শব্দহীন_বৃষ্টি (৩)

0
1288

শব্দহীন_বৃষ্টি
(৩)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
__________________________
বাড়ি জুড়ে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। বাবা রাজী হয়েছেন সাগরের কক্সবাজার আর সেন্ট মার্টিন এর ট্রিপে। অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা শেষ হতেই সে বাবাকে বলেছিলো কক্সবাজার যেতে চায় বন্ধুদের সাথে। বাবা এক কথায় বারণ করে দিয়েছিলেন। টাকা কোন ফ্যাক্ট ছিলো না সাগরের কাছে মা, ভাই আর চাচুদের থেকে মিলিয়ে সে দু’এক ট্রিপের টাকা এমনিতেই জোগাড় করতে পারে৷ কিন্তু সমস্যা হলো বাবার অনুমতি ছাড়া আজ অব্ধি সে কোথায় যায় নি৷ আর সেই থেকেই বাবাকে রাজী করানোর জন্য কত কি করলো৷ পরীক্ষা শেষ হয়েছে রেজাল্ট বেরিয়েছে তবুও বাবাকে রাজী করানো গেলো না। আর আজ নাকি বাবা নিজেই ভাবিকে ডেকে বলেছে ” বউ মা সাগর যেন বন্ধুদের সাথে কোথায় যেতে চেয়েছিলো এখানে পাঁচ হাজার টাকা আছে। দিয়ে দিও “। পাঁচটা এক হাজার টাকার নোট দিয়েছিলেন ভাবির কাছে। আর এটাই হলো গুড নিউজ। সাগর যখন শুনলো ঘটনাটা তখন তার মুখভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় ছিলো না সে খুশি হলো কি অবাক হলো। তবে এতে বেশ হৈ হুল্লোড় বাঁধিয়েছে সমুদ্র, শৈবাল, সাথী,তিথি,যুথী মিলে। একেকজন তো লিস্ট তৈরি করে ফেলেছে কার কি চাই। এ ব্যাপারে চাচীরা ও কম যায় না। তাদের ও আবদার এই শুটকি ওই শুটকি চাই৷ চাচারা আতঙ্কে কারণ এই ট্রিপে শুধু সাগর নয় বরং পরিবারের সবার উদ্দেশ্যেই খরচা হবে। কিন্তু যার জন্য এতসব সে নিজে হতভম্ব । এদিকে দোলার প্রতি আজ একটু অন্যরকম ভালোলাগার সৃষ্টি হলো তা নিয়ে ও ভাবনায় সে। দোলার কথা মনে হতেই আবার মনে পড়লো সকালে পাওয়া সেই ডায়েরিটার কথা। মিষ্টি হাসির স্বপ্নকুমারীর কথাটা ও হুট করেই মনে পড়লো৷ সেই হাসির কন্যাটি কিশোরী না তরুণী অর্ধেক ছবি থেকে কিছুতেই ধরা গেল না। সাগর দোতলায় এসে নিজের ঘরে ঢুকলো। সাগরের ঘরে আসবাব বলতে একটা সিঙ্গেল খাট,একটা রিডিং টেবিল, দু’টো চেয়ার, আর একটা এক কপাট আলমারি। দরজার পেছনে কিছু ডিজাইনড হ্যাঙ্গার। ব্যস এইটুকুই। ওহ হ্যা ওয়াল জুড়ে কিছু পেইন্টিংস আছে তার সাথেই একটা নিজের বাঁধাই করা ছবি। বাকা হাসির সেই ছবিটির পেছনে আঠা দিয়ে লাগানো একটা ছোট পিন যাতে ঝুলানো থাকে সাগরের এক কপাটের আলমারির ভেতরের ছোট্ট ড্রয়ারের চাবি। বলতে গেলে বিশেষ একটা সিন্ধুক তার সেই ড্রয়ার। আর এজন্যই ওই ড্রয়ারের চাবিটি থাকে সর্বদা সকলের চোখের আড়ালে। কুড়িয়ে পাওয়া সেই ডায়েরিটাকে ও এখন খুব যত্ন করে রেখেছে ওই ড্রয়ারে। তারপর চাবিটা নিয়ে আবার ছবির পেছনে ঝুলাতেই দরজায় টোকা পড়লো।

–” কে?”

