#তি_আমো,৪৬,৪৭
পর্ব ৪৬
লিখা- Sidratul Muntaz
আমার চোখ দু’টি অচিরেই বন্ধ হয়ে গেছে। হৃৎপিন্ডে লাবডুব শব্দ হচ্ছে। যখন আমি চোখ মেলে চাইলাম তখন আশেপাশে কেউ নেই। নিহা, মোহনা আন্টি, ভাইয়া, সবাই উধাও৷ আমি উত্তপ্ত কণ্ঠে বললাম,” এটা কি হলো? ঝগড়ার সময় শুধু ঝগড়া করবেন। তাই বলে এইসব কি?”
” এখন ঝগড়ার সময় না তারিন। আর আমি ঝগড়ার মুডেও নেই।”
” আপনি কি সারাক্ষণই চুমু দেওয়ার মুডে থাকেন?”
” শুধু যখন তুমি সামনে থাকো তখন।”
আমি রেগে ঈশানের বুকে ধাক্কা মেরে বললাম,” আপনি একটা খাটাশ!”
ঈশান অবাক হয়ে আমার হাত দু’টো চেপে ধরে বলল,” এইখানে কাঁদার কি হলো?”
” আপনি সব ভেস্তে দিলেন।”
” আচ্ছা বাবা, ঠিকাছে। তোমার ঝগড়া করতে ইচ্ছে হলে আরও ঝগড়া করো৷ আমি শুনছি।”
” এখন আর ঝগড়া করেও লাভ কি?”
” তাহলে কি মারামারি করবে? আমি একটা আর তুমি দশটা?”
আমি অগ্নিদৃষ্টিতে চাইলাম। ঈশান হেসে ফেলল। অগত্যা আমারও হাসি পেয়ে গেল। ঈশান আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল,” ঝগড়ার সময় কাউকে এতো কিউট লাগে আমি জানতাম না। বিয়ের পর তুমি প্রতিদিন আমার সাথে একবার হলেও ঝগড়া করবে, ওকে?”
” আর আপনি এমন অদ্ভুত কাজ করে আমার মুডের বারোটা বাজিয়ে দিবেন?”
ঈশান মাথা নাড়ল। আমি রাগ করতে নিয়েও আবার হেসে ফেললাম। স্টেজে গিয়ে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিহা এসে আমার মাথায় খুব জোরে একটা গাট্টা মারল। আমি চমকে উঠলাম। নিহার চেহারা একদম শুকনো। আমি উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,” ভাইয়া আর মোহনা আন্টি কোথায়?”
নিহা বিরস মুখে উত্তর দিল,” আমি নিজেই জানি না৷ তারা যে এখনও হার্ট এটাক করেনি এটাই অনেক। তোকে ঝগড়া করতে বলেছিলাম। আর তুই শুরু করলি ওপেন শো। হোয়াট আ সিন! ছি, ছি,আমি কত লজ্জা পেয়েছিলাম জানিস?”
” আমি কি ইচ্ছে করে করেছি? লজ্জা তো তোর থেকে বেশি আমার লাগছে। ওরা কি কিছু বলেছিল?”
” বলার মতো কোনো অবস্থা ছিল? দু’জনেরই তো বলতি বন্ধ। একজন ডানপাশে চলে গেল। অন্যজন বামপাশে চলে গেল। আমি তালগাছের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তারা চলে যাওয়ার পর আমিও দৌড়ে পালিয়ে এলাম। ”
” তুই তালগাছের দিকে তাকিয়ে থাকবি কেন?”
” চোখ রাখার আর কোনো জায়গা পাচ্ছিলাম না তাই।”
আমি হেসে দিলাম। নিহাও হাসতে লাগল। ভাইয়া আর মোহনা আন্টি মাঝে আমরা যে মিষ্টি একটা কলহ বাঁধানোর চেষ্টা করছিলাম সেটা সম্ভব হলো না। কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যিই ঝগড়া হয়েছিল। একদম অনুষ্ঠানের শেষের দিকে। তারিফ ভাইয়া ঈশানের সাথে ছবি তোলার সময় হঠাৎ বলল,” তোমার বাবা আসবে না?”
