একদিন নববর্ষা -৩৮

0
179

একদিন নববর্ষা -৩৮
অদ্রিজা আশআরী
____________
আনকোরা হাতে নিতিন কেকের ব্যাটার তৈরি করছে। দুপুরের এই সময় টা বাড়ি একদম নিঝুম থাকে। মা, দাদি যে যার ঘরে ভাতঘুম দেয়। অন্যদিন এই সময় নিতিন নিজের ঘরে গল্পের বই পড়ে। রিনাকে ঠেলে রান্নাঘরে পাঠায় কফি বানিয়ে দেবার জন্য। আজ অবশ্যি পরিস্থিতি ভিন্ন। রিনা যেন হুট করে এখানে চলে না আসে সে ব্যাপারে কড়া নজর রাখছে নিতিন!

ব্যাটারে কোকো পাউডার মেশাতে মেশাতে নিতিন আনমনে হাসল। ঝলমলে হাস্যজ্বল ছেলে রাশিক। ভারি দুরন্তও বটে। নিতিন কে কখনো চুপ থাকতে দেয় না। সারাক্ষণ নানান কথার জালে হাসিতে মাতিয়ে রাখে। রাশিকের মাঝে অনন্য একটা প্রভাবক ক্ষমতা আছে। এটাই রাশিককে বাকি সবার থেকে আলাদা আর আকর্ষণীয় করেছে। কিছুক্ষণ ওর আশেপাশে থাকলে আফিমের মতো ওর কথাবার্তা মস্তিষ্কে আর মনে প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। নিতিন বহু আগেই সেই আফিমের নেশায় আকণ্ঠ অবগাহন করেছে। শুরুটা স্কুলের সামনে ফুচকার ভেন থেকে। ওর প্রতি রাশিকের একটা বিশেষ অনুভূতি আছে সেটা ওরা বন্ধুরা সকলেই টের পেয়েছিল। বন্ধুদের প্ররোচনায় তারপর একদিন রাশিকের সঙ্গে কথাও হয়ে গেল। বিনিময় হলো ফোন নম্বর।

সদ্য পনেরোতে পা রাখা চঞ্চল কিশোরী নিতিন। চোখে রঙ্গিন চশমা থাকার সুখটা সবে উপভোগ করতে শুরু করেছে ওর ঝোড়ো মন! রঙ্গিন চশমায় দুনিয়ার সবকিছুই বড় সুন্দর দেখায়। এইযে রাশিক নামের বেপরোয়া, ভবঘুরে ছেলেটি। সে যেন আফিমের মাদকতা ছড়িয়ে দিয়েছে নিতিনের দু’চোখে। ওর সঙ্গ ছাড়া নিতিনের দিনগুলো বড় দুর্বিষহ মনে হয় আজকাল।

রাশিক চকলেট খেতে খুব ভালোবাসে। প্রতিবার ওদের দেখা হলে, খানিকক্ষনের ঘোরাঘুরি শেষে যখন কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে,সবসময় নিজের জন্য চকলেট জাতীয় কিছুই অর্ডার করে রাশিক। চকলেট আইসক্রিম, চকলেট পেস্ট্রি, চকলেট শেক…।
নিতিন একবার জিজ্ঞেস করেছিল,
–‘ সবসময় শুধু চকলেট কেন রাশিক? পৃথিবীতে চকলেট ছাড়াও আরো অনেক ভালো খাবার আছে।’
রাশিক ফিচেল হেসে বলল,
–‘ পৃথিবীতে মমতাজ ছাড়াও কিন্তু অনেক সুন্দরী মেয়ে ছিল। কিন্তু শাহজাহান ওই একজনের জন্যই তাজমহল গড়েছিল। ‘
–‘ধ্যাৎ! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! ‘
–‘ যাই বলো। তবে তুমি নিজেও কিন্তু চকলেটের মতো। ওইযে ক্যাডবেরী ডেইলি মিল্ক বাবলি আছে না? একদম ওটার মতো। যদিও এখনো টেস্ট করে দেখা হয়নি। ‘ নিতিনের আত্মা ধক্ করে উঠল। টেস্ট কথাটা বলে রাশিক ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছে! রাশিক কথায় কোনো রাখঢাক রাখতে জানে না। তবে সে যা ভাবছে, রাশিক নিশ্চয়ই ততটা খারাপ ছেলে নয়!

