মনের_ক্যানভাসে-০৫,০৬

0
282

#মনের_ক্যানভাসে-০৫,০৬
#লাবিবা_আল_তাসফি

৫.

—————

লাইব্রেরির এককোণে একা বসে হুমায়ূন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাসটি পড়ছি। এই নিয়ে সপ্তমবার আমি উপন্যাসটা পড়লাম। তবুও যেন প্রত্যেক লাইনে থাকে অসীম আগ্রহ। কেন যেন এই উপন্যাসটা আমার ভেতরটা খুব কাঁদায়। উপন্যাসটা পড়তে পড়তে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলাম। ঠিক তখনি কেউ যেন আমার সামনে একটা সাদা রুমাল এগিয়ে দিল। উক্ত ব্যক্তির দিকে তাকাতেই আমি হতভম্ভ, বিমুঢ়। এটা সত্যিই রাশেদ ভাই। তাকে এর আগে কখনো লাইব্রেরিতে দেখা যায়নি। এ যেন অমাবস্যার রাতে চাঁদের দেখা মেলার মতো ঠেকলো। মন আমার তখন আকাশ ছুঁই ছুঁই। এ যেন অন্যরকম ভালোলাগা। বুঝলাম প্রেমে পড়ে মন আমার বড্ড ছেলেমানুষী হয়ে গেছে। এই যে রাশেদভাই আমার চোখের জল মুছতে রুমাল এগিয়ে দিল এ সামান্য ব্যাপারটা আমার হৃদয় নিতে পারছে না। কেমন অস্বাভাবিক ভাবে বুক কাঁপছে। হাত ও কিছুটা কাঁপছে বোধহয়। এ অনুভূতিকে আমি কিভাবে লুকাবো? নিজেকে দেখে উপহাস করতে মন চাচ্ছে। যখন আকাশ কুসুম ভাবনায় বিভোর ছিলাম ঠিক তখনই আমার মাথায় আসলো রাশেদ ভাইতো কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো তবে আজ কেন? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই সে যেন আমার না বলা প্রশ্ন বুঝে নিল। আমার পাশের চেয়ার টেন তাতে গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ রেখেই বলল,

‘তোর বাপ চাচারা বড্ড বিরক্তিকর মিনি। তাদের অত্যাচার আমার উপর দিনকে দিন বেড়েই চলছে। ভেবেছিলাম কোনো একদিকে চলে যাব কিন্তু হাতে টাকা নেই। টাকা গুছানো পর্যন্ত তাই তাদের সহ্য করতে হবে। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করবে তাই ভাবলাম অনার্স টা শেষ করেই ফেলি। সো কলড সার্টিফিকেট ও হবে আর তোর বাপ চাচাদের ভনভন শোনা থেকেও কয়েক ঘন্টার জন্য মুক্তি মিলবে।’

হাহ! এই মানুষটাকে বোঝানোর মতো ভাষা আমার কাছে নেই। যে বুঝেও বুঝতে চায়না তাকে কিভাবে বোঝাবো? আমরা সকলে তার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। কিন্তু এটা বুঝতেই চায়না সে। ইতিমধ্যে লাইব্রেরি রুমে মেয়েদের ভীর জমেছে। যেন মেলা বসেছে এখানে। কয়েকটা মেয়ে বই পড়ার অযুহাতে রাশেদ ভাইয়ের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তারা পড়ছে কম দেখছে বেশি। বিষয়টা আমার হজম হচ্ছে না। সহজ ভাবে বলতে গেলে আমি জ্বলছি। ভিষণ ভাবে জ্বলছি। পড়ার জন্য অন্য কোনো টেবিল নেই? এখানেই কেন বসতে হবে? আমি কোনভাবে রাগ চাপিয়ে রাশেদ ভাইকে বললাম,

‘উঠেন এখানে আপনার কোনো কাজ নেই। ঘুমাতে হলে বাসায় গিয়ে ঘুমান। লাইব্রেরিতে মানুষ পড়তে আসে ঘুমাতে না।’