ঈশানের পাশাপাশি বাকি সকলের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। মোহনা আন্টি অপ্রসন্ন গলায় বলল,” না, আসবে না।”
ভাইয়া বলল,” বিয়েতে গার্ডিয়ান থাকা উচিৎ। তিনি না এলে বিয়ে কিভাবে হবে?”
ঈশান কঠিন মুখে বলল,” আমার গার্ডিয়ান একজনই। আমার মম।”
” মম তো আছেই। কিন্তু বাবাকেও তো লাগবে। ছেলের বিয়েতে বাবা থাকবে না এটা কেমন কথা।”
মোহনা আন্টি তেতে উঠে বললেন,” বাবা ছাড়া কি বিয়ে হওয়া সম্ভব না? বাবা থাকলেই বিয়েতে উপস্থিত হতে হবে এমন নিয়ম কোথায় লেখা আছে?
ভাইয়া দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি আড়ষ্ট গলায় বললাম,” ঈশানের বাবা আর মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সে এখন তার মায়ের সাথেই থাকে।”
ভাইয়া বেশ চমকানো গলায় বলল,” আমি তো এসব কিছুই জানতাম না।”
ঈশান পরিষ্কার কণ্ঠে বলল,” বিয়েটা আমার হচ্ছে। আমার বাবার তো না। তাই বিয়েতে তিনি থাকলেন কি থাকলেন না, এতে কি যায়-আসে?”
ভাইয়া বলল,” নিশ্চয়ই যায়-আসে। বাবা ছাড়া সন্তান অস্তিত্বহীন। আমি কিসের ভরসায় আমার বোনকে তোমার কাছে দেই, বলোতো? তোমার তো কোনো চাকরিও নেই। নিজেই এখনও পড়াশুনা করছ। বিয়ের পর আমার বোনকে রাখবে কোথায়? যে বাবার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই সেই বাবার বাড়িতে আমি আমার বোনকে যেতে দিবো কেন?”
ভাইয়ার কথায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল ঈশানের মুখ। মোহনা আন্টি দরাজ গলায় বললেন,” তারিন আমার বাড়িতে থাকবে। আমার বাড়ি মানে আমার ছেলেরও বাড়ি।”
ভাইয়া দ্বিমত পোষণ করল,” না। আপনার বাড়ি মানেই আপনার ছেলের বাড়ি নয়। ওইটা আপনার বাবার বাড়ি। মানে ঈশানের নানার বাড়ি। তাছাড়া আমি শুনেছি আপনার বাবার সাথেও আপনি সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।”
মোহনা আন্টি রক্তিম দৃষ্টিতে বললেন,” হ্যাঁ করেছিলাম। তাও একটা বেঈমানের জন্য।”
ভাইয়া বিষাদসিক্ত চেহারা নিয়ে হাসল। আক্ষেপের স্বরে বলল,” সেই বেঈমানের কি দোষ বলুন? আপনার বাবাই তাকে অপমান করে বের করে দিলেন। শর্ত দিলেন দুইমাসের মধ্যে যোগ্য হয়ে দেখাতে হবে। বেঈমান অপারগ ছিল। দুইমাস তো দূর, দুইবছর সময় দিলেও সে কিছু করতে পারতো না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ঈশান পারবে। আমি তাকে দুইবছরের সময় দিতে চাই।”
ঈশান ঝটিতে ভাইয়ার দিকে ঘুরে তাকাল। ভাইয়া ঈশানের কাঁধে হাত রেখে বলল,” বিয়ে দুইবছর পরে হবে। যখন তুমি আমার বোনের যোগ্য হতে পারবে। মা অথবা বাবার বাড়িতে নয়। নিজের বাড়িতে আমার বোনকে রাখতে পারবে। ততদিন আমার বোন আমার কাছেই থাকবে। তুমি কি রাজি?”
