আমার_অবেলায়_তুমি,০৪,০৫

0
536

#আমার_অবেলায়_তুমি,০৪,০৫
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৪

মাহতাব অফিসে পৌছে নিজের কেবিনে চলে গেলো। অফিসের সবাই মাহতাব কে রাগী গম্ভীর মানুষ হিসেবেই জানে। কিন্তু মাহতাবের অসম্ভব ভালো ব্যবহারের জন্য সবাই তাকে সমিহ করে চলে।
মাহতাব কেবিনে ঢুকেই ম্যানেজার কে কল করলো তার কেবিনে আসার জন্য।
ম্যানেজার নক করে ভিতরে এসে মাহতাবের সামনে এসে দাড়ালো।

— বসুন হাসিব সাহেব।

— জি স্যার।

— আমি কাল বিকেলে বিয়ে করেছি হাসিব সাহেব। হুট করেই সব হয়ে গেছে তাই কাউকে কিছু জানানো হয়নি। রিসিপশনে বড় করে আয়োজন করে সবাইকে জানাবো। আপাতত আপনি হালকা মিষ্টিমুখ করার ব্যবস্থা করুন। অফিসের সবাইকে মিষ্টিমুখ করবেন। গেটম্যান সহ সবাই যেন পায় খেয়াল রাখবেন।

হাসিব সাহেব হা করে তাকিয়ে আছে মাহতাবের দিকে। তার স্যার বিয়ে করেছে বিশ্বাসই হচ্ছে না। নিজের হতভম্বতার রেষ কাটিয়ে কোন রকম সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে গেল।

অফিসের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। প্রায় সবাই মাহতাবের বিয়ের কথা শুনে খুশি হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন মুখ টিপে হাসাহাসি করছে। তাদের অবশ্য কেউ পাত্তা দেয়নি।

মেহরাব হসপিটালে এসে ড.কানিজ ফাতেমা কে নিয়ে মধুর কেবিনে গেল। লামিয়া আগেই চলে এসেছে। মধু আর ময়না বেগম তখন গল্প করছিল। আসলে ময়না বেগম একাই কথা বলছিল মধু চুপচাপ শুনছিল। ময়না বেগমের পরিবারের নারী নক্ষত্র সব বর্ণনা করা শেষ।এমনকি মাহতাবের প্রাক্তন প্রেমিকার কথাও বাদ রাখেনি। তার মতে সব কিছু শুরুতেই জেনে রাখা ভালো। পরে অন্য কারো থেকে জানলে সংসারে অশান্তি হবে। মধুর অবশ্য মাহতাবের প্রাক্তনের কথা শুনে খারাপ লাগেনি। বরং মাহতাব এতো বছর তাকে মনে রেখে যে কষ্ট পেয়েছে তার জন্য খারাপ লেগেছে।

মধুকে চেকআপ করা শেষে ডক্টর চলে গেলো। আপাতত মধু ঠিক আছে।কাল সকালে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে। কিছুদিন ফুল রেস্টে থাকতে হবে।

লামিয়া আসতেই ময়না বেগম তাকে আপেল কে*টে দিলেন। পাশে বসিয়ে কুলসুম বেগম কি করছে,তাকে ধমক টমক দিয়েছে কিনা সেই খবরাখবর নিচ্ছে। তার ভাষ্যমতে তার ভাই দুটো আহাম্মক। বউদের হয়ে কথা বলতে গেলে তাদের জ্বিব্বায় জ্যাম লেগে যায়। আর বড় আহাম্মক টা তো যখন তখন গিরগিটির মতো রঙ বদলায়। আস্তো বেয়াদব!

লামিয়া শব্দ করে হাসছে। মেহরাব কয়েকবার চোখ রাঙিয়ে তাকিয়েছে। সেদিকে সে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। মেহরাব কে জব্দ হতে দেখে তার মজা লাগছে।

— রাতে আমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল লামু? মনে আছে তো?

