিয়েছো সেই খেয়াল আছে?
সাবের চুপ করে রইলো।
তিনি আরও বললেন – সব তোমার দায়িত্ব এড়ানোর অজুহাত।
আবেদ বলল- বাবা, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আসলে নানান ব্যস্ততায় তোমাদের দিকে খেয়াল করা হয়না কিন্তু তোমাদের দু’জনকে ছাড়া এই বাড়ি অচল।
কামাল সাহেব ম্লান হাসলেন।
বললেন – দেখলে তো কাছে থেকেও সম্পর্ক কতো দূরের হয়ে যায়।
– বাবা মেহের সব সময় ডাক্তারের ট্রিটমেন্টে আছে ওকে নিয়ে গ্রামে চলে যাবে এটা কেমন কথা?
-কিন্তু মেহের এমন অবস্থায় আছে ওকে ফেলে রেখে মরতেও আমার ভয় লাগবে, আল্লাহ মাফ করুন এমন কথা আমাকে বলতে হচ্ছে।
আবেদ কিছু বলতে যাচ্ছিলো।
তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন – আমার যা বলার তা বলা হয়ে গেছে এর আর অন্যথা হবেনা।
আমি উঠছি ঘুমানোর সময় হলো আমার।
কামাল সাহেব উঠে পড়লেন, সেলিনাও সাথে গেলেন।
ঘরের সবাই চুপ করে রইলো।
মিথি ভাবলো কি এমন হয়েছে যে বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে। মেহেরকে এসাইলামে দিলেই হয়। আজাইরা দরদ পাগলের জন্য। আজ প্রায় ওকে মেরেই ফেলছিলো।
মিথি বললো – তোমরা সবাই মনে হয় আমাকেই দায়ী করছো আজকের ঘটনার জন্য।
সাবের বলে উঠলো – মনে হয় আবার কি তুমি তো বুবুকে দেখতেই পারোনা।
– সাবের তুমি কিন্তু সব সময়ই সীমা ছাড়িয়ে কথা বলো।
– আর তুমি সীমা ছাড়িয়ে অকাজ করো, পাষন্ড মহিলা। আজ যদি বুবুকে চলে যেতে হয় তার জন্য তুমিই দায়ী।
মিথি এবার আবেদের দিকে তাঁকিয়ে বললো – দেখলে তোমার ভাইয়ের ব্যবহার? এ বাড়ির কোন মানুষটা সুস্থ বলো তুমি? কারোর যেতে হবেনা আমিই চলে যাব এখান থেকে।
আবেদ বললো – তোরা থামবি এবার? কি বাজে ঝগড়া শুরু করলি? বাবা-মায়ের রাগটা আগে ভাঙা।
নেলি চুপ করে সব কথা শুনছিলো সে বললো – মা-বাবারা সন্তানের উপর রাগ করলেও সেটা ধরে রাখেন না। ভাইয়া, জানি বুবুকে সবাই ভালোবাসেন, তবে আর একটু সহনশীল হতে হবে বুবুর প্রতি।
আবেদ বললো- মেহের এমন আচরণ করে মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।
– ভাইয়া, বুবু আমাদের জন্য আল্লাহপাকের তরফ থেকে একটা পরীক্ষা, আমাদের জন্য অনেক বড় নিয়ামতও।
– তা ঠিক।
– বুবু ইচ্ছে করে এমন করেনা, এটাই তার অসুখ। আমাদের বুঝতে হবে সেটা।
মিথি ব্যাঙ্গ করে বললো। – আচ্ছা তুমি মেহেরজানের সব ঢং সহ্য করে আল্লাহপাকের সব নিয়ামত নিয়ে নাও, আমরাও চেষ্টা করবো ওর ঢংয়ের সাথে মানিয়ে নিতে। মেহেরজান তো আবার তোমার সাথে সখি পাতিয়েছে।
নেলি অসহায়ভাবে সাবেরের দিকে তাকালো।
সাবেরের চোখে একইসাথে বিষ্ময়, মুগ্ধতা আর কৃতজ্ঞতার ছোঁয়া।
আবেদ বললো – আমি নেলির সাথে একমত।
