তি_আমো পর্ব ৫৬

0
260

#তি_আমো
পর্ব ৫৬
লিখা- Sidratul Muntaz

ঈশানকে বিদায় দিতে সবাই বের হলো। কেবল তারিন ছাড়া। সে একটা ঘরে এসে নীরবে দরজা আটকে বসে ছিল। সে যেই ঘরে বসে ছিল, সেই ঘরের জানালা দিয়ে আবার সদর দরজায় কি হচ্ছে না হচ্ছে সব দেখা যাচ্ছিল। তারিন সেদিকেই তাকিয়ে ছিল নির্বিকার।

একটা ট্যাক্সি দাঁড়ানো। ঈশান কিছুক্ষণের মাঝেই সেই ট্যাক্সিতে উঠে যাবে। সম্ভবত মোহনা আর তারিফও ঈশানের সঙ্গে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাবে। ঈশান সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে আশেপাশে কাউকে খুঁজছে। তারিনের অযথাই মনে হলো ঈশান কি তাকে খুঁজছে? তার কি সেখানে যাওয়া উচিৎ? মনে হওয়া পর্যন্তই ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ ছিল। তারিন সেখানে গেল না। যথারীতি ট্যাক্সিতে তারিফ আর মোহনা ঈশানের সঙ্গে উঠে গেল। আর বাকিরা ঘরে ফিরে এলো। তারিন বুঝতে পারল না ঈশান চলে যাওয়ায় তার এমন কষ্ট কেন হচ্ছে? ঈশান বুঝি তাকে খুব ঋণী করে দিয়ে গেল!

দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। তারিন গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল ফাহিম দাঁড়ানো। সে মুচকি হেসে বলল,” আসুন।”

” এইখানে একলা বসে কি করছো? ”

তারিন বিছানায় বসতে বসতে বলল,” তেমন কিছু না। এমনি।”

ফাহিম এসে তারিনের সামনে বসল। তার অবগতির জন্য বলল,” তোমাকে সবাই খুঁজছিল। ঈশান ভাইকে বিদায় জানাতে এলে না কেন?”

তারিন মাথা নিচু করে বলল,” এমনি।”

ফাহিম একটু কাছে এলো। গমগমে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,” তারু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

” করুন!”

” ঈশান ভাইকে এখনও ভালোবাসো?”

তারিন একটু থমকালো। তারপর হালকা হেসে বলল,” কেন ভালোবাসবো না? ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না। কিন্তু ভালোবাসার ধরণটা বদলে যায়। সেই সাথে বদলে যায় চাওয়া-পাওয়ার ধরণ।”

” তাই? এখন তাহলে ঈশানের ব্যাপারে তোমার চাওয়া-পাওয়া কি?”

” আমি চাই সে অনেক বেশি ভালো থাকুক। সবসময় হাসি-খুশি থাকুক। তার জীবন সুখ আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক।”

ফাহিম এবার কিছুটা কঠিন হয়ে বলল,” আর যদি তুমি জানতে পারো, ঈশান ভাইয়ের ভালো থাকার জন্য তোমাকে প্রয়োজন… তখন তুমি কি করবে তারিন?”

তারিন ভ্রু কুচকে চাইল। হকচকিয়ে বলল,” এটা কেমন প্রশ্ন? ধূর!”

” আমার প্রশ্নের উত্তর দাও৷ এইটা তো অসম্ভব কিছু না। হতেও পারে যে তিনি তোমাকে এখনও ভালোবাসেন। আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে দেখে তিনি কিছু বলেননি। কিন্তু যদি তুমি এখনও তার অপেক্ষায় থাকতে তাহলে হয়তো আবার তোমাদের..”

তারিন উঠে দাঁড়ালো। যথেষ্ট রাশভারী কণ্ঠে বলল,” এটা আর সম্ভব না ফাহিম ভাই। ভাঙা জিনিস জোড়া লাগানো গেলেও সেটা আগের মতো কখনও হয় না। আর ঈশানের জন্য আমি সব কর‍তে পারব। সে আমাকে যা দিয়েছে তার জন্য আমি আজন্ম ঋণী। তাই যদি কখনও জীবন দেওয়ার প্রশ্ন আসে আমি হয়তো তার জন্য জীবনও দিয়ে ফেলতে পারব। কিন্তু আপনাকে ঠকাতে পারব না। কারণ আপনি আমার কাছে এখন আমার জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ”

ফাহিম অভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখে অশ্রু জমে গেল। হৃদয় সিক্ত হলো। নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাগ্যবান বলেও বোধ হলো হয়তো।বেশ কিছুক্ষণ পর ফাহিম শান্ত কণ্ঠে বলল,” আমার এই মুহূর্তে একটা দুঃসাহস করতে খুব ইচ্ছে করছে তারু। যদি তুমি অনুমতি দাও…”

” কি?”

” আগে বলো, অনুমতি দিচ্ছো?”

