তি_আমো পর্ব ৩৩

0
296

#তি_আমো
পর্ব ৩৩
লিখা- Sidratul Muntaz

আমার চেহারায় লজ্জার চেয়েও বেশি আনন্দ ঝলমল করছে। বিয়ের প্রসঙ্গে মোহনা আন্টির সাথে কথা বলা আমার জন্য সহজ হতো যদি এখানে ঈশান উপস্থিত না থাকতো। তার হাসি আমাকে বিব্রত করে দিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে কথা বলতে গেলে গলাও কাঁপবে। মোহনা আন্টি আবার প্রশ্ন করলেন,

” এতো লজ্জা পেলে কি চলবে? বিয়ের জন্যই তো এতোকিছু করলে তোমরা। আর এখন নিজেরাই চুপচাপ আছো! আমরা কি এখন তোমাদের ধরে-বেঁধে জোর করে বিয়ে দিবো নাকি? এই ওয়েট, তোমরা আবার আমাদের না জানিয়ে লুকিয়ে বিয়েও করে ফেলোনি তো? আমার কিন্তু সন্দেহ লাগছে!”

আমি নাকে-মুখে ‘না’ বলতে চাইলাম কিন্তু এর আগেই ঈশান গালে হাত রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছে,” হতেও পারে মম! ইম্পসিবল কিছু তো না।”

মোহনা আন্টি অবাক হয়ে বললেন,” হোয়াট? সিরিয়াসলি?”

আমার চোয়াল ঝুলে পড়ার উপক্রম। ঈশানকে চোখ রাঙিয়ে বললাম,” এসব কি বলছেন? ধূর! একদম না আন্টি। আপনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। আমি আমার ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে কখনোই বিয়ে করব না।”

ঈশান হাসছে। মোহনা আন্টি একটু পর বললেন,” বিয়ের পরেও কি আমাকে আন্টি বলেই ডাকবে? ”

আমি মাথা নিচু করে হাসলাম,” তাহলে কি বলব?”

” ছোটমা বলতে পারো..”

ঈশানের মুখ থেকে দেখলাম হাসি উঁবে গেল। মোহনা আন্টিও আঁড়চোখে ঈশানের দিকে চেয়ে আছেন। হঠাৎ কি হয়ে গেল আমি বুঝলাম না। ঈশান উঠে পড়ল,” আমি একটু আসছি।”

তারপর আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে ‘বাই’ বলে সে চলে গেল। এতে খানিক স্বস্তিই পেলাম আমি। মোহনা আন্টি হেসে আমাকে বললেন,”আমাকে মা বলে ডাকতে পারো। নয়তো ঈশানের মতোই ডাকবে.. মম!”

আমি মিষ্টি হেসে বললাম,” আমার মা ডাকতেই ভালো লাগবে।”

মোহনা আন্টি কফিতে চুমুক দিয়ে একটু সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” তোমার ভাইয়া কখন ফিরবে?”

আমি ফ্যাকাশে মুখে বললাম,” জানি না মা। তবে আমি চাই দ্রুত ফিরে আসুক। ভাইয়া এমন একটা মানুষ যে বন্ধু বিপদে পড়লে নিজের পরিবারের কথাও ভুলে যায়। কখন যে ফিরে আসে তার কোনো ঠিক নেই।”