–” আমি” দোলার জবাব।

–“ওহ ; দোলা ভেতরে এসো” বলে সাগর দরজার কাছে গেল। ততক্ষণে দোলা দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এসেছে।

–” ব্যস্ত?” দোলা প্রশ্ন করলো।

–” না’তো।”

–” কবে যাচ্ছেন কক্সবাজার? ”

–” এখনো ঠিক করিনি। বন্ধুদের জানাতে হবে। সবাই আপাতত বিজি নিজ নিজ কাজে। বেশিরভাগই জব,টিউশনি নিয়ে নিয়েছে৷ আসলে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালীন৷ আর এখন তো সেই পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হয়ে মাস্টার্স ও শুরুর পথে”। এতটুকু বলে থামলো সাগর।

–” এতোদিন আগের প্ল্যান তবে তখন কেন যাননি “। দোলা কথাটা বলতে বলতে বিছানায় বসলো পা তুলেই। সাগর বুঝতে পারলো মেয়েটা আপাতত কিছুটা সময় এখানেই বসে গল্প করতে চাইছে। সাগরের গল্প করতে খারাপ লাগছে ব্যাপারটা তেমন নয় বরং বেশ লাগছে দোলার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু এক ঘরে বসে এভাবে দু’জন ছেলে মেয়ে আড্ডা দেবে বড়রা কি চোখে দেখবে কে জানে?

–” কি হলো মিষ্টার সাগর “?

–” হুম, নাহ কিছু না”।

–” আপনাকে অন্যমনস্ক লাগছে খুব। আমি কি এসে বিরক্ত করলাম আপনাকে “? দোলার কন্ঠে বিচলিত ভাব।

–” আরেহ না না আসলে কিছু একটা ভাবছিলাম। আর হ্যা প্ল্যানটা অনেক আগের। আগেই যাওয়া হত যদি বাবার অনুমতি থাকতো। আজ কি মনে করে অনুমতি দিলেন সেটা ভেবেই অবাক আমি”।

–” আঙ্কেল খুব স্ট্রিক্ট তাই না? আর আপনারা আঙ্কেলকে খুব ভয় পান “।

–” উহুম, ভুল বললেন। ভয় পাই তেমন নয়৷ এ বাড়িতে আমি আর সমুদ্র দু’টোই খুব ঘাড়ত্যাড়া আর রাগী। ডর,ভয় জিনিস গুলো আমাদের মধ্যে একদমই নেই বলা যায়। কিন্তু বাবা, মা কিংবা বাড়ির অন্য কোন সদস্য যে আমাদের চেয়ে বয়সে বড় তাদের সকলকে যথেষ্ট সমীহ করেই চলি৷ বাড়ির ছোটরা সবাই এমনটা করে। আমার এই যাওয়ার ব্যাপারে যদি বাবা আগেই যেতে বলতেন সেখানে যদি মা কিংবা চাচুরা কেউ বারণ করতেন তবুও যাওয়াটা ক্যান্সেল করতাম”। সাগর এক নাগাড়ে বলে চলল কথা গুলো আর দোলা মুগ্ধ হয়ে শুনছে প্রত্যেকটা কথা।সাগর লক্ষ্য করেছে দোলার দৃষ্টি তার মুখেই নিবদ্ধ। এতে কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে তার। সাগর চেয়ার টেনে বসেছিলো দোলা যখন বিছানায় পা তুলে বসেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে দোলার দৃষ্টির সামনে নিজেকে রাখতে কেমন যেন সংকোচ হচ্ছে তাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সাগরের উঠে যাওয়ায় ধ্যান হটলো দোলার আর লজ্জায় পড়ে গেল। এতক্ষণ সে একটা ছেলের দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলো ছিহ কি লজ্জার ব্যাপার। দোলাও এবার বিছানা ছেড়ে সোজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