তারিন মাথা দুলিয়ে বলল,” হুম।”

ফাহিম সটান উঠে দাঁড়িয়ে তারিনের কপালে একটা চুমু দিল। তারিনের চোখ বন্ধ হয়ে গেল অনায়াসে। শরীরে ছড়িয়ে পড়ল উষ্ণ আভা। ফাহিম বিড়বিড় করে বলল,” আই লভ ইউ।”

তারিনকে ওমন স্তব্ধ অবস্থাতে রেখেই ফাহিম দরজার কাছাকাছি চলে গেল। তারিন চোখ মেলে তাকাতেই দেখল ফাহিম যেই জায়গাটায় বসেছিল সেখানে একটা উপহারের বাক্স। তারিন কিছুটা চমকে তাকাল দরজার দিকে। ফাহিম মুচকি হেসে তাকে চোখের ইশারায় বোঝালো, জিনিসটা খুলে দেখতে। তারপরেই সে চলে গেল।

তারিন এতোগুলো ধাক্কা একবারে সামলে নিতে পারল না। তার কিছুটা সময় লাগল। তারপর বড় করে শ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসল। উপহারের বাক্সটা গোলাপি র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো। তারিন যখন সেটা খুলছিল, তার হাতের আঙুল কিছুটা কাঁপছিল। কি থাকতে পারে এর ভেতর?

বাক্স খোলার পর একটা চিরকুট বের হলো। আর একটা কার্ড। কার্ডে প্যাঁচানো ইংরেজি অক্ষরে লেখা,” Happy birthday, My Beautiful Star.”

তারপর আবার বাংলায় লেখা,” আমার আকাশের একমাত্র তারা, জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা তোমার জন্য। জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত হাসি-আনন্দে ঝলমল করুক। যেভাবে আমার আকাশটা ঝলমলে করেছো তুমি। তোমার এই তেইশতম জন্মদিনটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি স্পেশাল। কেন বলোতো? কারণ গত বাইশবছর ধরে তুমি আমার থেকে দূরে ছিলে। কিন্তু এখন থেকে তুমি আমার। শুধু আমার! বিশ্বাস করো, তোমাকে পাওয়ার থেকে চমৎকার ব্যাপার আমার জীবনে আগে কখনও ঘটেনি আর ভবিষ্যতেও ঘটবে না। ভীষণ ভালোবাসি তারা!”

তারিন বিস্মিত হয়ে কার্ডটা হাতে নিয়ে চুপচাপ ওভাবেই বসে রইল। মাত্র কয়েক মুহূর্তেই যেন সে সম্পূর্ণ বোকা বনে গেছে। আজ তার জন্মদিন! অথচ এটা তার নিজেরই মনে নেই। শুধু তার কেন? কারোরই মনে নেই। নিহা পর্যন্ত মনে রাখেনি। আসলে এতো ঝামেলার মাঝে কারোই এই ব্যাপারটা মাথায় ছিল না। অথচ ফাহিম ঠিক উপহার তৈরী করে রেখেছে। কিভাবে পারে মানুষটা?

তারিন চিরকুট খোলার আগে গিফটের আরেকটা ছোট্ট বাক্স পেল, সেটা খুলল। ঝনঝন করে গড়িয়ে পড়তে লাগল একটা নুপুর, একটা বাদামী টেডি বিয়ার ঝোলানো রিং, একটা ওরনার ছেঁড়া অংশ আর একজোড়া স্বর্ণের কানের দুল। তারিন হতভম্ব হয়ে গেল। কারণ নুপুরটা তার খুব পরিচিত। কিছুক্ষণ ইনিয়েবিনিয়ে দেখতেই মনে পড়ে গেল দশম শ্রেণীতে ভাইয়া তাকে কিনে দিয়েছিল। সেই জোড়া নুপুরের একটা হারিয়ে যাওয়ায় কত জায়গায় মরিয়া হয়ে খুঁজেছিল সে! কখনও ভাবতে পারেনি সেই হারানো নুপুর আজ এইভাবে ফেরত আসবে। টেডি বিয়ারটাও তারিনের। সে যখন কলেজে পড়তো, এই টেডি বিয়ার রিংটা তার কলেজ ব্যাগে ঝোলানো থাকতো। নিহাদের বাড়িতে গিয়েই রিংটা হারিয়ে গেছিল। এতোবড় বাড়িতে ছোট্ট একটা টেডি বিয়ার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই তারিন সেই কসরত করেনি। তবে তার খুব মনখারাপ হয়েছিল। আর ওরনার ছেঁড়া অংশটাও তারই প্রিয় লেহেঙ্গার। তারিন নিজের মনেই হাসল। এতো এতো পুরনো জিনিস ফাহিম কিভাবে সংরক্ষণ করল? কতবছর ধরে জিনিসগুলো তার কাছে ছিল। বোঝাই যাচ্ছে খুব যত্নে রেখেছে। তারিন এবার চিরকুট খুলল।

” প্রিয় তারা,

খুব দেরিতে উইশ করলাম। ভেবেছিলাম বারোটা বাজলেই তোমার ঘরে আসবো। কিন্তু পরিস্থিতিটাই অন্যরকম ছিল। তাই নিজের অস্থিরতা কমাতে ভাবলাম একটা চিঠি লিখি। এই চিঠিটা আমি যখন লিখছি তখন কিন্তু ঠিক বারোটাই বাজে! তোমার জন্মদিনের প্রহর শুরু হয়ে গেছে।

নুপুর, টেডি বিয়ার আর ওরনার ছেঁড়া অংশ দেখে অবাক লাগছে? এমন আরও অনেক কিছু আমার কাছে ছিল। সব আমি সাথে রাখি না। তবে এই তিনটা জিনিস সবসময় সাথেই থাকে। তোমার মনে আছে তারু? তখন তুমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ো। এই টেডি বিয়ারটার সঙ্গে একা একা কথা বলতে। একদিন আমি তোমাকে দেখে ফেললাম। তুমি খুব লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলে..”