আমার বোন এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তার মনে আরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। ও আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।
– বাবাকে বুঝাতে হবে, যা একরোখা মানুষ। সাবের বললো।
নেলি বললো – ভাইয়া, মা-বাবার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হচ্ছে বুবু। বুবুকে সবাই যদি একটু যত্ন, একটু আদর করেন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আবেদ ধরা গলায় বললো – আমরা নিজেদের নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম সত্যিই শেষ কবে মেহেরের সাথে গল্প করেছি মনে নেই। অথচ আমাদের মনোযোগ ওর বেশি দরকার।
মিথির ঘুম পাচ্ছিলো। সে বললো – আমি উঠছি, ঘুম পাচ্ছে। আবেদকে রেখেই সে উঠে পড়লো।
সাবের একবার ভাবলো ভাবিকে দু’টো কড়া কথা শুনিয়ে দেয়। কি ভেবে সেটা আর করলোনা।
কিছু কিছু ঘটনা অনভিপ্রেত হলেও ঘুমন্ত অনুভূতিতে টোকা দেয়। আজকের ঘটনাটি সেই রকমই। সাবেরের ঘুমন্ত অনুভূতি জেগে উঠেছে।
জীবনের সুখগুলো বারবার ধরা দেয়না।
ধরা দেয়া সুখকে পায়ে মাড়ানোর মত বোকামি সে আর করবেনা। আগামীকাল সকালে মা-বাবার পা ধরে বসে থাকবে সে। যেভাবেই হোক বাবার রাগ ভাঙাতে হবে।
আবেদ বললো – আমি একটু মেহের কে দেখে আসি
আবেদের আজ মন কেমন কেমন লাগছে কতো দিন ছোট বোনটার সাথে ভালো করে কথা হয়না।
মেহেরের ঘরে যেয়ে দেখলো মেহের শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। আবেদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো। তার বুকের ভেতর চিনচিন করতে লাগলো।
তার সুস্থ বোনটা কিভাবে হুট করে অসুস্থ হয়ে গেলো। মানুষের ব্রেন কি জটিল একটা জিনিস!
একটু এদিক সেদিক হলেই সর্বনাশ হয়ে যায়।
মেহের আবেদকে দেখে উঠে বসলো।
একদম সুস্থ মানুষের মতো বললো – ভাইয়া, ইউটিউবে পুরানো মুভি দেখছি দেখবে নাকি?
– কি মুভি রে?
– সান ফ্লাওয়ার, সুফিয়া লোরেনের। কি অসাধারণ মুভি। শেষ সিনটা আমি সহ্য করতে পারিনা। চোখে পানি চলে আসে।
– কষ্টের মুভি আমি দেখিনা, হাসির মুভি হলে দেখতে পারি।
– আচ্ছা, তাহলে মিস্টার বিন দেই?
– এখন মুভি দেখবোনা।
– তাহলে আমাকে কি বলতে এসেছো বলে চলে যাও। তোমার বউ আবার কথা শুনাবে।
আবেদ হেসে ফেললো। মেহেরজানের এই স্বাভাবিক আচরণ দেখে মিথি ভাবে ওর অসুখটা হয়তো ঢং।
– বলতে এসেছি, বাসায় কোন আনন্দ নাই, কেমন মেন্দা মারা আবহাওয়া। একটা কিছু কর যেন সবাই মিলে একটু আনন্দ করতে পারি।
– হ্যাঁ, আসলেই তো অনেক দিন আনন্দ করা হয়না।এর জন্য সাবের দায়ী। আমার সখিকে সে খুব কষ্ট দেয়। কেন দেয় জানো?
– জানিনা তো।
– ভালোবাসে বলেই কষ্ট দেয়।
– কি বইয়ের ভাষায় কথা বলিস!
