একদিন নববর্ষা -৩৯

0
127

একদিন নববর্ষা -৩৯
অদ্রিজা আশআরী
___________
ফেব্রুয়ারী মাস। সাভারে বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে শীত। সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত কুয়াশায় আচ্ছন্ন রয় চারপাশ। দুপুরের আগে সূর্যের দেখা পাওয়া দুষ্কর বলা চলে।

আজ প্রায় তিনদিন পর সকালে একটু রোদের দেখা মিলল। নাহয় দুপুর গড়ালেও আকাশের সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব টা রোজ তেমনি রয়ে যায়।

শৈত্যপ্রবাহের কারণে গত তিনদিন কেটেছে পুরোপুরি রোদহীন! একটু রোদ্দুর পেয়ে তাই বর্ষা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। উঠোনে কিঞ্চিৎ সময় হাটাহাটি শেষে বসল চৌকাঠের নিচ থেকে শুরু হওয়া সিড়ির প্রথম ধাপে। সকালের মখমলি রোদ, আলোছায়ার আবর্তে ছুটে বেড়াচ্ছে ওকে ঘিরে। বাড়ির সামনে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আম গাছটির পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো রোদেরা এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। সকালের আকাশে আজ পাখির আনাগোনা বেশ। সেদিকে তাকিয়েই বর্ষা বুঝতে পারে। ওরা সবাই বহু প্রতীক্ষিত রোদের আগমনে আনন্দিত। তাই সূর্যের আলোকে ঘিরে ওভাবে বৃত্তাকারে ঘুরছে।

নির্মল শুভ্র মেঘের আস্তরণ পড়েছে সকালের নীল ঝকঝকে আকাশে। এমন দিনে সবকিছু ভালো লাগে। অকারণে মন বারবার পরিতোষের কল্লোলে ভাসে।

————

তার ঘন্টা-দুই পরের চিত্র।
বর্ষা তখনো বসে আছে সিড়ির ধাপে। রোদটা এবার বেশ চড়া হয়েছে। খানিক আগেও যে রোদ ত্বকে মখমলি পেলবতা ছড়াচ্ছিল, সে রোদ এখন গা পুড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ বর্ষা বোধহীন। নির্বিকারে স্বস্থানে বসে আছে। রোদের তেজী উত্তাপ গায়ে লাগছে, তবুও জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছে না। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। যেখানে কয়েকটি পিঁপড়ে খড়খুটোর একটি ছোট টুকরো টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের গোপন আস্তানায়।
বাম চোখের কোলাজ থেকে জলের একটি বিন্দু তখনি নামল ওর গাল বেয়ে। নিজের দুঃখী মনটাকে আর প্রশ্রয় দিতে চায় না। তাই চোখ কাঁদলেও আজ ওর মন অবিচল! সে কথা প্রমাণ করতেই যেন অকম্পিত, স্থির চোখে পিঁপড়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল সে।

ভেতর থেকে নাসিমার চড়া গলার কথা শোনা যাচ্ছে। সেসব অবশ্যই সুখের কথা নয়। গলা উচ্চগ্রামে চড়িয়ে তিনি বলে চলেছেন পোড়া কপালি মেয়েকে নিয়ে নিজের দুর্ভোগের কথা। শত শ্লেষাত্মক কথার আঘা’তে, মর্মভেদী অভিশাপে জর্জরিত করছেন মেয়েকে। ফাবিহা নিজের ঘরে বাচ্চা নিয়ে ব্যাস্ত। তবে ওর মনেও কোথাও যেন একটু চিত্তপ্রসাদের তৃপ্তি।

