#তি_আমো,৩৬,৩৭
পর্ব ৩৬
লিখা- Sidratul Muntaz
” আমরা কোথায় নামব?”
নিহা বলল, ” শাহজালাল উপশহরে৷ বাস থেকে নেমে আমরা মাইক্রো দিয়ে যাওয়ার সময় কিন্তু মালীনছড়া চা বাগান উপভোগ করব। সবাই চাইলে নেমে সেলফিও তুলতে পারি। তারপরে আমরা সরাসরি চলে যাবো সাফিনের বাংলো বাড়িতে।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম,” বাংলো বাড়ি নাকি?”
” হ্যাঁ। অনেক সুন্দর! ”
আমি আঁড়চোখে নিহাকে দেখে নিয়ে সন্দেহী কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম,” তুই জানলি কি করে? আন্টি-আঙ্কেলকে না জানিয়ে সাফিন ভাইয়ের সাথে গোপনে সিলেট এসেছিলি নাকি?”
নিহা রেগে আমার পিঠে জোরে-সোরে একটা ঘুষি মেরে বলল,” তোর কি করে মনে হলো যে তোকে না জানিয়ে আমি এতোবড় কান্ড করব? কখনোই না! ভিডিওকলে দেখেছিলাম। গত ঈদে যখন সাফিন বাড়ি এলো!”
” আচ্ছা, সাফিন ভাইয়ের তো সিলেটে কেউ নেই। উনি কার সাথে ঈদ করার জন্যে সিলেট আসেন?”
” সিলেটে সাফিনের চাচা-চাচী আছে তো। ওদের কাছেই আসে। ওরাই বাংলোটার দেখা-শুনা করে।”
” ও।”
নিহা একটু পর বলল,” জানিস, উপশহরে কিন্তু তোর শাশুড়ীর বাপের বাড়িও আছে।”
আমি চোখ কুচকে উচ্চারণ করলাম,” আমার শাশুড়ীর বাপের বাড়ি?”
” মানে মোহনা আন্টি। তার বাবা কিন্তু বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। অনেক পয়সাওয়ালা। আর ঈমান আঙ্কেল ছিলেন মোহনা আন্টির বাবার বিজনেস পার্টনার। মোহনা আন্টির লাইফে একটা ট্রাজেডি ঘটেছিল। তারপর মোহনা আন্টি সবাইকে ছেড়ে ফ্যামিলির উপর অভিমান করেই কাজিন এবং বাবার বিজনেস পার্টনার ঈমান আঙ্কেলকে বিয়ে করে ফেলেন। আর লন্ডনে চলে যান। মোহনা আন্টির বাবাও উপশহরের বাড়ি বিক্রি করে ঢাকায় সেটেল হয়ে গেলেন। কিন্তু ওই বাড়ির সাথে আমাদের অনেক মেমোরিজ আছে। তাই আমরা সিলেট এলেই ওই বাড়িতে একবার না একবার যাই। ওইটা আমাদের কাছে একটা গেস্ট হাউজের মতো। ”
আমি আগ্রহবোধ করে বললাম,” এবারও কি আমরা সেই গেস্ট হাউজে ঘুরতে যাবো?”
” তুই চাইলে নিশ্চয়ই যাব! ঈশান ভাইকে বলিস।”
আমার খুব আনন্দ লাগছে। আমার জীবনের প্রথম সিলেট ভ্রমণ বুঝি খুব রোমাঞ্চকর হতে চলেছে! হঠাৎ একটা বিষয় মনে পড়ায় আমি নিহার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালাম। নিহা ভ্রু কুচকে বলল,” কিছু বলবি?”
” আচ্ছা, তুই না আমাকে বলেছিলি মোহনা আন্টি আর ঈমান আঙ্কেলের লাভ ম্যারেজ? তারা নাকি একজন-অন্যজনকে অনেক ভালোবাসে! তাদের বিয়েটাও নাকি স্বপ্নের মতো! অথচ এখন দেখি বলছিস অন্য কথা। মোহনা আন্টি পরিবারের উপর অভিমান করে বিয়ে করেছে।”
নিহা জীভ কাটল। তারপর হেসে ফেলল। আমি খুব রেগে তাকিয়ে রইলাম৷ আঙুল উঁচু করে বললাম,” দ্যাখ, হাসবি না। মিথ্যা কেন বলেছিলি?”
নিহা আমার কাঁধে মালিশ করতে করতে বলল,” তোকে আমি কখনও মিথ্যা বলি না তারু। কিন্তু সেদিন আমি প্রথম জানতে পারলাম তোর সাথে ঈশান ভাইয়ের সম্পর্ক চলছে। অর্থাৎ তিনি তোর বয়ফ্রেন্ড। এই অবস্থায় তার পারসোনাল লাইফের ট্রাজেডি নিয়ে আমি তোকে কিছু বলতে চাইনি। আসলে বিয়ের পর মোহনা আন্টি আর ঈমান আঙ্কেল কখনোই একে-অন্যের সাথে মিশতে পারেননি। তাদের মধ্যে একফোঁটা বনি-বনা ছিল না। এই নিয়ে ঈশান ভাই সবসময় ডিপ্রেসড থাকতো৷ এখন তোকে যদি উনি এইসব নিজে থেকে না বলে আর আমি আগ বাড়িয়ে বলে দেই তাহলে ব্যাপারটা কেমন লাগে না? সেজন্য বলিনি আর কি!”
