তি_আমো,০৮,০৯

0
608

#তি_আমো,০৮,০৯
পর্ব ৮
লিখা- Sidratul Muntaz

ছাদে সামিয়ানা টানিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। শ’খানেক বেলুন ফুলানো হয়েছিল। ব্যান্ড পার্টি ভাড়া হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টিটা এসে সবকিছু ভেস্তে দিল। নিহা মনখারাপ করে বসে আছে৷ সাফিন ভাইয়া হাঁটু গেঁড়ে তারই সামনে, হাতটা শক্ত করে ধরে বসা। নিহা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুছে বলল,”একসাথে কাপল ডান্স করব ভেবেছিলাম, কিচ্ছু হলো না। আজকেই কেন বৃষ্টিটা হতে হলো?”

সাফিন ভাইয়া সান্ত্বনার সুরে বললেন,” বৃষ্টি হয়েছে ভালো হয়েছে। চলো তুমি আর আমি একসাথে বৃষ্টিতে ভিজি।”

” অসম্ভব! আমার মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে।”

” তুমি মেকাপ ছাড়াই অনেক সুন্দর জান!”

” এসব বলে কি আমাকে কনভিন্স করতে চাইছ?”

” এছাড়া আর কি করব? তোমার জন্য তো বৃষ্টি থামাতে পারি না!”

” কেমন প্রেমিক তুমি? যদি আমার জন্য বৃষ্টিই থামাতে না পারো?”

” অ্যাঁ! কি বলছ এসব?”

আমি হাসতে হাসতে বারান্দায় এলাম। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে প্রকৃতি। অল্প অল্প পানির ঝাপটা আমার নাক-মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেশ লাগছে! মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম কিছু হলে ভালোই লাগে। হঠাৎ কেউ এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। আমি প্রথমে ভাবলাম ঈশান। তাই ইচ্ছে করেই তাকাচ্ছিলাম না। তারপর সে কথা বলল,” এখানে কি করছ তারিন?”

আমি চেয়ে দেখলাম ফাহিম ভাইয়া। নিহার চাচাতো ভাই হয় সে। এই বাড়িতে অনেক আসা-যাওয়ার সুবাদে তার সাথে আমার মোটামুটি পরিচয় আছে। কিন্তু সেভাবে কথা হয়নি কখনও। আমি মুচকি হেসে বললাম,” বৃষ্টি দেখছি ভাইয়া। কি আর করব?”

” নিহার কপালটাই খারাপ। আজকের মতো ঝকঝকে দিনে বৃষ্টি হবে এটা আমরা চিন্তাই করিনি।”

” আমার কিন্তু ভালোই লাগছে। বৃষ্টিটা আলাদা উৎসবের মতো। তাছাড়া ব্যান্ড পার্টির ভ্যাজর ভ্যাজর শোনার চেয়ে বৃষ্টির এই ঝমঝমে শব্দ শোনা অনেক ভালো। ”

” নিহার সামনে এই কথা বলতে যেও না আবার। সে ভাববে তার অনুষ্ঠান নষ্ট হওয়ায় তুমি খুশি হয়েছ।”

আমি খিলখিল করে হাসলাম। ফাহিম ভাই বলল,” গান শুনবে?”

” আপনি গান জানেন?”

” অতটা ভালো না। আমি তো মিউজিক প্লেয়ারে গান ছাড়ার কথা বলছিলাম।”

” না। মিউজিক আমার ভালো লাগে না। মাথা ধরে যায়। তবে খালি গলায় গান শুনতে আপত্তি নেই।”

ফাহিম ভাইয়া ঠোঁট টিপে হাসল। কিছু একটা ভেবে বলল,” তোমার জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারি। ভালো না লাগলে বলে দিও।”

আমি হেসে বললাম,” আচ্ছা।”

ফাহিম ভাই গান শুরু করল। আমার প্রিয় গান,” খামোশিয়া।” মন দিয়ে শুনছিলাম। বেশ ভালোই গলা তার। এমন সময় সাফিন ভাইয়া ছুটে এলেন। হন্তদন্ত হয়ে বললেন,” ফাহিম এদিকে আয় ভাই, কথা শোন।”

” কি হয়েছে?”

