#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি,০৬,০৭
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৬
রজনী গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে লিমা বেগমের বুকে। লিমা বেগমও নিজের সাথে মিশিয়ে রেখেছেন রজনীকে। কেউ দেখলে বুঝবে না,মেয়েটা তাঁর কিছু হয় না। দেখলে মনে হবে,মেয়েকে জড়িয়ে মা ঘুমিয়ে আছে। লিমা বেগমের ঘুমটা অনেক আগেই ভেঙে গেছে। কিন্তু রজনী তাঁকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে, যে লিমা বেগম ছুটতে পারছে না। তবুও তিনি ধীরেধীরে রজনীকে ছাড়িয়ে উঠে বসলেন। গায়ের কাঁথাটা ভালো করে টেনে দিয়ে তিনি উঠে গেলেন। নিচে নেমে দেখলেন পল্লব নাস্তা করছে।
_ কিরে তুই নাস্তা করছিস। আমি তো উঠতে পারিনি।
_ মা একটা ডিম সেদ্ধ, এক গ্লাস জুস এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। তোমাকে ডেকে ব্যস্ত করতে চাইনি।
_ তুই কি বেরিয়ে যাচ্ছিস,তাও এতো সকালে
_ মা সকাল সকাল না বের হলে পৌঁছাতে লেট হবে,রাস্তায় যা জ্যাম।
_ হুম বুঝলাম, কিন্তু একটা কথা বলতে চাই।
_ বলো
_ মেয়েটার কি করবো বুঝতে পারছি না। কাল তো তোর বাবা আসবে। তিনি তো এসব ঝামেলা পছন্দ করে না। আর মেয়েটার অবস্থাও এমন, ফেলে দিতে পারবো না।
_ মা আমার মনে হয়,সে আমাদের কিছু না জানিয়ে তাঁর বিপদ আরো বারাচ্ছে। নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে বেশিই তিনি নিজের ক্ষতি করছে।
_ আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু কাল কি ঘটলো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
_ আমি যতোদূর বুঝতে পেরেছি,তাতে আমার মনে হচ্ছে অনেক কিছু।
_ অনেক কিছু, কী?
_ আমার এখন কিছু বলার সময় নেই! ফিরে এসে বলবো। কাল বাবা ফিরছে,আমায় তো বাড়িতেই থাকতে হবে! না হলে তো বাবা রেগে যাবে।
_ ভাগ্যিস তিনি রেগে যায়,না হলে তো তুই বাড়িতে আসতেই চাস না।
_ মা আমার ভালো লাগে না বাড়িতে। আমার দমবন্ধ লাগে বাড়িতে। তাঁর থেকে আমার চেম্বারে আমার ভালো লাগে। নিজের মতো করে আমি শ্বাস নিতে পারি।
_ আর এদিকে যে আমার শ্বাসবন্ধ হয়ে যায় তোকে না দেখলে,সে বেলায়।
_ দয়া করো মা,আর কিছু বলো না। আমি গেলাম।
_ সাবধানে
_ হুম
পল্লব দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারও ফিরে এলো। লিমা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো।
_ মা
_ হুম
_ উনার ঘুম ভাঙলে বলো,আমি তাঁর ফোন নিয়ে গেছি! তিনি যেন আমার থেকে নিয়ে আসে। আর তাঁকে বিকালে যেতে বলো আমার চেম্বারে,ফেরার সময় একসাথেই ফিরবো। কিছু দরকারী কাজ আছে আমার উনার ফোন দিয়ে ।
_ ওর ফোন দিয়ে কি কাজ।
_ মা,আমাদের জানতে হবে আসল ঘটনা।
_ তোর কি মনে হয়,তুই ওর ফোন আঁটকে রাখলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।
_ চেষ্টা করতে তো কোন বাঁধা নেই মা।
_ হুম, আচ্ছা বলবো।
পল্লব চলে গেলো। লিমা বেগম নাস্তা বানাতে ঢুকলেন রান্না ঘরে।
—————–
