একদিন নববর্ষা -৪১

0
139

একদিন নববর্ষা -৪১
অদ্রিজা আশআরী
___________

নিতিনের সকল নিষ্প্রভতার স্থায়ী অবসান ঘটে সেই সকালে। যেদিন নিজেকে নতুনতম আবরণে জড়িয়ে, দীর্ঘ দু মাস পর নিতিন পা রাখে বাড়ির বাইরে। চৌকাঠে পা ফেলতেই বৈশাখের প্রথম দুর্নিবার মাতাল হাওয়া, তীব্র প্রতাপে ওর গায়ে এসে বা’রি খায়। মাখিয়ে দেয় স্নিগ্ধতার প্রলেপ। দ্বিতীয় পদক্ষেপ ফেলার আগে নিতিন থমকায় অল্পকালের জন্য।

কখনো আবেগতাড়িত মেয়ে সে ছিল না। অথচ আজ কিছু হারিয়ে, কিছু পেয়ে ওর ভেতর টা ওলটপালট হয়ে গেছে হাহাকারের নিঃসীম আবেশে। বাবাকে হারানোর পর রাশিকের দেয়া আঘাতটা ছিল বড় বেশি আগ্রাসী।এলোমেলো করে দিয়েছিল নিতিনকে ভেতর থেকে। আঘাতের পর আঘাত। হারানোর পর আবার কিছু হারানো…

কিন্তু এর বিনিময়ে আজ যা পেয়েছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় হয়তো কখনো শেষ হবে না আল্লাহর কাছে। পড়নের আকাশী রঙা বোরকা আর সাদা হিজাবের ওপর চোখ রেখে নিতিন সেকথা ভাবে। ওর বোরকা পড়ার সিদ্ধান্তে বিরোধীতা করেনি কেউ। যে নিতিন থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট, ছোট ছোট টপস্ পড়ে অনায়েসে বাড়ির বাইরে চলে যেত আজ তার গায়ে এই অতি মার্জিত পোশাক দেখেও চোখ রাঙায়নি একজনও!

জীবনে হঠাৎ আসা ঝড়ের তান্ডবে গুমরে যাওয়া নিতিন আচমকাই সিদ্ধান্ত নেয় জীবনের গতিপথ বদলে ফেলার। মূলত এই আঘাতটাই ওকে ইন্ধন যোগায়। অনলাইন থেকে বোরকা নেয়। ঘরের আবহ বদলায়। যে ঘরে দিনরাত সাউন্ড বক্সে ইংরেজি গান বাজতো সেঘরই মুখরিত হয় নিতিনের দ্বিধাজড়িত ভাঙা সুরের কুরআন তিলাওয়াতে। নিতিন সারাক্ষণ ল্যাপটপে মুখ গুজে ইমানদীপ্ত লেকচার সিরিজ গুলো শোনে। রেইনড্রপস মিডিয়ার ‘সীরাহ’, নোমান আলী খানের লেকচার, ইসলামের মৌলিক বিষয়ের ওপর জ্ঞান অর্জনের জন্য ছোট ছোট অডিও ক্লিপ।

প্রকৃত মেধাকে কেউ কখনো লুকিয়ে রাখতে পারে না। সে যে পরিস্থিতিতেই থাকুক, মেধা নিজেকে প্রকাশ করবেই। এই সুক্ষ্ম মেধাশক্তির নিমিত্তেই কিনা, অল্প কদিনে নিতিনের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তার ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। নিতিন বোঝে এবার গন্তব্যে বাছাইয়ে সে কোনো ভুল করেনি।

ভাইয়ের বেপরোয়া স্বভাবের কিছুটা ছোট কাল থেকেই নিজের মধ্যে ধারণ করেছিল নিতিন। সেই বেপরোয়া মানবীয় ধাত, ওকে শিখিয়েছিল অন্যের ধ্যান ধারণা সম্পর্কে নির্লিপ্ত হতে। ওকে নিয়ে কে কি ভাবছে, ওর আচরণ অন্যের মনে কি প্রভাব ফেলছে এই নিয়ে কখনো বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনি নিতিন। ধীরে ধীরে এর প্রভাবেই ওর মাঝে একটা প্রবল আগ্রাসী মনোভাবের আভাস পাওয়া গেছিল।