” গ্যারেজে ঈশানের গাড়িতে একটা গিফট প্যাকেট আছে। নিহার বার্থডের জন্য এনেছিলাম। প্ল্যান ছিল অনুষ্ঠান শেষ হলে সবার সামনে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু সেটা তো আর হলো না৷ তাই ভাবছি এখনি দিব। তুই শুধু গ্যারেজ থেকে জিনিসটা নিয়ে আসবি।”

ফাহিম ভাই চোখ-মুখ কুচকে বলল,” গ্যারেজ যেতে হলে এখন বাগান পেরিয়ে ওইসাইডে যেতে হবে। আমার সাদা পাঞ্জাবী৷ কাঁদা লাগলে মহা সমস্যা। আমি পারব না। তুমি কোনো কাজের লোককে পাঠাও। ”

” কাজের লোক পাঠানো যাবে না। ঈশানের গাড়িতে অনেক দামী জিনিস থাকে। আমি কি কাজের লোকের হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে দিব? আর সে কি তালা খুলে আনতে পারবে? তাছাড়া ঈশানকেও কোথাও পাচ্ছি না। সে থাকলে তো সমস্যাই ছিল না।”

আমি এগিয়ে এসে বললাম,” সমস্যা নেই। আমাকে দিন। আমি নিয়ে আসছি।”

সাফিন ভাই দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন,” তুমি মেয়ে মানুষ। এতোদূর যাওয়ার দরকার নেই।”

” নো প্রবলেম। আমার এমনিতেও বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই বাহানায় একটু বৃষ্টিতে ভেজা হবে!”

আমার কথায় সাফিন ভাই হেসে দিলেন। পকেট থেকে চাবি বের করে বললেন,” সাবধানে যেও। আর্চিসের লাল একটা প্যাকেট পাবে। সেটাই আনবে। আর গাড়ির রং রয়্যাল ব্লু। এই রঙের একটাই গাড়ি আছে।”

” ওকে।”

ফাহিম ভাইয়া বলল,” আচ্ছা আমিও যাই ওর সাথে?”

সাফিন ভাইয়া নিচের ঠোঁট কামড়ে ধমকের সুরে বললেন,” এখন তোর সাদা পাঞ্জাবীতে কাঁদা লাগবে না?”

” কাঁদা লাগলে ধুঁয়ে নিব! নো প্রবলেম।”

” এখন নো প্রবলেম? আর একা যাওয়ার সময় তো খুব প্রবলেম হচ্ছিল!”

আমি হেসে দিলাম। ফাহিম ভাইয়া আমার সাথেই এলো। কিন্তু শেষমেষ সে বের হতে পারল না। রুবা আন্টি মানে নিহার মা ফাহিম ভাইকে অন্যকাজে লাগিয়ে দিলেন। আমি একাই ছুটলাম গ্যারেজের দিকে। দারোয়ান তখন গ্যারেজের গেইট বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সে নিজের ঘরে ফিরে যাবে। আমি বললাম,” মামা দাঁড়ান, গেইট বন্ধ করবেন না। আমি গাড়ি থেকে একটা জিনিস নিব।”

দারোয়ান মামা বলল,” আমি টয়লেটে যাচ্ছি আপামণি। আপনার কাছে চাবি দিয়ে গেলাম৷ কাজ শেষ করে তালা লাগায় দিয়েন।”

” কিন্তু আমি যদি লাগাতে না পারি?”

