শব্দহীন_বৃষ্টি
(৪)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
__________________________
খোঁচা দাঁড়ি, গম্ভীর, কঠোর মুখভঙ্গি ,বলিষ্ঠ দেহাগঠন। একজন সুদর্শন সুপুরুষ বটে সাগর আহমেদ।
প্রায় দশ,পনেরো মিনিট ধরে সাগর গিটার বাজাচ্ছে আর এই দশ মিনিটে তার দুই ভাই দু’টো গান গেয়েছে। ছাঁদে আড্ডার আসর জমেছে বেশ ভালোই। সাগর যখন সাদা প্যান্ট, টি-শার্ট গায়ে ছাঁদের দরজায় দাঁড়িয়েছিলো হালকা আলোয় প্রথমে সবাই আৎকে উঠলেও পরবর্তী তে ভয়ে চুপসে গিয়েছিলো সাথী আর সমুদ্র। তারা ভেবেছিলো আজ ভাইয়া রাত জেগে আড্ডার অপরাধে বকবে কিংবা একটুখানি উত্তম মধ্যম দিবে। কিন্তু নাহ তেমন কিছুই হয় নি। বরং ভাইয়া নিজেই তাদের পাশে বসেছে আড্ডা দিবে বলে। মিনিট কয়েক বাদে দেখা গেল ছোট চাচী, চাচা আর যুথী ও এসে যোগ দিয়েছে। একসাথে এতগুলো মানুষ আড্ডা দিবে ভেবে সাগর বলল, ” আড্ডার আসর জমালি আর মুখের চালান রাখলি না এটা কেমন কথা”? সাথে সাথে সৈকত আর ছোট চাচু ও যোগ দিলো এখন খাওয়ার ব্যবস্থা ও করতে হবে আর গানের ও। খুব দ্রুত হয়ে গেল সেসবের ব্যবস্থা। ছোট চাচী আর ভাবী মিলে নিচে গেল। ফিরে এলো চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে বড় একটা বোলে করে।
–” শুধু মুড়ি মাখা”? কথাটা বলেই সৈকত ভ্রু কুঁচকালো।
–” মাঝরাতে হুট করে পার্টি করলেই এর চেয়ে বেশি কিছু জুটবে না”। মুখ ভেঙিয়েই বলল শিলা।
–” আমার সমস্যা নাই বউ মা মুড়িমাখাই মজা করে খাবো আমি” বেশ উৎফুল্ল হয়েই বললেন রিয়াদুল ইসলাম।
–” কিছু মানুষ খাবার পেলেই খুশি হয়ে যায় তাদের আবার পছন্দ- অপছন্দ, ভালো-মন্দ বলতে কিছু আছে নাকি”? ছোট চাচী কথাটা চাচুকেই উদ্দেশ্যে করে বলেছে তাই সবাই বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো৷
–” সাথীর আম্মু হজম করে নিচ্ছি কথাটা এই মুহুর্তে তোমার কথা চিবানোর ইচ্ছে নেই৷ এখন তো আমার ভাতিজাদের গান শুনবো। কি বলিস সৈকত”?
