#প্রিয়_তুই,০৩,০৪
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৩
তিতাস মার খেয়ে আর দাঁড়াল না। গমগম শব্দ তুলে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তখন অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি কুটিল হেসে মনে মনে বলল,
-‘ তোমাদের দু’জনকে আমি এক হতে দিবো না তিতাস। কখনো না, কোনোদিনও না।”
একথা বলে সে ঘুরতেই নার্সের সঙ্গে ধাক্কা খেলো। তার হাতে থাকা ফোনটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। বোধহয় ফোনের গ্লাস ফেটে গেছে। বেশ কয়েকজন রোগী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। হয়তো এর পরের ঘটনাও দেখতে আগ্রহী উনারা।
তবে নার্স মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছেন। উনি ভয়ে আছে, যদি তার নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এমনিতেই সেকেন্ড ওয়ার্নিংয়ে আছেন তিনি। এবার কেউ অভিযোগ জানালে বিনাবাক্যে হসপিটাল ত্যাগ করতে হবে।
যেটা উনি মোটেও চাচ্ছেন না। এতদিন অহংকার করে রোগী এবং তাদের বাসার লোকদের সঙ্গে মন্দ আচরণ করেছেন। অকারণে রোগীর প্রতি রাগ দেখিয়েছেন, যা ইচ্ছে বলেছেন। পরে রোগীদের বাসার লোকরা হসপিটাল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন। ফলস্বরূপ উনাকে ওয়ার্নিং দিয়েছেন।
এখন যদি এই ভদ্রলোক অভিযোগ করে তাহলে শেষ রক্ষা আর হবে না। পরিশেষে তাকে পথে বসতে হবে। ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। তখন অগন্তুক বিরক্ত নিয়ে কিছু বলতে গেলে পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,
-‘আরে আয়মান তুমি এখানে?”
অগন্তুক অর্থাৎ আয়মান কৌতুহল বশত পেছনে ফিরে দেখে ভোর দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মিষ্টি হাসি। হালকা মিষ্টি রঙের থ্রি পিচে তাকে আরো মিষ্টি দেখাচ্ছে। আয়মান মুখভর্তি হাসি নিয়ে ফোনটা তুলে ভোরের মুখোমুখি দাঁড়াল। তখন ভোরের কল আসাতে তাকে দাঁড়াতে বলে সাইডে গিয়ে কথা বলতে লাগল। আর আয়মান ওর দিকে তাকিয়েই মিটিমিটি হাসল।
সে ভোরকে ছায়ার মতো ফলো করে, দেখে। তবুও তার তৃপ্তি আসে না। মনের খোরাক মিটে না। বরং ক্ষণে ক্ষণে তার সঙ্গ পেতে মনে আকাঙ্খা জন্মে, নিষিদ্ধ ভাবনা মস্তিষ্কে কিলবিল করে। এই মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। যেটা তাকে সর্বদা টানে, আকর্ষন করে।বিমোহিত হয়ে করে তোলে
প্রতি মুহূর্তে। সে তার সুপ্ত অনুভূতির কথা ভোরকে জানাতে গিয়েও ফিরে এসেছে, পিছিয়ে গেছে। মনের কোণে লুকিয়ে রাখা গাঢ় অনুভূতি প্রকাশে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। শুধু একটা ভয়ে, যদি ভোর ভুল বুঝে অথবা তার সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে।
এসব ভেবে আয়মান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।তখন কল কেটে ভোর ব্যস্ততা দেখিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তাকে কিছু বলারও সময় দিলো না। আয়মানও আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। এখানে তার কোনো কাজ নেই শুধু ভোরের জন্য এসেছিল।
