মনের_ক্যানভাসে-০৩,০৪

0
469

#মনের_ক্যানভাসে-০৩,০৪
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩.
____________

ঘড়িতে সময় দুপুর দেড়টা। জানালা থেকে সূর্যের রঙিন আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। কিছু আলো এসে পড়েছে দেয়ালে টাঙ্গানো রাশেদ ভাইয়ের বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটায়। উজ্জ্বল মুখখানির উপর রোদের আলো যেন ঝলমল করছে। দৃষ্টি থমকালো সেই সুদর্শন মুখখানির উপর। কে বলবে এই অতিব সুদর্শন ছেলেটা এমন ছন্নছাড়া? হতাশ চিত্তে কাজে হাত লাগালাম। পড়ে থাকা শেষ শার্টটা ভাজ করে কাবার্ডে তুলতেই ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো রাশেদ ভাই। তার পরিহিত ধূসর রঙের গেঞ্জিটার অনেকাংশই পানিতে ভিজে গেছে। চুল থেকে টুপটাপ জলকণা ঝরে ভিজিয়ে দিচ্ছে পরিহিত পোশাক। কপালে থাকা জলরাশি গুলো সূর্যের আলোয় মুক্তোর মতো জ্বলছে। এই মুহূর্তে সময়টা থেমে গেলে কেমন হতো? কে-ড্রামার মতো যদি এই মুহূর্তে আমি সময়কে কন্ট্রোল করতে পারতাম তবে অবশ্যই এই সময়কে থমকে দিতাম। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতাম রাশেদ ভাইয়ের কপালের মুক্ত দানাগুলোকে। হঠাৎ করেই হাতে থাকা টাওয়ালটা আমার দিকে ছুড়ে মেরে বেডে ধুপ করে বসে পড়লো রাশেদ ভাই। হঠাৎ এমন হওয়ায় প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমার রেগে যাওয়ার কথা ছিল। রেগে দু চারটা কথা শুনিয়ে দরজা ধুপ করে আটকে এখান থেকে প্রস্তান নেওয়ার কথা ছিল। আমার জন্য এগুলো অতিব সাধারণ ছিল। কিন্তু আমি তেমন কিছুই করলাম না। রাশেদ ভাই অবাক হলেন বুঝি। আমার দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকালেন। বুঝতে চাইলেন বোধহয় আমার পদক্ষেপ। আমি তখনও নিষ্পলক তাকিয়ে। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত ও হলেন বোধহয়। পরিবেশ ঠিক করতে সে সবসময়ের মতো দুষ্টু হেসে আমাকে লজ্জায় ফেলতে বললেন,’ তোকে বউ বউ লাগছে মিনি। খুব শীঘ্রই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আর কতদিন আমাদের ঘাড়ের উপর থাকবি?’

