একদিন নববর্ষা -৪০

0
160

একদিন নববর্ষা -৪০
অদ্রিজা আশআরী
___________

নিতিনের কিছু একটা হয়েছে। কি হয়েছে কেউ জানে না। নিতিন কাউকে জানতে দেয়নি। সে শুধু নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। প্রজ্জ্বল আভায় পূর্ণ মোম বাতাসের ঝটকায় যেমন হুট করে নিভে যায়। নিভে যাওয়া মোমের অবশিষ্ট সুতোর কালোরঙা ধোঁয়া শেষ উষ্মাটুকু বাচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় এঁকে বেঁকে ছড়িয়ে পরতে থাকে চারদিক। নিতিনের বেলায়ও যেন তাই ঘটেছে। সেই অবশিষ্ট সুতোর নলের মতো এখন শুধু ওর দৃষ্টি অস্থির ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে। কেউ কিচ্ছু জানে না। শুধু বোঝে কোনো এক ঝোড়ো সন্ধ্যার, কয়েক মুহুর্তের দুর্বিষহ কোন একটি ব্যাপার নিতিনকে শেকড় থেকে স্তিমিত করে দিয়েছে।

নিতিনের সঙ্গে একটা সখ্য আছে বলেই নিতিনের এই বিশেষ নাজুক ব্যাপারটিতে বর্ষার অবগতি অন্যদের চেয়ে বেশি হয় তা নয়। সেও বাকিদের মতো কেবলি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রয় সবটা শুনে। রাফিয়াই তাকে জানায় কিভাবে হাজারিবাগের বাসিন্দা এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার মাধ্যমে সেদিন নিখোঁজ নিতিনের খোঁজ পেয়েছিলেন তারা মধ্যরাতে। ঘটনা বেশিদিনের পুরনো নয়। মধ্যে তিনটে রাত পেরিয়েছে কেবল। এরই মাঝে রাফিয়া চেহারার দুত্যি হারিয়েছেন, চোখের নিচে মোটা বাদামি আস্তরণ পড়েছে মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করে।

নিতিন কে শারিরীক ভাবে অক্ষতই পেয়েছিলেন তারা। কিন্তু মন! হয়তো ব্যাখারও অতীত, এমনি কোনো এক বিমর্ষতায় আচ্ছন্ন ছিল সেসময় নিতিনের কোমল বাৎসল্যপূর্ণ মন!

বর্ষাকে মনে মনে অনেক সাহস সঞ্চার করতে হলো নিতিনের কাছে যাবার জন্য। দরজায় কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ভেতরে কারো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। তবু খানিকক্ষণ বাদেই সহসা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে নিতিন। নাহ! নিতিনকে দেখে বর্ষার সেরকম ভয় হয়নি, যতটা হবে বলে আশা করেছিল। কেবল মেয়েটির চোখের উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে। নিতিনের চোখে আলো নেই, মুখে পেশির ঘনঘন সঞ্চার নেই। নিতিন মিইয়ে গেছে ঝরা পাতার সিন্ধুনীল রঙের মতোন!

বর্ষা চিরকালই বড় নির্মল মনের মেয়ে। কোনো কালেই কাউকে আগলে রাখার বেলায় সে ভূমিকা করতে জানে না। ভালোবাসা রচনার বাঁধাধরা নিয়ম মেনে চলে না। সেখানে ভূমিকা, ভাবসম্প্রসারণ, উপসংহারের নেই কোনো বালাই।
দু’পা এগিয়ে সে নিতিনকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরল। মুখ ফুটে কথা বলল খানিক বিলম্বে।
–‘আমার আপু। কি হয়েছে তোমার? সবাইকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছো? নিতিন যে সকলের প্রিয় দুরন্ত চড়ুইছানা। সে সারাক্ষণ উড়ে বেড়াবে, ছটফট করবে, বিষম অনাচারে মাতিয়ে রাখবে সারাবাড়ি। তা না করে এভাবে চুপচাপ রুদ্ধ ঘরে বসে থাকলে কি হয়? ভালো দেখায় বলো তো? ‘