ঈশান হতভম্ব হয়ে গেল। আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মোহনা আন্টি তেজস্বী কণ্ঠে বলল,” প্রতিশোধ নিচ্ছেন? নিজের ক্ষোভ বাচ্চাদের উপর মেটাতে চাইছেন?”
” আমি শুধু আমার বোনের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে চাইছি। যেমনটা আপনার বাবাও চেয়েছিলেন। তিনি যদি ভুল না হয়ে থাকেন তাহলে আমি কেন ভুল হবো?”
তাদের এই ঝগড়ায় আমরা কেবল নীরব দর্শক। ঈশানকে দেখলাম স্টেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি তাকে আটকাতে গেলাম কিন্তু সে আমার কথা শুনল না। আমি ভূমিতে বসে কাঁদতে শুরু করলাম। চারপাশ থেকে মেয়েরা এসে আমাকে ধরল। তাদের সান্ত্বনা বাণী আমার কানে পৌঁছাচ্ছে না। ভাইয়ার দিকে চেয়ে একবার বলতে ইচ্ছে হলো, দয়া করো প্লিজ। এভাবে আমাদের শাস্তি দিও না।
ঈশান একটু পর একটা কাগজ আর কলম নিয়ে ফিরে এলো। ভাইয়াকে সাইন করার নির্দেশ দিয়ে বলল,” দুইবছর পর আমি তারিনকে নিয়ে যাবো। কিন্তু এর আগে আপনার লিখিতভাবে কথা দিতে হবে তারিনকে অন্যকোথাও বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। দুইবছর পর আমি যদি স্বনির্ভর হতে পারি তাহলে আমাকে ফেরাতেও পারবেন না।”
ভাইয়া ঈশানের এহেন আচরণে হেসে ফেলল। কাগজটা হাতে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইল। তখনি ঈশান বাঁধা দিল,” এটা প্রমাণ হিসেবে থাকবে। ছিঁড়বেন না।”
” ছিঁড়ে ফেলছি কারণ এটার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমাদের বিয়ে হবে। আমি মজা করছিলাম।”
ভাইয়ার কথায় আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। নিহাও প্রায় কেঁদে ফেলছিল। ভাইয়ার বক্তব্য শুনে সে খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি দুইহাতে চোখের জল মুছে ফেললাম। ঈশান প্রশ্ন করল,” এটা কেমন মজা ভাইয়া?”
” ছোট্ট একটা পরীক্ষা৷ ধরে নাও তোমার পরীক্ষা নিলাম। আর তুমি পাশ করেছ।”
ঈশান অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল,” কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার তারিনকে বিয়ে করার যোগ্যতা নেই। ”
মোহনা আন্টি বলল,” তুই তারিনকে ভালোবাসিস এটাই তোর যোগ্যতা ঈশান। এর উপরে কিছু থাকা জরুরী নয়।”
তারিফ ভাই বলল,” তাই নাকি? আপনি মানেন এই কথা? জেনে ভালো লাগল।”
ঈশান বলল,” ভাইয়া আমি চাই না আপনি কোনো রকম দ্বিধা নিয়ে আমাদের বিয়েতে রাজি হোন। আপনার যদি আসলেই আমাকে অযোগ্য মনে হয় তাহলে আমি যোগ্য হওয়ার চেষ্টা করব৷ আপনি যা শর্ত দিবেন সবকিছু পূরণ করব। তারপর তারিনকে নিয়ে যাবো।”
মোহনা আন্টি অহংকারী কণ্ঠে বলল,” দ্যাটস মাই বয়। চ্যালেঞ্জ নিতে কখনও ভয় পায় না। আর বাকিদের মতো পালিয়েও যায় না।”
ভাইয়া রূঢ় গলায় বলল,” ঠিকাছে। তাহলে চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড। ”
এই কথা বলেই ভাইয়া ঈশানের দেওয়া কাগজে সই করল। সবার মাঝে একটা অপ্রীতিকর উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। তারপর যেটা হওয়ার সেটাই হয়েছিল। আমরা ঢাকায় নিজেদের বাড়ি ফিরে এলাম। আর ঈশান মোহনা আন্টিকে নিয়ে লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করল। তার গ্র্যাজুয়েশনের আর মাত্র কিছু মাস বাকি। চলে যাওয়ার দুইদিন আগে ঈশান আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। ভাইয়া সময় বেঁধে দিল। সর্বোচ্চ আধঘণ্টা। আমি শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলাম। ঈশান আমার হাত ধরে শান্ত কণ্ঠে বলল,” এবার কান্নাটা থামাও। যাওয়ার আগে তোমার হাসিমুখ দেখে যাই?”
