হৃদয়ঙ্গম #পর্ব_২

0
279

#হৃদয়ঙ্গম
#পর্ব_২
#তুষার_আব্দুল্লাহ_রিজভী

“আমার বিয়ের বিষয়ে আলাপ করে ফেললে আর ঠিকও করে ফেললে কিন্তু আমাকে কিছু জানালে না? মতামত নেওয়া প্রয়োজন নিলে না, মা? তাও আমার সম্পর্কে শালি হয় তার সাথে?” পাবেল কথাগুলো বলে থামল। কষ্ট হলেও একবার বড়ো করে শ্বাস নিল। মায়ের স্বভাবটা আজ পাবেলের কাছে নেহাতই ছেলেমানুষী ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।

পাবেলের মা ফাতেমা বেগম তখন কিছুটা দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন, “দেখ বাবা তোর বয়স বেশি না। তোর জীবন তো শেষ হয়ে যায়নি তাই না? এই বয়সে আরেকটা বিয়ে করে সংসারী হো। দেখবি আগের মতো না হোক, হাসি খুশি আর সুখী থাকতে পারবি।”

“দেখো মা, আমার বিয়ে করার কথা তোমাদের ভাবতে হবে না৷ ভাবতে গেলেই বা কেন? তাদেরই বা ‘হ্যাঁ’ বলতে গেলে কেন?”

“আমি কী ইচ্ছে করে ‘হ্যাঁ’ বলেছি? তারা আমাকে সব বুঝিয়ে বলল তাই ভেবে দেখলাম এটাই ঠিক হবে। আর শোন বাবা মা কখনো ছেলে মেয়ের খারাপ চায় না।”

“মা, এসব জ্ঞান দিও না৷ আমার কাছে এসব এখন তুচ্ছ মনে হয়। আর আমার সম্পর্কে সে শালি। সমাজ কী বলবে ভেবে দেখেছো

ফাতেমা বেগম ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললেন, “সমাজ কী বলল সেটা দিয়ে কী করব? সমাজের কথা তোকে ভাবতে হবে না। আমি যেটা বলেছি সেটাই আমার আদেশ। যদি পালন না করিস, আমার ম*রা মুখ দেখবি।”

পাবেল মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে থেকে বেড়িয়ে চলে গেল মায়ের ঘর থেকে। ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন ফাতেমা বেগম। কষ্ট হলেও সব চেপে রাখলেন। এতেই ওর ভালো হবে।

***

পাবেল মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর নিজের বেডরুমে যায়। বিছানায় নিশ্চুপ হয়ে কিছু সময় বসে থাকে। এরপর বেলকনিতে গিয়ে কিছু সময় পায়চারি করে। আজকে পাবেলের মনটা শান্ত করতে পারছে না। চঞ্চল হয়ে আছে। স্বস্তি পাচ্ছে না কিছুতেই।

নন্দিনী এমন সময়, “ভাইয়া, ভাইয়া” বলে রুমপ ঢুকলো পাবেলের। পাবেল ডাক শুনেই বেলকনি থেকে বেরিয়ে চলে আসল নন্দিনীর সামনে।

নন্দিনী জিজ্ঞেস করল, “কি রে ভাইয়া খাবি না? সেই কখন ভাত বেড়ে রেখেছি টেবিলে। আয় তো খেয়ে নিয়ে যা খুশি কর।”

“না রে বোন। খাবো না,” নিচু স্বরে বলল পাবেল।

“জানি তোর মন খারাপ। মায়ের সাথে কথা বলেছি তখন বাহিরেই দাঁড়িয়ে সব শুনেছি। চিন্তা করিস না তো। যা হবে ভালোই হবে।” একটু থেমে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করল নন্দিনী। বলল, “চল খেয়ে নে আগে। এই তো কিছু সময় আগে খেতে চাইলি।”

“মনটাই ভালো লাগছে না। আজকে একটার পর একটা শকড খেয়ে পেট ভরে গেছে,” বলেই বৃথা হাসার চেষ্টা করল পাবেল।

“ভাই!” বড়ো বড়ো চোখে তাকালো পাবেলের দিকে নন্দিনী। “তুই না খেলো আমিও খাব না বলে দিলাম। যত মন খারাপই থাকুক। আগে খাবি পরে সব হবে। বললেই কী বিয়ে হয় নাকি? তোর ভালো না লাগলে করবি না।”

“মায়ের শেষ কথা হয়তো শুনিসনি তাই এমন বলছিস। তার কথা না শুনলে মায়ের ম*রা মুখ দেখব। এটাই আমার সব আশাকে মুছে দেয়।”

“দূর, কিসের এত চিন্তা করিস। এত বড়ো ছেলে হয়েও বড়ো হলি না। মা এমনিতেই কিছুদিন পর পটল তুলবে। তোর জীবন গুছা তুই নিজে। আমি হস্তক্ষেপ করব না। যদি কখনো দেখি বেলাইনে গেছিস, চিনিসই তো আমাকে। চল এবার।”

বলেই পাবেলের হাত ধরে টানতে লাগল নন্দিনী। পাবেল না পেরে বলল, “আচ্ছা যা তুই। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

“আচ্ছা জলদি আয়। গরুর মাংস ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না কিন্তু। আর আমিও আগুনের কাছে যাব না বলে দিলাম।” নন্দিনী বলেই হুর হুর করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

বোনের কথায় জাদু আছে পাবেল সেটা জানে। সব পরিস্থিতি সামলেও নিতে জানে ওর বোন। এই যেমন মন খারাপ থাকা সত্ত্বেও ওকে মানিয়ে নিল। এখন না খেয়েও থাকতে পারবে না পাবেল। ছোটো বোনের রাগ সম্পর্কে ভালোই জানা আছে পাবেলের।

পাবেল ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে চলে গেল। চেয়ারে বসতেই নন্দিনী খাবার বেড়ে দিতে লাগল। একেক একেক করে সব খাবার দেয়ার পর খেতে শুরু করল পাবেল। বোনও পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল।

পাবেলের খাওয়া দেখে নন্দিনী জিজ্ঞেস করল, “কেমন হইছে ভাই?”