ইউটিউব দেখে দেখে নিতিন শেষপর্যন্ত চকলেট কেক তৈরি করে ফেললো। রাফিয়ার কাছে পূর্বেই অনুমতি নিয়ে রেখেছিল। বিকেলে বন্ধুর বাড়ি যাবে গ্রুপ স্টাডি করতে। তাই যখন কাঁধে স্কুল ব্যাগ ঝুলিয়ে ভেতর টিফিনবাক্সে কেক নিয়ে বেরোল সে, রাফিয়া দেখেও কিছু বললেন না।
গাড়ি সঙ্গে না নিলে মা সন্দেহ করতে পারে। এরও একটা সমাধান নিতিন ভেবে রেখেছিল। কাটাবন পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সে। সাহেদ কে বলল বন্ধু ঐশী এখানে ওকে নিতে আসবে। ঐশীর বাড়ি কাটাবনেই। মাঝেমধ্যেই আসা হয় নিতিনের। তাই সাহেদও বেশি কিছু না বলে ফিরে গেল। গাড়িটা দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করতেই নিতিন রিকশা ডাকল। গন্তব্য অদূরেই, মধুর ক্যানটিনে।

সন্ধ্যায় নিতিন ফিরল ভীষণ আনমনা হয়ে। যাবার বেলার উৎফুল্লতার ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। রাশিক আজ বেশ অদ্ভুত একটা আবদার করেছে। একেবারে প্রত্যক্ষ আবদার ঠিক নয়। ঘুরিয়ে পেচিয়ে। বলা যায় সেই আবদারটাই এখন ওর সকল দুঃশ্চিন্তার কারণ।

নিতিন বেশ হাতখোলা মেয়ে। নিতিনের উপস্থিতিতে অন্যকেউ খরচ বহন করবে ব্যাপার টা ওর ঠিক পছন্দ নয়। রাশিকের সঙ্গে ঘোরাফেরার সময়ও সর্বদা রেস্টুরেন্টের বিল সহ যাবতীয় খরচ নিতিন পরিশোধ করে এসেছে। রাশিক খানিকটা বোহেমিয়ান ধরনের জীবন যাপনে অভস্ত্য। পড়াশোনার সুবাদে শহরে একা মেসে থাকে। মাস শেষ না হতেই ওর টানাপোড়েন লেগে যায়। সেসব নিতিনের অজানা নয়। তাই নিতিন চেষ্টা করে রাশিক কে যতটা সম্ভব ভারমুক্ত রাখতে।

নাব্যর একমাত্র আদরের ছোট বোন সে। নাব্যর কাছে চাওয়া মাত্র টাকা পেয়ে যায়। কৈফিয়ত দিতে হয়না কখনো। রাফিয়া অবশ্য এসবের ঘোর বিরোধী। সেজন্য নিতিন আজকাল মায়ের অজ্ঞাতে ভাইয়ের কাছ থেকে হাত খরচের নামে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়।

বিকেলে দেখা করতে এসে রাশিক বেশ আরম্বিক গলায় জানাল টিউশনির এই সামান্য টাকা দিয়ে ওর আর চলছে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে নিতিনের পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার আগে ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তো! এদিকে সেশন জটের খপ্পরে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। কবে এখান থেকে বেরোবে, মাস্টার্স করবে আর তারপর চাকরিতে ঢুকবে। ততদিনে নিতিনের পরিবারে বিয়ের তোরজোর শুরু হয়ে যাবে। তাই রাশিক চায় উদ্যোক্তা হতে। সল্প পরিসরে একটা ব্যাবসা শুরু করবে সে। যেটা ওকে নিজের একটা আলাদা পরিচয় গড়তে সাহায্য করবে।
এজন্য রাশিকের অনেক টাকার প্রয়োজন। গ্রামে বাবার সঙ্গে কথা বলে কয়েক লাখ টাকার ব্যাবস্থা করেছে সে। আর কিছু টাকা হলেই এবার সে একটা কিছু শুরু করতে পারে। এতসব কথার দ্বারা রাশিক কি ইঙ্গিত করেছে নিতিন সেটা বুঝল। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে মিনমিনে গলায় বলল,
–‘ তোমাকে সাহায্য করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগতো রাশিক। কিন্তু আমার কাছে এত টাকা নেই, যতটা হলে তোমাকে সাহায্য করা যায়। ‘
নিতিনের কথা শুনে রাশিক কিছুটা বিরক্ত হলো।
–‘ তোমার কাছে আমি টাকা চাইছি না নিতিন। আমি শুধু আমার সিচুয়েশন টা তোমার সঙ্গে শেয়ার করলাম। রুমমেটদের কাছে ইতোমধ্যে এত বেশি ধার জমে গেছে যে সেগুলো শোধ না করলে আপাতত কোনো প্রকার সাহায্যই ওদের কাছ থেকে পাওয়ার আশা রাখা যায় না।
আর ফিনানশিয়াল হেল্প বাদ দিলাম। ওরা পাশে না থাকলে এমনিতেও আমি ব্যাবসা টা দাঁড় করাতে পারবো না। ‘

