তি_আমো পর্ব ৫৩

0
242

#তি_আমো
পর্ব ৫৩
লিখা- Sidratul Muntaz

তারিনের হাত ধরে করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় ফাহিম হঠাৎ বলল,” একটা বলি তারু? যদি কিছু মনে না করো!”

” কি কথা?”

” তোমার ঈশান ভাইয়ের সামনে বেশি না যাওয়াটাই ভালো। ”

তারিন তাকাতেই ফাহিম ঝটপট আরও যুক্ত করল,” আমি জাস্ট বললাম। বাকিটা তোমার ইচ্ছা।”

তারিন এবার খিলখিল করে হেসে উঠল” কেন? আপনার কি ভয় হচ্ছে? ঈশান ভাই আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে?”

ফাহিম মুচকি হাসল। তারিনের চোখে চোখ রেখে বলল,” আর কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।”

তারিন অবাক হয়ে তাকাল। ফাহিমের মসৃণ দৃষ্টি ভরে উঠেছে আত্মবিশ্বাসে। তারিন বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,” এতো বিশ্বাস?”

” হুম।”

কিছুক্ষণ তারা অকারণেই একে-অন্যের দিকে চেয়ে রইল। হুট করেই নিহা এসে উপস্থিত হলো,” তারু, তোর সাথে জরুরী কথা আছে। এদিকে আয়।”

ফাহিম সঙ্গে সঙ্গে তারিনের হাত ছেড়ে দিল। নিহা ফাহিমের দিকে চেয়ে আবেদনসূচক কণ্ঠে বলল,” ওকে একটু নিয়ে গেলাম ফাহিম ভাই।”

ফাহিম পাশ কাটানো গলায় বলল,” যাও। আমাকে জিজ্ঞেস করার কি আছে?”

ফাহিম সামনে হাঁটতে লাগল। সে চলে যাওয়ার পর তারিন বলল,” কোথায় যেতে হবে?”

নিহা আশেপাশে তাকিয়ে একটু দেখে নিয়ে বলল,” থাক, কোথাও যেতে হবে না। এখানে যেহেতু কেউ নেই, তাই এখানেই বলি। তুই এটা কি করলি বলতো?”

” কি করেছি?”

” ফাহিম ভাইয়ের সাথে এংগেজমেন্ট করে ফেললি? কিভাবে হলো, কখন হলো? আমি তো ভাবতেও পারছি না। তুই আর ফাহিম ভাই! ওহ মাই গড!”

তারিন হাসতে হাসতে বলল,” আর কাউকে বলিসনি তো? এনাউন্সমেন্ট আরও পরে করব।”

নিহা বিরস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” ঈশান ভাইয়ের কি হবে তারু? তোর কি উনার জন্য একটুও খারাপ লাগে না?”

তারিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিচের দিকে চেয়ে মলিন কণ্ঠে উত্তর দিল,” লাগে। জীবনের প্রথম প্রেম বলে কথা.. খারাপ তো লাগবেই। কিন্তু আমার খারাপ লাগা দিয়ে কার কি যায়-আসে?”

নিহা তারিনের গালে হাত রেখে উদগ্রীব হয়ে বলল,” যায়-আসে তারু! নিশ্চয়ই যায়-আসে! ঈশান ভাই তোকে এখনও ভালোবাসে, তুই কি এটা জানিস?”

তারিন নির্বিকারচিত্তে বলল,” জানি।”

নিহা যেন হতবাক। চোখ বড় করে তাকাল,” জানার পরেও তুই এতো নরমাল কিভাবে আছিস? তোর কি কষ্ট হচ্ছে না?”

” কষ্ট যা পাওয়ার তা আমি অনেক আগেই পেয়ে গেছি। এখন কষ্টটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।”

” মানে? বুঝিয়ে বল না! তোদের প্রবলেমটা কি? কেন সবকিছু এমন হয়ে গেল? ঈশান ভাই কষ্ট পাচ্ছে, তুইও কষ্ট পাচ্ছিস। আবার তুই ফাহিম ভাইকেও বিয়ে করছিস। এসব কি হচ্ছে?”