” তাহলে চেয়ারের এইখানে চাবি রাইখা দিয়েন।”

দারোয়ান এই কথা বলেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। আমি কথাটা পুরোপুরি বুঝলাম না। চাবিটা কি চেয়ারে রেখে দিলেই হবে? তাহলে হাতে নিয়ে ঘোরার দরকার কি? আমি চেয়ারে চাবি রেখেই গ্যারেজে ঢুকে গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। নিজের বোকামির কথা স্মরণ করে নিজের উপরেই বিরক্ত হলাম। মোবাইলটা সাথে থাকলে ভালো হতো। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখতেই পাচ্ছি না। আরচিসের লাল প্যাকেট কিভাবে খুঁজব? আর ঈশানের গাড়ি কোনটা? এতোবড় গ্যারেজে প্রায় বিশের অধিক গাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিভাবে বুঝব কোনটা রয়্যাল ব্লু? আমি হাঁটছি তো হাঁটছি! মনে হচ্ছে ফাঁকা মাঠে হারিয়ে গেছি। একটা গাড়ির দরজা খোলা ছিল৷ আমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম৷ শব্দ শুনে কেউ একজন বলল,” কে ওখানে?”

আমি ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমি ছাড়া এখানে দ্বিতীয় কেউ থাকার কথা নয়। তাহলে কথা কে বলছে? হঠাৎ একটা আলোর রশ্মি আমার চোখে লাগল। আমি তখনও মেঝেতে পড়ে আছি। দুইহাতে চোখ ঢাকলাম। কণ্ঠস্বরটি বিস্মিত সুরে বলল,” তারিন! এখানে কি করছ?”

আমি ঈশানের কণ্ঠ শুনে ভড়কে গেলাম। অবাক হয়ে বললাম,” আপনি এখানে কি করছেন?”

ঈশান মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে এগিয়ে এলো। আমার কাছে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসল, ” ওঠো।”

আমি ঈশানের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। ঈশান পুনরায় প্রশ্ন করল,” এখানে কেন এসেছ?”

তার কণ্ঠস্বর কিছুটা ভারী শোনাচ্ছে। আমি বললাম,” সাফিন ভাইয়া আমাকে পাঠিয়েছে। আপনার গাড়িতে একটা জিনিস ছিল। সেটা নেওয়ার জন্য৷ এইতো চাবি।”

” সাফিন তোমাকে পাঠিয়েছে এই বৃষ্টির মধ্যে? আর কেউ ছিল না?”

” আমি নিজেই এসেছি। কেন? আপনার কোনো সমস্যা?”

” না। আমার কি সমস্যা থাকবে?”

” আপনি এই অন্ধকারে ভূতের মতো এখানে বসে আছেন কেন? কি করছিলেন?”

” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস। তুমি যেটার জন্য এসেছিলে সেটা নিয়ে চলে যাও।”

আমার মেজাজ খারাপ হলো। আশ্চর্য মানুষ তো! নিজে সারাক্ষণ ছ্যাঁচড়ামি করে বেড়ায় আর এখন ভাব ধরা হচ্ছে। আমিও কিছু বললাম না। গাড়ি থেকে লাল রঙের প্যাকেটটা খুঁজে নিলাম। ঈশান বলল,” পেয়েছ?”

” হ্যাঁ। এইতো।”

” ঠিকাছে। যাও এখন।”

” আচ্ছা, একটা কথা..”

” কি?”

” গাড়ির চাবি তো আমার কাছে। তাহলে আপনি কিভাবে লক খুললেন?”

” ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। আর কোনো প্রশ্ন?”

” না।”

আমি চলে এলাম। মনে মনে ঈশানকে জঘন্য কয়টা গালি দিলাম। অসভ্য লোক! এতো ভাব দেখাচ্ছে কেন হঠাৎ? খুব অবাক হলাম। ঈশানের এই স্বভাব বিরুদ্ধ আচরণটা যেন আমি মেনে নিতে পারছি না। সে আগে যেমন ছিল, ঠাট্টা-মশকরা করতো, তেমন ভাবেই তাকে মানাতো। এখন এই গম্ভীর ঈশানকে আমার একদম ভালো লাগছে না। নাকি আমি ট্রিগারড হয়ে যাচ্ছি? ঈশান আগের মতো আমার পেছনে লাগছে না বলে! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজার কাছে এলাম। কিন্তু হায়! দরজা বন্ধ! বন্ধ কি করে হলো?