ফিরে এসে নিতিন সে’রাতে অনেক ভাবলো। সকলের বড় আদরের মেয়ে সে। প্রতিবার ওর ঈদের প্রাপ্য সালামির পরিমাণ গিয়ে অযুতে ঠেকে। সেই টাকা গুলো কখনো তেমন ভাবে খরচ করা হয়নি। কারণ মাস শেষ হবার আগেই নাব্য ওকে চাহিদার চেয়ে বেশি টাকা দিয়েছে সবসময়।

পরের দু’দিন নিতিন শুধু ভাবল। ওর মনও বেশ খারাপ রইল। কারণ সেদিন বিকেলের পর থেকে রাশিক ওর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে না। এই দু’দিনে রাশিক একবারও নিজে থেকে কল দেয় নি। নিতিন যতবার কল দিচ্ছে, রাশিক ছাড়াছাড়া ভাবে দু একটা কথা বলে কল কেটে দিচ্ছে। তাতে নিতিনের নাওয়া-খাওয়া সিকেঁয় উঠেছে। রাশিকের সঙ্গে কথা বলতে না পেরে দম বন্ধ লাগছে ওর। মনে হচ্ছে রাশিক নামক আফিমের সংস্পর্শ না পেলে এবার মা’রা পড়বে ও।

তৃতীয় দিন সকালে নিতিন বেশ উৎফুল্ল হয়ে রাশিকের নম্বরে ডায়াল করল। কল রিসিভ করে পূর্বেকার মতোই রাশিক গা ছাড়া ভাব দেখালো। তবে আজ নিতিন আর সেসবের পরোয়া করল না। উত্তেজিত গলায় বলল,
–‘ আর মুখ গোমড়া করে না থেকে এখন একটু হেসে ফেলো তো রাশিক।’
–‘ আমার হাসি পাচ্ছে না। ‘
–‘ পাবে। তোমার হাসি পাবার ব্যাবস্থা করেছি আমি। হাসির শব্দ শোনা মাত্র সবকিছু বলব তোমায়। ‘
রাশিক এবার সত্যিই হেসে ফেললো। কণ্ঠে দায়সারা ভাব বজায় রেখে বলল,
–‘ কি বলবে?’
–‘ রাশিক, টাকার ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। যদিও খুব বেশি না। তবে ব্যাবসা টা এবার শুরু করতে পারবে হয়তো তুমি! ‘
–‘সত্যি! নিতিন তুমি সত্যি টাকা’টা ম্যানেজ করে ফেলেছো? আমি জানতাম, তুমি ঠিক পারবে।’
–‘নব্বই হাজার টাকা ম্যানেজ করেছি আমি। সরি এর বেশি সম্ভব হয়নি। টাকা নিয়ে কবে আসবো বলো?’
রাশিক কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
–‘ কষ্ট করে আজ সন্ধ্যায় একবার আসতে পারবে হাজারিবাগে? ‘
–‘সন্ধ্যায়? ‘
–‘ কেন? খুব অসুবিধা হয়ে যাবে? ‘
–‘ না না। সমস্যা নেই। আমি ম্যানেজ করে ফেলবো। ‘

মা, দাদি মাগরিবের সালাতে দাঁড়িয়েছেন। সালাতের পর মাসনুন আমল শেষে দাদির ঘরে যাবেন রাফিয়া। তারপর শাশুড়ীকে সঙ্গে নিয়ে ডাইনিং এ আসবেন। সেখানে বসবে সন্ধ্যার চা-আড্ডা। তখন হয়তো ডাক পড়বে নিতিনের। নিতিন সাড়া না দিলে রাফিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন। তারপর শাশুড়ীকে নিয়েই চা পান করে উঠে যাবেন।

