একদিন নববর্ষা -১০,১১

0
236

একদিন নববর্ষা -১০,১১
অদ্রিজা আশয়ারী
১০

ফের গরানবনে আগমনের উদেশ্য লেখালেখি হলেও ওতে এবার একদম মন দিতে পারছি না। বর্ষাতে শুরু হয়ে বর্ষাতেই শেষ হয়ে যায় দিন।
বর্ষা তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করে সময় কাটায় আমায় সঙ্গে। এছাড়াও রোজ সকালে রয়েছে আমাদের একসাথে প্রাতভ্রমণ। এখনো কেউ আমাদের একসঙ্গে দেখেনি কিংবা দেখে থাকলেও সে নিয়ে প্রশ্ন তোলে নি। এটা আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে। তবুও বর্ষা সর্বদা খুব ভীত আর সাবধানি থাকে।

আজ বিকেলে কাছেই একটা নদীতে মাছ ধরার উৎসব আছে। বর্ষার আজ আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার কথা। শার্টের হাতা গুটিয়ে আমি ফের একবার ঘড়ি দেখলাম। তিনটা বেজে সাতান্ন মিনিট। এখানে সন্ধ্যা নামে খুব দ্রুত। ঘড়ির কাঁটা পাঁচের ঘর পেরতে না পেরতেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বর্ষা এখনো কেন আসছে না!

শেষ বার আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে এবার দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে এলাম। উঠোনে হাটতে লাগলাম উদ্দেশ্য হীন। এরও প্রায় মিনিট দশেক পর বর্ষা এল। দৌড়ে কাছে এসে কানে হাত রেখে বারবার সরি বলে বাচ্চা মেয়ের মতো লাফালাফি জুড়ে দিল। বর্ষার হাসি-হাসি চঞ্চল মুখের ওপর দুটি সরু হয়ে আসা চোখে গাঢ় করে আঁকা অঞ্জন। দুহাত ভর্তি চুড়ির ঝুমুরঝুমুর শব্দে ভারি আমার চারপাশের বাতাস। আমি গম্ভীর মুখে বললাম, –
-” আজ না এলেই পারতে। এমনিতেও সন্ধ্যে নামতে আর বেশি দেরি নেই।”

বর্ষা মুখটা করুন করে বলল,
-” বললাম তো সরি।”

আমি হাটতে শুরু করলাম।
-“বারবার সরি বলছ যে। সরির মানে জানো তো?”

বর্ষা আমার সাথে পা মিলিয়ে হাটতে গিয়ে প্রথমে একটু হিমশিম খেয়ে গেল। তারপর এক ছুটে দুপা সামনে এগিয়ে পেছন ফিরে চোখ বড় বড় করে বলল,
-” ওমা! আপনি ভাবিছেন এই সামান্য কথার মানে আমি জানি নে বুঝি?”

-“কিচ্ছু ভাবিনি। তবুও একবার তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হল।”

কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বর্ষা হঠাৎ আমাকে ভেঙচি কেঁটে জোড়ালো পদক্ষেপে সামনে এগোতে শুরু করল।

আমি ফিচেল হাসলাম।
-“আচ্ছা থাক থাক। বলতে হবে না। এসো।”

সাথে সাথে মুখ গোমড়া করে দু পা পিছিয়ে ফের আমার পাশাপাশি হাটতে শুরু করল সে।

__________________

মাছ ধরার উৎসব দেখে ফিরতি পথ ধরার আগেই সন্ধ্যা নেমে এল। নদীর তীরে প্রচুর মানুষ এসেছিল। উৎসব টাও জমেছিল খুব। সন্ধ্যে নামতেই অনেকের সাথে আমরাও ফিরতি পথ ধরলাম। একে একে একসময় পথ ভিন্ন হয়ে এল সবার সাথে। আমি আর বর্ষা কেবল আমাদের গন্তব্যের একক পথিক হয়ে রইলাম।