রাশেদ ভাই চোখ খুলে তাকিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে নিল। এখান থেকে ওঠার ইচ্ছে নেই তার সেটাই বোঝাতে চাইলো। কিন্তু আমি এত সহজে কেন হাল ছেড়ে দিব? এই যে মেয়েগুলো চোখ দিয়ে তাকে গিলে খাচ্ছে এটাতো মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। একজন লয়াল প্রেমিকা হিসেবে আমার দায়িত্ব রাশেদভাইকে এসকল কুনজর থেকে রক্ষা করা। আমি সেটাই করবো। আমি এবার কোন কথা ছাড়া রাশেদ ভাইয়ের হাত ধরে টেনে তুললাম।

‘তোর শরীর ঠিক আছে মিনি? এভাবে হাত ধরে টানাটানি কেন করছিস? কোনো ছেলের হাত ধরে টানাটানি করা মোটেই ভালো লক্ষণ না। হাত ছাড় বলছি।’

বিমর্ষ চোখে রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। লাইব্রেরিতে থাকা সকলে তখন রাশেদ ভাইয়ের কথায় তীব্র হাসিতে ফেটে পরেছে। তীব্র দুঃখ, অপমানে বাক্যহারা হয়ে গেলাম। এমনটা নয় যে এই প্রথম আমি তার হাত ধরলাম। এর আগেও ধরেছি বহুবার। তখনতো এমন বলেনি। আজ কেন এত মানুষের সামনে এভাবে অপদস্থ করলো? কোন কথা ছাড়া বেরিয়ে এলাম। আজ আর কোনো ক্লাস করার মানসিকতা নেই। সোজা কলেজ থেকে বের হয়ে এলাম। রাশেদ ভাইয়ের করা এ সামান্য অপমান আমার মন নিতে পারছে না। ইতিমধ্যে রাশেদ ভাই ও এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।

‘রিকশা ঠিক করে দিব? বাড়ি যাবি?’

‘আমি একাই করে নিব। আপনাকে ভাবতে হবে না।’

আমি আর রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম না। কেন যেন মনে হচ্ছে তার দিকে তাকালেই আমি কেঁদে ফেলবো। কিন্তু তার সামনে আমি কাঁদতে চাইনা। একদমই না। ইতিমধ্যে রাশেদ ভাই একটা রিকশা ঠিক করে তাতে চেপে বসেছেন। রিকশা আমার সামনে এসে থামতেই রাশেদ ভাই হাত বাড়িয়ে দিলেন।

‘উঠে আয়।’

আমার ভিষণ রাগ হলো। ইচ্ছা হলো এই হাতটাকে কেটে ময়লা পানিতে ছুড়ে ফেলতে। কিছুক্ষণ আগে এই হাত ধরা নিয়েই আমায় কথা শুনিয়ে এখন আবার নিজ থেকেই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাজার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি কেন যেন তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। এটাই প্রথম আমার রাশেদ ভাইয়ের সাথে একই রিকশায় ভ্রমন। আকাশ মেঘলা হয়ে এসেছে। বৃষ্টি হলে বেশ ভালো হতো। উপলব্ধি করলাম আমার মন খুব বেশিই ফুরফুরে লাগছে। এমন প্রেমময় পরিবেশে ভালোলাগার মানুষটার সাথে একসাথে রিকশা ভ্রমন আমার প্রেমি হৃদয়কে প্রেমময় বৃষ্টিতে সিক্ত করে তুলছে। আবেশে বন্ধ হয়ে এলো চোখ। উপলব্ধি করলাম সময়টা খুব বেশিই স্পশাল।