ভোর হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরে দেখে ওর বড় ভাইয়ের ছেলে ভোম্বল হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। যদিও তার ভালো নাম আছে, সাফায়াত সাফি। তবে ভোর তাকে ভোম্বল বলেই ডাকে। খুব আদরের সে। ভোম্বল বাঁ হাত পুড়িয়ে চিৎকার করে কাদঁছে,
ভোর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজও করে দিলো। তারপর পাঁচ বছরের ভোম্বল কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর রা হলো দুই ভাই আর সে। বাবা-মাসহ সাতজন
সদস্যের পরিবার তার। তবে বর্তমানে সে একা ফ্ল্যাটে থাকে।
কারণ পিয়াসের মৃত্যুর পরে আত্মীয়-স্বজনরা এসে উপদেশ দিয়ে যেতেন। কেউ বা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চায়তেন সে অপয়া, অলক্ষী। তার সংসার ভাগ্য খুবই খারাপ, নয়তো বিয়ের দিনেই বিধবা হতো না। মূলত এসব থেকে মুক্তি পেতে তার একা থাকা। তবে মাঝেমধ্যে এখানে আসে, সবার সঙ্গে সময় কাটিয়ে যায়। এতে বাসার বাকি সদস্যরা আত্মীয়দের
আনাগোনা থেকে রেহাই পায়।
ভোর ভোম্বলকে রুমে শুইয়ে দিয়ে ওর বাবার কাছে বসল। ওর বাবা হাসিব চৌধুরী মৃদু হাসলেন। মেয়ের মাথার স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,
-”মা, তোমার নামে বিচার এসেছে।”
-”তিতাস দিয়েছে?”
-” হুম, ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালো।”
-”জানি বাবা।”
-” তাকে একটা সুযোগ দিলে হয় না, মা?”
-“বাবা, তিতাস ভালো তবে তাকে মেনে নেওয়া আমার জন্য কঠিন। গত ছয় মাসে আগে ওদের বাসায় পিয়াসের বউ হয়ে পা রেখেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ আমি বিধবা।
আমার সেই ক্ষতই এখনো রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত।”
মেয়ের এ কথার জবাব উনি আর কিছু বলতে পারলেন না। শুধু নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
এখন রাত দুইটা একুশ। প্রগাঢ় আঁধারিয়া তিমির। চারপাশে নিস্তব্ধ পরিবেশ। এখন সুখী ব্যক্তিদের নিদ্রালু হওয়ার সময়।
আর যারা রাতজাগা পাখি তারা হয়তো বিষাদ কুড়াতে ব্যস্ত।
নতুবা সেই বিষাদে সেই নিজেকে পুড়াতে মগ্ন। তিতাস আজ বাসাতেই আছে। টেবিলে বসে একমনে পড়ছে। বাবা থাকছে ওর মায়ের সঙ্গে। যদিও সে নার্সদের সজাগ থাকার আদেশ করেছে। যেন কোনো সুবিধা না হয়। তাছাড়া ওর পড়ার চাপ বেশি থাকায় মায়ের সঙ্গে থাকতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রুগ্ন মাকে দেখে সে পড়তে পারে না, মনযোগও আসে না। ফলে অনেক পড়া জমে গেছে। এজন্য ওর বাবা আজ পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাতে ওর পড়া কভার করতে সুবিধা হয়। তিতাস আঙুলের ভাঁজে কলম নাড়িয়ে বিরবির করে পড়ছে। তখন ওর ফোন ভাইব্রেট হতে লাগল। এবার সে পড়তে পড়তেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফোনের স্কিণে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘ভোর।’ ততক্ষণে পূর্বের কল কেটে ফোন নতুন উদ্দ্যেমে ভাইব্রেট হচ্ছে। তখন থাপ্পড় খেয়েও তার অভিমান কিংবা রাগ কোনোটাই হয় নি। যদিও ভোরের উপর রাগ করতে পারে না সে। কারণ সর্বদাই ওর মনে হয় ভোর নিজের জায়গাতে সঠিক, নির্ভুল। কারণ সেও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, তার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া আছে, আত্ম-সন্মান বোধ আছে। সে কেন একই ভুল করবে!