ফাবিহার মতো নাসিমা আজকাল বর্ষার এখানে পড়ে থাকাটাকে ভালো চোখে নিচ্ছেন না। ফাবিহা যথেষ্ট চতুর মেয়ে। সে সোজা কথায় কিছু বলে না কখনো, বর্ষার এখানে থাকা নিয়েও ওর যা আপত্তি সেসব আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েই খান্ত ছিল। কিন্তু নাসিমা ব্যাতিক্রম। কোনো প্রকার ভদ্রতারই ধার ধারেন না তিনি। কোনো কিছু অপছন্দ হওয়া মাত্র মুখের ওপর সেই কথা বলে দেয়া স্বভাব তার। তাই যখনি বুঝলেন বর্ষা এখানে নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য আসেনি। এসেছে অগণিতকালের বোঝা হয়ে। স্বামীর সঙ্গেও ওর সম্পর্ক ঠিক সুবিধের যাচ্ছে না। হয়তো আগে থেকেই বর্ষাকে এখানে গছিয়ে দেবার অভিপ্রায় ছিল নাব্যর। এইবার সুযোগ পেয়ে সে কাজটাই করেছে। নয়তো অমন গা-ছাড়া কেন হবে ওদের ভাব একে অপরের প্রতি? সেই প্রথম থেকেই, মেয়েকে স্বামী সঙ্গে কখনোই সখ্য গড়তে দেখেননি তিনি।

এতে অবশ্যি নাব্যর দোষও খুব বেশি দেখেন না নাসিমা। ও হলো পুরুষ মানুষ। মন তো একটু উড়ো উড়ো থাকবেই। সেটা সামলে নেয়া তো স্ত্রী হিসেবে বর্ষার কর্তব্য ছিল। কিন্তু ওই অপয়া, অভাগী মেয়ে একাজেও ব্যার্থ হয়েছে। স্বামীর মন জয় করতে পারেনি। যার দায় এখন নাসিমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। তার নির্ঝঞ্ঝাট সোনার সংসারে উটকো ঝামেলা এসে জুটেছে।

বর্ষার প্রতি নাসিমার আচরণে এখন সর্বদাই প্রবল আগ্রা-সী ভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রতিদিন, বর্ষার কখনো শেষ না হওয়া ভুলগুলো নতুন ভাবে আবিষ্কার করেন তিনি। সাজিয়ে বসেন অভিযোগের পসরা। রোজ রোজ অকথ্য গা’লিগালাজ, তিরষ্কারের লাঞ্ছনায় বিদ্ধ করেন মেয়েকে। ততক্ষণ পর্যন্ত থামেন না, যতক্ষণ না মেয়েকে অপমানে, আঘাতে নিষ্পেষিত করে আত্মতুষ্টি লাভ হয়। এসবের শুরু সেদিন থেকে, যেদিন ফাবিহা কথা তুলেছিল বর্ষার স্বামী ও শশুড়ালয় নিয়ে। রাখঢাক হীন ভাবে একে একে সব কথা উগ্রে দিয়েছিল নাসিমার কাছে।

সেই কষ্ট গুলো, যেগুলো খুব সন্তর্পণে এতকাল বাবা মায়ের কাছ থেকে গোপন করে এসেছিল বর্ষা। স্বামীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক যত ফিঁকেই হোক, সেখানে ওর অবস্থান যত নিচেই থাকুক। ও কখনো চায়নি নিজের পরিবারকে সেসব জানাতে। চিরকাল মেয়েকে বোঝা মনে করে এসেছে যারা, নতুন করে তাদের মনে আর কোনো শংকার জন্ম দিতে চায়নি সে।

অথচ কিছুই আড়াল রইল না। বর্ষার অনভিলাষ সত্ত্বেও সবাই সবটা জেনে গেল। জানল চিরকাল যে মেয়েটি ভালো সন্তান হবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বারবার হেরে গেছে, সে আজ স্ত্রী হিসেবেও হয়েছে পুরোদস্তুর ব্যার্থ। যে সন্তান আসছে, হয়তো তার ভালো মা হিসেবেও এবার মেয়েটি ব্যার্থ হবে। ব্যার্থতা আর সে যেন জন্মলগ্ন থেকেই একে অপরের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত।