নাস্তা বানানো শেষ হতেই লিমা বেগম ফ্রেশ হলেন। তারপর রজনীর ঘরের দিকে গেলেন। লিমা বেগম রজনীর ঘরে যেতেই দেখলেন,রজনী পাগলের মতো কিছু একটা খুঁজছে। ঘরের সব জিনিস উল্টে পাল্টে ফেলছে। দুর্বল শরীর নিয়ে সে কাজগুলো গুছিয়ে উঠতে পারছে না। একটু বসছে,আবারও কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে লিমা বেগম ধরে ফেললেন।
_ কি খুঁজছ, তোমার শরীর অনেক দুর্বল।
_ আন্টি আমার ফোন,আমার ফোনটা পাচ্ছি না।
কথাটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো রজনী।
_ ফোন আছে। আগে ফ্রেশ হও, নাস্তা করো তারপর ফোন দিবো।
_ না আন্টি, আমাকে এখনি বাড়িতে একটা ফোন দিতে হবে।
_ দেওয়া যাবে। আগে ফ্রেশ হও নাস্তা করো,ঔষধ খেয়ে একটু সুস্থ হও তারপর।
_ আন্টি আমি ঠিক আছি,আপনি জানেন না এই মুহূর্তে আমার বাড়িতে ফোন দেওয়াটা কতো জরুরি।
_ কিন্তু ফোনটা তো ধারেকাছে নেই।
_ মানে
_ মানে ফোনটা পল্লব নিয়ে গেছে। কোন দরকারে।
_ আমার ফোন উনার কি দরকার থাকতে পারে।
কথাটা চিৎকার করে বললো রজনী। রজনীর চিৎকারে একটু থমকে গেলো লিমা বেগম। তিনি নিজেকে সামলে বললো।
_ রাতে তোমার ফোনটা হাত থেকে পরে গিয়ে হয়তো কিছু সমস্যা হয়েছে। ফোন চালু হচ্ছে না। পল্লব হয়তো জানতো ফোনটা তোমার অনেক প্রয়োজনীয়। তাই সে ঠিক করতে নিয়ে গেছে।
লিমা বেগমের কথায় রজনী কিছুটা শান্ত হলো। লিমা বেগম ইচ্ছে করে মিথ্যা বললেন। না হলে রজনী আরো রেগে যেতো। আর এই রেগে যাওয়ার ফলস্বরূপ হয়তো খাবার ঔষধ কোনটাই খেতো না। তাই তাঁর একটু মিথ্যা বলা। রজনী শান্ত হয়ে কিছু সময় বসে রইলো। তারপর উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। লিমা বেগম সস্থির শ্বাস ফেলে নিচে চলে গেলেন। আর এদিকে তিনি শুনতে পেলেন না,রজনীর বুকফাটা আত্মনাত। কেউ দেখলো না,রজনীর নিজেকে করা আঘাত।
————-
বিকালের হিমেল হাওয়া একটু একটু শীতের আবহাওয়া বয়ে নিয়ে আসছে। জানান দিচ্ছে খুব বেশি দেরি নেই শীত আসতে। গায়ের ওড়নাটা আরো একটু গায়ে পেঁচিয়ে সামনে তাকালো রজনী। কতদূর সিএনজিটা এসেছে দেখার জন্য। এই কয়ঘন্টা নিজেকে অনেক ভাবে সে কন্ট্রোল করেছে। যখনই লিমা বেগম বলেছে,পল্লব তাঁকে ফোন আনতে তাঁর চেম্বারে যেতে বলেছে! তখন থেকেই তাঁর ভেতরে উত্তেজনা কাজ করেছে। কখন ফোন হাতে পাবে,কখন বাড়িতে ফোন দিবে। কাল ওভাবে জ্ঞান হারিয়ে সবটা পরিষ্কার করার আগেই, সবটা ধোঁয়াশা হয়ে গেলো। আজ সবটা পরিষ্কার করতে হবে। তাই ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘরে ঠেকতেই রজনী বেরিয়ে পরেছে। অবশেষে গন্তব্যে নামলো রজনী। ভাড়া মিটিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। নিচে একটা ছোট্ট মুদি দোকান। আর উপরে বিশাল এক চেম্বার পল্লবের। চেম্বার দেখলেই বোঝা যায়,বাবার অঢেল সম্পত্তি মালিক সে একাই। অবশ্য বাবা-র সম্পত্তির জন্য সে বসে নেই। নিজের পরিচয় সে নিজেই গড়ে তুলেছে। রজনীকে দেখে একটা ছেলে বললো।
_ রোগী দেখার টাইম শেষ। আগামীকাল আসবেন, স্যার আজ আর রোগী দেখবে না।
_ আমি আপনার স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছি,একটু উনাকে ডেকে দিন।