– আমি জানি, জানি। বলেই মেহের মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
আবেদ আর ওকে ঘাটালোনা। বোনের মাথায় হাত রেখে বললো – তোর অনেক বুদ্ধি। কতো কিছু বুঝে ফেলিস যা হয়তো সাবের নিজেই বুঝেনা।
– তুমি ঘুমাতে যাও ভাইয়া, আমি ভেবে বের করি আনন্দের জন্য কি করা যায়।
**************
আজ প্রিয়ংবদা বাড়িটায় বেশ উৎসব উৎসব ভাব।
প্রথমে কথা ছিলো সাবের সবাইকে বাইরে খাওয়াবে।
মেহেরজান ভেবে বের করেছে ছাদে বারবিকিউ পার্টি হবে। আজকাল সবাই কতো রকম পার্টি করে। তাদের বাড়িতেই কিছু হয়না।
আজ রান্না থেকে মাকে ছুটি দেয়া হবে।
সবাই মিলে রান্না করবে।
মেনু হল চিকেন বারবিকিউ এর সাথে পোলাও, মাছের কাবাব, খাসির মাংস। ডেজার্টে থাকবে ঘরে পাতা টক মিষ্টি দই।
মিথি বললো – বারবিকিউ এর সাথে নান খায় মানুষ পোলাও খায়না।
আবেদ বললো – মানুষ যা খুশি খাক, আমরা পোলাও খাবো।
অনেক বছর পর সেলিনার আজ খুব ভালো লাগছে। মেহেরজানের জন্য তার যে ভাবনা ছিলো নেলি তার অনেকটাই দূর করেছে।
তিনি দূর থেকে রান্নার তদারকি করছিলেন।
কামাল সাহেব বললেন – ছেলেমেয়েরা কি রাঁধতে কি রাঁধবে শেষে অখাদ্য হবে। যাওনা তুমি একটু দেখ।
– একদিন অখাদ্যই খাওনা। আজ আমার ছুটি। সেলিনা রেগে বললেন।
কামাল সাহেব আর কথা বাড়ালেন না।
তার বড় ভালো লাগছে। বাড়িটা যেন বিষন্নতা কাটিয়ে ঝলমল করছে। হয়তো এটা সাময়িক আনন্দ। তবুও হোক না কিছু আনন্দ।
জীবনে হতাশা, গ্লানি, কষ্ট, ক্লেদ যেমন আছে তেমনি সুখ, আনন্দও আছে।
মেঘের আড়ালে সূর্য হাসি মুখে লুকিয়ে থাকে।
সূর্যের হাসি মুখ দেখার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।
কামাল সাহেবও অপেক্ষা করবেন।
সাবের আজ বাসা থেকে বের হয়নি। মেহেরজানের কড়া হুকুম। সাবেরের ঘাড়ে দায়িত্ব পড়েছে মাছের কাঁটা বেছে কাবাবের জন্য রেডি করা। এটা যে এতো কঠিন কাজ, তার জানা ছিলোনা। তার খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে। নেলিও আশেপাশে নেই, তাহলে ওর উপর ঝামেলা দিয়ে সে কেটে পড়তে পারতো। নেলি আনুর মায়ের সাথে মুরগী কাটছে।
মিঠু তার পাশে ঘুরঘুর করছিলো।
সাবের বললো – যা তো বাবা, হাত ধুয়ে এসে মাছের কাঁটা বেছে দেখ খুবই মজার কাজ।
মিঠু গম্ভীর হয়ে বললো – আমি কাঁটা বাছতে পারিনা।
সাবেরের আর কিছু করার নেই সে বিরক্ত হয়ে মাছ থেকে কাঁটা আলাদা করতে লাগলো।
*********
রাত গভীর হওয়ার পর সবাই ঘুমুতে চলে গেছে।
শুধু মেহেরজান তার অভ্যাস মতো জেগে রইলো।
নেলির কেনো যেনো ঘুম চটে গেছে।
সে বারান্দায় বসে রইলো।
সাবের হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
আজ রাতে মনে হয় ঘুম আসবেনা।
নেলির মন কেমন হাহাকার করে উঠলো।
খুব মায়ের কথা মনে হচ্ছে।
বেলিটার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।