তারিন ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে বলল,” তুই কিছু জানিস না নিহা। তাই বুঝবিও না।”

নিহা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল৷ তারিন চলে যেতে নিলেই সে হাত টেনে ধরল,” থাম, আগে আমাকে বুঝিয়ে বল। কি জানি না আমি? যেটা জানি না, সেটা জানা! তোদের জন্য আমি কিছু করতে চাই৷ আমার এসব ভালো লাগছে না।”

তারিন নিজের সোয়েটারের পকেটে হাত গুঁজে বলল,

” তোর আমার জন্য কিছু করতে হবে না। আমি যথেষ্ট ভালো আছি। নিজের সিদ্ধান্তে খুশি আছি।”

” কিন্তু ঈশান ভাই সুখে নেই। তুই একজনকে কষ্ট দিয়ে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করতে পারিস না। তোর জন্য ঈশান ভাইয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এটা আমি কিভাবে মেনে নিবো? তুই এতো সেলফিশ কেন হয়ে গেলি তারু?”

তারিন আর শান্ত থাকতে পারল না। ক্ষীপ্ত গলায় প্রায় চেঁচিয়ে বলল,” আমি সেলফিশ? আমি? তোর ঈশান ভাইয়ের জীবন আমার জন্য নষ্ট হয়নি। উল্টো সে নিজেই আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেছিল। এই সবকিছুর জন্য সে দায়ী। আমি তো শুধু তাকে মাফ করে দিয়েছি। যদিও সে ক্ষমা ডিজার্ভ করে না।”

তারিন কথাগুলো খুব দ্রুত বলতে গিয়ে যেন হাঁপিয়ে উঠল। বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। নিহা হতভম্বের মতো চেয়ে থেকে খুব কষ্টে ঠোঁট নেড়ে উচ্চারণ করল,” মানে? কি করেছিল ঈশান ভাই?”

তারিন ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,” ঈশান আমার সাথে প্রতারণা করেছিল। ভাইয়ার উপর রেগে সে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আমাকে সম্পূর্ণ ভেঙে চুরমার করে দিয়ে লন্ডন চলে গেছিল। আমি তো ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলেছিলাম রে! তারপর ফাহিম ভাইকে পেলাম। তিনি আমার জীবনে না এলে আমার জীবনটা এতো দ্রুত আবার স্বাভাবিক হতো না! এখন আমি আগের চেয়ে অনেক বেটার আছি। ইন ফ্যাক্ট, আমার তার মনে হয় আমি বেস্ট আছি। ”

নিহা অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলল,” ঈশান ভাই প্রতারণা করেছিল? কি প্রতারণা করেছিল?”

তারিন পকেট থেকে ফোন বের করে নিহাকে ম্যাসেজটা দেখালো৷ দুই বছর ধরে মেসেজটি খুব যত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছে সে। যখনই ঈশানের কথা মনে করে মন আবেগী হয়, তখনি এই মেসেজটি সে দেখে নেয়। সাথে সাথে সব অনুভূতি গায়েব হয়ে যায়। নিহা পুরো মেসেজ পড়ে বোকা বনে গেল। সে সত্যিই ভাবেনি ঈশান এমন কিছু করবে। তার এখন ঈশানের থেকেও বেশি তারিনের জন্য কষ্ট হচ্ছে। এই মেসেজ পড়ে সে নিজেই কেঁদে ফেলছে, তাহলে তারিনের কি অবস্থা হয়েছিল? নিহা ভারী কণ্ঠে বলল,” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তারু। ঈশান ভাই এটা কিভাবে করতে পারল? সে তোকে কত ভালোবাসতো!”

” শুধু ভালোবাসাই সবকিছু না নিহা৷ ভালোবাসার মূল্য দিতেও জানতে হয়।”

” ফাহিম ভাই কি এগুলো জানে?”