“আরে জোস! এত ভালো খাবার কতদিন পর যে খাচ্ছি হিসাব নেই। তুই অনেক ভালো রান্না করিস।” পাবেলের খাবার ভর্তি মুখে কথা কিছুটা অস্পষ্ট আসছে।

“আগে সব গিলে নে পরে কথা বল। আর কিছু লাগবে?” নন্দিনী জিজ্ঞেস করল।

“না না, আর লাগবে না,”পাবেল বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “রাত তো খাসনি এখনো তাই না?” বলেই এক লোকমা খাবার তুলে নিয়ে আবার পাবেল বলল, “হা কর তো বোন।”

নন্দিনী কথা না বলে হা করল। সাথে সাথে খাবার চালান করে নিল পাবেল বোনের মুখে। নন্দিনী খেতে লাগল। এভাবে দু ভাইবোন রাতের খাবার খাওয়ার সমাপ্তি ঘটালেও পাবেলের মনটা শান্ত হলো না।

ছোটো বোনকে খাওয়ানোর সময় মনে পড়ল তার বউ নীলার কথা। নীলাকেও এভাবে খাইয়ে দিতো। নীলাও খাওয়াতো পাবেলকে। মাঝে মাঝে পাবেল এমনও করতো নীলা আর নন্দিনীকে খাইয়ে দিচ্ছে একসাথে। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা সংসার ছিল। নীলার কখনো এসবে হিংসা লাগেনি আর না নন্দিনীর। একজনের স্বামী আর একজনের ভাই।

পাবেল বেডরুমে এসে বিছানায় শুয়ে রেস্ট করতে লাগল। কিন্তু ভালো লাগছিল না পাবেলের। অন্তরের ভেতরের শান্তিটা আর নেই। নীলা চলে যাওয়ার পর থেকে কখনো ঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি ও। নীলার একটা বুকসেল্ফ আছে নিজের। ঘরের পাশ্চিম দিকে। সেটা ভর্তি বই রাখা। ওর সকল পছন্দের বইগুলো সাজিয়ে রাখা ওর মতো করেই। ওটার যত্ম নীলা যেমন নিতো, এখন পাবেলও নেয়। নীলার যত্ম করার প্রতিটা বিষয়কে পাবেল আগলে রেখেছে। কিন্তু নিজের যত্ম রাখার বিষয়টাতে অবহেলা করে ফেলে।

নীলার বুকসেল্ফের মাঝে থেকে একটা বই বের করল। নীলা থাকাকালীন ও কখনো বই ছুঁয়েও দেখতো না৷ বইয়ের প্রতি আগ্রহ ওর কখনো ছিল না। কিন্তু নীলা চলে যাবার পর থেকে রাতজাগা সময়ে বই হাতে নেয়। যত্ম সহকারে পড়ে। সেল্ফে থাকা অধিকাংশ বই পাবেলের পড়া শেষ বলা যায়। এর মাঝেই যেন নস্টালজিয়ায় ভুগে ও আজকাল। হাতে নেয়া বইটার ভেতর থেকে নীলার একটা ছবি বের করল। ওটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ও কিছুসময়। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুম থেকে বললে ভুল হবে, ছবি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল পাবেল।

হাটতে হাটতে নীলার অনেক স্মৃতিই মনে খোঁচা দিল পাবেলের।নীলাকে মনে গাঁথতে গাঁথতে একটা ব্রিজের উপর এসে পড়ল ও৷ ব্রিজের রেলিংয়ের উপর এসে বসল পাবেল। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাতে থাকা নীলার হাসি মাখা মুখের ছবিটা দেখতে লাগল। নিচে বয়ে চলা নদীটার স্রোতের শব্দ কানে এসে ঠেকছে বারবার পাবেলের। কখন যে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দিয়ে গড়িয়ে কয়েকটা ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ল ওর জানা নেই। ফাঁকা ব্রিজ। এতো রাত্রিরে কোনো গাড়িরও চলাচল নেই বলে হয়ত ওর কান্নার সাক্ষী প্রকৃতি ছাড়া আর কিছু হতে পারল না।

হঠাৎ এক ধমকা হাওয়া এসে হাতে থাকা ছবিটা উড়িয়ে নিয়ে গেল। ছবিটা হাওয়ায় ভাসিয়ে ল্যাম্পোস্টের আলোয় চিকচিক করতে থাকা নদীতে নিয়ে ফেলল। উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেও ছবিটা ধরতে পারেনি ও। ওর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে, লাফ দিয়ে নদীতে নেমে ছবিটা নিয়ে আসতে। ছবিটার চলে যাওয়া দেখতে লাগল নদীর বহমান স্রোতের সাথে। দাঁড়িয়ে রইলও পাবেল ওভাবেই।

হঠাৎ ওর কাঁধে পেছন থেকে কারো হাতের স্পর্শ পেল। চমকে গিয়ে পাবেল ঘুরে তাকাল পেছনে। তাকানো মাত্রই ওর হৃদপিণ্ডের লাফানোর গতি কতটা বেড়ে গেছে হিসাব নেই। শরীরের হাড় যেন হিম হয়ে আসছে। মেরুদন্ড বেয়ে ঠান্ডা অনুভূতি বয়ে গেল। কারণ পিছনে আর কেউ নয়, ওর মৃত স্ত্রী নীলা দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here