আমি দুই হাতের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। চিৎকার করে বললাম,” কেউ আছেন? প্লিজ দরজাটা খুলুন!”

গ্যারেজ রুমটা এতো বিশাল যে আমার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার আমার কানেই ফিরে এলো। আমি আরও জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। নিশ্চয়ই দারোয়ান মামার কাজ এটা। তিনি চেয়ারে চাবি দেখে ভেবেছেন আমি চলে গেছি৷ তাই তিনিও গেইট আটকে ঘরে গিয়ে বসে আছেন। আর এই বৃষ্টির মধ্যে কেউ বাগানের এই পাশে আসবেও না। অর্থাৎ আমার চিৎকার শোনার কেউ নেই! এই কথা ভেবে ভয়ে আরও জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। ঈশান ছুটে এসে বলল,” প্রবলেম কি তোমার? এমন করছ কেন?”

আমি অসহায় সুরে বললাম,” গেইট.. লক।”

” চিৎকার করলে কি গেইট খুলে যাবে?”

” না। আপনি আপনার ফোনটা দিয়ে কাউকে কল করে আসতে বলুন না প্লিজ। এই অন্ধকারে আমার দম আটকে আসছে।”

ঈশান গম্ভীরমুখে বলল,” গ্যারেজরুমে নেটওয়ার্ক নেই। ফোন করা সম্ভব না।”

আমি আতঙ্কে অস্থির হয়ে বললাম,” তাহলে কি করব?”

” অপেক্ষা করো।”

” কিন্তু কতক্ষণ অপেক্ষা করব?”

” জানি না।”

আমি আবার চিৎকার শুরু করলাম। ঈশান হঠাৎ আমার মুখ চেপে ধরল। আমার নিশ্বাস আটকে এলো। ঈশান থমথমে কণ্ঠে বলল,” প্লিজ তারিন, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকো। আমার মাথা ধরেছে। প্লিজ! পায়ে পড়ি তোমার।”

আমি চুপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। ঈশান দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আমার। কিভাবে এখান থেকে বের হবো? কতক্ষণ আটকে থাকতে হবে? গরমে, অন্ধকারে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি। অথচ ঈশান কি নির্বিকার! যেন কোনো রোবট দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। সহসা একটি অদ্ভুত শব্দে আমি কেঁপে উঠলাম। ভারী একটা জিনিস আমার কোলের উপর দিয়ে লাফিয়ে গেল। আমি দেখলাম ইঁদুর। ভুবন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ঈশানের গলা। আমার শরীরের ধাক্কায় ঈশান দুই কদম পিছিয়ে গেল৷ তার পিঠ মিশে গেল দেয়ালে। আমি চোখমুখ খিচে প্রাণপণে বলতে লাগলাম,” ইঁদুর, আমাকে বাঁচান। ইঁদুর!”

ঈশান কোনো কথা বলল না। একটা শব্দ পর্যন্ত না। আমি তাকে ওভাবেই কয়েক মুহূর্ত জড়িয়ে ধরে থাকলাম। একটু পর আমার ভয় কাটলে আমি তাকে ছেড়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। সে শান্ত সুরে বলল,” গাড়িতে গিয়ে বসো। ইঁদুর আসবে না।”

আমি সংকুচিত কণ্ঠে বললাম,” ভয় লাগছে।”

ঈশান আমার হাত ধরে আমাকে গাড়িতে নিয়ে এলো। দু’জন ভেতরে ঢুকে বসলাম। ঈশান গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে দিল। এসি ছাড়ল। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। গাড়ির সাথে মাথা হেলিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। নিজের কাজের জন্য নিজেরই লজ্জা লাগছে। অথচ ঈশান কিছুই বলল না। অদ্ভুত! জড়পদার্থের মতো সে গুম মেরে বসে আছে এখনও। আমি তার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করলাম,” আপনার কি হয়েছে?”