আমি কোনো প্রতিউত্তর করলাম না। আমাকে চুপ দেখে রাশেদ ভাই আবারো অবাক হলেন। আজ যেন তার অবাক হওয়ার দিন। কিন্তু আমি তাকে আরো অবাক করে দিয়ে টাওয়েল হাতে এগিয়ে এলাম। আলতো হাতে অগোছালো ভেজা চুলগুলোকে মুছে দিলাম। রাশেদ ভাই কিছু বলতে চেয়েছিলেন বোধহয়। কিন্তু পারলেন না। শান্ত নিশ্চল চোখে কেবল দেখে গেলেন আমার কাজ। আমি তার সে শীতল দৃষ্টিতেও দৃষ্টি মিলিয়েছিলাম। কেন করেছিলাম জানিনা। তবে ঐ দৃষ্টি আমার মনের দুয়ারে কড়া নেড়েছে প্রবল ভাবে। চুল মোছা শেষ হতেই রাশেদ ভাই ব্যস্ত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এভাবে চলে যাওয়ার কারণ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে নিজের করা কাজের জন্য নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলাম। সাথে একঝাঁক লজ্জাও জায়গা করে নিলো মুখশ্রীতে। আর দেরী করলাম না। কাউকে না জানিয়েই বাসায় ফিরে এলাম। এরপর টানা দুদিন আমি খাওয়া ছাড়া রুমের বাহির হইনি। অনুভূতি এমন যেন বাহির হলেই সকলে আমার লজ্জার কারণ বুঝে নিবে। সকলের দৃষ্টি থেকে লজ্জাকে লুকিয়ে রাখতে নিজেকে পুরোপুরি আড়াল করে নিয়েছিলাম দুদিন। কিন্তু আমার করা এ কাজটা বিশাল এক ঝামেলা বয়ে আনলো। হঠাৎ এভাবে নিজেকে আড়াল করায় মা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি ভেবে বসেছেন নিশ্চই প্রেমে বিরহ জনিত কারণে আমি এমন আচরণ করছি। একমাত্র মেয়ে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দেবদাসি হয়ে যাচ্ছে মা হয়ে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। মা হয়ে মেয়ের কষ্ট সে কিভাবে সহ্য করবে? ইতিমধ্যে মায়ের কল পেয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ছোট মামা ছুটে এসেছেন। রাশেদ ভাইয়েরা সকলেও সকাল সকাল এসে উপস্থিত হয়েছেন। বাবা কাজের সূত্রে নারায়ণগঞ্জ অবস্থান করছেন। কাজ ফেলে ছুটে আসা তার সম্ভব হয়নি। তবে মিনিটে মিনিটে কল করে আপডেট জেনে নিচ্ছেন। কি একটা বাজে অবস্থা। বর্তমানে আমি লিভিং রুমে আসামির ন্যায় সকলের সামনে বসে আছি। কাকা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। চোখে মুখে গম্ভীরতা বিরাজমান। তার পরিবারের মেয়ে প্রেম জনিত কারণে পাগলাটে আচরণ করছে এটা তার কাছে খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। মা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মুখে আচল গুজে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। পাশেই কাকিমা দাঁড়িয়ে মাকে শান্ত হতে বলছেন। সোফার একপাশে রাশেদ ভাই বসে ফোনে ভিডিও গেম খেলছেন। এই মানুষটার যেন কোনো কিছুতেই মন নেই। সে তো নিজের দুনিয়ার মানুষ। এ দুনিয়ার খোঁজ রাখার সময় কোথায় তার? তাকে দেখা মাত্র এক সুন্দরী রমনীর বুকে বেজে ওঠা দামামার শব্দ কি সে শুনতে পাচ্ছে? সে কি জানে এই দুটোদিন তাকে দেখার জন্য মোন কতটা ব্যাকুল হয়েছিলো? না! সে জানেনা। জানার কথাও না। হঠাৎ-ই মন ভিষণ খারাপ হলো। শ্রাবণের মেঘের মতো একরাশ কালো মেঘ ঘিরে ধরলো আমায়। বুকে কোথায় একটা সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। মোন ভাঙার তীব্র কষ্ট অনুভব করতে পারছি যেন। ভেজা নয়ন ঘুরিয়ে তাকালাম মানুষটার দিকে। কতটা নিশ্চিন্তে বসে গেম খেলছে! মানুষটা কি কখনো সত্যিই আমার অনুভূতিকে বুঝবে?

‘হ্যা রে আমার ভাগ্নি হয়ে কিনা তুই সেকা খেয়া বেকা হয়ে বসে আছিস? আমার ভাগ্নিকে হতে হবে স্ট্রং। শ খানেক ছেলেকে একসাথে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে না পারলে সুন্দরী হওয়াই বেকার। আর তুই? আমার সম্মানটাতো রাখবি নাকি?’

কৌতুহল দমাতে না পেরে অবশেষে ছোটমামা মুখ খুলল। আমি গোলগাল চোখে মামার দিকে তাকালাম। মামাও যেন নিজের ভুল বুঝতে পারলো। তৎক্ষণাৎ সে টেবিলে থাকা পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে দু চামচ পায়েস মুখে পুরে নিলো। ছোটমামা বেশ রশিক মানুষ। অল্প বয়স হওয়ায় মামার সাথে আমার বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তবে ভুল সময়ে ভুল কথা বলার বাজে রকম অভ্যাস রয়েছে মামার। এ কারণে বাবার সাথে মামার খুব একটা মেলেনা। সাপে নেউলে সম্পর্ক তাদের। দুজন সামনাসামনি হলেই তর্ক বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। আজ বাবা নেই বলে পরিবেশ এখনো শান্ত। নয়ত এতক্ষণে হয়তো মামা আমাদের বাড়ির গেটের বাহিরে থাকতো।
কাকা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বুঝলাম এমন পরিস্থিতিতে তিনি প্রস্তান নিতে চান। তাই কাকা কিছু বলার পূর্বেই আমি মুখ থেকে আওয়াজ ছাড়লাম।

