একদিন নববর্ষা-২,০৩

0
292

একদিন নববর্ষা-২,০৩
অদ্রিজা আশয়ারী
০২

বর্ষা চলে যাবার পরও আমি সেপথে তাকিয়ে রইলাম। আমার ভেতরে একটা ঝড় বয়ে গেল! মুহুর্তের জন্য মনে হল এই মেয়েটিকে আমার সারাজীবনের জন্য পাশে প্রয়োজন।

পরদিন থেকে শুরু হল আমার মাষ্টারি। বর্ষন ছেলেটা ভারি মিষ্টি। আমার প্রতি বোনের মতোই সদা ভীত দৃষ্টি তার চোখে। বর্ষনকে যখন পড়াই তখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে বর্ষা এসে আড়াল থেকে ভাইকে নজর রাখে। আমি যথাসম্ভব ভালো শিক্ষক হবার চেষ্টা করি।
দুদিন সকাল-বিকেল দুবেলা নিয়ম করে বর্ষন কে পড়ানোর পর সেদিন বিকেলে বর্ষা নিজের কাজ শেষে ভাইকে নিতে এল।
–“সাহেব, ও পড়া পাড়ে তো?” সন্দিহান স্বরে প্রশ্ন এল দরজার পাশ থেকে। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম। সাথে বললাম,
“তোমারও নিশ্চয়ই পড়াশোনা একদম হয়নি। বর্ষনের সাথে তুমিও তো পড়া শুরু করতে পারো।”
অস্ফুট একটা শব্দ করে কিছুক্ষণ থেমে সে ইতস্তত করে বলল,
“ভাই পড়লেই হইব। আপনি ওরে মানুষ কইরা দিয়া যান সাহেব।”
মনে মনে আমি হাসলাম। এখানে যে কদিন থাকি। সে সময়ের মাঝে আর যাই হোক কাউকে পুরোপুরি মানুষ করে রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। বর্ষা মেয়েটি বড় বেশি সরল। তাই এমন বলছে।

গরানবনের দিনগুলো কেটে যেতে লাগল স্বপ্নময় ভাবে। বর্ষার মতোই এই গরানবনের রূপও নির্বাক অথচ সুন্দর। এক বিকেলে বর্ষন আমাকে নিয়ে গেল ছোট এক নদীর ধারে বেড়াতে। এর মধ্যেই আমার সাথে তার ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাই আজ সে আমাকে তার প্রিয় জায়গায় যাবার সঙ্গি হবার অধিকার দিয়েছে।

দুপাশে ঘন জঙ্গলে ঘেরা সেই ছোট্ট নদী। জঙ্গলের সামনে ছোট তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট নাও আর বৈঠা যেন স্বপ্নের নদী পারাপারের সরঞ্জাম।

আমরা দুজন পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। আমার দুচোখে মুগ্ধতা দেখে বর্ষন গর্ব ভরে হাসল। এ যে তার নিজের আবিষ্কার। এখানে খুব বেশি মানুষের পদক্ষেপ যে পড়েনি এখনো, সে বোঝাই যাচ্ছিল। বর্ষন উত্তেজিত হয়ে বলল,
–“জানেন নবু ভাই, এই জায়গাটা বুবুরও খুব পছন্দ। আমি আর বুবু ছুডু বেলায় কত খ্যালছি এই জঙ্গলে। আর বাদলার দিনে তো আরও মজা। আকাশে যহন কালো মেঘ করত, কলাগাছের ভেলা বানায়া আমি আর বুবু নদীতে ভাইসা পড়তাম। তারপর আর কি কমু….নদীযে আমাগরে কই কই ভাসায়া নিয়া যাইত…..। এহনো আমি আর বুবু এমন করি। ”

তারপর সে নৌকাটা দেখিয়ে বলল,”এইযে দেহেন আমাগর নাও।”
বর্ষনের কথা শুনতে শুনতেই খেয়াল করলাম আকাশে ভারী ভারী কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। সেই সাথে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ আর চারিদিকে বাতাসের শো শো গর্জন। নদী তীরের জঙ্গল ঘেঁষা গরান, সুন্দরী গাছগুলো একে অপরের গায়ে বাড়ি খাচ্ছে সজোরে। প্রায়ান্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক।

বর্ষন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তারপর হঠাৎ হাসি ফুটল তার মুখে। সে রহস্য করে হেসে বলল,
–“নবু ভাই, মেঘ আসতাসে, বাদলা নামব। আপনি ভাসবেন আমার সাথে নাওয়ে?”
আমি একমুহূর্ত না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। বর্ষনের মতো একরত্তি ছেলে যদি এই ঝড়ের আগের, উত্তাল ঢেউয়ে ভরা ছোট্ট নদীকে ভয় না পায় তবে আমি কেন পিছিয়ে যাব? প্রকৃতি যেন আমাকে সম্মোহন করে ফেলেছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে লাগলাম ঝড়ের আগের ভয়াল রূপ। আর উঠে বসলাম সেই ছোট্ট নাওয়ে..।

নৌকাটা সবে চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা মিহি ডাক ভেসে এল। তারপর যেন হাওয়া ফুঁড়ে, গাছপালার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কেউ একজন। আমার রহস্য মানবী!