মোহনা আন্টি অনেকটা কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার মতো বলতে লাগলেন,” জানো তারিন, যখন আমি ঈশানের বাবাকে বিয়ে করি তখন আমার বয়স মাত্র বিশ। আমাদের সময় এই বয়সটা বিয়ের জন্য মোটামুটি লেইট বলা যায়। আমাকে বিয়ে দিতে প্রায় উঠে-পরেই লেগেছিল সবাই। মা-বাবা সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতো। যেন বিয়ে না করা মস্ত অপরাধ! কিন্তু আমি তখন কারো অপেক্ষায় ছিলাম। আর দিনশেষে বুঝলাম, অপেক্ষা জিনিসটা খুব বাজে ব্যাপার। সবসময় অপেক্ষা মধুর হয় না। মাঝে মাঝে খুব নিষ্ঠুরও হয়। আমি যখন বুঝলাম, অপেক্ষা করে কোনো লাভ হবে না, জীবনের সব অপেক্ষাই বৃথা! তখন একপ্রকার জেদ ধরেই ঈশানের বাবাকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত ভালোবাসতে পারিনি। ফলশ্রুতিতে আমাদের ডিভোর্স হয়েছে। এখন আমি মুক্ত আর আমার পাশে আমার ঈশান আছে। সে তার বাবার সাইড নেয়নি। আমার সাইড নিয়েছে। এটা যে আমার জন্য কতবড় পাওয়া, তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমি আমার সারাটি জীবন এখন আমার ছেলে, তোমার মতো মিষ্টি একটা মেয়ে আর অনেকগুলো আদুরে ছানা-পোনা নিয়েই কাটিয়ে দিতে চাই।”

আমি লজ্জায় হেসে ফেললাম। কিন্তু চোখ ছলছল করছে। মোহনা আন্টি আমার হাতে হাত রেখে বললেন,” তোমাদের ভালোবাসাটা অনেক সুন্দর, অনেক মিষ্টি৷ আমি চাই না তোমরা অপেক্ষা করো। জীবনে সঠিক সময় বলে কিছু হয় না। মন যখন সায় দেয়, তখনি সঠিক সময়।”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” এটা কি ঈশানের কথা?”

মোহনা আন্টি ফিক করে হেসে বললেন,” না। এটা আমার কথা। কিন্তু আমিই ঈশানকে শিখিয়েছি।”

আমি একটু ইতস্ততভাবে বললাম,” আসলে ছোটবেলা থেকেই আমি ভাইয়ার খুব বাধ্য। কখনও ভাইয়ার অনুমতি ছাড়া কিছু করিনি। ভাইয়া যদিও বিয়েতে অনুমতি দিয়েছে কিন্তু আমি চাইব ভাইয়া ফিরে এলেই বিয়ে করতে।”

” তুমি কি জানো? ঈশান যে আটদিন পর লন্ডন চলে যাচ্ছে?”

আমি কথাটা শুনে বজ্রাহত হলাম। মাথার মধ্যে ফট করে একটা শব্দ বেজে উঠল। ভীষণ চমকালাম,” না তো! লন্ডন কেন?”

” ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম। ও তো লন্ডনের রয়্যাল হলোওয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে..”

” কি?”

মোহনা আন্টি বিস্ময় নিয়ে বললেন,” তুমি জানতে না এইসব?”

আমি বোকার মতো দুই পাশে মাথা নাড়লাম। মোহনা আন্টি হেসে বললেন,” এই ছেলেটাও না! তোমাকে দেখি কিছুই বলেনি। আচ্ছা আমি বলছি শোনো, ঈশানের ছোটবেলা থেকেই আমরা লন্ডন ছিলাম। বাংলাদেশে আসা হয় শুধু ফ্যামিলি ওকেশনে৷ এবার এসেছিলাম নিহার বিয়ে উপলক্ষ্যে। তবে ঈশানের সামনে এক্সাম। সে আসতে চায়নি। তাও এসেছে রিসার্চের জন্য। ও সাইকোলজির স্টুডেন্ট তো! বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়, বিভিন্ন মানুষের সাথে মিশতে হয়, হিউম্যান বিহেভিয়ার সম্পর্কে তারা রিসার্চ করে। আমি এতো বুঝি না। তুমি ঈশানকে জিজ্ঞেস করতে পারো এই সম্পর্কে.. যদি তোমার কৌতুহল হয়।”

আমার চোখের পলক পড়ছে না। মুহূর্তেই পৃথিবীটা অচেনা হয়ে উঠল। কফির সুন্দর ঘ্রাণ বিষাক্ত লাগল। বাগানের খোলা পরিবেশের শুদ্ধ বাতাসেও দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ আমি চুপ রইলাম স্তব্ধের মতো। মোহনা আন্টি বকবক করে যাচ্ছেন। আমার আর কিছুই শুনতে ভালো লাগছে না। একটু পর আমি বললাম,” আন্টি, মায়ের কাছে যেতে হবে। মা বলেছিল বিকাল পাঁচটায় ভাইয়াকে একটা ফোন করতে হবে।”