নিতিনের সেই বেপরোয়া স্বভাবটাই আজকের এই নতুন পথচলাকে ওর জন্য সহজ করে দেয়। বোরকা পরিহিতা নিতিনকে দেখলে কে কি ভাববে তা নিয়ে কোনো সংকোচ ওর মধ্যে আসেনা। তবুও নিতিনের প্রবল ধারণা হয়েছিল প্রথম আঘাত টা হয়তো মায়ের দিক থেকেই আসবে। আর যাকেই হোক, মাকে তো সে এড়াতে পারেনা!

মা বিরোধিতা করলে নিশ্চিত ভাবে নিতিনকে পরাস্ত হতেই হতো। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এইযে নিতিনের এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী পরিবর্তনে রাফিয়া অনুমাত্র প্রতিবাদ করেন না। সেদিন সকালে নিতিন যখন বোরকা পড়ে স্কুলে যাবার জন্য বেরিয়ে আসে, রাফিয়া থমকান ঠিকই। কিন্তু পরমুহূর্তে প্রায় হাসিমুখে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতে রাজি হন। হয়তো ভাবেন ছোট কাল থেকে বাবা ভাইয়ের অতিরিক্ত আহ্লাদে মেয়ের ভাবপ্রবণতার যেরকম বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছিল, সেই দুর্ঘটনাটার পর নিতিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেও অস্বাভাবিক হতো না। তার চেয়ে এই পরিবর্তন টা ভালো। অন্তত অল্পের ওপর দিয়েই দায়টা মেটানো তো গেছে!

বৈশাখের মাতাল হাওয়ায় থমকে যাওয়া পা জোড়া নিয়ে, উদ্ধেলিত বক্ষস্থলের দ্রিমদ্রিম শব্দটাকে বহু কষ্টে আড়াল করে নিতিন চৌকাঠ পেরোয়। কলের পুতুলের মতো গাড়িতে উঠে বসে। একসময় ওর হৃদকম্পন স্বাভাবিক হয়। ব্যাক সিটে মায়ের পাশাপাশি বসে সেদিন পুরনো শহর দেখে নিতিন নতুন চোখে। সেই একই পুরনো ফেনীল আকাশ, রোজকার শহুরে রাস্তায় সেই একই তীব্র যানজট। তবুও আজ সবকিছু বড় অর্বাচীন আর আনকোরা হয়ে ধরা দেয় নিতিনের দুচোখে। উচ্ছ্বাসিত শিশুর মতো এই সাধারণ দৃশ্য দেখে নিতিন উৎফুল্ল হয়। আর বোঝে এই উচ্ছ্বাসের সবটুকু কৃতিত্ব ওই একফালি আচ্ছাদনের।

সেই মুহুর্তে নিতিন একটা কঠিন সত্যি প্রগাঢ় ভাবে অনুধাবন করে। বোঝে সেদিনের সেই সন্ধ্যাটা ওর জন্য বিশাল একটা ব্লেসিং হয়ে এসেছিল রবের পক্ষ থেকে। সেই কালরাত্রিটা না এলে কখনো নিতিনের উপলব্ধি বোধ জাগ্রত হতো না। নিজেকে আমুল বদলে ফেলে এই নতুনের পথে যাত্রাটা এতো সহজ হতো না কখনো। সবকিছু পূর্বাবস্থায় থাকলে রাফিয়াই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতেন। আকাশে ডানা মেলে ওড়ার বয়সে স্বেচ্ছায় নিতিনের এই ডানা ছেটে ফেলার সিদ্ধান্তকে কখনো নিরবে মেনে নিতেন না তিনি। নিতিনের মনে পড়ে কুরআনের সেই আয়াত টা। ‘নিশ্চই কষ্টের পর রয়েছে স্বস্তি। ‘