পথঘাট বেজায় বন্ধুর। বনঘেঁষে সরু সরু রাস্তা। আষাঢ় মাস। সর্বদা পড়ছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। সরু রাস্তায় প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদা। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে যতটা সম্ভব কাঁদা বাচিয়ে হাটছি। ধূসর সন্ধ্যার আলোয় দেখলাম তবুও আমার বাদামি রঙা ডেনিম প্যান্টের অনেকাংশ কাঁদায় মাখামাখি। অথচ বর্ষার জলপাই রঙা শাড়িতে কোনো কাঁদা নেই। কাঁদা লাগেনি তার পায়েও। সে দিব্যি উৎফুল্ল হয়ে হেটে বেড়াচ্ছে।
-” এই পথ দিয়েই কি এসেছিলাম আমরা? ” কাছের বন থেকে ভেসে আসা একটা ডাহুকের সঙ্গী হারানো করুণ আর্তনাদের মাঝেই আমি বর্ষাকে প্রশ্ন করলাম।

সাঁঝের কালচে আলো পরদ ফেলে দিয়েছে তখন সবখানে। অরণ্যে, অন্তরীক্ষে, ভূতলে…। ফড়িং এর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, কাঁদা থেকে পা বাঁচিয়ে বর্ষা বলল,
-” উহু।”

-“তবে? ”

-“ওই পথে মানুষের চলাচল বেশি। ঘাট থেইকে সবাই ফিরতে শুরু করিছে। সবাই ওইপথেই ফিরবে। কেউ চিনে ফেলবার পারে। সময় বেশি লাগলেও এই পথ নিরাপদ। তাই এই পথ নিলাম।”

-“ওহ। তা আজ জলদি জলদি বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাস্ত হচ্ছো না যে? আজকের জন্য তোমার আম্মা তোমাকে ছুটি দিয়েছেন বুঝি?”

বর্ষা হাসলো,
-” আম্মা বাড়ি নাই। আমাদের দুই বাড়ি পরে সুমিদের বাড়ি। সুমি আজ নাইওর আসছে তো সেইখানে গেছে। ”

ভ্রু কুচকে বললাম,
-“নাইওর কি জিনিস? ”

উত্তরে বর্ষা তার সুধাময়ী স্বরে ছন্দ করে বলল,

“থাকো থাকো থাকোরে বইন পন্থের দিকে চাইয়া
বাপ- ভায়ে কমু খবর নাইওর নিত আইয়া।”

-“এইবার বুঝছেন?”

আমি বোকার মতো ডানে বামে মাথা ঝাঁকালাম।
-“কিচ্ছু বুঝিনি।”

-“নাইওর মানে হইলো বিয়ার পর মেয়ে লোকের প্রথম বাপের বাড়ি ফেরা।”

-” ওহ, এই ব্যাপার! তুমি গেলে না সেখানে? নাইওর দেখতে? ”

বর্ষা নিশ্বাস ফেলে বলল
-” আপনার জন্যিই যেতি পারলাম কই? আমি গেলে এইখানে কে আসত?”

-“সেকথাও ঠিক। তোমার আম্মা কিছু বলেনি, যাওনি যে?”

বর্ষা ঝাপসা হয়ে আসা আলোয় একবার আমার পানে চেয়ে রহস্য করে হাসলো
-” না। কইছি মাথা ব্যাথা।”

-“তারমানে মিথ্যে বলে এসেছো? ”

বর্ষা হ্যাঁ বলবে নাকি না। বুঝতে না পেরে দ্বিধান্বিত স্বরে আমতা আমতা করছে। আমার রাগ হলো। সহসা ভীষণ গম্ভীর স্বরে বললাম,
-“শোনো বর্ষা। মিথ্যে বলা আমার ভয়ানক অপছন্দ। হোক সেটা যেকোনো পরিস্থিতিতে। আর কখনো মিথ্যে বলবে না। মনে থাকবে তো?”

