#চেনা_পথে,০৫
#Tahmina_Akhter
মাশফি বাড়িতে পৌঁছে কারো সঙ্গে দেখা না করেই সোজা রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজকের সকালটা মন ভরে দেখার তীব্র ইচ্ছে জেগেছে। ভোরের মতো ওতটা স্নিগ্ধতা হয়তো নেই তবু্ও যেন ভালো লাগার কমতি নেই। সূর্য মামার রোদ ধীরে ধীরে প্রখর হয়ে ওঠছে। পাখ-পাখালির ডাক যদিও শহরে খুবই কম শোনা যায় তবে আজ দূর থেকে নাম জানা একটি পাখির ব্যাকুল ডাক শোনা যাচ্ছে। হয়তো,, সঙ্গী নেই বলে তার এত ব্যাকুলতার ডাক!
মাশফির চোখে-মুখে হাসির রেখার ছাপ। চোখদুটোতে যেন অন্যরকম এক মুগ্ধতা লেগে আছে।
গোলাপি রঙের থ্রী-পিছ পরনে,, ভেজা চুল ছেড়ে দেয়া সেই এলোকেশীর মুচকি হাসিতে আজ মন বেঁধেছে মাশফির।
আদিবার আজ মন খারাপ। বিষন্ন স্বরে আনমনে নিজের সঙ্গে কথা বলছে,,
” আন্টিকে আজ দুদিন ধরে দেখছি না বলে আমার মন ভীষণ খারাপ। আন্টি যদি বৃহস্পতিবারে আমাকে বলতো যে উনি বাড়িতে যাবেন তাহলে আমি কোনোভাবে নানুর বাসায় যেতাম না। আন্টির কাছে শুক্রবার দিন পড়তাম। ইশশ্ আন্টি কবে আসবে তুমি? আই মিস ইউ সো মাচ”
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আদিবার সব কথা শুনেছে আদিবার দাদি মিনা। আদিবার মন খারাপ দেখে মিনারও ভালো লাগছে না। কি করে আদিবার মন ভালো করা যায় সেটা নিয়ে আপাতত ভাবছে সে। ভাবতে ভাবতে মিনার মনে হলো আদিবার সাথে মধুর মোবাইলে কথা বলিয়ে দিলে কেমন হয়? বেচারি মনটা কিছুটা হলেও ভালো হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। নিজের ঘর গিয়ে মোবাইলটা এনে আদিবার রুমের দরজায় নক করলো। আদিবা ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলে মিনা ঘরের ভেতরে ঢুকে তাড়াহুড়া দেখিয়ে বললেন,,
— আদিবা তোর কাছে মধুর মোবাইল নাম্বার আছে? মেয়েটার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল।
আদিবা খুশি হয়ে দাদির সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
— আন্টির নাম্বার তো আমার পুরোটাই মুখস্থ। দাও মোবাইলটা ; কল দেই।
মিনা মোবাইলটা আদিবার হাত দেয়। আদিবা নাম্বার উঠিয়ে কল দিলো। চারবার রিং বাজতেই ওপাশে কল রিসিভ হলো।
— হ্যালো,, আন্টি কেমন আছো??
আদিবার গলা পেয়ে মধু অনেকটা অবাক হয়ে উত্তর দিলো,,
— ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?? নাম্বার কোথায় পেলে আমার??
মধুর কথায় আদিবা মাথা চুলকানোর ভান করে। নাম্বার কোথায় পেয়েছে এটা তো বলা যাবে না। বললে আন্টি মাইন্ড করবে। তাছাড়া,, দাদিও বকবে।
— আন্টি তোমার সঙ্গে দাদি কথা বলবে।
কথাটি বলে ওর দাদির হাতে মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় আদিবা। এদিকে মিনা উনার নাতনির কান্ড দেখে হাসছেন। এতক্ষণ কি-না মন খারাপ ছিল আর এখন বাঁদরের মতো নাচতে নাচতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
— হ্যালো,, কেমন আছো মধু?
— আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমি ভালো আছি. আপনি কেমন আছেন?