লামিয়ার মুখ শুকিয়ে গেল। কাল একটু মুখ টিপে হাসার জন্য মেহরাব তাকে শাস্তি দিয়েছে। বুড়ো বয়সে এসে লোকটার মাথা খারাপ হয়েছে। সেজন্যই ঘুম থেকে উঠতে এতো দেড়ি হয়েছে। লামিয়া মেহরাবের দিকে তাকিয়ে মুখ বাকিয়ে চুপ করে রইলো।

— তুই ওকে চোখ রাঙ্গাচ্ছিস কেন বেয়াদব! তোর চোখ খুলে আমি জাদুঘরে রেখে আসবো।

— তুমি ভুল বুঝছো আপা!

মেহরাবের অসহায় কন্ঠে মোটেও দমে গেল না ময়না বেগম। গমগমে গলায় বলল,

— আমার চুল বাতাসে পাকেনি। হাড়ে মজ্জায় শয়তানি তোদের। লামিয়া কে জ্বালালে আমি ওকে আবার বিয়ে দিয়ে দিবো। ঘটক আমার হাতেই আছে।

লামিয়া আবার ফিক করে হেসে দিলো। মেহরাব হার মেনে মুখ কালো করে বেড়িয়ে গেলো। বোন টা যে কার মতো হয়েছে কে জানে?সারাক্ষণ তাদের পিছনে লেগেই থাকে।

মধু হাসি মুখে ভাই বোনের খুনশুটি দেখছিল। ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের প্রতি এতো ভালবাসা দেখে ওর মনটা ভালো হয়ে গেলো। এরকম একটা পরিবার তো ওর স্বপ্ন ছিল। কতো রাত সেই স্বপ্নে বিভোর থেকেছে সে৷ এবার বুঝি তার স্বপ্ন পুরোন হলো!

— তুমি শুয়ে থাকো মধু। বসে থাকতে খারাপ লাগবে তো।

ময়না বেগমের আদুরে গলা শুনে চোখ ভিজে গেল মধুর। চোখের কোণে পানি নিয়ে ধরা গলায় বলল,

— এতো আদুরে গলায় ডাকবেন না আপা। আমার অভ্যাস নেই। এতো আদুরে ডাক শুনলে বুক ধরফর করে৷ কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা হয়,কান্না আসে। আমাকে একটু কম কম আদর করুন। আস্তে আস্তে আমি বেশি ভালোবাসা পাওয়ার অভ্যাস করে নিবো।

ময়না বেগম মধুকে তৎক্ষনাৎ বুকে টেনে নিয়েছে। লামিয়া ও পাশ থেকে জরিয়ে রেখেছে। ময়না বেগম মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলল,

— এখন থেকেই অভ্যস্ত হয়ে যা। তুই নিজেও জানিস না তুই আমাদের কে।আমাদের কলিজার একটা অংশের ভালো থাকার কারণ তুই। তোকে আমরা এখনো সিন্দুকে ভরে রাখিনি এই তো ঢের। অমূল্য রত্নের থেকেও বেশি মূল্যবান রত্ন তুই আমাদের। আমার ভাই টাকে একটু ভালোবেসে আগলে রাখিস তাহলেই হবে। তোর নিজের জন্য ভালোবাসার চিন্তা করতে হবে না। ভালোবাসার সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে তুই।যত পারিস নিয়ে নিবি। মাহতাব তোকে বুকে ভরে রাখবে। শুধু একটু সময় দে।

লামিয়া, মধু, ময়না বেগম সবার চোখেই পানি। পরিবার টা এবার বুঝি সম্পুর্ন হলো।

হসপিটাল থেকে বেরিয়ে মেহরাব সরাসরি মাহতাবের অফিসে এসেছে। ভাইয়ের কাজে সাহায্য করলে ভাই তারাতাড়ি ভাবির কাছে যেতে পারবে। মাহরাবের কেবিনে ঢুকে অবাক হয়ে গেলো সে। পুরো কেবিন জুড়ে ফুলের ছড়াছড়ি৷ মেহরাব হেসে বললো,

— এগুলো কে দিলো ভাই?

— অফিসের সবাই নতুন জীবনের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। (হালকা হেসে)

— তুমি সবাইকে বলে দিয়েছো?(অবাক হয়ে)

— অন্যকারো থেকে শুনে আমাকে নিয়ে গসিপ হবে এটা আমার পছন্দ নয়। (গম্ভীর গলায়)

মেহরাব মাথা নাড়লো।

— তোমার মিটিং ছিল মনে হয়? আমাকে বুঝিয়ে দাও,আমি মিটিং সামলে নিবো।

— আমাকে থাকতে হবে।

মেহরাব আর কিছু বললো না। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই বলল,

— তুমি খুশি তো ভাই?