আজ যেন নাসিমা একটু বেশিই খেপেছেন। ফাবিহার ছোট ভাই ভার্সিটি কোচিং এর জন্য এখানে এসে থাকছে। আরও বেশ কিছু দিন থাকবে। এতে নাসিমা অবশ্যি খারাপ কিছু দেখেন না। বোনের বাড়িতে ভাই প্রয়োজনে এসে থাকতেই পারে। তার ওপর ফাবিহার বড় ভাইয়ের জন্যেই আজ সোহাগের চাকরিতে বেশ পদোন্নতি ঘটেছে।
কিন্তু সমস্যা হলো এবাড়িতে মোটে দুটো মাত্র ভালো শোবার ঘর, সামনে একটি বসার ঘর আর সিড়ির নিচে রয়েছে আরো একটি ছোট ঘর। ফাবিহার ভাই আসার পর থেকে বসার ঘরেই মেঝেতে বিছানা পেতে শুতে হচ্ছে ওকে। অন্য বড় ঘরটিতে ফাবিহা নিজে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকে। পাশের ঘরে থাকেন নাসিমা। আর ছোট ঘরটিতে বর্ষা। থাইরয়েডের সমস্যা কারণে শীতকালেও নাসিমা বেশ ঘামেন। রাতে পাশে কারো ঘুমালে তার অস্বস্তি হয়। তাতে গরম বেশি লাগে। সেজন্য তিনি নিজের ঘরটা ছেড়ে বর্ষার সঙ্গেও থাকতে পারছেন না। তাছাড়া বর্ষা বলতে গেলে প্রায় অর্ধেক রাত জেগেই কাটায়। শরীরিক যন্ত্রণার জন্য ঘুম আসে না। অর্ধরাত্র পর্যন্ত ওর ঘরে বাতি জ্বলে। সেখানে গিয়ে তিনি নিজের ঘুমটাকে মাটি করতে চান না। ফলাফল ফাবিহার ভাইকে প্রথম থেকেই ওই মেঝেতে রাত কাটাতে হচ্ছে। যা নিয়ে ফাবিহা মহা অসন্তুষ্ট। দিনরাত ফোঁসফোঁস করছে ।

এই একটি কারণে বর্ষার এখানে থাকাটা আরও বেশি ক্রোধ উদ্রেক করছে নাসিমার। বর্ষা চলে গেলে সে ঘরটিতে অবিলম্বে ফাবিহার ভাই দখল নিতে পারে। কিন্তু বর্ষাকে কিভাবে বিদেয় করবেন তিনি? রাফিয়া যোগাযোগ রাখেন ঠিকই। কিন্তু চলেন গা বাচিয়ে। শেষ সময়ে এসে এই পোয়াতি মেয়ের সেবাযত্নের ভার যেন নিজের কাঁধে না চাপে। সেই ভয়েই হয়তো !
তাহলে নাসিমাই বা কেন করবেন এতকিছু? যে আসছে সে তো তার বংশের কেউ নয়। আজ তিনি মেয়েকে, নাতিকে কলিজা ছিড়ে ভালোবাসবেন। দুদিন পর হয়তো দেখা যাবে রাফিয়ার নাতির জন্য দরূদ উথলে উঠেছে। টাকার গরম দেখিয়ে ওদের নিয়ে চলে যাবেন। তাহলে নাসিমার রইল কি!

এইসব হিসেব নিকেষ বহু আগেই কষে রেখেছেন নাসিমা। আগ বাড়িয়ে আর কিছুই করবেন না তিনি। এবার ভালোয় ভালোয় মেয়েটা ঘাড় থেকে নামলে বাঁচা যায় !

নাসিমা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘জামাই কবে নিতে আসব তোরে?’
বর্ষা উত্তর করল না। চুপচাপ সিড়ির ওপর বসে রইল।
নাসিমার রাগটা উত্তরোত্তর বেড়ে চলল। কি মেয়েকেই জন্ম দিয়েছেন তিনি! শত অপমানের বিপরীতে মুখে একটিও রা নেই। বর্ষার এই নিশ্চুপ থাকাটা নাসিমার ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সকাল থেকে গলা চড়িয়ে চিৎকার করছেন তিনি। অথচ যাকে উদ্দেশ্য করে এসব বলা তার কোনো বিকার নেই। অমন তেজি মেয়ে হলে কবে এই বাড়ি চিরতরে ছেড়ে যেত। আর একে বলেই বা কি লাভ! এর তো যাওয়ার কোনো জায়গাও নেই!