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,”তুই একটা গাঁধী নিহা। কাজটা একদম ঠিক করিসনি। কারণ তোর এই কথার জন্যই ঈশানের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল।”
নিহা চোখ বড় বড় করে চাইল,” বলিস কি?”
তারপর কপালে হাত রেখে অপরাধী স্বরে বলল,” তোদের যেন কখনও ঝগড়া না হয়, সেজন্যই আমি কিছু বলিনি। তুই যদি আমার থেকে শুনে ঈশান ভাইকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে যেতি তাহলে ঈশান ভাই রেগে যেতো। এই ভেবেই আমি মিথ্যা বলেছিলাম। কিন্তু কিভাবে বুঝব যে তুই ঈশান ভাইয়ের থেকেই সব জেনে গেছিস? স্যরি রে!”
আমি হেসে নিহাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,” আচ্ছা, ইটস ওকে। ”
বাস খুব জোরে ব্রেক কষল। ড্রাইভার জানাল, বাসে সমস্যা হয়ে গেছে। আর আগানো সম্ভব নয়। সবার মুখে প্রবেশ করল দুশ্চিন্তার ছাপ। অতঃপর আমরা বাক্স-পেটরা গুছিয়ে নেমে পড়লাম মাইক্রোবাসের খোঁজে। সেই মাইক্রো থেকে সরাসরি সাফিন ভাইয়ের বাংলোতে। সবাই অনেক ক্লান্ত ছিলাম তাই মাঝে অনেক সুন্দর জায়গা পেলেও নামতে ইচ্ছে করল না। ঘরে গিয়ে আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়ল। যারা জেগে ছিলাম, তারা একসাথে লাঞ্চ করলাম। নিহা আমাদের পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল। আমি, নীরা, নিহা আর রেহেনা, আমাদের চারজনের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধন তৈরী হয়ে গেছে। সামিয়া আর আনিকা একটু কেমন যেন! তারা সবসময় তাদের মতো থাকে।
নিহা আমাদের জিজ্ঞেস করল, কফি খাব কি-না! আমরা সবাই আগ্রহ দেখালাম। নিহা আমাদের নিয়ে রান্নাঘরে এলো। সাফিন ভাইয়ের চাচী রান্না করছেন। এই বাসায় আসার পর সর্বপ্রথম চাচীর সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে। বেশ ভালো মহিলা। একদম নরম স্বভাবের। সাফিন ভাইয়ের চাচা নাকি আমাদের আরও বাজার করতে গেছেন। এতো মানুষ যে দল বেঁধে চলে আসব এটা তারা বুঝতে পারেনি। চাচা এখনও বাজারে আছেন৷ তিনি নাকি খুব বেছে বেছে বাজার করেন। চাচা-চাচীর ছেলে-মেয়েরা থাকে বিদেশে। তারা চাচা-চাচীর তেমন খোঁজও নেয় না। চাইলেই পারে তাদের বিদেশের বিরাট বাড়িতে বাবা-মাকে নিয়ে রাখতে। কারণ তাদের টাকার অভাব নেই। তবুও নেবে না। শুধু মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাবে আর মাঝে মাঝে ফোন করে একটু খোঁজ নিবে। এতেই দায়িত্ব শেষ। চাচা-চাচী অবশ্য নিজের ছেলে-মেয়েদের থেকে সাফিন ভাইকেই বেশি ভালোবাসেন। সাফিন ভাইয়ের বাবা-মা নেই। আর চাচা-চাচীর ছেলে-মেয়ে থেকেও নেই। এজন্য সাফিন ভাই তাদের চোখের মণি। নিহা আমাদের সাথে কফি খেতে খেতে এইসব গল্প করছিল। নীরা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,” আচ্ছা রিসেপশনে কি প্ল্যান? ”
নিহা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” আমরা ঠিক করেছি খোলা জায়গায় অনুষ্ঠান হবে। স্টেজ আমরা নিজেরাই সাজাবো। গানের জন্য ব্যান্ড ভাড়া করব।”
রেহেনা হাত তালি বাজিয়ে বলল,” অনেক এক্সাইটিং লাগছে! দারুণ মজা হবে এবার।”
