চেনা_পথে,১৩,১৪

0
321

#চেনা_পথে,১৩,১৪
#Tahmina_Akhter

১৩.

সেন্টারে এসে যখন দেখলো মধু নেই তখন মাশফির উত্তর দেয়ার মুখ থাকে না ওর পরিবারের কাছে। কারণ,, আবৃত্তি কল করে বলেছিল দুজনকে একসঙ্গে আসতে। কিন্তু,, মধু…

মিনা এবং আবৃত্তি বেশ কয়েকবার মধুর নাম্বারে কল করলো কিন্তু রিসিভ করছে না মধু। উপায়ন্তর না পেয়ে আবৃত্তি এসে মাশফির মোবাইল ফোন থেকে মধুর নাম্বারে কল করলো।

সিএনজি থেকে সবে বাড়ির সামনে নেমে মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মধু। আবৃত্তির এবং মিনার নাম্বার থেকে কল আসছে তা দেখা সত্ত্বে মধু কল রিসিভ করেনি। কল রিসিভ করলে বিয়েতে যেতে বলবে৷ কিন্তু,, এই মূহুর্তে মধুর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। একাকিত্ব বোধকে অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ যেন উপভোগ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তার মন।

বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগে আবারও কল আসলো মধুর মোবাইলে। মধু মোবাইলের স্ক্রীণে চোখ রাখলো দেখার জন্য যে আসলে কে কল করেছে? কিন্তু,, আগত যেই নাম্বার থেকে কল এসেছে সেই নামটা দেখে আপাতত বিস্ময়ের সীমা পেরিয়ে গেছে।

“অচেনা” নামে সেইভ করা সেই নাম্বার থেকে কল এসেছে। বহুকাল আগে এই নাম্বার থেকে মধুর যেন বার্তা আসত। তাও যেমন তেমন বার্তা না হৃদয় কাঁপানো বার্তা। যার মন ভুলানো শব্দ পড়ে মধু নিজের অবস্থান, নিজের পরিচয় ভুলে গিয়েছিল।

কলটা কেটে যায়। মধুর চোখ থেকে জল গড়িয়ে মোবাইলের স্ক্রীণে পরলো। আবারও কল বাজছে মধু দোটানায় ভুগছে আদৌও কি তার কল রিসিভ করা উচিত? ভাবতে ভাবতে মধু কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ ভেসে এলো। খুব পরিচিত একটি কন্ঠ। আদিবার মা আবৃত্তির।

— মধু তোমাকে এতবার কল দিচ্ছি রিসিভ করছো না কেন? মা, আমি কতবার আমাদের নাম্বার থেকে এতবার কল করলাম কিন্তু রিসিভ করলে না। যেই না মাশফির নাম্বার থেকে কল করলাম ওমনি রিসিভ করলে। আমাদের সঙ্গে রাগ করেছো মধু। নয়তো, আমাদের কল রিসিভ করলে না কিন্তু মাশফির নাম্বার দেখে রিসিভ করলে। কারণ মাশফির নাম্বার তো আর তোমার কাছে নেই ।

আবৃত্তির কথার ফাঁকে মধু কিছু বলতে যেয়েও বারবার আঁটকে যাচ্ছিল। সেই পুরনো নাম্বার মাশফি সাহেবের! মানে কোনো হিসেব মেলাতে পারছে না মধু। ওদিকে আবৃত্তি বারবার হ্যালো বলছে মধুর কানে ঢুকছে না। একটা সময় পর আবৃত্তি কল কেটে দিয়ে আবারও কল ব্যাক করলো। তবে মধু রিসিভ করলো না। ব্যাগে মোবাইল রেখে সোজা বাড়িতে ঢুকলো। বহুবছর আগের পুরনো হিসেবের অংকের সমস্যাগুলো আজ হয়তো সমাধান মিলবে।

★★★★★★★★★★★

আদিবার বিয়েতে মধু এটেন্ড করেনি বিধায় আদিবার বেশ অভিমান জমা হয় মধুর প্রতি। বৌ ভাতের অনুষ্ঠানের পর সে যখন নিজের বাড়িতে ফিরে এলো তখন মধুর কাছে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল কেন ওভাবে কাউকে না জানিয়ে চলে গিয়েছে? প্রতিউত্তরে মধু হাসিমাখা গলায় বললো,,