_______________________

নিরব বসে আছে চামেলির ঘরে। এসেছে একটু আগেই । আসার সময় মাহির জন্য এক বক্স রসগোল্লা নিয়ে এসেছে। শিউলি খালা নাকি নিজেই বানিয়েছে রসগোল্লা গুলো। শিউলি হলো নিরবের মা মাহির বড় খালা। নিরব এসেই ভয়ে ভয়ে আগে খালার ঘরে প্রবেশ করেছে। বাঘিনী কাল বহুবার কল দিয়েছিলো কিন্তু সে একটা কল ও রিসিভ করতে পারেনি৷ পুরনো এক স্কুলের বন্ধু অনেক বছর পর যোগাযোগ করেছে তাই কথা ফুরাচ্ছিলো না।আর রাতেও পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকায় কল করা হয় নি।

–‘ কিরে আর কতক্ষণ এখানে বসে থাকবি। যা গিয়ে দেখ তোর বাঘিনী চুপটি মেরে বসে আছে বই নিয়ে। ভাব এমন যেন পড়ে একেবারে দুনিয়া উদ্ধার করে ছাড়বে।” মাহির মা একগাল হেসেই বললেন নিরবকে।

–” খালামনি আমি এসেছি সেটা তুমি বলোনি মাহিকে “?

–” বলেছি তো, আপা যে রসগোল্লা পাঠিয়েছে সেটাও বলেছি। ”

–” তাহলে এখনও যে এলোনা একশন দেখাতে “! নিরব অবাক হলো। সে তো আজ মনে মনে ঠিকই করে এসেছে আজ আর বাড়িই ফিরবে না। মাহি নিশ্চিত রেগে আছে কাল থেকে তাই আজ দেখতেই তার বিখ্যাত কিল ঘুষি শুরু করবে।কিন্তু তেমন কিছু না হওয়ায় নিরব এবার সোজা গেল মাহির ঘরেই। দরজা আধ বেজানো ছিলো সে ঢুকতেই মেয়েটা হাতে থাকা বইটা ফিকে মারলো তার উপর।

–” আউ, মেরে ফেলবি নাকি?” নিরবের কপালে হালকা একটু লেগেছে। বইটা খুব একটা স্বাস্থ্যবান না হওয়ায় রক্ষা। বইটা হাতে নিয়ে নামটা দেখলো ” হিমুর রুপালি রাত্রি” অনুচ্চস্বরে পড়লো।

–” ওহ হো বাচ্চা মেয়ে হিমুর প্রেমে পড়লো নাকি”? নিরবের প্রশ্ন। মাহি রাগে ফুঁসছে ফিরে ও তাকাচ্ছে না তার দিকে। মন খারাপ আর রাগে একসাথে ব্লেন হয়ে আছে৷ নিরব নিজে কথা দিয়েছিলো যখন যা লাগবে শুধু একটা ফোন কল তাতেই হাজির হবে মাহির সামনে। কিন্তু কি হলো কাল? আলতার জন্য মনটা আকুপাকু করছিলো কতো। বৃষ্টিতে ভেজা ছাঁদে আঁচল ছড়িয়ে আলতা মাখা পা দেখিয়ে ফটোগ্রাফির শখটা পূরন হলো না নিরব ভাইয়ার জন্য । কল রিসিভ করলেই বলতো জলদি আলতা কিনে নিয়ে এসো সাথে তোমার ডিএসএলআর ক্যামেরা ও। গাল ফুলিয়ে বসিয়ে ক্ষান্ত নয় মাহি এবার কান্না ও করছে। নিরব ঝটপট মাহির পাশে বসে কাঁধ ঝাঁকালো। “এই বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? রাগ করেছিস? খালামনি কিছু বলেছে? মাহিম কিছু বলেছে? ” এক নাগাড়ে বলেই চলছে এদিকে ন্যাকা কন্যার কান্নার দমক বেড়েই চলছে৷ মাহির মা ও কান্না শুনে দৌড়ে এলো। কিন্তু মেয়েটা মুখ খুলছেই না কেন কাঁদছে। মাহির বিরক্ত হয়ে আবার রুম ছেড়ে বেরিয়ে ও গেছেন৷ কিন্তু নিরব তো আরেক ন্যাকা ছেলে। যে পর্যন্ত কান্না না থামবে সেই পর্যন্ত পাশে বসে মাথায় হাত বুলাবে। মাহির জন্মের পর থেকেই সবার থেকে একটু এক্সট্রা আদর করে নিরব তাকে। আর তাই মাহি বাবার পর একমাত্র নিরবের কাছেই তার সকল আহ্লাদ, আবদার রাখে।
অনেকক্ষণ পর কান্না থামলেই হিচকি তুলতে তুলতে অভিযোগ আর অভিমানের কথা জানালো মাহি। স্যরি দিয়ে কাজ হবে না তাই সকল অভিযোগ ঘুচাতে নিরবকে রাতেই আলতা কিনে আনতে হলো। কিন্তু তাতেই লাভ হলো কই এই রাতে তো আর যাইহোক গৌধুলিময় ফটোগ্রাফি সম্ভব নয় তাই নিরবকে কাল বিকেলে আবার আসতে হবে। শুধু আসলেই হবে না পুরো ছাঁদ আর ফুলের সকল টব,গাছ সব ভিজিয়ে বৃষ্টিময় প্রকৃতি তৈরি করতে হবে৷
__________