আমাদের গল্প চলতেই থাকল। এক পর্যায় আমরা এখান থেকে ফিরে গিয়ে কি করব সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু করলাম। মোহনা আন্টির নাকি সামনের মাসে জন্মদিন। প্রত্যেক বছর তিনি নিজের জন্মদিনে সবাইকে গিফট দেন। এটা তাঁর বিশেষত্ব। সাধারণত আমরা কি জানি? যার জন্মদিন সে উপহার পায়। কিন্তু মোহনা আন্টি অন্যরকম। তিনি কারো থেকে উপহার নেবেন না। বরং নিজেই সবাইকে উপহার দিবেন। আর প্রত্যেকবার জন্মদিনের সময় তিনি লন্ডনে থাকেন। লন্ডন থেকেই সবার জন্য অনেক কিছু পাঠান। কে, কি চাইছে তার একটা লিস্ট তৈরী করে তিনি কেনা-কাটা শুরু করেন। কিন্তু এবার তো মোহনা আন্টি লন্ডনে যাচ্ছেন না। যেহেতু আমার আর ঈশানের বিয়ে তাই লন্ডন যাওয়া পেছানো হবে। আর ঈমান আঙ্কেলের সঙ্গেও ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাই ঈমান আঙ্কেল যেহেতু লন্ডনে আছেন, মোহনা আন্টি সেখানে না গিয়ে বাংলাদেশেও থেকে যেতে পারেন। সেই সম্ভাবনাও আছে। এসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। নিহা ঠিক করল সে এবার মোহনা আন্টির জন্মদিনে সিলেট থেকে ঢাকা চলে আসবে। তারপর একটা বড়-সড় পার্টির আয়োজন করে মোহনা আন্টিকে চমকে দিবে! নিহার এই বুদ্ধি সবার পছন্দ হলো। কথায় কথায় নীরা বলল, এইটা নাকি মোহনা আন্টির পঁয়ত্রিশতম জন্মদিন। যেটা তারা খুব স্মরণীয় করে রাখতে চায়। এই কথা শুনে আমার মুখ থেকে কফি পড়ে গেল। আমি কাশতে লাগলাম।
সবাই আমার দিকে চমকে তাকাল। নিহা বলল,” তোর আবার কি হয়েছে?”
আমি নাকে-মুখে প্রশ্ন করলাম,” মোহনা আন্টির বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ নাকি? এটা কিভাবে সম্ভব? তাহলে ঈশানের বয়স কত?”
আমার এই প্রশ্নে সবার চেহারায় একটা মেদুর ছায়া পড়ল। রেহেনা আমতা-আমতা করে বলল,” ঈশান ভাইয়ের বয়স পঁচিশ।”
আমি চোখ বড় করে চেয়ে থেকে বললাম,” মোহনা আন্টির কি তাহলে দশ বছরে বিয়ে হয়েছিল? কিন্তু আমি শুনেছিলাম উনি যখন বিয়ে করেছেন তখন উনার বয়স ছিল বিশ!”
আমার এই অবুঝ মনের সহজ প্রশ্নের উত্তরটা কেউই দিল না। তবে আমি শুধু এইটকু বুঝলাম এইখানে খুব বড় একটা ‘কিন্তু’ আছে। নিহা আমাকে চোখের ইশারায় বলল, পরে সব বোঝাবে। আমিও আর প্রশ্ন করলাম না। তবে এই বিষয়টা আমার মাথার মধ্যেই গেঁথে রইল৷ সারাদিন আমি চিন্তা করতে লাগলাম। নিহার সাথে আমার আলাদা করে আর কথা হলো না৷ তাই আসল ব্যাপার জানার সুযোগও হলো না। সন্ধ্যায় ঈশানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ঈশান কোন ঘরে আছে, কিভাবে থাকছে তা দেখতে আমি তার ঘরে যেতে চাইলাম৷ সে আমাকে একটা ছোট্ট, আঁটসাঁট ঘরে নিয়ে এলো। আমি অবাক হয়ে বললাম,” এতো ছোট ঘরে আপনি থাকবেন? মনে হচ্ছে পুরো বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘর এটা।”
ঈশান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” কি আর করার? আমরা এতো মানুষ, সবার জন্য তো আর আলাদা আলাদা ঘর রাখা সম্ভব নয়। আর আমি সাফিনকে বলেছিলাম আমার একা ঘরই লাগবে। তাই আমাকে এখানে পাঠানো হলো।”
আমি হাত ভাজ করে জানতে চাইলাম,” একা ঘরই কেন লাগবে?”
ঈশান বিছানায় বসতে বসতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” কারো সাথে বেড শেয়ার করতে পারি না। অস্বস্তি হয়। ঘুমই আসে না।”
ঈশানের পাশে বসলাম৷ গালে হাত রেখে দুষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,” বিয়ের পর কি করবেন?”
ঈশান আমার থেকেও দুষ্ট কণ্ঠে বলল,” বিয়ের পর তো ঘুমাবোই না!”
আমার মুখে রক্ত জমে লাল হয়ে গেল। অন্যদিকে চেয়ে বললাম,” আপনার ঘরটা সুন্দর। ”
ঈশান আমার কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে নিয়ে বলল,” আমার বউটা আরও সুন্দর। ”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে লজ্জা মেশানো কণ্ঠে বললাম,” ধূর।”
পেছনে ঈশান হেসে উঠল ভারী শব্দে৷ আমার বিকালের ঘটনাটা আবার মনে পড়ল। ঈশানের পাশে বসে একটু সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” একটা সত্যি কথা বলবেন?”