তারিন এইটুকু পড়ে এখনও খুব লজ্জা পেল। তখন তার বয়স মাত্র সতেরো। সে সত্যিই টেডি বিয়ারের সঙ্গে লুকিয়ে কথা বলতো। এই ব্যাপারটা কেউ জানে না। এমনকি নিহাও না। কিন্তু ফাহিম দেখে ফেলেছিল। আবার সেই কথা সে এখনও মনে রেখেছে! কি লজ্জা! তারিন বাকি লেখাটা পড়তে লাগল,

” আমার কিন্তু খুব মজা লেগেছিল ব্যাপারটা।একদিন দেখলাম তোমার টেডি বিয়ারটা দরজার কাছে পড়ে আছে। সাথে সাথে তুলে নিলাম। তোমাকে ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিলাম। আর তুমি শুনলে অবাক হবে যে এরপর থেকে আমিও মাঝে মাঝে ওর সাথে কথা বলি। প্রায় সাড়ে চারবছর ও আমার সাথে ছিল। ও হয়ে গেছে আমার পরম বন্ধু। যখনই মনখারাপ হতো, ওর সাথে কথা বলতাম। আজকে কেন ওকে ফিরিয়ে দিচ্ছি জানো? কারণ এখন থেকে আমার আর কখনও মনখারাপ হবে না। এখন আমার সাথে তুমি যে আছো!

কানের দুলজোড়া আমার মায়ের। মা বলেছিল তোমাকে দিতে। আমি রেখে দিয়েছিলাম। যাতে আজকে দিতে পারি। তাহলে হয়তো তোমার বেশি ভালো লাগবে। এবার একটা জরুরী কথা শোনো, তোমাকে জন্মদিনের গিফট হিসেবে আমি নিজে থেকে এখনও কিছু দেইনি। কারণ আমি চাই, তোমার সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটিই তোমাকে দিব। তুমি নিজের মুখে আজ আমার কাছে যা চাইবে সেটাই কিন্তু পাবে। শুধু আজকের দিনে না, তোমার জীবনে এরপর থেকে যতবার জন্মদিন আসবে প্রত্যেকবার এই এক নিয়ম কার্যকর থাকবে। এখন ঝটপট বলে ফেলো তারা, কি চাই তোমার? মনে রেখো, যা চাইবে তাই কিন্তু পাবে! আমি তোমার চাওয়া পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা করব। যদি সেজন্য আমাকে নিঃস্ব হয়ে যেতে হয় তাও সই!”

তারিন চিরকুটটা ভাঁজ করে রাখল। তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। সে ভাবতে পারছে না, ফাহিমের কাছে আজ তার কি চাওয়া উচিৎ? কি দিতে বাকি রেখেছে মানুষটা তাকে?

ঈশানকে শেষবারের মতো বিদায় দেওয়ার সময় তারিফ তার হাত ধরে কৃতজ্ঞ স্বরে বলল,” তুমি যে আমাকে কি দিয়েছো তা হয়তো তুমি নিজেও জানো না। যদি কখনও সুযোগ আসে আমি তোমার জন্য জীবনও দিতে প্রস্তুত থাকব।”

ঈশান হাসল তবে প্রতিউত্তর করল না। তারিফ আরও বলল,” আমি সবসময় তোমার জন্য দোয়া করব যেন তুমি ভালো থাকো। যখন সময় পাবে তখনি চলে আসবে। আমার বাড়ির দরজা সারাজীবন তোমার জন্য উন্মুক্ত।”

ঈশান বিনীত কণ্ঠে বলল,” এসব বলে আমাকে ঋণী করবেন না ভাইয়া। আমি যা করেছি সব আমার মমের খুশির জন্য। আর তার একমাত্র খুশি আপনি। এখন থেকে সে সবসময় খুশি থাকবে।”

” আমাদের জীবনে খুশি এনে দেওয়ার জন্যে তুমিও সবসময় খুশি থেকো।”

ঈশান এবার মোহনার দিকে চাইল। মোহনা কোনো কথাই বলতে পারছে না এই পর্যায় এসে। ঈশানকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে লাগল। ঈশান হেসে বলল,” ওহ মম, আর কত কাঁদবে? আমি তো সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি না। কিছুদিন পরেই আবার আসব।”

মোহনা কিছু বলল না। চুপ করে ঈশানকে জড়িয়ে ধরেই রাখল। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে সে। ঈশান বাধ্য হয়ে বলল,” ছাড়ো না মম। দেরি হচ্ছে।”

মোহনা এবার মাথা তুলে তাকাল। ঈশানের চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,” ভালো থাকবি, নিজের যত্ন নিবি। আর আমি বার-বার বলছি। ড্রিংক্স কিন্তু একদম নিষেধ। ইটস টু ব্যাড ফোর হেলথ। ব্যাঞ্জোর থেকে আমি সব আপডেট জানবো৷ তার সাথে কথা হয়েছে।”

ঈশান মুচকি হেসে মোহনার চোখের জল মুছে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,” ওকে।”