দিনের সমাপ্তি হয়েছিলো অনেক আগেই। এখন রাতের ও মধ্যভাগ চলছে৷ বাড়ির বড়রা প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এটাই সুযোগ ছাঁদে গিয়ে আড্ডা দেওয়ার। প্ল্যান করেছে সমুদ্র, সাথী আর দোলা মিলে। তাতে মধ্যমণি থাকবে দোলা। সমুদ্র বলল “কিন্তু এই আড্ডা জমবে যদি সৈকত ভাইয়া,ভাবী আর সাগর ভাইয়া থাকে”৷ দোলা বলল, ” তবে তাই হোক তাদের ও ডাকা হোক এই আড্ডায় “।

–” ইশ, দোলা আপু তুমি কি পাগল? সৈকত ভাইয়া আর ভাবী কে না হয় রাজী করানো যাবে। কিন্তু,,,,” থেমে গেল সাথী।

–” কিন্তু কি? ” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে দোলা।

–” সাগর ভাইয়াকে এখন ঘুম থেকে তুললে সাথী আর আমার পিঠে মাইর নিশ্চিত “। ফ্যাকাশে মুখে বলল সমুদ্র।এমনিতেই রাত বারোটায় উঠে এসেছে অন্ধকার ছাঁদে৷ চিলেকোঠার ঘরটার টিমটিমে আলোর নিচে বসে আছে সাথী,সমুদ্র আর দোলা। রাতের খাবারের পর কথা হয়েছিলো তাদের তিনজনের। কথা উঠেছিলো সাগরের ঘরে গিটার দেখে। গিটারটা সমুদ্রের। মাস কয়েক বাদেই সমুদ্রের মেট্রিক পরীক্ষা তাই সাগর এটা তার ঘর থেকে নিজের ঘরে রেখেছিলো। সেখানেই দেখেছে দোলা গিটারটা। দোলা নিজের ফোন থেকে হঠাৎই কল করে শিলাকে বলল, ” আপু তুমি আর দুলাভাই ঘুমিয়ে না থাকলে ছাঁদে এসো প্লিজ”।

সমুদ্র আর সাথী দু’জনেই ভয় পেল সৈকত এসেই যদি বকা দেয় রাত জাগার কারণে! কিন্তু কয়েক মিনিট বাদেই যখন তারা এলো তখন ভয় পালালো দু’জনেরই। কারণ সৈকত তেমন কিছুই বলেনি শুধু প্রশ্ন করেছে ” কাল ক্লাস নেই”? দু’জন একটু করে মাথা নেড়েছিলো যদিও অন্ধকারে তা সৈকত দেখেনি। সমুদ্র ছাঁদের গেইট বন্ধ করে গিটারটা নিয়ে মাত্রই তার গুলোতে আঙ্গুল চালাতে যাচ্ছিলো। তখনই ধরাম করে ছাদের দরজায় আওয়াজ হয়ে দরজাটা খুলে গেল। সবার চোখ তৎক্ষনাৎ ছুটে আসা শব্দের দিকেই। দরজায় আবছা আলোয় চোখে পড়লো একটা নরমূর্তি। মাথার এলোমেলো চুল,পরনে সাদা প্যান্ট, সাদা টি-শার্ট । আবছা আলো আবছা অন্ধকারে বেশ চোখে লাগলো সবার সাদা রঙটা।

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here