এই কথা শুনে আমি আরও জোরে কাঁদতে কাঁদতে ঈশানকে জড়িয়ে ধরলাম৷ ঈশান রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” একদম ভয়ের কিছু নেই। দুইবছর তো দূর, আমার একবছরও সময় লাগবে না। দেখো আমি কত দ্রুত ফিরে আসি! ”
” আপনি আমাকে নিয়ে যান প্লিজ।”
” এই কথা বলে তো কোনো লাভ নেই। জানো নিয়ে যেতে পারব না, তবুও কেন চাইছ? তোমাকে নিষেধ করতে আমার কষ্ট হয় তারিন।”
আমি ঈশানের কপালে তৃতীয় চুমু দিয়ে বললাম,” ভালো থাকবেন।”
ঈশান মৃদু হেসে বলল,” এতোদিন কাছাকাছি ছিলাম, একবারও চুমু দিতে ইচ্ছে হয়নি তোমার। এখন চলে যাওয়ার সময় চুমু দিয়ে ভরিয়ে ফেলছ। এইটা কেমন অবিচার?”
আমি হেসে উঠলাম। দরজায় খটখট শব্দ হতেই আমি ঈশানের থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ বাইরে থেকে ভাইয়ার কণ্ঠ শোনা গেল,” টাইম আপ।”
ঈশান দরজার কাছে গিয়ে বলল,” আসছি।”
আমি চমৎকার করে হেসে বললাম,” অপেক্ষায় থাকব।”
চলবে
#তি_আমো
পর্ব ৪৭
লিখা- Sidratul Muntaz
ঈশান বাড়ি থেকে যেদিন চলে গেল ঠিক সেদিন সন্ধ্যায় মোহনা আন্টি ফোন করে আমাদের দাওয়াত করল। তার বাড়িতে যেতে হবে। মেয়েদের নিয়ে অনুষ্ঠান। আমি, মা আর বুড়িকে নিতে সকাল সকাল গাড়ি পাঠানো হবে। মা জানাল ভাইয়া অনুমতি দিলে তবেই আসবে৷ কিন্তু মোহনা আন্টির কড়া নির্দেশ, যে কোনো মূল্যে আসতেই হবে। তিনি অপেক্ষায় থাকবেন। আমি খুশি হলাম। এই সুযোগে ঈশানের সাথে আরও একবার দেখা হয়ে যাবে। ভাইয়া আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিচ্ছে না। সারাক্ষণ ঈশানের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। কিন্তু চোখের দেখা না দেখলে ভালো লাগে না৷ তার উপর দুয়েকদিন পর সে চলে যাবে। কত মাস, কত বছর পর ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই। এসব চিন্তা করলেও নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ভাইয়ার যুক্তি হলো ঘন ঘন দেখা করার চেয়ে এখন থেকেই না দেখে থাকার অনুশীলন করা ভালো। যাতে পরে কষ্ট কম হয়। কিন্তু এতে যে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে সেটা আমি ভাইয়াকে কি করে বোঝাই? আমি মায়ের কাছে রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করলাম,” প্লিজ মা, চলো না আমরা যাই। ভাইয়াকে রাজি করাও না!”