” সব জানে। আমি তার কাছে কিছু গোপন করিনি। যেদিন বিয়ের পাকা কথার জন্য উনি আমাদের বাসায় এসেছেন সেদিনই আমি তাকে সবকিছু বলে দিয়েছি। তিনিও তোর মতো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি। তবে একটা ব্যাপার কি জানিস? যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। ঈশান আমার সাথে এটা না করলে আমি ফাহিম ভাইকে কখনও চিনতে পারতাম না৷”

নিহা চোখের জল মুছে বলল,” ঈশান ভাই কিন্তু এখনও সত্যি কথাটা জানে না। তারিফ ভাইয়া তো মোহনা আন্টির সাথে কোনো প্রতারণা করেনি! তাহলে ঈশান ভাই কি শুধু শুধুই তোকে শাস্তি দিল না?”

তারিন চোয়াল শক্ত করে বলল,” সে জানলেও বা কি? যদি তার ভুল ভেঙে যায় তাহলে সে কি করবে? বড়জোর আমার কাছে এসে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু তুই-ই বল, এতোকিছুর পরেও কি আমার তাকে ক্ষমা করা উচিৎ? কয়েক মুহূর্তের জন্য ধরে নিলাম যে আমার ভাই সত্যি দোষী। কিন্তু সেইজন্য সে আমাকে কেন শাস্তি দিবে? কেন আমাকে ঘৃণা করবে, বল? এটা তো কোনো লজিক হলো না। আমি কেন তাকে ক্ষমা করব? শুধু একটা কারণ দেখা! উত্তর আছে তোর কাছে? ঈশানের মতো মানুষের জন্য কি আমার ফাহিম ভাইকে হেলায় হারানো উচিৎ?তাকে তো আমি কষ্ট দিতে পারব না! আমি নিজেও ঈশানের থেকে কষ্ট পেয়েছি। তাই আমি জানি, কষ্ট পেলে কেমন লাগে! এই একই কষ্ট ফাহিম ভাইকে আমি কোনোদিন পেতে দিব না।”

” তাহলে কি তুই এখন ফাহিম ভাইকেই ভালোবাসিস?”

” ভালোবাসা এতো সহজ না। তবে আমি ফাহিম ভাইকে অসম্ভব পছন্দ করি, তিনি আমাকে ভালোবাসেন। তার এই ভালোবাসাটাকে আমি রেসপেক্ট করি। আর আমার কি মনে হয় জানিস? শুধু এই রেসপেক্ট নিয়েই ফাহিম ভাইয়ের সাথে আমি জনম জনম কাটিয়ে দিতে পারব। কিন্তু ঈশানের সঙ্গে ভালোবাসা নিয়েও এক মুহূর্ত থাকা সম্ভব নয়। সে আমার ভালোবাসার মনটাই ভেঙে দিয়েছে। আর যে জিনিস একবার ভাঙে, তা কখনও জোড়া লাগে না!”

নিহা হঠাৎ তারিনকে জড়িয়ে ধরে ফেলল। রুদ্ধ স্বরে বলল,” তুই খুব ভালো থাকিস, তারু। আমি শুধু এটাই চাই এখন।”

তারিফ মাঝখানে বসেছে। তার আশপাশ জুড়ে বন্ধুরা। নিহা আর সাফিন সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করছে। প্রথমে তারিফের এখানে আসার পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু নিহার অনুরোধে আসতে হয়েছে। নিহা বলল,” আমার মেয়ের জন্মদিন আর আপনি আসবেন না, ভাইয়া? এইটা কোনো কথা? অবশ্যই আসতে হবে। আর একা এলে চলবে না। আপনার সব বন্ধুদেরও নিয়ে আসতে হবে।”

তারিফদের গল্প আগ্রহ নিয়ে শুনছে সবাই। ইউনিভার্সিটি জীবনের মজার মজার সব গল্প বলা হচ্ছে। মোহনাকে দেখেই তারিন হাত নেড়ে ডাকল,” মাধবীলতা আন্টি, প্লিজ এদিকে আসুন।”

হঠাৎ পুরনো নাম শুনে চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো মোহনা। শুধু কি মোহনা? তারিফসহ তারিফের সকল বন্ধুরাও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তারিফের এক বন্ধু সোহেল তো বলেই উঠল,” তুমি এই মাত্র কি বললে তারিন?”