প্রতুত্তরে গাল ফুলিয়ে বর্ষা আমাকে রেখেই এগিয়ে চলল। সামনেই দেখলাম একটা সাঁকো। বর্ষা সোজা সেদিকে হেটে চলেছে। ভেবেছিলাম সাঁকোর কাছাকাছি গিয়ে হয়তো ডানে কিংবা বায়ে কোনো একদিনে মোড় নেবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম সে তড়তড়িয়ে বাঁশের চিকন সাঁকোটা পাড় হয়ে ওপারে চলে গেল। বর্ষা…. বর্ষা…ডাকতে ডাকতে ওকে অনুসরণ করে সাঁকোয় এক পা এক পা করে কিছুদূর এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লাম। সাঁকোটা ভয়ানক রকম দুলছে। কোনোমতে দুহাতে আঁকড়ে ধরলাম খাঁড়া বাঁশের ফালি। তারস্বরে চেঁচিয়ে বর্ষাকে ডাকতে শুরু করলাম।
-” বর্ষা, বর্ষা এদিকে এসো। আমি পড়ে যাবো। আমাকে বাঁচাও । প্লিজ হেল্প মি। কুইক। ”

সেই নিষ্ঠুর মানবী তখন খালের ওপারে দাঁড়িয়ে দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়ছে। তার মাঝে আমাকে উদ্ধার করতে আসার কোনো লক্ষনই নেই।
-“এসো বর্ষা প্লিজ। নাহয় তোমার আর কোনদিন নাইওর আসা হবে না। তার আগেই বিধবার পোশাক গায়ে জড়াতে হবে। ”
শেষ কথাটা শুনে বর্ষার হাসি থেমে গেল। আগের মতো তড়তড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের মাঝে সে চলে এল আমার কাছে। গলায় অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ঝড়িয়ে বলল,
-” এইসব কথা আরেকবার বললে আমি নিজেই ধাক্কা দিয়া আপনেরে এই সাঁকো থাইকা ফেইলা দিমু। ” বলে সে হাত বাড়িয়ে দিল।

তার সাহায্য নিয়ে খুব ধীর পদক্ষেপে চলতে শুরু করলাম। বর্ষার স্বরে আদ্রতা নেমে এসেছে,
-“আর কখনো কইবেন নে এমন কথা। আমার নাইওর আসতে হবে নে। তাও সই।”

এত সামান্য একটা কথা বর্ষার মন খারাপ করিয়ে দেবে ভাবিনি। পরিবেশ হালকা করার জন্য বললাম,
-“কি মেয়েরে বাবা! বিয়ে হবার আগেই স্বামীর বাড়ি থেকে না ফেরার ফন্দি এঁটে নিচ্ছো। শশুর বাড়ির জন্য এত অধীর হলে এখনি চল ঢাকায় চলে যাই।
তারপর তোমার বাবাকে ফোন করে বলল,
বসির সাহেব, আপনার মেয়েকে অপহরণ করে এনেছি। কোনো মুক্তিপণের বিনিময়ে একে আর আপনারা ফেরত পাবেন না। হা হা হা…..।”
বর্ষা তখনো আমার হাত ছাড়েনি। কথা শেষ হওয়া মাত্রই সে আমার বাহুতে কিল দিতে শুরু করল। সেই সাথে প্রবল হাসি।

সেই আঁধার রাত্রির প্রথম প্রহরে, এই বিরান ভূমিতে, সদ্য আঁধার নেমেছে যেখানে ধরিত্রীর বুকে। দুজন মানব-মানবী প্রাণ খুলে হাসছে। নিজেদের ভালোবাসায় এত বেশি মত্ত ছিল তারা। যে নিজেদের ভালোবাসায় প্রথম এবং চূড়ান্ত বাঁধার উপস্থিতি এড়িয়ে গেছিল তাদের নজর।

সামনে তাকিয়ে হঠাৎ বসির শেখের উপস্থিতি লক্ষ্য করে বর্ষা পাথরের মতো জমে গেল মুহুর্তে। আমার বাহু ছাড়তেও ভুলে গেল সে। আমার মুখের হাসি ম্লান হয়ে গেছে। নিজের জন্য নয়। বর্ষার পরিণতির কথা ভেবে। তবে ভেতরে একটা অদম্য জেদ দানা বাধছে। আমি অনায়াসে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি। খেলার দান আমার দিকে ঘুরে যাবে। যদি বর্ষা একবার রাজি থাকে চিরজীবনের জন্য আমার হাত ধরতে!

