এতোটুকুই_তো_ঝড়বৃষ্টি
পর্বঃ০২
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
-‘তোর বন্ধুকে তুই কোলে নিয়ে তুলুতুলু কর,নাচানাচি কর,ঘোরাঘুরি কর এতে আমার কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু আমার পক্ষে ঐ হাবলুকে বিয়ে করা সম্ভব না।’
প্রিয়ম আহত চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল।ভাইয়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে প্রমার বেশ মায়া হলো।বুঝ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
-“সাজিম হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল ছেলে।একদম পার্টিকুলার।দ্যা গার্ল হু ম্যারিস হিম,উইল বি ভেরি লাকি।আমি নিশ্চিত একজন আইডিয়াল স্বামীর যেসব ডিউটিই থাকতে,সাজিম সেগুলো যথাযথ ভাবেই ফুলফিল করতে পারবে।কিন্তু আমার স্বামী হিসেবে এমন একজন মানুষকে চাই যে আমার বন্ধু হবে।যার সাথে আমি অনায়াসে সবকিছু শেয়ার করতে পারবো।আমার আদর্শ স্বামী চাই না….ভাই।”
-“কিন্তু সাজিমকে আমি বললে…..”
প্রমা ভ্রু কুঁচকালো।প্রিয়মের কথার মাঝেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
-“আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”
প্রমার অপ্রসন্নতা ধরতে পেরে প্রিয়ম থেমে গেল।অসহায় অসহায় ফিল হচ্ছে তার।সাজিমের জন্য কি সে কিছুই করতে পারবে না!প্রমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।এভাবে কঠিন স্বরে কথা বলতে তার বিবেকে বাঁধছে।কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় নেই!
-‘আমার প্রতি তোর বন্ধুর উদাসীনতা কি তুই বুঝতে পারছিস না?না বুঝে থাকলে তোকে সিম্পল একটা উদাহরণ দেই।’
রাস্তায় তীব্র জ্যাম।আধঘন্টা যাবৎ এক জায়গায় আঁটকে আছে তারা।প্রিয়ম গাড়ির স্টিয়ারিং উইলে মাথা গুঁজলো।প্রমার কথা আদোও শুনছে কি না বোঝা গেলো না।প্রমাও ভ্রুক্ষেপহীন।নিজের মতো বলা শুরু করলো,
-‘রেস্টুরেন্টে বসে তুই যখন বললি তোরা কথা বল,আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।সাজিমের তখন বোঝা উচিত ছিলো যে, তুই তাকে আমার সাথে আরো কিছু টাইম স্পেন্ড করার সুযোগ দিয়েছিস।কিন্তু সাজিম কি করলো!তোকে বললো আমাকে তোর সাথে পার্কিং লটে নিয়ে যেতে।এমনকি হাবলুটা এগিয়ে এসে বিদায়ও দিলো না।কেবল ফ্যালফ্যাক করে তাকিয়ে রইল।’
-“এতেই তুই বুঝে নিলি যে তোর প্রতি সাজিমের কোনো ইন্টারেস্ট নেই।তাই তো??”
-‘অভিয়াসলি,পুরো ব্যাপারটা একদমই স্পষ্ট।আমার প্রতি তার যদি কোনো আগ্রহ থাকতো,আমাকে কি সে এভাবে ইগনোর করতে পারতো?’
প্রিয়ম চুপ।মাথা তুলে রাস্তার দিকে তাকালো।জ্যাম ছেড়ে গেছে।কিছু দূর যেয়ে গাড়িটা রাস্তার এক পাশে পার্ক করলো।তড়িঘড়ি করে গাড়ির দরজা খুলে বাহিরে বের হলো।প্রমা ভীষণ অবাক হলো।প্রাণ প্রিয় বন্ধুর রিজেকশন সহ্য করতে না পেরে কি তার ভাই পাগল হয়ে গেল!প্রিয়ম প্রমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না,এক প্রকার টেনে গাড়ি থেকে নামালো।তারপর প্রমার হাত ধরে রেস্টুরেন্ট যে পথে সেদিকে রওনা দিলো।পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের মধ্যে সেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেল।এর মধ্যে প্রমা টু শব্দটুকুও করলো না।সে দেখতে চায়,প্রিয়ম আসলে কি করতে চাইছে!রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করতেই,প্রিয়ম প্রমার হাত ছেড়ে দিলো।কাউন্টারে ম্যানেজারকে ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেল না প্রমা।এমনকি টেবিলগুলোও ফাঁকা।একটু আগেও তো এই জায়গায় বেশ মানুষজন ছিলো।বলতে গেলে দশ/বারোটা টেবিলের প্রায় সবগুলোতেই মানুষ ছিলো।কোথায় গেল তারা?প্রমা প্রশ্নবোধক চোখে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।ম্যানেজার তাদের দিকে এগিয়ে এলো।ভদ্রলোকের চেহারা খানিকটা বাচ্চাদের মতো।তাকে দেখে বেশ প্রসন্ন মনে হচ্ছে।উৎসুক মুখে বলল,
-‘আপনারা ফিরে আসলেন যে!সাজিম ভাই ডেকেছে নাকি?’