— তোমার চাচ্চু জানে আদিবা।

মধুর এমন উত্তর মোটেও পছন্দ হয়নি আদিবার। এমন গা ছাড়াভাবেও কি উত্তর দেয়া যায়? চাচ্চু যদি কারণ জানে তবে আমাদের জানায়নি কেন? আদিবা একবার গিয়েছিল মাশফিকে জিজ্ঞেস করতে কিন্তু সাহসে কুলোয়নি বিধায় ফিরে আসে।

মাশফির জাপানে ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। হাতেগোনা আর একসপ্তাহ আছে বাংলাদেশে। আদিবার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল দুদিন থাকার পর আজ ফিরে এসেছে। বাড়িতে ঢুকার পর সর্বপ্রথম যে মুখটা দেখলো তা দেখে মাশফির অবাক হবার কথা কিন্তু মাশফিকে খুবই স্বাভাবিক দেখালো। খুব পরিচিত মানুষের সঙ্গে যেমন আমাদের দেখা হলে আমরা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করি ঠিক সেভাবেই মাশফি মধুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,

— ভালো আছেন? সেদিন না বলে চলে গিয়েছিলেন কেন?

মাশফির কথায় মধুর হাসি পায় তবে প্রকাশ্যে তো হাসা সম্ভব নয়।

— ভালো আছি। সেদিন চলে গিয়েছিলাম বলেই আমার চোখের সামনে থাকা কুয়াশা পরিষ্কার হয়ে একফালি রোদ্দুর দেখেছি। যেই রোদ্দুরের অপেক্ষায় আমি এতকাল যাবত অপেক্ষা করছিলাম।

মধুর কথাবার্তার মানে কিছুই বুঝতে পারছে না মাশফি। তবুও ভদ্রতার খাতিরে হাসিমুখে মধুর কথা শুনছে।

এমনসময়,, রান্নাঘর থেকে আবৃত্তি এলো হাতে দুটো চায়ের কাপ নিয়ে। কিন্তু,, মাশফিকে দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো,,

— আরে মাশফি তুমি কখন এলে?? দেখো কান্ড আমি মাত্র দুই কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এলাম।

— থাক ভাবি আপনারাই ইন্জয় করুন। আমি বাইরে যাব একটু। চলে যাওয়ার আগে কিছু ফ্রেন্ড চাচ্ছে গেটটুগেদার পার্ট করতে। তো ভাবলাম আজ রাতেই হোক। নয়তো,, সময় হবে না পরে।

মাশফি এতটুকু বলে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আবৃত্তি মধুর দিকে একটি চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেয়। মধু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আবৃত্তিকে জিজ্ঞেস করলো,,,

— মাশফি সাহেব চলে যাবেন নাকি?

— হুম ছয়দিন পর ফ্লাইট। মা এতবার করে অনুরোধ করলো দেশে একেবারে থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু,, মাশফি রাজি হলো না। বললো,, দেশে থাকলে নাকি দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে। এখন তুমিই বলো কোনো সন্তান যদি তার মা’কে বলে দেশে থাকলে দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে। তাহলে কোনো মা তার সন্তানকে আটকানোর চেষ্টা করবে? বিদেশে থেকে যদি বেঁচে থাকে তবে বেঁচে থাকুক।

মধু কাপের অবশিষ্ট চা টুকু শেষ করে আবৃত্তির হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে বললো,,

— আপু,, আসছি আমি। এটা মাশফি সাহেবকে দিয়েন তো কষ্ট করে।

আবৃত্তি মধুর হাত থেকে নীলছে রঙা খামটা নিলো। মধুর দিকে তাকালো উত্তর পাবার আশায়। মধু মুচকি হাসি দিয়ে বললো,,

