#তি_আমো
পর্ব ২৮
লিখা- Sidratul Muntaz
চলে যাওয়ার আগে আমি নিহার থেকে বিদায় নিতে এলাম। তাছাড়া আন্টি-আঙ্কেল মানে নিহার বাবা-মায়ের কাছেও ক্ষমা চাইতে হবে। আমার জন্যই গতকালের অনুষ্ঠানে এতোকিছু হলো। রুবা আন্টি রান্নাঘরে কমলার মাকে নিয়ে নাস্তা বানাচ্ছিলেন। আমি যেতেই তিনি হেসে বললেন,” আরে তারিন, গুড মর্ণিং। খেয়েছ কিছু? বসো, নাস্তা করো।”
তার এমন স্বাভাবিক আচরণে আমি বিব্রতই হলাম। অপরাধী কণ্ঠে মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম,” আমি স্যরি বলতে এসেছি আন্টি।”
” ওমা, আবার স্যরি কেন? তুমি তো আমার মেয়েরই মতো। ”
এই কথা বলেই রুবা আন্টি আমায় জড়িয়ে ধরলেন। আমার চোখে পানি চলে এলো। রুবা আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” দোষটা আমাদেরই। আমরাই তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি। তোমার ভাইয়া তো আমার প্রতি ভরসা রেখেই তোমাকে একা পাঠিয়েছিল। অথচ আমি বিয়ের কাজে এতো ব্যস্ত ছিলাম যে একবার তোমার খোঁজও নেওয়া হয়নি। আর মাঝখান থেকে যে এতোবড় দূর্ঘটনা ঘটে যাবে সেটাও আমরা কেউ ভাবিনি।”
আমি মাথা উঠিয়ে বললাম,” আপনি নিজেকে ব্লেইম করবেন না আন্টি। আপনি অনেক ভালো। একদম আমার মায়ের মতো। ”
রুবা আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” ফাহিমকে আমি অনেক বকেছি। ও অনুতপ্ত। তোমার কাছে ক্ষমা চাইবে, দেখো।”
” ফাহিম ভাইয়ের দোষ নেই। ভুল আমার। উনি বারণ করা সত্ত্বেও আমি মিষ্টিগুলো খেয়েছিলাম।”
রুবা আন্টি চোখ বড় করে বললেন,” তুমি তো আর জানতে না যে মিষ্টিতে কিছু মেশানো আছে। তাহলে তোমার ভুল কেন হবে? ফাহিমেরই দোষ। আর এজন্য শাস্তিও সে পেয়েছে। তোমার ভাইয়া কিন্তু কাল ফাহিমকে অনেক ঝেরেছে। আমি আগে জানতাম না যে তারিফের এতো রাগ।”
কথাগুলো রুবা আন্টি হেসে বলছেন কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে এগুলো মোটেও হাসির ব্যাপার নয়। আমার খুব খারাপ লাগল৷ এতোকিছুর মাঝে ফাহিম ভাই বেকার ফেঁসে গেল। ভাইয়া সবদিক থেকে ফাহিম ভাইকেই অপরাধী ভাবছে। কিছু না করেও বেচারা ভাইয়ার চোখে ক্রিমিনাল। যাওয়ার আগে একবার ফাহিম ভাইয়ের সাথেও দেখা করে ‘স্যরি’ বলতে হবে। আমি রুবা আন্টিকে প্রশ্ন করলাম,” আন্টি নিহা কি ঘুম থেকে উঠেছে? ওর সাথে একটু কথা বলব।”
” হ্যাঁ, হ্যাঁ নিহা তো উঠে গেছে। তুমি ওর ঘরে যাও কোনো সমস্যা নেই।”
আমি নিহার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। কালরাতে নিহাদের বাসর রাত এই বাড়িতেই হয়েছিল। সাফিন ভাইয়ের বাবা-মা নেই। আত্মীয় বলতে বিদেশে একজন মামা থাকেন। তিনিই এসেছিলেন বিয়েতে। সাফিন ভাইয়ের আসল বাড়ি সিলেট। তাই নিহাকে নিয়ে তিনি দুই একদিনের মধ্যেই সিলেট চলে যাবেন। তবে তাদের বৌভাতও শুনেছি এখানে হবে।
আমি নিহার ঘরে ঢুকে দেখলাম সাফিন ভাই বিছানায় উবু হয়ে ঘুমাচ্ছে। আর নিহা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখা মাত্রই নিহা দ্রুত ছুটে এসে বলল,” তারু, তুই উঠেছিস? সকাল থেকে কয়বার তোর খোঁজে গিয়েছি আমি জানিস? কিন্তু তোর ভাইয়ার জন্য ঘরে ঢুকতে পারিনি।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” ভাইয়া কি তোর উপরেও রেগে আছে?”