নিতিন নিরুত্তর থেকে বর্ষার কাছে এগিয়ে আসে। তারপর হঠাৎ অক্লেশে গ’লা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। অনেকটা শব্দ করে।
তিন দিন পর এই প্রথম বাঁধ ভাঙে ওর কান্নার। এতদিন নির্বাক থেকে সকলকে বিষম পীড়ন করে সে যেন বর্ষাকেই একান্ত করে খুঁজছিল। পাওয়া মাত্র সকল রুদ্ধ আবেগের দেয়াল একসঙ্গে আছড়ে পড়েছে। টাল সামলাতে বর্ষা একটু হিমশিম খায়। গভীর মমতায় ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–‘ নিতু, যত ইচ্ছে তুমি কাঁদো। কিন্তু এই কান্নার শেষে যেন একটা স্বচ্ছ হাসিমুখ দেখতে পাই। এই কান্নার পর আর কখনো কাঁদবে না তুমি।’

বর্ষার কথা হয়তো নিতিনের কানেই যাচ্ছিল না। কিন্তু তার ছোয়ায় যে আন্তরিকতা ছিল, তার মাধুর্যে নিতিন খুব দ্রুত বিবশ হয়ে পড়ল। বর্ষাকে আশ্রয় করে দীর্ঘ সময় নিজের মতো দুঃখবিলাস করল। বর্ষা বাঁধা দিল না। সে জানে। একটা সময় নিতিন নিজেই খুলে বলবে সবটা।

অশ্রুজলে লালিমায় ছেয়ে যাওয়া চোখ মুছে একসময় কথা বলতে আরম্ভ করে নিতিন।
–‘ভাবি তুমি জানো আমার অপরাধের কোনো ক্ষমাই হয় না। কখনো হয় না। তুমি ভাবতে পারবে না তোমার সামনে বসে থাকা এই মেয়েটা কত জঘন্য কাজ করেছে।
আমার খুব বাজে কোনো শাস্তি পাওয়া উচিত। সবাই জানতো নিতিন বাবার জন্য প্রাণ দিতে পারে, সবার মন থেকে মুছে গেলেও নিতিনের মনে তার বাবা চিরকাল নিজ স্থানে অম্লান থাকবে। অথচ সেই আমি, একটা সস্তা ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে আমার বাবাকে ভুলেছিলাম!
তুমি বলেছিলে না প্রেম হারাম? হারামে জড়ানো মানে জেনেশুনে আল্লাহর অবাধ্যতা করা। অথচ দিনের পর দিন অসঙ্কোচে আমি তাই করে এসেছি। আমি আমার আল্লাহর বিধান অমান্য করেছি, বাবার কথা ভুলেছি। আর..আর কি করেছি তুমি জানো?
দাভাইয়ের টাকা চুরি করেছি। রচনার মতো অনর্গল মিথ্যা বলেছি কাছের মানুষ গুলোর কাছে।
ভাবি, বলো তো আমার মতো বাজে মেয়ে আর আছে?’ নিতিনকে দারুণ মরিয়া দেখায়। সে হঠাৎ দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ায় স্বস্থান ছেড়ে। অধীর হয়ে বলে,
–‘ তুমি দূরে থাকো ভাবি। আমার কুল’ষিত ছোয়া যেন তোমার গায়ে না লাগে। আমি খুব খারাপ মেয়ে। চিরকাল যারা ভালোবেসেছে, সস্তায় পাওয়া দুদিনের প্রেম তাদের সবাইকে ভুলিয়ে দিয়েছে আমার মন থেকে। ভাবতে পারো তুমি? আমি আমার আল্লাহকেও মনে রাখিনি সেই দিনগুলোতে। তখন যদি আল্লাহ আমার মৃত্যু লিখে রাখতেন! আমি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পেতাম না। চিরকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বল’তাম। কিন্তু আল্লাহ এর পরও আমাকে দয়া করেছেন, সুযোগ দিয়েছেন। তাই এখন আমি দিনরাত শুধু ক্ষমা চেয়ে যাই। কখনো যদি আল্লাহ আমাকে কবুল করে নেন। ‘

নিতিন শিশুর মতো কাঁদছে। বর্ষার বুক ভেঙে গেল। মেয়েটা কত সহজে নিজের যা কিছু ভুল ছিল, সেসব স্বীকার করে নিয়েছে। তবুও ওর ভেতরটা আগুনের হল্কাবন্দী হয়ে আছে। চিরকাল কি এভাবেই সরলেরা কষ্ট শুধু পায়? ওদের ভুল যত না অন্যকে আঘাত করে, তার চেয়ে অনেক বেশি ওরা নিজেরাই জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়। বর্ষা বোঝে নিতিনের ভুল ভাঙানো দরকার। অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার পর ক্বলবে আর কোনো পাপ অবশিষ্ট থাকতে পারে না।