” পাঁচটা বাজতে এখনও অনেক দেরি। বসো না! মাত্র সাড়ে চারটা বাজে।”

আমি ঘড়ির দিকে চাইলাম। আমতা-আমতা করে বললাম,” এখনি যাই। আমার দাদী খুব অসুস্থ।”

” আচ্ছা যাও। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু ভেবো। কারণ ঈশান লন্ডন চলে গেলে যদি তোমার ভাইয়া ফিরে আসে তখন আবার ঈশানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর ঈশান তখন খুব বিজি হয়ে যাবে। আমি এসব চিন্তা করেই বলছি কি দরকার এতো অপেক্ষার? এই আটদিনেই বিয়ে হয়ে যাক। তারপর তুমি আমাদের সাথে লন্ডন চলো। আমি কি তোমার মার সাথে এই বিষয়ে কথা বলব?”

” না আন্টি। আমি পরে আপনার সাথে কথা বলব।”

এইটুকু বলেই আমি দ্রুত প্রস্থান করলাম। নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। ঈশান আমাকে মিথ্যা বলেছে, এটা আমি মেনে নিতেই পারছি না৷ এতোবড় সত্যি সে কি করে গোপন করল?

আমাদের বাড়ি থেকে যেদিন ঈশান চলে আসবে সেদিন সে ভাইয়াকে বলেছিল কানাডায় স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করেছে! আমার ভার্সিটিতে এসেও একই কথা বলেছিল। বরং আরও বলেছিল আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। কারণ আমি অন্য কাউকে বিয়ে করছি, এই ব্যাপারটি সে মেনে নিতে পারবে না। এই সব কি তাহলে নাটক? সে তো এটাও বলেছিল যে নিহা আর সাফিন ভাইয়ের বিয়ের পর আমাকে নিয়েই কানাডায় চলে যাবে! অথচ মোহনা আন্টি বললেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা, ঈশান লন্ডনের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে! সে সাইকোলজির স্টুডেন্ট। এখানে এসেছে শুধুই রিসার্চের জন্য। আর সে আটদিন পর লন্ডন যাবে। এই কথাগুলো সে আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি কেন? সে যেমন আমার ভাইয়ার সাথে মিথ্যা বলেছে তেমনি আমার সাথেও মিথ্যা বলেছে! অনেক কিছু গোপন রেখে আমার সাথে প্রেম করেছে! আর নিজে থেকে কিছু স্বীকারও করেনি! মোহনা আন্টি না বললে আমি জানতেও পারতাম না।

আমি যখন বাগান থেকে ঘরে ফিরছিলাম, তখন দেখা হলো ঈশানের সঙ্গে। সে অবশ্য আমাকে লক্ষ্য করল না। আমি তাকে সহজেই পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। ঈশান ব্যাডমিন্টন খেলায় আর আড্ডায় রিফাত ভাইদের সাথে খুব ব্যস্ত। আমি চুপচাপ ঘরে ঢুকে পড়েছি। অসহ্য লাগছে, ঈশানের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে৷ কিন্তু তাকে এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে মন চাইছে না। সে নিজে থেকে বলেনি। তাহলে আমি কেন জিজ্ঞেস করব? তবে আমার কিছু ভালোও লাগছে না। এই অনুভূতিটা এতো যন্ত্রণাদায়ক কেন?

আমি ঘরে প্রবেশ করতেই মা বলল,” নিহা তোকে খুঁজছে। তুই নাকি অনেকক্ষণ ধরে ওর সাথে দেখা করিস না?”

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম,” ও কোথায়?”