‘অযথা তোমরা কথা বাড়াচ্ছো। তোমরা যেমনটা ভাবছো তেমন কিছুই হয়নি। আমার সামনে এক্সাম। তাই নিজেকে পড়াশোনার মাঝে ব্যস্ত রাখছি। ব্যাস এটুকুই।’

এতক্ষণে মায়ের কান্না থামলো। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নাক টেনে জানতে চাইল,’দরজা কেন বন্ধ করে ছিলি? এমনটা আর কখনো করবি না।’

আমি মেনে নিলাম। কাকা তখনি বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। বাজারে তার চালের গোডাউন আছে দুটো। ব্যাবসা খুব ভালো হয়। কাকার বয়স হয়েছে। একা সামলাতে কষ্ট হয়। রাশেদ ভাইকে অনেকবার বলেছে দায়িত্ব নিতে। কিন্তু সে কিছুতেই এ দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। এসব ব্যাবসায় তার আগ্রহ নেই। সে তো মুক্ত পাখির মতো ছুটতে চায়। দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে নিলে কি আর ছুটতে পারবে? তার এমন ছন্নছাড়া কাজের জন্য কাকা তাকে দু মাস হাত খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু তাতে লাভের কিছুই হয়নি। বরং কাকার নাক কাটা গেছে। রাশেদ ভাই কাকার পরিচিত লোকদের কাছ থেকে কাকার নাম করে নিজের হাত খরচের টাকা ধার হিসেবে নিয়ে নিয়েছিলো। এরপর কাকা আর কখনো এ ব্যাপারে রাশেদ ভাইয়ের সাথে কথা বলেননি। পড়াশোনাটাও ছেড়েছে আজ কিছুদিন হলো। এসব পড়াশোনা তার আর ভালো লাগে না। এটা একটা বাড়তি প্যারা। তার মতো বুদ্ধিমান মানুষ এমন বাড়তি ঝামেলা কেন বহন করবে? কোনো প্রশ্নই আসে না। এমন ছন্নছাড়া, কেয়ারলেস মানুষটাকে কি করে মনে জায়গা দিলাম ভাবতেই রাগ হয়। এই মানুষটা কি আদেও ভালোবাসার যোগ্য?

চলবে……..

#মনের_ক্যানভাসে

#লাবিবা_আল_তাসফি

৪.

——————

টিমটিম সন্ধ্যা তারা জ্বলছে আকাশে। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়েছে। কিছু সময় পরপর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে যেন সে। ছাদে দাঁড়িয়ে চাঁদ মামার হাইড এন্ড সিক খেলা দেখছিলাম। ঠিক তখনি আগমন ঘটলো রাশেদ ভাইয়ের। নিঃশব্দে আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে একইভাবে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। আমি না তাকিয়েও বুঝে নিয়েছি মানুষটাকে। তার গায়ের কড়া পারফিউম নাকে এসে ঠেকছে। পারফিউমটা বেশ মিষ্টি। কেমন মাতাল করা ঘ্রাণ।

‘মিনি?’

‘হুম’

‘চকলেট খাবি? বেশ টক। একদম তোর মতো।’

রাশেদ ভাইয়ের কথা শুনে হাসলাম। সবাই সবাইকে মিষ্টি, ফুল এসবের সাথে তুলনা করে। সে আমায় টক উপমা দিল। কিন্তু এতেও আমি বেশ খুশি। যদিও টকটা আমার একদমই পছন্দ না কিন্তু রাশেদ ভাইয়ের পছন্দ। তাই তার দেওয়া এই উপমাটাও আমার পছন্দ হলো।

‘মিনি?’

