শব্দহীন_বৃষ্টি (১)

0
3968

বুকের আঁচল মাটিতে গড়াবে কেন? আর আঁচল সামলাতেই যদি না পারবে তবে শাড়িই পড়বে কেন? আনমনেই গর্জে উঠলো সাগর। কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি শেষে পরিষ্কার হয়েছে আকাশ। সাগরের আজ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়নি বলে বৃষ্টি থামতেই ছাঁদে এসেছিলো। পাশের বাড়ির এক মেয়ে নিজেদের ছাঁদে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিলো শাড়ি পড়ে। সাগর যখন সামনে তাকালো মেয়েটির আঁচল তখন নিচে গড়িয়ে পড়েছে আর তাতেই রাগ চড়ে যায় তার।মেয়েটি খুব একটা দুরত্বে নয় তবুও মুখটা অস্পষ্ট । সাগর অতিশয় ভদ্র, হাজী ছেলে মোটেও নয় কিন্তু হঠাৎ করেই তার খারাপ লাগলো এমনটা দেখে৷ বন্ধুদের সাথে তো হরদম সুন্দরী মেয়ে আর তাদের দৈহিক গঠন নিয়েও হাসি মশকরা চলেই। কিন্তু কখনও কোন মেয়েকে দেখে সামনাসামনি বাজে চোখে তাকায়নি। সাগরের নিজের কোন বোন নেই। তবে বাড়িতে আছে চাচাতো বোন তিনটা আর তিনটাই তার তুলনায় হাঁটুর বয়সি৷ তিন জনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সাথী ক্লাস এইটে পড়ে মেঝো যুথী ক্লাস ফাইভে পড়ে। আর তিথি বাড়ির সবচেয়ে কনিষ্ঠ ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সাগরের তথাকথিত বউ তিথি কলিজার এক অংশ। তিন বোনের নামকরণ সাগরের নিজেরই করা। সাগরের বড় ভাই সৈকত বিবাহিত তার বউ শিলা হঠাৎ ছাঁদে এসে ডাকলো তাকে ” সাগর একটা কাজ করে দাও না ভাই”।

–“কি কাজ ভাবি “?

–” একটু রেলস্টেশনে যেতে পারবে। প্লিজ না করো না”।

–“স্টেশনে কেন “?

–” আমার ফুপাতো বোন আসছে আজ সিলেট থেকে । ও ট্রেনে আসছে কিন্তু বিয়ের সময় ছিলো না তাই এ বাড়ি তার চেনা নয়”।

–” ওহ, কিন্তু আমি কি করে চিনবো তাকে?” সাগর বলতেই শিলা নিজের ফোনের গ্যালারি ওপেন করে কিছু ছবি দেখালো সাগরকে আর বলল ” ফোন নম্বরটা নাও ট্রেন থেকে তোমায় কল দিবে “।

–“ভাবীর বোনের মত এমন সুন্দরী এক বেয়াইন থাকতে আমি কিনা এখনও সিঙ্গেল ! এটা কোন কথা হলো? ফিসফিস করে বলল সাগর।

“আপনার বোন কোন ক্লাসে পড়ে ভাবী “? মিষ্টি করে হাসি দিয়ে ভাবীকে জিজ্ঞেস করতেই ভাবী সন্দেহি চোখে তাকালো সাগরের দিকে৷ এতে সাগর কিছুটা লজ্জাই পেল আবার অস্বস্তিতে ও পড়লো। মনে মনে ভাবলো “ভুল জায়গায় ভুল প্রশ্ন করেছি ।”

–” কি যাবে তো? ”

–” কখন পৌঁছুবে?”