মাহতাব শান্ত চোখে তাকালো। ল্যাপটপ থেকে হাত সরিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। চোখ থেকে চশমা টা খুলে শান্ত গলায় বলল,

— বাবা যখন মা*রা গেলো তখন আপা সবে স্বামী হারিয়ে আমাদের বাসায় এসেছে। তুই টেনে আর আমি অনার্সের ছাত্র। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারি মানুষটা যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলো তখন আমাদের অবস্থা অনেকটা মধুর মতো হয়েছিল। ছেলে সহ আপাও তার শ্বশুর বাড়িতে অত্যাচারিত হয়েছে। আপার শ্বাশুড়ি তাকে ঠিকমতো খেতে দিতো না। একবার গরম ভাতের প্লেট আপার গায়ে ছুড়ে মারে। আপার গলা সহ কাধের অনেকটা পু*ড়ে গিয়েছিল সেদিন। তারপর আপাকে বাবা গিয়ে নিয়ে আসে আমাদের বাড়ি।আদরের মেয়ের এই অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারেনি বাবা।একদিন স্ট্রোক করে বসে। আর আমাদের ছেড়ে চলে যায়৷ মা শোক সামলাতে পারলেও আপা খুব ভেঙে পরে। বাবার একাউন্টে বেশি টাকা ছিল না। আমাদের বাড়িটা তখন নতুন করা হয়েছে। পাচ তলা বাড়িটা করতে বাবার প্রায় সব টাকাই খরচ হয়ে গিয়েছিল। বাসা ভারার টাকা দিয়েই আমাদের সমস্ত খরচ চলতো। ঠিক সেই মুহুর্তে সাহিদা আমাকে ছেড়ে গেল। কারোর অসহায় চোখের আকুতি আমি বুঝি মেহরাব। আমি মধুর মাঝে আমার আপার অসহায় মুখটা দেখেছি। আমি ওর আকুতি ভরা চোখে পুরনো আমাকে দেখেছি। আমাদের কষ্টের সময় পার হয়ে গেছে। এখন আল্লাহর রহমতে আমরা সুখে আছি। সেই সুখের অংশ নাহয় মধুও হলো।

— তাকে মেনে নিবে না?

— ভালোবাসা টা একদিনে হয়না মেহরাব। এখন আর আবেগে ভেসে যাওয়ার বয়স নেই আমার যে হুট করেই ভালোবাসা হয়ে যাবে। তার জন্য সময় দরকার। দুজনের মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়ার একটা ব্যপার আছে। আমি আমার সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা করবো। এতটুকু বলতে পারি,সাহিদার জন্য এখন আর কোন অনুভূতি নেই৷ সে তার মতো সুখে থাক। আমিও নাহয় আমার ভালো থাকা খুজে নিবো।

মেহরাব মুচকি হাসলো। ভাই কে নিয়ে তার চিন্তা নেই। সে কখনো অবিবেচকের কাজ করে না। তাদের আজকের এই অবস্থান তার ভাইয়ের জন্যই। তাকে ডাক্তার বানানোর সমস্ত অবদান তার ভাইয়ের। বট গাছের মতো তাদের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মাহতাব হসপিটালে পৌছালো বিকেল পাচ টায়। ময়না বেগম তখনো মধুর পাশে বসে। লামিয়া হাজার বলেও তাকে বাসায় পাঠাতে পারে নি। মাহতাব এসে ময়না বেগম কে এক হাতে জরিয়ে ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ময়না বেগম ভাইয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না। তাকে গাড়ি তে তুলে দিয়ে ড্রাইভার কে সাবধানে গাড়ি চালাতে বলে আবার হসপিটালে চলে এলো সে। লামিয়া তাকে দেখে বেরিয়ে গেল।
মাহতাব মধুর সামনে বসে শান্ত গলায় বলল,

— এখন কেমন আছো? ব্যথা কমেছে?