_ স্যার ভাতঘুম দিয়েছে এখন। তাঁকে ডাকা যাবে না।
_ ডেকে দিন,তিনিই আমায় আসতে বলেছে।
লোকটা সরুচোখে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো। তারপর এক ছুটে কোথাও মিলিয়ে গেলো। তাঁর কিছুক্ষণ পর ছেলেটার সাথে, সেদিনের সেই ছেলেটা দৌড়ে এলো। এসিস্ট্যান্ট নবাব রজনীকে দেখে একটু হাল্কা কেশে নিলো। তারপর রজনীর দিকে এগিয়ে এসে বললো।
_ স্যার এখন কারো সাথে দেখা করবে না,আপনি আসতে পারেন।
_ দেখুন আগে আপনার স্যারকে ডেকে দিন।
_ বললাম তো ডাকা যাবে না।
_ সেদিনের মতো সিনক্রিয়েট আমি করতে চাইছি না,ডেকে দিন আপনার স্যারকে। আমি কিন্তু–
নবাব একটু ভয় পেলো। আজকালকার মেয়েদের একটুও বিশ্বাস নেই। যখন তখন যা খুশি তাই করতে পারে। তাই সে কোন রকমে বললো।
_ আচ্ছা ডেকে দিচ্ছি। এই ফারুক তুই এখানেই থাকিস।
_ আচ্ছা
এরপর নবাব ছুটলো পল্লবের কাছে। পল্লব সবে মাথাটা রেখেছিলো বালিশে,এরমধ্যেই নবাব ছুটতে ছুটতে এলো।
_ স্যার,স্যার সেই মেয়েটা আবার এসেছে। এবার এসেও কেমন ব্যবহার করছে।
পল্লব অবাক হয়ে বললো।
_ কোন মেয়েটা
_ ওই যে,সেদিন আপনার সাথে ঝগড়া করলো।
পল্লব কিছু সময় ভবতেই রজনীর কথা মনে পরলো। তাই সে বলল।
_ নিয়ে আসো
_ কিন্তু স্যার
_ যা বললাম তাই করো।
_ আচ্ছা
নবাব আবার ছুট লাগালো। যেমন ভাবেই সে ছুটে গিয়েছিলো,তেমন ভাবেই ছুটে এসেছে।
_ আপনাকে স্যার ভেতরে ডাকছে। চলুন আমার সাথে।
রজনী নবাবের সাথে ভেতরে গেলো। একটা দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে নবাব বললো।
_ ভেতরে যান,স্যার ভেতরেই আছে।
তারপর নবাব সরে দাঁড়ালো। রজনী দরজটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকতেই সে দেখলো ছোট্ট একটা কোয়াটার রুমের মতো একটা রুম। যাঁর বাড়ি এতো বড়,সে কিনা এই ঝুপড়ির মতো একটা রুমে থাকে। অথচ তাদের বিষাল সাইজের রুমগুলো সব খালি পরে আছে। এই জন্যই হয়তো বলে, বড়লোকের মতিগতি বোঝা বড় দায়।
_ ওভাবে না তাকিয়ে থেকে ভেতরে আসুন।
পল্লবের কথায় চারিদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো রজনী। এবার তাঁর চোখ পড়লো পল্লবের দিকে। পল্লব শর্ট প্যান্ট আর গেঞ্জি পড়া। পায়ে কালো পশম গুলো সব স্পষ্ট। পল্লব অতিরিক্ত ফর্সা নয়,কিন্তু যতোটা ফর্সা তাতেই তাঁর কালো পশম গুলো একদম চেয়ে আছে। যেন সাদা আকাশে এক টুকরো কালো মেঘ। চুলগুলো এলোমেলো, চোখেমুখে ঘুমের রেশ লেগে আছে। যে কেউ ক্রাশ খেতে পারে। কারণ বর্তমানে ক্রাশ খাওয়া,আর সাথে করে বাঁশ নিয়ে ঘোরা এক।
_ ওভাবে কি দেখছেন চারচোখ দিয়ে। দুই চোখ দিয়ে দেখলেই মানুষের নজর লেগে যায়! আর আপনি চারচোখ দিয়ে দেখছেন। নজর তো তাহলে বেশি লেগে যাবে।
পল্লবের কথায় রজনী লজ্জা পেলো। আসলেই সে একটু বেশিই তাকিয়ে ফেলেছিলো। বাড়িতে এই দু’দিন তাঁকে এভাবে দেখেনি বলেই হয়তো এভাবে তাকিয়ে ছিলো। আর তাই লোকটা এভাবে বলতে পেরেছে। কিন্তু এখানে সে ঝগড়া করতে আসেনি,তাই সোজাসুজি বললো।
_ আমার ফোনটা দিন,আমার কাজ আছে।
_ এই মুহূর্তে আপনার ফোন আপনায় দেওয়া যাবে না।
_ দেওয়া যাবে না মানে?