মা না জানি কত চিন্তা করে বেলিকে নিয়ে।
বেলিরও একদিন সংসার হবে। অচেনা, অজানা মানুষদের সাথে থাকতে হবে। সেখানে যদি ঘরের মানুষটাই পরের মতো ব্যবহার করে তখন কি যে কষ্ট হয়। নেলির মন খারাপ ভাবটা আরও ভারী হলো।
রাত বাড়ার সাথে সাথে কেমন রহস্যময় আঁধার ঘিরে আছে চারপাশটাকে।
সেই আঁধারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নেলির মনে হলো তার এইটুকু জীবনে মানিয়ে চলতে চলতে ক্লান্তি এসে গেছে। বুবুই ভালো আছে। নিজের এক জগতে নিজেই রানী।
নেলির পাশে এসে সাবের দাঁড়ালো। নেলিকে তার কিছু কথা বলার ছিলো। তার মনে হলো আজকে যদি কথাগুলো বলা না হয় তাহলে হয়তো আর বলা হবেনা। কিছু কিছু কথা বলার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয়। আজ যেন সেই পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সাবেরের কিছুটা দ্বিধা লাগছে। বিয়ের পর থেকে নেলি তার খারাপ মেজাজই দেখেছে।
সে কিভাবে শুরু করবে ভাবছিল।
নেলি সাবেরকে দেখে অবাক হলোনা।
বললো – জেগে আছো এখনো?
সাবের বললো – পাশের একজন যদি জেগে থাকে তাহলে কি ঘুম আসে?
– আমি তো প্রায়ই রাত জাগি, অন্ধকার কেটে কিভাবে দিনের আলো ফুটে সেটা দেখি।
– একদিন আমাকে নিয়েও তো দেখতে পারতে। সাবের কেমন উদাসী গলায় বললো।
– ও বাবা, তোমাকে নিয়ে দেখার উপায় আছে।
তুমি বলতে অন্ধকার কেটে কিভাবে দিনের আলো ফুটে সেটা দেখার কিছু নেই। ফালতু জিনিস।
সাবের হেসে ফেললো।
নেলি অবাক হলো। এ কোন সাবের! হীরে কি কখনো গলে!
– তুমি তো হীরের টুকরো ছেলে, হীরের মতই কঠিন।
– কে বলেছে তোমাকে এসব ফালতু কথা?
নেলি আর বললনা বড় মামী বলেছে। সেটা বললে খুব হাস্যকর শুনাবে।
সে আমতা আমতা করে বললো – আমার মনে হয়েছে।
– তোমার আর কী মনে হয়েছে?
– মনে হয়েছে তুমি আমাকে দেখতে পারনা।
সাবের আবার হাসলো।
– তোমার সম্পর্কে আমার কি মনে হয়েছে শুনবে?
নেলির খুব শুনতে ইচ্ছে করছিলো তবুও সে চুপ করে রইলো।
সাবের বললো- আমার মনে হয়েছে এই মেয়েটা বুবুর সখি, কিন্তু আমার সখি কেন হচ্ছেনা।
নেলি কেঁপে উঠল আবেগে। সাবের হালকা করে নেলির চিবুক ধরে বললো – আজ আমরা দু’জন একসাথে ভোর হওয়া দেখবো। তুমি একটু বস, আমি দু’ কাপ কফি বানিয়ে আনি।
নেলি বসে আছে। সাবের গেছে কফি বানাতে। তার যদিও খুব ইচ্ছে করছে সাবেরের পাশে যেয়ে কফি বানানো দেখতে। আবার অপেক্ষা করতেও ভালো লাগছে। একই সাথে দু’রকম ইচ্ছে কেবল মানুষেরই হয়। রাতের অন্ধকার আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে।
সাবের আসছে, তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
নেলি বসে আছে, ভালোবাসার অপেক্ষায়। যে ভালোবাসার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করা যায়।
সমাপ্ত।