নিতিন জানালা থেকে মুখ ফেরায়। রবের কাছে কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে আসে ওর মস্তক। আজ যা কিছু পেয়েছে তা শুধুই রবের দান। ওর কোনো কৃতিত্ব নেই। বিন্দুমাত্র নেই। এমনকি কখনো এই দিনের জন্য রবের কাছে দুহাত তুলে আর্জি পর্যন্ত করেনি সে। তবুও তিঁনি শুনেছেন। নিতিনের অব্যক্ত চাওয়া গুলো এতো সুন্দর উপায়ে পূর্ণ করে দিয়েছেন। এক হাতটি দ্বারা অন্য হাতের মুঠো শক্ত করে চে’পে ধরে সে। অশ্রুরা নিরবে এসে হাজির হয় তার চোখের কোলে।

————–

স্কুলে নিতিনের এই নতুন বেশভূষা নিয়ে বিশেষ শোরগোল করে না কেউ। ক্লাসের মেয়েরা নিতিনের বর্তমান জীবনের দুর্যোগ সম্পর্কে অনেকটাই অবগত ছিল। এসব খবর কখনো চাপা থাকে না। তবুও নিতিনের এই নবরূপটা ওদের মনে আবার নতুন করে কৌতুহলের উদ্রেক করে। যদিও নিতিনের অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখ আর নির্লিপ্ততা দেখে একসময় সেটুকুও দূর হয়।

সেদিন বিকেলে নিতিন বাড়ি ফেরে একটা ঝরঝরে প্রশান্ত মন নিয়ে। ফ্রেশ হয়ে দু’মুঠো খাবার মুখে পুরেই ওপরের ঘরে রওনা দেয়। সেখানে গিয়ে বর্ষাকে না পেয়ে উদাসভাবে নেমে আসে নিচে। রিনি জানায় রাফিয়া বর্ষাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেছেন। অতএব শেষ ভরসা হিসেবে নিতিন দাদির ঘরে উঁকি দেয়।
দরজার ফাঁকে ওর একফালি মুখ দেখে দাদি বিচিত্র ভঙ্গিমায় হেসে ওঠেন। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকেন।

নিতিন ছুটে এসে দাদির গা ঘেঁষে বসে। আড়চোখে দাদির সহাস্য মুখখানা দেখে ভ্রুকুটি করে। দাদির ভাঁজ পড়া গাল দুটো আলতো ভাবে টেনে দিয়ে বলে,
–‘এই ওল্ড বিউটি। তুমি এভাবে হাসছো কেন?’

–‘আমি বুড়া মানুষ। মাথায় কত কি ঘুরে। সেইসব ভাইবা হাসি পাইবার ই পারে। আমার কথা ছাড়। তোর কথা ক।
তুই নাকি আজ বিরাট এক কাম করছস?’

উত্তর না দিয়ে নিতিন মুখ টিপে হাসে একটু।

–‘এইডা কুনু কথা! তুই বুরকা পইরা স্কুলে গেলি সেই খবর আমার জানতে হইল রিনির কাছে? একবার এই বুড়িরে দেহায়া গেলে কি হইতো? নিজ চোক্ষে দেখতাম আমার নাতনিরে বুরকায় কেমন লাগে! ‘

আরক্ত মুখে নিতিন বলে
–‘সরি দাদি। আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু.. এমন লজ্জা করছিল। কতবার তো ভাবলাম আজ বরং থাক। কাল থেকে নাহয় বোরকা পড়ে যাবো। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজের মনকে সুস্থির করলাম। তোমার কাছে এলে নির্ঘাত বোরকা ফেলেই চলে যেতাম। তাই আর আসিনি।’

দাদি পরম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন তার একসময়কার উগ্র আর ভীষণ আধুনিকা নাতনির মুখপানে। আজ নিতিনের চোখের চাহনিতে, গলার স্বরে কোনো উগ্রতা নেই। বরং ভীষণ এক নম্রতার স্নিগ্ধ আবেশে আচ্ছন্ন সব। দাদির বুঝতে বাকি রইল না কিসে তার অমন উন্নাসিক, আত্মানুরাগী নাতনিকে এমন বিনয়ের চাদরে ঢেকে দিয়েছে।