নাসিমার মস্তিষ্কে বিকৃত ক্রোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো। ক্রমশ হুশজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি। অকস্মাতে বর্ষার খুব কাছে এগিয়ে এসে ওর গায়ে জোড়ালো একটা ধা-ক্কা দিলেন।
–‘ কথা কস না কেন? কবে ছাড়বি তুই এই বাড়ি? দিনের পর দিন এইভাবে বাপের বাড়ি পইরা থাকতে তোর লজ্জা করে না?’

বর্ষা মাথা নিচু করে বসে রইল। সত্যিই এই প্রশ্নের জবাব নেই ওর কাছে। কি বলবে! কোথায় যাবে সে, ছেড়ে এই বাড়ি? স্বামী নামক সেই লোকটির আশ্রয়ে? সে কি আদতেও বর্ষার প্রত্যাগমনে খুশি হবে? হবে না। এখানে কিংবা ওখানে, স্থান যেটাই হোক। ওকে আসলে কেউ-ই চায় না। বর্ষা খুব বোঝে। মাঝেমধ্যে ভেবে অবাক লাগে ওর। এতো বড় পৃথিবীতে, এতো ভয়ংকর নিঃস্ব কেন সে! আজ ওর কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। কারো বুকে মাথা রেখে, চিৎকার করে কেঁদে কষ্ট গুলো বলার সুযোগ নেই। আজ নিজের প্রাণ নিয়ে যেখানে সে এতো বেশি অসহায়। কিছুদিন পর অন্য প্রাণটি ভূমিষ্ঠ হলে তখন সে কি করবে? কার কাছে একটু সত্যি আশ্রয় মিলবে? বর্ষা ভাবে, আরও আগেই কেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল না। এই অনাগত সন্তান নিয়ে এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে একটু মাথা গোজার ঠাইয়ের জন্য?

নাসিমা শীতল দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের এই নির্বিকার ভাব যত দেখছেন তত আগুন ধরে যাচ্ছে তার মাথায়। হাতদুটো নিশপিশ করছে।
–‘ এতো বড় ঘর পাইলি। তবুও তুই সেইহানে টিকতে পারলি না। নিজের স্বামীরে ধইরা রাখতে পারলি না। এহন তো জামাই তোর খোঁজ খবর পর্যন্ত নেয় না।
বাপ তো গেছেই। এহন ভাইয়ের অন্ন ধ্বংস করতে আইসস। সারাটা জীবন তুই খালি আমারে জ্বালায়া গেলি। হতভাগী ম’রতে পারোস না তুই। এহন তোর মুখ দেখলেও আমার… ‘
কথার মাঝখানে এসে একেবারে অকস্মাৎ থেমে গেলেন নাসিমা। উঠোনের অন্যপাশে গেইটের বাইরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকালেন সেদিন। গেইট টা শব্দ করে খুলে যেতেই মুহুর্তে নাসিমার মুখের রঙ বদলে গিয়ে পাংশু বর্ণ ধারণ করল। কাগজের মতো ফ্যাকাসে চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন সেদিকে।
মায়ের হঠাৎ এই নিশ্চুপ হয়ে যাবার কারণ কি বুঝতে না পেরে বর্ষা মাথা ওপরে তুলল। তারপর মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল গেইটের পানে। সেখানে নাব্য দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের মতো কঠিন মুখ করে।

ফাবিহা অনেকক্ষণ ধরেই বুঝতে পারছিল আজ একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন নাসিমা। ভেবেছিল এইবার এসে মাকে একটু শান্ত হতে বলবে। কিন্তু আসি আসি করেও আসা হচ্ছিল না। বলতে নেই, ওর বেশ ভালোই লাগছিল বর্ষার প্রতি নাসিমার এই বাক্যবাণ শুনতে।