ঈশান সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনে হাতজোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,” তোমার সঙ্গে আর জীবনেও মিথ্যা বলার দুঃসাহস করব না। প্রমিস!”
আমি হেসে ফেললাম। অতি স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ” মোহনা আন্টি আপনার সৎ মা হোন। তাই না?”
কথাটা কেমন যেন বজ্রপাতের মতো আঘাত করল ঈশানের চেহারায়। আমি নিজেও কিছুটা স্তম্ভিত হলাম৷ এভাবে জিজ্ঞেস করা উচিৎ হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে ঈশানের মুখের হাসি মুছে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। আমি নরম গলায় বললাম,” স্যরি.. আসলে আমি নিহাদের থেকে শুনেছিলাম..”
ঈশান আমার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষাই করল না। সে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। একা বসে রইলাম এভাবেই। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে গেল, আমি তখনও এটা বুঝতে পারছি না যে কি করা উচিৎ এবার! তবে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। সেদিন বিকালে যখন মোহনা আন্টি, আমি আর ঈশান বাগানে বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম তখনও মোহনা আন্টির একটা কথায় রাগ করে ঈশান এভাবেই উঠে চলে গেছিল। আজ আমার মনে হচ্ছে কথাটি এই প্রসঙ্গেই ছিল। আমি তখন ভেবেছিলাম ঈশান হয়তো কোনো কাজে গেছে। কিন্তু এখন বুঝছি সে তখন রাগ করে উঠে গেছিল।
সন্ধ্যায় আমি সারা বাড়ি খুঁজলাম ঈশানকে। কিন্তু সে কোথাও নেই। কেউই তার হদিশ আমাকে দিতে পারল না। রুবা আন্টি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বললেন,” নতুন জায়গায় এসেছে তো, তাই হয়তো ঘুরতে গেছে। চিন্তার কিছু নেই। এসে যাবে। তুমি একটা ফোন করে দেখো! ফোন করেছ?”
আমি ইতস্তত হয়ে বললাম,” না।”
” তাহলে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে নাও।”
আমি আর বলতে পারলাম না যে ঈশানকে ফোন করার সাহস আমার হচ্ছে না। সে যেভাবে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, তাতে মনে হচ্ছে ফোনও ধরবে না।
চলবে
#তি_আমো
পর্ব ৩৭
লিখা- Sidratul Muntaz
নিহা কাজে-কর্মে খুব ব্যস্ত। আমার দিকে তাকানোর সময়ই হচ্ছে না। আগামীকাল সন্ধ্যায় তাদের রিসেপশন মানে বৌভাতের অনুষ্ঠান। সেই পরিকল্পনা চলছে। সাফিন ভাইয়ের সাথে কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি করে সে ড্রয়িংরুমে এসে বসল। সাফিন ভাই বৌভাতে লুঙ্গী আর পাঞ্জাবী পরতে চাইছেন। কিন্তু নিহা তাঁর জন্য ঢাকা থেকে দামী স্যুট এনেছে। সেই স্যুট সাফিন ভাইকে দেখানো মাত্রই তিনি মুখ বাঁকা করে নিষেধ করে দিলেন৷ এটা নিয়েই নিহা রেগে আছে৷ আমি নিহার পাশে বসে বললাম,” এগুলো কোনো কথা নয়, নিহা। সাফিন ভাই যেভাবে কমফোর্টেবল সেটাই পরুক।”
নিহা বিস্ফোরিত চোখে বলল,” লুঙ্গী পরলে তাকে জোকারের মতো লাগবে।”
” কখনোই লাগবে না। তিনি যেটাই পরবেন সেটাতেই হৃত্তিক রোশানের মতো লাগবে। তিনি খুব হ্যান্ডসাম আছেন।”
” তোর এই পামগুলো তুই সাফিনের কাছে গিয়ে মার।”
” পাম মারছি না, সত্যি বলছি। আচ্ছা শোন, যদি তিনি হাসিমুখে লুঙ্গী পরে তাহলে দেখতে সুন্দর লাগবে নাকি মনখারাপ করে স্যুট পরে একটু পর পর ঘাম মুছলে তখন দেখতে সুন্দর লাগবে?”
আমার কথায় নিহা একটু বিভ্রান্ত হলো,” তুই কি বলতে চাস? ক্লিয়ার কর।”
” মানে সাফিন ভাই যেটায় কমফোর্টেবল তাকে সেটাই পরতে দেওয়া উচিৎ। উনার নিজের বিয়ের রিসিপশন। উনিই যদি খুশি না থাকে তাহলে আমাদের আনন্দ দিয়ে হবে কি? তুই তো তোর যেটা ইচ্ছা সেটাই পরবি। এখন তোকে যদি লেহেঙ্গা ছেড়ে এঞ্জোলিনা জোলির মতো ওয়েস্টার্ন পরতে বলি তোর কি ভালো লাগবে?”