ছোট্ট নদীটা ক্রমশ ভয়াল হয়ে উঠছে। আমাদের ছোট্ট নাওয়ে একের পর এক এসে বাড়ি খাচ্ছে কালো ঢেউ। রোমাঞ্চটা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। পরিস্থিতি আরও ভয়াল হয়ে উঠুক। আমি পরোয়া করি না। আমি এখন একটি মেয়ের প্রেমে সঙ্গাহীন, আবেগে টইটম্বুর, সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পড়া এক মাতাল কিশোর। সাতাশোর্দ্ধ গম্ভীর লেখক ইমতিহান নাব্য এখানে অনুপস্থিত। এখানে যে বসে আছে, সে শুধু একটি গ্রাম্য কিশোরীর আগন্তুক প্রেমিক।
নাওয়ের যেপাশে আমি বসে আছি তার ঠিক উল্টো দিকে অর্থাৎ নাওয়ের ওপর কোণায় বর্ষা বসে দার টানছে। যদিও তাকে খুব বেশি কিছু করতে হচ্ছে না। স্রোতই আমাদের নিজ মর্জিমাফিক পথে নিয়ে চলেছে। আর নৌকার ঠিক মাঝ বরাবর বসে আছে বর্ষন। তার উপস্তিতি আপাতত উহ্য আমার কাছে। বর্ষা আর নাব্য ছাড়া এই ঝড়ের পূর্বের উত্তাল নদীতে আর কারো উপস্থিতি আমি বরদাস্ত্ করব না।

বর্ষার আগমনের পর আমার কাছে প্রকৃতির রূপ ম্লান হয়ে গেছে। আমি শুধু তাকেই দেখছি। অথচ এখন পর্যন্ত সে একটি বারও তাকায়নি আমার দিকে। দার হাতে বসে উত্তাল নদী দেখায় ব্যাস্ত ভীষণ। আমার চেয়ে তার মুগ্ধতা কম নয়। অথচ এই রকম ভয়াল সৌন্দর্য সে কাছ থেকে দেখেছে বহুবার।

হঠাৎ ঝমঝমিয়ে আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি বর্ষাতে শুরু করল। শীতল ঝোড়ো হাওয়া, উত্তাল নদী, বৃষ্টির প্রচন্ড তেজ আর ওপরে আকাশ ভীষণ অন্ধকার। মনে হল এ যেন পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানের সেই মাঝ সমুদ্রে, ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজটা।

বর্ষা হঠাৎ জিগ্যেস করল,”আপনি সাতার জানেন তো?”
তার চোখে খানিক আতঙ্ক। নদী আমাদের ক্রমশ গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যাত্রা শুরুর স্থান থেকে ইতোমধ্যে সরে এসেছি অনেক দূর। এদিকে দিনের শেষ হতে বেশি বাকি নেই। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যাবে। বর্ষা বোধহয় এবার ফেরার কথা ভাবছে। তবে সেটা ভীষণ কঠিন হবে তা ওর মুখে ঝিলিক দিয়ে যাওয়া ভয় দেখে বুঝতে পারছি।

আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে তার দিকে ফিরলাম। প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়ায় তার মাথা থেকে আঁচল খসে পড়েছে, খোপা খুলে গিয়ে অবাধ্য চুলগুলো উড়তে শুরু করেছে। বাতাসের তোড়ে ছোট হয়ে এসেছে তার চোখ। সে ক্রমাগত দার টেনে চলেছে। চুল ঠিক করার সময় নেই।

হঠাৎ দেখলাম আমার পায়ের নিচটা পানিতে থৈথৈ করছে। অর্থাৎ নাওয়ে পানি ঢুকছে। বর্ষা সেদিকে তাকাল। তার মুখের সমস্ত মুগ্ধতা ও রোমাঞ্চ সরে গিয়ে সেখানে এখন শুধুই আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারপর বুঝলাম সেসব শুধুই আমাকে ঘিরে। ভাই বোন দুজনেই এর আগে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে। তাই তারা জানে এই অবস্থায় কি করতে হয়। কিন্তু এবিষয়ে আমি একেবারে অর্বাচীন। বর্ষা তার ভাইকে বলল,’ তুই সাতরে পাড়ে উইঠা যা। গিয়া আমাগর জন্যে অপেক্ষা কর।’ কথা বলতে বলতেই বর্ষা যত দ্রুত সম্ভব দার টেনে নৌকাটাকে তীরের দিকে নিতে চেষ্টা করল। বর্ষনকে দেখলাম নদীর এই উত্তাল রূপের মধ্যে, প্রচন্ড কৌশল জানা সত্ত্বেও ওপারে যেতে হিমশিম খেতে।