— সময় হলে জানতে পারবেন। অনুরোধ রইলো আপনি এটা খুলে পড়বেন না।

মধু চলে গেলো। আবৃত্তি খামটি আবারও উল্টেপাল্টে দেখলো। তারপর,, মাশফির ঘরের দিকে যাচ্ছে খামটা দেয়ার জন্য।

মাশফি সবে বিছানায় শুয়েছিল। পিঠে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। যেহেতু সন্ধ্যায় বের হবে তাই একঘন্টা ঘুমিয়ে নিলে সুবিধা হবে।

এমনসময় দরজার কড়া নড়ে। মাশফি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললে আবৃত্তিকে দেখতে পেলো। যদিও আবৃত্তিকে দেখে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ মনে হচ্ছে মাশফির কাছে।

— কিছু বলবেন ভাবি??

— আসলে.. হয়েছে কি? মানে আমাদের আদিবার ম্যাম মধু বললো তোমাকে এটা দিতে।

খামটি মাশফির দিকে বাড়িয়ে আবৃত্তি বললো। খামটির দিকে তাকিয়ে মাশফি অবাক এবং বিস্মিত হলো। এক, মধুর ওকে চিঠি দেয়ার কথা না। দ্বিতীয়ত, নীলচে রঙা খামে চিঠি। সাধারণত চিঠির খাম থাকে বাদামি রঙা। খুব স্পেশাল ভাবে কেউ যদি কাউকে চিঠি দেয় তবেই খামের রঙ একেকরকম হয়। এত রঙ থাকতে নীল রঙের খাম কেন?

ভাবতে ভাবতে মাশফি আবৃত্তির হাত থেকে খাম নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। আবৃত্তি কিছু বলতে গিয়েও বলে না। কিন্তু,, মনের খোঁচখোচানি কমে না উল্টো বেড়ে যাচ্ছে। মধু খাম দিলো, মাশফি শোনার পর বিনাবাক্য নিয়ে নিলো। দেখে মনে হচ্ছে যা কিছু হচ্ছে সবটা স্বাভাবিক ভাবে হচ্ছে। আদৌও কি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে ?

মাশফির শরীর কাঁপছে। মধু আবার খামে করে কি বার্তা পাঠালো? কয়েকবছর আগের মাশফি যদি মধুর হাতের খাম পেত তবে আনন্দ আত্মহারা হতো নাকি চুপচাপ থাকত ; এটা নিয়ে ভাবছে।

এই যে এখন হৃদয়ে কম্পন হচ্ছে এটা কিসের জন্য? মধুকে ভালোবাসে তবে আগের মতো নয়। প্রথমবার যখন বুঝতে পারলো মধু কখনোই তার হবার নয় তখন মনে হয়েছিল যে সে আর প্রাণে বাঁচবে না। বছর ঘুরলো ধীরে ধীরে মনের অবস্থা পরিবর্তন হতে থাকলো। মনের কোণে মধুর অবস্থান ঠিক আগের মতোই আছে। কিন্তু ভালোবাসা না পেলে মরে যাবে এমন ভাবার্থ থেকে বের হয়ে এসেছে মাশফি। কিন্তু,, আজকের দিনে এসে দাঁড়িয়ে মাশফির মনে হচ্ছে এতকাল তার হৃদয় তার কাছ থেকে অনুভবগুলো লুকিয়ে রেখেছিল। সুযোগ পেয়েছে বলে সবটা বুক ফুড়িয়ে বের হয়ে আসছে।

নীলচে রঙা খাম থেকে লাল রঙা কাগজ বের করলো। লাল রঙ দেখে মাশফির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে দুটো কথা। এক, সতর্কীকরণ বার্তার ক্ষেত্রে । দুই, ভালোবাসা জাহির করার জন্য লাল রঙ ব্যবহৃত হয়। এই দুটো থেকে প্রথমটা হয়তো মাশফির জন্য।