ঈশান বিরস কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল,” শুনে কি করবে?”

” কিছু তো করতে পারব না। অন্তত টাইমটা পাস হবে।”

ঈশান মুচকি হাসল। আমি অনুরোধ করলাম,” বলুন প্লিজ!”

ঈশান বিষাদসিক্ত কণ্ঠে জানাল,” আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে তারিন!”

আমি খুব অবাক হয়ে তাকালাম।

চলবে

#তি_আমো
পর্ব ৯
লিখা- Sidratul Muntaz

পিনপতন নীরবতা। কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করে ধেঁয়ে আসছে শুধু মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ। এই স্নিগ্ধ শীতল রাতে আমি যতটা বিস্মিত, ঈশানের মন তার চেয়েও বিষণ্ণ।
আমি ধাতস্থ হয়ে বললাম,” এটা কি বলছেন? কেন ডিভোর্স হচ্ছে তাদের?”

ঈশান দুইহাতে পুরো মুখে মালিশ করতে করতে বলল,” মম আমাকে একটু আগে ফোন করে জানিয়েছে, আমার বাবার থেকে ডিভোর্স নিতে চায় সে। বাবাও রাজি। দু’জন আগে থেকেই সিপারেটেড। এতোদিন আমার জন্য অফিশিয়ালি ডিভোর্স নেয়নি। কিন্তু এখন ডিভোর্স বাধ্যতামূলক। ”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” ডিভোর্স বাধ্যতামূলক? কেন?”

ঈশান অস্বস্তি ঠেলে বলল,” কারণ দু’জনেই তাদের জীবনে নতুন লাইফ পার্টনার পেয়ে গেছে।”

আমি আরও একবার ধাক্কা খেলাম। কানে কিছু একটা ঝনঝন করে উঠল। কয়েকদিন আগেও ঈশানদের বিশাল বাড়ি, টাকা-পয়সা আর ভালো অবস্থান দেখে আমি আক্ষেপ করছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, খুব ভালো যে আমাদের ওতো টাকা-পয়সা নেই। সংসার ভরা শান্তি তো আছে! যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না৷ ঈশান বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,” মম আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কার সঙ্গে থাকব? বাবা অথবা মায়ের মধ্যে যেকোন একজনকে সিলেক্ট করতে হবে। এটা কি সম্ভব?আমি কি বললাম জানো?”

” কি বললেন?”

” আমি আর কখনোই বাড়ি ফিরব না। বাবার কাছেও না আর মমের কাছেও না।”

” তাহলে আপনি কোথায় থাকবেন?”

” জানি না।”

আমার অস্থির লাগছে। ঈশানের বিষণ্ণ মুখটির দিকে চেয়ে নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে। আমি বললাম,” এভাবে ভেঙে পড়বেন না। তাদের বোঝান, তাদের সাথে মন খুলে কথা বলুন। যদি সত্যিই তারা ডিভোর্স নিয়ে নেয়, তাহলে আপনার কি হবে? আপনার লাইফটা শেষ হয়ে যাবে।”

ঈশান আমার দিকে চেয়ে অত্যন্ত ঠান্ডা স্বরে বলল,” তারা আমার মা-বাবা তারিন। যেখানে তাদের আমার কথা মনে ছিল না সেখানে আমি কেন মনে করাতে যাব?”

” অভিমান করছেন?”

” করেও কি লাভ? যদি মূল্য দেওয়ার কেউ না থাকে?”