–‘ নিতিন, আল্লাহ কে তুমি কতটা জানো? একটা গল্প শুনবে?
একদিন এক লোককে তার বাচ্চা ছেলে জিজ্ঞেস করল, বাবা আকাশ কত বড়? লোকটির মুখ মেঘে ছেয়ে গেল। বলল, ‘অনেক বড়। কিন্তু যত বড়ই হোক। আমার পাপের পরিমাণ ওই আকাশের চেয়েও বিশাল। ‘
লোকটি পাপী ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল নিজের অগণিত পাপের জন্য অনুশোচনা কারী। তুমি জানো? শুধু মাত্র এই কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। কারণ সে নিজের পাপ সম্পর্ক অবগত ছিল। এবং জানতো আল্লাহর রহম ছাড়া এই পাপের শাস্তি থেকে তার মুক্তি নেই।
তোমার পাপ কি আকাশ ছুয়েছে নিতিন? আকাশ ছোয়া পাপও নির্দ্বিধায় এক মুহুর্তে ক্ষমা করেন যিনি। তিনি তোমার এই সামান্য অপরাধ ক্ষমা করবেন না বলে ভাবছো?
কুরআনে রব্বে কারীম কি বলেছেন জানো,
‘যে গুনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’ [১]
তাহলে তুমি কেন হতাশ হচ্ছো, এতটা ভেঙে পড়ছো নিজেকে নিয়ে?
নিশ্চয়ই পাপ করে যে তওবা করে নেয় আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন।’

বর্ষার কথা নিতিনের অন্তঃস্থিত কোণ ভেঁদ করে যেন আরও গহীনে, লুকায়িত ক্বলবের প্রাচীরে আ’ঘাত করল। ক্ষণিকের মাঝে ওর মুখের সকল পেশির সঞ্চারণ স্পষ্ট হল। মনে হয় যেন পথহারা এক নিঃসঙ্গ রাহী, আলোহীন পথে চলতে চলতে হঠাৎ দৃঢ় অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে। নিতিনের চোখের ভাস্বরতা ক্রমে ফিরে আসছিল।
বর্ষাকে অবাক করে দিয়ে নিতিন কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ হেসে উঠল। সত্যিকারের হাসি।
-‘ ভাবি, তুমি কি জাদু জানো? এইমাত্র আমার সব আফসোস দূর হয়ে গেছে। যে আফসোস আমাকে দিনরাত কাঁদাচ্ছিল, পোড়াচ্ছিল, কষ্ট দিচ্ছিল। তোমার কথার প্রভাবে এটা হয়েছে। আল্লাহ চেয়েছেন তোমার মাধ্যমেই আবার আমার হারানো আমিকে খুঁজে পাই।
আমি সব ভুলতে চাই। আল্লাহকে ভালোবাসতে চাই। আবারও আব্বাকে রোজ রোজ দো’আয় স্মরণ করতে চাই। তুমি আমাকে সাহায্য করবে তো?’

হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ওর মুখে অপলক তাকিয়ে রইল বর্ষা। আল্লাহর কাছে বারবার নিতিনের জন্য দো’আ করছিল সে। কিন্তু আল্লাহ এত সহজ করে দেবেন সবকিছু সে ভাবেইনি।
তবুও বর্ষা গোপনে একবার প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের জন্য!
ওর দুঃখ গুলো যদি নিতিনের দুঃখগুলোর মতো এমন পলকা হয়ে হাওয়ায় ভেসে যেত। আহ! যদি এভাবেই ওর জীবনের হারিয়ে যাওয়া সকল আলোরা এক এক করে আসতো ফিরে!

বর্ষা নিজের ঘরে ফিরে এলো। হঠাৎ বড় বেশি হাসফাস করছে ওর ভেতর টা। মনে হচ্ছে যেন নিতিনের সকল কষ্ট, আর সেই কষ্টের ছটফটানি গুলো সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে, ওর গায়ে পুশ করে দিয়েছে কেউ। বর্ষা বুকে হাত রাখে। এতো কষ্ট কেন হচ্ছে! ভেতরে যেন দাউদাউ করে জ্বলছে দাবানল। সেই দবানলের উৎস কি তা সে জানে না। একে কি মুড সুইং আখ্যা দেয়া যায়? মুড সুইং কখনো এতো বিভৎস হয়?

