একটি ভুল পর্ব-চার

0
251

#ধারাবাহিকগল্প
#একটি ভুল
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

জুনায়েদ রিমাকে বললো,
——তুমি এতো দূরে চলে গেলে আমার সাথে তোমার দেখা হবে না। আমি তোমার সাথে নিয়মিত দেখা না হলে থাকতে পারবো না। আবার তোমার কাছে যেতেও পারবো না। আইনত তুমি এখন আমার স্ত্রী। সেই জোর আমি তোমার উপর প্রয়োগ করি না। তাই বলে তুমি আমায় ছেড়ে এতো দূরে যাবে এটা আমি মানতে পারবো না। এছাড়া তোমার ঢাকা ভার্সিটির পরীক্ষা এখনও বাকী আছে। এখানে চেষ্টা কর।
—–কিন্তু আব্বু আম্মু চাচ্ছে আমি ডাক্তারীটা পড়ি। আমি কি করে ওদের অবাধ্য হই?
—–আমাকে বিয়ে করে তুমি এমনিতেই অবাধ্য হয়েছো। আজ না হোক কাল ওনারা জানতে পারলে হয়ত একটু কষ্ট পাবেন। সেই কষ্টটা আগে থেকে তোমার এসব অবাধ্যতায় পেয়ে ধাতস্থ হয়ে যাক।

জুনায়েদের কথায় রিমা মনে মনে বিরক্ত হলো। ওর তো আসলে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার কথা ছিল। সেদিন রিমার মনে হয়েছিল জুনায়েদের সাথে এতো তাড়াতাড়ি ওর জড়িয়ে পড়াটা ঠিক হয়নি। জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ওর পড়শোনার উপর ভালোয় প্রভাব ফেলেছে। যে ভুলটা হয়ে গেছে সেটাকে তো আর ঠিক করা যাবে না। কিন্তু সংশোধন করে নিতে হবে। জুনায়েদের কথা শুনলে চলবে না। ওকে ভাল রেজাল্ট করে ওর এই ভুলটাকে সংশোধন করে নিতে হবে।

এদিকে ওর বাবা মাকে মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হচ্ছে। সেদিন ওর মায়ের এক কলিগ দিলারা বেগম ওর মাকে ডেকে বললো,
—-সখিনা আপা জানেন আমাদের গ্রামে এক কৃষক নিজের কোনো জমিজমা নাই। অন্যের জমি চাষ করে। তার ছেলে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। কি তাজ্জব ব্যাপার! কোচিং তো দূরের কথা পেটে ঠিকমতো দানা পানিও পড়তো না। অথচ দেখেন সকাল বিকাল কোচিং দিয়েও প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজে অনেকে চান্স পায় না। ঢাকা মেডিকেলে পড়তে না পারলে আমার কাছে তাকে ডাক্তার মনে হয় না। কসাই মনে হয়।

রিমার মা উনার কলিগের কথার কোনো উত্তর দিলো না। কারণ কথায় কথা বাড়ে। অথচ ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করলেও তার নামের পাশে যদি তিন চারটে ডিগ্রী না থাকে তার কাছে কেউ রুগী দেখাতে যাবে না। এটাই বাস্তবতা। উনাকে এখন এসব বলে লাভ নেই। মেয়ে যখন ভাল জায়গায় চান্স পায়নি তখন নানাজনে নানা কথা বলবে। কিল খেয়ে কিল হজম করতে হবে।
এর মাঝে ঢাকা ভার্সিটির ক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেলো। রিমার সেখানেও চান্স হলো না। যদিও বাবা মা দুজনেই রিমার উপর প্রচণ্ড অসন্তষ্ট। তারপর মেয়েকে সান্তনা দিয়ে রিমার বাবা বললো,
—–মন খারাপ করিস না। তুই তো মেডিকেলে চান্স পেয়েছিস। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ থেকে না হয় এমবিবিএস পাশ করে আসলি। তারপর আরোও ডিগ্রী নিবি। সম্ভব হলে বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসবি। তখন কেউ মনেই রাখবে না তুই কোন মেডিকেল থেকে পাশ করেছিস। এতো ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই।
রিমা বললো,
——-আব্বু আমি কক্সবাজারে যাবো না। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না।
রিমার মা বললো,
—–একথাটা আগে মনে ছিল না। এখন এসব ডং চলবে না। তোমাকে কক্সবাজারে গিয়েই পড়তে হবে।