” তোর ভাই কি আমার কথায় রাজি হবে? তার যদি মর্জি ভালো থাকে তাহলে এমনিই অনুমতি দেবে।”
” যদি অনুমতি না দেয়?”
মা প্রবল বিশ্বাস নিয়ে বলল,” দেবে। কেন দেবে না?”
রাতে ভাইয়া যখন খেতে বসেছে তখন মা ভাইয়াকে দাওয়াতের কথা জানালো। আমি নিজের ঘরে বসে পড়ার ভং ধরেছি। কিন্তু দরজায় কান পেতে শুনছিও ভাইয়া আর মায়ের কথোপকথন। সব শুনে ভাইয়া বলল,” তোমাদের যেতে ইচ্ছে হলে যাবে। এতো জিজ্ঞাসার কি আছে?”
” তোকে না জানিয়ে কখনও কোথাও গিয়েছি আমি?”
” যেও সমস্যা নেই। তবে তারুকে একটু চোখে চোখে রেখো।”
” কেন? তুই কি ঈশানকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিস? ওর উপর কি তোর সন্দেহ হয়?”
” হবে না কেন? সে তো আর ফেরেশতা নয়। সে লন্ডন থেকে কবে না কবে ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই।আমি তাদের মধ্যে যে দেয়ালটা তৈরী করেছি সেটার প্রয়োজন আছে।”
” যেই ছেলে চাইলেই তারুকে বিয়ে করতে পারতো সে বিয়ে না করে লন্ডন যাচ্ছে নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে। যাতে সে তারুর যোগ্য হতে পারে। তবুও তাকে তুই সন্দেহ করিস?”
ভাইয়া কোনো উত্তর দিল না। মা একটু পর হঠাৎ বলল,”মোহনা বলেছিল আমার হাতের রান্না নাকি তার মায়ের মতো। আমি ভাবছি কাল যাওয়ার সময় তার জন্য রেঁধে নিয়ে যাবো।”
” বেয়াইনের জন্য দরদ দেখি একদম উতলে পড়ছে এখন থেকেই। ”
” বেয়াইন হিসেবে না। আমি আমার মেয়ে হিসেবে মোহনাকে স্নেহ করি।”
” কিন্তু সম্পর্কে সে তোমার বেয়াইনই হবে মা।”
মা নরম সুরে বলল,” এজন্যই কি তুই মোহনার সাথে খোলাখুলি কথা বলতে ভয় পাচ্ছিস?”
ভাইয়া বিব্রত গলায় বলল,” খোলাখুলি আবার কি কথা বলব?”
” ঈশান কিন্তু মোহনার নিজের ছেলে না।”
” এই কথা আমি জানি।”
” তাহলে সে তারুর শাশুড়ীও না। আবার সে ডিভোর্স নিয়েছে। তুইও এখনও বিয়ে করিসনি। তোরা দু’জনেই একা।”
ভাইয়া কঠিন স্বরে বলল,” এই ধরণের কথা ভুলে চিন্তা কোরো না মা। আমাদের মধ্যে যা ছিল তা অতীত। এখন যেটা হচ্ছে সেটা বর্তমান। মিস মোহনা শুধু আমার ছোট বোনের শাশুড়ী ছাড়া আর কিছুই না। আমি সবকিছু ভুলে গেছি। তুমিও ভুলে যাও।”
” কত আশা করেছিলাম, এবার অন্তত সব ঠিক হবে। আমার পরিবারটা পূর্ণ হবে। বাড়িতে ছেলের বউ আসবে।”
ভাইয়া কথা বলছে না। মা রেগে বলল,” সব যদি ভুলেই যাস তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধা কই? মোহনা না হোক, অন্যকাউকে বিয়ে কর!”