ভাবনাটা মনে আসতেই দাদি ভীষণ প্রবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বর্ষার আগমনে এই পরিবারে যে বিশাল এক বিপ্লব ঘটে গেছে তার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি নিজে। আশির কোঠা পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছে অনেক কিছুই আজকাল তিনি সাধারণের আগে আঁচ করতে পারেন।

বর্ষাকে কিছুই করতে হয়নি। ওর উপস্থিতিটুকুই ছিল যথেষ্ঠ। যার প্রভাবে রাফিয়ার মতো ভীষণ দুনিয়া মুখী মানুষ পর্যন্ত নিজ জায়গা থেকে টলতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাফিয়া চিরকাল ভালো গৃহিণী হবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ঠিকই অথচ কখনো হতে পারেননি সন্তানের জন্য আর্দশ মা। তার চোখের ওপর দিয়ে নাব্য দিনদিন উচ্ছনের পথে গেছে, নিতিন উগ্র হয়ে উঠেছে। তিনি কখনো বাঁধা দেননি।

ছেলেমেয়ের বিপথে যাবার বাজে প্রভাব যখন পরিবারে পরেছে কেবল তখনি বিষম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। হা-হুতাশ করেছেনে, কেঁদেকেটে একাকার হয়েছেন।
বর্ষা তাকে উপলব্ধি করিয়েছিল হা-হুতাশ করার চেয়ে সন্তানের জন্য রবের কাছে দুহাত তুলে দুফোঁটা চোখের জল ফেলা কত উত্তম! বর্ষার সংস্পর্শে এসে রাফিয়া সালাতে নিয়মিত হয়েছিলেন। টিভিতে সারাক্ষণ মত্ত হয়ে হয়ে থাকার বদলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন বই।

আর অন্য নির্দশনটি তো তার চোখের সামনেই উপস্থিত! দাদি জানেন নিতিনের এই বদলে যাওয়ার পেছনে কোথাও না কোথাও বর্ষার অধিষ্ঠান রয়েছে। উপস্থিতি প্রচ্ছন্ন রেখেই আর সকলের মতো নিতিনের মনে প্রভাব বিস্তার করেছে ওর সৎ আদর্শ।

অথচ! অথচ নিজের সবচেয়ে বড় খুটি, ঝড়ের মুহুর্তে শেষ অবলম্বন। নিজ স্বামীকে একবিন্দু বদলাতে পারেনি বর্ষা। ভালোবাসার কাছে হার মানেনি নাব্যর কোনো স্বকীয়তা। সে আগে যেমন বন্য, বেপরোয়া ছিল এখনো তাই রয়েছে। ব্যাপার টা শোনায় প্রহসনের মতো। এ যেন সারা পৃথিবী শুচিতায় মুড়িয়ে শেষে নিজ ঘরেই নোংরা জলের ছড়াছড়ি!

————-

দিন হারিয়ে যায়, আবার দিন আসে। পুরনো সে দিনের সুখ, স্মৃতি আর সময়ের ওপর এসে পড়ে নতুন দিনের প্রলেপ। আবারও সুখ আসে, স্মৃতি গড়ে ওঠে, সময় রঙিণ হয়। দিনশেষে হারিয়ে যায় পুরনোর পথ ধরে।

সময়ের সেই রেশ ধরেই আবার বৈশাখ এসেছে। বৈশাখ মানে যেন প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনেও কিছু উত্তাল ঝোড়ো দিনের আবির্ভাব। ঘনঘন দূর্যোগের তাণ্ডব, ভয়-ভীতি আর অনিশ্চয়তার শংকা…
বৈশাখ যেন শোকে মাতম হবারই মাস। তাই বুঝি নাব্যর পুরনো ক্ষত চুইয়ে আবার রক্তক্ষরণ হয়। হৃদয়ে হয় অপ্রতিরোধ্য ভাঙচুর।

আমার ক্লান্ত মন ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন,
ঘর ভরা দুপুর,
আমার একলা থাকার সুর,
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায় কতদূর।

মাতালের মতো এলোমেলো ভারী আওয়াজে কথাগুলো আওড়ায় নাব্য। ঝড়ের রাতের নির্বাক একলা পথে চলতে চলতে একসময় সে খেই হারায়। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হয় মেঘের গর্জন। নির্জন হাইওয়ে ধরে শো শো শব্দ তুলে মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি পাশ কাটিয়ে যায়।

সুরহীন ভাঙা স্বরে নাব্য আবারও আওড়ায়..