নিহা মুখ কুচকে বলল,” না, না একদম ভালো লাগবে না। ছিঃ! আমার জন্য লেহেঙ্গাই বেস্ট।”
” হ্যাঁ আমিও সেটাই বলছি। আর লুঙ্গী তো খারাপ কিছু না। আমাদের ঐতিহ্য।”
নিহা আমার নাক টেনে বলল,” ওরে আমি ঐতিহ্য রক্ষাকারী!”
নিহা খিলখিল করে হাসল। আমি হাসলাম না। কারণ ঈশানের দুশ্চিন্তায় আমার কিছুই ভালো লাগছে না। নিহা ঠিক বুঝে ফেলল৷ আমার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করল,” তোর কি হয়েছে বলতো? সব কথা কেমন গম্ভীর হয়ে বলছিস! মন-টন খারাপ নাকি?”
আমি ধীরগতিতে মাথা নাড়লাম৷ নিহা বিচলিত হয়ে উঠল,” কি হয়েছে আবার?”
আমি ঈশানের ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বললাম৷ নিহা মুখে হাত রেখে বলল,” ওহ শিট, তুই আবার ঈশান ভাইকে জিজ্ঞেস করতে গেলি কেন? আমি না তোকে বলেছি এই বিষয়ে পরে বুঝিয়ে বলব?”
আমি অসহায়ের মতো বললাম,” ভুল হয়ে গেছে। আমি তো বুঝিনি যে বিষয়টা এতো সেন্সিটিভ। ঈশান এমন রিয়েক্ট কেন করল?”
” জানি না। হয়তো কষ্ট পেয়েছে। ঈশান ভাইয়ের জন্মের সময়ই তার মা মারা গিয়েছিল। ঈমান আঙ্কেলকে আমি মামা ডাকি না কেন জানিস? কারণ উনাকে আমার মামার মতো আপন মনেই হয় না! উনি খুব উদাসীন ধরণের আর একটু স্বার্থপর। ঈশান ভাইয়ের মা কিন্তু ঈমান আঙ্কেলের বউ ছিল না৷ গার্লফ্রেন্ড ছিল। তারা ভেবেছিল বাচ্চা হওয়ার পর বিয়ে করবে। কিন্তু ঈশান ভাইকে জন্ম দিতে গিয়েই তিনি মারা গেলেন। তারপর ঈমান আঙ্কেল কাউকে উনার বাচ্চার কথা জানাননি। উনি ঈশান ভাইকে একটা গভর্নেস দিয়ে লালন-পালন করাতেন লন্ডনে। তিনি থাকতেন এক বাড়িতে আর ঈশান ভাই গভর্নেসের সঙ্গে থাকতো অন্য বাড়িতে। মাঝে মাঝে তিনি শুধু খোঁজ নিতে যেতেন। আর চেয়েছিলেন যদি কোনো ভালো দম্পতি পেয়ে যান, তাহলে ঈশান ভাইকে দত্তক দিয়ে দেবেন।”
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। নিহা আমার অভিব্যক্তি দেখে একটু থামল। আমি হত বিস্মিত সুরে বললাম,” বাবাও এমন হয়?”
” হয়। উনি তো ঈশান ভাইকে চাননি। লন্ডনে তিনি তখন ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। অঢেল সম্পত্তির মালিক। ছেলে থাকলে তো এইসবের ভাগ ছেলেকেও দিতে হবে। মেয়ে-টেয়ে নিয়ে ফূর্তি করবেন কি করে?”
আমি আশ্চর্য হয়ে তাকালাম। নিহা সহজ হেসে বলল,” নিজের মামা সম্পর্কে এসব বলছি কিন্তু উনি মানুষটা এমনই। তারপর কি হলো শোন, বাংলাদেশে ঈমান আঙ্কেল প্রায়ই আসতেন। আমাদের জন্য অনেক শপিং-টপিং করতেন। মায়েরা উনাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগল। তখন তো আর কেউ জানতো না যে উনার অলরেডি দশবছরের একটা ছেলে লন্ডনে আছে গভর্নেসের কাছে!”
আমি করুণ স্বরে বললাম,” মা-বাবা ছাড়া একটা বাচ্চা পুরো দশবছর গভর্নেসের কাছে বড় হলো? কি অদ্ভুত! ”
আমার মনটা ভার হয়ে গেল। নিহা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,” এটা স্বাভাবিক। আরও কত বাচ্চারা এমন অবহেলায় বড় হয়! ঈশান ভাইয়ের তো মা ছিল না। আর বাবা থেকেও ছিল না। তারপর শোন, দেশে আসার পর ঈমান আঙ্কেলের মোহনা আন্টিকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। মোহনা আন্টি কিন্তু প্রচন্ড সুন্দরী ছিলেন। এখনও তিনি সুন্দরী, তাহলে বোঝ তরুণী বয়সে আরও কত সুন্দরী ছিলেন! ঈমান আঙ্কেল তো তার রূপে মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ঈমান আঙ্কেল স্বার্থবাজ হলেও সৎ মানুষ ছিলেন। তিনি বিয়ের আগে মোহনা আন্টিকে বলেছিলেন তার একটা ছেলে আছে। বিয়ের পর শুধু বউ হলে চলবে না, সেই ছেলেকে দেখা-শুনার দায়িত্বও নিতে হবে। মোহনা আন্টি ঈশান ভাইয়ের ছবি দেখে বাচ্চাটির মায়ায় পড়ে গেলেন। তখন তিনি কথা দিলেন ঈশান ভাইয়ের দেখা-শুনা তিনি মায়ের মতোই করবেন। কিন্তু ঈমান আঙ্কেলের বউ তিনি কখনোই হবেন না। কারণ তিনি অন্য আরেকজনকে ভালোবাসেন।”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,” বাহ, বিয়ে নিয়ে বেশ ভালো সওদা তো!”