ফ্লাইটে ওঠার পর সে দেখল ঠিক তার পাশের আসনেই বসে আছে তারিন। ঈশান নিজের মনেই হাসল। আজ পুরো যাত্রাটা সে হয়তো তারিনকে সঙ্গে নিয়েই করবে।

সকাল সকাল উর্বশীর কাছে একটা ই-মেইল এলো। বাংলাদেশ থেকে চকলেট আন্টি ই-মেইল পাঠিয়েছে। উর্বশী খুব আগ্রহের সাথে ই-মেইলটি ওপেন করল-

” ডিয়ার উর্বশী,

কেমন আছো লিটল এঞ্জেল? বাংলাদেশে আসার পর থেকে আমি কিন্তু তোমাকে অনেক অনেক বেশি মিস করছি। গতবার ই-মেইলে তোমাকে ঈশান আর তারিনের সম্পূর্ণ কাহিনী লিখে জানিয়েছিলাম। সেই মেসেজ পড়ে নিশ্চয়ই তোমার মনখারাপ হয়ে গেছে! আজকের মেসেজ পড়ে আশা করছি তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। কারণ আজ আমি তোমাকে একটা সুসংবাদ দিতে যাচ্ছি।

ঈশান কিন্তু লন্ডনে ব্যাক করেছে। আজকে সকালেই ওকে ফ্লাইটে তুলে দিয়ে এলাম। তারপর থেকে এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না আমি৷ মনের অস্থিরতা কমানোর নিমিত্তে এই রাতেই তোমাকে লিখতে বসে গেলাম। কারণ এই মুহূর্তে তুমি ছাড়া ভরসা করার মতো আমার কেউ নেই।

জানো তো, ঈশান লন্ডনে একাই ফিরে গিয়েছে। আর ওর বাবার সাথেও কোনো যোগাযোগ নেই। আমার ছেলেটা পুরো একা হয়ে যাবে। তুমি ছাড়া ওই ভিনদেশে ওকে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ নেই। তাই ঈশানকে ভালো রাখার গুরুদায়িত্ব এখন তোমার। কেবল তুমিই পারো ওর মুষড়ে পড়া মলিন জীবনটাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করতে। ইন ফ্যাক্ট তোমার থেকে ভালো এই কাজটা কেউ পারবেই না! আর কেউ না জানলেও আমি কিন্তু জানি,আমার ছেলেকে তুমি কতটা ভালোবাসো!

প্লিজ, আমার ছেলেকে সবসময় ভালো রেখো উর্বশী। ওর মন তুমি কিভাবে জয় করবে সেটা একান্ত তোমার ব্যাপার। ঈশানের জীবনে আমার অভাব, তারিনের অভাব সবকিছু পূরণ করতে তুমি একাই যথেষ্ট। দ্রুত দেখিয়ে দাও তোমার ম্যাজিক, লিটল এঞ্জেল! আমি কিন্তু অধীর আগ্রহে সুসংবাদের অপেক্ষায় থাকব। বেস্ট অফ লাক।

-তোমার চকলেট আন্টি।”

ই-মেইলটা প্রায় রুদ্ধশ্বাসে পাঁচবার পড়ে উঠে দাঁড়ালো উর্বশী। তার মনে হচ্ছে গলায় কেউ শিকল বেঁধে দিয়েছে। খুশিও লাগছে আবার ভয়ে দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থাও হচ্ছে। ঈশানের সামনে গেলে এমনকি তার কথা ভাবলেও উর্বশীর এই অবস্থা হয়। তাও চকলেট আন্টির উৎসাহে দুইবার গিয়েছিল। একবার বাড়িতে আরেকবার তার চেম্বারে। দুইবারই ঈশান ইয়াজিনের কাছে নালিশ করার হুমকি দিয়েছে। এতেই উর্বশী ভয়ে মিইয়ে গেছে। তাই তৃতীয়বার ঈশানের সামনে যাওয়ার দুঃসাহস তার হচ্ছে না। আচ্ছা, মানুষটা এতো বদমেজাজি কেন? সে আবার উর্বশীর দূর্বল জায়গাও জানে। ইয়াজিনকে যদি ঈশান এই বিষয়ে কিছু বলে দেয় তাহলে ইয়াজিনও ফট করে বাবাকে জানিয়ে দিবে। আর উর্বশীর বাবা তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাগী বাবা। তিনি হয়তো উর্বশীর ঘর থেকে বের হওয়াও বন্ধ করে দিবেন। কি করা যায়? এমন কিছু করতে হবে যাতে ঈশান ইয়াজিনকে এই বিষয়ে কিছুই জানাতে না পারে। উর্বশী সেরকমই কিছু একটা ভাবতে লাগল।

তবে বেশ খানিকক্ষণ এই নিয়ে চিন্তা করেও কোনো সমাধান মাথায় এলো না। তার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেন? তার পছন্দের ছেলেটিই কেন তার ভাইয়ের ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড হলো? ঈশানের সাথে ইয়াজিনের পরিচয় না থাকলে ব্যাপারটা কত সহজ হতো! মোহনার সাথে উর্বশীর মা রোহিনীর বেশ ভালো সম্পর্ক। উর্বশীদের বাড়িতে যত অনুষ্ঠান হতো, মোহনা ঠিক দাওয়াত রক্ষা করতে চলে আসতো। কিন্তু ঈশান আসতো না।

মোহনা বাড়িতে এলেই সর্বোচ্চ উৎসাহে ছুটে আসতো উর্বশী। আশেপাশে খুঁজতো ঈশানকে। আর খুঁজে না পেলেই হয়ে যেতো মনখারাপ। মাঝে মাঝে সে মোহনাকে আড়ষ্ট গলায় জিজ্ঞেসও করতো,” ঈশান আসেনি আন্টি?”