কিন্তু আমরা তীরে পৌঁছাতে পারলাম না। তার আগেই নৌকাটা হঠাৎ ডুবতে শুরু করল। আমার দিক থেকেই ওটা আগে কাত হতে শুরু করল। আমি খুব একটা ভয় পাচ্ছি না। মনে মনে নিজেকে বলছি,”নাব্য, আজ তোমার সাঁতারের পরীক্ষা। পাস করলে তীরে পৌছুতে পারবে , আর হারলেই………… অনিবার্য মৃত্যু!”
বর্ষা আমার দিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়েই আছে। বোধহয় ভাবছে এই মুহুর্তে তার কি করা উচিত!

ছোট্ট নদীটা যে এত গভীর ভাবতেই পারিনি। নদীর হিম শীতল স্রোতে হাবুডুবু খেতে খেতে আমি তীরের দিকে ভিরতে চেষ্টা করলাম। বৃষ্টির জোড়ালো বোলের জন্য তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও প্রাণপণ চেষ্টায় তীরের দিকে যাচ্ছি। তীরের কাছাকাছি পৌঁছুলে অর্থাৎ এই ডেঞ্জারজোন টা পেরুলেই আর অজানা কোথাও ভেসে যাওয়ার ভয় থাকবে না। কিন্তু তার আগেই ঘটল বিপত্তি। ঝড়ে উল্টো হয়ে ভেসে আসা একটা ভাঙাচোরা নৌকার কিনারা সোজা এসে বাড়ি খেল আমার মাথা বরাবর। আমি বুঝলাম আর কোনো আশা নেই। স্নায়ুগুলো একে একে নিস্তেজ হয়ে আসছে। জ্ঞান হারানোর আগে শেষ মুহুর্তে টের পেলার গভীর জলের মধ্যে দিয়ে একটা শীতল হাত স্পর্শ করেছে আমার হাতে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

***

জ্ঞান যখন ফিরল, নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটি অন্ধকার কুঠুরিতে। মাথা কাজ করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। যাক মারা যাইনি তাহলে! ওপরের দিকে হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। ভিড়ানো জানলার ফাঁক গলে খানিক আলো আসছে। আলোটা সূর্যের নাকি বাতির ঠিক বোঝা গেল না। এখন সকাল না রাত? আমি কোথায় আছি? আর বর্ষা? বর্ষা কেমন আছে? বেঁচে আছে তো?
অসংখ্য প্রশ্ন মনের মধ্যে। হৃদপিণ্ডটা দুরন্ত ভাবে লাফাচ্ছে। দরজার বাইরে পদশব্দ পেয়ে সেদিকে তাকালাম। রশু ঘরে এল। দাঁড়াল বিছানার পাশ ঘেঁষে। তার গলার স্বর উত্তেজিত।
–“নবুদা, উঠেছেন তাহলে! আপনি কি কান্ডটাই না করেছেন। একে তো এমন ভয়ংকর দুর্যোগ। গ্রামবাসী বিপর্যস্ত। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার ওপর মফস্বল থেকে ফিরে শুনি আপনি নিখোঁজ। লোক নিয়ে খুঁজতে বের হলাম। এদিকে গুজব ছড়িয়ে পরল নদী নাকি আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। দেখেছে দুজন লোক।

আমি মৃদু হাসলাম। -” ভেসে যাইনি তা তো নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছ। কিন্তু বেঁচেই বা ফিরে এলাম কি করে সেটা বুঝতে পারছি না। ”

–“বেঁচে ফিরেছেন হায়াত শেষ হয়নি বলে। আমাদের কাজের মেয়েটা আপনাকে ভেসে যেতে দেখেছিল। সে আর তার ভাই-ই আপনাকে তীরে টেনে নিয়ে এসেছে।”

আমি স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে নিরব রইলাম। অর্থাৎ আমাদের বৈকাল ভ্রমণে বেরোনার পুরো ব্যাপারটাই সবার কাছে গোপন করে গেছে বর্ষা আর তার ভাই। আমারো তবে চুপ থাকাই বাঞ্চনীয়।