যাকে বিয়ে করে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে শশুড়বাড়িতে এসেছিল, সেই মানুষটাই তাকে ঠকিয়ে ঘন্টা না পেরোতেই আত্মহত্যা করেছে। কাপুরষদের মতো সমাধান না খুঁজে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ওকে বিধবার সাজ উপহার দিয়েছে। সঙ্গে অপয়া, অলক্ষী, স্বামী খোঁকোর তকমা লাগিয়েছে। কতশত নোঁংরা কথা শুনতে বাধ্যও করছে। অথচ ভোর এসবের প্রাপ্য নয়।
সে নির্দোষ, নিরপরাধ। তবে তিতাস এখনো বুঝতে পারে না পিয়াস কেন আত্মহত্যা করেছে? কারণ পিয়াস খুশি মনেই ভোরকে সহধর্মিণী হিসেবে মেনে বিয়ে করেছিল। এমনকি তিতাসকে এমনও বলেছিল,
-”ভাই, ভোরের চোখ দু’টো আমাকে খুব টানে। মনে হয়, তার চোখজোড়া আমায় কাবু করতে সক্ষম।”
বড় ভাইয়ের কথা শুনে সে হেসে মজা করে বলেছিল,
-”ভাই কোথাও কোনো চক্কর লাগিয়ে বিয়ে করো না। দেখা যাবে, বিয়ের পরদিনই তোমার পূর্বের বউ এসে হাজির হবে। তখন বাসায় হাঙামা না বেঁধে যায়। তাই বলছি, সময় আছে ভেবে চিন্তে বিয়ে করো।”
একথা শুনে পিয়াস উচ্চশব্দে হেসেছিল। এছাড়াও, তিতাস নিজেও অবগত, পিয়াস কখনো কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায় নি। কারণ তার সমস্ত ভালোবাসাটুকু বউয়ের জন্যই তোলা ছিল। তাহলে আত্মহত্যা কেন? এসব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে
মরিয়া সে। তিতাসে ভাবনার ছেদ ভাঙ্গল ভাইব্রেটের ভোঁ ভোঁ শব্দে। সে দ্রুত কল রিসিভ করতেই ভোর বলল,
–”কোথায় তুই?”
-”বাসায়।”
-”পরীক্ষা কবে?”
-”আগামী সপ্তাহে।”
-”আগামীকাল বাসায় থাকবি?”
-“বোধহয় না, কেন?”
-”আমি যাব তোদের বাসায়।”
-”হঠাৎ?”
-”কাজ আছে।”
তিতাস কান থেকে ফোন সরিয়ে আঙুল দিয়ে কান খুঁচিয়ে আবার ফোন কানে রাখল। ভুলভাল শুনছে নাকি পুনরায় নিশ্চিত হলো। না, যা শুনছে সব ঠিক। সে কিছু বলতে গেলে কল কেটে গেল। তিতাস কলব্যাক করলে ভোরের ফোন বন্ধ দেখাল। এই মেয়েটার মাথায় কখন কি চলে বোধগম্য হয় না তার। তিতাস চেয়ারে হেলান দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে পুনরায় পড়াতে মন দিলো। তবে মনোযোগী হতে পারল না। মাথাতে নানান চিন্তা এসে ভর করল। বিয়ের পর ভোর ভুলেও ওদের বাসার ধারে কাছেও আসে নি। তাহলে কাল আসবে কেন?
এ বাসাতেই বা কি কাজ তার? তিতাস খোলা বইটা বন্ধ করে
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আজ আর পড়াশোনা হবে না। এরচাইতে ঘুমানোই উত্তম। সে আর কিছু না ভেবে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাল।
To be continue………!!