মধু ইতস্ততভাবে বলল,

— জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

— কাল বাসায় নিয়ে যাবো।তোমার মা সহ সবাই থানায় আছে। শুধু তোমার সৎ ভাই জয় বাইরে। তোমার এতে কোন সমস্যা আছে?

মধুর কিছুটা খারাপ লাগলো। তবুও মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। মাহতাব তার জন্যই তো এতো কিছু করেছে। কিছু বলে তাকে ছোট করার মানেই হয় না। তাছাড়া তাদের শাস্তি হওয়া দরকার।

— দেখো মধু,আমি কিছু কথা তোমাকে সরাসরি বলতে চাই। আমার বয়স বর্তমানে ৩৮ বছর।আর তোমার বাইশ। আমাকে মেনে নিতে তোমার সমস্যা হতেই পারে। তাই তোমার যত সমস্যা আমাকে বলবে। আমি সাধ্য মতো চেষ্টা করবো সমাধান করার। তবে কখনো বিচ্ছেদ পাবেনা। বোঝ ই তো,বুড়ো বয়সে তো আর বউ পাবো না। তাই তুমিই সম্বল।

মধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মাহতাবের দিকে। মাহতাব কথা শেষ করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে ফ্রেশ হতে।

চলবে,,,

#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি (সাথী)
#পর্ব_৫

রাত টা কাটিয়ে সকালেই মধুকে বাসায় নিয়ে এসেছে মাহতাব। সারারাত মধু লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ছিল। মাহতাবের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও অস্বস্তি হচ্ছিল। অথচ মাহতাব ছিল স্বাভাবিক। সব সময়ের মতো শান্ত। মধু আড় চোখে মাহতাবের অগোচরে মাহতাব কে দেখেছে। প্রত্যেক টা অঙ্গভঙ্গি গভীর চোখে অবলোকন করেছে।আশ্চর্যজনক ভাবে এই শান্ত গম্ভীর লোকটাকে তার ভালো লেগেছে। এক কথায় ভিষণ ভালো লেগেছে। বয়স নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। বয়স শুধু একটা সংখ্যা। মনের মিল কতটুকু হয় এখন এটাই দেখার অপেক্ষা।

মধুকে নিয়ে বাসায় ফিরতেই হুলুস্থুল পরে গেলো। কুলসুম বেগম আর ময়না বেগম তিন তলা থেকে নেমে এসেছে তাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। লামিয়া রান্নাবান্নায় লেগে গেছে। বাড়িতে আজ কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের ইনভাইট করা হয়েছে। হুট করেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কাউকে জানানো হয়নি। তাই সামান্য আয়োজন করে তাদের জানানোর ব্যবস্থা। তাছাড়া ভাড়াটিয়ারা আছে।তাদেরকেও নিজ থেকেই জানিয়ে দিতে চায় কুলসুম বেগম। অযথা তার সোনার টুকরো ছেলে নিয়ে কুৎসা রটুক তা সে চায় না। ময়না বেগম অবশ্য এসব ঝামেলা করতে নিষেধ করেছিলেন। মধুর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এখন এসব করে আরো প্রশ্নের মুখে পরতে হবে। কিন্তু কুলসুম বেগম শোনেনি। ময়না বেগম ও আর কথা বাড়ায় নি৷ তার বুঝদার মা মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসে থাকে।

মধু এখন আগে থেকে অনেকটাই সুস্থ।শরীরে আঘাতের দাগ অনেকটা মিলিয়ে এসেছে। মাহতাব তাকে হাত ধরেই গাড়ি থেকে নামালো। ময়না বেগম এগিয়ে গিয়ে আগলে ধরলো মধুকে। মধু মুচকি হেসে কুশল বিনিময় করলো তার সাথে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কুলসুম বেগমের দিকে এগিয়ে গেলো। মাহতাব অনেকটা অস্থির হয়ে মাকে একহাতে জরিয়ে ধরলো৷ মুখে চিন্তার ছাপ তার। তবে আরেক হাতে ঠিকই মধুকে ধরে রেখেছে৷ এটা খুব সামান্য একটা বিষয়। তবুও মধুর ভিষণ ভালো লাগলো।

— আপনি নিচে এসেছেন কেন আম্মা? আমরাই তো আসছিলাম। কষ্ট করে আবার নামতে গেলেন কেন?