রশুর সাথে কথা বলতে বলতেই একবার মাথায় হাত রেখে চমকে উঠলাম। সেখানে যে এত বড় কাপরের পট্টি বাঁধা সেটা আগে খেয়ালই করিনি। রশু বলল ভুরুর ওপরে চামড়াটা একটু থেতলে গেছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাই ওটা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এখানে ফার্স্ট এইড এর ব্যাবস্থা নেই। তাই গাছের শেকড়-বাকড়ের রস নিংড়ে, কাটা স্থানে লাগিয়ে তারপর পট্টি বেঁধে দেয়া হয়েছে। রশু এবার একটু ইতস্তত করে বলল,
–” নবুসা……বাড়িতে… একটা ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলে ভালো হত না? সপ্তাহ হতে চলল এখানে আছি, এখন আবার এই বিপত্তি। চাচী তো এসবের কিছুই জানে না।”

রশুর প্রস্তাব আমি কঠোর ভাবে প্রত্যাখ্যান করলাম। আম্মাকে যেচে ফোন করে আমার খবর জানানো মানে, কথা বলা পুতুলের সচল হবার রিং ঘুরিয়ে দেওয়া। এরপর তিনি একনাগাড়ে ফোন করতেই থাকবেন। আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত নিস্তার দেবেন না।

রশু মাথা চুলকে বাইরে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে জিগ্যেস করলাম এখন সকাল না বিকেল, সে বলল সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।

দরজায় ফের করাঘাত। রশু ভেবে চুপ রইলাম।
বার দুয়েক করাঘাতের পর কেউ একজন ভেতরে পা বাড়াল। ফিসফিস স্বরে ভেতরে আসার অনুমতি চেয়ে কেবল বলল-“সাহেব..”
এক পা বাড়িয়ে বর্ষা দাঁড়িয়ে রইল। আর তার আঁচলের পেছন থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল একটা ছোট্ট মুখ। বর্ষন।
আমি দুজনকেই ডাকলাম। বর্ষন এক দৌড়ে আমার কাছে চলে এলেও বর্ষা এল না। ঘর তখনো প্রায়ান্ধকার। সে গিয়ে আমার বিছানা থেকে সবচেয়ে কাছের জানালাটার খড়খড়ি টেনে দিল। মুহুর্তে ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল একরাশ আলো আর জঙ্গলের গাছ-মাটির মিশ্রিত জোড়ালো সোঁদা গন্ধ। ভোরের সেই প্রথম আলোয় আমি দেখলাম আমার জীবন ঋতুর, প্রথম আগমনী বর্ষাকে। ভোরের আলো তার মুখে ঐশ্বরিক আভা মেখে দিয়েছে। সে যেন আর সাধারণ মানবী নেই। আকাশলোকের কোনো এক অচেনা কিরণ ঘিরে রেখেছে ওকে।

এতক্ষণে ঘরে তাকিয়ে বুঝলাম আমি কুঠিবাড়িতে, আমার নিজের ঘরেই আছি। কোথায় আছি সে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু রশু আসার পর ব্যাপারটা বলতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।
বর্ষা আমার দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিল। অপর জানালার খড়খড়ি টেনে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। হাত কচলে একসময় বলল
–“বর্ষন আপনেরে দেখনের জন্য বেচেইন হয়া রইসে। তাই ওরে….. নিয়া আসলাম। আ… আপনি ভালো আছেন?”

আমি বর্ষনের উৎসুক মুখের দিকে তাকালাম। গাল টেনে উত্তর দিলাম,
–“হু।”

ঘরে আমরা তিনজন। বর্ষন তার ছেলেমানুষী কৌতুহল নিয়ে আমার কপালের পট্টি দেখায় ব্যাস্ত। আর সব চুপ। বর্ষা সেখানেই মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। এই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতেই যেন বর্ষা এবার বলল,
–” আপনি সকালে কি খাইবেন? রশু ভাই বলছিল দেশী মুরগির ঝোল আর সাদা ভাত। চলব তো? ”

আমি উত্তর না দিয়ে চেহারায় গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে তার মুখের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম। তা দেখে সে যেন আরও দমে গেল। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
–” আ…আমি আসি। আপনার নাস্তা বানাইতে হইব।” বলে সে চলে গেল। তাড়াহুড়োয় একবার দরজায় তার মাথা ঠুকে গেল। তা দেখে ফিক করে হেসে ফেলল বর্ষন।

চলবে……..