” আমার বিয়ের বয়স ফুরিয়ে গেছে, মা।”
” বিয়ের বয়স কখনও ফুরায় না। মানুষ সত্তর বছর বয়সেও বিয়ে করে।”
ভাইয়া হেসে বলল,” ঠিকাছে। আগে আমার সত্তর বছর হোক, তারপর দেখা যাবে।”
মা রেগে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। রান্নাঘরের দিকে এগোনোর সময় বলল,” আমার সাথে আর কথা বলবি না তুই।”
ভাইয়া বেসিন থেকে হাত ধুঁয়ে মায়ের সাথে রান্নাঘরে গেল। আমি এবার আমার ঘরের জানালায় কান পাতলাম। সেখান থেকে রান্নাঘরের কথা শোনা যায়। ভাইয়া বলছে,” রাগ কোরো না মা। স্যরি। তুমি আমাকে না বুঝলে আর কে বুঝবে?”
” শুধু আমিই কেন তোকে বুঝব? এবার তুইও একটু আমাকে বোঝ। একটা বিয়ে কর। কানা হোক, ল্যাংরা হোক, যেমনই হোক, তুই শুধু একটা বিয়ে কর।”
” শেষমেষ কানা- ল্যাংরা বিয়ে করব?”
ভাইয়া হাসতে লাগল। মা দরাজ কণ্ঠে বলল,” তুই এখনও মোহনাকে ভালোবাসিস?”
” ছিঃ এসব কি বলছ?”
” নাহলে তুই বিয়ে করবি না কেন?”
” আমি বিয়ে করব না মানেই আমি মিস মোহনাকে ভালোবাসি এইটা কেমন কথা?”
” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল। তুই মিথ্যা বললে যেন আমি মরে যাই।”
” উফ, মা! আচ্ছা ধরো আমি ভালোবাসি। এজন্য কি আমার বিয়ে করতে হবে? ভালোবাসার সাথে বিয়ের তো কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ সুখী হওয়ার জন্য ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে। কিন্তু আমি এমনিই যথেষ্ট সুখে আছি। তোমাদের সুখই আমার সুখ। তারুর খুশিই আমার খুশি। তাছাড়া তোমার কি মনে হয় মা? ঈশান যখন জানবে আমি তার মাকে বিয়ে করতে চাইছি এই ব্যাপারটা কি সে সহজভাবে মানবে? ধরো তোমাকে এখন কেউ বিয়ে করতে এলো। আমি কি রাজি হবো? এটা অসম্ভব। এটা চিন্তাও করা যায় না। মাঝখান থেকে তারুর সাথে ঈশানের সম্পর্ক নষ্ট হবে। আমি এটা কোনো অবস্থাতেই চাই না মা। যে সুখ আমি পাইনি সেই সুখ আমার বোন পাক৷ ও ভালো থাকুক। কারণ ওর খুশিই তো আমার খুশি।”
মা কাঁদতে কাঁদতে বলল,” একটা প্রশ্ন করব তোকে?”
” আরে… আবার কান্নাকাটি কেন? আচ্ছা প্রশ্ন করো।”
” মোহনা যদি ঈশানের মা না হতো তাহলে তুই ওকে এতো বছর পর ফিরে পেলে কি করতি?”
ভাইয়া নিশ্চুপ হয়ে গেল। মা দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যি কথা বল।”
ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” অনেক রাত হয়েছে,মা। শুয়ে পড়ো প্লিজ।”
ভাইয়ার নীরবতাই যেন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। আমার বুকে চাপা একটা কষ্ট সৃষ্টি হয়েছে। একবার মনে হচ্ছিল, আমি চাইলেই সব ঠিক করতে পারি। তারপর আবার মনে হলো, আমার হাতে কিছু নেই।
এই বাড়ি আসার পর থেকেই আমি শুধু ঈশানকে খুঁজে যাচ্ছি। রুবা আন্টিরাও এসেছে। নিরা, রেহেনা, সবার মাঝে আমি নিহাকে খুব মিস করছি। সে আছে তার শ্বশুরবাড়ি মানে সিলেটে। এই মুহূর্তে সে এইখানে থাকলে এক মিনিটেই ঈশানকে খুঁজে আনতো। শুধু কি তাই? আমাদের দেখা করানোর জন্য কত রকম উপায় যে বের করতো! বসার ঘরে মা আর বুড়ির সাথে কথা বলছে মোহনা আন্টি। আমি সম্পূর্ণ বাড়িটা ঘুরছি। ঈশান তার নিজের রুমে নেই। আমি বিসমিকে দেখতে পেয়েই ডাকলাম,” বিসমি, শোনো!”
