এতোটুকুই_তো_ঝড়বৃষ্টি #পর্বঃ০১

0
755

#এতোটুকুই_তো_ঝড়বৃষ্টি
#পর্বঃ০১
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

-‘ছেলে মেরিন ইন্জিনিয়ার হলেই কি হবে?চাকরি তো করে প্রাইভেট কোম্পানিতে।আমি প্রমার জন্য সরকারি চাকুরিজীবি ছেলেই চাই।’

-‘সাজিম ইজ ওয়ান অফ দ্যা মোস্ট ফ্যান্টাস্টিক পারসোন,আই হ্যাভ এভার সিন..বাবা।আমি হলফ করে বলতে পারি, আমাদের প্রমার জন্য সাজিম বেস্ট।এছাড়া দেশের বিগেস্ট শিপ বিল্ডার কোম্পানির মধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড অন্যতম।মেরিন ইন্জিনিয়ারদের বেতন স্কেলও বেশ ভালো।সাজিমের বেতনে প্রমা অনায়াসে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে পারবে।’

মাহবুব সাহেব ছেলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।যার অর্থ তিনি রেগে যাচ্ছেন।প্রিয়মের মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না।সে চেয়ার টেনে তার বাবার বিপরীত পাশের বসে পড়লো।অতি সন্তপর্ণে মাহবুব সাহেবের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো।

-‘ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, বাবা!একজন সরকারি কর্মকর্তার সাথে বিয়ে দিলেই কি প্রমা সুখে থাকবে?ভবিষ্যতে ছেলের চরিত্রে যদি সমস্যা দেখ!তখন কি হবে ভেবেছ একবার?প্রমা কষ্ট পেলে আমাদের ভালো লাগবে….তুমিই বলো?এর থেকে ভালো না জানা শোনা ছেলের হাতে প্রমাকে তুলে দেই!ভাই হিসেবে আমার বোনের ক্ষতি হোক আমি তা কখনই চাইবো না।’

মাহবুব সাহেব কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন।এবার তাকে কিছুটা চিন্তিত মনে হল। প্রিয়মের বন্ধু হওয়ায় সাজিম বেশ কয়েকবারই তাদের বাড়িতে এসেছে। মাহবুব সাহেবের কাছে সাজিমকে জেন্টেলম্যানই মনে হয়েছে।প্রিয়ম তার বাবার উদ্বিগ্নতা রেশ ধরেই বলে উঠলো,

-আমাদের ব্যাচের মধ্যে সবার মধ্যে সাজিমই সবচেয়ে বেশি ক্লিন প্রোফাইল বেয়ার করে।প্লিজ বাবা!কেবল একবার প্রমাকে সাজিমের সাথে একাকি মিট করতে দেও।প্রমার যদি সাজিদকে পছন্দ না হয়,তখন না হয় রিজেক্ট করে দিও।শুধুমাত্র সরকারি ও বেসরকারি চাকরির রেশ ধরে,তুমি এতো বড় সিদ্ধান্ত নিও না।’

মাহবুব সাহেব ছেলের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে,চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন।ধপধপ শব্দ করে ছাদের সিঁড়ি দিকে পা বাড়ালেন।সেদিকে তাকিয়ে প্রিয়মের ভেতর থেকে কেবল চাপা শ্বাস বের হয়ে এলো।

-‘গাধার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে,নিচে যেয়ে তোমার বোনকে রেডি হওয়ায় জন্য তাড়া দেও।ছেলেটিকে সারাদিন অপেক্ষা করানোর ইচ্ছে আছে নাকি!’

চমকে উঠে সিঁড়ি দিকে তাকালো প্রিয়ম।মাহবুব সাহেব ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে আছেন।ছেলের সাথে চোখাচোখি হলো।প্রিয়মের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।

——-

এ পর্যন্ত চার গ্লাস পানি খেয়ে ফেলেছে সাজিম।তলপেটে এই মূহুর্তে ভীষণ চাপ দিচ্ছে।ওয়াশরুমে যাওয়া ইমারজেন্সি দরকার।সর্বনাশ!এখন যদি প্রিয়ম এসে পরে!এসে যদি তাকে না পায়!সমস্যা আসলে প্রিয়ম না।সমস্যা প্রমা।এ মেয়েকে দেখলেই বুকে ঝড় উঠে যায়।এতো অস্থির লাগছে কেন সাজিমের?টেনশনে দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে সে।আচমকা পাশের চেয়ারে ধপ করে কেউ বসে পড়লো।সেদিকে তাকাতেই সাজিমের ভেতরে অদৃশ্য প্রশান্তি বয়ে গেল।তলপেটে কিছু সময় আগের মতো চাপও অনুভূত হচ্ছে না।মেয়েদের খোলা চুলের ভাঁজে এতো সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে বুঝি!প্রমা আহামরি সুন্দর না হলেও,সাজিমের কাছে সে মরি মরি সুন্দর।এই যে প্রমাকে দেখে সাজিমের মরে যেতে ইচ্ছে করছে,এ হলো মরি,মরি সুন্দর।নীল রঙের শাড়িতে প্রমাকে প্রানবন্ত নীলপদ্ম মনে হচ্ছে।