–” বিকেল চারটা নাগাদ বলেছিলো। এখন তো পৌনে চারটা বাজে৷ তুমি এখনই চলে যাও আর নাও নম্বরটা তোলো তোমার ফোনে বলেই শিলা নম্বর বলল ।”

–” ভাবি আপনার বোন কি মালপত্র নিয়ে আসবে সাথে নাকি শুধু নিজেই আসছে?” সাগরের কথা শুনে শিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ সাগর বলল ” মানে হলো বাইক নিয়ে গেলে আসতে পারবে নাকি মালপত্রের জন্য ট্যাক্সি লাগবে “। শিলা বুঝলো সাগর কি বোঝাতে চাচ্ছে তাই বলল ” একটা ব্যাগ তো অবশ্যই থাকবে “।

–” ওহ, আচ্ছা”। বলে সাগর ছাঁদ থেকে নামলো৷ নেমে গেল শিলা ও।

পুরনো আমলের সাদাসিধা দোতলা বাড়িটির একমাত্র মালিক ছিলো সাগরের বাবা। সাগরের বাবার মেট্রিক পরীক্ষার সময় সাগরের দাদা মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয় সাগরের বাবা শহিদুল সাহেবকে। তিনি পরিবারের বড় ছেলে হয়ে সব দ্বায়িত্ব পালন করতে নিজের পড়াশোনা ছাড়েন। ছোট দু’ভাই আর এক বোনকে পড়াশোনা করান, সংসারের খরচ ও বহন করেন। একা সবটা সামলাতে না পেরে নিজের মামাদের সহযোগিতা ও নেন৷ সাগরের দাদী জমিজমা যতটুকু ছিলো সবটা বিক্রি করে নিজের বুদ্ধি আর বড় ছেলের পরিশ্রম মিলিয়ে মোটামুটি স্বচ্ছলতার জীবন তৈরি করেন। বাকি ছেলেদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার লক্ষে তাদের উচ্চশিক্ষিত ও করেন৷ আর বাড়িটি বড় ছেলের নাম করেন মনের ভয় থেকে৷ বড় ছেলে সবার কথা ভেবে পরিশ্রম করেন দিন শেষে ছোট ছেলেরা যদি বড় ছেলেকে কখনো কোন কারণে ধোঁকা দেয়? বড় ছেলে উচ্চশিক্ষিত নয় তার সম্বল শুধু ব্যবসাটাই। আর ব্যবসা যে সবসময় ভালোই চলবে তার কি গ্যারান্টি এসব ভেবেই বাড়িটা বড় ছেলে কে লিখে দেন। কিন্তু শহিদুল সাহেব বছর কয়েক চুপ থাকলে সৈকতের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বাড়িটি সমান ভাবে তিন ভাগ করেন। কারণ তিনি ভাইদের বাড়ি থেকে কখনো আলাদা না করলেও ছেলেরা যে করবে না তার বিশ্বাস নেই। আজকাল জমিজমা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে হাজারো শত্রুতার চোখে পড়ে তাই নিজে সবটা সমান করে ভাগ করেন আর বোনের ভাগের জায়গা বাড়িতে না দিয়ে বোনের নামে তার শ্বশুড়বাড়িতেই জমি কিনে দেন৷

সাগর যখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলো তখনই দেখলো বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়িতে ঢুকছে৷ সাগর এগিয়ে বাবাকে সালাম দিয়ে ব্যাগ নিয়ে নিলো। বাবা কোন কথা না বলে একবার সাগরের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন৷ এ বাড়িতে নিয়ম বাড়ির বড় ছোট সবাই সালাম দিতেই হবে৷ সাগর বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে মাকে ডেকে বলল বাজার কোথায় রেখেছে তারপরই চলে গেল রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে।