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আমি। আসলে হয়েছে কি তোমার জন্য আদিবার মন খারাপ তাই তোমার সাথে কথা বলিয়ে দেয়া। কবে আসবে???
— এই তো আগামীকাল সকালে রওনা হবো। ইনশাআল্লাহ,, পরশু দিন থেকে আদিবাকে পড়াতে আসব। আদিবাকে জানিয়ে দেবেন আন্টি।
— আচ্ছা বলব ওকে। ভালো থেকো।
— জি আন্টি। আল্লাহ হাফেজ।
কথা শেষ করতে না করতেই মধুর মা এসে মধুকে প্রশ্ন করছেন কার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলছিল? মধু বললো ওর ছাত্রী এবং ছাত্রীর দাদির সঙ্গে। কবে থেকে পড়াতে যাব এটা বলে দিয়েছি। মধুর বাঁকা চোখে তাকিয়ে মেয়েকে বললেন,,
— কই তোর অন্য টিউশনি থেকে তো কেউ কল দিলো না। এরা কেন কল দিলো?
— মা তুমি কি সন্দেহ করছো?
মধু বিরক্ত হলো ওর মায়ের কথায়। একটা সাধারণ বিষয়কে এতটা জটিল করে দেখার কি আছে? আশ্চর্য তো!
— তুই কিন্তু পরের আমানত। এটা খেয়াল রাখিস। যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে তোর বাপের আর আমার গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
নাসিমা চলে গেলেন। এদিকে মধু মন খারাপ করে হাঁটুতে মাথা গুজে বসে রইলো। আমানত! শব্দটা যেমন ভারী তেমন একে বহন করা আরও বেশি কঠিন।
বাসের জানালার ধারে বসে আছে মধু। চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছে। বাবা-মা যদিও বাস কাউন্টার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছেন। বাবা যতটা সহজ হয়ে মধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন ঠিক ততটাই কঠিন হয়ে কথা বলছিলেন মধুর মা। মধুর মা কি মধুকে অযথাই সন্দেহ করছে না?
গতকালের ঘটনার পর থেকে মধুর মা কেমন করে যেন বারবার মধুর সঙ্গে কথা বলছেন। ইনিয়েবিনিয়ে সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কেন? মধুর তো সব কিছুই তো মনে আছে। ভুলে যাওয়ার মতো সম্পর্কে তো আর সে বাঁধা পরেনি।
মাঝেমধ্যে মধুর মনে হয় শুধুমাত্র নামে মাত্র সম্পর্ককে এভাবে চলতে দেয়া যায় না। কিন্তু,, বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলা হয় না। কারণ,, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের কিছুই বলতে নেই। নয়তো,, সমাজ কিংবা পরিবার বাঁকা চোখে তাকাবে। চরিত্রের ওপর আঙুল তুলবে। মধুর এত শক্তি আছে নাকি ঝড় সইবার?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসের সীটে মাথা এলিয়ে দেয়। যা হবার হবে। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হোক তারপর বাকি যা কিছু আছে তা নিয়ে ভাবা যাবে।
——————-
মধু চট্টগ্রামে এসেছে আজ দুদিন হলো। আজ আদিবাকে পড়াতে যাবে। ভার্সিটি থেকে এসে কোনোমতে গোসল সেরে ভাত খেয়ে রওনা হলো আদিবাকে পড়ানোর উদ্দেশ্য।
রোজই দশমিনিটের পথ হেঁটে যায় মধু। শরীরও ভালো থাকলো পকেটের টাকা দুটো বাঁচলো। ছোটবেলায় বাবা যখন দশটাকা দিত তখন কোনো কিছু না ভেবে খরচ করে ফেলত। চিন্তা যে ছিল না তখন। কিন্তু, আজকের দিনে এসে দশটাকা খরচ করার আগে দশবার ভাবতে হয় মাস শেষে কারো কাছে গিয়ে হাত পাততে হবে না তো?