লাল রঙের কাগজের ভাজ খুলে যত্ন সহকারে চোখ বুলালো,,

” কাজলচোখের নেশায় ডুবে গেছে মন। চোখের সমুদ্রে কি করে সাঁতার কাটতে হয় তা তো জানা নেই। একটু সাহায্য করবে কি?যদি সাহায্য না করো তবে তোমার সেই বিশাল ঘোমটার ভেতরে আমার মুখ ঢুকিয়ে নিষিদ্ধ একটি কাজ করে বসব। তখন কিন্তু,, আমাকে বকতে পারবে না ”

লেখাগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে না মাশফি সাহেব। কোনো এককালে আমার মোবাইলে হুবহু এরকম বার্তা এসেছিল। জীবনে প্রথমবারের মতো এরকম ভয়াবহ কথা আমি পড়েছিলাম। সেদিন গা কাঁপতে কাঁপতে মরে যাবার উপক্রম হয়েছিল আমার। কারণ,, ওমন কথা শোনার অভ্যাস যে ছিল না। এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হচ্ছে সেই কালপ্রিটকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। আপনি কি আমায় সাহায্য করবেন? এজ এ ওয়েল উইশার ?

ইতি
মধু

চিঠি শেষ। কিন্তু চিঠিতে পড়া শব্দগুলোর রেষ মাশফির গায়ে রয়ে গেছে। গা কাঁপছে। মধু কিছু টের পেলো কি না এই ভেবে? যদি টের পেয়েও থাকে তবে মাশফির কথা মধুর মাথায় আসলো কি করে? কারণ,, এমন কোনো সাইন নেই যে মধুর মাথায় মাশফির কথা আসবে।

#চলবে

#চেনা_পথে
#Tahmina_Akhter

১৪.

গত দুদিন যাবত মাশফির যাচ্ছেতাই অবস্থা। একের পর এক চিঠি আসছে এক এক রঙের খামে করে। প্রত্যেকটা চিঠির শিরোনামে মাশফির কথাগুলো লেখা থাকে। যেগুলো একসময় সে মধুর জন্য লিখেছিল। একদিকে জাপানে ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। মধুর সঙ্গে দেখা করে কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই সাহসটুকু অব্দি নেই। ভয় হয় যদি ধরা পরে যায়।

চোর বুঝি চুরি করে এতটা ভয় পায় না যতটা ভালোবেসে ভালোবাসা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ছটফট করছে মাশফি।

সকালে ডাইনিং টেবিলে সবাই যখন একসঙ্গে বসে নাশতা খাচ্ছিল তখন আবৃত্তি আরও একটা চিঠির খাম এগিয়ে দেয় মাশফির দিকে। সবার দৃষ্টি মাশফি এবং আবৃত্তির দিকে। মাশফির তো সাদা রঙা খাম দেখে বিষম খেয়ে অবস্থা খারাপ। মিনা ওঠে এসে ছেলের পিঠে হাত বুলাচ্ছে একবার আরেকববার মাথা উপরিভাগে থাপ্পড় দিয়ে বিষম কমানোর চেষ্টা করছেন। ধীরে ধীরে মাশফি স্বাভাবিক হয়। চেয়ার ছেড়ে ওঠে এসে আবৃত্তির হাত থেকে ছোঁ মেরে খামটি নিয়ে তড়িঘড়ি করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। চটপটে মাশফিকে বহুবছর আগে দেখেছে সবাই। কিন্তু,, আজ সেই পুরনো মাশফিকে দেখে সবাই যারপরনাই অবাক। বিশেষ করে মাশফির দাদি। কারণ,, এই নাতিকে তিনি হারে হারে চেনেন। বিদেশ যাওয়ার আগে তার নাতিকে যেমন দেখেছিল আজ তার নাতিকে তেমনি দেখলেন। মাঝের যে কটা দিন দেখলেন তা বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন৷

— আবৃত্তি???

— জি ; মা।

— মাশফির হাতে ওটা কিসের খাম দিয়েছো? ভয় পাওয়া চেহারা নিয়ে কোনোমতে চোরের মতো পালিয়ে গেলো যে!