রোহিনী ধমক দিয়ে বলতেন,” ঈশান কি আবার? ভাইয়া বল!”

মোহনা মুচকি হেসে বলতো,” ও এসব অনুষ্ঠান পছন্দ করে না। তাই আসেনি।”

উর্বশীর সাথে মোহনার গাঢ় সম্পর্কটা এভাবেই শুরু হয়। উর্বশী তার নাম চকলেট আন্টি দিয়েছিল এর কারণ মোহনা দেখতে খুব সুন্দর। ছেলেরা সুন্দর হলে তাদের ডাকা হয় চকলেট বয়। আর চকলেট বয়ের মা হবে চকলেট আন্টি৷ এটাই তো নিয়ম! ঈশানকে নিয়ে উর্বশীর কিশোরী বয়স থেকে লালন করা অনুভূতি মোহনা নিশ্চিত বুঝতে পারতো। কারণ
প্রত্যেকবারই উর্বশী খুব ঘটা করে সাজগোজ করতো ঈশানের জন্য। কিন্তু ঈশান কখনও ফিরে তাকালে তো! এতো সুন্দর সে, তবুও কেন ঈশান তাকে লক্ষ্য করেনি? উর্বশী ল্যাপটপ থেকে মোহনার পাঠানো তারিনের ছবিগুলো আরেকবার বের করল। কাল প্রায় সারারাত সে ছবিগুলো দেখেছে। আর মনে মনে বলেছে,” মেয়ে, তুমি বড় ভাগ্যবতী।”

আজ সারাদিন ঈশান বাড়িতেই ছিল। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন নিজের জন্য রাখা উচিৎ। তাছাড়া ইদানিং তার একা থাকতেই বেশি ভালো লাগছে। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। যার নিজের মনেই শান্তি নেই সে কি-না আবার অন্যের জীবনে মানসিক শান্তি ঠিক আনবে। হাস্যকর ব্যাপার!

দুই বোতল রেড ওয়াইন নিয়ে বসার পর ঈশানের মোহনার কথা মনে পড়ল। রিনরিনে কণ্ঠে মোহনা বলছে,” ড্রিংকস একদম নিষেধ। ইটস টু ব্যাড ফোর হেলথ।”

ঈশানের চোখ ভিজে এলো। মনের দুঃখ ভুলতে সে ত্বরিত গতিতে দুই প্যাগ গলায় ঢেলে শান্ত হলো। ব্যাঞ্জো ঈশানের ড্রাইভার এবং ব্যক্তিগত সহযোগী। সে বাড়ি ফেরার সময় ঈশানের কাছে অনুমতি চাইতে এলো,”স্যার, আমি চলে যাচ্ছি।”

” কোথায়?” ঈশানের কণ্ঠ অতিরিক্ত ঠান্ডা। ব্যাঞ্জো ইতস্তত করে বলল,” বাসায়। আমার মনে হয় না এখানে আমার আর কোনো কাজ আছে।”

ঈশান চোখ কচলাতে কচলাতে বলল,” কে বলেছে তোমার কাজ নেই? এদিকে এসো। আমার পাশে বসো। আজকে থেকে আমার সাথে গল্প করাই তোমার কাজ। এজন্য এক্সট্রা পেমেন্টও পাবে তুমি।”

ব্যাঞ্জো অধৈর্য্য নিয়ে বসল। ঈশান শ্রান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,” একটা কথা বলোতো ব্যাঞ্জো৷ সবাই শুধু চলে যায় কেন?”

ব্যাঞ্জো অনেকক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বলল,” কারণ এই মিথ্যা পৃথিবীতে একমাত্র চলে যাওয়াটাই সত্য, স্যার।”

ঈশান ফিক করে হাসল। আঙুল নেড়ে বলল,” ভালো বলেছো। চলে যাওয়াটা সত্য। আমাদের সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে। তাই না? তুমি খাবে ব্যাঞ্জো?”

” না স্যার, ঠিকাছে। আপনি খান।”

” আরেহ, লজ্জা পেও না। নাও, খাও।”

ঈশান তার রঙিন পানি ব্যাঞ্জোকেও ঢেলে দিল। তার মন রক্ষার্থে ব্যাঞ্জো সেটা গ্রহণ করল। ঈশান অন্য গ্লাসে নিজের জন্য রেড ওয়াইন ঢেলে চুমুক দিতে দিতে বলল,” আচ্ছা ব্যাঞ্জো!”

” জ্বী, স্যার?”

” তোমার এইম কি?”