নিহা মুখ বেজার করে বলল,” ঈশান ভাই ছাড়া তোর ভাই সবার উপরেই রেগে আছে।”
তারপর নিহা একটু মজা করে বলল,” কি হয়েছে জানিস? সকাল সাতটায় একবার আমি তোর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখনও তুই ঘুমাচ্ছিস। তারিফ ভাই প্রহরীর মতো দরজায় আসন পেতে বসে আছে। আমি যখন তোর সাথে দেখা করার কথা বললাম, তখন তারিফ ভাই গম্ভীর ভাবে কি বলল শুনবি?’ তারুর সাথে কারো দেখা হবে না। ফাহিম তোমাকে পাঠিয়েছে তাই না? ওকে জানিয়ে দাও, ঈশানের সাথে আমি তারুর বিয়ে ঠিক করেছি। ও যেন তারুর ধারে-কাছেও আর না আসে। ‘ এই কথা শোনার পর আমি এতো শকড হয়েছি যে আর কোনো জবাব দেইনি। ঘরে এসে হাসতে হাসতে পাগল হয়ে গেছি। সাফিনকেও ঘটনা বলার জন্য ডাকলাম। কিন্তু সে উঠলই না। সব মজা মিস করছে বলদটা।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,” এখানে আমি বিপদে আছি আর তুই মজা নিচ্ছিস?”
“মজাই তো। তুইও মজা নে। টেনশনের কিছু নেই তারু। একবার শুধু ঈশান ভাইয়ের সাথে বিয়েটা হয়ে যাক তোর। তারপর কেউ কিছু করতে পারবে না। এমনিতেও সত্য প্রকাশ হওয়ার পর তোদের জীবনেও বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ তোর ভাইকে তো তুই-ই ভালো চিনিস। ফাহিম ভাইয়ের সাথে এখন যা হচ্ছে, ঈশানের সাথেও তাই হবে। এর থেকে ভালো, আগে বিয়েটা হয়ে যাক৷ তারপর যত ইচ্ছা ঝড় আসুক, দু’জন একসঙ্গে সামলাবি। খুব ভালো সুযোগ কিন্তু।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। নিহার মতো চিল থাকতে পারছি না আমি। দুশ্চিন্তায় ক্রমাগত হাত-পা কাঁপছে। এই বুঝি সব সত্যি প্রকাশ হয়ে গেল। আমি শুকনো গলায় বললাম,” আচ্ছা, ভাইয়া এখন ভাবছে ফাহিম ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল, তাই না?
নিহা হেসে বলল,” হ্যাঁ। এজন্যই তো জোর করে ঈশান ভাইয়ের সাথে তোকে বিয়ে দিতে চাইছে। তুই বিয়েতে রাজি হয়ে গেছিস না?”
আমি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লাম। নিহা আরও জোরে হেসে বলল,” তোর ভাই আস্তো গাঁধারে! নিজেকে পন্ডিত মনে করে। তোদের মাঝে ভিলেইন সাজতে গিয়ে এখন নিজেই তোদের মিলিয়ে দিচ্ছেন৷”
আমি রেগে বললাম,” এই নিয়ে ফাজলামি করিস না, নিহা। মোহনা আন্টি আজ সকালে আমার সাথে ঈশানের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া উনাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে।”
নিহা মাথায় হাত দিয়ে বলল,” বলিস কিরে! যাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল তার ছেলের সাথেই তো এখন বিয়েটা দিচ্ছে। অদ্ভুত না?”