শ্বাশুড়ির কথা শুনে আবৃত্তির হাসছে। আবৃত্তিকে হাসতে দেখে সবাই বিস্মিত হলো। কারণ,, মিনা এমন কোনো কথা বলেনি যার কারণে এভাবে হাসতে হবে! মাশফির দাদি বিরক্ত গলায় আবৃত্তিকে বলেই ফেললো,,

— তুমি তো দেহি আদিবারে বিয়া দিয়া পোলাপাইনের মতো করতাছো। বয়স হইতাছে যে আয়নায় দেহো না?

আবৃত্তি ওর দাদি শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,,

— দাদি গো আমি পোলাপানের মতো করছি না। আপনার নাতি করছে ; দেখছেন না? এই বয়সে এসে মেয়ে মানুষের কাছ থেকে প্রেমপত্র পেয়ে নাকমুখে শ্বাস আঁটকে মরণদশা করে ফেলছে।

আবৃতির এতটুকু কথা যথেষ্ট ছিল সবার জন্য। মাহবুব,, ইমতিয়াজ,, মিনা,, দাদি সবাই আবৃত্তির দিকে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে। ওদের তাকানো দেখে আবৃত্তি হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে।

— এভাবে তাকিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই আমার কথা বদলে যাবে না? যা বলছি সত্যি বলছি।

মিনা আবৃত্তির কাছে গিয়ে ওর দু-হাত চেপে ধরে বললো,,

— ভেবেচিন্তে কথা বলো আবৃত্তি। যা বললে সবটা সত্যি তো? মাশফি বলেছে তোমায়? মেয়ে বাংলাদেশি নাকি বিদেশিনী?

আবৃত্তি ওর শ্বাশুড়ির ছটফটানি বন্ধ করার জন্য পাশের চেয়ারে টেনে বসিয়ে দিলো। তারপর,, ফিসফিসিয়ে বললো,,

— মা আপনি ভাবতেও পারবেন না আপনার ছেলে কতটা বোকা? নিজের ভালোবাসাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে। অথচ,, আমরা কেউ কিছুটি টের পায়নি।

— সেই মেয়েকে চেনো তুমি??

মিনা কান্নারত সুরে জিজ্ঞেস করলো আবৃত্তিকে। আবৃত্তি মুচকি হাসি দিয়ে বললো,,

— আমি আর কিছু বলব না। মাশফি এসে আপনাদের বলবে। আমার বিশ্বাস এবার মাশফি খালি হাতে ফেরত আসবে না। মুঠোভর্তি সুখ নিয়ে ফিরে আসবে। ওর সুখ দেখে আমরা খুশি হবো মা। আপনি দেখবেন মাশফি সেই আগের মতো হয়ে গেছে। যার দুষ্টুমিতে ভরা কথা শুনে আমরা হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলতাম।

আবৃত্তির কথায় সকলের চোখে যেন নতুন করে স্বপ্ন
জেগে ওঠে। মনে মনে সবার একই প্রার্থনা যেন মাশফির মরুভূমিতে ওপরওয়ালা স্বর্গোদ্যান দান করে।

**********************

“সাদা রঙের মানে বুঝেন মাশফি সাহেব?”

চিরকুটে আজ এতটুকু লেখা তবে চিরকুটের সঙ্গে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ ফুল। শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ফুলের রঙটা বলা মুশকিল। তবে ফুলটা যে বিশেষ কারণে পাঠিয়েছে এটা তো মাশফি বুঝতে পারলো।

থুতনিতে হাত রেখে মাশফি ভাবছে সাদা রঙের মানে কি? কিন্তু,, মাথায় আসছে না। অথচ,, ওর মনে হচ্ছে যে ও জানে সাদা রঙের মানে কি?

মধু কোন নতুন খেলায় মেতে উঠলো ওর সাথে? পুরনো হিসেবের খাতা খোলার খুব কি প্রয়োজন ছিল?

মাশফি হুট করে আঁতকে উঠল। মোবাইলে কল আসার শব্দ শুনে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার তবে বেশ চেনা। এতটাই চেনা নাম্বার যে চাইলেই মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। মধু কি তবে এতবছর অব্ধি নাম্বারটা নিজের কাছে রেখেছিল?