মা হেসে উঠল। আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম। মা হাসতে হাসতে বলল,” নিহা তার ঘরেই আছে। গিয়ে দ্যাখ।”

আমি মায়ের হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলাম না। এই মুহূর্তে আমার সবকিছু বিষণ্ণ লাগছে। তবে নিহার ঘরের দিকে যাওয়ার পথে আমার মনে পড়ল, দুপুরের শেষ দিকে আমি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলেছিলাম, নিহা আমাকে ডাকছে ব্যাডমিন্টন খেলতে। অথচ এখন নিহা নিশ্চয়ই মাকে বলে দিয়েছে যে আমার সাথে তার সকালের পর আর দেখাই হয়নি! এজন্যই কি মা হাসছিল?

নিহার ঘরে খুব ভীড়। সামিয়া, আনিকা, নীরা, আরও অনেক মেয়েরা হৈ-হুল্লোড় করছে। তারা সম্ভবত গানের কলি খেলছে। আমি কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই চলে যেতে চাইলাম। যাতে আমাকে কেউ না দেখে। ওইখানে বসলে আমার মাথাব্যথা করবে। আর এই মুহূর্তে আমার একা থাকতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আমি ফিরে যেতে নিলেই পেছন থেকে নিহা আমার হাত টেনে ধরল,” ওই স্টুপিড, কোথায় যাচ্ছিস? সারাদিন কোনো খোঁজ-খবর নেই। ঈশান ভাইকে পেয়ে একদম মহারাণী হয়ে গেছিস? দিন-দুনিয়া ভুলে গেছিস?”

নিহার কথায় সবাই গান থামিয়ে এদিকে তাকাল। আমি কারো কারো চোখে ঈর্ষাও দেখতে পেলাম৷ কাজিনদের মধ্যে যারা ঈশানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো, তারা আমায় সহ্য করছে না। ওই মুহূর্তে তাদের ঈর্ষাটা আমার কাছে খুব বিরক্তিকর লাগল। কারণ আমার মনে হচ্ছে, তারা আমার চেয়ে অনেক ভালো আছে। আর আমিই ঠকে গেছি৷ ঈশান যদি আমাকে ঠকায় তাহলে আমি মুষড়ে পড়ব। সেই ভয়ে প্রতি মুহূর্তে আড়ষ্ট হচ্ছি। এই যন্ত্রণা কেউ বুঝবে না! নিহা বড় বড় দৃষ্টিতে বলল,” ভেতরে চল। আজরাতে তুই আমার সাথে থাকবি।”

আমি একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,” তুই সাফিন ভাইকে ছেড়ে আমার সাথে থাকবি?”

” অবশ্যই। আমি কি তোর মতো? যে জামাই পেলেই দুনিয়া ভুলে যাব? তুইও তো আমার আরেকটা দুনিয়া। আমি তোকে সারাদিন মিস করেছি। কিন্তু তুই মনে হয় না আমাকে একটুও মিস করেছিস।”

নিহা অভিমানী দৃষ্টিতে তাকাল। আমি প্রশমিত হেসে বললাম,” আমিও তোকে খুব মিস করেছি নিহু!”

তারপর নিহাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখের টলমল জল নিহার জামার কাঁধে মুছে শান্ত হলাম।

রাত আটটা। নিহাদের সাথে গল্পে মেতে উঠেছি। ঈশানের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ ভুলে থাকার চেষ্টা। সেও আমার কোনো খোঁজ নিচ্ছে না। রুবা আন্টি এসে বলল,” এখানে ভালো স্মুথি বানাতে পারে এমন কে আছে?”

সাথে সাথে নিহা আমার দিকে আঙুল তাক করল,” এইযে আমাদের তারু। এইসব জুস, স্মুথি, শেইক বানাতে ও একদম এক্সপার্ট। ”

আমার মনটা খারাপ। তাই এই মুহূর্তে কিছু বানাতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু রুবা আন্টি বললেন,” আয় না মা, আমাকে একটু দেখিয়ে দে। ইউটিউবের উপর ভরসা নেই। তোরটাই দেখি।”