#পর্ব_০৪
পরদিন সকালে রোজার হাকডাকে তিতাস সদ্য নেত্রজোড়া খুলে তাকাল। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে আড়মোড়া ভাঙল। ঘুমে ঢুলঢুলু চোখজোড়া ডলে উঠে বসল। ওর প্রিয় কোলবালিশ খানা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কখন যে পড়ে গেছে খেয়ালই নেই।বিছানার অর্ধেক চাদর মেঝেতে ছুঁইছুঁই।
বিছানা সাজানো কুশনগুলোও ড্রেসিংটেবিলের সামনে জমা করা।পড়ার টেবিলে বই দিয়ে চিপস চানাচুরের প্যাকেট চাপা দেওয়া। গতরাতে পড়তে পড়তে খেয়েছিল সে।খাটের পায়ার কাছে রাখা সবুজ রঙা পাপোসটাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে ধারণা করা যায়, খাটের তলায় নয়তো ড্রেসিংটেবিলের চিপায়। অথবা জমিয়ে রাখা নোংরা জমা কাপড়ের ভেতরে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। একগুচ্ছ কাপড় বিনব্যাগের উপর স্তুপ করে রাখা। তিতাস ওর পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে হাসল। একদম মনমতো করে অগোছালো করা, বাহ্ দেখতে ভালোই লাগছে। তারপর অনেক খুঁজে কোণায় রাখা বিনব্যাগের পাশ থেকে স্যান্ডেল উদ্ধার করল। রুমে পরা এ স্যান্ডেলজোড়া পিয়াস কিনে দিয়েছিল। তারপর সময় নিয়ে সে স্যান্ডেল দু’খানা পায়ে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। কুঁচকানো টি-শার্ট টেনে টুনে ঠিক করল। ততক্ষণে রোজার দরজা থাবড়ানোও বেড়ে গেছে। তিতাস আলসেমি ভরা দেহখানা নিয়ে হেলেদুলে দরজা খুলতেই রোজা মিষ্টি হেসে বলল,
-”ছোট মিয়া, আম্মু তোমাকে ডাকছে।”
-”কেন?”
-”জানিনা।”
-” যাচ্ছি, তা তুই কেঁদেছিস কেন?”
-”কই না তো।”
-”আবার!
-”পাশের বাসার ছোটন আমাকে ল্যাংড়া বলেছে।”
-” ল্যাংড়াকে তো ল্যাংড়াই বলবে এখানে কান্নাকাটির কী আছে?”
রোজা হাসিপূর্ণ মুখখানা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। আদুরে মুখখানাতে জমা হলো একরাশ বিষণ্নতা। ডাগর ডাগর চোখ দুটোতে দেখা দিলো অবাধ্য নোনাজল। মলিন বদন নামিয়ে একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেল মেয়েটা। যেন বাক্শক্তিহীন।
পরক্ষণেই সে ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদতে গিয়েও চেপে গেল। তবে তার আখিঁদ্বয় দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে গেল কয়েকফোঁটা
অশ্রুধারা। সে আর কথা না বাড়িয়ে ওর হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে যেতে গেলে তিতাস তাকে আঁটকে ধরল। হাঁটু গেড়ে বসল রোজার সামনে। তারপর ওর চোখ মুছিয়ে মৃদু হাসল।
রোজা তখনো নির্লিপ্ত, পরিবর্তনশূন্য। তিতাস ওর মুখখানা
তুলে, পিয়াসের বেলকনিতে লাগানো সদ্য ফোটা গোলাপটা দেখিয়ে বলল,
-”বনু বল তো, গাছে গোলাপ না ফুটে যদি সাদা খরগোশের বাচ্চা ফুটত তাহলে কেমন হতো?”
তিতাসের এ কথা শুনে রোজা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল। এ আবার কেমন কথা? গাছে আবার খরগোশ ফুটে নাকি? তাও আবার সাদা খরগোশ। গাছে না ফুটে এমনিতেই ভালো দেখায়, দেখতে আদুরে লাগে। তাছাড়া গাছে ফুটলে, খরগোশ ঝুলে থাকত, খুব কষ্ট পেতো। তখন মোটেও ভালো দেখাত না। একথা ভেবে রোজা জবাবে বলল,
-”মোটেও ভালো দেখাত না। ফুল গাছেই সুন্দর দেখায়।”
-“সত্যি তো?”
-”হুম।”
-” আমাদের সৃষ্টিকর্তা যাকে যতটুকু প্রয়োজন তাকে ঠিক ততটুকুই সৌন্দর্য দান করেন। ল্যাংড়া বলে কষ্ট পাচ্ছিস, কাঁদছিস, এটা ঠিক না বনু। সব সময় ভাববি তোর সঙ্গে যা হচ্ছে বা হবে সব সৃষ্টিকর্তার মর্জিতে। উনার হুকুম ব্যতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না।”
-” ছোট মিয়া আমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে আমাকে কি খুব পঁচা দেখাত? এজন্যই কি আমার আল্লাহ আমাকে এমন বানিয়েছেন?