মাশফির একহাতে চিরকুট। অন্যহাতে মোবাইল কানে ঠেকিয়ে রেখেছে। দু’পাশে দুজন মানুষ একে অপরের কথা শুনতে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু,, সকল বাঁধা উপেক্ষা করতে যেন যত আপত্তি!

মাশফি আজ সকল কিছুকে উপেক্ষা করে শীতল গলায় মধুকে করুণ সুরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,,

— প্রতিশোধ নিতে চাইছেন?

— নিশ্চয়ই আমরা শত্রু নই। প্রতিশোধ নিতে যাব কেন? আমি তো শুধু তাকে খুঁজছি যে একসময় আমার সঙ্গে মাইন্ড গেম খেলেছে। সে তো আর জানে না তার সেই খেলায় আমি কতটা হারিয়ে শূন্য হয়েছি। শুধু তাকে একটু সময়ের জন্য শাস্তি দিতে চাই এটুকু আমার চাওয়া।

ফোনের ওপাশে মধুর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মুচকি হাসি দেখতে পেলো না মাশফি। মাশফির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাতের পিঠে ঘাম মুছলো। শ্বাস ছেড়ে মধুকে শুধু এতটুকু বললো,,

—-কিন্তু,, আমাকেই কেন এসব পাঠাচ্ছেন? আপনার কি ধারণা আমি এসবের পেছনে দায়ী?

শেষের কথাটি বলতে গিয়ে মাশফির কন্ঠস্বর কেঁপে উঠল। কারণ,, সে যে মিথ্যা বলছে। তার চেয়ে ভালো কে জানে? যা কিছু হয়েছে তার সবকিছুর আড়ালেই ছিল মাশফি।

— আপনি দায়ী এই কথা আমি একবারও বলিনি। আপনি শুধু শুধু নিজের দিকে কথা টানছেন। আমি চাই আপনি আমাকে সাহায্য করুন সেই ব্যক্তিটাকে খুঁজে করতে। দ্যাটস ইট।

— আমি তাকে চিনি না। আপনি প্লিজ আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমি আপনাকে আদিবার টিচার হিসেবে চিনি এবং জানি। এর বাইরে আপনার সঙ্গে অহেতুক সম্পর্ক কিংবা কথা বাড়ানোর প্রয়োজন আমি দেখছি না।

কথাগুলো বলার সময় মাশফির মনে হলো ওর গলা কেউ চেপে ধরেছে। কলিজা টেনে বের করে আনছে। শুধু পাঁজর ভেদ করে বের করে আনতে পারছে না বলে হচ্ছে না।

— সম্পর্ক কেমন আমি জানতে চাই না। আমি শুধু সেই সময়টুকুর দাম চাই। যেই সময়টা শুধু আমার মানে একান্তই আমার হবার কথা ছিল। কিন্তু,, কারো লেখা দু’চারটা বাক্য পড়ে আমার মস্তিষ্কে-হৃদয়ে যে পরিবর্তন এসেছিল। এবং আমি এর পেছনে যতটুকু সময় ব্যয় করেছি এবং যতটুকু হারিয়েছি। আমি এর সবটা ফেরত পেতে চাই তাও চড়া দাম দিয়ে। এখন আমার চোখে দেনাদার হিসেবে আপনি আছেন। অতএব আপনি এই দেনা মেটাবেন যে কোনোকিছুর মূল্যই হোক

মাশফি মধুর কথা শেষ হবা মাত্র মোবাইলটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারলো। মূহুর্তে মোবাইলে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পরলো। মাশফির শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে। এতটা রাগ নিজের জীবনের প্রতি এর আগে কখনো জমেনি। ভালোবাসা এতটা অসহ্য হবে জানলে কারো দিকে তাকানোর মতো ভুল করতো না সে। যেই ভালোবাসা দু-হাত দিয়ে সুখ ভরিয়ে দিতে পারে না আর যাই হোক সেটা “ভালোবাসা” এর মতো সুখকর নাম ডির্জাভ করে না। এর নাম তো হওয়া উচিত ছিল “নিজ হাতে জীবন ধ্বংসকরণ কার্যক্রম”।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here