” হ্যাঁ। ঈমান আঙ্কেল ভেবেছিলেন মোহনা আন্টি হয়তো মজা করেছেন। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কতদিন আর বউ হয়ে তিনি স্বামীর থেকে আলাদা থাকবেন? কিন্তু মোহনা আন্টি বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। বিয়ের পর পনেরো বছর ধরে আজ পর্যন্ত একবারের জন্যেও তিনি ঈমান আঙ্কেলের বউয়ের দায়িত্ব পালন করেননি।”
আমি চোখ বড় করে উচ্চারণ করলাম,” সিরিয়াসলি? এমনও হয়?”
” হয়েছে। এমনটাই হয়েছে। আর ঈমান আঙ্কেল তো ছিলেনই ক্যারেক্টরলেস। তার বউয়ের কি দরকার? গার্লফ্রেন্ড নিয়ে মস্তি করতে পারলেই হলো! বউও কিছু বলে না। আবার একমাত্র ছেলের দেখা-শুনার জন্যেও বিনা পয়সার কাজের লোক পেয়ে গেছেন। তার আর কি চাই? এভাবেই চলছিল তাদের সংসারটা। কিন্তু মোহনা আন্টি শেষমেষ আর টিকে থাকতে পারলেন না। ডিভোর্স দিলেন ঈমান আঙ্কেলকে। তিনি শুধু ঈশান ভাইয়ের বড় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এখন তো ঈশান ভাই ম্যাচিউর। তাই সে বাবা-মায়ের ডিভোর্স মানতে পেরেছে। আগে হলে কখনোই মানতো না। ঈশান ভাইয়ের আসল ভয়টা কি ছিল জানিস?”
” কি?”
” মোহনা আন্টি তো তার আসল মা নয়৷ কিন্তু তার বাবার বউ। এখন বাবার সাথেই যদি বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাহলে হয়তো মোহনা আন্টি ঈশান ভাইকে ছেড়েও চলে যাবেন। কিন্তু ঈশান ভাইয়ের তো এই দুনিয়ায় সবচেয়ে আপন বলতে কেবল মোহনা আন্টি আছেন। তাই তিনি এই ব্যাপারটা নিয়ে এতো সিরিয়াস ছিলেন। এবার বুঝতে পেরেছিস?”
নিহা তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিনমিন করে বলল,” একটা অসুস্থ সম্পর্ককে জোর করে আমরা আর কয়দিনই বা বেঁধে রাখতে পারি? মোহনা আন্টি ঈমান আঙ্কেলের থেকে ডিভোর্স নিয়ে ভালোই করেছেন। কারণ কেউই সুখী ছিল না।”
আমারও দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আমি নিহার দিকে চেয়ে বললাম, “ঘটনাটা আসলেই খুব দুঃখজনক। ঈশানের মনখারাপ করা জায়েজ আছে।”
” তাহলে এখন তুই ঈশান ভাই কই আছে খুঁজে বের কর। তারপর স্যরি বল। সবসময় শুধু ছেলেরাই স্যরি বলবে আর মেয়েরা বলতে পারবে না এমন নিয়ম কিন্তু নেই।”
আমি হেসে দিয়ে বললাম,” অন্যায় করে থাকলে নিশ্চয়ই স্যরি বলব। মিথ্যা অহংকার নিয়ে বসে থাকার মতো মেয়ে আমি না।”
আমি সব দ্বিধা পায়ে ঠেলে ঈশানকে ফোন করলাম। বিশ্বাস ছিল সে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। দুইবার রিং হতেই ঈশান ফোন রিসিভ করল। ওই পাশ থেকে তার ভরাট কণ্ঠ শোনা গেল,” হ্যালো।”
আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। নিচু কণ্ঠে বললাম,” হ্যালো, আমি তারিন বলছি।”
ঈশান অতি ঠান্ডা স্বরে বলল,” তোমার নাম্বার আমার ফোনে সেইভ আছে। পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিছু বলার থাকলে বলো।”
তার এমন স্ট্রেইট ফরয়ার্ড কথা শুনে আমি একটু ভড়কেই গেলাম৷ কণ্ঠে আটকে গেল শব্দগুচ্ছ। কথাই আসছিল না মুখ দিয়ে। ইতি উতি করে বললাম,” আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
ঈশান আগের মতোই ঠান্ডা স্বরে জবাব দিল,” বাড়ির পেছনের মাঠে একটা তেতুলগাছ আছে। আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে আছি।”
” আপনার ভয় করছে না?”