কিন্তু সম্বিত ফিরে পেতেই বর্ষা চাপা স্বরে একবার ‘বাজান’ বলে হাত ছেড়ে আমার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। মনে হল মুহুর্তে আমার ভেতরের জেদ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির তৈরি কাঁচের দেয়াল টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল।

বসির শেখ মেয়ের তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় কেবল বলল,
-“বাড়িত যা।”

বর্ষা ভীত হরিণীর মতো ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে চলে গেল। মুহুর্তে বসির শেখের পুরো মুখাবয়ব পালটে গেল। পুর্বের দিনের মতো সে আমাকে সালাম ঠুকে বলল,
-” এদিকে কই গেছিলেন সাহেব?”

ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলাম,
-” মাছ ধরার উৎসব দেখতে। ”

-“আমিও সেদিকেই যাচ্ছিলেম। শুনিছি বেশ ভালো মাছই উঠেছে। ভাইবছি কিছু কিনব। আপনি কিনবেন সাহেব?”

-“না। আমি ফিরব এখন।”

-” তাহলি পরে ভালো মাছ দেখে আমিই কিছু আপনের ওখানে পাঠিয়ে দেব নে। আপনার আসার লাগবে না।”
বসির শেখের গলার আন্তরিকতায় কোনো খাদ নেই।

আমি বেশিকিছু না বলে ফিরতি পথ ধরলাম। বুকের ভেতরের দ্রিমদ্রিম শব্দটা বাড়তে লাগল। বহু যত্নে গড়া একটা সুক্ষ কাঁচের দেয়াল হঠাৎ ভেঙে চূড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা দায়ক তীব্র অনুভূতিতে ভারি হয়ে এল ভেতর টা।

বসির শেখ মানুষ টা যে সহজ না বরং শেয়ালের মতো ধুরন্ধর তা বুঝতে পেরেছি। এত সহজে এই ব্যাপার টা সে ভুলে যাবে বলে আমার বিশ্বাস হলো না। বসির শেখ কিছু করতে চাইলে তার রোষানলে সর্বপ্রথম পড়বে বর্ষা। এই চিন্তা আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিল। সারারাত কাটিয়ে দিলাম একটা অজানা আশংকায়। আমার বর্ষা ভালো থাকবে তো!

চলবে…..….

একদিন নববর্ষা – ১১
অদ্রিজা আশয়ারী
_____________

নদীর এ-কূল ভাঙে,
ও-কূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা।

আমাদের সম্পর্কের ভাঙন টাও যে এত ক্ষিপ্রবেগে ধেয়ে আসছে ভাবিনি আমরা কেউ। না বর্ষা না আমি। পরদিন সকালেই সেই ভাঙনের প্রথম ইশারা নজরে পরল। রোজ সকালে বর্ষার দেয়া চায়ে ঘুমের রেশ কাটে। আজ ঘুম ভেঙে দোর খুলতেই দেখি বর্ষার মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। আমাকে দেখেই কাজ ফেলে হেঁশেলের দিকে ছূটল। মিনিট ঘুরতেই ফিরে এল চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে।
-“সালাম সাহেব। আপনের চা।”

অনেকগুলো ভাবনা একই সময় আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। একটা অনিশ্চিত আশংকায় মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেছে। নিশব্দে চা নিয়ে চুমুক দিলাম। সেদিনের মতো আজও চিনি ক্ষানিকটা বেশি। তবে বর্ষার মা যথাসম্ভব নিপুণ ভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে তা বোঝা গেল।

একই ভাবে দাঁড়িয়ে বিমুঢ়ের মতো ভাবতে ভাবতে আরও কয়েকবার চায়ে চুমুক দিতেই কাপের তলানিতে জমে থাকা চিনি এসে ঠেকল মুখে। কড়া চিনি খাওয়ার অভ্যেস না থাকায় বাধ্য হয়ে মুখে থাকা অবশিষ্ট চা বা-পাশের মেহেদী গাছের গুড়িতে ফেললাম। আমার অসংযত জেদটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ফের। চট করে বললাম,
-“বর্ষা কোথায়? ও আসেনি যে?”