ধাপগুলো নিতিনের মুখস্থ। যতক্ষণে নিতিনের ব্যাপারে তিনি খোঁজ শুরু করবেন সেই সময়ের আগেই নিতিন ফিরে আসবে। আর একটু দেরি হলে নাহয় বলে দেয়া যাবে নিচের বাগানে বসেছিল। ডাক শুনতে পায়নি।

নিতিন চুপিসারে গেইট খুলে বেরিয়ে এল। বাড়ির সামনে থেকে রিকশা নিল হাজারিবাগের উদ্দেশ্যে। রিকশাটা চলতে শুরু করল সন্ধ্যায় ঝাপসা আলো মাখা নগরীর মধ্য দিয়ে। নিতিনের মনে কোথায় যেন একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। রাশিকের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর পর থেকে অনবরত নিজের আপন মানুষ গুলোর চোখে ধূলো দিচ্ছে সে। সম্পর্ক টা আড়াল করতে একের পর এক মিথ্যে বলতে বলতে আজকাল মিথ্যা বলাটা ওর জন্য ডালভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগেও, গাড়ির ভেতর থেকে কাঁচের বাইরে চোখ ফেললে, শহরটাকে খুব অচেনা মনে হতো ওর। অথচ আজকাল রাশিকের জন্য একা রিকশায় চড়ে দূর দূরান্তে ছুটে যেতেও দ্বিধা করে না সে! এসব জানলে মা আর দাভাই কতো কষ্টই না পাবে!

হাজারিবাগের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করল নিতিন, আজকের পর থেকে রাশিকের সঙ্গে এভাবে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা বন্ধ করে দেবে সে৷ রাশিক হাজার বললেও আর কখনো মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে না।

হাজারিবাগে বেশ একটা নিরিবিলি স্থানে রিকশা থামাতে বলল সে। রিকশা ওয়ালা আড়চোখে তাকাল ওর পানে। এই ভর সন্ধ্যায়, এমন নিরব রাস্তায় একা একটি মেয়ে কি প্রয়োজনে আসতে পারে ভাবছে হয়তো! ভাড়া মিটিয়ে এদিকসেদিক তাকাল নিতিন। রিকশাওয়ালা চলে যেতেই জায়গাটা আরও বেশি সুনশান মনে হচ্ছে। রাশিক কেন এরকম একটা জায়গায় আসতে বলল ওকে?

প্রায় পনেরো মিনিট পার হয়ে গেল রাশিকের আসার কোনো নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। টাকার ব্যাগটা নিজের সঙ্গে চেপে ধরে রাশিকের নম্বরে অনবরত ডায়াল করে যাচ্ছে নিতিন। রাশিক কল রিসিভ করছে না। আতঙ্কে নিতিনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। মা হয়তো এরই মধ্যে খোঁজ শুরু করেছেন৷ ঘরে গিয়ে ওকে না পেলে কি করবেন কে জানে! নিতিনের মনে হলো এই ভর সন্ধ্যায়, রাশিকের কথায় ভরসা করে এই অচেনা জায়গায় আসা ওর চরম ভুল হয়েছে। আশেপাশে একটা রিকশা পর্যন্ত নেই। আসার সময় ভেবেছিল রাশিক ওকে রিকশায় উঠিয়ে দেবে। তাই রাস্তাঘাটও অত খেয়াল করে আসেনি।
নিতিনের হৃদকম্পন ঝড়ের বেগে বাড়তে লাগল। রাশিক যদি না আসে তবে একা কিভাবে বাড়ি ফিরিবে সে আজ?