-“অদ্ভুত তো মশাই!এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন,ওদিকে চেইন যে খোলা সেই খবর আছে আপনার।”

সাজিম হতভম্ব হয়ে গেল।প্যান্টের সামনে হাত দিয়ে চট করে উঠে দাঁড়াল।আশেপাশে তাকিয়ে ওয়াশরুম খোঁজার চেষ্টা করলো।প্যান্টের চেইন এডজাস্ট করার জন্য এই মূহুর্তেই ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার।

-আশেপাশে কাকে খুঁজচ্ছেন?ভাইয়াকে বুঝি!আগের আপনার ব্যাগের চেইন ঠিকমতো লাগান।ব্যাগের চেইন খোলা অবস্থায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে এসেছেন?কি কেয়ারলেস,আপনি!’

সাজিম টেবিলে নিচের দিকে এক কোণায় থাকা তার ট্রাভেল ব্যাগের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ছাড়ল।ঝুঁকে ব্যাগের চেইন লাগিয়ে কাচুমাচু ভাবে চেয়ারে বসে পড়লো। এদিকে সাজিমকে কিছু সময়ের জন্য ভড়কে দিতে পেরে,প্রমা মনে মনে বেশ খুশিই হলো।সাজিমের বিমূঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে তার হাসি পেয়ে গেলো।হাসি চেপে রাখতে না পেরে সে খিলখিল করে উঠলো।এদিকে প্রমার এক হাসিতেই সাজিমের অবস্থা রফাদফা।সে আচমকা প্রমার একহাত টেনে নিয়ে,সেই হাতের উল্টোপিঠে বেশ দীর্ঘ এক চুমু খেলো।প্রমা থরথর করে কেঁপে উঠলো।পলক ঝাপটে বড়ো বড়ো চোখে সাজিমের দিকে তাকিয়ে রইল।এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে নিলো। চেয়ার ঠেলে দাড়িয়ে পড়লো।পর মূহুর্তেই টেবিলে থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে সাজিমের মাথায় ঢেলে দিলো।সাজিমের ঘোর কাটলো।তড়িৎ গতিতে মাথা নিচু করে ফেললো।ছি!ছি একটু আগে সে কি করলো?বন্ধুর বোনের অনুমতি ব্যতিত তাকে ছুঁয়ে ফেলেছে।প্রিয়মে যে জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে!তার বুকটা হুহু করে উঠলো।নিজের গালে মনে মনে কষে এক চড় মারলো। সাজিম ভেবেছিলো প্রমা হয়ত চলে যাবে।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে,প্রেমা পুনরায় আগের জায়গায় বসে পড়লো।প্রমা সামনে থাকা মানুষটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।সাজিমের কপালে লেপ্টে থাকা ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।গ্লাসে বেশ ভালোই পানি ছিলো।প্রমার ভীষণ রাগ হওয়ার কথা থাকলেও,তার কেন যেন রাগ হচ্ছে না!সাজিমকে তো আগেও দেখেছে।প্রায় সময় যখন তাদের বাসায় আসতো বেশির ভাগ সময় মাথা নিচু করেই থেকেছে।সরাসরি কখনো প্রমার দিকে তাকিয়েছে কি না,প্রমার মনে পড়ে না।অতিরিক্ত ভদ্র স্বভাবের জন্য,প্রমা সাজিমকে তেমন পছন্দ করতো না।এখন মনে হচ্ছে না ছেলের কিছুটা লুচু স্বভাবও আছে।আশ্চর্য!তার কি এই লুচুকে পছন্দ হয়ে গেছে?যদি তা নাই হয়ে থাকে তাহলে প্রমার কেন,সাজিমের চুলগুলো নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিতে ইচ্ছে করছে!

-‘সস..সরি।’

সাজিমের কন্ঠ কানে প্রবেশ করতেই প্রমা ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে এলো।মানুষটা কি ঠান্ডায় কাঁপছে নাকি কাঁদছে!

-‘আই এম এক্সট্র্যামলি সরি।’

সাজিম পুনরায় বলে উঠলো।দু’হাতে নিজের চোখ মুছে প্রমার দিকে পিটপিট করে তাকাল।
প্রমার আচমকা মন খারাপ হয়ে গেল।আজকে তার কেন যেন বার-বার মায়ের কথা মনে পড়ছে!নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।তার মা কান্না করে দু’হাতে চোখ মুছতো।তারপর পিট পিট করে তার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতো।সে চাহনির কাছে তার বাবা যে কতো শতো বার দমে গেছে!প্রমা তার গলায় থাকা লকেট ডান হাতে চেপে ধরলো।চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু বলছে সে।সাজিম প্রমার গলার দিকে তাকিয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলো।কিছু সময় আগের মতো তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো।চুলের গোড়া গোড়া ঘামে ভিজে যাচ্ছে।এই মেয়ের গলার চামড়া কি দিয়ে তৈরি?এতো সাদা!সাজিম লক্ষ্য করলো কেবল প্রমার গলা না,সম্পূর্ণ প্রমাই ফকফকে সাদা।এ যেন বিদেশিনী!কই আগেও তো প্রমাকে দেখেছে,আজকে এতো এতো ভালো লাগা কাজ করছে কেন?প্রমার দিকে তাকিয়ে থাকতে অদ্ভুত ঘোরে পড়ে গেল সাজিম।