ঝাড়ু ফেলে বর্ষার মা অপরাধীণির মতো ভয়ে ভয়ে বলল,
-” মাইয়ার অসুখ। এহন থেইকে আমিই কাম করুম। ”

বর্ষার মা মিথ্যে বলছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বুঝতে বাকি রইল না আর। এ হলো বসির শেখের চক্রান্ত। বর্ষাকে আমার সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার।

জানিনা কিভাবে এত সহ্যক্ষমতা এলো আমার। সবকিছু বুঝেও পরের দুদিন একেবারে ঝুম রইলাম।
আর হৃদয়ের বাটখারা ভারি হতে লাগল সেই অদৃশ্যময়ীর প্রতি অজানা, এক অহেতুক অভিমানে। বারবার মনে হলো তল্পিতল্পা গুটিয়ে এবার ফিরে চলি। আর কেন এখানে পড়ে থাকা! কিসের জন্য থাকা! সেই নিষ্ঠুর মানবী তো আমাকে ভুলেছে সর্বাঙ্গীণ। তবে আর কেন এই মৃগয়া ভূমে আমার অনর্থক বিচরণ!

এর পরদিনই কিন্তু মন বদলে গেল। অভিমানের সুর বদলে রুপ নিল প্রণয়ের গানে।
সব ভুলে লেখায় মন দিয়েছিলাম। যার অযুহাত টেনে ফের এই অরণ্য মধ্যে আসা। জানালা সংলগ্ন কাঠের টেবিলে ছড়ানো কাগজের পাতার আবেশে ডুবে ছিলাম পুরোপুরি। জানালায় ছোট পাথর ছুড়ল কে যেন। পাত্তা না দিয়ে লেখায় মন দিলাম। ফের একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ। বনের কোনো প্রাণী হবে ভেবে আবারও এড়িয়ে গেলাম।

হঠাৎ জানালার সামনে ভুতের মতো আচমকা ভেসে উঠল বর্ষার মুখ। জানালার গরাদে হাত রেখে, নির্মল দুটি চোখে চেয়ে বর্ষা হাসছে। আমি বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। গরাদে রাখা বর্ষার হাতের ওপর নিজের হাত রেখে অধৈর্য হয়ে বললাম,
-“বর্ষা, বর্ষা…. কেমন আছো তুমি?”
উত্তরে বর্ষা কেবল স্মিত হাসল। সেই হাসিতে প্রাণ অল্পই ছিল।

-“তুমি বাইরে কেন দাঁড়িয়ে? ভেতরে এসো। ” বলেই দরজার দিকে পা বাড়ালাম ওকে নিয়ে আসার জন্য।
এই প্রথম কথা বলল বর্ষা।
-“শোনেন…… শোনেন। এহন ভেতরে আসতে পাইরবো না। আপনি এইদিকে আসেন। স্থির হয়া বসেন এইখানে। আর বলেন কেমন আছেন?”

ভেবেছিলাম কোনো ভাবেই নিজেকে বিকাবো না এইবার। বর্ষা এলেও অভিমানে অবিচল থাকব। কিন্তু বর্ষা আসতেই আমার সব রোষাবেশ এক মুহুর্তে গলে জল হয়ে গেল। হঠাৎ জেদি বাচ্চার মতো অভিমানী স্বরে বলে উঠলাম,
-“বর্ষা তুমি এতোদিন আসো নি কেন? আমি কিভাবে ভালো থাকব ভেবেছো একবারো?” খেয়াল করলাম আমার গলার স্বর কাঁপছে ভীষণ আদ্রতায়।

বর্ষা মুখখানি অবিচল রেখে স্থির চোখে চাইল আমার দিকে। জানালার ফাঁকে হাত গলিয়ে আমার হাত ধরে ভীষণ সমঝদারের মতো গম্ভীর মুখে বলল,
-“এত অস্থির হয়েন না। আমি অপারগ। বাজান সব জাইনা গেছে। এইখানে আমার আর কাজে আসা হইব না। ”

-“সব জানার পর তোমাকে কোনো কষ্ট দেয়নি তো? ঠিক আছো তো তুমি? ”