বাসায় এসে লম্বা শাওয়ার নিলাম। মা আমাকে সুন্দর দেখতে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি দিয়ে গেছে পড়ার জন্য। শাড়িটা আমার হবু শশুর বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছে। শাড়িটা বেশ সুন্দর। আজ ও বাড়ি থেকে আমায় দেখতে আসবে। শুনেছি ছেলে দেশের বাইরে থাকে। মাস ছয়েক পর দেশে ফিরলে তখন বিয়েটা হবে। এই ছয় মাস ই আমার জন্য যথেষ্ট। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শাড়ি পড়ে হালকা সাজলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই প্রশংসা করলাম। সত্যিই শাড়িটা বেশ মানিয়েছে। ওবাড়ি থেকে লোক আসতে আসতে দুপুর গড়িয়েছে। তারা আবার সন্ধ্যার পরপরই ফিরে গেছেন। সকলে বেশ মিশুক। আমাকে যেন তারা নিজেদের একজন ভেবে নিয়েছেন। আমার বেশ খারাপ লাগছে। এই মানুষগুলো কখনোই আমার পরিবার হতে পারবে না যে! আমার দুনিয়াতো কেবল আমি রাশেদ ভাইকে নিয়ে সাজিয়েছি। যেখানে এই মানুষগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।

______________

এক পশলা বৃষ্টি শেষে পরিবেশ এখন বেশ শিতল। এত ঠান্ডার মাঝেও ফুল স্পিডে ঘু্রে চলছে রাশেদের রুমের বৈদ্যুতিক পাখাটা। অবিরাম ভাবে ঘুরতে থাকা পাখাটার যেন কোনো ক্লান্তি নেই। পাখার ক্যাটক্যাট শব্দ নিশ্চুপ পরিবেশকে ভারী করে তুলছে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে রাশেদ বইয়ের পরবর্তী পাতা উল্টালো। দীর্ঘ দু ঘন্টা যাবত বইয়ের পাতা উল্টে চলছে সে। কোনো ভাবেই বইয়ের মাঝে মনোনিবেশ করতে পারছে না। বারবার ঘুরেফিরে মিতালিতেই যেন মন বাধা পড়ছে। বাস্তবিক ভাবে দেখতে গেলে মিতিলি খুব সাধারণ একটা মেয়ে। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো না হলেও মায়াবি চোখের মায়ায় আটকে পড়াটা খুব স্বাভাবিক। তার থেকেও বড় কথা রাশেদ কখনোই মিতালিকে অন্য নজরে দেখেনি। ছোট থেকেই বড় ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে। কিন্তু কে জানতো এই পরিণত বয়সের মিতালি তার মনে প্রেমের জোয়ার বয়ে আনবে? ব্যাকুল করে তুলবে হৃদয়কে? এক দম বন্ধকর অবস্থায় ফেঁসে আছে সে। কোনো ভাবেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। বুকের ভেতরটা কেমন অশান্ত হয়ে আছে। মাথায় সর্বদা মিতালি নামের মেয়েটা কলরব করে চলছে। রাশেদ চায়না তার মনকে প্রশ্রয় দিতে। মিতালি মেয়েটা ভালো। ওর সুন্দর একটা ভবিষ্যত আছে। তার সাথে মিতালি কখনোই সুখি হবে না‌। সে চায়না তার সাথে জড়িয়ে মিতালির সুন্দর জীবনটাকে ন্ষট করে দিতে। সে বোঝে মিতালির চোখের দৃষ্টি। যা বারবার প্রমাণ করে দেয় তার প্রতি মিতালির দুর্বলতা। সবটা বুঝেও রাশেদ বারবার সে আকুতি ভরা চোখকে অগ্রাহ্য করে চলছে। কিন্তু কতদিন? এরতো একটা শেষ চাই।

চলবে……….