-“আপনি আবারও আমার দিকে বোয়াল মাছের মতো মুখ করে,তাকিয়ে আছেন দেখি?এখনই চোখ বন্ধ করেন!এখন মানে এখনই।”

প্রমা রেগে গেল। তার দু’গালে লালচে আভা দেখা যাচ্ছে।সাজিম সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো।মনে মনে বললো,

-“চট্টগ্রাম থেকে এসেছি তো আপনাকে দেখতে।এমন ঘোরে পড়ে যাবো ভাবি নি!আপনি তো জানেন না চোখ বন্ধ অবস্থায় আপনাকে আমি আরো ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি।এ দেখা অনুভবের দেখা।”

-‘কিরে মেয়ে দেখতে এসে,চোখ বন্ধ করে বসে আছিস কেন?বিয়ের পরে কিন্তু বলতে পারবি না,বন্ধু না দেখিয়ে বোনকে আমার কাছে গছিয়ে দিয়েছে।”

প্রিয়মের গলার আওয়াজে সাজিম চট করে তাকাল।প্রিয়ম সাজিমের বিপরীত পাশের চেয়ারে বসে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে।সে সময় লাগিয়ে গাড়ি পার্কিং করে এসেছে।বন্ধুর কথায় সাজিম আড়চোখে প্রমার দিকে তাকালো।প্রমা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার ভাইয়ের আচরণে বেশ বিরক্ত।ইসস,ঢং দেখো!প্রমা এই হাবলুকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছে যেন!হাবলু হলেও বলতে হয়,ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম।পরনে আকাশি রঙের শার্ট পেশিবহুল হাতে কেমন এঁটে বসে আছে।ছিঁড়ে টিড়ে যাবে না তো আবার?চেহারায় বেশ নরম নরম একটা ভাব আছে।গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ আর গৌঢ়বর্ণের মাঝামাঝি।উজ্জ্বল শ্যামলা।প্রমা সিউর এই ছেলেকে সে যেভাবে ইচ্ছে চালাতে পারবে।কিন্তু প্রমা এমন একজন মানুষ চায়,যে তার ওপর অধিকার খাটাবে।ভালোবাসার দাবি করবে!সাজিমকে সে সময় একটু রাগ করে বলায়,সে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।কেন সে বলতে পারলো না,আপনাকে তো দেখতে এসেছি চোখ বন্ধ করলে দেখবো কি করে!

——

খাওয়ার সময় প্রমার একটা জিনিস খুব ভালো করে খেয়াল করলো।রেস্ট্রন্টটে সেল্ফ সার্ভিস চালু নেই।ওয়েটারটা নিজ থেকে খাবার এনে দেয়।অথচ ওয়েটারদের বসিয়ে রেখে,সাজিম নিজে কিচেন থেকে সব খাবার টেবিলে এনে রাখলো।সেই সাথে অতি যত্নে প্রিয়ম আর প্রমার বোলে বেড়েও দিলো।প্রমা ঠোঁট বাঁকালো।তাকে ইমপ্রেস করার ধান্দা….যতোসব!সেজন্যই তো তার আর প্রিয়মের পছন্দের টম ইয়াম স্যুপ নিয়েছে, সাথে অবশ্য থাই ক্লিয়ার স্যুপও আছে।এই ক্লিয়ার স্যুপ জিনিসটা প্রমার একটুও পছন্দ না!অথচ দেখো মানুষটা কেমন চায়ের মতো সুরুৎ সুরুৎ শব্দ করে, তৃপ্তি সহকারে স্যুপটা খেয়ে যাচ্ছে।প্রমার এই মূহুর্তে অতি পছন্দের টম ইয়াম স্যুপ বিষাদ মনে হচ্ছে।হুট করে সে সাজিমের সাথে,নিজের স্যুপের বোল অদলবদল করে নিলো।স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সাজিমের খাওয়া চামচ দিয়ে ক্লিয়ার স্যুপ চেটেপুটে খেয়ে নিলো।সম্পূর্ণ ঘটনায় প্রিয়ম একেবারে নির্লিপ্তি।দেখেও যেন দেখলো না!

এদিকে সাজিম প্রমার আধ খাওয়া টম ইয়াম স্যুপ চামচে নিয়ে যতোবার ঠোঁটের কাছে এসেছে।ততোবার অদ্ভুত অনুভূতিতে ভেতরটা পুলকিত হচ্ছে।এই স্পুনে যে প্রমার ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ লেগে আছে!এই চামচ নিজের মুখে ভেতর কি করে পুরে নিবে সে?এমন কাজ করার আগে,সে একদম শেষ হয়ে যাবে।তার আর খাওয়াই হলো না।প্রিয়ম আর প্রমার চোখের আড়ালে,অতি সাবধানে স্পুনটা নিজের পকেটে ভরে নিলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here