–” হ্যা, হ্যা এখন গান হবে আর শুরুটা করবে সৈকত ভাইয়া”। সমুদ্র একটু চেঁচিয়ে বলল৷
–” ওমা! তোমার ভাই আবার গান ও জানে নাকি? কই বিয়ে হলো ছ’মাস চলে আজ অব্দি ঠিকঠাক গলা খাঁকড়ি দিতে ও তো শুনলাম না”। শিলা একটু খোঁচা মেরেই বলল। কিন্তু এতোটাও সহজ হলো না খোঁচা মেরে বসে থাকা৷ সাগর আর সমুদ্র একসাথেই বলে উঠলো ” আমার ভাইকে খোঁচা মারলে ছেড়ে কথা বলবো না কিন্তু “।
–” কি করবেন শুনি? আপু তো ঠিকই বললো কই দুলাভাই যদি গাইতেই পারে তবে বউকে কেন শোনালো না কখনও “? দোলা ও এবার তাল মিলিয়ে বলে দিলো।
–“বেয়াইন সাহেবা আমার ভাই স্পেশাল মোমেন্ট, স্পেশাল,ওয়েদার আর স্পেশাল রিজন পেলেই গায় শুধু। আর তার প্রতিভা ও স্পেশাল মুহুর্ত ছাড়া প্রকাশ করে না”। সাগর একটু মুড দেখিয়েই বলল এরই মাঝে সাথী বলে উঠলো, ” ভাই বলছো কেন ভাইয়া? বলো আমরা ভাই বোনেরা। ”
সাথীর মা ও যোগ দিলো এবার ” হ্যা দোলা আমাদের বাড়িতে শৈবাল আর তিথি ছাড়া বাকি সব গুলো ছেলে মেয়েই মিউজিকে বেস্ট।
–” কি বলছেন ছোট চাচী”! বেশ অবাক হলো শিলা। তার বিয়ের এ ক’মাসে সে শুধু সাগরের গিটার বাজানো দেখেছে আর সমুদ্রের গান শুনেছে তবে সেটা অনেকটা গুনগুন করে। সবার কথা শুনে সৈকত শুধু মুচকি হাসছে৷ যুথী পুরো সময় চুপ ছিলো এবার সে নড়েচড়ে বসলো৷
–” ভাবী সাথীপু গত বছর উপজেলায় ভিত্তিক সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে গানের জন্য পুরষ্কার পেয়েছে। এবার জে.এস.সি দিবে বলে আম্মু গান থেকে আলাদা করে দিয়েছে। আমি আলসেমি করি বলে আমার গান গাওয়া বন্ধ সাথীপু’র সাথে সাথেই। সমুদ্র ভাইয়া গিটার,গান দু’টোই শিখেছে কিন্তু এ বছর মেট্রিক তাই ভাইয়ার ও বন্ধ করে দিয়েছে৷ সাগর ভাইয়া তো বাড়ির বাইরে প্রেক্টিস কর,,, ”
–” ওই পুচকি চুপ যা। একাই বকবক করে যাচ্ছিস। পুরো গানবৃত্তান্ত শোনাতে কে বলছে তোকে”? ধমকে উঠলো সাগর। আর বাকি সবাই হাসছে শিলা আর দোলা ছাড়া। তারা দু’বোন তো অবাকের শেষ সীমানায়। এ বাড়ির সব ছেলেমেয়েই কি গানের পাখি!
_______________________
মাহি কান্না থামিয়ে সকল অভিযোগ,অনুযোগ সবটা যখন নিরবকে বলে ক্ষান্ত হলো তখন নিরব নিয়ে আসা রসগোল্লা খাওয়ালো তাকে। এরপর আরো ঘন্টাখানেক সময় আড্ডা দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে চলে যেতেই মাহি ঘুমিয়ে পড়েছ। আজ তার ম্যাথ টিচার আসেনি তাই আর পড়তে বসতে ও ইচ্ছে হয় নি। কিন্তু রাত বারোটার পরই ঘুমটা ভেঙে গেছে গিটারের টুংটাং মৃদু আওয়াজে। জানালা খোলা তবুও আওয়াজটা খুব অল্পই আসছিলো। কিন্তু ঘুম অনেকটা হয়ে গেছে আগেই তাই হয়তো এতটুকু আওয়াজেও ভেঙেছে। বিছানায় বসেই শরীর কিছুটা মুচড়িয়ে বিছানা ছাড়লো। জানালা দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্রের ছাঁদে টিমটিমে আলো। এবার গিটারের সাথে সমুদ্রের কন্ঠও শোনা যাচ্ছে। মাহি তার কন্ঠ চেনে স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই সমুদ্র,সাথী,যুথী তিনজনই গায়। সাথীর সাথে মাহির খুব ভাব বরাবরই। ছুটির দিন গুলোতে প্রায়ই সাথী, যুথি আর মাহি মিলে তাদের ছাঁদে বসে খেলাধুলা ও করতো৷ তবে তাদের সঙ্গী আরো একজন হতো সেটা হলেন হাওয়া বেগম।