আমি অনীহা সত্ত্বেও উঠে গেলাম৷ তাও ভালো! কাজের মধ্যে থাকলে মন খারাপ ভাবটা ভুলে থাকা যাবে। ঈশান আমার খোঁজ কেন নিচ্ছে না? আমার মস্তিষ্ক না চাইলেও মন খুব করে ঈশানকে দেখতে চাইছে। মন এতো বেহায়া কেন হয়? ইশ! স্মুথি বানানো শেষ হওয়ার পর রুবা আন্টি সাত-আটটা গ্লাস একটা ট্রে-তে নিয়ে আমাকে বললেন,” এগুলো সোজা দক্ষিণ দিকের ঘরে দিয়ে এসো। তারপর তোমার কাজ শেষ। ”

আমি মাথা নেড়ে ট্রে সাবধানে নিয়ে গেলাম৷ কিন্তু ঘরে ঢুকতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। কারণ ঈশান সেখানেই আছে। আমার মেজাজ খারাপ হলো। বিকালের পর তো সে আর একবারও আমার কাছে আসেনি। আর এখন আমি নিজেই তার কাছে উপস্থিত হলাম! ছেলেরা গোল হয়ে বসে কার্ড খেলছে। আমি ভেতরে ঢুকেও বেরিয়ে এলাম। দূরে বিসমিকে দেখেই তাকে ডেকে বললাম,” শোনো না, বিসমি।”

বিসমি উল্লাসিত স্বরে বলে উঠল, “আরে ভাবীজি, বলো, বলো!”

আমি তার ডাক শুনে ভ্যাবাচেকা খেলাম। স্মিত হেসে বললাম,” এটা নিয়ে যাও। ভেতরে ভাইয়াদেরকে দিয়ে আসো। এজন্যই ডেকেছি।”

” ওকে।”

বিসমি আমার হাত থেকে ট্রে নিয়ে ভেতরে গেল। আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম। হঠাৎই মনে হলো, বিসমিও নিশ্চয়ই ঈশানদের সঙ্গে লন্ডন থাকে। যেহেতু সে মোহনা আন্টির ব্যক্তিগত সহযোগী! এ কারণেই মেয়েটির চাল-চলন এতো স্মার্ট! তাকে প্রথম দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। সাফিন ভাই চিৎকার করে বলল,” ঈশাইন্না, তুই আমাকে সাতবার হারিয়েছিস। এখন আমার টার্ন। দ্যাখ কি হয়! লাগা বাজি।”

ছেলেরা সবাই চেঁচামেচি করছে। আমি চলে আসতে নিলে দরজার সাথে ধাক্কা খেলাম আর ঈশানের নজর আমার উপর পড়ে গেল। সে উৎফুল্ল হয়ে বলল,” হায়।”

আমি শুনেও না শোনার ভাণ করে চলে এলাম। তখন সাফিন ভাইয়ের চিৎকার ভেসে এলো,” খবরদার ঈশান যাবি না। এখন আমার জেতার সময় আর তুই ভাগছিস কেন?”

আমি বুঝলাম ঈশান আমার পেছনে আসছে। আমি দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। কিন্তু তার সঙ্গে কি আর পারা যায়? ঠিকই বাতাসের গতিতে এসে আমার হাত ধরে ফেলল,” এই দাঁড়াও, এতো দ্রুত কোথায় যাচ্ছ? ট্রেইন ছুটছে নাকি?”

আমি জরুরী গলায় বললাম,” আমাকে কেউ ডাকছে।”

ঈশান চোখ ছোট করে বলল,” কই? আমি তো শুনতে পাচ্ছি না! এদিকে এসো। সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি?”

আমি ঈশানের সাথে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলাম,” একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

” করো।”

” আপনি কি আমার সাথে কখনও কোনো মিথ্যা বলেছেন?”

ঈশান একটু চমকাল। তারপর ভাবতে লাগল। অবশেষে ঠোঁট উল্টে বলল,” কই, না তো!”

আমি চোয়াল শক্ত করলাম,” ভেবে দেখুন। হয়তো আপনার মনে পড়ছে না।”

ঈশান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” কি জানি? আমার মনে হয় না বলেছি। কেন? হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

আমি শক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললাম,” আমার কাজ আছে, আমি যাই।”

ঈশান আমার হাত হেচকা টান মেরে বলল,” এই দাঁড়াও! এতো কিসের জরুরী কাজ, হুম? তুমি কি আমার চেয়েও বেশি ব্যস্ত?”