ঈশান দায়সারা কণ্ঠে ” না” বলেই ফোন রেখে দিল।
আমি ছুটে গেলাম। তবে যাওয়ার আগে চুল ঠিক করলাম। চোখে কাজল দিলাম। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগালাম৷ একসময় ভেবেছিলাম ঈশানের সামনে আমি কোনোদিনই সেজে যেতে পারবো না৷ ভয়ংকর লজ্জা হবে আমার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার খুব সেজে-গুজেই তার সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে। সে যদি আমার রূপে মুগ্ধ হয়ে চেয়েও থাকে তাহলে আজ আমি লজ্জায় একদম গুটিয়ে পড়ব না। বরং দ্বিগুণ আনন্দ নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরব।
বাড়ি থেকে বের হয়ে পেছন দিকে যেতে সামান্য হাঁটলাম। তারপরই দৃষ্টিগোচর হলো তেতুলগাছ আর ঈশানের লম্বা অবয়ব। আমি ঈশানের কাছে গিয়ে শব্দ করলাম,” হায়।”
ঈশান আমাকে দেখে সাথে সাথেই আবার অন্যদিকে মুখ ঘোরালো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” হ্যালো।”
আমি ভাবছিলাম কিভাবে কথা শুরু করব। তারপর কোনোকিছু চিন্তা না করে যেটা মন বলল, সেটা করে ফেললাম। ঈশানকে আচমকা জড়িয়ে ধরলাম। আমার এই আচরণে ঈশান কতটা বিস্মিত হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না। তবে তার বুকের বামপাশে খুব জোরে ধড়াক ধড়াক শব্দ হতে লাগল। আমি সেই শব্দ অনুভব করতে চোখ বন্ধ করে নিলাম। ঈশানও আমাকে নিজস্ব শক্তিতে জড়িয়ে ধরল। কোনো কথা হলো না। শুধু একটি চমৎকার মুহূর্ত আমাদের মাঝে অতিবাহিত হচ্ছিল। আমি চোখ বন্ধ করে ঈশানের বুকে মুখ গুজে রইলাম। আর আমি না দেখেও জানি, ঈশানও চোখ বন্ধ করে আমার মাথায় মুখ গুজে আছে। দু’জন অনেকক্ষণ চুপ ছিলাম। অনুভব করছিলাম একে-অন্যের অস্তিত্ব। একটু পর আমি সিক্ত কণ্ঠে বললাম,” আই এম স্যরি। আমি আপনাকে খারাপ স্মৃতি মনে করিয়ে কষ্ট দিতে চাইনি। বিশ্বাস করুন, আমি এসব কিছুই জানতাম না। একটু আগে নিহার কাছে পুরো ব্যাপারটা শুনেছি। আমার খুব খারাপ লাগছে।”
ঈশান আমাকে টেনে তুলল। আমার মুখটা আঁজলায় নিয়ে শান্ত চোখে চেয়ে রইল। আমার চোখে তখন অশ্রুতে পরিপূর্ণ। ঈশান আঙুল দিয়ে আমার অশ্রু মুছল। জানি না কেন, তখন আমার আরও বেশি কান্না পেল। ঈশান হেসে উঠল। আমি তার হাসি দেখে রাগান্বিত হয়ে বললাম,” হাসছেন কেন? আমাকে কাঁদতে দেখলে আপনার মজা লাগে?”
ঈশান হাসতে হাসতে বলল,” ভূত হয়ে গেছ একদম। চোখের কাজল ছড়িয়ে পেত্নী পেত্নী লাগছে।”
আমার মনে পড়ল যে আমি চোখে কাজল দিয়েছিলাম। ভুলেই গেছি! জীভ কেটে চোখ মুছলাম। ঈশান তার হাত দিয়ে মুছে দিল। তারপর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,” তবুও সুন্দর লাগছে।”
আমি হেসে দিলাম। ঈশানও হাসল, তবে প্রাণবন্ত হাসি নয়। তার ভেতরে এখনও একটা চাপা কষ্ট কাজ করছে তা আমি বুঝতে পারছি। আমি ঈশানের বাহুতে স্পর্শ করে বললাম,” আমি আপনার কি?”
ঈশান চোখ কুচকে রহস্যের ভঙ্গিতে বলল,” কি?”
” আপনিই বলুন!”
ঈশান একটু ভেবে বলল,” তুমি হচ্ছ আমার মনের রাণী।”
ঈশানের এই উত্তর আমার খুব পছন্দ হলো। আমি মিষ্টি হেসে বললাম,” তাহলে আমি আপনার মনে রাজত্ব করছি তাই তো?”
ঈশান মাথা নাড়ল। আমি বললাম,” যেই মনে আমি রাজত্ব করছি সেই মন যদি খারাপ হয় তাহলে ভালো করার দায়িত্ব কি আমার নয়!”