— আমার ছেলের বউ কে আমি এগিয়ে নিবো না! এ কেমন কথা বাবা? আমি তো আর সিরি ভেঙ্গে নামিনি। লিফট দিয়েই এসেছি৷ আমার একটুও কষ্ট হয়নি।

মাহতাব শান্ত হলো। গম্ভীর মুখে মায়ের হাত ধরে দাড়িয়ে রইলো। কুলসুম বেগম মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— কেমন আছো মা?

মধু সালাম দিয়ে বলল,

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা।আপনি কেমন আছেন?

— আমি ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। এখন থেকে আরো ভালো থাকবো।

মাহতাব তাদের কথা থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

— বাসায় গিয়ে বাকি কথা বলো আম্মা।এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার হাটু ব্যথা বেড়ে যাবে।

কথা শেষ হতেই মাহতাব কুলসুম বেগম কে ধরে লিফটের দিকে হাটা শুরু করেছে। যাওয়ার আগে ময়না বেগমের হাতে মধুর হাত টা আস্তে করে দিয়ে দিয়েছে। ময়না বেগম মধুকে নিয়ে তাদের পিছনেই লিফটে ঢুকে গেলো। মধু পাচতলা বাড়িটা চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছে। পুরোনো আমলের হলেও বাড়িটা সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর বেলি ফুলের বাগান টা। সবার বাগানে নানান রকম ফুল গাছ শোভা পেলেও মাহতাব নিজের বাগানে প্রায় পঞ্চাশ টা বেলি ফুলের গাছ লাগিয়েছে। রাতে বেলিফুলের সুভাষে সারা বাড়ি মো মো করে।

বাসায় ঢুকে সরাসরি নিজের রুমে চলে গেছে মাহতাব। তাকে কয়েকঘন্টার জন্য বাইরে যেতে হবে। আসার সময় মধু মাহতাব কে অনুরোধ করে বলেছে আলেয়া বেগমে সহ সবাইকে ছেড়ে দিতে। খারাপ হলেও এতো বছর তাদের কাছেই বড় হয়েছে সে। মাথার উপরে ছাদ তো দিয়েছিল।সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই তাদের উপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তুলে নিয়েছে মধু।তাই মাহতাবকে বুঝিয়ে বলেছে তাদের উপর করা কেইস তুলে নিতে৷ মাহতাব মেনেছে।তবে শান্ত গলায় সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে আজ থেকে তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে পারবেনা মধু। এখন তার একমাত্র পরিচয়, সে মাহতাব ইব্রাহীমের স্ত্রী। তার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।

মাহতাব নাস্তা করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। দুপুরের মধ্যেই তাকে বাসায় ফিরতে হবে। লামিয়ার শুকনো মুখটা চোখে এড়ায়নি তার। আত্মীয়রা আসলে মেয়েটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে। বিয়ের সাত পাচ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের ঘরে কোন সন্তান নেই। আত্মীয় স্বজনরা আসলেই লামিয়াকে খুচিয়ে খুচিয়ে কথা শোনায়।মাহতাব জানে সবটা।তাই ভাইকে আলাদা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। কথা বলে ফেললে যতই প্রতিবাদ করা হোক,সেই কথা আর ফিরিয়ে দেয়া যায় না৷ বন্দু*কের গু*লির চেয়েও কথার আঘাত ভয়ংকর। মাহতাব চায়না আজ লামিয়া কোন কথার আঘাত সহ্য করুক।মেহরাব বাসায় নেই। আজ তার কয়েকটা অপারেশন আছে।তাই সকাল সকাল হসপিটালে চলে যেতে হয়েছে।

ময়না বেগম মধুকে মাহতাবের রুমে নিয়ে গেলেন। শুভ্র রঙের রুমে বিছানার চাদর থেকে শুরু করে সব কিছুই সাদা। ছিমছাম গোছানো রুমে ঢুকে মধু ইতস্তত করতে লাগলো। কোথাও বসতেও তার ভয় করছে। মনে হচ্ছে তার গা থেকে ময়লা লেগে যাবে।