ব্যাঞ্জো এবার আরও চিন্তায় পড়ে গেল এবং একই সাথে বিরক্ত হলো। বাড়ি যাওয়ার তাড়া নিয়ে এই ধরণের উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর দিতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। ডোরবেল বাজল। ব্যাঞ্জো উঠতে নিলেই ঈশান বলল,” তুমি বসো। আমি দেখছি।”

ডেলিভারি ম্যান আসার কথা ছিল। ঈশান মনে মনে সেটাই আশা করেছিল। কিন্তু দরজা খোলার পর সে হতবাক। প্রথমেই মনে হলো ভুল দেখছে না তো? নেশার ঘোরে ভুল দেখাটা খুব অস্বাভাবিক কিছু না। ঈশান চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। সামনের মানুষটি একদম বাস্তব! বিস্ময়ের চাপে ঠোঁট হা হয়ে গেল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,” বাবা!”

ঈমান সাহেব আন্তরিকভাবে অনুমতি চাইলেন,” ভেতরে আসতে বলবে না?”

ঈশান অপ্রস্তুত গলায় বলল,” হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। এসো।”

নিজে সরে সে বাবাকে প্রবেশের জায়গা করে দিল। ঈমান সাহেব সোফায় বসতে বসতে ব্যাঞ্জোর উদ্দেশ্যে বললেন,” হ্যালো।”

ব্যাঞ্জো বলল,” হায়।”

ঈশান নিরস কণ্ঠে বলল,” ব্যাঞ্জো, উনি আমার বাবা।”

ব্যাঞ্জো এবার উঠে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশ করল,” হ্যালো, স্যার!”

ঈমান সাহেব হাসলেন। ঈশানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,” তোমার মম কোথায়?”

ঈশান ব্যাঞ্জোর উদ্দেশ্যে বলল,” তুমি চাইলে এখন চলে যেতে পারো ব্যাঞ্জো।”

ব্যাঞ্জো দ্রুততার সাথে প্রস্থান করল। ঈশান সোফায় বসতে বসতে নির্বিকার গলায় বলল,” মম আসেনি।”

ঈমান সাহেব মৃদু হেসে বললেন,” আমি জানতাম সে আসবে না।”

ঈশানের মুখের ভাব গম্ভীর হলো। কণ্ঠে কঠোরতা মিশিয়ে বলল,” তুমি কি সবকিছু জেনেই ইনটেনশনালি এখানে এসেছো?”

” আমাকে ভুল বুঝো না। তুমি আমার ছেলে। তোমার সব খোঁজ-খবর আমাকে রাখতে হয়। তোমার মমের বিয়ে কবে হচ্ছে?”

” এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না।”

” সমস্যা নেই। আমি জেনে নিবো। তুমি কি বিয়েতে যাচ্ছো?”

” হ্যাঁ অবশ্যই। তুমি চাইলে তোমাকেও নিতে পারি। যাবে নাকি?”

ঠাট্টার সুরেই প্রশ্নটা করল ঈশান। ঈমান সাহেব তা বুঝতে পেরে ঠোঁট উল্টে বললেন,” না৷ আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। আমি এসেছিলাম এখানে একান্তে তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে। যে কথাগুলো তোমার জানা দরকার।”

” হুম, বলো। আমি একাই আছি। এখন থেকে সবসময় একাই থাকব।”

” একা থাকার প্রয়োজন যেন না হয় তাই আমি ঠিক করেছি এখন থেকে তোমার সঙ্গে থাকব।”

ঈশান কাশতে শুরু করল। ঈমান সাহেব তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,” আমাকে তুমি অপছন্দ করো সেটা আমি জানি। বাবা হিসেবে আমি অপদার্থ, স্বামী হিসেবে ব্যর্থ। কিন্তু একটা ব্যাপার কি কখনও চিন্তা করে দেখেছো? আমার জায়গায় যদি অন্যকেউ থাকতো তাহলে তোমার মম কিন্তু এতো স্বাধীনতা পেতো না যত স্বাধীনতা আমি তাকে দিয়েছিলাম।”

ঈশান ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকাল। ঈমান সাহেব অমায়িক হেসে বললেন,” আমি তো সবসময় চাইতাম সে চলে যাক; তার যেখানে খুশি! সে তো কোনোদিন আমাকে মন থেকে মেনে নেয়নি আর আমিও কোনোদিন তার মনের উপর জোর খাটাতে যাইনি। তুমি তাকে পেয়ে খুশি ছিলে, সে তোমাকে পেয়ে খুশি ছিল আর তোমাদের এই খুশিতে আমিও খুশি ছিলাম। ঈশান তুমি কি জানো? আমি তোমার মমকে কতটা ভালোবেসেছিলাম?”

ঈশান তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” হুহ! মিথ্যা। ভালোবাসলে যেতে দিলে কেন তাকে?”

ঈমান সাহেব আর্দ্র গলায় বললেন,” ভালোবাসি বলেই তো যেতে দিয়েছি তাকে!”

ঈশান নিশ্চুপ হয়ে গেল। ঈমান সাহেব কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন,” তুমি হয়তো আমার উপস্থিতি সহ্য করতে পারছো না। আমার এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। আমি আসছি। যদি কখনও দরকার হয় তাহলে ভুলে যেও না যে তোমার একজন বাবা আছে..”