নিহা হাসতে লাগল। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বড় করে শ্বাস ছাড়লাম। নিহা পেছনে এসে বলল,” অনেক বড় প্রবলেমে ফাঁসতে যাচ্ছিস তোরা। সেটা কি বুঝতে পারছিস? তবুও প্রবলেম নেই। বিয়ে হচ্ছে এটাই বড় বিষয়। বিয়ের পর কোনো প্রবলেমই আর প্রবলেম না।”
আমি ফিচলেমি করে হাসলাম। নিহার দিকে চেয়ে বললাম,” ও। তোর তো এখন নতুন বিয়ে হলো। ভালো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে মনে হচ্ছে। মাত্র একরাতেই এতো অভিজ্ঞতা?”
নিহার চেহারা মুহূর্তেই লাল হয়ে উঠল। বড় বড় চোখ করে সে রাগী গলায় বলল,” তারু, আমি সেরকম কিছু মিন করিনি। ছিঃ! আমি বলছি, বিয়ের আগে তোরা একা ছিলি। বিয়ের পর হয়ে যাবি দোকা। তোদের তো আর তখন কেউ আলাদা করতে পারবে না। যত ঝড় আসবে দু’জন একসঙ্গে সামলাবি। দূরে সরে যাওয়ার চান্স নেই।”
আমি নিহার কাঁধে হাত রেখে বললাম,” ঠিক বলেছিস।”
পাশের বারান্দা থেকে ঈশানের কণ্ঠ ভেসে এলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে একটু থামলাম। তারপর দেয়ালে আড়ি পাতলাম। মোহনা আন্টি আর ঈশানের মধ্যে কথা হচ্ছে। নিহাদের বারান্দাগুলো একটা অন্যটার সাথে সংযুক্ত হওয়ায় একরুম থেকে অন্যরুমে সহজেই কথা শোনা যায়। আমার মনে আছে, নিহার জন্মদিনে যখন এসেছিলাম তখন এই বারান্দায় দাঁড়িয়েই আমি ঈশানের সাথে কথা বলেছিলাম। ঈশান তখন ছিল পাশের রুমের বারান্দায়।
আমি আর নিহা নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। কারণ মোহনা আন্টি ঈশানের সাথে যে বিষয়ে কথা বলছে সেটা আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনছি। মোহনা আন্টি হয়তো কাঁদছেন।
” ঈশান, কি করবি তুই এখন?”
ঈশান মোহনা আন্টিকে মানানোর চেষ্টা করল,” কিছুই করার নেই মম। তুমি শান্ত হও।”
” কিভাবে আমি শান্ত হবো? তুই তারিনকে খুব ভালোবাসিস সেটা আমি জানি। আমার ছেলে তার পছন্দের মেয়েটিকে হারিয়ে সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে মনখারাপ করে ঘুরবে এটা আমি দেখতে পারব না। আমি তারিনের ভাইকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু উনি আমার কথার গুরুত্বই দিচ্ছেন না। আমি আবার চেষ্টা করব।”
” প্লিজ মম, এইরকম করো না। তারিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাই হাজার বললেও এখন আর কোনো লাভ নেই।”
” বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মানে? কার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হলো?”
” তারিনদের বাড়িতে যে ছেলেটা থাকতো তার সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
” তুই কি চাস তারিনের বিয়ে হয়ে যাক?”