_ কাল যেভাবে ভয়ে পেয়ে অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন,আমি চাই না সেভাবেই আপনি আবার অসুস্থ হন।
_ মানে,আপনার মাথা ঠিক আছে আপনি কি বলছেন?
_ হুম একদম ঠিক আছে। আপনি একজনের নাম শুনতেই ওভাবে জ্ঞান হারালেন। গায়ে ধুম জ্বর উঠিয়ে ফেললেন। সেই আপনি যদি দেখেন,সেই নামের মানুষটা আপনায় ফোন করেছে আপনি নির্ঘাত হার্টঅ্যাটাক করবেন।
_ আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
_ মঈনুল না কি নাম ছেলেটার,সে আপনার বান্ধবীর থেকে আপনার নাম্বার যোগাড় করে ফেলেছে।
_ কিহহ
_ প্লিজ জ্ঞান হারাবেন না। কারণ আপনি যদি এখন অজ্ঞান হয়ে এখানে পরে যান,আমার এসিস্ট্যান্ট ভাববে আমি কিছু আপনার সাথে করে বসেছি। তাই জ্ঞান হারানো যাবে না। এখানে বসুন।
এই কথা বলেই রজনীর হাত ধরে পল্লব নিজের পাশে বসালো। রজনীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে বললো।
_ আপনি যদি সবটা আমাদের না বলেন,আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না। সবটা না বুঝলেও যতটা বুঝেছি,আপনি খুব বিপদে আছেন। তাই প্লিজ আমাদের বলুন। অন্তত আমাকে বলুন।
_ আসলে তেম—-
রজনী কথা শুরু করার আগেই পল্লবের ফোন বেজে উঠলো। পল্লব ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো।
_ হ্যা নবাব বলো
_ ***********
ওপাশে কি বললো শোনা গেলো না কিছুই।
_ কি বলছে।
_*******
_ তুমি বলোনি এটা তোমার নাম্বার
_*******
_ আচ্ছা, নতুন সিম কিনতে বলেছিলাম কিনেছো।
_ *******
_ আচ্ছা কিনে নিয়ে আসো,আর ততোক্ষণ ফোনটা অফ করে রাখো।
_********
_ রাখছি।
হাত থেকে ফোনটা রেখে দিলো পল্লব। রজনীর দিকে তাকিয়ে বললো।
_ মঈনুল আবারও ফোন করেছে। কাল রাতেও করেছিলো। সকাল থেকে পনেরোবার ফোন করেছে। পনেরোবারই নবাব ধরেছে,তবুও মঈনুল বিশ্বাস করেনি এটা আপনার নাম্বার নয়। বুঝতে পারছেন তাহলে আপনি কতটা ভয়াবহ বিপদের মুখে আছেন। ছেলেটার কথা শুনে বোঝা গেছে,সে যখন তখন কলরেকর্ড বের করে আপনার ঠিকানা বের করে নিতে পারবে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও যদি আপনি সত্যিটা না বলেন,আমরা কিন্তু কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবো না।
_ এমনিতেই আপনারা কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবেন না। ও আমাকে মেরে ফেলবে। ও অনেক ভয়ানক। মানুষ খুন করতেও ওর হাত কাঁপে না। আমি মরে যাবো,তাতে আফসোস নেই। কিন্তু আমার জন্য ও বাবাকে,আর নিলিকে মেরে ফেলবে। আল্লাহ আমি এখন কি করবো। ও আমায় মেরে গুম করে দিবে।
_ রজনী আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। আপনি ভয় পাচ্ছেন, তাই ভয় আপনায় আঁকড়ে ধরে আছে। সবটা খোলাসা করে বলুন,দেখি কিছু করতে পারি কিনা।
_ কিছু করতে পারবেন না। আমার নাম্বার যখন ও যোগাড় করেছে,আমাকেও খুঁজে পেতে ওর সময়ের দরকার নেই। ও যখন তখন আমার সামনে এসে,আমার গলায় ছুরি ধরে বলবে। তুই শেষ রজনী, তুই শেষ।