আরও প্রায় মিনিট দশেক পর একটা সরু গলির ভেতর থেকে আচমকা আবির্ভাব ঘটল রাশিকের। নিতিন ওকে দেখে দৌড়ে কাছে গেল। কেন এতো দেরি হলো, ফোন ওঠাচ্ছিল না কেন….. একের পর এক প্রশ্ন করে চলল সে। লক্ষ্য করল রাশিক কোনো উত্তর দিচ্ছে না। অকস্মাৎ রাশিকের পেছনে তাকিয়ে থমকে গেল সে। জমাট বাঁধা অন্ধকার ভেদ করে একেবারে যেন ভূতের মতো বেরিয়ে এল ঐশী। নিতিনের বেস্টফ্রেন্ড।
–‘ ও…ঐশী তুই এখানে?’
ঐশী নিঃশব্দে রাশিকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিতিন হা করে তাকিয়ে রইল। ওকে আরও অবাক করে দিয়ে রাশিক হঠাৎ রুক্ষ স্বরে বলল,
–‘টাকা গুলা দে।’
–‘রাশিক তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? ঐশী তোমার সঙ্গে কিভাবে এলো? তোমার আমার সাথে মজা করছো তাই না?’
রাশিক আবার বলল,
–‘ বেশি কথা কইস না টাকা দে।’
নিতিনের হতবিহ্বল ভাব কাটবার আগেই ঐশী এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে টাকার ব্যাগটা ছি’নিয়ে নিয়ে ওকে ধা-ক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে।

পড়ে গিয়ে ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠল নিতিন। কান্নাজরিত গলায় বলল,
–‘রাশিক এসব কি হচ্ছে? তুমি কিছু বলছো না কেন? তোমার সামনে ও আমাকে….’
–‘ ও কি বলবে? খুব তো এতোদিন আমার প্রেমিককে নিয়ে শহর চষে বেড়িয়েছিস !’
–‘তোর প্রেমিক! কে তোর প্রেমিক?’
-‘রাশিক। রাশিকের সাথে আমার দুই বছরের রিলেশন। পরিবার সম্পর্ক টা মানতে নারাজ। আমরা পালানোর প্ল্যান করেছি। কিন্তু সেজন্য অনেক টাকার দরকার। তাই আমিই বুদ্ধিটা দিয়েছিলাম রাশিক কে। তোর সঙ্গে প্রেমের নাটক করার। বোকা মেয়ে! আমি জানতাম তুই ফাঁদে পা দিবি। তবে এত অল্পদিনের পরিচয়ে প্রেমিককে এতোগুলো টাকা দিতে রাজি হয়ে যাবার মতো বোকামি তুই করবি সেটা ভাবিনি। এখন চুপচাপ বাড়ি চলে যা। আমাদের খবর কাউকে জানালে তোর ছবিগুলো রঙচঙা ভাবে এডিট করে ভাইরাল করবো। মনে থাকে যেন। চলো রাশিক।’
কথা শেষ করে ঐশী ঘুরে হাটা ধরতেই রাশিক বলল,
–‘দাঁড়াও। ওর ফোন আর হাতের ব্রেসলেটটা খুলে নিয়ে যাই। বিপদে এগুলোও কাজে লাগতে পারে। ‘
রাশিক উবু হয়ে নিতিনের হাত থেকে নিষ্ঠুর ভাবে টেনে ব্রেসলেট টা খুলে নিল। হিং’স্র গলায় বলল,
-‘ফোন টা কোথায় রেখেছিস? জলদি বের কর।’ নিতিন কম্পিত হাতে পার্স থেকে ফোন বের করার সঙ্গে সঙ্গে সেটা একটানে ছি’নিয়ে নিয়ে ঐশির পেছন পেছন হাটতে আরম্ভ করল রাশিক।

নিতিন মূঢ়ের ন্যায় স্থবির হয়ে মাঝরাস্তায় বসে রইল। ঝর্ণাধারার মতো ওর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ব্রেসলেট টা হিরের ছিল। নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করায় বাবা খুশি হয়ে ওটা ওকে গিফট করছিল। বাবার অন্যতম প্রিয় স্মৃতি ছিল এই ব্রেসলেট টা । কতবার বাবার কথা মনে করে ব্রেসলেটে চুমু খেয়েছে সে। সেটাও ওই প্রতারক নিয়ে গেল!

নিতিনের কাছে মনে হলো যেন ঐশীর দেয়া ধা-ক্কাটার সঙ্গে সঙ্গে রাশিক নামক আফিমের কড়া আবেশ থেকে বেড়িয়ে এসেছে সে। ওর এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রাশিক এমনটা করেছে ওর সঙ্গে! রাশিক ছিল ওর জীবনের প্রথম আবেগ। রাশিকের মোহ ওর রন্ধে রন্ধে এমন ভাবে মিশে গেছিল যে ওকে ছাড়া নিজের অস্তিত্বও কল্পনা করতে পারতো না সে। সেই রাশিক এতো জঘন্য ভাবে ওকে ঠকালো!