বর্ষা ফের একবার আমাকে ফাঁকি দেয়ার হাসি হাসলো। সেই সময় প্রথম বর্ষার ঠোঁটের বা পাশে চেরা দাগটা আমার নজরে পড়ল। সাথে সাথেই নজর ঘুরল ওর দুই হাতে। সেখানে অসংখ্য খয়েরী রেখা। বুঝতে সময় লাগলো না ওগুলো মা/রের দাগ।
মুহুর্তে ভেতরে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল দপ করে। বর্ষা আর আমার মাঝে গরাদের প্রাচির আছে সেকথা ভুলে গিয়ে বর্ষার হাত টেনে ধরলাম স/জোরে।
-“এই দাগ কিসের?” আমার গলার স্বর ক্রোধে ভয়ানক ভাবে কাপঁছে।
-” ওরা তোমাকে মে/রেছে?”

প্রশ্ন করে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ালাম। গন্তব্য বসির শেখের বাড়ি। বর্ষা বুঝতে পেরে চেচিয়ে উঠে বাইরে থেকেই আমার হাত টেনে ধরল।
-“দোয়াই লাগে। আপনি কোথাও যাইবেন না। আল্লাহর কিরা। নাইলে আমি আর কোনোদিন আপনের সাথে দেখা কইরতে আসমু না। ”
শেষ কথাটা শুনে আমি বর্ষার মুখের দিকে ফিরলাম। তার চোখ মুখ শক্ত। বলার ধরনে দৃঢ়তা শতভাগ।

ছেলে বেলা থেকেই আমার জেদের বিশেষ মূল্য ছিল বাবা মায়ের কাছে। এমন কখনো হয়নি। কোনো একটা বিষয়ে জেদ করেছি আর সেটা পাইনি। রাগ দমানোর আগেই রাগের কারণ খুঁজে বের করে তা মিটিয়ে দিয়েছেন তারা। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজের সাথে যুদ্ধে জড়াতে হয়নি কোনোদিন। জানি না কিভাবে অন্যের কথা ভেবে দমাতে হয় নিজের বেপরোয়া ক্রোধ!

আজ, হয়তো এ-ই জীবনে প্রথম, এত প্রচেষ্টা করতে হলো নিজের ক্রোধকে সংযত করার জন্য। দেহের প্রতিটি শিরা উপশিরা জ্বলছে ক্রোধে। ইতোমধ্যে আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট শুরু হয়েছে।

আমি নিরবে বসে পড়ে বর্ষার পানে চেয়ে অশান্ত মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। ভালোবাসার উগ্র শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি আমি। নিজের বলতে আমার আর কোনো শক্তি নেই।
-“বর্ষা, তুমি কেন আমাকে থামাচ্ছো? ওরা তোমাকে মে/রেছে? আটকে রেখেছে। তবুও আমাকে চুপ থাকতে বলছো!
ওরা তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই না? তুমি এসো। আর কক্ষণো যেও না ওবাড়ি। আমরা এখান থেকে অনেক দূর চলে যাব। কেমন?”

কতটা বিবশ হয়েছি। নিজের কথায় বুঝতে পারলাম। যেখানে বর্ষার গায়ের প্রতিটি আচড়ের বিনিময় শোধ তোলার কথা ছিল সেখানে আজ বর্ষার মুখপানে চেয়ে পালানোর প্রস্তাবে ওর অনুমতি প্রার্থনা করছি আমি!

অথচ বর্ষা আমার এই কথাটাকেও ছেলেমানুষি ভেবে হেসে উড়িয়ে দিল। একমুহূর্ত নিচু হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে বাড়িয়ে ধরল একটা ফ্লাস্ক।
-” এইখানে তিনকাপ চা আছে। থাউকি বেলাতে আমি ফের বর্ষনরে পাঠামু। ওর হাতে ফ্লাস্ক দিয়া দিয়েন। ততক্ষণ পর্যন্ত এইটা দিয়া কাজ চালান। এহন আমি আসি৷ পলায়া বের হইছি বাড়ি থেইকে। কেউ দেখলে সর্বনাশ। আর একটা কথা। আপনি কক্ষনো ভুলেও আমাগর বাড়ির দিকে যাইবেন না। আল্লাহর কিরা। কথাটা মনে রাইখেন। ” বলে বর্ষা এক এক মুহুর্ত রইল না। যেভাবে উড়ে এসেছিল। ঠিক সেভাবেই উড়ে চলে গেল। মাঝখানে আমার বুকে রেখে গেল এক আকাশ দলছুট কালো মেঘ।