#মনের_ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি

৬.
_____________

দেখতে দেখতে পরীক্ষার ডেট পরে গেল। খাওয়া, গোসল বাদে বাকি সব একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে এসে মনে হচ্ছে দিন চব্বিশ ঘন্টার জায়গায় ছাব্বিশ ঘন্টা হলে বোধহয় বেশ হতো। পড়ার জন্য আরো দু ঘন্টা সময় বেশি পেতাম। রাশেদ নামের ভূতটাকেও আপাতত শিকলবন্দি করে রেখেছি। হয়তো কিছুটা হেংলা পাতলাও হয়েগেছি পরীক্ষার ভারে। মহাযুদ্ধ সংগ্রাম গাধাখাটুনির পর অবশেষে কাদাজল খাইয়ে পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটলো। মাথা থেকে ভারী কোনো বোঝা নেমে যাওয়ার মতোই প্রশান্তি অনুভব হলো। পুরো দুদিন দরজা বন্ধ করে প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি। এবার পালা এলো আমার তাকে চক্ষু দর্শন করার। রাশেদ ভাইকি এ কয়দিনে বদলে গেছে? কিছুটা মোটা হয়েছে নাকি হ্যাংলা? দাড়ি গুলোকি বড় হয়ে দেবদাস টাইপ হয়েছে নাকি সুন্দর কাটিং দ্বারা আবদ্ধ হয়ে আছে? নানান প্রশ্নে জর্জরিত হৃদয় নিয়ে হাজির হলাম রাশেদ ভাইদের বাসায়। ঢোকার পথেই দেখা হলো রাকিবের সাথে। সকাল সকাল ছাতা হাতে কোথাও বের হচ্ছে বোধহয়। ছেলেটা খুব বেশিই ম্যাচিউর। একটুতেই রাশেদ ভাইয়ের মতো রাগে ফেটে পড়ে না। সব পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে ওর। আমাকে দেখতেই মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,

‘ভাইয়াকে খুঁজতে এসেছো? এতদিন ঝগড়া না করতে পেরে নিশ্চই খুব একটা ভালো নেই তুমি সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তুমি ভেতরে যাও আমি বাজার থেকে পপকর্ন নিয়ে আসছি। বেশ জমিয়ে ফাইটিং শো দেখা যাবে কি বলো?’

প্রতিউত্তরে আমি দাঁত বের করে হাসলাম। কারণ রাকিবের বলা কোনো কথাই মিথ্যা নয়।

যতটা আগ্রহ নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম ঠিক ততটাই আঘাত পেলাম যখন দেখলাম ড্রয়িংরুমের সোফায় মিতু‌আপুর কোলে মাথা রেখে রাশেদ ভাই নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে গুনগুনিয়ে গান গাইছে। মিতু আপু কোমল হাতে রাশেদ ভাইয়ের চুলের ভাঁজে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে। এ অধিকার তো কেবল আমার পাওয়ার কথা ছিল। ঐ জায়গাটা আমার থাকার কথা ছিল। কিন্তু তেমনটা হয়নি। যে জায়গার অপেক্ষায় আমি কাঙ্গাল হয়ে আছি সে জায়গাটা আমার হওয়ারই নয়। সেখানেতো অনেক আগে থেকেই অন্য কেউ বসতি গড়েছে। আমিই কেবল বোকার ন্যায় অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। এমন নয় যে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে আমি জানিনা। তাদের সম্পর্কের শুরু থেকে সবটা আমার জানা। শুধু এটাই নয়। রাশেদ ভাইয়ের সব প্রেমিকাদের সম্পর্কেই আমি জানি। কিন্তু তাদের এই সম্পর্ক কখনো হাত ধরার চাইতে গভীরে প্রবেশ করেনি। কেন যেন মনে হচ্ছে রাশেদ ভাইকে এ জীবনে আমার আর পাওয়া হলোনা। আমার প্রথম প্রেম যা এভাবে বিনষ্ট হবে তা কল্পনার বাইরে ছিল। কি বলা বা করা উচিত বুঝতে পারছি না। জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম যেন। আমার সহযত্নে গড়ে তোলা প্রেম, ভালোবাসা কখনোই আমার ছিল না ভাবতেই মন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ। বসন্তের হাওয়ার মতো করেই প্রেম এসেছিল আবার শেভাবেই যেন সব ক্ষণিকেই শেষ হয়ে গেল। কেবল পড়ে রইলো মন ছাড়া দেহ খান। ঘর থেকে নিশ্চুপেই প্রস্তান করলাম। তাদের প্রেমময় বাক্য আর প্রাণখোলা খিলখিল হাসির ধ্বনি এখনো আমার কানে ঝংকারের ন্যায় বাজছে। আগোছালো পায়ে হেঁটে বাড়ির কাছের পার্কের একটা ফাঁকা জায়গায় এসে বসলাম। কোমল সবুজ ঘাসগুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে আছে। সময় কতটা গড়িয়েছে তা জানা নেই। তবে আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। আমি ছাড়া এ পার্কে আর একটি কাক পাখিও নেই। আমি একইভাবে বসে রইলাম। বৃষ্টির পানিতে চোখের জন মুছে যাচ্ছে। চিৎকার করলাম। লুকিয়ে থাকা সব কষ্ট মুছতে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। যার সাক্ষী হলো এই বিস্তার পার্ক আর সবুজ ঘাসগুলো।