সত্যি মিথ্যের পরোয়া না করে রাশিককে বিশ্বাস করে এতো গুলো টাকার ব্যাবস্থা করেছে সে। বলাই বাহুল্য এর জন্য কিছুটা অসৎপথ অবলম্বন করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সেসব কিছুকে রাশিকের ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ মনে করে নিতিন নির্দ্বিধায় কাজটা করেছিল। নব্বই হাজার টাকার মধ্যে মাত্র ত্রিশ হাজার ছিল নিতিনের নিজের সঞ্চয়। ঈদের সালামির টাকা গুলো জমিয়েছিল সে।
নিতিনের ভাবলেও লজ্জা করছে বাকি ষাট হাজার টাকা দাভাইয়ের আলমিরা থেকে সরিয়েছে।

ব্যাবসার কাছে ব্যাবহৃত বেহিসেবী টাকা নাব্যর আলমিয়ার থাকে। নিতিন সেখান থেকেই গোপনে সরিয়েছিল টাকা। ভেবেছিল যে করেই হোক, নাব্য টের পাওয়ার আগেই স্বস্থানে রেখে দেবে। হুট করেই ষাট হাজার সংখ্যা টা বড় বেশি ভারি মনে হলো নিতিনের। এমন একটা নিকৃষ্ট কাজ সে কিভাবে করে ফেললো!

কৈশোরের প্রথম প্রেমের এতো জঘন্য সমাপ্তি আর নিজের বোকামির কথা ভেবে রাস্তায় বসেই নিতিন হাউমা’উ করে কেঁদে উঠল। ঠিক করল আর কখনো বাড়ি ফিরবে না। এই কলুষিত মুখ আর কখনো দেখাবে না মা, দাদি আর দাভাইকে। যা খুশি ঘটে যাক আজ, সে এখানেই বসে থাকবে। খুব বাজে কিছু যদি হয় ওর সঙ্গে, তবে ধরে নেবে সেটা ওর চরম পাপের শাস্তি!

—————–

দ্বিতীয় বারের মতো ফোন বেজে ওঠায় নাব্য রিসিভার কানে তুললো।
–‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।’
সালামের উত্তর দিয়ে ওপাশ থেকে বর্ষা রিনরিনে স্বরে একটু হাসির ঝংকার তুলে বলল,
–‘ কি করছিলে?’
নাব্য দায়সারা গোছের উত্তর দিল,
–‘কাজ।’
–‘ এখনো অফিসে? অসময়ে ফোন দিয়ে ফেললাম বোধহয়!’
নাব্য কিছু বলল না।
বর্ষাই ফের বলল,
–‘ তোমার বউ কেমন আছে?’
–‘ বোধহয় ভালোই আছে।’
–‘ এখনো কি বাবার বাড়িতেই? আচ্ছা.. বাচ্চা কি হবে ডক্টর বলেছে কিছু? ছেলে নাকি মেয়ে?’
–‘ জানি না। ‘
–‘সত্যিই জানো না!’
–‘ না। কি বলতে ফোন করেছ এখন জলদি সেটা বল। আর… তোমাকে তো আমি বলেছিলাম যেকোনো দরকারে আমাকে ফোন না করে রশু জানাতে। ‘
বর্ষার গলায় মন খারাপের সুর ভেসে এলো,
–‘ সেকথা ভুলিনি। আসলে বর্ষন কিছুদিন ধরেই তোমাকে দেখার বায়না করছিল তাই…..। সেদিন যে বর্ষনের অনুরোধে তুমি আমাদের ঘুরতে নিয়ে গেলে। তাতেই ওর মনে বড় লোভ বেড়েছ। সারাক্ষণ শুধু বাইরে যাবার জন্য বায়না….’