আমার ক্লান্ত মন ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন….

শ্রান্ত পায়ে হেটে একসময় বাড়ি পৌঁছায় সে। গেটের দারোয়ান তখন ঘুমে বিভোর। হয়তো ভেবেছিল গাড়ির হর্ন শোনা মাত্র শশব্যাস্ত হয়ে উঠে গেট খুলে দেবে। কিন্তু আজ নিজ পদযুগল দ্বারা হেটেই বাড়ি ফেরে নাব্য। অবিরত কিছুক্ষণ ধা-ক্কা দেয়ার পর দারোয়ান গেট খোলে। পরম বিস্ময়ে তাকায় নাব্যর পানে। নাহ, পেছনে কোনো রিকশা, ক্যাব কিছুই নেই। তবে কি গাড়ি ছাড়া ফ্যাক্টরি থেকে এতটা পথ হেটে ফিরেছে নাব্য?

নাব্য ওর প্রশ্নাতুর চাহনির পরোয়া না করে পা বাড়ায় ভেতরে। অনেক আগে থেকেই বর্ষা ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে আজ ঘরে পৌঁছে প্রথমেই চোখ স্থির হয় বর্ষার জাগ্রত অনুসন্ধানী চোখের ওপর। সেই পঙক্তি গুলো নাব্যর আবার উচ্চারণ করতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে করে,
‘প্রতিনিয়ত যুঝতে যুঝতে আজ আমি বড় বেশি ক্লান্ত। তুমি কি পারো আমার সমস্ত মনের শ্রান্তি, চোখের অবসাদ দূর করে দিতে? দুঃখ শোনানোর মতো আমার যে আর কেউ নেই। এক জোড়া একান্ত ব্যাক্তিগত শ্রবণেন্দ্রিয় আমার ভীষণ প্রয়োজন, যে কর্ণকুহরদ্বয় শুধু আমার কষ্ট শুনেই খান্ত থাকবে। আর কারো দুঃখ সে জানতে চাইবে না কখনো…’

অনেক দিন পর নাব্যর মনটা আজ সেই সমুদ্রের বুকে ঝড়ের রাতের মতো বর্ষার দিকে একপেশে ভাবে হেলে পড়ে। ওর মনে হয় বর্ষার একটুখানি অনুগ্রহ ছাড়া আজ পাওয়ার মতো ওর আর কিছুই নেই। অথচ সেটুকুও কত কঠিন। অবাস্তব মনে হয়। বর্ষার অনুগ্রহ পাওয়ার অধিকার যে হারিয়েছে সে বহুকাল আগেই..
এইযে তার ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মন কাউকে একটা খুঁজছে দুঃখ গুলো বলে হালকা হবার জন্য। হয়তো আরও একটু বেশি কিছু চাইছে। কিন্তু কেন বর্ষা আজ ওর কথা শুনবে? ছুয়ে দেবে দুঃখ গুলোকে?

সেই প্রথম থেকে, বর্ষাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই তো দেয়নি সে। বর্ষার চাওয়া গুলো এতো বেশি সামান্য ছিল। অথচ সেটুকু পূরণ করতেও অপারগতা প্রকাশ করেছে চিরকাল। তবে আজ কেনই বা বর্ষা সহানুভূতি দেখাবে ওর প্রতি?