” হ্যাঁ চাই। তুমিও এই বিষয়টা ভুলে যাও। তারিনের ভাইয়ের কাছে তুমি আর যাবে না। আমাকে কথা দাও।”
” তুই কি সেক্রিফাইস করছিস? খবরদার ঈশান, এইরকম কিছু ভাববি না। আমি জানি তারিনও তোকে ভালোবাসে। ওই ছেলেকে বিয়ে করলে তো তারিনেরও জীবনটা নষ্ট হবে।”
” তারিন ভালো থাকবে। কারণ যার সাথে তারিনের বিয়ে হচ্ছে, সে তারিনকে খুব ভালো রাখবে।”
” কিন্তু তোর থেকে ভালো রাখতে পারবে না। আমি জানি, আমার ছেলের থেকে বেশি কেউ তারিনকে ভালোবাসতে পারবে না।”
” কিন্তু তারিনের ভাই তো এইসব বুঝবে না, মম।তিনি আমাকে খুব খারাপ ভাবছেন।”
” আমি সব ঠিক করে দিব। আমি প্রমাণ করব যে আমার ছেলে কত ভালো। তারিনকে শুধু তুই ডিজার্ভ করিস ঈশান। আর অন্যকারো সাথে আমি তারিনের বিয়ে হতে দিব না।”
আমি আর নিহা ভয় নিয়ে একে-অপরের দিকে চাইলাম৷ মোহনা আন্টি মনে হয় এখন সবচেয়ে বড় ভেজালটা লাগাবে। ঈশান কিছুতেই তার মাকে সামলাতে পারছে না। শেষমেষ ঈশান ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” তোমার ছেলে খুব খারাপ, মম। তুমি কিছুই জানো না আমার সম্পর্কে। শুধু শুধুই আমাকে নিয়ে এতো প্রাউড ফীল করার কিছু নেই।তারিনের ভাই আমাকে যা ভাবে, আমি ঠিক তাই।”
মোহনা আন্টি হতবাক হয়ে বললেন,” এর মানে?”
” মানে পার্টিতে তারিনকে আমিই টাচ করেছিলাম৷ এটা সত্যি। আমিই তারিনকে চিঠি দিয়েছি। এটাও সত্যি। কাল যে তারিন ড্রিংক করেছে, সেটাও আমার জন্য। এতোগুলো কারণ কি আমাকে ঘৃণা করার জন্য যথেষ্ট নয়? এতোকিছুর পরেও কি তোমার মনে হয় যে তারিনের ভাইয়া আমার সাথে তার বোনের বিয়ে দিতে রাজি হবেন? কখনোই তিনি রাজি হবেন না। কারণ তোমার ছেলে খুব খারাপ, নিকৃষ্ট।”
মোহনা আন্টি সঙ্গে সঙ্গে ঈশানের গালে চড় মারলেন। আমি আর নিহা ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হলাম। ঈশানকে দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে চলে যাচ্ছে। মোহনা আন্টি বিছানায় বসে মাথায় হাত রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আমার প্রচন্ড খারাপ লাগল। ঈশান এটা কেন করল? মোহনা আন্টিকে সত্যিটা বলে এইভাবে কষ্ট দেওয়া তার উচিৎ হয়নি। এইসব কথা তো মোহনা আন্টি না জানলেও চলতো।
নিহা মোহনা আন্টির কাছে গিয়ে দুইহাতে আগলে ধরল,” আন্টি প্লিজ আপনি কাঁদবেন না।”
মোহনা আন্টি দিশেহারার মতো বললেন,” এসব আমি কি শুনলাম, নিহা? আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার ছেলে হয়ে ঈশান এইসব কিভাবে করতে পারে? আমি কি মা হয়েও তাকে কখনও চিনতে পারিনি? ”
” না আন্টি। আপনি ভুল ভাবছেন।”
” এতোদিন ভুল ভেবেছি। এখন ঠিকই ভাবছি। তোমরা শুনে রাখো, আজ থেকে ঈশান নামের আমার কোনো ছেলে নেই। আমার জন্য ঈশান মরে গেছে। ওকে বলবে যেন কখনও আমার সামনে না আসে।”
মোহনা আন্টির কান্না দেখে আমার এতো মায়া হলো! আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম,” ঈশান সব মিথ্যা বলেছে আন্টি। ও আমার সাথে কিছু করেনি।”