এবার হঠাৎ কেন সব নিশ্চুপ হয়ে হয়ে গেল। তার কারণ অনুসন্ধান করতে ফাবিহা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। চৌকাঠে পা রাখতেই নাব্যকে দেখে কপালে উঠল ওর চোখ। এদিকে সিড়ির দুপাশে মা মেয়ে দুজন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। থতমত খেয়ে গেল ফাবিহা। তবে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল,
–‘আরে আম্মা ভেতরে যান আপনি। আপনারাও না! মা মেয়েতে সারাদিন শুধু মিছে ঝগড়া! ‘
মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে গেইটের দিকে এগিয়ে গেল সে,
–‘আরে ভাইয়া আপনি দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন প্লিজ। এসে বসুন। কতদিন পর এলেন আমাদের বাড়ি। বর্ষা দেখে যাও কে এসেছে। ‘

বর্ষা তখনো মূঢ়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। নাব্য ওদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ফাবিহাকে সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে গলা চড়িয়ে বলল,
–‘আমি অপেক্ষা করছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে এসো। ‘
নাব্যর স্বরে এমন দৃঢ়তা ছিল যে বর্ষা জায়গা থেকে নড়তে বাধ্য হলো। এবং পাঁচ মিনিট পেরোনোর আগেই গায়ে বোরকা জড়িয়ে বেরিয়ে এল। হাতে একটা মাঝারি আকারের কালো ব্যাগ নিয়ে। ওটা নিয়ে উঠোন পারি দিতেই ওকে বেগ পেতে হচ্ছিল। গেইটের কাছাকাছি এসে সে ফের মাথা নিচু করল। হয়তো অবাধ্য যাতনার ফলিত বাহ্যিক রূপ, চোখের জলগুলো আড়াল করবার জন্যই। নাব্য সেইসব কিছুর পরোয়া করল না। বিনাবাক্য ব্যয়ে ব্যাগ তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে হাটতে শুরু করল। বর্ষা একবার পেছন ফিরল। নাসিমা ফ্যাকাসে মুখে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। কয়েক মুহুর্ত কাটল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে।
–‘আসি ভাবি। আসসালামু আলাইকুম। ‘ বলে বেরিয়ে এলো বর্ষা।

ফাবিহার হতভম্ব ভাবটা তখনো পুরোপুরি কাটেনি। কি থেকে কি ঘটে গেল মাথায় ঢুকছে না ওর। কেনই বা আজই নাসিমা বর্ষার ওপর এতো চড়াও হলেন। আর কেন আজই নাব্যকে আসতে হলো। ফাবিহার মনে বড় আফসোস হলো। কি কান্ডটাই না ঘটিয়েছেন তার শাশুড়ী মা। আজকের পর নাব্যর পরিবার ওদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবে কিনা সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নাব্য কোনো কথা বলছে না। বর্ষা নিরবে কেঁদে চলেছে। কান্না নিঃশব্দে হলেও, খানিক পর পর শব্দ করে হিচকি তুলছে। মাথায় আর চোখে বাজে রকমের ব্যাথা হচ্ছে। বর্ষা দুচোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দিল। এতে যদি ব্যাথাটা কিছুটা প্রশমিত হয়। অথচ হলো তার বিপরীত। ব্যাথাটা ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগল। হঠাৎ বর্ষা সোজা হয়ে তড়িতে বলল,
–‘গাড়ি থামান। আমি বমি করব। ‘
নাব্য দ্রুত রাস্তার পাশে নিয়ে গাড়ি থামাল। মধ্যদুপুরের হাইওয়ে বেশ ফাঁকা। দুপাশে ঘন রেইনট্রি গাছের প্রাবরণ। তারপর থেকে শুরু হয়েছে বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। পাশাপাশি সরিষা ফুলের হলুদ মাঠ। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অন্যপাশের দরজা খুলে দিল নাব্য। আশেপাশের অনেক দূর পর্যন্ত ওরা ছাড়া কেউ নেই বুঝতে পেরে নিকাব টেনে নামিয়ে বর্ষা বাইরে বেরিয়ে এলো। দু পা এগিয়ে গাছে হাত রেখে উবু হয়ে বমি করতে শুরু করল। নাব্য পানির বোতল আনতে গাড়ির কাছে গেছিল। ফিরে এসে বর্ষাকে ধরতেই ওর গায়ের ওপর হেলে পড়ল বর্ষা।
–‘ পানি খাও।’ ব্যাস্ত হয়ে বলল নাব্য। তারপর নিজেই পানি খাইয়ে দিল ওকে। দীর্ঘ সময় ধরে কান্না, মাথার যন্ত্রণা আর তারপর এই বমি। সবকিছু মিলে বর্ষার অবস্থা দাঁড়াল ভয়ংকর। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চোখ রক্তজবার মতো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। মুখখানা ক্লান্তিতে ফ্যাকাসে। নাব্য আজলা ভর্তি পানি নিয়ে ওর মুখ ধুইয়ে দিল। গাড়ির কাছে এনে, ওকে নিয়ে নিজেও গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বর্ষা চুপ করে ওর বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ খুলছে না। বড় বেশি নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ওর মাথায় হাত রেখে নাব্য বলল,
–‘তুমি বরং পেছনের সিটে শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করো। বাড়ি পৌঁছে তোমায় ডেকে দেব আমি। ‘