রিমা মুখে কিছু বললো না। কিন্তু মনে মনে ভীষণ টেনশনে পড়ে গেল। ওদিকে জুনায়েদ ওকে বললো ঢাকার বাইরে পড়তে গেলে ও এটা মেনে নিবে না। আবার বাবা মা চাইছে ও যেন ডাক্তারীটা পড়ে। বাবা মা যদি ওর বিয়ের বিষয়টা জেনে যায় কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে সব মিলিয়ে রিমার জীবনে তখন কঠিন সময় পার হচ্ছিল। মনের ভিতরটা ক্ষয়ে যাচ্ছিল। রিমা তখন কি পরিমান ডিপ্রেশনে ছিল তা একমাত্র আল্লাহপাক জানে।

এদিকে রিমার বাবা মা বুঝে পায় না যে মেয়েকে ছোটোবেলা থেকে টপার হিসাবে গড়ে তুললো সেই মেয়ের কাছে আউটপুট ওনারা কিছুই পেলেন না। ঘাটতিটা কোথায় ছিল উনারা বুঝতে পারছেন না। রিমারও খুব মন খারাপ। রিমার মা ওর উপরে প্রচণ্ড রেগে আছে দেখে ওর বাবা ওর মাকে বললো,
—–দেখো সখিনা,এ বয়সের মেয়েরা খুব সেনসেটিভ হয়। এমন কিছু বলো না। যাতে ওর মনের উপর চাপ পড়ে।
——আমি তো বুঝতে পারছি না রিমার বাবা ওর কোথায় ঘাটতি রয়ে গেছে।
এরপরে রিমার জাহাঙ্গীরনগরে পরীক্ষা হলো। সেখানে ও বোটানীতে চান্স পেলো। রিমা মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক ঢাকার মধ্যে চান্স পেয়েছে। যদিও বাবা মা সহজে মানতে চাইবে না তারপর ওনাদের বুঝিয়ে ও ভর্তি হতে পারবে এই বিশ্বাস ওর আছে। কিন্তু আবার সমস্যা তৈরী করলো জুনায়েদ। জুনায়েদ রিমার সাথে দেখা করতে চাইল। রিমার বাবা মা এখন রিমাকে কঠোর নজরদারিতে রেখেছে। কারণ ওই অপরিচিত নাম্বার থেকে রিমার বাবার মোবাইলে আবারও মেসেজ এসেছে। এবার রিমার বাবাকে ঐ অপরিচিত ব্যক্তিটি বলেছে,
“কিভাবে নিজের মেয়েকে আটকিয়ে রাখবেন?ও আপনার মুখের সামনে দিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। আপনার তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না”।
এবার রিমার বাবা ঘাবড়ে গেল। মেয়ের দিকে নজর রাখা শুরু করলেন। একা মেয়েকে বাড়ি থেকে বের হতে দেন না। এর মাঝে কোচিং থেকে রিমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে যারা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে তাদেরকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। অগত্যা রিমার বাবা কোচিং সেন্টারে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় রিমাকে বললো,
—–তোমার অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি বা তোমার মা এসে কোচিং সেন্টার থেকে নিয়ে যাবো।
ওর বাবা চলে যাবার পর ও জুনায়েদকে ওর মোবাইল থেকে ফোন দিয়ে বলে,
—–জুনায়েদ তুমি কোচিং এর সামনে আসতে পারবে?আমি আজ কোচিং এ এসেছি।
—–আমি এখনি আসছি। তোমার ফোন বন্ধ কেন?
——আমি বাবা মার কড়া নজরদারীতে আছি। তুমি কোচিং এ আসো সাক্ষাতে তোমাকে সব বলবো।
কথা শেষ করে রিমা জুনায়েদের নাম্বারটা ডিলিট করলো। ওর বাবা মা ইদানিং ওর মোবাইল চেক করে।
জুনায়েদ খুব তাড়াতাড়ি ফার্মগেটে রিমার কোচিং এর সামনে চলে আসে। তারপর রিমা জুনায়েদকে নিয়ে একটা নিরিবিলি খালি ক্লাসরুমে বসে। এখন কোচিং এ খুব একটা ভীড় নেই। যদিও জুনায়েদ ওকে নিয়ে বাইরে কোথাও বসতে চেয়েছিল রিমা রাজি হয়নি। জুনায়েদ রিমাকে বলে,
—–আজ কতদিন পরে তোমার সাথে আমার দেখা হলো। ইদানিং তোমার ফোন ও বন্ধ থাকে। তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো।
—–বাবা মা আমাকে খুব চোখে চোখে রাখে। জরুরী কথাগুলো আগে বলে নেই। এখন তুমি আমার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শোনো। তোমাকে একটা সুসংবাদ দিচ্ছি। আমি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ব
বিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। আমাকে আর ঢাকার বাহিরে যেতে হবে না। তুমিও যখন খুশী আমাকে দেখতে আসতে পারবে। জুনায়েদ তোমার আর একবছরের মধ্যে গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যাবে। তুমি এখন থেকে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নাও। আমিও পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস দিবো। বিসিএস হয়ে গেলে দেখবে আমার বাবা মা তোমাকে মেনে নিবে। তুমিও চাকরিতে জয়েন করে তোমার বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। তোমার ছোটো বোনটাকে এসএসসি পাশের পর ঢাকায় এনে ভাল কলেজে ভর্তি করে দিবে। আমাদের জীবনের সব সমস্যাগুলো আস্তে আস্তে সমাধানের দিকে এগোবে।