তারিন সবার অবস্থা দেখে একটু নিভে গেল। দুঃখিত কণ্ঠে বলল,” কিছু না। আন্টিকে ডাকছিলাম। উনি আমার আন্টি হয়, মোহনা আন্টি।”

সিদ্দিক বলল,” কিন্তু এর আগে তুমি মাধবীলতা বললে না?”

” কই, না তো!”

” হ্যাঁ বলেছো। আমরা শুনলাম তো।”

সবাই সিদ্দিকের কথায় সম্মত হলো। মোহনা আর তারিফ দু’জনই বিব্রত। তারিন নিজেও বিব্রতবোধ করছে। সে ভেবেছিল এতো ভীড়ের মধ্যে কেউ নামটা খেয়াল করবে না। তাই মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল৷ হাসি-আনন্দের গল্প ছেড়ে সবাই এখন তারিফ-মোহনার দুঃখময় প্রেমকাহিনীতে চলে গেল। বন্ধুদের মাঝে একজন এই প্রেমকাহিনীর বিষয়ে জানতো না। তার নাম জহির। সে প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, কি ব্যাপার? এই মাধবীলতা কে?”

তারিফ ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করল,” কেউ না। একটা গান ছিল না, মাধবীলতা আমি.. তুমি কানুনবালা.. ওই গানের কথাই হয়তো বলছে ওরা।”

সোহেল বলল,” একদম না। কথা ঘুরাস কেন? জহির শোন, তারিফ যে এতোবছর বিয়ে করেনি সেটা তো এই মাধবীলতা গানের জন্যই। এতো ইন্টারেস্টিং একটা গানের ইতিহাস, তুই এখনও জানিস না?”

জহির আগ্রহী হয়ে উঠল,” কি ইতিহাস? শুনি তো একটু।”

সোহেল পেছনে ঘুরে মোহনার দিকে চেয়ে বলল,” আপনিও আসুন না আপু। আপনার নামের সাথে যেহেতু মিল আছে, প্রেমকাহিনী আপনারও শোনা দরকার। ”

মোহনা বিনয়ের সঙ্গে নিষেধ করে দিল,” না। আমি এসব শুনতে চাই না।”

সে চলে যেতে নিলেই নিহা গিয়ে থামাল,”আহা, বসো না আন্টি! শুনো একটু! আমারও অনেক ইন্টারেস্টিং লাগছে। আমি শুনলে তোমাকেও শুনতে হবে।”

নিহা জোর করে মোহনাকে এনে আসরে বসালো। নীরা, রেহেনা, সামিয়ারা খুব আগ্রহ নিয়ে বসেছে। সবাই প্রেমকাহিনী শুনতে উদগ্রীব। তারিফ চোখ পাকিয়ে বন্ধুদের হুমকি দিতে লাগল। কিন্তু কেউ তার কথা পাত্তাই দিল না। সোহেল তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই গল্প বলতে শুরু করল,

” তারিফের সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপ সেই কলেজ লাইফ থেকে। যখন আমরা নতুন ইউনিভার্সিটিতে উঠলাম তখন তারিফ চাকরি পেল একটা কল সেন্টারে। তার ডাকনাম কিন্তু তখন ছিল আশু। আমরাও আশু নামেই ডাকতাম। একদিন একটা মেয়ে মোবাইলের টাকা বেশি কাটার সমস্যা নিয়ে ফোন করেছিল। সেই মেয়ের কণ্ঠ এতো সুন্দর যে তারিফ প্রথম আলাপেই প্রেমে পড়ে গেল৷ সেই মেয়েটিই আমাদের মাধবীলতা…”