বর্ষা তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না। কিঞ্চিৎ সময় পর ধীর গলায় উত্তর করল,
–‘ পেছনের সিটে শুতে আমার ভয় করে। গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করলে যদি সিট থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাই?’ ওর কথা আর কথার ভঙ্গিমায় হাসি পেল নাব্যর। অনেকদিন পর একটুমাত্র শব্দ করে নিজের বিশেষ হাসিটা সে হাসল । বর্ষা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে লাগল বুকে ঝড় তোলা সেই হৃদয় বিধ্বং’সী ভ’য়ংকর সুন্দর হাসি।’

–‘আচ্ছা থাক। পেছনে শুতে হবে না। এখন গাড়িতে উঠে বসো। ‘
বর্ষা পূর্বের স্থানে গিয়ে বসলো। নাব্য ভেতর এলো পেছনের সিট থেকে দুটো কুশন নিয়ে। কুশন দুটো নিজের কোলের ওপর রেখে বলল,
–‘এখানেই শুয়ে পড়ো আপাতত। বাড়ি পৌঁছে ভালো করে ঘুমিও।’
ব্যাথায় বর্ষা দুচোখে অন্ধকার দেখছিল। এই ব্যাথা সহ্য করে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই ওর। কারণ চাইলেও যেন-তেন ওষুধ নিতে পারবে না। সেসব এখন ওর জন্য সম্পুর্ন নিষেধ। তাই কিছু না বলে সে কুশনে মাথা রেখে সিটে শুয়ে পড়ল। মাথাটা ঠেকল নাব্যর বুকের কাছে গিয়ে। নাব্যর হৃদস্পন্দন স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল সে। পালস্ রেট গুনতে গুনতেই বোধহয়। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে, ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল বর্ষা।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দুপুর গড়িয়ে দিন বিকেলে হেলে পড়েছে। নাব্য ডেকে বলল ওরা বাড়ি চলে এসেছে। বর্ষা ঘুম ভেঙে উঠে বসল ভয়ানক মন খারাপ নিয়ে। ঘুমের মধ্যে আজকের ঘটনা গুলোই বারবার ঘুরেফিরে আসছিল স্বপ্নের রূপ নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের করা অসদাচরণ গুলো একে একে মনে পড়ে গেল ওর। বর্ষার আবারও কান্না পেল। কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। কিন্তু গাড়ি থেকে বেরোনোর আগে নাব্যর শেষ কথাটা শুনে শব্দ করে কেঁদে ফেললো বর্ষা। নাব্য দরজা খুলে গম্ভীর মুখে বলল,
–‘ আর কখনো ওবাড়ি যাওয়ার নাম মুখে আনবে না তুমি। ওদের সাথে আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ!’

চলবে ইন শা আল্লাহ ……….।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here