সেদিন’টার কথা মনে পড়ল নাব্যর। একটু বেশিই বদান্যতা দেখিয়েছিল সে। যার ফলাফল হয়েছিল ভয়ংকর। বর্ষনের কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য ওরা ভাইবোন বেড়িয়েছিল। মার্কেট থেকে ফেরার পথে রাস্তা হারিয়ে ফেললো বর্ষা। কল করল নাব্যকে। রশু তখন চট্টগ্রামে। তাই বাধ্য হয়ে নাব্যকেই আসতে হলো। বর্ষন বায়না করছিল কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য। ওরা উত্তরার কাছাকাছি থাকায় নাব্য গাড়ি ঘোরালো দিয়াবাড়ির দিকে।
সেখান থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যার রাস্তায় শ্বাসরোধী যানজটে আটকা পড়ল ওরা। গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল একটা বেবিশপ কে সামনে রেখে। হঠাৎ নাব্য খেয়াল করল, মলের পাশে পার্কিং লটে বাবার প্রিয় গাড়িটা। ভেতরে সাহেদ সিটে গা এলিয়ে শুয়ে আছে।
রাতে বাড়ি ফিরে নিতিন কে জিগ্যেস করে জানলো বর্ষাকে নিয়ে ওই বেবিশপে গেছিল নিতিন।
নিতিন নাব্যকে দেখেনি এই ব্যাপার নিশ্চিত। কিন্তু বর্ষাও যে দেখেনি সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা কোথায়! নাব্যর মনে খচখচানিটা বাড়ল যখন দেখল সেদিন থেকে বর্ষা ওকে এড়িয়ে চলছে।
অথচ বর্ষার ওকে উপেক্ষা করে যাবার ব্যাপার টা যে ওকে খুব বেশি কষ্ট দিল তা নয়। নাব্য জানে না মনের এই অদ্ভুত অবস্থার নাম কি! যেদিন গরানবনের সেই পুরনো বর্ষা ম্লান মুখে, মলিন পরিচ্ছদে ওর অফিসে এসে পা রাখল, সেদিন থেকেই সব ওলটপালট হয়ে গেল! বর্ষা যেন বসন্তের মতোই রঙিন ফুলের পসরা নিয়ে এসে, যাওয়ার বেলায় রাশি রাশি ঝরা পাতাবিছিয়ে দিয়ে গেল ওর মনের নরম মাটিতে।

তারপর থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক টা ফিঁকে হয়ে আসতে শুরু করেছে ওর। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে একটা প্রচ্ছন্ন অভিমানের দেয়াল। কতবার…কতবার নাব্য সেই দেয়াল ভেঙে ওপারে প্রবেশের পথ খুঁজেছে। কিন্তু প্রতিবার হেরে গেছে সে নিজের কাছে। বর্ষার ফেলে যাওয়া সেই ঝরা পাতা বিছানো ধূসর পথ, দিনরাত ওকে টেনেছে একটা ভুল, আচ্ছন্নতায় পূর্ণ অপরিচিত পথের দিকে। নাব্য বার বার ফিরে আসতে চেয়েছে। কিন্তু প্রতিবার আরও বেশি জালে জড়িয়ে গেছে…

–‘হ্যালো.. হ্যালো…. নাব্য কথা বলছো না কেন?’
বর্ষার কথায় সম্বিত ফিরে পেল নাব্য। ডেস্কের অন্যপাশে থাকা সেলফোনটা অনবরত বেজে যাচ্ছে। নাব্য ভ্রু কুঞ্চিত করে ওপরের নামটা দেখল।
–‘ একটা জরুরি ফোন এসেছে। রাখছি এখন। ‘
বলে এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে লাইন কেটে দিল।
বাজতে থাকা অপর ফোনটা কানে তুলতেই রাফিয়া উত্তেজিত গলায় বললেন,
-‘ নবু নিতিন কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনও বন্ধ।’ বলেই কান্না জুড়ে দিলেন তিনি।
-‘ কি! কখন থেকে খুঁজে পাচ্ছো না?’
-‘সন্ধ্যার পর ওকে আর দেখেনি বাড়ির কেউ।’
নাব্য দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। নয়টা পঞ্চান্ন মিনিটে ঘড়ির কাঁটা স্থির হয়ে আছে। এতো সময় ধরে নিতিন নিখোঁজ!
নাব্য চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে বেরোতে বেরোতে বলল,
-‘ তুমি অপেক্ষা করো আম্মা। আমি এক্ষুনি আসছি।’

চলবে ইন শা আল্লাহ …….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here