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে তার দিকে ঘুরে দাড়ালাম। রাশেদ ভাইয়ের দৃষ্টি আমার দিকেই। কেমন অদ্ভুত ঠেকলো সে দৃষ্টি। আমি সে দৃষ্টিতে তাকাতেই রাশেদ ভাই যেন চমকে উঠলেন। কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে যেমনটা ঠিক তেমন ভাবে। কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপটে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে বললেন,

‘ তোর যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে আমাকে বলতে পারিস। এভাবে দরজা বন্ধ করে বসে থেকে বাকি সবাইকে চিন্তায় ফেলার কোনো মানে হয়না। প্রেম ঘটিত ব্যাপার হলেও বলতে পারিস। ভয়ের কিছু নেই। সমাধান করার চেষ্টা করবো।’

একবারে এতটা বলে নিঃশ্বাস ছাড়লো রাশেদ। কোনো অজানা কারণে বুকের ভিতর তীব্র এক অস্বস্থি দানা বেঁধেছে। পা দূটো কাঁপছে অস্বাভাবিক ভাবে। যেন দাঁড়িয়ে থাকতে অক্ষম তারা। বিশ্রাম চাই তাদের। রাশেদ আর দাঁড়াল না। আর না দ্বিতীয়বার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর দিকে তাকানোর সাহস করলো। অগোছালো এলোমেলো পায়ে এক প্রকার পালিয়ে এলো ছাদ থেকে।

——————

ঝমঝমে বৃষ্টি থেমে এসেছে প্রায়। থেমে থেমে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য দাড়িয়ে আছি। এক ঘন্টার মতো হলো তবুও কোনো রিকশার হদিস নেই। বৃষ্টির সময় এই একটা সমস্যা। রিকশার দেখা মেলা দায়। দু একটা যা দেখতে পাওয়া যায় তাদের চাহিদা আকাশ সমান। ন্যায্য ভাড়ায় রিকশা পাওয়া আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমান।

কলেজের সামনের চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে মিতালির বিরক্ত হওয়া দেখছিল রাশেদ। তার মতে মেয়েদের সব থেকে সুন্দর লাগে যখন তারা রেগে যায় কিংবা কপাল কুঁচকে চোখ মুখ গম্ভীর করে রাখে তখন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখার মধ্যে আলাদা রকম প্রশান্তি রয়েছে। চার নম্বর চায়ের কাপে শেষ চুমুক বসিয়ে উঠে দাঁড়ালো রাশেদ। দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি হেসে বলল,

‘মামা খুচরা টাকা নেই সাথে। হিসাবের খাতায় তুলে রাখেন। মাসের শেষে বাপ দিয়ে যাবে টাকা।’

দোকানদার লোকটাও লাল দাঁত বের করে হাসলেন। চার কাপের জায়গায় সে পাঁচ কাপ চায়ের দাম খাতায় তুলে রাখলেন। এভাবে আরো কয়েক কাপ বাড়িয়ে লিখলে মাস শেষে বেশ টাকা লাভ হবে। রাশেদ আড়চোখে সবটাই দেখলো। কিন্তু কিছু বললো না। কথায় আছে চোরের দশ দিন গৃহস্থের একদিন। একদিন ঠিক এর কারসাজি ধরে আচ্ছা মতো টাইট দেওয়া যাবে।

রিকশার জন্য দাড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজেই বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা করলাম। ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিত হবে রাশেদ ভাই তার বিখ্যাত বাইক নিয়ে হাজির হলেন সামনে। ব্যাপারটা আমার অনেকটা বাংলা সিনেমার মতো মনে হলো। কিছু সময়ের জন্য নিজেকে বাংলা সিনেমার নাইকা ভেবে লাজুক দৃষ্টি নিয়ে রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। কিন্তু তাকানো মাত্রই রাশেদ ভাইকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রত হলাম। মুখ খুলে কিছু বলতে নিব তার পূর্বেই রাশেদকে বললেন,

‘উঠে বস। নামিয়ে দিয়ে আসছি। আর ভুলেও আমাকে তোর হিরো ভেবে জড়িয়ে ধরবি না। তাহলে লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দিবো। কাঁধে হাত রেখে শক্ত করে বোস।’

মোন খারাপ হলো বেশ। এভাবে বলল? আমি কি একবারও তাকে বলেছি আমাকে পৌঁছে দিতে? নিজেই তো এলো। এখন আবার হুমকিও দিচ্ছে। ভাবনার মাঝেই আবারো রাশেদ ভাই ধমক দিলেন। ভাবনা বাদ দিয়ে চুপচাপ বাইকে উঠে বসলাম। খুব সতর্কতার সাথে তার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসেছি। মনে মনে বললাম,’একান্তই ঠেকেছি বলে বাইকে উঠলাম। নয়তো আপনার বাইকে উঠতে আমার বয়েই গেছে।’