____________________

–“কখন থেকে বলছি এক কাপ চা করে দে তোর মামাকে। কথা কি কানে যায় না “? রেগে বললেন চামেলি বেগম। কিন্তু মাহির কানে কোন কথা গেলে তো! সেই কখন থেকে মায়ের মোবাইল ফোন নিয়ে বসেছে নিরবকে কল দিতে। কিন্তু কোন লাভ নেই নিরবের ফোন অনবরত ওয়েটিং এ৷ রাগে কষ্টে কান্না পাচ্ছে তার। নিরব বলেছিলো ” তোর যখন যা লাগবে আমাকে কল করে বলবি আমি এনে দেবো”। অথচ আজ তার কত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস লাগবে কিন্তু নিরব ভাইয়া কলই ধরছে না। নিশ্চিত ওই শাঁকচুন্নির সাথে কথা বলছে তাই ওয়েটিং এ। মাহির মামা এসেছে বৃষ্টি থামার পরপরই। ভালো পাত্রপক্ষ পেয়েছে তাই নিজের একমাত্র ভাগ্নীকে রেখে অন্য কোন মেয়ের কথা মাথায় আসেনি মাহির মামা সোহেল সাহেবের। লোকটা অতি ধুরন্ধর স্বভাবের বাইরের মানুষের কাছে। শুধুমাত্র নিজের ভাই বোনদের ক্ষেত্রে অতি দয়ালু। পেশা হিসেবে ঘটকালি বেছে নিয়েছেন৷ যদিও নিজে বিয়ের বয়স পার হওয়ার পরও বিয়ে করেন নি। আসলে পছন্দের মেয়েকে পরিবার মেনে নেয়নি তাই বাবা মায়ের বিপরীতে বিয়ে করেন নি। আর সেই কষ্ট থেকেই ঘটক হয়েছেন। খুঁজে খুঁজে প্রেমিক – প্রেমিকা পাত্র-পাত্রীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান দুই পক্ষের কাছে। এতে করে দু’জন ভালোবাসার মানুষকে সহজেই মিলিয়ে দিতে পারেন। এইতো ক’দিন আগেই নিজেদের প্রতিবেশি আযমের জন্য তারই গার্লফ্রেন্ড এর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। মেয়ে বাড়িতে নাকি প্রেমের বিয়ে কেউ মানে না তাই তিনি আযমকে পাত্র সাজিয়ে নিয়ে যান। ছেলে দেখে মেয়ের পরিবার পছন্দ করে বিয়ে দিতে রাজী হন। আযমের পরিবার ও মেয়ে পছন্দ হয়েছে বলে ধুমধামে বিয়ে দেন। কিন্তু এই মুহুর্তে ঝামেলা একটাই মাহি মুখ ফুলিয়ে ঘরে দোর আটকে বসে আছে। নিরব এখন ও কল ব্যাক করে নি। এদিকে তার মামা তার মা চামেলিকে বারবার বলছে “বুবু বিয়ের জন্য রাজী হয়ে যাও ছেলের গত মাসেই এম বি বি এস এর রেজাল্ট বের হয়েছে। কোটিপতির ছেলে নিজেদের হাসপাতাল আছে। ছেলে আবার লন্ডনে যাবে আরো পড়াশোনা করতে তাই বউ ও নিয়ে যাবে। আর বউ ও সেখানেই পড়াশোনা করবে”। শিমুল মামার কথা শুনে চামেলির মনে হয়েছে সমন্ধটা আসলেই লুফে নেওয়ার মত। কিন্তু মেয়ের বয়স মাত্র পনেরোয় পড়লো। পড়াশোনা ও মাত্র টেনে। তার উপর শিমুলের বর্ণনানুযায়ী ছেলেরা অর্থ পতিপত্তিতে তাদের থেকেও বিশাল ব্যবধানে উপরে। চামেলি বিশ্বাস করেন সম্পর্ক অসম হওয়া মানেই ভুল হওয়া। তবুও ভাইয়ের কথা ভেবে দেখতে হয়।
নিরব কল ব্যাক করেনি আর তাই মাহির মাথা বিগড়ে আছে। রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম ওদিকে শিমুল মামা বারবার ডেকে চলছেন চা খাওয়াতে। আসলে চা তো বাহানা উদ্দেশ্য ভাগ্নির মন খুঁচিয়ে দেখতে চান বিয়ে নিয়ে এই মুহুর্তে ধারণা কি তার! কিন্তু তা আর হলো কই দরজা খুলে বেরই হলো না। মাহির মা বলল ” তোর দুলাভাই বাড়ি ফিরুক। আগে তার সাথে কথা বলি পরে মাহিকে বলবো”। শিমুল বলল “ঠিক আছে”।