ঈশানের চেহারায় বিষাদময় হাসি। আমি তার হাতটা চেপে ধরে বললাম,” প্লিজ একটু স্বাভাবিক হোন আপনি। এতোটা মনখারাপ করে থাকবেন না। আপনাকে হাসি-খুশিই ভালো লাগে। এভাবে একদম ভালো লাগছে না।”

” হাসি-খুশি থাকতে তো আমিও চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য যে সহায় হলো না! ভাগ্যিস আমার কোনো সিব্লিংস নেই। তাহলে তাদেরও এসব সহ্য করতে হতো। আমি বাবা-মায়ের ডিভোর্সের পর আমি একদম একা হয়ে যাব।”

” আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। তারা আপনার কথা কেন চিন্তা করল না?”

ঈশান চুপ করে রইল। আমিও চুপ। ওভাবেই তার হাতটা ধরে থেকে বললাম,” আমি আপনার পাশে আছি। ”

ঈশান আমার দিকে তাকাল। কথাটা বলে ফেলার পর আমি নিজেই স্তম্ভিত। হঠাৎ এই কথা কেন আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো? ঈশান কোমল স্বরে বলল,” থ্যাংকস। ”

আমি হকচকিয়ে তাকালাম,” থ্যাংকস কেন?”

” সঠিক সময় এখানে এসেছ তাই। আমি তো বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।”

আমি চোখ বড় করে বললাম,” এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেতেন?”

” জানি না।”

” পাগলামি করছেন।”

” তুমি হলে কি স্বাভাবিক থাকতে পারতে?”

” জানি না। আমি নিজেকে আপনার জায়গায় চিন্তাও করতে পারছি না।”

ঈশান আমার হাতটা আরও শক্তভাবে চেপে ধরে প্রশ্ন করল,” তারিন, তুমি কি আমার পাশে সবসময় থাকবে?”

আমি অবাক হলাম। কিন্তু জবাব দিলাম না। ঈশান হয়তো জবাবের আশাও করল না। সে প্রশ্নটা করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; যেন জটিল কোনো ভাবনায় বুঁদ হয়ে গেছে। আমি বললাম,” একটা সত্যি কথা বলবেন?”

” কি সত্যি জানতে চাও?”

আমি যথেষ্ট সংকোচ নিয়ে প্রশ্ন করলাম,” আপনি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন?”

আমার এই প্রশ্নে হেসে উঠল ঈশান। তার হাসিতে আমি আরও বিব্রত হয়ে গেলাম। ইচ্ছে করল মাটির সাথে মিশে যাই। ঈশান আমার দিকে চেয়ে বলল,” তোমার কি মনে হয়?”

” জানি না। আমি বুঝতে পারছি না।”

” আমার দিকে তাকিয়ে থাকো, বুঝতে পারবে।”

আমি তাকালাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একমিনিট, দুইমিনিট.. এভাবে না জানি কত মিনিট কেটে গেল! আমি তাকিয়েই রইলাম। অজান্তেই দু’জন খুব কাছে চলে এসেছি। ঈশান হঠাৎ বলল,” থামো, এভাবে আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কিন্তু আমি তোমাকে কিস করে ফেলব।”

আমি ছিটকে সরে গেলাম। ঈশান হাসতে শুরু করল। জানালার দিকে মুখ করে বসলাম।অনেকক্ষণ পর তার হাসির শব্দ শুনে মন শান্ত হলো। তবে লজ্জাও লাগছে। তাই ঈশানের দিকে তাকালাম না। হঠাৎ গেইট খোলার শব্দ পেলাম। ঈশান ভারী নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” তোমার অপেক্ষা শেষ হলো। কেউ হয়তো গাড়ি নিতে এসেছে।গেট রেডি।”

এই কথা বলে ঈশান দরজা খুলতে নিলেই আমি বাঁধা দিলাম। ঈশান আমার দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল,” বের হবে না?”