_____________

নাজিয়া বেগম ব্যস্ততার সাথে চুলায় চা চাপিয়েছেন। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে প্লেটে সাজিয়েছেন। মিতালির জন্য সম্বন্ধ এসেছে। বেশ বড় বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। পাত্র ও শিক্ষিত। তাছাড়া মেয়ের ও বিয়ের বয়স হয়েছে। ভালো পাত্র হাতে থাকতে দেড়ি করবার কি আছে? চাহিদা থাকতে মেয়েকে সুপাত্রের হাতে তুলে দিলে চিন্তামুক্ত। সব মায়েরাই চায় মেয়েকে ভালো পরিবার দেখে বিয়ে দিতে। নাজিয়া বেগম ও তার বিপরীতে নয়।

বাড়ি ফিরতেই মাহিন মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আমার রুমে হাজির। আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে জামাকাপড় হাতে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললাম,’আমি মিষ্টি খাব না। আমার ভাগেরটা তুই খেয়ে নে। এখন রুম থেকে দূর হ।’

পড়নের কাপড় রাস্তায় জমে থাকা পানির ফলে অনেকাংশ ভিজে গেছে। অল্প সময়ের মাঝেই গোসল শেষ করে বের হলাম। মাহিন আমার রুমের খাটের উপর বসে মিষ্টির প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করে দেখছে খুব মনোযোগ সহকারে। চুলের পানি মুছতে মুছতে ওর পাশে বসলাম।

‘এখনো এখানে বসে আছিস কেন?’

আমার কন্ঠ শুনতেই মাহিন লাফ দিয়ে ওর হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি চোখ কুঁচকে তাকাতেই সামনের ফাঁকা মাড়ি বের করে হাসলো।

‘তোমার বিয়ের মিষ্টি তাই তোমাকে খেতে দিলাম। নয়তো সবকটা আমি খেয়ে নিতাম।’

ওর কথা বুঝতে না পেরে আমি বোকা মুখ করে তাকালাম। ও এবার লাফ দিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। আস্তে আস্তে আমার কানের কাছে এসে বলল,

‘আজ তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। ইয়ে বড় বাড়ি থেকে। মা বলেছে তারা অনেক বড়লোক। তোমাকে জানাতে মানা করছে। কিন্তু তাও বললাম। তুমি আবার মা কে বইল না।’

আমি কোনো কথা বললাম না। চুপচাপ উঠে জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। অসহায় লাগছে নিজেকে। এ বিয়েটা যে আমি করতে পারবো না! কি কি বলবো মাকে? আমি রাশেদভাইকে ভালোবাসি এটা বলবো? কিন্তু তাতেকি কোনো লাভ আছে? রাশেদভাই কি আমায় ভালোবাসে? আমার যে সময় দরকার। সবটা ঠিক করার জন্য সময় দরকার। ঠিক ততটা সময় যতটা সময়ে আমি আমার অনুভূতি তাকে জানাতে পারবো। তার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলতে পারবো ভালোবাসি। ততটা সময় দরকার যতটা সময়ে আমি বুকে সাহস নিয়ে বলতে পারবো চলেন না পালিয়ে যাই! এত বড় পৃথিবীতে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার গড়ার জায়গা ঠিক পেয়ে যাব। ব্যাস এতটুকু সময় হলেই হবে আমার।

___________

রাত আনুমানিক কত হবে হিসাব করা গেল না। চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে মশারা মিছিল নামিয়েছে যেন। সিগারেটের প্যাকেটে থাকা অবশিষ্ট একটা সিগারেট ও শেষ। আরো এক প্যাকেট হলে ভালো হতো। রাশেদ টান টান হয়ে ভেজা ছাদের মাঝেই শুয়ে পড়লো। বুকের ভেতরকার তুফান সামলাতে ব্যর্থ সে। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে নিজেকে সামলাতে হয় তা তার জানা‌নেই। এই প্রথম সে এমন অনুভূতির স্বিকার। আচ্ছা এই অনুভূতির কি কোনো নাম দেওয়া যায়? রাশেদ চোখ বন্ধ করে নিল। বড় করে শ্বাস নিয়ে আনমনে বলল,’মিনি! তুই অন্যকারো হবি ভেবেই কি এই অস্থিরতা?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here