ময়না বেগম মধুর হাতে একটা সুতির থ্রি পিস ধরিয়ে দিয়ে বলল,

— কোন রকম সংকোচ করবে না। এখন থেকে এই রুম,এই বাড়ি, আর এই বাড়ির মানুষ গুলোও তোমার। নির্দিধায় থাকবে সব সময়। ওটা ওয়াশরুম(আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে)।ফেশ হয়ে এসো।ভালো লাগবে।

মধু মাথা কাত করে সায় জানালো। তার ভিতরের অস্বস্তি কমছে না। তাদের সাথে বড্ড বেমানান লাগছে তাকে। অযত্নে চেহারা মলিন হয়ে গেছে। যেখানে খাওয়া জুটত না ঠিক ভাবে সেখানে চেহারার যত্ন নেয়া বিলাসিতা।
মধু ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ময়না বেগম ওখানেই বসে রইলেন।মেয়েটা খুব শান্ত। হয়তো পরিস্থিতির চাপে পরে চুপচাপ হয়ে গেছে। তার ভাইটা ও শান্ত,গম্ভীর। দুজন ঠান্ডা মানুষ মিলে কি বাড়ি টা কি হিমালয় বানাতে চাইছে নাকি!

থানায় গিয়ে ঝামেলা মিটাতে অনেকটা সময় চলে গেলো মাহতাবের। দুই দিন তাদের ভালোই আপ্যায়ন করা হয়েছে। মাহতাব সেদিকে ধ্যান দিলো না। শক্ত গলায় বলে এলো মধুর সাথে আর কখনো যোগাযোগ না করতে। আলেয়া বেগম আর জয়নাল বেপারীর চুপসানো মুখ দেখে মনে মনে শান্তি পেলো খুব।

নতুন বউ দেখতে আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবাই আসছে। মধু রেস্ট নিতে পারছে না ঠিকঠাক ভাবে। লামিয়া বুদ্ধি করে মধুকে হালকা সাজিয়ে দিয়েছে। এতে তার মুখের অস্পষ্ট দাগ গুলো ও ঢেকে গেছে৷ লং স্লিভের জন্য হাতের দাগগুলো ও দেখা যাচ্ছে না। কয়েক দফা দেখাদেখির পর ময়না বেগম স্পষ্ট সবাইকে বলে দিলেন এখন মধু রেস্ট করবে। আবার বিকেলে সবাই এসে চা খেয়ে যাবে সাথে বউও দেখে যাবে।

কুলসুম বেগমের বাপের বাড়ি থেকে তার আত্মীয় স্বজনরা এসেছে। কুলসুম বেগমের ভাইয়েরা কেউ বেচে নেই। দুই ভাবি আর তার ছেলে, ছেলের বউ তাদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সাহিদাও তার দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে হাজির। কুলসুম বেগমের বড় ভাবির ভাতিজি সাহিদা। তাই কেউ কিছু বলতেও পারছে না। আসার পর থেকেই মুখ কুচকে বসে আছে সে। তার চোখ গুলো আকুপাকু করছে মাহতাবের বউকে দেখার জন্য। মাহতাব যে এই বয়সে এসে বিয়ে করবে তা কল্পনাও করেনি সে। এতদিন মনে মনে অহংকার হতো তার,তার জন্য মাহতাব ঘর বাধেনি কারো সাথে। মাহতাব এখনো তাকেই ভালোবাসে এ ভেবেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতো। মনে মনে আফসোস হতো মাহতাব কে ছাড়ার জন্য। আগে মাহতাবের তেমন কিছু না থাকলেও এখন মাহতাব টাকার কুমির। তার পা থেকে মাথা অব্দি আভিজাত্য দিয়ে মোড়ানো। এখন এই মেয়ে নিশ্চয়ই এসব কিছু ভোগ করবে। এসব তো তার হতো। নিজের স্বার্থপরতায় হারিয়েছে সব। হিংসে হচ্ছে তার। মাহতাব অন্য কারো সাথে জীবন শুরু করেছে ভাবতেই মন বিষিয়ে যাচ্ছে।