পল্লব খেয়াল করলো,রাতের মতো করে রজনীর শরীর অস্বাভাবিক ভাবে আবারও কাঁপছে। তারমানে রজনী আবারও ভয়ে জ্ঞান হারাবে। পল্লবের কি হলো কে জানে। সে একটানে রজনীকে বুকে টেনে নিলো। বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো।
_ আপনার কিছু হবে না,রজনী। আল্লাহ চাইলে আমি আপনার কিছু হতে দিবো না। রাখে আল্লাহ মারে কে? আপনাকে আল্লাহ যদি রক্ষা করে,কারো ক্ষমতা নেই আপনাকে ছুঁয়ে দেখার। শুধু আমায় বলুন মঈনুল কে?
চলবে,,,
#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৭
মঈনুল আমার প্রাক্তন স্বামী।
রজনীর কথায় পল্লবের জড়িয়ে রাখা হাত,আলগা হয়ে গেলো। এমন কিছু হতে পারে পল্লব হয়তো ভাবতে পারেনি। তাই পল্লব অনেকটা অবাক হলো। কিন্তু রজনীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে বলতে রইলো তাঁর অতীত।
_ বর্তমানে যিনি আমার বাবা! তিনি আমার সৎবাবা। আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী। আমার বাবা যখন মারা যায় তখন আমি আমার মায়ের পেটে সাত মাস। আমার বাবা-র বন্ধু ছিলেন আমার বর্তমানের বাবা। আমাদের অনেক জায়গাজমি ছিলো। আমার বাবা-র আত্মীয় স্বজনরা সেটা লুটে নিতে চেয়েছিলো,বাবা-র মৃত্যুর পর! কিন্তু আমার মা শক্ত হয়ে সব আগলে নেয় সবটা। তিনি যতোই আগলে রাখুক সে একজন মেয়ে। তাঁর দিকে বাজে নজর সবার ছিলো। আমার মা যে অল্পবয়সী বিধবা নারী। এক সময় মা’কে আমার বাবা,মানে যাকে আমি বাবা বলে জানতাম! তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন। সে বেকার ছিলো,তিন কূলে কেউ ছিলো না যে তাঁকে বাঁধা দিবে এই বিয়ের জন্য। আমার তখন চারমাস বয়স। মা রাজি হয়! কারণ এই পৃথিবীতে একা যুদ্ধ করা অনেক কঠিন। তারপর তাঁদের বিয়ে হয়। আমাদের সংসার অনেক ভালোই কাটে। বাবা আমায় খুব ভালোবাসতেন। কখনোই তিনি বুঝতে দেননি,আমি তাঁর মেয়ে নই। এমন কী আমার কদর্য কমে যেতে পারে ভেবে আর কোন বাচ্চা তাঁরা নেয়নি। আমার বয়স যখন চার,তখন বাবা-র অনেক জমি মা বিক্রি করে দেয় হঠাৎ, তাঁর একজন বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য । তাঁরা কথা দেয়,সময় হলে তাঁরা টাকা ফেরত দিয়ে দিবে। তারপর আস্তে আস্তে দিন শেষে বছর শেষ হলো। আমি তখন নয় বছরে পা দিলাম। ভালো খারাপ কমবেশি বুঝি। মায়ের খুব বড় রোগ হলো। তখন খুব বড় বলেই জানতাম রোগটাকে। কারণ তখন ক্যান্সার কেমন রোগ এটা তো জানতাম না৷ বাবা নিজে থেকে সব বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা করালেন। কিন্তু মা সুস্থ হলেন না। কথায় বলে ক্যান্সারের নেই কোন এ্যান্সার। যদি মহান আল্লাহ রহম না করেন। বাবা তখন বাধ্য হয়ে মায়ের সেই বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ করে। তাঁরা ধীরে ধীরে সব টাকা ফেরত দেয়,যা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করানো হয়। সব টাকা