একদিন নববর্ষা – ৩
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

আমার মতো অস্থির প্রবণ লোকের পক্ষে সারাদিন একঘরে বসে থাকাটা প্রায় শাস্তির সমতুল্য। তবুও রশুর অনুরোধে বিকেল পর্যন্ত ঘরে শুয়ে-বসে কাটাতে হলো। কিন্তু তারপর আর সম্ভব হলো না।
রশু বলেছিল ভুরুর ওপর দিক কেবল সামান্য থেতলে গেছে। সেদিনের ঝড়ের সময় নদীতে ভেসে আসা ভাঙা নৌকার কোণা মাথায় লাগার ফলাফল। কিন্তু এই সামান্য আঘাত ভোগাচ্ছে বেশ। মাথা নুয়ালে কিংবা হঠাৎ ডানে-বায়ে ঘোরালেই ব্যাথায় ঝিমঝিম করে ওঠে। তবু বিকেলের চায়ে চুমুক দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, কপাল হয়ে একটা সাদা কাপড় মাথার পেছন দিকে বাঁধা। চুলগুলো সব উসকোখুসকো হয়ে আছে। মাথার পট্টির জন্য ওদের গুছিয়ে রাখা আপাতত অসম্ভব। আমি বাড়ির সামনে দেহরক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাছগুলোর মাঝখানে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটছি। বিকেলটা রোদহীন। বাতাস ভীষণ। গাছের পাতাগুলো খসখস শব্দ তুলে বাড়ি খাচ্ছে। আমার ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা চুলে বাতাস ঢেউ তুলছে।

তখন দেখলাম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বর্ষা আমার দিকে হেটে আসছে। বাতাসের ওপর আস্থা রাখা দায়। তাই সে তার আসমানী রঙা মলিন শাড়ীর আঁচল শক্ত করে দুহাতে চেপে ধরে আছে। আমার সাথে অনেকটা দূরত্ব রেখে সে দাঁড়াল। মাথার আঁচলটা মুখের ওপর আরেকটু টেনে বলল,
–” আমি বাড়িত যাই সাহেব। আর কিছু লাগবি নি?”

–“কিছু লাগবে না। তুমি যেতে পারো। সন্ধ্যায় আমি ফিরলে তখন একবার চা দিও।”

–“আপনি কোথাও যাইবেন? ”

–“হুম, একটু ঘুরে আসি। সন্ধ্যায় ফিরব। ”

বর্ষা একটু ইতস্তত করে তারপর বেশ জোরের সাথেই বলল,” রশু ভাই আপনারে ঘর থেকি বের হতি মানা করেছে। আপনার তবিয়ত খারাপ….।”

–“রশু এমন কথা সবসময় বলে…।”

–“সাহেব…আপনি গেলে রশু ভাই আমারে বকবে।”

আমি স্থির চোখে বর্ষার দিকে তাকালাম। -“তোমার রশু ভাইকে আমি বুঝিয়ে বলব। আশা করি তাতে কাজ হবে। আর নিতান্তই যদি আমাকে একা ছাড়তে না চাও তবে আমার সাথে তুমিও আসতে পারো। আমার ওপর নজর রাখাও হলো। রশুর বকা খাবারও ভয় রইল না। ”

বর্ষা একবার মুখ তুলে চেয়ে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। আমি বাড়ির পেছনের রাস্তায় হাটা ধরলাম। এই জঙ্গল আমার অতি প্রিয়। পেছন ফিরে দেখলাম বর্ষা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দ্বিধান্বিত মনে হচ্ছে। আসবে নাকি চলে যাবে সেই নিয়ে বোধহয়। আমি, “এসো” বলতেই এবার সে সুর সুর করে আমার পেছনে আসতে শুরু করল।

ঘন বন। অজানা সব পাখির অসহ্য কলরব। বাহারি পোকাগুলো ডেকে চলেছে অবিরত। দিকদিক ওদের প্রকট ডাক। যত গভীরে যাচ্ছি সবুজের পরিমাণ তত বাড়ছে। গরান, হেতাল, পশুর, ধুন্দল, কেওড়া… কতরকম গাছ চারিদিকে। বর্ষা আমার পেছন পেছন হাটছে। এই প্রথম আমরা একসাথে বেরুলাম। বর্ষা আর আমি একা।

চলতে চলতেই এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম,
–“এ বনে বাঘ আছে বর্ষা?”

–” জানিনে, কখনো দেখিনাই। তবে বাজান দেখিছিল একবার।”

–“কোথায়?” আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম।

–“এদিকে নয়। এ বনের পশ্চিমে। সেখানে বন আরও গভীর। গাছের শেকড় সব পানির নিচে। বাজান মাছ ধরতে গিয়া বাঘের মুখে পড়িছিল। ”

–” বাঘ কিছু করেনি তোমার বাবাকে?”

বর্ষার স্বর সপ্রতিভ হয়ে এসেছে। সে এখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। সংকোচটা কেটে গেছে অনেকাংশে। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে মাথা নাড়লো।
–” করিছিল। বাজানের মুখে থামা মেরিছিল। তার দাগ আছে এখনো। ”

–“তাই নাকি!”