নাব্য কোনোদিন ওকে ভালোবাসেনি, নাব্যর বুকের বা-পাশে, হৃৎপিণ্ড টা ওর জন্য স্পন্দিত হয়নি কখনো। অথচ নাব্যর একটা অংশ দিনের পর দিন সে নিজের দেহে ধারণ করে বেড়াচ্ছে। কত ভয়াবহ শারীরিক মানসিক যাতনার মধ্যে দিয়ে রোজ রোজ আগামীর জন্য বাচিয়ে রাখছে সেই প্রাণের অংশ টুকুকে। এত কষ্টের প্রতিদানে, প্রাপ্তির খাতা আজও শুধু শূন্যতায় খা খা করে!

এইতো, আজ ভরদুপুরেই। নিজের মা ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কত জঘন্য ছিল সেই পদ্ধতি। অভিশাপ আর অকথ্য গা’লির বাক্যবাণে মা আজ ওর বুক পূর্ণ করে দিয়েছে। এর পর আর কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না। রাখার স্থানও বোধহয় সংকুলান হতো।

না চাইতেও এমন শত শত দুর্বি’ষহ মুহুর্তের ছবি বর্ষার মনের চিত্রপটে ভেসে ওঠে। নিজের ওপর এতো ভয়ানক রাগ জন্মায়। যে রাগে অন্ধ হয়ে সে দাঁতে দাঁত চে’পে কাঁদতে শুরু করে। না চাইতেও এতো কিছু কিভাবে ঘটে গেল ওর জীবনে?
সেই যে একটা সময় ছিল। বর্ষা কিশোরী ছিল যখন। সারাক্ষণ আনন্দে নেচে গেয়ে বেড়াতো, তখন কোনো দুঃখই ওকে ছুতে পারতো না। ইচ্ছে হলেই মনটাকে নিয়ে কল্পনায় পাখির মতো উড়ে বেড়তো সে। সকল দুঃখ ফিঁকে হয়ে আসতো। স্কুল পালিয়ে ফুচকার দোকানে ভিরতো, রাস্তার সস্তা আঁচারে মন ভরাতো, ফুচকার ঝাঁঝে চোখ বেয়ে জল গড়ালেও মুখে থাকতো বিশ্ব জয়ের হাসি!

সেই দিনগুলো যেন অন্য এক জীবনের কথা! আজকের রূঢ় বাস্তবে সেসব প্রহসনের মতো মনে হয়। সত্যিই কত বদলে গেছে সে।
নাহ! এতো এতো প্রাপ্তির মাঝে নিজের করে কিছুই পাওয়া হয়নি ওর। বর্ষা বোধহয় আর কিছু পেতেও চায়না। সে মেনে নিতে শিখে গেছে। যাকিছু ঘটুক, সবই আজকাল মেনে নিয়ে আরাম বোধ করে।

খুব ধীরে ধীরে অপ্রকৃতস্থতার পর্যায়ে পৌছোতে থাকে বর্ষার বিচ্ছিন্ন চিন্তা পূর্ণ মস্তিষ্ক। বিছানায় হেলে মাথা চে’পে ধরে বসে থেকে হঠাৎ গন্ধটা টের পায়। প্রথমে কয়েলের গন্ধ ভেবে একটু স্বস্তি হলেও পরমুহুর্তেই ব্যাপার টা ওর মাথায় ধরে। ঘরে ও ছাড়া দ্বিতীয় কারো অস্তিত্ব নেই, তবে কয়েল জ্বালল কে?
তেমন কিছু না ভেবে খেয়ালের বসেই ভিরানো দরজা ঠেলে বর্ষা বারান্দায় নামে। এবং থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় যেন এই মাত্র ওকে দশ ইঞ্চি পুরুত্ব বিশিষ্ট একটা কংক্রিটের দেয়ালের নিচে চা’পা দেয়া হয়েছে।