স্বার্থপর মানুষদের এই এক সমস্যা। তারা সব কিছুতে নিজের স্বার্থ খোঁজে। মাহতাবের একা থাকা সাহিদার মনে প্রশান্তি জোটাতো। সে অন্যকাউকে নিয়ে সংসার করছে তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মাহতাব কেন করবে!এই তার ভালোবাসা!
মনে মনে গজগজ করছে সাহিদা।মাহতাব আসলে আজ কিছু কথা শুনিয়ে দিবে সে।দেখবে কোন রুপসী মেয়ে দেখে তার মাথা ঘুরিয়ে গেছে যে এই বয়সে এসে বিয়ে করতে হলো।

ময়না বেগম একটু পর পর সাহিদার দিকে তাকিয়ে গা জ্বালানো হাসি দিচ্ছে। এতো বছর পর একটা মোক্ষম জবাব দিয়েছে এই মেয়েকে। মধুকে দেখলে এই মেয়ের রাতের ঘুম হারাম হবে নিশ্চিত। কালনাগিনী একটা।

লামিয়া সুফিয়া খালা কে বলল ড্রয়িং রুমে নাস্তা পাঠিয়ে দিতে। কুলসুম বেগম তার ভাবিদের সাথে গল্প করছেন। সাহিদা কে দেখেই লামিয়া চোখ মুখ কুচকে ফেললো। এউ মেয়েকে তার একদম ভালো লাগে না। সোফার একপাশে বসতেই তার বড় মামীশাশুড়ী মুখ কুচকে বলল,

— তোমার কি খবর ছোট বউ। কোন খুশির খবর আছে নাকি? শোন,মাইয়া মাইনসের স্বার্থকতা হইলো বাচ্চাকাচ্চায়। অনেক বছর তো পার হইলো। আর তো দেড়ি করণ ঠিক হইবো না। মেহরাব রে কও আরেকটা বিয়া করতে। পুরুষ মানুষের দুইডা বউ থাকলে সমস্যা কই? আল্লাহ তো হুকুম দিছে চাইরডা পর্যন্ত করার। তুমিও থাকবা।হেয় তো আর তোমারে ছাইড়া দিতাছেনা।

লামিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখের পানি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আরো।এই মহিলার অনেকেই তার কথায় স্বায় জানিয়েছে।
ময়না বেগম চোখ মুখ শক্ত করে মায়ের দিকে তাকিয়ে। তার মাও বাচ্চা নিয়ে লামিয়ার উপর কিছুটা অসন্তুষ্ট। তাই সে চুপচাপ বসে আছে।

— বিয়ে করে আমরা আমাদের প্রশান্তির কারণ হিসেবে একজন জীবন সঙ্গিনী আনি।কোন বাচ্চা জন্মদেয়ার মেশিন নয় মামী। আল্লাহ চাইলে বাচ্চা হবে নাহলে হবে না। আমার ভাই লামিয়া কে নিয়েই সুখী। তাই তাদের ভালো টা তাদেরকেই ভাবতে দিন। এসেছেন, বেড়াবেন। হাসিখুশিতে থেকে চলে যাবেন। আমার পরিবারের কাউকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তার জন্য আমি এখনো বেচে আছি।

মাহতাবের শক্ত কথায় দমে গেল সবাই। বাসায় ঢুকেই এসব কথা শুনে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। মেয়েরাই মেয়েদের বড় শত্রু এটা কালে কালে প্রমাণিত। নাহলে একজন মেয়ে হয়ে কিভাবে আরেকজন মেয়েকে সতিন আনতে বলতে পারে!

সাহিদার দিকে চোখ যেতেই মাহতাব মুচকি হাসলো। লামিয়ার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলল,

— কাদবে না।ভাইয়া আছি তো।এবার আমকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও লামু।

লামিয়া হাসিমুখে পানি আনতে চলে গেলো। মাহতাব সাহিদার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— কেমন আছো সাহিদা? এসেছো ভালো হয়েছে। নতুন ভাবিকে দেখে যেও।ঠিক আছে? আমি ফ্রেশ হয়ে এসে গল্প করবো।

ময়না বেগম ফিক করে হেসে দিলো। তার কম কথা বলা ভাই ময়না পাখির মতো কথা বলছে। সাহিদার মুখটা দেখার মতো হয়েছে।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here