একটি ভুল পর্ব-দুই

0
304

#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

জুনায়েদ ঢাকা কলেজে মার্কেটিং এ অনার্স পড়তো। জুনায়েদের সাথে রিমার দেখাটা যদিও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তবুও একটা ঘটনার মাধ্যমে রিমা আর জুনায়েদ কাছাকাছি আসে। সেদিন রিমার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে বের হতে একটু রাত হয়ে গিয়েছিল। পথে কিছু ছেলে ওকে খুব ডিস্টার্ব করছিল। বিশ্রী ভাষায় টিজ করছিল। এমন সময় সিনেমার নায়কের মতো কোত্থেকে জুনায়েদের উদয় হলো। ওর প্রায় ছ,ফিট লম্বা মেদহীন বলিষ্ঠ গঠন দেখলে ক্যাডার ক্যাডার মনে হয়। ও সামনে আসাতে ছেলেগুলো ভয় পেয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। তারপরও জুনায়েদ ছেলেগুলোকে ডেকে শাসিয়ে দিলো। ঢাকা কলেজে পড়ার সুবাদে ও তখন হালকাভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। ছেলেগুলো রিমার বয়সী ছিল। তাই ওরাও ভয় পেয়ে চলে গেল। এরপর থেকে রিমাকে ওরা আর ডিস্টার্ব করেনি।

রিমা সেদিন মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে জুনায়েদকে দেখেছিলো। তারপর থেকে রাত হলেই জুনায়েদ ওকে বাসায় পৌছে দিত। মাঝে মাঝে রিমা ইচ্ছে করেই রাত করতো যাতে জুনায়েদ ওকে পৌছে দেয়। রিমা যে জুনায়েদের প্রতি আস্তে আস্তে দুর্বল হচ্ছিল জুনায়েদ এটা ঠিক বুঝত। আজ রিমার মনে হয় সেদিন জুনায়েদও রিমার দুর্বলতার সদ্বব্যবহার করেছে। আবারও রিমা ধুলো সরিয়ে স্মৃতির পাতায় হারিয়ে যায়।
অল্পবয়সী আবেগ আর ইমোশনগুলো খুব ভয়ঙ্কর। আবেগের ঢেউগুলোতে যদি ঠিক সময়ে বাঁধ না দেওয়া হয় তাহলে নর্দমায় ভেসে যেতে সময় লাগে না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের বিচার বুদ্ধি একরকম হয় না। রিমার জীবনেও এর ব্যতিক্রম হলো না।
সেদিন রিমা জুনায়েদের প্রেমে এতটাই হাবুডুবু খেয়েছিলো সারাক্ষণ ওর ভাবনায় ডুবে থাকতো। অপেক্ষা করত কবে জুনায়েদ ওকে প্রপোজ করবে। রিমা কল্পনায় ওর মাঝে হারিয়ে যেত। তখন শুধু জুনায়েদের সাথে সময় কাটাতে ওর ভাল লাগতো। একদিন জুনায়েদকে দেখতে না পেলে ওর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেত।

সেদিন ছিল শুক্রবার। শুক্রবারে রিমা বাসা থেকে বের হতো না। বাবা মা চাকরি করত বিধায় সেদিন ওরা ফ্যামিলি মেম্বাররা একসাথে সময় কাটাতো। রিমা বড় সন্তান হওয়ায় বাবা মা দুজনেই রিমাকে অনেক ভালবাসত। বিশ্বাস করত। কিন্তু সেদিন রিমা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কোচিং এর কথা বলে জুনায়েদের সাথে গাজীপুরে সাফারী পার্কে ঘুরতে গিয়েছিল। জুনায়েদের বাইকে সেদিন ও প্রথম উঠেছিল। বারবার যখন জুনায়েদের স্পর্শ ওর শরীরে লাগছিল অদ্ভূত শিহরনে ভীষণ ভাল লেগেছিল। ওর তখন মনে হয়েছিল জুনায়েদ আজ ওকে প্রপোজ করবে। ওর স্বপ্নটা অবশেষে পূরণ হবে। সেই আবেগে বড় সন্তান হিসাবে বাবা মার স্বপ্ন পূরণের কথা রিমা ভুলে গিয়েছিল। এটাও রিমা সেদিন যাচাই করেনি বা রিমার বয়স হয়নি জুনায়েদ আদৌ ওর যোগ্য ছিল কিনা। ওকে ভালবাসে কিনা। তারপর সাফারী পার্কে পৌছানোর পর জুনায়েদ ওকে বলে,
—-তোমাকে আজ এখানে কেন আনলাম জানো?
শিহরিত অনুভবে রিমা বললো,
—–কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি।
—–হ্যা আমি তোমাকে খুব ভালবাসি রিমা।সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে চাই।
রিমাও বলে,
—–আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসি। এই দিনটির অপেক্ষায় আমি ছিলাম।
জুনায়েদ টান দিয়ে রিমাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রিমাও ভালবাসার তীব্র অনুভূতীতে জুনায়েদকে জড়িয়ে ধরে।