অন্ধকার বারান্দায় নিমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে নাব্য। মুহুর্তে অন্তরটা ভয়ানক আ’ঘাতে ছেয়ে যায় ওর। এবার সত্যিই সহ্যের সকল সীমা অতিক্রান্ত করে বর্ষার উন্মনা মস্তিষ্ক। সে বোধহয় মনে মনে দু একবার আল্লাহর কাছে আর্জিও জানায় ক্রোধ টা দমন করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে! খেই হারিয়েছে ওর সমস্ত বোধশক্তি। এই লোকটা একদিন তাকে কথা দিয়েছিল আর কোনোদিন সিগারেট স্পর্শ করবে না৷ অথচ ক’টা দিন পেরিয়ে, আবেগ টা একটু থিতু হতেই কি সহজে সেসব ভুলে ফের পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে!
মুখের ভাষা হারিয়ে বর্ষা নির্বাক তাকিয়ে থাকে। মৃদ্য পায়ে হেটে দাঁড়ায় নাব্যর পাশে। পাশ ফিরে অকস্মাৎ ওকে দেখে নাব্য চমকায়। বোধহয় ওর হৃদকম্পন একটু দ্রুত হয়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ফের সিগারেটে মন দেয় সে। তাকে দেখে আর বিচলিত মনে হয় না।

বর্ষা গোপনে গোপনে আবারও অনুচ্চারণে বলে,
ও আল্লাহ, তুমি আমাকে একটু ধৈর্য দাও। সবর দাও।’ বারবার একথা বললেও বর্ষা ভুলে যায় সবরের পরীক্ষা টা একান্তভাবে নিজেকেই দিতে হয়। সবরের শেষে হয়তো রবের কাছথেকে মিলবে পুরষ্কার। কিন্তু সহসাই বর্ষার ধৈর্য চুত্যি ঘটে।
দাঁত চেপে কাঁপা কাঁপা স্বরে উচ্চারণ করে,
-‘ আপনি বলেছিলেন আর কখনো… কখনোই এসব খাবেন না? বলেন নি?’
নাব্য নিরুত্তর।
পায়ের রক্ত মাথায় উঠে শিরায় শিরায় আগুনের হল্কা ছড়াতে থাকে। বর্ষার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসে। যন্ত্রচালিতের ন্যায় সে একই কথা কয়েকবার উচ্চারণ করে, ‘আমি মরে গেলেই ভালো। আমি মরে গেলেই আপনি খুশি হবেন তাইনা?’ তারপর জড় মস্তিষ্কে সেদিনের মতো ফের একটা অঘটনের পুনরাবৃত্তি করে। নাব্যর হাত থেকে একটানে সিগারেট ছিনিয়ে নিয়ে সেটা নিজের দু ঠোঁটের ভাজে রেখে জোড়ালো একটা শ্বাস টানে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাশির দমকে পুরো শরীরে কাপুনি উঠে যায় ওর। নাব্য তখনো নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে বিমূঢ়ের ন্যায়। হঠাৎ মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।
–‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? এটা কি করলে?’

বর্ষা নিজেও হতভম্ব হয়ে যায়। এক লহমায় ফিরে আসে ওর স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি। দেহ ছেড়ে অপ্রকৃতস্থ আত্মাটা মুহুর্তে ছুটে পালায়। শরীরে প্রবল কষ্টের একটা ঢেউ এসে বাড়ি খায়। তার প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী হয় বর্ষা। হড়বড় করে মুখভর্তি বমি করে, নাক দিয়ে রক্তের নোনা স্রোত বয়ে যায়। নাব্যর চোখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তে কি থেকে ঘটে গেল বুঝে উঠতে পারে না।
বমিটা সম্পুর্ন তার শার্টের ওপর পড়েছে। বর্ষার মুখ জমে যায় ত্রাসিত যন্ত্রণা আর ভয়ে। ও ভাবে সমুদ্রের বুকে, সেই ঝড়ের রাতের মতো নাব্য আজও ওকে একটা জোড়ালো চ’ড় কষাবে।
–‘আ…..আমি ইচ্ছে করে করিনি। এক্ষুনি পরিষ্কার করে দিচ্ছি…।’ বলতে বলতেই গ্রিলে হাত রেখে হেলে পড়ে বর্ষা। উপস্থিত শারিরীক যাতনার কথা ভুলে নিজের হয়ে অনেক কথা সে বলতে চায়। নাব্যর সম্ভাব্য আ’ক্রমণ থেকে বাচবার জন্য। কিন্তু তার আগেই ক্রমে চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসে ওর দু’চোখে। চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে যাবার আগে পিছলে গিয়ে ফুলের টবে মাথায় একটা বা’রি খায়। মাটিতে পড়ে যাবার আগে নাব্য ওকে ধরে ফেলে। হুশ হারানোর আগে এইটুকু ভেবে বর্ষার স্বস্তি হয়। আজ নাব্য ওকে চ’ড় মা’রেনি!’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here