বিছানায় বসে বর্ষা তীব্র কটাক্ষবাণে নাব্যকে পর্যবেক্ষণ করে, মুখে একটিও শব্দ উচ্চারণ না করে। আলো আধারির নিস্তব্ধ ঘরে একটা নিঃশব্দ স্নায়ু’যু-দ্ধ চলতে থাকে ওদের মাঝে। বর্ষার তীব্র কঠিন শ্যেন দৃষ্টি দেখতে দেখতে নাব্যর ক্লান্ত মন আরও শ্রান্ত হয়ে পড়ে। ইচ্ছে হয় বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে এলোমেলো কিছু কথা বলে নিজের বিশৃঙ্খল মনটাকে একটু স্থানে আনতে। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অদৃশ্য এক দেয়াল। দিনে দিনে, তিলে-তিলে যে দেয়াল স্বেচ্ছায় গড়ে তুলেছিল সে। এতটা দূরে চলে গেছিল যে আজ একবার জড়িয়ে ধরার জন্য মনে মনে হাজারবার অনুমতি প্রার্থনা করতে হচ্ছে!

সাদা চোখে দেখলে হয়তো মনে হতে পারে বিবাহিত জীবনে হঠাৎ প্রাত্তন প্রেমিকার পুনরাগমনই নাব্যকে এতো দূরে ঠেলে দিয়েছে। গরানবনের সেই মাতাল প্রেম ও বিচ্ছেদের পর বর্ষার অচিন্তনীয় আগমনে নাব্য এতটা মোহাবিষ্ট হয়েছে যে স্ত্রীকে ভুলে, প্রাত্তনে মত্ত হয়েছে অনায়েসে। অথচ নাব্য জানে এসব সত্যি নয়। সে দ্বিচারিতা করতে চায় নি কখনো।

বর্ষা এসেছিল। নাব্য ওকে চলে যেতে বলেছিল। কিন্তু বর্ষা যায়নি। বরং ডালপালা মেলে নাব্যর পাশেই একটা স্থায়ী ভিত গড়ে তুলেছে।
সেই প্রথমের দিনগুলোতে, রাহিলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বর্ষা পুনরাগমন করেছিল যখন। নাব্য বারবার ওর স্ত্রীর কাছেই আশ্রয় খুঁজেছিল। বলতে চেয়েছিল, ‘গরানবনের বর্ষাকে আমি আর চাইনা। ও যখনি আমার পাশে ভীরেছে, ভীষণ যন্ত্রণা আর অভিঘাতের আতিশয্যে আমার জীবনকে আচ্ছন্ন করেছে।’
কাতর অনুরোধে জানাতে চেয়েছিল, চলো আমরা অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে বর্ষার ছায়াও কখনো ভীরবে না। সেখানে আমরা একটা নির্মল জীবন গড়ব। কোনো দ্বিধা, সংকোচ, রোষাবেশ যেখানে আমাদের মাঝে থাকবে না। বর্ষার অপচ্ছায়ার বিষে কখনো বিষাক্ত হবে না সেই ভূখণ্ডের মাটি।’

অথচ নাব্য বলতে পারেনি। ঝোড়ো হাওয়ার মতো যখনই ওই অভিশপ্ত প্রেম এসে ওর শান্ত জীবন ওলট-পালট করে দিয়েছে, তখন নাব্য নিজের স্ত্রীর কাছে ছুটে যেতে চেয়েও বারবার পথ হারিয়েছে। অপরাধ না করেও নিজেকে ওর অপরাধী মনে হয়েছে। অশুচিতার ভয়ে স্ত্রীকে সে ছুতে পারেনি। নিজের ওপর তিলে তিলে জন্মানো ক্রোধের হল্কা অজান্তেই ছড়িয়েছে ওই নিরীহ মেয়েটির গায়ে। আর নাব্যর স্ত্রী ভেবেছে নাব্যর পুরনো প্রেম জেগে উঠেছে। তাই সে আজ আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে নাব্যর চোখে।

এভাবে দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। একে অপরকে ভুল বুঝতে বুঝতে… ভুলের একটা আস্ত প্রাসাদ গড়ে তুলেছে ওরা দুজনে। এখন আর কেউ এই দুর্ভেদ্য প্রাসাদ পেরিয়ে কাছে আসতে পারছে না। একটা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভুল বোঝাবুঝি ক্রমে ওদের নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে…..।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here