সমুদ্রের গান শেষ হতেই সৈকত গান গেয়েছিলো একটা। সবাই খুব উপভোগ করছে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে ছাঁদের টিমটিমে আলোয় গানের আসর। মাহির খুব করে মন চাইছে ওই ছাঁদে জমা আসরে একটুখানি সময় বসতে। কিন্তু কি করে সম্ভব! নিজেদের ছাঁদ থেকেও অনেক ভালো শোনা যাবে কারণ দু’টো ছাঁদ পাশাপাশিই। এখন চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়ে ছাঁদে উঠতে পারলেই হলো। নিজের ঘরে থাকা ছোট্ট চার্জার লাইট নিয়ে ঘর থেকে বের হলো সে। সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে উঠলো। এ বাড়িতে ছাঁদের দরজায় তালা লাগানো হয় না এটাই ভালোকথা মাহির জন্য।
সৈকতের কন্ঠ অপরিচিত তবে বেশ ভালোই গাইছে। মাহির ভালো লাগলো। রেলিং ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে গান শুনছে। যুথীর গলা শোনা গেল।
–” এবার ভাইয়া তুমি শোনাবে “।যুথীর কথা শেষ হতেই কেউ একজন গিটার হাতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গিটারটা পাশে রেখে হাত দু’টো প্রসারিত করে দু’ধারে ধরে আছে। বোঝা গেল লোকটা খালি গলায় গাইবে তাই গিটার রেখে দিয়েছে। মাহি দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখেই কিছুটা ভয় পেল। অন্ধকারে সব সাদা পড়া ইয়া লম্বা দানব দাঁড়িয়ে আছে একটা। পিছন দিক দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিটির।চোখ কঁচলে আবার তাকালো মাহি।নাহ, এই লোককে সে চিনতে পারছে না তবে আন্দাজ করতে পারছে এই ব্যক্তি আর একটু আগে গান গাওয়া ব্যক্তি এই দু’জন তার বড় দু’ভাই হবে। মাহি সমুদ্রের বড় দুই ভাইকে ঠিকঠাক দেখেনি কখনো। ছোট বেলায় ওদের বাড়ি খেলতে যেত ক্লাস এইটের পর আর বাড়ির বাইরে কোথাও তেমন যাওয়া হয় নি। এই তো সৈকতের বিয়ের দাওয়াতে ও গিয়েছিলো অথচ বর, কনে না দেখেই চলে এসেছিলো। মা বলে খাওয়া শেষ বসে থেকে কি করবি?
আকাশে ওড়ে পাখিটা,,পাখিটা ওড়ে আকাশে
হো ওওও কোনদিনো একা বা দোকা
পাখিটারে যায় না দেখা,,
শুধু তার গান আসে ভেসে বাতাসে,,, বাতাসে
হো ওও রোদের নিচে মেঘ উড়ে মাটির উপর পরে ছায়া,,
ছায়ার ভেতর একটা ছবি কেমন যেন মায়া মায়া( 2)
শুধু তার গান আসে ভেসে বাতাসে,,বাতাসে,,
(বাকিটুকু নিজ দ্বায়িত্বে শুনে নিয়েন)
গান শেষ হতেই সবাই সবাই একসাথে হাত তালি দিয়ে তারিফ করতে লাগলো। এর মাঝেই কন্ঠ শোনা গেল পাশের বাড়ির ছাঁদ থেকে।