জুনায়েদের রিমার কথাগুলো ভাল লাগেনি। ও মনে মনে অন্য ফন্দি এঁটেছে। রিমাদের আর্থিক সচ্ছলতা আছে। অলরেডি ওর বাবা মিরপুর এক নাম্বারে তিনকাঠা জমির উপর পাঁচতলা বাড়ির ফাউন্ডেসন দিয়েছে। রিটায়ার করে ওর বাবা মা কোয়ার্টার ছেড়ে ওখানে চলে যাবে। তাই জুনায়েদ রিমাদের আর্থিক সচ্ছলতার সুযোগটা নিয়ে রিমাকে ব্লাকমেইল করে ওর বাবা মার কাছ থেকে টাকা আদায় করবে। তারপর সেই টাকা নিয়ে ও কানাডায় পাড়ি জমাবে। সেখানে নিজেকে সেটেলড করে রিমাকে নিয়ে যাবে। ওখানেই ভবিষ্যত গড়বে। অথচ রিমা যে স্বপ্ন দেখছে জুনায়েদের পক্ষে এই স্বপ্ন সফল করা সম্ভব নয়। রিমা হয়ত পারবে কিন্তু জুনায়েদের লেখাপড়ার অবস্থা খুব একটা ভাল না। তাই নিজের উদ্দেশ্য গোপন রেখে রাগ দেখিয়ে রিমাকে বললো,
—–তোমার জাহাঙ্গীর নগরে ভর্তি হতে হবে না। তুমি এখন আমার বিয়ে করা বউ। তাই আমি যেভাবে চাইবো, যখন তোমাকে ডাকবো তুমি আসতে বাধ্য। আর জাহাঙ্গীর নগরে পড়লে তোমার চরিত্রের ঠিক থাকবে না। তুমি তোমার বাবা মাকে ফাঁকি দিয়ে আমার সাথে হোটেলে সময় কাটিয়েছো, মজা নিয়েছো। এখন আমাকে ফাঁকি দিয়ে অন্য ছেলের সাথে রাত কাটাবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে। আমি জানি আমার কথাগুলো তোমার খারাপ লাগছে এতে আমার কিছু করার নাই। তুমি ইডেন কলেজে অনার্সে ভর্তি হও। আর নয়ত ডিগ্রী পড়ো। আর শোনো তোমার বাবাকে আমাদের বিয়ের কথাটা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে জানিয়ে দিবে। আর তোমার এতো পড়ালেখা করে লাভ নেই। তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে আমার বিদেশে যাবার টাকা যোগাড় করে দিবে। আমি কানাডায় যাবো। সেখানে দাঁড়িয়ে গেলে এরপর তোমাকে নিয়ে যাবো। তাই কোনরকমে ডিগ্রীটা পাশ করো তাতেই চলবে।
মনে রেখাে তোমাকে মাত্র চব্বিশ ঘন্টা সময় দিয়েছি। তুমি যদি আমার কথা না রাখো তাহলে এরপর কি ঘটবে সময়ই তা বলে দিবে। এই কথা বলে জুনায়েদ চলে গেলো। রিমা ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,”ও কাকে ভালবেসেছে”? জুনায়েদ ওর লোভী চেহারাটা ভালমানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। যা রিমার নজরে আসেনি। আসলে ঢাকার বাইরে বলে কথা না ওর ভয় রিমা যদি হাতছাড়া হয়ে যায়।রিমা আজ সবটা বুঝতে পেরেছে। কত বড় ভুল ও জীবনে করেছে এটা আজ সমস্ত রক্ত বিন্দু দিয়ে অনুভব করতে লাগলো। ওর হাত পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো। দমটা যেন আটকে আসতে চায়। গাজীপুরে ঐ ভুলটা না হলে ওর জীবনের পরিনতি এরকম হতো না। এই ভুলকে অস্বীকার করার উপায় নেই। যাকে ও বিশ্বাস করেছে সে তার স্বপ্নগুলোকে গুড়িয়ে দিয়েছে। ওর চাওয়া পাওয়াগুলোকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। ওর মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে মৃত্যুটাকে ওর সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here