আমি অনুনয় করলাম,” আর কিছুক্ষণ থাকি।”

” আমাদের এভাবে একসাথে কেউ দেখে ফেললে ব্যাপারটা ভালো হবে না তারিন।”

আমি গাড়ির লাইট নিভিয়ে দিয়ে বললাম,” কেউ দেখবে না এখন।”

” কিন্তু গেইট আবার লাগিয়ে দেওয়া হলে? আবার অপেক্ষা করতে হবে।”

আমি গাড়ির সিটে মাথা ঠেঁকিয়ে বললাম,” অপেক্ষা করব।”

ঈশান আর কিছু বলল না। আমি চোখ বন্ধ করে বসে আছি৷ খুব সম্ভবত ঈশান এখন আমার দিকেই চেয়ে আছে। তার চেহারায় একরাশ বিস্ময়। ব্যাপারটা ভেবেই আমার মজা লাগছে৷ মাঝে মাঝে মানুষকে চমকে দিতে এতো মজা লাগে কেন?

সারারাত আমাদের গাড়িতেই কাটল। এর মাঝে অনেকেই গ্যারেজে আসা-যাওয়া করেছে। গেইট অনেকবার খোলা হয়েছে। কিন্তু একবারও আমাদের নামতে ইচ্ছে হয়নি। সাফিন ভাই নিহার জন্য যে গিফটটা নিতে পাঠিয়েছিলেনসেটাও গ্যারেজের কোনো কোণায় পড়ে আছে হয়তো। আমি ইঁদুর দেখে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম৷ তারপর আর মনে নেই। ভোরে যখন আমাদের ঘুম ভাঙল তখন দু’জনেই জোরে চেঁচিয়ে ওঠার মতো দৃশ্য দেখলাম। নিহা আর সাফিন ভাইয়া দুইদিক থেকে অবাক বিস্ময়ে আমাদের দেখছে। আমি লজ্জায় গুটিশুটি হয়ে উঠে বসলাম। ঈশান হতভম্ব গলায় বলল,” তোরা এখানে কি করছিস?”

সাফিন ভাইয়া আমাদের দু’জনকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বললেন,” এই প্রশ্ন তো আমাদের করা উচিৎ। তোরা এখানে কি করছিস? হানিমুন?”

ঈশান কটমট করে বলল,” ননসেন্স! হানিমুন কেন করব?”

সাফিন ভাইয়া হাত দিয়ে ঈশারা করে বললেন,” তাহলে এমন চুইংগামের মতো চিপকে ছিলি কেন?”

আমি লজ্জায় কোনো কথা বলতে পারছি না। ঈশান আমতা-আমতা করে বলল,” এখন কয়টা বাজে?”

সাফিন ভাই আঙুল উঠিয়ে বললেন,” কথা ঘুরাবি না! আমরা যা দেখলাম তা এক্সপ্লেইন কর আগে।”

ঈশান কেশে গলা পরিষ্কার করল। আমি দ্রুত গাড়ি থেকে বের হতে নিয়ে আছাড় খেলাম। ঈশান বলল,” আরে সাবধানে!”

সে উঠে এসে আমার হাত চেপে ধরল। সাফিন ভাইয়া এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন ভয়ংকর কিছু দেখছেন। আকাশ থেকে মুক্তো ঝরে পড়তে দেখলেও এতো অবাক হতেন না হয়তো। নিহা আমার কাছে এসে বলল,” তারু, এটা কি আমার হ্যালুসিনেশন? নাকি তোর হ্যালুসিনেশনই এখন আমার উপর ট্রান্সফার হয়ে গেছে? আমি যা দেখছি তা কি ঠিক? তোরা ডেইট করছিস?”

আমি ঈশানের হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম,” একদম না। ডেইট কেন করব? এটা একটা ইন্সিডেন্ট জাস্ট। রাতে দারোয়ান মামা ভুল করে গেইট লক করে চলে গেছিলেন। আমি বের হতে পারিনি। ঈশানও ভেতরেই ছিল। তাই..”

আর কি বলা যায় সেটা ভাবছি। নিহা আমার মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল,” তাই তোরা এখান থেকে বের হতে না পেরে একজন- অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লি? অদ্ভুত! ”

সাফিন ভাইয়া হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি অস্বস্তিতে ফুঁসে উঠে বললাম,” আমি বাড়ি যাবো।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here