–” ওহ মাই গুডনেস আপনি তো দেখছি সমুদ্রের চেয়েও ভালো গাইতে পারেন। ইনফ্যাক্ট আপনারা যে তিনজন গাইলেন তার মধ্যে আপনি বেস্ট গাইলেন সাদা টিশার্ট ভাইয়া আর হ্যা এখন তো রাতের বেলা দিনের গান একদমই মানাচ্ছে না “। এক দমে কথাটা শেষ করেই জ্বিভে কামড় বসালো মাহি। জোশে পড়ে এত রাতে সে পাশের বাড়ির লোকের গান শুনে মন্তব্য করছে। ব্যাপারটা অকওয়ার্ড বলে মনে হলো এখন নিজের কাছেই।
____________________
সাগরের মনে ভালো আর চমৎকার এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে যখন দেখলো দোলা অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। যতক্ষণ সে গান গেয়েছে পুরো সময় দোলা শুধু তার দিকেই চেয়ে ছিলো। তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা আবছা আলোতে ও চোখে পড়েছিলো। অন্যরকম ছিলো সেই চোখের ভাষা কিন্তু সেই মুগ্ধতা কয়েক সেকেন্ডই স্থায়ী ছিল। এরপরই পাশের বাড়ির ছাঁদ থেকে ছুটে আসা মন্তব্যে ঘোর কাটিয়ে অবাক করেছিলো তাকে এমনকি উপস্থিত সবাইকেই। মধ্যরাতে অন্ধকার ছাঁদে একটা মেয়ে চুপচাপ তাদের গান শুনছিলো। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি সবাই চমকে গিয়েছিলো। সমুদ্র আর সাথী একসাথেই প্রশ্ন করে উঠলো মাহিকে ” এতো রাতে ছাঁদে একা কি করো”?
–” একা কোথায়! ওই তো তোমরা এতজন একসাথে আছো। কাছেই তো। ”
–“মেয়েটা কে “? শিলা প্রশ্ন করলো।
–” এ তো মনজুর আঙ্কেল এর মেয়ে মাহিয়া। আমার ক্লাসেই পড়ে ” সমুদ্র বলল।
–” কত ভয়ানক রকম সাহসী মেয়েটা তাইনা “! দোলা চোখে মুখে বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
–” শুধু কি সাহসী? একদম বিচ্ছু মেয়ে মাহি৷ ছোট বেলায় ছিলে অবশ্য এখন তো আসে না এদিকে। ” সাথীর মা বলল কথাটা।
–” তা মামনি তুমি এত রাতে একা ছাঁদে এসেছো কেন? ভয় লাগে না! ” বলেই সাথীর বাবা মুড়ির বোল নিয়ে দক্ষিণ দিকটায় এগিয়ে গেলেন৷ যেদিকে মাহি দাঁড়ানো ছিলো৷ বোলটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ” নাও মুড়ি খাও আর গান শোনো “। মাহিও বেশ উৎফুল্ল হয়ে এক মুঠো মুড়ি নিয়ে মুখে পুরে বলতে লাগলো, ” ইশ, আপনারা সব্বাই কত্তো মজা করতে পারেন একসাথে”।তার কথায় আফসোস স্পষ্ট৷ বাড়িতে যতক্ষণ ফ্রী থাকে সে একাই থাকে৷ হয় ছাঁদে নয় ঘরেই বসে থাকে৷ এখন তো আর খেলাধুলা ও করা হয় না। মাঝে মাঝেই ভাবে সে কেন বড় হলো? ছোট থাকাটাই ভালো ছিলো।
সাগর ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখলো৷ রাত দেড়টা পাড় হয়ে গেছে। তাই আর দাঁড়াতে চাইলো না বলে গেইটের দিকে এগিয়ে “গুডনাইট ” বলে চলে গেল। কারো কোন জবাবের অপেক্ষা করলো না ৷ বিষয়টা পরিবারের সবাই বুঝতে পারলেও অবাক হলো দোলা আর মাহি দু’জনেই। আর দু’জন দু ‘ ছাঁদে থাকা সত্ত্বেও একসাথেই বলে উঠলো ” ভাব?!” দোলার বলার অর্থ প্রশ্নবোধক হলেও মাহির বলার অর্থ আশ্চর্যবোধক ছিলো।
চলবে