” বলেন ভাবী।”
আমি লাজুক মুখে বললাম,” তোমার ভাইয়া কোথায় বলতে পারবে?”
” ভাইয়া তো বিদেশ চলে গেছে।”
” কি? সত্যি? আমাকে না জানিয়ে কিভাবে চলে গেল?”
আমি মুখের অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে দিল বিসমি। রসিকতার সুরে বলল,” মজা করেছি ভাবী। ভাইয়া ছাদে আছে। গেলেই দেখতে পাবেন।”
আমাকে আর পায় কে? দৌড়ে ছাদে উঠতে লাগলাম। সিঁড়ি ভেঙে যখন আমি উঠছি কেউ হাত ধরে হেচকা টান মারল। আমি ভয় পেয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখি ঈশান৷ সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরলাম,” আমি আপনাকে প্রচন্ড মিস করেছি।”
” কালকেই না দেখা হলো? মাত্র একরাতেই এই অবস্থা?”
আমি ঈশানের বুকে আঘাত করে অভিমানী কণ্ঠে বললাম,” একদম মজা নিবেন না।”
ঈশান আমাকে ধাক্কা মেরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। তারপর আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল। আমি বিস্মিত সুরে বললাম,” কি করছেন?”
ঈশান নেশাময় কণ্ঠে বলল,” আমিও মিস করেছি। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। ভেবেছিলাম আর দেখা হবে না। কিন্তু হয়ে গেল।”
আমি হেসে বললাম,” ভাগ্যে থাকলে কি-না সম্ভব।”
” মম যখন বলল তোমরা আসবে, আমি তো বিশ্বাসই করিনি। তোমার খরুস ভাই তোমাকে আসতে দিতে রাজি কিভাবে হলো?”
” ভাইয়াকে খরুস বলবেন না।”
” আচ্ছা, তোমার ভাই ভদ্রলোক।”
” অবশ্যই ভদ্রলোক। ভাইয়ার প্রতি আপনার এতো রাগ কিসের?”
” অনেক রাগ। তুমি বাচ্চা মানুষ। এসব বুঝবে না।”
আমি চোখমুখ কুচকে বিরক্তি নিয়ে বললাম,” আমি বাচ্চা? স্কিউজ মি, আমি কিভাবে বাচ্চা হলাম?”
ঈশান জবাব না দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিল। আমি চেঁচিয়ে বললাম,” আরে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
ঈশান বিড়বিড় করে বলল,” বাসরঘরে।”
” বিয়ের আগেই বাসর ঘর? ছিঃ, ক্যারেক্টারলেস।”
” আমার ক্যারেক্টার সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়াই নেই।”
ঈশান সত্যি সত্যি আমাকে তার ঘরে নিয়ে এলো। দরজা বন্ধ করল। পর্দা টেনে দিতে দিতে বলল,” আজকের এই সময়টা শুধুই আমাদের।”
আমি মুচকি হাসলাম। ঈশান আমার কাছে এলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে গভীরভাবে চুম্বন করল। আমি হারিয়ে গেলাম অসীম কোনো সুখের দুনিয়ায়। ভেবেছিলাম আজকে ঈশানের সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলব। ভাইয়া আর মোহনা আন্টি সংক্রান্ত। কিন্তু ঈশান আমাকে সেই সুযোগ দিলে তো? আসার পর থেকেই সে রোমান্টিক মুডে আছে। আজ তার কি হয়েছে কে জানে? তবে আমি ঈশানকে বাঁধা দিতে পারছিলাম না। আজকে ঈশান যেটাই করুক, আমি তাকে একটুও বাঁধা দিতে পারব না। সেই শক্তি আমার নেই।
চলবে