মোহনা আন্টি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। বরং অপরাধী স্বরে বললেন,” ওর দোষ ঢাকার চেষ্টা করছ? আমি তোমার কাছেও ক্ষমা চাইছি। মা হিসেবে ব্যর্থ ছিলাম বলেই এমন ছেলে জন্ম দিয়েছি। জীবনে কখনও আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে ভালো মেয়ে হতে পারিনি৷ স্বামীর কাছে ভালো স্ত্রীও হতে পারিনি৷ একটা ব্যাপারে আমি খুব গর্ব করতাম যে আমি ভালো মা হতে পেরেছি। ছেলেকে মানুষ বানাতে পেরেছি। কিন্তু না, সে তো অমানুষই রয়ে গেছে। একদম তার বাবার মতো হয়েছে। আমি সবদিক দিয়েই ব্যর্থ। আমার মতো মহিলার বেঁচে থাকারই কোনো অধিকার নেই।”
নিহা মোহনা আন্টির চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” এতো ভেঙে পড়ার কিছু নেই আন্টি। ঈশান ভাইয়া আপনাকে এই মিথ্যা কথা কেন বলেছে জানেন? যেন আপনি তারিনের বিয়েতে ঝামেলা না করেন। ঈশান ভাই চায় তারিনের বিয়ে হোক।”
মোহনা আন্টি শক্ত গলায় বললেন,” ও এটা কেন চাইবে? ও কি তারিনকে ভালোবাসে না? অবশ্য ওর মতো ছেলে ভালোবাসার কি বুঝবে? ও তো একটা…”
মোহনা আন্টি কথা শেষ না করে আবার কাঁদতে লাগলেন। আমি মোহনা আন্টির কাছে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম৷ হাত ধরে বললাম,” আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন আন্টি। ঈশানের কোনো দোষ নেই৷ সে খারাপ না।”
” তোমার সাথে ঈশান এতকিছু করল তাও তুমি বলছ সে খারাপ না?”
আমি মোহনা আন্টিকে সব বোঝাতে চাইলাম কিন্তু এর আগেই নিহা বলল,” ঈশান কিছুই করেনি। সব মিথ্যা। তারিনকে পার্টিতে ব্যাড টাচ করেছিল অন্যকেউ।”
মোহনা আন্টি প্রশ্নবাণ ছুঁড়লেন,” সেই অন্যকেউটা তাহলে কে?”
নিহা তড়িঘড়ি করে বলল,”যার সাথে তারিনের বিয়ে ঠিক হয়েছে সে।”
আমি নিহার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। মোহনা আন্টি চোখ বড় করে বললেন,” তাহলে এই ছেলের সাথে তারিনের বিয়ে কিভাবে হচ্ছে? ওইরকম একটা ক্রিমিনালের সাথে!”
নিহা প্রশমিত কণ্ঠে বলল,” তারিফ ভাই তো আর এসব কিছু জানে না। তাই বিয়ে দিচ্ছে। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আমরা বিয়েটা থামাব।”
মোহনা আন্টি আর কিছু না বলে দরজার দিকে যেতে লাগলেন। আমি প্রশ্ন করলাম,” কোথায় যাচ্ছেন আন্টি?”
মোহনা আন্টি কাঠ কাঠ গলায় বললেন,” তুমি কিছু ভেবো না তারিন। তোমার এই বিয়ে আমিই ভাঙব। এখনি তোমার ভাইয়াকে সবকিছু জানাব আমি।”
মোহনা আন্টির কথা শুনে আমি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মেঝেতে বসে পড়লাম। নিহা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো৷ দু’জন-দু’জনের দিকে চেয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। তারপর আমি জোরে একটা চিৎকার করলাম। নিহা বড় বড় শ্বাস ছেড়ে বলল,” থাম তারু, আমি সব ঠিক করে দিব।”
আমি গর্জন করে বললাম,” খবরদার তুই আর কিছু ঠিক করতে যাবি না। তোর জন্যই সব ঝামেলা হয়েছে। এতোকিছু বলার কি দরকার ছিল? আমি মোহনা আন্টিকে বোঝাচ্ছিলাম তাতে হচ্ছিল না?”