প্রিয়ম উত্তর দিলো না।গম্ভীর মুখে উল্টো প্রশ্ন করলো,
-‘সে কোথায়?’
-‘ভাইয়ের কথা আর কি বলবো?কি যে করে না!আপনার বেরিয়ে যেতেই সব ওয়েটারদের নিয়ে দু’তলায় গেল।আপনি তো সবই জানেন,প্রতিবার যখনই আসে সব ওয়েটারদের নিয়ে গেট টুগেদার পার্টি করে।সবাইকে বসিয়ে রেখে নিজ হাতে সার্ভ করে।তাদের পার্টির জন্য আজকে এক ঘন্টা রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে।’
-‘সে যে আপনাদের একটা চামচ চুরি করেছে,সেই খবর আছে আপনার?ব্যাটা চামচ চোর!”
প্রিয়মের কথায় ম্যানেজারের মুখ থমথমে হয়ে গেল।শিশুসুলভ চেহারা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।কোনো উত্তর না পেয়ে প্রিয়ম পুনরায় বলল,
-‘আপনি চাইলে কিন্তু আমরা তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি।চামচ চুরির মামলা।এক্ষেত্রে আপনি আমার থেকে সর্বাত্মক সুবিধা পাবেন!আমি আপনার রাজসাক্ষী হবো।’
ম্যানেজার আচমকাই প্রিয়মের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।ফ্যাসফ্যাসে গলায় কিছু বলল।কান্নার কারণে কিন্তু কিছুই বোঝা গেলো না।
এদিকে প্রমা বজ্রহতের মতো সামনে তাকিয়ে আছে।ম্যানেজারের প্রথম কথাগুলো তার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে।বুকটা ধড়ফড় করছে।এতো মিল কি করে!!ম্যানেজারকে ডিঙিয়ে সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
——-
-‘সাজিম ভাই ভালো মানুষ,ভাই।উনি একটা কেন,একশটা চামচ নিলেও আমার কোনো লস হইবে না!সাজিম ভাইয়ের হয়ে আমি মাফ চাই,আপনে এ কথা আমাদের মালিককে বইলেন না।’
প্রিয়মের চেহারায় এবার দ্বিগুণ কঠোরতা ভর করলো।সে ধমকে উঠলো।
-‘আপনি একটা চোরের জন্য আমার পা ধরে বসে আছেন।ছাড়েন বলছি!এখনই ছাড়েন!এই মূহুর্তে উঠে দাঁড়ান।নাহলে কিন্তু আমি সরাসরি এ্যাকশন নিবো।”
ম্যানেজার যেভাবে আচমকা লুটিয়ে পড়েছিলো,ঠিক সেভাবেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।সে উঠে দাঁড়াতেই প্রিয়ম বিজ্ঞ মানুষের মতো মাথা নাড়লো।তারপর বলল,
-“আপনার সব কথাই বুঝলাম।সে ভালো মানুষ!তার জন্য কনসিডার করাই যায়। ঠিক আছে!কিন্তু এই এক ঘন্টায় আপনাদের কতো ক্ষতি হয়ে গেল।সেটা মালিকের কানে গেলে তো আপনারা ছাঁটাই হয়ে যাবেন।”
-“সাজিম ভাই ওয়েটারদের বিল পে করার সময়,এক ঘন্টার ক্ষতিপূরণও দিয়ে দেয়।”
ম্যানেজার চট করেই জবাব দিলো।প্রিয়ম তার সামনে থাকা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলো আর ভাবলো,মানুষটি কী সহজ!চেনা নেই,জানা নেই অপরিচিত একজন মানুষের জন্য কতোটা অনায়াসে কেঁদে উঠলো!অবশ্য,সাজিম মানেই স্পেশাল।তার সবকিছুই ভিন্ন।সে তার আশেপাশের সবাইকে নিয়ে মায়ার এক চক্র তৈরি করে রেখেছে।মায়াচক্র!এই লোকটিও সেই মায়া চক্রের একজন সদস্য!এদের মায়া নামক অনুভূতির একটু লোভ দেখালেই হয়,সব করতে পারে।একে আর অহেতুক ভয় দেখানো ঠিক হবে না।প্রিয়ম লোকটির কাঁধে চাপড় মারলো।তারপর হেলেদুলে হেঁটে রেস্টুরেন্টের বাহিরে বেরিয়ে গেলো। প্রিয়ম বের হতেই ম্যানেজার প্রশান্তির শ্বাস ফেললো।
——-
-‘ভাই আপনে লজ্জা পাইতাছেন!এদিকে আপনের লাভ স্টোরি শোনার জন্য আমার মনটা আকুপাকু করতাছে।একটুই বলেন!বেশি না বলেন…শর্টকাটে বলেন।’
-“হ ভাই…..বলেন।আমরা সকলে শুনতে চাই।”