সোহেল গল্প বলে যাচ্ছে। সবার দৃষ্টি চকচক করছে। শুধু মোহনা আর তারিফের মুখ শুষ্ক। দু’জনই আবেগ লুকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এই গল্প শুনে পুরনো স্মৃতিগুলো আবার নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে, উজ্জীবিত হচ্ছে। মোহনা নিতান্তই অনাগ্রহের সাথে এখানে বসেছিল। কিন্তু যখন সোহেল তারিফের বাবার মৃত্যুর কাহিনীটা বলল, তখন খুব হকচকিয়ে মোহনা তাকাল তারিফের দিকে। গল্প শুনে সবার হৃদয় ভারী হয়ে উঠছিল। সোহেল আগ্রহ নিয়ে গল্প বলে যাচ্ছিল,” কি যে কষ্টের দিন ছিল! সিলেটে আমার মামা থাকতো। আমি খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে এসেছিলাম। তারপর তারিফকে নিয়ে মামার বাড়ি গেলাম। সেখানে সে অনেকদিন ছিল। মাধবীলতার বাবা খুব অপমান করেছিল তারিফকে। তারা ছিল বিশাল বড়লোক। তারিফ অবশ্য এটা জানতো না। জানলে হয়তো মাধবীলতার সাথে প্রেমটাই করতো না। কারণ অসম প্রেমের পরিণতি কখনও ভালো হয় না। তারিফ আর মাধবীলতার প্রেমের পরিণতিও ভালো ছিল না। মাধবীলতার বিয়ে হয়ে গেল প্রবাসী একজনের সাথে। তারিফ ঢাকায় ফিরে এলো। সে তার পরিবারের সাথেও কয়েক মাস যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিল। তারপর বাড়ি ফিরে দেখল তার বাবা মা-রা গেছে। সংসারের অবস্থা বেগতিক। তারিফ প্রেমের আবেগ মুছে ফেলে সংসারের হাল ধরল৷ তারপর নাকি একবার মাধবীলতা এসেছিল তারিফের কাছে। কিন্তু তারিফ দেখা করেনি। মাধবীলতাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।”

রেহেনা খুব মনখারাপ করে বলল,” আহা! ফিরিয়ে দিল কেন?”

” কারণ তার নিজের থাকারই জায়গা নেই। বাবা মরার পর সংসার নিয়ে পথে বসার মতো অবস্থা। দেউলিয়া অবস্থা। মাধবীলতাকে রাখবে কই? এজন্য বাধ্য হয়েই ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখনও সে বিয়ে করেনি। যদিও আমাদের কাছে স্বীকার করে না। তবুও আমরা জানি মাধবীলতার জন্যই সে বিয়ে করেনি।”

তারিফ মুখ ভার করে বলল,” কচু জানিস তোরা। আচ্ছা হয়েছে, এবার চুপ। গল্প শেষ।”

” এখনও শেষ হয়নি। তুই মাধবীলতার স্মৃতি বাঁচাতে বাড়িটা কিভাবে কিনলি সেই গল্প বলব না?”

সবাই উৎসাহী কণ্ঠে একতালে বলল,” জ্বী, জ্বী, বলেন।”

সোহেল আবার বলতে শুরু করল। ঠিক এমন সময় তারিন খেয়াল করল ঈশানও এখানে আছে। সেও বিস্ময় নিয়ে গল্প শুনছে। মোহনা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। আর সবাইকে উপেক্ষা করে সেখান থেকে চলে গেল। তারিন এই অবস্থা দেখে তারিফের দিকে তাকাল। তারিফও মোহনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারিন ভাইয়ের কাছে গিয়ে কানে কানে বলল,” ভাইয়া, মোহনা আন্টি কাঁদছিল। তুমি কি একটু গিয়ে দেখবে?”

তারিফ চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই তারিন মাথা নিচু করে ফেলল। ভয়ে আবার নিজের জায়গায় এসে বসল। এই নিয়ে আর উচ্চবাচ্যও করল না। মিনিট পাঁচেক পরেই তারিফ সেখান থেকে উঠে গেলে তারিনের ঠোঁটে হাসি ফুটল। সে জানে, তার ভাইয়া এখন মোহনা আন্টির কাছেই যাবে! তারিনও দ্রুত উঠে যেতে চাইল। ঈশান তাকে থামিয়ে বলল,” যেও না তারিন। থাকুক ওরা একা!”

