শব্দহীন_বৃষ্টি (৭)

0
1119

শব্দহীন_বৃষ্টি
(৭)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
__________________________
প্রকৃতি আজ বড্ড রুক্ষ সেই সাথে প্রথম ক্লাসটাও রুক্ষ স্যারের। মাহির মন মেজাজ ভোর বেলা থেকে খোঁচা মারা আবহাওয়ার মত শীতল। তার কারণ আজ ঘুম থেকে উঠেই ছাঁদে উঠেছিলো। আর তখনই ঝপাৎ করে এক রাশ ভালোলাগা তার মনের আঙিনায় ঝাপিয়ে পড়েছিলো সাগরকে দেখে। বুঝ হওয়ার পর আজই প্রথম সে পাশের বাড়ির এই সুদর্শন যুবকটিকে এতোটা সামনে থেকে দেখেছে৷ ঘরের পাশে ঘর তবুও কিনা এই সুদর্শন সুপুরুষটিকে সে দেখেনি? আশ্চর্য! ছাঁদে উঠে আড়মোড়া ভাঙতে চোখ বুঁজেছিলো মাহি আর তখনই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো।

–” এই পিচ্চি চোখ খুলে রেলিং থেকে সরে দাঁড়াও “। কথাটা শুনেই মাহি চট করে চোখ খুলে সামনে তাকায়। সাদা ঢিলাঢালা শার্ট আর লুঙ্গি পড়ে হাতে ব্রাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওপাশের ছাঁদে একটা সুন্দর পুরুষ। মাথার চুল গুলো একদম কাকের বাসার মত এলেমেলো , চোখ দু’টো ফোলা ফোলা। লোকটার গায়ের রঙ তো মাশাআল্লাহ একদম কাঁচা হলুদ এর মত। মাহি একবার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার সামনের ব্যক্তিটির দিকে তাকালো। নাহ, তার গায়ের রঙ এতোটাও সুন্দর নয় যতোটা ওই লেকটার। হুট করেই মন খারাপ হয়ে গেল৷একটা পুরুষ মানুষ এত সুন্দর হবে কেন? সুন্দর বলতে শুধু ফুল,পাখি প্রকৃতি হবে আর মেয়েরা হবে সুন্দরী। দুনিয়ায় সুন্দর বলতে কোন পুংলিঙ্গ থাকবে না। ব্যাকরণে শুধু সৌন্দর্যের স্ত্রী লিঙ্গ হবে। তার এই ভাবনা চলমান রেখে এখন পর্যন্ত সে রেলিং এর পার থেকে সরেনি তা দেখে ব্যক্তিটি আবার বলল, ” এই পিচ্চি কথা কানে যায় না? শ্বাতসকালে কি ছাঁদ থেকে পড়ে হাত পা ভাঙার শখ জাগছে “?

–” আপনি কি পরশু রাতের সাদা টি-শার্ট ভাইয়া?” মাহি খুব উৎসুকভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো। সাগর এতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল৷ পরশু রাতে তবে এই মেয়েই ওখানে দাঁড়িয়ে তাদের গান শুনেছিলো। কি সাংঘাতিক! মেয়েটাকে সে যত ছোট ভেবেছিলো দেখতে মোটেও অতোটা ছোট নয়। আর কথাবার্তা তো বেশ পাকা বুড়ি বুড়ি লাগে। গলা খাঁকড়ি দিয়ে সাগর বলল, ” এ্যাই মেয়ে রেলিংয়ে এমন ঝুঁকে না থেকে সরে দাঁড়াও”। কথা শেষ করে সাগর আর দাঁড়ায়নি কিন্তু মাহি পেছন থেকে ডেকেই চলছে, ” আরে শুনুন বললেন না তো আপনি সেই ভাইয়াটা কিনা”?