আমার মেজাজটা হুট করে তখন কেন যে এতো চড়ে গেল! আমি কাটা কাটা কণ্ঠে বললাম,” বার বার আমাকে টাচ করবেন না। অসহ্য লাগে।”

ঈশান স্তম্ভিত হলো। আমি তাকে ওই অবস্থায় রেখেই নিহার ঘরে চলে এলাম৷ তারপরেই শুরু হলো মোবাইলে একের পর এক মেসেজ আসা। ঈশান মেসেজ দিচ্ছে।

” তারিন, কি হয়েছে তোমার?”

” এতো অদ্ভুত আচরণ কেন করলে?”

” তোমার কি মনখারাপ?”

” এই ওয়েট, তোমার ভাইয়া কিছু বলেনি তো? আমার সাথে প্রবলেম শেয়ার না করলে বুঝব কিভাবে?”

আমি কোনো রিপ্লে করছি না। শুধু মেসেজ সিন করে রেখে দিচ্ছি। ঈশান একটু পর লিখল,” তারিন তুমি এখনি একবার ছাদে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।”

আমি এবার লিখলাম,” আমি আপনার হুকুমের গোলাম না যে যখন যেটা বলবেন সেটাই করব।”

” ও তাই? হুকুমের গোলাম না হলেও তুমি আমার ব্যক্তিগত মিষ্টি গোলাপ। এবার আসো।”

” এসব বলে কোনো লাভ নেই। আমি আসছি না।”

” যদি আমার পাগলামি দেখতে না চাও, তাহলে আসো তারিন৷ আমি কিন্তু ওয়ার্নিং দিচ্ছি।”

” আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন। আমি কোনোভাবেই আসব না।”

” ওকে, ওয়েল!”

তারপর যেটা কল্পনাও কর‍তে পারিনি সেটাই হলো। ঈশান ফট করে নিহার বেডরুমে চলে এলো। তাকে দেখে সব মেয়েরা সলজ্জ হাসল। কেউ কেউ ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করল। নিহা প্রশ্ন করল,” আপনার এখানে কি?”

ঈশান কারো কোনো কথায় তোয়াক্কা না করে সরাসরি আমার কাছে এসে বলল,” তারিন, চলো।”

আমি গাঁট হয়ে বসলাম। তার দিকে তাকালামও না। ইচ্ছে করে নীরার কাঁধে হাত রেখে অন্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করলাম। যাকে বলে রূঢ় অবহেলা। নীরা আমার কথা না শুনে অবাক চোখে ঈশানের দিকে চেয়ে আছে। শুধু নীরা নয়, সবাই। আমিই নির্বিকার। ঈশান এবার সবার বিস্ময়কে স্তব্ধতায় বদলে দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিল। আমি হতভম্ব। মুখ দিয়ে চিৎকার আসতে নিয়েও গলায় আটকে গেল। রেহেনার হাত থেকে পপকর্ণের বাটি পড়ে গেল। সবাই যখন স্তম্ভিত তখন নিহা হাত তালি বাজিয়ে বলে উঠল,” দারুণ৷ দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে য়ায়ে…”

তার কথায় অনেকেই সায় দিল চেঁচিয়ে। আর বাকিরা তখনও হা করে আছে। আমার পায়ের পাতা কাঁপছে ভীষণভাবে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছি একদম। মনে-প্রাণে চাইছি, কোনো মুরব্বির সাথে যেন দেখা না হয়। মা, বুড়ি অথবা রুবা আন্টি কিংবা নিহার বাবা, চাচা কেউ দেখলে কি মনে করবে? ঈশান অবশ্য আমাকে নিরিবিলি জায়গা দিয়েই নিয়ে যাচ্ছিল। আশেপাশে কেউ ছিল না। আমার মুখ-চোখ ভয়ংকর লাল। ঈশান আমাকে একেবারে ছাদে নিয়ে কোল থেকে নিচে নামাল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here