আদিবাকে আজ ড্রইংরুমে পাওয়া গেছে। বসে বসে টিভিতে কার্টুন দেখছিল হয়তো। মধুকে দেখতে পেয়ে আদিবা অনেক খুশি হয়।কিন্তু, মুখ দেখলে মনে হবে আট-দশটা দিনের মতো আজকেও মধুকে দেখে আদিবার মনে কিঞ্চিত পরিবর্তন হয়নি।
মধু আদিবাকে বললো ওর বইখাতা এখানে নিয়ে আসতে। আদিবা একদৌঁড়ে গিয়ে ওর প্রয়োজনীয় বই খাতা নিয়ে চলে এলো।
মধু বই খুলে আদিবাকে ইংলিশ পড়াচ্ছিল এমন সময় বাড়ির বাইরে থেকে ভেতরে আসতে দেখা যায় মাশফিকে। মধু ওর মাথার ওড়না আরেকটু টেনে বসলো। যতটা পারা যায় ধীর কন্ঠে আদিবাকে পড়াচ্ছে।
মাশফি পায়ের জুতা জোড়া খুলে স্যু রেকে রেখে ড্রইংরুম পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল। হুট করে মাশফির মনে হলো ও মধুকে দেখেছে। ঘাড় ফিরিয়ে সোফার দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যি সত্যি মধু বসে আছে মাথায় ইয়া বড়ো ঘোমটা চাপিয়ে। মাশফির মুখ হাসি ফুটে ওঠলো অকারণেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। মধু অতি সন্তর্পনে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো মাশফি চলে গিয়েছে কিনা? না সে নেই। নিজের এমন আচরণের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নয় মধু। যদিও পরপর দুবার ওমন ইন্সিডেন্টের কারণেই হোক মধুর আনইজি ফিল হতো। কিন্তু,, সেদিন সকালে মাশফির সাথে হবার পর মধু কিছুটা সহজ হয়।
তবে এতটাও সহজ হতে পারেনি যে তার সঙ্গে বসে আলাপ করবে কিংবা সৌজন্যতা বজায় রেখে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করবে।
আদিবার পড়া শেষ হতেই মধু চলে যায়। মধু চলে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পর মাশফি তাড়াহুড়ো করে ড্রইংরুমে আসে। কিন্তু,, যার জন্য এত তাড়াহুড়ো করলো সেই তো নেই? আদিবাকে জিজ্ঞেস করলে ও জানায় যে কিছুক্ষণ আগেই সে চলে গেছে।
মাশফি মাথায় হাত রেখে কিছু একটা ভাবলো। তারপর,, এক দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। দরজায় লক করে সর্বপ্রথম নিজের মোবাইলটা হাতে নিলো। তারপর,, কল লিস্টে ঢুকে একটি নাম্বার বের করলো। এই নাম্বারটা নিতে যে পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে বাপরে বাপ সেই কথা ভাবতে গেলে গলা শুকিয়ে আসে মাশফির।
কিছু একটা করলো তারপর মোবাইলটা বিছানার ওপর রেখে মাশফি হাসতে হাসতে কিছু একটা ভাবলো। বেচারার মুখটায় লাল আভা ফুটে ওঠে।
” কাজলচোখের নেশায় ডুবে গেছে মন। চোখের সমুদ্রে কি করে সাঁতার কাটতে হয় তা তো জানা নেই। একটু সাহায্য করবে কি?যদি সাহায্য না করো তবে তোমার সেই বিশাল ঘোমটার ভেতরে আমার মুখ ঢুকিয়ে নিষিদ্ধ একটি কাজ করে বসব। তখন কিন্তু,, আমাকে বকতে পারবে না ”
স্টুডেন্টকে পড়ানোর সময় হুট করে মেসেজ টোন বেজে ওঠলে মধু হাতে নিয়ে চেক করে। কিন্তু,, অচেনা নাম্বার থেকে এমন ভয়ানক প্রস্তাব পেয়ে আপাতত মধুর গা কাঁপছে। আচ্ছা,, এমন নয়তো ভুল করে ওর নাম্বারে কেউ এই মেসেজটা পাঠিয়েছে? আর যদি সত্যি হয় তাহলে মধুর কি হবে? ভেবে মধুর গা কাঁপছে। আজ বুঝি জ্বর চলে আসবে!
#চলবে