তারিন আগ্রহ দমাতে পারছে না। তীব্র কৌতুহল নিয়ে বলল,” প্লিজ, দূর থেকে দেখব। একটু! আমার খুব এক্সাইটেড লাগছে।”

ঈশান মৃদু হেসে বলল,” আচ্ছা যাও।”

তারিন খুশিতে গদগদ হয়ে ঈশানকেও ধরে বলল,” আপনিও চলুন।”

বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে বকুলফুলের গাছের নিচে মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। তারিফকে দেখেই সে ঝটপট দুইহাতে চোখের জল মুছতে লাগল। তারিফ কিছু বলল না। কেবল দাঁড়িয়ে রইল। সে কেন এখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা সে নিজেও জানে না। মোহনা হঠাৎ করেই প্রশ্ন করল,” আঙ্কেল কিভাবে মা-রা গেলেন?”

তারিফ প্রশমিত কণ্ঠে উত্তর দিল,” বাবার মৃত্যু শুধু একটা এক্সিডেন্ট। এজন্য তুমি নিজেকে দায়ী ভেবো না।”

ঠিক সতেরো বছর পর ‘তুমি’ ডাকটা শুনে মোহনার হৃদয় ধ্বক করে উঠল। তারিফের দিকে আঁড়চোখে চেয়ে বলল,” আমাকে একবার জানাতে পারতে! আঙ্কেলের ওই সময় মৃত্যু হয়েছিল এটা জানলে আমি তোমাকে সেদিন ভুল বুঝে চলে যেতাম না। যত কষ্টই হোক, তোমার কাছেই থেকে যেতাম।”

তারিফ মুচকি হেসে বলল,” জানি। সেজন্যই তো বলিনি। যে মেয়ে পাগলামি করে সিলেট থেকে পালিয়ে ঢাকা চলে আসতে পারে, সেই মেয়ে ভিখারীর সাথে সংসার করার মতো চূড়ান্ত পাগলামিটা করতে আর বাদ রাখবে কেন?”

মোহনাও হেসে প্রশ্ন করল,” তুমি ভিখারী ছিলে বুঝি?”

” ওই সময় আমার অবস্থা ভিখারীর থেকেও খারাপ।”

মোহনা অভিযোগ করল,” তাই বলে আমাকে এতো নিষ্ঠুরভাবে তাড়িয়ে দিবে? একবার দেখাও করতে আসোনি। আমি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ফিরে গিয়েছিলাম। তুমি শুধু একজনকে পাঠিয়ে বলে দিলে, আমাকে আর ভালোবাসো না। কিভাবে পারলে এটা?”

” এটা না বললে তুমি যেতে না। আর দেখা করিনি ভয়ে। যদি তোমাকে দেখার পর আর যেতে দিতে ইচ্ছে না হয়? ওই সময় তোমাকে গ্রহণ করলে শুধু কষ্টই পেতে মাধবী। মা, দাদী কেউ তোমার নাম শুনতে পারতো না। কারণ তাদের মনে ধারণা জন্মে গেছিল যে তোমার জন্যই বাবা মা-রা গেছে। ”

” সত্যিই তো আমার জন্য মারা গেছে। যেদিন তুমি সিলেট এসেছিলে সেদিন যদি বাবাকে না পাঠিয়ে আমি নিজে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসতাম তাহলে হয়তো এসব কিছুই হতো না। বাবাও তোমাকে অপমান করতো না, তোমার এক্সিডেন্টও হতো না আর আঙ্কেলও বেঁচে থাকতো।”

“উহুম। ভাগ্যে যা ছিল সেটাই হতো। এখন এসব ভেবে আফসোস করে কি লাভ বলো?”

” এতোবছর ধরে তোমাকে ভুল বুঝে এসেছি। একবারও কি আমার ভুল ভাঙাতে ইচ্ছে হয়নি তোমার?”

তারিফ মাথা নেড়ে বলল,” হয়েছিল। কিন্তু যতবার ভেবেছি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব ততবারই বিবেক থেকে একটা অদৃশ্য বাঁধা এসেছে। তুমি বিবাহিত ছিলে। তোমার সুন্দর সংসার নিয়ে হয়তো সুখেই ছিলে। আমি এসব বলে কেন শুধু শুধু তোমার সুখ নষ্ট করব বলো?”