আমরা হেটে চললাম। কত অচেনা পাখির ডাক, অদ্ভুত দেখতে সব গাছ। বর্ষা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল সেসবের সাথে। সময়ের খেয়াল রাখিনি কেউ। বহুদূর থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসতেই সম্বিত ফিরল। ঘুরে বর্ষাকে বললাম,
–” ফিরিয়ে নিয়ে চল।” কথাটা বলেই একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাথায় হঠাৎ প্রচন্ড একটা ব্যাথার ঢেউ উঠল। ঝিমঝিম করতে লাগল ভেতরটা। চোখ মেলে আরও অবাক হলাম। ঝুপ করে কখন আঁধার নেমেছে টেরই পাইনি। এখন তবে ফিরব কেমন করে? এ বনের সবই আমার অচেনা। তার ওপর মাথার এই যন্ত্রণা।
বর্ষা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার অস্ফুট স্বরে বলল,
–“কি হইল সাহেব? আপনার তবিয়ত খারাপ হইছে নি?”

–“কিছুটা। ”

–“হাইটতে পারবেন?”

আমি যদিও বললাম, ” হু। ” তবে সেই বলায় কোনো জোর ছিল না।

বর্ষা নিশব্দে সামনে এগিয়ে চলল। আমিও যতদূর পারি সাবধানে ঘন গাছ গাছড়ার ভেতর দিয়ে এগোতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে একবার সামনে দেখে, আরেকবার নিচের ঝোপঝাড় দেখে তা থেকে পা বাঁচিয়ে চলা অসম্ভব হলো আমার জন্য। একে তো বারবার মাথা ওপর-নিচ করার ফলে ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছে, তার ওপর নিচে তাকিয়ে হাটার সময় একটা গাছের গায়ে কপালের কাঁটা জায়গাটাই ঠুকে গেল। আমি “উঁ” বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।

বর্ষা “কি হইল, কি হইল ” বলে ছুটে কাছে এলো। আমার হালাত দেখে কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ইতস্তত করে সে হঠাৎ নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বলল,” আমার হাত ধইরা হাটেন। রাইত বাড়তাসে। আমাদের এইক্ষুনি বাড়ি ফিরা দরকার।”
আমি কোনো কথা না বলে বর্ষার আদেশ মান্য করলাম। সে তার কোমল হাতে খুব যত্নে আমার হাটটা তুলে নিয়ে হাটতে শুরু করল। আমি অন্ধের মত তাকে অনুসরণ করে গেলাম। মনে মনে বলতে লাগলাম, ” এই অরণ্য কখনো শেষ না হোক। হাজার বছর ধরে চলুক এভাবে হাতে হাত রেখে আমাদের একসাথে পথচলা। ”

আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। যদিও বর্ষাকে ভীষণ অস্থির মনে হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা যেভাবে এগুচ্ছে তাতে বোধহয় ভয় পাচ্ছে সে। আমি তার ভয় আরও বাড়ানোর জন্য বললাম, ” বাড়ি ফিরে এখন যদি দেখি রশু এসে গেছে সাথে তোমার বাড়ির লোকও তোমাকে খুঁজতে এসেছে তাহলে কি হবে বলত?”

বর্ষা যেন আকাশ থেকে পড়ল। রাত বাড়ছে। তার বাড়ির লোকও যে তার খোঁজে আসতে পারে এমন একটা সম্ভাবনার কথা সে ভাবেই নি। সে দ্রুত হাটতে লাগল। পারলে আমার হাতটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে উড়াল দেয় বাড়ির পথে। আমি আবার একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ভেসে আসা তীক্ষ্ণ একটা শব্দে ব্যাঘাত ঘটল। কথা না বলে দাঁড়িয়ে পরলাম। বর্ষাও মুহুর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। দূর থেকে কেউ একজন রাগত, প্রবল কণ্ঠে চিৎকার করে বলছে,” কেডা, কেডা হাটে ওইহানে? ”
কণ্ঠটা আস্তে আস্তে আমাদের নিকটবর্তী হতে লাগল। বর্ষাকে দেখলাম স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে। তারপর হঠাৎ সে আমার হাত ছেড়ে ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করল বিপরীত দিকে। মুহুর্তে সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম বনের হাজারো পাখির কলরব, ঝিঁঝি পোকার প্রকট শব্দ আর ঘন গাছপালার মাঝে ধূলো উড়িয়ে আমার রহস্য মানবী হারিয়ে গেছে। তার বাতাসে ওড়া আসমানী রঙা আঁচলের কোনো চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই!