শেষ হয়েছে, কিন্তু মায়ের অসুখ সারেনি। আমার দশ বছর বয়সেই মা মারা যায়। হাউমাউ করে কেঁদেছি। মাটিতে গড়াগড়ি করেছি,কিন্তু মা ফিরে আসেনি। শোক সইতে না পেরে দেয়ালে মাথা ঠুকেছি,কিন্তু মা আমার চোখ খুলে তাকায়নি। সেদিন আবারও উপলব্ধি করলাম বাবা আমায় অনেক ভালোবাসে। স্ত্রী শোক ভুলে গিয়ে আমায় আগলে নিলেন বাবা। মা’কে নিয়ে গেলেন মাটি দিতে। আমি চিৎকার করলাম,আমার মা’কে তোরা রেখে যা। ওরে আমি ঘুমাবো কেম্নে। আমায় কে খাইয়ে দিবে বায়না করলে। ওরে তোরা রেখে যা আমার মা’কে। কিন্তু আমার কথায় কি আর নিয়ম বদলে দিবে ওরা। তাই শুনলো না আমার কথা। আমি অসুস্থ হয়ে পরলাম মায়ের মৃত্যুশোক সইতে না পেরে। দিন যায় আর আমি অসুস্থ হতে থাকি। সবাই বাবাকে বললো দ্বিতীয় বিয়ে করতে। অনন্ত আমার জন্য হলেও যেন তিনি বিয়ে করে। অবশেষে ছয়মাসের মাথায় বাবা বিয়ে করলেন। তখনো আমি জানতাম না তিনি আমার বাবা নন। বাবা-র দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে বাবা শর্ত রাখলেন,তিনি কখনোই মা হতে পারবে না। তিনি রাজি হলেন। ঘরে নতুন প্রাণ ফিরে এলো। সারাদিন মায়ের মতো সংসারে কাজ করতেন,আমার খেয়াল রাখতেন। আস্তে আস্তে আমি সুস্থ হলাম। কিন্তু আমার প্রতি খেয়াল শুধুমাত্র তাঁর লোকদেখানো ছিলো। অবশ্য শুরুতে বুঝতে পারনি,পরে বুঝতে পেরেছি। মা প্রেগন্যান্ট হলো বাবা-র শর্ত অমান্য করে। বাবা রাগারাগি করতেই তিনি বললেন। রজনী আপনায় বাবা ডাকলে হয়তো আপনার প্রাণ ঠান্ডা হয়,কিন্তু আমায় মা ডাকলে আমার প্রাণ ঠান্ডা হয় না। আমার শান্তির জন্য হলেও আমি মা হতে চাই। বাবার বলার মতো আর কোন কথা ছিলো না সেদিন। তারপর আর কী? আমার সাথে সেসব অত্যাচার হতে রইলো! যা বাকি পাঁচটা অসহায়, এতিম মেয়ের সাথে হয়। বাবা আসলে হয়তো তিনি একটু ভালো ব্যবহার করতেন, কিন্তু বাবা চলে যেতেই শুরু হতো তাঁর ক্ষমতা জারী করা। এক সময় বাবা-র চোখের পরে গেলো আমার সাথে করা অন্যায় গুলো। সেদিন বাবা মা’কে বোঝালেন। কারণ অল্পতেই রেগে যাওয়ার মানুষ বাবা নন। কিন্তু বাবা-র বুঝানো,মায়ের কানে গেলো না। দিনকে দিন তাঁর অত্যাচার বেড়েছে। আর আমি নিরব হয়ে সয়ে গেছি। কখনো কখনো প্রতিবাদ করেছি,কিন্তু পেরে উঠিনি৷ আমার এই ভাঙাচুরা জীবনটা আরো ভেঙে দিতে একটা সংবাদ এলো! আমার বিয়ের। সমোন্ধটা আমার সৎমা নিয়ে এলেন। কিন্তু বাঁধ সাধলো বাবা।
কারণ সবে আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। কিন্তু আমার সৎমা সেটা মানতে নারাজ। তাঁদের প্রচুর কথা-কাটাকাটি হলো। এক সময় বাবা থাপ্পড় দিয়ে বসলেন মা’কে। আমি ভয়ে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে আড়াল থেকে। কিন্তু মা যেন নিজের রাগটা বহুগুণ বারিয়ে নিলেন,ওই থাপ্পড় খেয়ে৷ তিনি সেদিন মুখ ফস্কে বলে দিলেন। রজনী তোমার নিজের মেয়ে না,অথচ তাঁর জন্য তুমি তোমার জান দিয়ে দাও। আর নিজের সন্তানের জন্য