নিহা করুণ দৃষ্টিতে বলল,” স্যরি।”
আমি ভয়ানক দুশ্চিন্তায় উঠে দাঁড়িয়ে নিহার পিঠে এলোপাতাড়ি ঘুষি মেরে বললাম,” রাখ তোর স্যরি। এখন স্যরি বলে লাভ কি হবে?”
আমাদের ঝগড়া শুনে পাশের ঘর থেকে সাফিন ভাই উঠে এলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল,” কি হয়েছে তারু? সকাল সকাল আমার বউটাকে এভাবে মারছ কেন?”
আমি ক্ষীপ্তবৎ হয়ে বললাম,” কারণ আপনার বউ আমাদের সবাইকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছে।”
নিহা বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,” তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? আমি বুঝিনি যে এমন হয়ে যাবে। মোহনা আন্টি কিভাবে কাঁদছিল তুই দেখেছিস? যদি হার্ট এটাক করে ফেলত? আমি শুধু তাকে শান্ত করতে চেয়েছি।”
” এখন সে নিজে শান্ত হয়ে আমার ভাই আর মাকে হার্ট এটাক করাতে যাচ্ছে। আমার দাদীও হার্ট এটাক করবে। তাদের সবার শোকে আমিও হার্ট এটাক করব। আমি ফুল ফ্যামিলিকে হার্ট এটাক করানোর ব্যবস্থা করেছিস তুই।”
সাফিন ভাইয়া কিছু না বুঝেই বলল,” তোমরা সবাই একসাথে হার্ট এটাক করতে যাচ্ছ কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। আজ কি কোনো হার্ট এটাক ডে?”
আমি ক্রোধান্বিত হয়ে বললাম,” না। কিন্তু আপনার বউয়ের জন্য আজকের দিনটি ক্যালেন্ডারের পাতায় হার্ট এটাক ডে হিসেবে যোগ হবে। ইতিহাস হবে, তারিন নামের একটা মেয়ে ছিল৷ তার নিহা নামের একটি বন্ধুর মতো শত্রু ছিল। সেই শত্রু তারিনের পুরো পরিবারকে হার্ট এটাক করানোর জন্য দায়ী।”
নিহা আমার কপালে হাত রেখে বলল,” তুই পাগল হয়ে গেছিস তারু। পানি খা। একটু শান্ত হয়ে বস। আমরা ভেবে একটা প্ল্যান বের করছি।”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,” রাখ তোর শান্ত হয়ে বসা! মোহনা আন্টি কি আমাদের প্ল্যানের জন্য বসে থাকবে? তিনি নিশ্চয়ই এতোক্ষণে সব ব্লাস্ট করে দিয়েছে।”
” তাইতো! ”
নিহা এইটুকু বলেই বসে রইল। চিন্তায় হয়তো আজ সবার বোধ-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। আর আমি কি করছি এসব? আমার তো মোহনা আন্টিকে আগেই থামানো উচিৎ ছিল। আমি দ্রুত ছুটে গেলাম।
করিডোরে মোহনা আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথেই ভাইয়া। আমার আতঙ্কে নিশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম। দ্রুত গিয়ে বললাম,” আন্টি প্লিজ, আপনি আমার কথা শুনুন। আমি শুধু ছোট্ট একটা কথা বলব আপনাকে।”
মোহনা আন্টি ভাইয়ার দিকে চেয়ে বলল,” তুমি তোমার ভাইয়াকে খুব ভয় পাও তাই না, তারিন? আর তোমার ভাইয়ারও নিজের বিচক্ষণতা নিয়ে অনেক অহংকার। আমার ছেলেকে রিজেক্ট করে সে অনেক ভালো পাত্র জোগাড় করেছে৷ সেই পাত্র যে আসলে কেমন সেটা কি তোমার ভাইয়ের জানা উচিৎ নয়?”