সেদিনের পর টানা এক সপ্তাহ তীব্র জ্বরে জ্ঞান হারা হয়ে পড়েছিলাম। সপ্তম দিনের দিন আমার হবু শশুর বাড়ি থেকে লোক এলো আমায় দেখতে। এতদিন পর আসার তীব্র বেদনা প্রকাশ করলেন এক ভদ্র মহিলা। তিনি সম্পর্কে আমার হবু শাশুড়ি। হঠাৎ করেই সে ভাডিও কলে কারো সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এমন পরিস্থিতিতে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। কিছুটা লজ্জাও পেলাম। এই প্রথম আমি আমার হবু বরকে দেখলাম। গায়ের রং সাদা ফর্সা। হালকা চাপদাড়ি ও আছে। মোট কথায় সুদর্শন। চোখ নাক অনেকটা তার মায়ের মতোই। তার নামটাও প্রথম শুনলাম আদনান। এই প্রথমবারের মতোই তার সাথে আমার কথা হলো। প্রথম সাক্ষাতেই লজ্জার মাথা খেয়ে আমি তাকে আবদার করে বসলাম খুব দ্রুত ফিরে আসার জন্য। বিয়েটা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি হওয়া ভালো। আমার এমন কথা শুনে তিনি প্রথমে তাজ্জব হলেও পরক্ষনে হেসে ফেললেন। রসিকতা করে বললেন,

‘আমাকে বোধহয় মিসের খুব বেশিই ভালোলেগেছে! মাত্রতো কয়েক মাসের ব্যাপার। সহ্য করে নিন। আমি দ্রুত ফেরার চেষ্টা করবো।’

এরপর আর কোনো কথা হয়নি। দীর্ঘ সময় দুজন শব্দহীন থাকার পর অবশেষে ওপাশ থেকে আদনান বললেন,

‘আপনাকে ক্লান্ত লাগছে। নিজের যত্ন নিন। খুব শীঘ্রই দেখা হবে। রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।’

টুট টুট শব্দে মোবাইল কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সাথে বিচ্ছিন্ন হলো আমার একরাশ স্বপ্ন যার প্রত্যেকটাকে ঘিরে ছিল রাশেদ ভাই। চোখ থেকে বিনা নেমন্তন্নে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।