তার পরমুহূর্তেই সেই প্রবল কণ্ঠের অধিকারী আমার একেবারে নিকটে এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা ফুরিয়েছে। আকাশের গায়ের গোলাপি আভা গায়েব হয়ে সেখানে কালো রঙ ধরতে শুরু করেছে। তাই সামনের লোকটির চেহারা আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। আবছা ভাবেই তাকালাম সেদিকে।

লোকটা কাছে এসে সেলাম ঠুকে বলল,
–“সালাম সাহেব।” এতক্ষণে তার কণ্ঠটা কোমল হয়ে এসেছে। ভেবে নিলাম লোকটা আমাকে চিনতে পেরেছে। এই অন্ধকার বনের মাঝেও তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা অবাক করল আমাকে।
সালামের জবাব দিতেই সে বলল,” সাহেব, কিছু মনে করবেন নি। ভর সন্ধ্যেতে জঙ্গলে লোক দেখে ভেবিছিলেম চোরা শিকারী আসিছে বুঝি। তাই ওমন ডাক পারিছি। ”

–“কিছু মনে করিনি।” বলে আমি হাসতে চেষ্টা করলাম। কারন যাই হোক এই লোককে দেখেই বর্ষা ওমন দৌড়ে পালিয়েছে। আমাদের বন ভ্রমণে রদ ঘটিয়েছে এই অচেনা লোকটির অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন। বর্ষার ওভাবে চলে যাওয়া টা ভীষণ অপ্রত্যাশিত ছিল আমার জন্য।

–“সাহেব বাড়ি ফিরবেন তো? আসেন আপনারে পৌঁছায়ে দিয়া আসি।”
লোকটির কথা নিরবে মেনে নিয়ে আমি হাটতে লাগলাম। সে চলল আমার আগে আগে। গাছপালার ঘন ঝোপ লাঠি দিয়ে ভেঙে পথ করে দিতে লাগল আমাকে। বাড়ির কাছাকাছি এসে বলল,” আপনি কি একাই এসিছিলেন এখানে? মনে হইলো যেন আরও একজনকে দেখলেম।”

উত্তরটা আমি একটু ঘুরিয়ে দিলাম।
–” আপনি আসার পর আমি তো আর কাউকে দেখিনি। আচ্ছা, এখানে একা এলে বিপদের সম্ভাবনা কতটুকু?”

–“সে আর বইলতে! জঙ্গলে এভাবে একা একা আসা ভালো কথা নয় সাহেব। কখন কি বিপদ ঘটি যাবে সে বলা মুশকিল। যাইহোক, আপনি আমারে চিনেছেন তো? আপনার বাড়িতে রান্না কইরতে যায় যে, সে আমার মেয়ে। ”

আমি এবার চমকে তাকালাম। এই তাহলে বর্ষার বাবা! সেজন্যই তখন বর্ষা ওভাবে দৌড়ে পালিয়েছিল। কিন্তু কেন? আমার সাথে বর্ষাকে দেখলে কি এমন বলত তার বাবা, যে ভয়ে তাকে পালাতে হলো।

বর্ষার বাবা আমাকে বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে দিয়ে তবে ফিরতি পথ ধরলেন। তিনি নিজের নাম জানালেন বসির শেখ। যাওয়ার আগে একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বর্ষাকে না পেয়ে আমাকে বললেন।
–” মাইয়াডা বাড়িত গেছে বোধহয়। আমি তারে পাঠানের ব্যাবস্থা কইরতেছি। আপনের চা-নাস্তার বন্দোবস্ত করি দিবেনি সে। ”

***

জানালার পাশ ঘেঁষে কাঠের টেবিল। টেবিলে আমার লেখার সরঞ্জাম সাজানো। মাঝখানে একটা পিদিমের শিখা দপদপ করে জ্বলছে। আমি বসে আছি টেবিল সংলগ্ন কাঠের চেয়ারে। এখানে ইলেকট্রিসিটি নেই। রাতে তাই পিদিমই একমাত্র ভরসা। খোলা জানালা দিয়ে ধীর লয়ে আসছে মিহি শীতল বাতাস।
ঢাকায় আমাদের দ্বিতল বাড়ির এসিঘরের সাথে এই বন-অরণ্যের কুঠি বাড়ির পিদিম জ্বালিত, জানালা দিয়ে আসা মিহি বাতাসে ভরপুর, গ্রামীণ জীবনের কোনো তুলনা চলে না। সেই দ্বিতল এসিঘরে বসে এখানে থাকার সুখ কোনোদিন অনুভব করা সম্ভব নয়। তাই বোধহয় আমি ঘুরে ফিরে বারবার আসি এই বন্য জীবনের কাছে। আমার পরিবারের কাছে যেটা ভীষণ রকমের হেয়ালিপনা।

দরজায় কড়া নেড়ে রশু ভেতরে এলো। আমি একবার ঘাড় ফিরিয়ে ওকে দেখলাম, ” কখন ফিরেছ রশু? রোজ রোজ কি তোমার মফস্বলে না গেলেই নয়?”