-”বনু, পৃথিবীতে এমন আরো অনেকক মানুষ আছে। তারাও বেঁচে আছে, নিজেদের পরিচিতি লাভ করছে।এজন্য বলছি,
শরীরের ত্রুটির কাছে নিজেকে গুটিয়ে রাখিস না। কষ্ট পেয়ে বোকার মতো কেঁদে হাল ছাড়িস না। বরং এখন থেকে দশের একজন হয়ে দেখা। সর্বদা মনে রাখবি, যাদের নজর সর্বদা অন্যের দিকে তারা জীবনে কিছু করতে পারে না। হিংসাতে জ্বলতে জ্বলতে জীবনে যায় তাদের। আজ ছোটন বলেছে, কাল অন্য একজন বলবে। এরচেয়ে মেনে নে তুই ল্যাংড়া।
ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিকভাবে গ্রহন কর। আশেপাশের মানুষদের কথাকে অগ্রাহ্য করে মনে রাখ, তুই আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ। তখন দেখবি, কষ্ট লাগবে না।”
রোজা কথাগুলো মনে দিয়ে শুনে মাথা নাড়াল, খুশি হলো।
তখন চাচী চেঁচিয়ে বললেন,
-”তিতাস! রোজা! হারিয়ে গেলি নাকি দু’জন? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়।”
তিতাস রোজার হুইলচেয়ার ঠেলে ড্রয়িংরুমের দিকে গেল।
ততক্ষণে এটা ওটা বলে রোজার মুখে হাসিও ফুটাল। রোজা এখন খিলখিল করে হাসছে। তিতাস সেখানে পৌঁছে দেখে তার মা সোফায় বসে আছেন। পাশেই ওর বাবা ফোনে কথা বলছেন। কথা শুনে মনে হচ্ছে ফোনের অপর পাশের ব্যক্তি ভোর। কারণ তিনি ভোরের সঙ্গে এভাবে কথা বলেন। একটা কথার আগে পিছে দুইবার করে ‘মা’ শব্দ যুক্ত করেন। আদর যেন ঠিকরে পড়ে। সকালবেলা এসবের মানে তার বোধগম্য হচ্ছে না। আম্মু বাসায় কেন? ডিসচার্জ করাল কে? আসবেই যখন তাকে কেন জানাল না?
এসব ভেবে সে কিছু বলতে গেলে ওর বাবা ইশারায় নিষেধ করলেন। তিতাস ইশারা বুঝে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওর থমথমে মুখশ্রী দেখে ওর আম্মু মৃদু হাসলেন। তিতাস এগিয়ে গিয়ে উনার পাশে বসতেই সেখানে রবিন উপস্থিত হলো। সে
একগাল হেসে হাতের জিনিসগুলো একে একে তার বাবাকে বুঝিয়ে দিলো। তারপর অকারণেই হেসে বিদায় নিলো। এই ছেলেটা ভোরের সহকারী। তিতাস তাকে দু’চক্ষে সহ্য করতে পারে না। ওকে দেখলেই ওর মনে হয় নাক বরাবর লাগাতার
ঘুষি বসিয়ে দিতে। নয়তো গন্ধযুক্ত ডোবার পানিতে গড়াগড়ি খাওয়াতে। তারপর জিজ্ঞাসা করতে, ‘রবিন ভালো আছো?’