দোলা প্যাকিং করছে আজ রাতের ট্রেনে সে সিলেটে ফিরবে৷ স্কলারশিপ এর জন্য কিছু ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে ভার্সিটিতে৷ হাতে সময় খুব কম সব ঠিকঠাক থাকলে এক মাসের মধ্যে সে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাবে। শিলা তাকে জোর করছে আর দু’টো দিন থেকে যেতে। তারপর না হয় গিয়ে সবটা দেখবে৷ কিন সৈকতের মা বুঝদার মহিলা তিনি শিলা কে ধমক দিলেন। “এ কেমন কথা এত বড় একটা সুযোগ হাতে এসেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব সবটা ঠিকঠাক করে নেওয়া। শিলা কেন অবুঝের মত কথা বলছে”?

দাদুনী যখন শুনেছে দোলা চলে যাচ্ছে তিনি মনে মনে ঠিক করেছেন আজই দশ টাকার বাতাসা কিনে বাচ্চাদের খাওয়াবেন। দোলাকে তিনি প্রথম দিন থেকেই অপছন্দ করেন। মেয়েটা বেয়াদব সালাম দেয় না, বাজে কাপড় পরে আর সবচেয়ে বাজে দিক হলো সাগরের গা ঘেঁষে বসে যখন তখন৷ হাওয়া বেগম ভাবেন সাগরের ওপর বদনজর পড়েছে এই বদ মেয়ের।আজ রাতেই এই মেয়ে বিদায় হতেই তিনি সাগরকে ঝাড়ফুঁক করবেন। আজ সকালে নাস্তার টেবিলে সাগরের পাশে বসেছিলো দোলা। বেখেয়ালবশত বুকের ওড়না কিছুটা সরে গিয়েছিলো। সেই থেকে হাওয়া বেগমের হা হুতাশ বেড়ে গেছে৷ দু’বার করে বড় বউমা কে বলেছেও ছেলে কে একটু দোয়া পড়ে ফু দাও৷ তিনি কথা কানে তোলেননি।
সাথী,যুথি,সমুদ্র, তিথি শৈবাল সবাই এখন স্কুলে। বাড়িতে মহিলারা ছাড়া আর কেউ নেই। দোলার ট্রেন রাতের হলেও কোন কারণে তার মা বলেছে দুপুরে রওয়ানা দিতে৷ সকালে হলে না হয় সৈকত নিজেই ট্রেনে কিংবা কোন বাসে উঠিয়ে দিতো। এখন দশ’টা বাজে এই মুহুর্তে সৈকতের পক্ষে সম্ভব নয় অফিস থেকে বের হওয়া৷ বাধ্য হয়েই সাগরকে ফোন করলো তার মা। বাড়িতে বর্তমানে এই একজন ছেলেই আছে যার দিন-দুনিয়ায় খাওয়া, ঘুম আর আড্ডা ছাড়া কোন কাজ নেই। টিউশনি করবো করবো করে করা হয় না। একবার শুরু করেছিলো তারপর কোন কারণে স্টুডেন্টকে এমন মার মেরেছে বেচারা পরদিন থেকে আর সাগরের সামনেই আসে নি।

সাগর আর দোলা বসে আছে এক রিকশায়। বাড়ি থেকে রিকশা করে বাস স্ট্যান্ড এ যাচ্ছে । চুপচাপ ছিলো দু’জনেই। নিরবতা ভেঙে দোলা বলল, ” ভালো কাটলো আপনাদের সাথে সময় গুলো”।

–” আবার সময় করে চলে আসবেন আবারও এমন সময় কাটাবো সবাই মিলে”। সামনে চোখ রেখে বলল সাগর। সে টের পাচ্ছে দোলা তার দিকেই তাকিয়ে আছে । অস্বস্তি হচ্ছে এভাবে কেন তাকিয়ে আছে মেয়েটা!