রশু মিনমিনে স্বরে বলল, ” মফস্বলে না গেলে শহরের খবর কিছু পাওয়া যায় না। তাছাড়া বাজারের জন্য তো সেখানে যেতেই হয়। আজ অবশ্য সেসব কোনো কারণে যাইনি। আপনার ওষুধ আনতে গিয়েছিলাম। ফিরেছি অনেকক্ষণ। আপনি লিখছেন ভেবেই আর আসিনি। ” একটু থেমে বলল,
–“নবুদা, বর্ষা বলল আপনার ব্যাথাটা নাকি বিকেলে বেড়েছিল। বাইরে বেরিয়েছিলেন বুঝি? এতো বারণ সত্ত্বেও। ”

গরমে হাসফাস অবস্থা। আমি শার্ট খুলতে খুলতে বললাম, ” রিপোর্ট করা হয়ে গেছে তাহলে! শুধু কি এটুকুই জানিয়েছে যে আমি বেরিয়েছিলাম, সাথে যে সেও ছিল সেটা বলেনি?”

–“বর্ষাও ছিল নাকি আপনার সঙ্গে? তাহলে তো হলোই। মেয়েটা কর্তব্যজ্ঞানহীন নয়৷ সবদিকে খেয়াল আছে। রান্নাটাও চমৎকার। চাচী আম্মার পরে আর কারো হাতের রান্না এতো ভালো পাইনি। ঠিক কিনা বলুন?”

আমি আড়চোখে রশুর দিকে তাকালাম। ফিচেল হেসে বললাম, ” ব্যাপারখানা কি রশু। তোমার মুখে তো সহজে কারো প্রশংসা রূচে না৷ হঠাৎ এর এত প্রশংসা যে! প্রেমে-টেমে পড়ে যাওনি তো আবার ?”

রশু বার দুয়েক কেশে লজ্জিত ভাবে বলল,” নবুদা আপনার সবকিছুতেই কেবল মশকরা। আমি তো এমনেই বললাম। ”

–” বুঝেছি। তবে সাবধানে থেকো। মন বেশি পিচ্ছিল হয়ে গেলে পা ফসকাতে সময় লাগবে না। মেয়েটা এসেছে? এসে থাকলে একবার চা দিয়ে যেতে বোলো ওকে।”

–“দেখছি। ” বলে রশু চলে গেল।

বর্ষা চা নিয়ে দরজায় কড়া নেড়ে কেন ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল বুঝলাম না। দাঁড়িয়ে আছে দেখে ওকে ভেতরে আসতে বললাম। দেখলাম ভেতরে আসতে ইতস্তত করছে সে। তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খেয়াল হলো খালি গায়ে বসে আছি এখনো। দ্রুত গায়ে শার্ট চড়িয়ে ওকে আসতে বললাম। বর্ষা চা রেখে চলে যাচ্ছিল। খুব করে চাইছিলাম ও আরো কিছুক্ষণ থাকুক। তাড়াতাড়ি বললাম, ” আ…..বর্ষা, আমার কাপড় গুলো একটু গুছিয়ে রেখে যাও। ”

বর্ষা নিশব্দে কাপড় ভাজ করতে লাগল। আমি লেখার খাতার দিকে তাকিয়ে দেখলাম লেখাগুলো সব এলোমেলো, ঝাপসা লাগছে দুচোখে। বুঝলাম বর্ষার আগমনের সাথে সাথে আমার মন-মস্তিষ্ক বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছে। তবুও পেন্সিল হাতে বসে আছি। ঘরে একটা অস্বস্তিকর নিরবতা। সব সময়ের সপ্রতিভ আমিও ভীষণ এলোমেলো হয়ে যাই বর্ষা এলে। মনের ভেতর হাজার কথার বুদবুদ অথচ মুখ দিয়ে একটিও শব্দ বেরুচ্ছে না। বর্ষাও বোধহয় বুঝতে পারছে আমি লিখছি না, বসে আছি এমনিই। একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ ধরে ভেতরে খোচা দিচ্ছিল। এবার জিজ্ঞেস করলাম,”তখন ওভাবে ছুটে পালালে কেন? বাবাকে বুঝি ভীষণ ভয় পাও?”

বর্ষা অস্ফুট হাসল,বলল, ” হুম। বাঘের মতোন। ”

এবার আমার হাসার পালা। -“সত্যি! কিন্তু কেন? বাবা বুঝি তোমাকে ভালোবাসে না?”

বর্ষা অন্যমনস্ক হয়ে হাসল ,বলল,” বাসতো যদি নিজের বাপ হইতো।”

-” কি!” আমি বিস্মিত হয়ে বললাম।

বর্ষা বলল,” উনি আমার বাপ না।”

চলবে…

অদ্রিজা আশয়ারী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here