রিমার বয়সটা কম হওয়াতে জুনায়েদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড রিমার জানা হয়নি। জুনায়েদ কিন্তু রিমার পরিচয় পুরোটা জেনে নিয়েছিলো। রিমা ছাত্রী হিসাবে খুব মেধাবী ছিল জুনায়েদ জানত। বাবা মা দুজনেই সরকারী অফিসে ভাল চাকরি করে। অপরদিকে জুনায়েদের বাবা কৃষক ছিলেন। নিজের জমিজমা তেমন ছিল না অন্যের জমি চাষ করতে। জুনায়েদের পরিবারে জুনায়েদ একমাত্র লেখাপড়া শিখছে। ওর বোনের হাসবেন্ড ইন্টার পাশ করে শ্রমিক হিসাবে কাতারে চলে যায়। বোনের লেখাপড়া বেশিদূর গড়ায়নি।
এদিকে রিমার পড়াশোনার বারোটা বেজে যায়। পি টেস্টে রেজাল্ট খুব খারাপ হয়। কলেজের প্রিন্সিপাল রিমার বাবা মাকে ডেকে পাঠায়। সেদিন রিমার রেজাল্ট খারাপ হওয়াতে বাবা মা রিমাকে নিয়ে প্রথম ধাক্কা খায়। রিমাদের বাসায় ওর যে ফুফু থাকতো উনি রিমা আর জুনায়েদের বিষয়টা জানতেন। কারণ রিমা প্রতিদিন রাতে জুনায়েদের সাথে কথা বলতো। মোবাইলে জুনায়েদের নামটা জুলি নামে সেভ করা ছিল। মাঝে মাঝে ও কথা বলার সময় ওর মা ঘরে আসলে রিমা ফোনে বলতো,
—–জুলি দোস্ত ফোনটা রাখি। পড়াশোনার চাপ আছে।
ওর মা ভাবত মনে হয় ক্লাসের কোন বান্ধবীর সাথে কথা বলছে। তবে ওর ফুফুটা ওর সাথে ওর রুমে থাকতো বিধায় জুনায়েদের ব্যাপারটা জেনে ছিল। এই বিষয়টা ওর ফুফু রিমার বাবা মাকে কখনও জানায়নি। এমনকি রিমার রেজাল্ট খারাপ হওয়া সত্বেও বলেনি। আসলে আজ রিমার মনে হয় স্বামী স্ত্রী দুজনে চাকরি করলেও নিজের সংসার, ছেলেমেয়েদের তদারকি দিনশেষে নিজেরই করা উচিত। এটা কখনও অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
প্রিন্সিপাল রিমার বাবা মাকে ডেকে নিয়ে বলে,
—–এতো ব্রিলিয়ান্ট একটা মেয়ে সে পি টেস্টে ফেল করলো। ও আগের মতো পড়াশোনায় মনযোগী নাই। আপনাদের একটু খোঁজ নেওয়া দরকার ও কোন বাজে সঙ্গদোষে পড়েছে কিনা।
রিমার বাবা একটু বড় গলায় বললো,
—– রিমা আমার সেরকম মেয়েই নয়। রেজাল্ট ও খারাপ করেছে বটে তবে আপনারদেরও এর পিছনে কিছু দায় থেকে যায়। যাই হোক আমি আমার মেয়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবো।
প্রিন্সিপাল আবারও বললো,
—–চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আপনার মেয়ে আমাদের কাছে মাত্র ছয় ঘন্টা থাকে বাকী সময়টা আপনাদের কাছে। সুতরাং সন্তানের সবকিছু আদ্যপান্ত আপনাদের জানা উচিত। আর সর্বপরি নিজের সন্তানের দায়ভার নিজেকেই বহন করা দরকার। কারণ সন্তানের ক্ষতি হলে আপনার সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হবে। আমার উচিত ছিল আপনাকে ইনফর্ম করা। আমি আমার দায়িত্ব থেকে করেছি।

বাসায় এসে রিমার মা রেগে গিয়ে ওকে বললো,
—-যদি ভালো করে পড়াশোনা করতে না পারো তাহলে আমাকে জানিয়ে দিও। তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিবো। পরের বাড়িতে ঝি গিরি করে ভাত খেও। আমি আমার ছেলে দুটোকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবো।
রিমা ওর বাবার খুব ভক্ত ছিল। তাই বাবার কাছে গিয়ে সরি হলো। আর ওর বাবাকে কথা দিল ও খুব ভাল করে লেখাপড়া করবে। রিমা ওর কথা রেখেছিল। পরীক্ষার সময়ে ও জুনায়েদের সাথে দেখা সাক্ষাত করা বন্ধ করে দেয়। যদিও রিমার খুব মন খারাপ হতো তারপরও ভাল রেজাল্ট করার স্বার্থে নিজেকে সামলে নিত। এদিকে রিমার সাথে দেখা না হওয়ায় জুনায়েদ ওদের বাসার কাছে এসে মাঝে মাঝে ঘুরঘুর করতো। রিমার রুমের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতো। রিমা বারান্দায় এসে ওর সাথে দেখা দিতো।
যার কারণে জুনায়েদ একদিন ওর বাবার সামনে পড়ে যায়। রিমার বাবা ওকে প্রচণ্ড অপমান করে বলে,
—-তোমাকে যদি কখনও এই মহল্লায় দেখি তাহলে একজন ইভটিজার হিসাবে পুলিশে দিবো।

রিমাকেও ওর বাবা শাসিয়ে দেয়। কিন্তু জুনায়েদ এতে মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়। ও এটা ঠিক বুঝেছে রিমার বাবা স্বেচ্ছায় রিমাকে কখনও ওর সাথে বিয়ে দিবে না।

যাইহোক রিমা গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে। রিমার বাবা মা আনন্দে আত্মহারা হয়। এর মাঝে রিমা মেডিকেল কোচিং এ ভর্তি হয়। ওর বাবা মা সরল মনে ভাবে মেয়ে তাদের সঠিক ফর্মে ফিরে এসেছে। বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here