ঈমান সাহেব দরজা পর্যন্ত এগোতেই পেছন থেকে ডাক এলো,” বাবা।”

ঈমান সাহেব থামলেন। পেছনে তাকিয়ে একবার দেখলেন ছেলের মুখটি। ঈশান তখনও সোফায় বসে ছিল। তারপর হঠাৎ করে সে বাবার দিকে তাকাল। ঈমান সাহেবের চোখে অশ্রু এসে গেছে। ঈশান দৌড়ে এসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আই লভ ইউ বাবা। প্লিজ ডন্ট লীভ মি এলোন।”

ঈমান সাহেব স্নেহপূর্ণ মুখে হাসলেন।

তারিনের একটা ভালো ছবি নিয়ে রান্নাঘরে এলো উর্বশী। রোহিনী ডিনার তৈরী করছে। উর্বশী মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,” মাম্মা, একটা কুয়েশ্চন করি?”

” কি কুয়েশ্চন?”

” এই মেয়েটাকে দেখতে কেমন?”

রোহিনী ভ্রু কুচকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে বললেন,” বাঙালি নাকি? কোথায় পেয়েছিস এই মেয়ের ছবি?”

” আহা, কোথায় পেয়েছি সেটা জেনে তোমার কাজ কি? তুমি শুধু বলো ওকে দেখতে কেমন?”

” উমম… খুব সুন্দর। বলিউডের দিয়া মির্জার মতো দেখতে।”

উর্বশী যথেষ্ট মনখারাপ নিয়ে বলল,” সত্যি? এতো সুন্দর!”

” তুই আফসোস করছিস কেন? এই মেয়ে যেমনই হোক, আমার মেয়ের কাছে কিচ্ছু না।”

” ইশ, বাড়িয়ে বলছো।”

” সত্যি! আমার মেয়ে হলো ঐশ্বরিয়া।”

” হয়েছে থাক, তুমি তো বলিউড ছাড়া আর কিছুই বোঝো না।”

উর্বশী ড্রয়িংরুমে এসে ল্যাদারের জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে নিল। রোহিনী হাঁটতে হাঁটতে পেছনে এসে প্রশ্ন করলেন,” এই সময় কোথায় যাচ্ছিস?”

” কাজ আছে। ফ্লোরিডার বাসায় যাচ্ছি। রাতে ওখানেই থাকব।”

” হুট-হাট বাড়ি থেকে বের হওয়ার বদঅভ্যাস হয়ে গেছে নাকি তোমার? এমন করলে মেইন দরজা লক করে রাখতে হবে।”

ইনজাদ সাহেবের গম্ভীর এবং ভারী কণ্ঠ শোনা গেল৷
নীরবে বই পড়ছিলেন বলে তার উপস্থিতি কেউই টের পায়নি।উর্বশী বাবার গমগমে কণ্ঠ শুনে আৎকে উঠে ভীতদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। রোহিনী ইশারা দিয়ে বলল,” নিশ্চিন্তে যা। তোর বাবাকে আমি ম্যানেজ করে নিবো।”

উর্বশী নিচু কণ্ঠে বলল,” পরীক্ষার জন্য যাচ্ছি বাবা৷ সামনে তো এক্সাম।”

ইনজাদ সাহেব হাসলেন। উর্বশী দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

বাবা আর ছেলে একসাথে বসে রঙিন পানির স্বাদ নিচ্ছিল। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লেন ঈমান। ঈশান বসে আছে একাকি। তার মনটা এই মুহূর্তে খুব ভালো লাগছে। অকারণেই সে হাসছে। মোহনাকে একবার ফোন করে বলতে ইচ্ছে হলো,” আমাকে নিয়ে একদম টেনশন কোরো না মম। আমি আর একা নেই। বাবাও এখন আমার সাথে আছে। আমি আর বাবা, উই আর ফ্যামিলি।”

কলিংবেল বাজল। ঈশানের মনে হলো কোথাও মিউজিক বাজছে। সে মিউজিকের তালে তালে নাচতে লাগল। তখন কলিংবেল আবারও বেজে উঠল। ঈশান অবাক হয়ে বলল,” মম, তুমি এসে গেছো? ওয়াও!”

দরজা খোলার পর ঝাপসা দৃষ্টিতে সে দেখল একটি রমণীকে। মেয়েটির লম্বা চুল, বড় চোখ, পাতলা মুখ, ঠোঁটে দুষ্ট হাসি। ঈশান চমকিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কে আপনি?”

উর্বশী আশাহত গলায় বলল,” প্রত্যেকবার দেখা হওয়ার পরেই কি আপনি আমার চেহারা ভুলে যান? এই পর্যন্ত আমাদের দেখা হয়েছে মোট পঁচিশবার। হাফ দেখা হয়েছে একশো ছিয়াশি বার। ”

ঈশান কড় গোণার চেষ্টা করে বলল,” হাফ দেখা মানে কি?”

” হাফ দেখা মানে হলো আমি শুধু লুকিয়ে দেখেছি। কিন্তু আপনি আমাকে দেখেননি।”

ঈশান কিছু না বুঝে মাথা চুলকাতে লাগল। উর্বশী তার অবস্থা লক্ষ্য করে খানিকটা চিন্তিত স্বরে বলল,” আরে আপনি এমন টলছেন কেন? অসুস্থ নাকি? আপনার চোখ এমন লাল কেন?”

কাছে এসে ঈশানের চোখ টেনে দেখতে লাগল উর্বশী। ঈশান অতি বিরক্ত হয়ে তার হাত সরিয়ে প্রশ্ন করল,” আপনি কি ডাক্তার?”