তখনো হয়তো সে বরাবরের মতোই হলুদ দাঁত বের একগাল হেসে জবাব দিবে, ‘হ্যাঁ, ভাই।’
একে নিয়েও ভোরের সঙ্গে তার একদফা ঝগড়া হয়ে গেছে।
রবিনের দোষ অকারণেই হাসে। সিরিয়াস পরিস্থিতিতেও সে হাসি থামাতে পারে না। সামান্য কারণে হেসে লুটোপুটি খায়।
যেটা তার একেবারেই পছন্দ নয়। ওর কথা হচ্ছে, সিরিয়াস পরিস্থিতিতে আমি হাসব। তবে আমার সামনে কেউ হাসতে পারবে না। হঠাৎ তিতাসের মাথায় খেলো গেল, রবিন যেহেতু এখানে অর্থাৎ ভোরই ওর মাকে ডিসচার্জ করিয়েছে। নতুবা
তাকে না জানিয়ে উনারা আসতেন না। যদিও ওর মা আগের তুলনায় কিছুটা সুস্থ। এই নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে সোজা রুমে চলে গেল। তারপর ভোরকে কল করল,
-”হ্যাঁ বল তিতাস।”
-‘হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ?”
-‘জানিসই তো কেউ বা কারা তোদের নজরে রাখছে। কী ভাবিস তুই নিজেই চালাক? না বললে জানতেও পারব না?’
তিতাস ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে মৃদু হাসল। তারপর কথা কাটাতে বলল,
-‘ সবার ভাগ্যে সিনিয়র বুদ্ধিমতী বউ জুটে না। সেই ক্ষেতে আমি কিন্তু খুব সৌভাগ্যবান।’
-‘পেয়েছিস নাকি? বিয়ে হলো কবে?কই দাওয়াত টাওয়াতও তো পেলাম না?’
-‘পাই নি। তবে তাকে আমি জয় করে নিবোই, নিবো। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হয়, সে আমাকে ভয় পায়। এজন্যই ধরা দিচ্ছে না।’
ভোর জুসের গ্লাসটা নিঃশব্দে রেখে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-‘কিসের ভয়?’
তিতাস তখন ফিচেল কন্ঠে ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো,
-‘আমাকে ভালোবেসে ফেলার ভয়।’
একথা শুনে অপর পাশে তখন পিনপতন নীরাবতা। হঠাৎ কল কেটে গেল। তিতাস কান থেকে ফোন সরিয়ে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল,
-‘ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।’-
তখন রাত সবে সাড়ে আটটা। তিতাস সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে কেবল হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরল। শুভ্র শার্টের বোতাম খুলে শরীর এলিয়ে দিলো নরম তুলতুলে সোফায়।
হাত বাড়িয়ে রিমোর্ট নিয়ে টিভিতে গান চালু করল। পছন্দের গান দেখে নিজেও গেয়েও উঠল দু’টো লাইন। তারপর গলা ছেড়ে চাচীকে ডেকে বলল, ‘চাচী, শরবত বানিয়ে দাও’ তার একটু পরে, ‘চাচী, কফি করে দাও’ মিনিট পাঁচেক পরে,’চাচী ঝাল কিছু বানাও তো’ এমনভাবে একের পর এক আবদার চলতেই থাকল। আর চাচী ব্যস্ত হাতে তার আবদার মিটাতে লাগলেন। কারণ তিতাসের এমন কান্ডে অভ্যস্ত তিনি। বরং সে আবদার না করলেই শূন্য শূন্য লাগে। এর আধা পরেই, কলিংবেল বেজে উঠল। তিতাস শুনেও অলস ভঙ্গিতে শুয়ে রইল। ঘাড়ত্যাড়া এই ছেলে উঠবে না জেনে ওর বাবা নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন। ভোর লাগেজ হাতে ভেতরে ঢুকে
অপর পাশের সোফায় বসল। তিতাস ওকে দেখে উঠে বসে বসল। ততক্ষণে ওর বাবা রান্নাঘরে গিয়ে চাচীকে ভোরকে রুমে দিয়ে আসার কথা বললেন। তিতাস সেদিকে একবার তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
-‘কাহিনি কি?’
ভোর এবার তিতাসের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
-‘সর্ষের মধ্যে নাকি ভূত লুকিয়ে থাকে। তাই ভূত খুঁজতে সোজা এখানে চলে এলাম। হতেও তো পারে ভূত আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে। অথচ আমরা বুঝতে পারছি না।’
To be continue…….!!