#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী
রিমার বিয়ে হয়েছে পঁচিশদিন হল। আজ সকালে কিচেনে গিয়ে রিমা শাহেদের জন্য নাস্তা তৈরী করছিলো। হঠাৎ কিচেনে শব্দ হওয়ায় রিমার শাশুড়ি রাহেলা বেগম দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে চিৎকার করে শাহেদকে ডেকে বললো,
—–এই শাহেদ তোর বউয়ের কি হল দ্যাখ? হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়লো ক্যান?
শাহেদ দৌড়ে এসে রিমাকে উঠানোর চেষ্টা করতে লাগলো। রিমার জা মর্জিনা এসে শাহেদকে বললো,
—–মেজ ভাই আগে রিমার মুখে পানি ছিটা দেন। দেখবেন জ্ঞান ফিরে আসবে।
শাহেদ তাড়াতাড়ি গ্লাসে করে পানি নিয়ে রিমার মুখে ছিটিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ওর জ্ঞান ফিরে আসলো। তারপর শাহেদ ওকে ধরে রুমে নিয়ে শুয়ে দিল। অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে সাতটা বাজে। এসময় শ্যাওড়াপাড়ায় প্রচণ্ড জ্যাম হয়। আজকে অফিসে যেতে শাহেদের দশটা বেজে যাবে। অগত্যা নাস্তা না করেই শাহেদ অফিসে রওয়ানা হলো।
রিমার খুব বমি বমি লাগছে। রিমা ওয়াশরুমে গিয়ে হড়হড় করে বেসিনে বমি করলো। বমির শব্দে মর্জিনা এসে রিমাকে দেখে গিয়ে ওর শাশুড়িমাকে বললো,
——মা রিমা তো দেখি বমিও করছে। ওর তো বিয়ে হয়েছে কেবল পঁচিশদিন। এতো তাড়াতাড়ি কনসিভ করলো ক্যামনে?
—-তুমি শিওর মর্জিনা ও বাচ্চা কনসিভ করছে।
—–হ্যা মা আমি শতভাগ নিশ্চিত ও প্রেগনেন্ট।
—–আমি তখনি শাহেদরে বলেছিলাম এই মেয়েটারে তুই বিয়া করিস না। যার চরিত্রে একবার দোষ লেগে যায় সেকি কখনও ভাল হয়। কার বীজ পেটে করে নিয়ে এসে আমার শাহেদের ঘাড়ে চেপে বসেছে কে জানে। আমার ছেলেটাকে সাধাসিধে পেয়ে ওর বাপ সুন্দর করে ওর কাছে গছিয়ে দিলো। ছেলে যে আমার কি দেখে মজে গেল আমি বুঝলাম না। আজ আসুক শাহেদ ওকে বলবো এই বাচ্চা তুই এবরশন করে ফেলে দিয়ে আয়। আর নয়ত ওকে ওর বাপ মার কাছে দিয়ে আয়।
রিমা শরীরটা একটু ভাল লাগায় ও কিচেনে চলে আসে। আবার নাস্তা বানাতে শুরু করে। মর্জিনা দৌড়ে এসে বলে,
—–মা তোমাকে রান্না ঘরে আসতে নিষেধ করেছে।
—–ভাবি বমি করার পর শরীরটা ভাল লাগছে। মা মনে হয় ভাবছে আমার শরীর খুব খারাপ। তাই হয়ত কিচেনে ঢুকতে নিষেধ করেছে।
—–না মা সেটা ভাবেননি। যাক আমি ওসব ওথা আমার মুখ দিয়ে বলতে চাই না। মা তোমাকে বলবেন। এদিকটা আমি সামলে নিবো। তুমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে বাথরুম ধুয়ে ফেলো।
—-মিনারা খালা তো একটু পরেই চলে আসবে। ঐ কাজগুলো তো খালাই করে।
—-আজ মিনারা আসবে না। তুমিই করে ফেল। আর হ্যা এমনিতেই আমার সহজ সরল ছেলেটার যা
ক্ষতি করার তোমার বাবা করে ফেলেছেন। এখন আমার এতো যত্নে গড়া সংসারে তুমি আর অমঙ্গলের ঘন্টা বাজিও না।
—–মা আমি বুঝতে পারছি না আপনি এসব কথা আমায় কেন বলছেন।
—–বিয়ের আগে নষ্টামী করে এখন সাধু সাজা হচ্ছে। কার সাথে নষ্টামী করে পেট বানিয়েছে। এখন আমার শাহেদের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছো। আমি বেঁচে থাকতে একাজ হতে দেবো না। তখনই শাহেদকে বলেছিলাম এই মেয়ে তোর যোগ্য না। কি দেখে যে মজে গেল আমার ছেলে বুঝলাম না। গায়ের রংটা শুধু সাদা দেখলে তো হবে না। স্বভাব চরিত্র সাদা না কালো সেটাও তো বোঝা দরকার। ছেলে আমার কথা শুনলো না।
—–মা আপনি যা নয় তাই আমাকে বলছেন। আমি তো এখনও টেস্ট করি নাই আমি প্রেগনেন্ট কিনা। আর যদি কনসিভ করেই থাকি তাহলে এই সন্তান আপনার ছেলের।
এই কথাগুলো বলে রিমা কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে গেল।