” না। ডাক্তার তো আপনি। ফিলিংসের ডাক্তার। অথচ নিজেরই কোনো ফিলিংস নেই। রোবট কোথাকার!”

” আরে, আরে, আপনি আমার বাড়িতে ঢুকছেন কেন? বের হোন!”

” সব লুটপাট করব আজ। তাই ঢুকছি।”

” হোয়াট?”

ঈমান সাহেব এতো শব্দ শুনে জেগে উঠলেন। ঘোরমাখা গলায় জানতে চাইলেন,” কি সমস্যা? কে এসেছে?”

উর্বশী বিনয়ের সাথে বলল,” হ্যালো আঙ্কেল, আসসালামু আলাইকুম। ”

তারপর ঈশানের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,” আঙ্কেল যে আছে এটা আগে বলবেন না?”

ঈশান তেরছা দৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে বলল,” বাবা এটা তোমার কয় নম্বর গার্লফ্রেন্ড দেখো তো?”

উর্বশীর চোখ গোল হয়ে গেল। ঈমান সাহেব আশ্চর্য কণ্ঠে বললেন,” যাহ, এইটুকু মেয়ে আমার গার্লফ্রেন্ড হবে কেন? এটা তো একটা স্কুল গার্ল।”

উর্বশী খিটমিট করে বলল,” আমি স্কুল গার্ল না।”

ঈশান অবাক হয়ে বলল,” আমারও তো কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। তাহলে আপনি কে?”

উর্বশী জবাব না দিয়ে ভেতরে যেতে লাগল। ঈশান তার পেছনে যেতে নিলেই ঈমান তাকে ডেকে বললেন,” গুড চয়েজ। মেয়েটা অনেক সুন্দর। ”

ঈশান হতাশ কণ্ঠে বলল,” কিন্তু আমি তো তাকে চিনিই না।”

তারিন স্তব্ধ, বিমূঢ়। একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা তার শরীর বেয়ে উঠে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো সেটা অশ্রু হয়ে নির্গমন করবে। আজ তারিনের গায়ে হলুদ ছিল। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। এই মাত্র নিহার কাছে সে জানতে পারল ঈশান বিয়েতে আসছে না। জরুরী কাজের বাহানায় সে আসতে নাকচ করে দিয়েছে। একই দিনে মোহনা আর তারিফেরও বিয়ে। অথচ ঈশান আসবে না! এর পেছনে কারণটা কি?

নিহা শাড়ি-গয়না সব গুছিয়ে রাখছিল। তারিনকে অনেকক্ষণ ধরে নিশ্চুপ দেখে সে প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে তারু? সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে মনখারাপ লাগছে?”

তারিন আনমনা হয়েই বলল,” না। আমি ভাবছি অন্য একটা কথা।”

” কি কথারে?”

নিহা কাজ ছেড়ে তারিনের দিকে মনোযোগ দিল। তারিন চোখের কোণ মুছতে মুছতে বলল,” ঈশান বিয়েতে কেন আসছে না? এই বিয়ের জন্য তো সে নিজেই মোহনা আন্টি.. মানে ভাবীকে রাজি করিয়েছিল।”

” হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছে। সমস্যা তো থাকতেই পারে।”

” সে ফিরে গেলই কেন? দেশেই তো থাকতে পারতো৷ আমার মনে হচ্ছে…”

তারিন থেমে গেল। নিহা তার কাঁধে হাত রেখে জরুরী কণ্ঠে জানতে চাইল,” কি মনে হচ্ছে, বল?”

তারিন কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল,” সে হয়তো আমার জন্যই আসবে না।”

” তোর জন্য কেন? তুই কি করেছিস?”

” আমার মনে হচ্ছে সে এখনও আমাকে ভালোবাসে। যদি সেটাই হয় তাহলে দুইবছর কোথায় ছিল? আর হঠাৎ করেই বা কেন এলো?”

” তুই অযথাই এসব ভাবছিস তারু। নিজেকে দোষারোপ করিস না। তুই ফাহিম ভাইয়ের কথা চিন্তা কর। তাকে তুই ভালোবাসিস তো?”

” নিঃসন্দেহে! তার মতো মানুষকে ভালো না বেসে থাকা অসম্ভব।”

” ঈশান ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসিস?”

তারিন মুখ ফিরিয়ে বলল,” সেটা বলতে পারব না। ভালোবাসায় তুলনা করা যায় না। তবে ঈশানের জন্যই ভাইয়া আর ভাবী এক হয়েছে। তাই ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার জন্য যদি ও কষ্ট পায়, তাহলে আমি নিজেকে মাফ করতে পারব না।”

” সেও তোকে কষ্ট দিয়েছিল৷ তাই ধরে নে কাটাকাটি হয়ে গেছে। এবার হাস তো।”

নিহা এই কথা বলে নিজেই হাসতে লাগল। যদিও সে জানে, তারিনের ধারণা একদম সঠিক। ঈশান তো সত্যিই তারিনের জন্য কষ্ট পাচ্ছে। এটা নিহা জানে। কিন্তু তারিনকে এই কথা জানিয়ে সে বিভ্রান্ত করতে চায় না। আগামীকাল তারিনের বিয়ে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here