তো কখনো মুখ ফুটে কথাও বলো না। নিজের আসল পরিচয় জানার পর আমি থমকে গেলাম। নিজের প্রতি তখন প্রচুর অনীহা এলো। খুব ঘৃণা হতে রইলো। আমার জন্য বাবা হয়তো সুখী একটা জীবন পাচ্ছেন না। আমি ঘরে চলে এলাম। আর ওদিকে চলতে রইলো বাবা-মায়ের তুমুলঝগড়া। সকাল হলো,সেই সাথে সূচনা হলো আমার জীবনের নতুন এক সকালের। বাবা কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে সবেমাত্র খেতে বসলেন। আমিও পাশে বসলাম। মা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। মায়ের গালে বাবা-র শক্ত হাতের দাগ স্পষ্ট। বুঝতে পারলাম,আমি চলে আসার পরে-ও মা’কে বাবা মেরেছে। আমি কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম নিজের মনের সাথে তখনই । আর সেটা বাবাকে বলেও দিলাম।
_ বাবা
_ বলো
_ মা যেই সমোন্ধেটা এনেছে, আমি রাজি সেখানে বিয়ে করতে।
আমার কথায় বাবা-র খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো! সাথে মায়ের খাবার দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেলো। আমার কথা শুনে বাবা কঠিন সুরে বললেন।
_ কোন বিয়ে হবে না,চুপচাপ খেয়ে উঠে কলেজে যা-ও।
_ পরের মেয়ের জন্য আর কত করবে আব্বা?
এই কথাটা আমি বলতে পারি,এটা হয়তো সেদিন বাবা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। তাই তাঁর মুখে ওঠা পানির গ্লাস পড়ে গেলো। আর আমি তখনো নিরব হয়ে খাচ্ছি। বাবা-র সাথে সাথে মাও খুব অবাক হলেন। তাঁরা কয়েক মুহূর্তে বুঝে নিলেন! রাতে তাঁদের তর্কবির্তক সবটাই আমার কানে এসেছে। আর সবটা না হলে-ও আসল ঘটনা আমি জেনে গেছি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি আরো একটি কথা বললাম।
_ বিয়েটা এই সপ্তাহের মাঝেই হবে। আর কাউকে জানানোর দরকার নেই। শুধু শুধু পরের মেয়ের জন্য টাকা খরচ করার কোন দরকার নেই।
কথা শেষ হতেই, আমি প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পড়লাম। আর তখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বাবা। কিন্তু আমি বাবাকে কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। আমার কথায় বাবা খুব অভিমান করলেন। তাঁর অভিমানের প্রথম কারণ, সে তো কখনো আমায় বুঝতে দেয়নি আমি তাঁর মেয়ে নই! তাহলে কেন আমার এতো কঠিন সিদ্ধান্ত। আর দ্বিতীয় কারণ, তাঁকে আমি এতোটা পর কীভাবে ভাবলাম। বাবা বিয়েতে রইলেন না। মা নিজ দায়িত্বে সব করলেন। কারণ তাঁদের ঘাড় থেকে যে আপদ বিদায় হচ্ছে। আমি বিদায়ের সময় কাঁদিনি। হয়তো বাবা সামনে থাকলে কাঁদতাম। কারণ একমাত্র তো তিনিই আমার আপন কেউ ছিলেন এই পৃথিবীতে। বাবা ছিলেন না বলেই হয়তো আমার চোখে পানি আসেনি। একমাত্র বাবার উপর আমি নির্ভরশীল ছিলাম। তাঁর কাঁধে আমি নিশ্চিন্তে মাথা রাখতে পারতাম। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি সেদিনের অভিমানে নেওয়া সিদ্ধান্ত আমার জীবনের ভূমি নাড়িয়ে দিবে।
চলবে,,,