সাগর প্রায় পনেরো মিনিট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে শিলার ফুপাতো বোন দোলার জন্য । শিলা বলেছে চারটার মধ্যে চলে আসবে দোলা। কিন্তু কই! চারটা পনেরো বাজে এখনও তো এলো না। মেজাজ খারাপ লাগছে তার এখন। ভেবে নিয়েছে আর মাত্র পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে। তারপর আর থাকবে না। পাঁচ মিনিট পূর্ণ হওয়ার আগেই ফোন বাজলো সাগরের।নতুন নম্বর তবে অচেনা নয়। শিলা ভাবি নম্বরটি দিয়েছিলো আসার সময় সেইভ করতে ভুলে গিয়েছিলো সে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল, ” আপনি কি পৌঁছে গেছেন? আমি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়াচ্ছি “।
সাগর বেশ অবাকই হলো । এ কেমন মানুষ ফোন রিসিভ করে সালাম দোয়া নেই। ভদ্রতার কোন ছাপই নেই মনে হলো৷ যা হয় হোক আমার কি?

ভাবির বোনকে যখন খুঁজে পেল তখন চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসি আসি করছে সাগরের৷ ভাবির বোন তো ছবির থেকেও বেশি সুন্দরী আর বড় কথা হলো ড্রেসআপ যা করেছে তাতে বাড়িতে গেলে নিশ্চিত একটা হাঙ্গামা হবে। হোয়াইট লেগিংস, পিঙ্ক টপ না কি যেন বলে সেগুলো। বডি শেইপ যে এই মেয়ে লোক দেখানোর জন্যই এমন পোশাক পড়েছে তা নিশ্চিত । কিন্তু সাগর হেজিটেট ফিল করছে এমন একটা মেয়ের সাথে বাড়িতে যেতে। যদিও সে স্বইচ্ছায় আসেনি। কিছুই করার নেই মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বেয়াইনকে ওয়েলকাম করলো। ট্যাক্সি করে বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে মনে মনে দোয়া পড়ে নিলো যেন বাবার সামনে না পরতে হয়। দোয়া কবুল হলো বাবা বাড়িতে ছিলো না কিন্তু সাগরের মেজাজ খারাপ হলো সমুদ্র বাড়িতে ছিলো আর নতুন বেয়াইনকে দেখে পাশে পাশে ঘুরঘুর করছে। সমুদ্রটা এখন কিশোর বয়সী চোখের সামনে একটা মেয়ের এমন চলাফেরা তার মস্তিষ্কে খারাপ প্রভাব না ফেলে আবার। তার উপর সাথী,যুথী উফ,,,, সাগর আর ভাবতে পারছে না। ওয়েস্টার্ন পড়ে মেয়েটা পড়ুক কিন্তু তাতে উশৃংখলতার ছাপ কেন থাকবে? সমুদ্র আর তিথি দু ভাই বোন। বাড়িতে তারা মোট সাত জন ভাই বোন। সৈকত, সাগর দু ভাই তাদের বাবা পরিবারে সবার বড়। সমুদ্র আর তিথি দু ভাই বোন তাদের বাবা মেঝো আর সাথী,যুথি, শৈবাল তিন ভাই বোন তাদের বাবা সবার ছোট। বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য তিথি আর শৈবাল দু’জনেই ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে এ বছর।
___________________

মাহি সারা সন্ধ্যা কারো সাথে কথা বলেনি। মন খারাপ হয়েছে নিরব কেন একটা বার কল ব্যাক করেনি। তার উপর টানা কয়েকঘন্টা তার ফোন বিজি ছিলো। নিরব যখন কল ব্যাক করলো মাহি তখন রিসিভ করে একটি কথাই বলল, ” মরে গেছে মাহি তোমার জন্য। আজকের পর আর কোন দিন কল দিবে না এমনকি এ বাড়িতে পা ও রাখবে না “।

শব্দহীন_বৃষ্টি
(১)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

(শুরুটা একটু বোরিং হবে। ভালো না লাগলে এড়িয়ে যাবেন দয়া করে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here