ঈশান হেসে আবারও মাথা নাড়ল। আমি ঘাড়টা একটু হেলিয়ে বললাম,” তাহলে আমাকে বলুন, আপনার কেন মনখারাপ? কি করলে আপনার মন ভালো হবে?”
ঈশান ভারী নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর দুষ্ট কণ্ঠে বলল,” কিস করলে।”
আমি আৎকে উঠলাম। কড়া দৃষ্টিতে চাইলাম। ঈশান হাসছে। আমি কোমরে হাত রেখে বললাম,” এটা তো মন ভালো করার বিষয় হতে পারে না।”
ঈশান দৃঢ়চিত্তে বলল,” এটাই আমার মন ভালো করার টনিক।”
বলে সে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। আমি একটু বিব্রত হলাম৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেনে নেওয়ার মতো বললাম,” আচ্ছা বেশ। কিস করুন।”
এই কথা বলে আমি ঈশানের সামনে দাঁড়ালাম। চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু আমার চোখের পাতা কাঁপছে; কাঁপছে ঠোঁটের ভাজটিও। ঈশান চট করে বলল,” না থাক।”
আমি চোখ খুলে তাকালাম। অবাক কণ্ঠে বললাম,” কেন?”
” এমনি।”
” সমস্যা নেই। আপনি করুন। তাও যদি আপনার মন ভালো হয়।”
ঈশান আমার হাত ধরে বলল,” তুমি এভাবেই আমার সাথে থাকো। আমার মন সবসময় ভালো থাকবে।”
আমি চমৎকার করে হেসে প্রশ্ন করলাম,” তাই? তাহলে তখন আমার সামনে থেকে উঠে চলে গেলেন কেন?”
ঈশানের মুখের হাসি ঝাপসা হলো। হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” ছোটবেলার কিছু কথা মনে পড়ে গেছিল। সেজন্য।”
আমি ঈশানের কাছে এসে আবেগভরা কণ্ঠে জানতে চাইলাম,” কি মনে পড়েছিল?”
ঈশান কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার মতো বলতে লাগল,” স্কুলে যাওয়ার সময় আশেপাশের সবাইকে দেখতাম, তাদের বাবা-মা আছে৷ রোজ তাদের জন্য অপেক্ষা করে। স্কুল ছুটির পর বাবা অথবা মাকে বাইরে দাঁড়ানো দেখলে সবার মুখে যে আনন্দের একটা হাসি ভেসে উঠতো, সেই হাসি আমি কোনোদিন হাসতে পারিনি। আমি জানতাম না মায়ের হাতের রান্না কেমন হয়, বাবার আদর কেমন হয়। প্রচন্ড অসুস্থতার সময় আমার পাশে শুয়ে কেউ কাঁদেনি। ছোটবেলা থেকে খুব লোনলি ফীল করতে করতে বড় হয়েছি। আমি শুধু জানতাম আমার কেউ নেই। বাবা নামের একজন আছে, কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে না। তারপর আমার জীবনে হঠাৎ করেই এলো মম। পৃথিবীর সব ধরণের খুশি, ভালোবাসা আর সুখ নিয়ে। সেই মম হয়ে গেল আমার দুনিয়া। তার চেয়ে সুন্দর মুখের হাসি এই পৃথিবীর কারো নেই, তার চেয়ে মিষ্টি করে কেউ কথা বলতে পারে না, তার মতো স্নেহ দিয়ে কেউ আমাকে স্পর্শ করেনি কখনও। আমি মমের প্রতি ঝুঁকে পড়লাম। মম যেদিন প্রথম বলল যে তিনি আমার আসল মম নয়, সেদিন মানতে খুব কষ্ট হয়েছিল৷ কারণ ওই বয়সে আমি মা বলতে বুঝতাম যে আমাদের সবচেয়ে আদর করে। মম ছাড়া এর আগে কেউ আমাকে এতো আদর করেনি। আমি চিৎকার করে মমকে বলেছিলাম, তিনি যেন আমাকে আর কখনও এটা মনে না করায় যে তিনি আমার মম নয়। সত্যিটা আমার জানার দরকার নেই। আমি শুধু জানতে চাই, তিনিই আমার মম। এটাই সত্যি। আমি শুধু এটাই বিশ্বাস করি যে উনিই আমার মম, তারিন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও উনিই আমার মম।”
আমি দেখলাম ঈশানের চোখ টলমল করছে। আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম৷ হৃদয় অস্থির হয়ে উঠল আমার। তীব্র কণ্ঠে বললাম,” তিনি আপনার মম। শুধু আপনার মম হওয়ার জন্যই তিনি আপনার বাবাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি কখনও কারো স্ত্রী হোননি। তাঁর একমাত্র পরিচয়, তিনি আপনার মম। এমনকি তিনি বাকি জীবনও আপনার মম হয়েই কাটিয়ে দিতে চান। আপনি খুব লাকি, ঈশান। এমন মম পৃথিবীতে আর কারো নেই।”
চলবে