___________

এক দুই তিন করে কেটে গেল আরো সাতটি দিন। আমি সারাক্ষন বাসাতেই থাকি। প্রয়োজন ছাড়া রুম থেকে বের হইনা বললেই চলে। বদ্ধ দরজার আড়ালে আমার না পাওয়ার বেদনার আর্তনাদ চাপা রয়ে গেল। কেউ জানতে পারলো না। আর না কেউ বুঝতে পারলো। নিজেকে নিজে শান্তনা দিলাম। বুঝালাম কারো জন্য জুবন থেমে থাকে না। কোনো না কোনো উপায়ে ঠিক জীবন কেটে যাবে। এই মনব্যাথাটাও হয়তো একসময় দায়িত্বের কাছে চাপা পড়ে যাবে। থেকে যাবে কেবল এবং কেবলমাত্র এক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস।

গরম চায়ের কাপে চুমুক বসাতেই কপাল কুঁচকে নিলো রাশেদ। চায়ের কাপ পূর্বের স্থানে রেখে দু ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট গুজে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালালো। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। সব কেমন যেন বিদঘুটে বিস্বাদ। এই তেক্ততায় ভরা জীবন ভালো লাগছে না তার। একটু শান্তি চাই। জীবনের হিসাব মিলাতে গিয়ে রাশেদের অনুভব হলো এ জীবনে সে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। তার পছন্দের কিছুই তার হয়নি। ঐ মেঘাচ্ছন্ন আকাশটার মতোই তার জীবনের সব প্রাপ্তির স্থান শুন্য কালো মেঘে ঢাকা। নিশ্চুপ পরিবেশকে কাঁপিয়ে বিকট শব্দে বেজে উঠলো মুঠোফোনটা। রাশেদের বিরক্ত লাগলো। অলস ভঙ্গিতে পকেট থেকে ফোন বের করতেই ফোনের স্ক্রিনে পরিচিত নামটা দেখে কেন যেন মনে থাকা বিস্বাদ তিক্ততা দূর হয়ে গেল। একচিলতে হাসি খেলে গেল সারা মুখ জুড়ে। ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে পরিচিত কন্ঠের ডাকটা ভেসে আসলো।

‘রাশেদ ভাই?’

রাশেদ উত্তর দিলনা। পরিচিত নারীর প্রাণকাড়া সে ঢাক আরো একবার শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষার প্রহর বাড়তে লাগলো। এক সেকেন্ড দুই সেকেন্ড করে অতিবাহিত হয়ে গেল এক মিনিট। কিন্তু ওপাস থেকে আর কোনো শব্দ এলো না। শোনা গেল কেবল ভারী শ্বাস। রাশেদ মনে মনে কথা সাজিয়ে নিল ওপাশের রমনীর উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার কথা তখর মনেই রয়ে গেল। প্রকাশ করার পূর্বেই বিচ্ছিন্নি হলো সংযোগ। সাথে সাথেই পরিচিত নম্বরে ডায়াল করলো। একবার দুইবার তিনবার কিন্তু প্রত্যেকবার কল বাজতে বাজতে কেটে গেল। চতুর্থবারেরবার ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে কোন মেয়েলি কন্ঠে জানালো তার ডায়ালকৃত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রথান করা সম্ভব নয়। তীব্র রাগে আছড়ে ফেলল ফোনটা। মুহূর্তেই কয়েক খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেল মুঠোফোনটি। রাশেদ উপলদ্ধি করলো মিতালি নামের মেয়েটা খুব করে তাকে অবহেলা করছে। যেমনটা কোন অপ্রয়োজনীয় বস্তুকে হেলা করা হয়। ঠিক সেভাবেই তার থেকে মেয়েটা মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে। এর কারণকি সেই বিদেশে থাকা সুদর্শন পুরুষ? যাকে প্রথম দেখাতেই নারী লাজুকতা ভুলে মিতালি দ্রুত বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে? কোনো ধারালো বস্তু যেন মনে দাগ কেট গেল। বিষন্ন দৃষ্টিতে ছিন্নবিন্ন মুঠোফোনটার দিকে তাকালো রাশেদ। তার নিজেকে ঐ মুঠোফোনের মতোই অপ্রয়োজনীয় অচল বলে মনে হলো।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here