আমি ভয়ে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলাম। ভাইয়া মৃদুব হেসে রূঢ় স্বরে বলল,” এখন নিজের ছেলের গতি খুঁজে পাচ্ছেন না বলে ঈশানের নামে উল্টা-পালটা বলতে এসেছেন? এসব আপনার থেকে আশা করিনি।”
মোহনা আন্টি গলা উঁচিয়ে বললেন,” আমার ছেলেকে এতো আন্ডারেস্টিমেট করার কিছু নেই। সে আপনার পছন্দ করা পাত্রের থেকে হাজার গুণ ভালো। ”
ভাইয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” চরিত্রের নেই ঠিক, আবার সে ভালো! শুনুন, আমার বোন কোনো পণ্য নয় যে পয়সা থাকলেই পাওয়া যাবে। টাকা-পয়সার চেয়েও আমার কাছে আদর্শ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ”
মোহনা আন্টি হাত ভাজ করে বললেন,” তাই বুঝি? আপনার ঠিক করা পাত্র কি খুব আদর্শবান? ডাকুন তাহলে তাকে। আমিও একটু কথা বলে দেখি। আমি তাকে সিম্পলি কয়েকটা প্রশ্ন করব।”
আমি চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছি। ঈশানকে এখানে ডাকা মানে চূড়ান্ত বিপদ। আমি এবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম ঈশান আছে নাকি? সে যদি হঠাৎ চলে আসে? ভাইয়া ফট করে বলল,” আপনার মতো মানুষকে জবাব দেওয়ার জন্য হলেও আমি ঈশানকে এখানে ডাকব। তবে আপনি তাকে কোনো আজে-বাজে প্রশ্ন করে যদি ইনসাল্ট করার চেষ্টা করেন তাহলে খুব খারাপ হবে।”
” সে যদি আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে তাহলে ইনসাল্ট করব কেন? আপনি তাকে ডাকুন আগে।”
ভাইয়া উচ্চশব্দে ঈশানকে ডাকতে লাগল। আমার প্রাণপাখি কাঁপতে লাগল। ঈশান তো যেকোনো সময় চলে আসবে। আমি দ্রুত করিডোরের বাইরে বের হলাম। ঈশানকে দেখলাম দক্ষিণ দিকের রুম থেকে বেরিয়ে আসছে। তার যাত্রা করিডোরের দিকে। আমি তার পথ আটকে দাঁড়ালাম,” কোথায় যাচ্ছেন?”
ঈশান ভ্রু কুচকে বলল,” কানে শুনতে পাচ্ছ না? তোমার ভাইয়া ডাকছে তো আমাকে!”
আমি বিপর্যস্ত গলায় বললাম,” খবরদার যাবেন না।”
এই কথা বলেই আমি ঈশানের হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। ঈশান বিভ্রান্ত হয়ে বলল,” আরে, যাব না কেন? আজব!”
আমি ফিসফিস করে বললাম,” ভাইয়ার সাথে আপনার মাও আছে।”
” হোয়াট?”
ঈশানের চোখে আতঙ্কের উদ্রেক হলো। আমি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়েই ঈশানকে নিয়ে নিহাদের স্টোর রুমে ঢুকে পড়লাম। দরজা আটকে দিলাম। ঈশান কপালে হাত দিয়ে বলল,” তারিন এসব কি করছ তুমি? এভাবে আর কত? আমি খুব টায়ার্ড! এবার সবাইকে সব সত্যি বলে দেওয়া উচিৎ। ”
আমি ঈশানের দিকে ফিরে হাতজোড় করলাম,” দয়া করে এমন করবেন না। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
আমি চোখ দু’টো অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেল। ঠোঁটে কাঁপতে লাগল। ঈশান বিস্মিত হয়ে বলল,” তারিন, এতো ভালোবাসো কেন আমাকে?”
আমি উদভ্রান্তের মতো ঈশানকে জড়িয়ে ধরলাম। দুই পাশে মাথা নেড়ে বললাম,” জানি না। দুনিয়া ভেসে গেলেও আমি আপনাকে হারাতে চাই না। আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে নিয়ে এখনি কোথাও পালিয়ে যেতে। কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
ঈশান আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” এমনিতেও এখন আমাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না।”
চলবে