ফজলু মিয়ার সাথে বসির শেখের একটা ভালো বোঝাপড়ার সম্পর্ক আছে। সে ব্যাপারে আমি অবগত ছিলাম। বিকেলে সে রোজ একবার ঘুরে যায় এদিক থেকে। আমার কিছু প্রয়োজন কিনা জেনে অনেকসময় এনে দেয় মফস্বল থেকে। আমার ধারণা আমার আর বর্ষার ব্যাপার টাও সে পুরোপুরি অবগত। আজ বিকেলে যখন এলো, চলে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ফ্লাস্কের দিকে নজর পরল ওর। সবে তখন বর্ষন ওটা রেখে গেছে। হেসে বলল,
-” কই পাইলেন সাব? ভাবছিলাম জিজ্ঞেস করমু আপনেরে। মফস্বল থেইকে একটা আনন লাগব কিনা। ”

হঠাৎ কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না। মিথ্যা বলা অসম্ভব। তার ওপর ওর অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কে দিয়েছে ফ্লাস্কটা ইতোমধ্যে সেই বিষয়ে জ্ঞান আছে তার। দায়সারা হয়ে বললাম,
-“বর্ষন এনেছে।”
উত্তর টা ওর পছন্দ হবে না জানতাম। ফজলু মাথা নেড়ে দাঁত খিলাই করতে করতে উঠোনে নেমে গেল।
-“একটু বাজারতন ঘুইরা আসি। আপনের কিছু লাগব?”

-“না।”

-“আইচ্ছা।”

***

ভেবেছিলাম এভাবেই দিন কেটে যেতে থাকবে। চাচ্ছিলাম আর যাইহোক। একেবারে যেন সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে আমাদের। কিন্তু এক এক করে এরপর তিনদিন কেটে গেল। বর্ষা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। না বর্ষা না বর্ষন। ভাইবোন কারোর কোনো খবর নেই। এদিকে গত দুদিন থেকে বর্ষার মায়ের বদলে সম্পুর্ন অপরিচিত একটি মহিলা এসে কাজ করতে শুরু করেছে।

বর্ষার কথা মনে রেখেছি আমি। যত কষ্টই হোক। নিজের মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেকে বারবার রুখেছি ওবাড়ি যাওয়া থেকে। ভেতরে ভেতরে আমার বিষন্ন মনে জখম ছড়াচ্ছে। বুঝতে পারছি আমাদের অগোচরে যে ভালোবাসায় শিশমহল গড়েছিলাম আমরা, তা খুব নাযুক অবস্থায় আছে। ভেঙে খান খান হয়ে যাবে যেকোনো সময়।

এই সময় আমার পাশে রশুর প্রয়োজন খুব বেশি অনুভব করছি। আমার মাথাটা অকেজো এখন। চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে। মস্তিষ্কের সমস্ত কার্যক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে ভালোবাসা নামক এক বিষাক্ত অনুভূতি!

রান্নার নতুন মধ্যবয়সী মহিলাটির নাম জমিলা। আমি ডাকি জমিলা চাচি। একেবারেই সহজ সরল । কাজে-কর্মে ভীষণ আন্তরিক।

বর্ষার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার চতুর্থ দিন। বিকেলে জমিলা চাচি উঠোন ঝাড় দিতে দিতে কথায় কথায় বললেন। এবাড়িতে করিমন বিবি অর্থাৎ বর্ষার মায়ের কাজ ছাড়ার কারণ। আজ বিকেলে পাশের গ্রাম থেকে পাত্র দেখতে আসবে বর্ষাকে। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় বসে ছিলাম। জমিলা চাচির কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই উঠে দাঁড়ালাম। পেয়ালা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। চারিদিকে চায়ের ছড়াছড়ি। আমি ক্রোধে অন্ধ হয়ে হাটা ধরলাম পুবে। বর্ষার বাড়ির দিকে। বসির শেখের সঙ্গে আজ অন্তিম বোঝাপড়া সেরে আসব।
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here