রিমা ভাবছে সারাজীবন ওর ঐ ভুলটা বয়ে বেড়াতে হবে। শাশুড়ির মুখে এসব কথা শোনার পর রিমার পৃথিবীটা দুলে উঠলো। সত্যি যদি শাহেদ ওর মার কথা বিশ্বাস করে ওকে ওর বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় তাহলে ওর বাবাকে হয়ত আর বাঁচানো যাবে না। এমনিতেই ওর ঐ ঘটনার পর ওর বাবা স্ট্রোক করেছিলো। সে ধাক্কা আজ পাঁচ বছর ধরে সামলাচ্ছে। সমাজে মুখ দেখানো যাচ্ছিলো না।ভাই দুইটা মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে। ওর কারণে ওর পরিবারকে অনেক ধকল পোহাতে হয়েছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওর বাবা মা ওকে বিয়ে দিয়েছে। যেভাবেই হোক শাহেদের হাতে পায়ে ধরে হলেও এই সংসার ওকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
শাহেদের বাবা বেঁচে নেই। শাহেদের বাবা আর রিমার বাবা এক অফিসে চাকরি করতো। শাহেদ যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন ওর বাবা স্ট্রোক করে মারা যায়। শাহেদরা দুই ভাই একবোন। রাশেদ তখন ক্লাস সেভেনে আর মুন্নি তখন সিক্সে পড়ত। রাশেদ সবার বড়। ও এখন পারটেক্স গ্রুপে চাকরি করে। শাহেদ সাস্ট থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে ইউনিলিভার কোম্পানীতে জয়েন করেছে। রিমার বাবা সেসময় ওদের অনেক টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতো। এমনকি ওর বোনের বিয়েতেও টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। মুন্নি সোসিওলজিতে মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা প্রমিন্যান্ট এনজিও তে জয়েন করেছে। ওর হাসবেন্ড ব্রাকে রিসার্চ অফিসার পদে জয়েন করেছে। ওদের এতোদূর আসার পিছনে রিমার বাবার অনেক অবদান আছে। শাহেদ পারেনি রিমার বাবার অবদানকে অস্বীকার করতে।
রিমা খুব টেনশনে আছে শাহেদ যদি ওর মার কথা বিশ্বাস করে। কিন্তু ওর মা যা ভেবেছে তাতো ঠিক নয়। যদি ও সত্যি কনসিভ করে তাহলে এ সন্তানের বাবা তো শাহেদ। এতে কোনো ভুল নেই। ও জানে না ওর ভাগ্যে কি লেখা রয়েছে।
রিমার আজ আর রুম থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না। শাশুড়ি মা এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না বলে বিয়ের পর থেকেই নানারকম তীক্ষ্ণ কথার বাণে দিনগুলো পার হতে থাকে। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। রিমা যদিও রাজশাহী ভার্সটি হতে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স কমপ্লিট করেছে কিন্তু আরোও বড় কিছু অর্জন করার ওর যোগ্যতা ছিল। অথচ একটা ভুলে কালবোশেখি ঝড়ের মতো একটা আঘাত এসে ওর জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙ্গেচূড়ে তছনছ হয়ে গেল।
রিমা ভাবছে জীবনের শুরুটা যদি ঝকঝকে রোদ্দুরের মতো আলো দিয়ে শুরু হয় তাহলে বলা যাবে না ওই রকম মেঘমুক্ত আকাশের মতোই জীবনটা সুন্দর হবে। রিমার অবস্থাটা অনেকটা সেরকম। অথচ রিমাদের ছিলো বাবা মা দুই ভাইসহ ছোটো সাজানো সুখের সংসার। ওরা তিন ভাইবোন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে পড়াশোনা করতো। রিমা ছিল টপার গার্ল। ও তখন ইন্টার ফাস্টইয়ারে পড়ে। ওর দুভাই ক্লাস সেভেনে পড়তো। ওরা জমজ ছিলো। ওদের নাম ছিল তানভীর আর তাশদীদ। ওরাও ছাত্র ভালোয় ছিলো। কিন্তু রিমা ছিলো অলরাউন্ডার। যেমনি ভাল বিতার্কিক ছিল তেমনি খেলাধুলা পড়াশোনা সব কিছুতেই ও ছিল টপার গার্ল। ওর বাবা এজি অফিসের ডাইরেক্টর আর মা বাংলাদেশ ব্যাংকে অফিসার পোস্টে চাকরি করতেন। সুখ তখন ওদের সংসারে উপচে পড়তো। বাবা মা উভয়েই চাকরি করতেন। ওদের বাসায় ওর এক দূরসম্পর্কের ফুফু রিমাদের দেখাশোনা করার জন্য থাকতো। উনি ডিভোর্সি ছিলেন। রিমার বাবা মা ওর ফুফুর উপর সংসারের দায়ভার চাপিয়ে খুব নিশ্চিন্তে ছিলেন। রিমা মাঝে মাঝে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্ররিতে যেতো। ওখানেই জুনায়েদের সাথে রিমার পরিচয় হয়।
চলবে