–” আমরা কি বন্ধু হতে পারি”? কথাটা হঠাৎ করেই বলল দোলা। সাগর এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো দোলার দিকে৷ জবাবে কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব এতোটা খারাপ হবে না তবে ততোটা ভালো ও হবে না সাগর জানে। এই মেয়েকে তার নিঃসন্দেহে সুন্দরী মনে হয়। কিন্তু মনমানসিকতা সম্পূর্ণ সাগরের বিপরীত। বন্ধুত্বে রুপ কিংবা গুণ ম্যাটার করে না। ম্যাটার করে মনমানসিকতা। মনের মিল স্বভাবে ভালোলাগা থাকতে হয়। এই মেয়ের সাথে কয়েক ঘন্টা থেকেই বুঝতে পেরেছে মেয়েটি দরিদ্রতা সহ্য করতে পারে না। চলাফেরায় ক্লাস মেইনটেইন করতে পছন্দ করে ।

–” কি হলো আমার বন্ধুত্ব পছন্দ হয় নি”? দোলার কথায় সাগর বিব্রত বোধ করলো। কোনমতে বলল, ” অপছন্দ করার মত ও কিছু নেই”।

–” তবে এক্সেপ্ট করছেন বন্ধুত্ব “।

–” হুম”।

–” মাঝেমধ্যে গল্প গুজব করতে চাইলে সময় দিবেন “?

–” বিশেষ কোন ব্যস্ততায় না থাকলে অবশ্যই দিবো”।

–” ধন্যবাদ, ফোন নম্বরটা?” সাগর নিজের ফোন নম্বরটা সেইভ করে দিলো দোলার ফোনে৷
___________________
লাঞ্চ টাইম, মাহি আর নিপা স্কুলের গেইটের বাইরে এক ফুসকাওয়ালাকে পেয়েছে৷ দু’জনে একের পর এক ফুসকা খেয়েই চলছে৷ আজ বহুদিন পর এমন সুযোগ পেয়েছে৷ গেইটে দাড়োয়ান অভিভাবক ছাড়া কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দেয় না টিফিন আওয়ারে৷আজ টিফিন আওয়ারে দাড়োয়ানকে হেড স্যার ডেকেছিলেন কোন কারণে৷ তাই বেচারা গেইট ছেড়ে সরে যেতেই মাহি আর নিপা ছোট গেইট একটু খানি খুলে বেরিয়ে গেছে৷ কিন্তু বিপত্তি দাড়োয়ান ফিরে এসেই ছোট গেইট খোলা দেখে ভয় পেয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে গেইট লাগায় নয়তো যদি ভুল করে ও কোন স্যার মেডাম দেখে এই সময় গেইট খোলা তবে নিশ্চিত তার চাকরি যাবে৷ ফুসকা খাওয়া শেষ দু’বান্ধবী ফিরে দেখে গেইট লক। ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ে সমুদ্র কে। মাহি এক কোণায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভাবে ইশারা করতে থাকলো। এক সময় সমুদ্রের চোখে পড়লো গেইটের ওপার থেকে কেউ ইশারা করছে। সামনে যেতেই বুঝতে পারলো তারা প্রবলেমে পড়েছে।

__________________

–” হ্যালো, নিরব ভাইয়া শোনো আমি গান শিখবো পাশের বাড়ির সাদা টি-শার্ট ভাইয়ার কাছে “।বিগলিত গলায় এক নাগাড়ে বলে চলছে মাহি৷ ওপাশ থেকে নিরব কিছু একটা বলতেই মাহি আবার বলল, ” হ্যা ভাইয়া জানো না ওই ভাইয়াটা কি যে সুন্দর,, না মানে কি যে সুন্দর করে গান গায় তুমি শুনলে প্রেমেই পড়ে যাবে একদম”। ওপাশে আবারও নিরব কিছু বলতেই মাহি জ্বিভে কামড় বসালো। ” এই ছিঃ ছিঃ তা কেন হবে। তুমি তো ছেলে আর ছেলে হয়ে আরেকজন ছেলের প্রেমে কেউ পড়ে! আচ্ছা রাখছি। মা এখনও রাজী হয় নি তুমি কালই আসো মা’কে বোঝাও বাবা রাজী হয়ে গেছে”।

–” এমন ভাবে বলছিস যেন তোর গান শেখা নয় কোন পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করার জন্য রাজী করাচ্ছিস’! মায়ের গলা শুনতেই মাহি কল কেটে পেছনে ফিরে তাকালো৷

চলবে

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here