মোহনা রাগে দাঁত পিষে বলল,”তোমাকে ছাড়া আমি সুখে আছি এটা তুমি ভাবলে কেমন করে? এতোগুলো বছরে এমন কোনো দিন যায়নি যেই দিন তোমার কথা আমার মনে পড়েনি। আমার সংসারটা তো কোনো সংসার ছিল না আশু! শুধু একটা সমঝোতা ছিল। ঈশানের মা হওয়ার জন্যই আমি সেই সংসারে পড়ে ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার জায়গাটা কখনও কাউকে দিতে পারিনি।”

” আমিও কি পেরেছি? আমি তো তোমাকে ভোলার চেষ্টাও করিনি। তুমি সবসময় আমার পাশে ছিলে। শুধু তোমাকে স্পর্শ করতে পারতাম না। কিন্তু তুমি ছিলে তো.. অনুভবে, কল্পনায়, স্বপ্নে।”

মোহনা মুখে হাত চেপে কান্না সামলালো। প্রশ্ন করল আকুল হয়ে,” কেন এতো ভালোবাসলে বলোতো?”

তারিফ ছলছল দৃষ্টিতে বলল,” জানি না।”

মোহনা বাঁধনছাড়া হয়ে আছড়ে পড়ল তারিফের বুকে। শুরু করল ফুঁপিয়ে কান্না। তারিফ ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” এখনও কেন এতো কাঁদছো তুমি?”

” এটা আমার আনন্দের কান্না।”

” মানুষ আনন্দে হাসে। তুমি কি আনন্দেও ফুঁপিয়ে কাঁদবে?”

” তুমি চোখের জল মুছে দাও, তাহলে আমি আর কখনও কাঁদবো না।”

তারিফ মোহনার মুখটা তুলে খুব যত্ন করে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,” এবার তাহলে হাসো!”

মোহনা হাসল। ওই হাসি দেখে তারিফও হাসল; সবচেয়ে সুখের হাসি। দূর থেকে তাদের বিস্ময় নিয়ে দেখছিল ঈশান আর তারিন। অচিরেই ঈশানের মুখ ফুটে বের হলো,” ভালোবাসা ভয়ংকর সুন্দর, তাই না?”

তারিন বিবশ কণ্ঠে বলল,” দীর্ঘ অপেক্ষার পর হঠাৎ পেয়ে যাওয়া অতি প্রতীক্ষিত ভালোবাসা আরও বেশি সুন্দর হয়!”

এবার ঈশান তাকাল তারিনের দিকে। তারিন বামহাতে নিজের চোখের জল মুছল। তখন অন্ধকারেও ঝলমল করে উঠল তারিনের অনামিকা আঙুলের ছোট্ট হীরের আংটিটা। যা দেখে ঈশানের অনুভূতিরা টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল অনায়াসে। সুন্দর মুহূর্তটা যেন হঠাৎই ভরে উঠল বিষাক্ত বাতাসে। শ্বাস নিতে আবারও কষ্ট হচ্ছে ঈশানের। বুক ভার হয়ে আসছে। তারিন বলল,” চলুন। আমরা এখন চলে যাই।”

ঈশান অন্যদিকে ঘুরে বলল,” তুমি যাও।”

তারিন কিছু বলতে নিয়েও আর বলল না। সে নীরবে চলে যেতে লাগল। ঈশান পেছন ফিরে দেখল, তারিন সত্যিই চলে যাচ্ছে। কিন্তু ঈশান তো চায় তারিন থেকে যাক। শুধু এখনের জন্য নয়, সারাজীবনের জন্য থেকে যাক! তাছাড়া ঈশান যে ভুল করেছে সেজন্য তারিনের কাছে ক্ষমাও চাওয়া হয়নি। সে যদি ক্ষমা চায়, তাহলে কি তারিন তাকে মাফ করবে? ঈশান ডাকল,” তারিন, শোনো।”

তারিন ঘুরে তাকিয়ে হাসল। ঈশান এক নিশ্বাসে বলে ফেলল,” আই এম স্যরি। প্লিজ কাম ব্যাক!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here