লিটুর দেখাদেখি প্রায় সকলেই হইহই করে উঠলো।এদিকে সাজিমের কান লাল হয়ে গেছে।কি বলবে!কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পেলো না। আশেপাশে তাকালো।সে সহ মোট বারোজন রেস্টুরেন্টের ছাদের একটা টেবিলে গোল হয়ে বসে আছে।সবার উৎসুক চাহনি তার দিকে।সবার আগ্রহ দেখে সে ধীরে সুস্থে বলা শুরু করলো,
-‘প্রিয়ম আমার স্কুল জীবনের বন্ধু হলেও,প্রমাকে প্রথম দেখেছিলাম তিন বছর আগে।ভার্সিটির ফ্রেশারস রিসিপশনের যাওয়া আগেই মেয়েটার সাথে সেদিন অঘটন ঘটলো।কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে রাস্তার পাশে রিকশার জন্য দাড়িয়ে ছিলো।মুখের একপাশে কাঁদা,সেই সাথে গায়ে জড়ানো কমলার রঙের শাড়ির কুঁচিতেও একগাদা কাঁদা ছিলো।অবিন্যস্ত চুলগুলো হাত দিয়ে বিন্যস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলো।প্রমার টলটলে সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কিছু একটা হয়ে গেল।জীবনের পঁচিশ বসন্তে এসে আমার হৃদয়ে প্রেমের জোয়ার বয়ে গেলো!মায়াবী সেই মুখটি আমাকে কাবু করে ফেলল।পুরো দু’দিন ঘুমোতে পারলাম না!আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম!খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম আমার স্কুল জীবনের বন্ধুর বোন সে।ছুটে গেলাম বন্ধু কাছে।আমার সমস্যা খুলে বললাম।বন্ধু চুপ রইলো! আমি দিশেহারা!গায়ে প্রচন্ড জ্বর।তখন আমার ঘুম একান্ত প্রয়োজন!রিকুয়েষ্ট করলাম দু’দিন যেন আমাকে তার বাড়িতে থাকতে দেয়।সে রাজি হলো।প্রিয়মের বাড়িতে পৌঁছতেই আমি সিঁড়ি কাছে লুটিয়ে পড়লাম।চারদিকের তখন প্রমা প্রমা সুবাস!মাতোয়ারা হয়ে গেলাম আমি।সেই দু’দিন ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুখী ঘুম হলো।প্রমার সামনেও গেলাম না,কথাও বললাম না।সে আমার আশেপাশে আছে এটা ভেবেই আমি সুখী ছিলাম।আমার অবস্থা দেখে বন্ধু বেশ মায়া হলো,আমাকে তাৎক্ষণাৎ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হলো।আমি সব মেনে নিলাম।সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিলাম।কতোশতো কোর্স করলাম!ট্রেনিং নিলাম।গভারমেন্ট জব না পেয়ে প্রথমে যখন হতাশ হলাম,প্রিয়ম আমাকে সাহস দিলো।প্রাইভেট কোম্পানিতেই জব নিলাম।আমি আমার চেষ্টা আর কনফিডেন্স নিয়েই প্রমার বাবার সামনে যেয়ে দাড়ালাম।আমার নিজের ওপর ভরসা ছিলো।”
সাজিম থামলো।একসাথে এতো কথা বলে তার গলা শুকিয়ে গেছে।ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো।এতো সময় সকলে সাজিমের কথায় মাঝেই ডুবে ছিলো।হায়!ভালোবাসা কতো বিচিত্র!কেবল ভাগ্যবানরাই একে আস্বাদন করতে পারে।
-“এটা প্রমার আর আমার একত্রিত লাভ স্টোরি না হলেও,আমার স্টোরি!আমার একান্ত ওয়ান সাইড লাভ স্টোরি।শুধু প্রমাকে পাওয়ার জন্যই,আমি আজকের আমার আমিকে তৈরি করেছি।প্রমাকে না পেলে আমি হয়ত মরে যাবো না,কিন্তু এই আমার আমিটা একদম ভঙ্গুর হয়ে পড়বে।আমার বিশ্বাস এই আমি টাই আমাকে প্রমার হতে সাহায্য করবে।’
সাজিমের কথা শেষ হতেই,সকলে একযোগে হাততালি দিতে লাগলো।লিটু চেয়ার ছেড়ে উঠে সাজিমকে জড়িয়ে ধরলো। কয়েকজন শিষও বাজালো।সবার চোখ মুখে উপচে পড়া খুশি।এমন কি টেরেসের থাই ডোরের বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রমাও করতালিতে যোগ দিলো।তার চোখের কার্নিশে অশ্রু,ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি।আর সবটাই ঘটে গেল সাজিমের অন্তরালে।
চলবে
ভুল-ভ্রান্তি মার্জনীয়।