শব্দহীন_বৃষ্টি (১৭)+(১৮)

0
884

শব্দহীন_বৃষ্টি
(১৭)+(১৮)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
________________________

সাগর খুঁজে ফিরে হতাশ হয়েছে বারবার। কোথাও পায়নি সেই ডায়েরির মালিক কে। একবার মনে হয়েছিলো মানুষটি অন্য কেউ নয় সে মাহি। আর তাই একদিন তো মাহিকে পড়ানোর সময় ইচ্ছে করেই ডায়েরিটা মাহির বইয়ের নিচে রেখেছিলো৷ নিশ্চয়ই মেয়েটা খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করবে ডায়েরিটা কোথায় পেয়েছে? তেমন কিছুই হয় নি। ডায়েরিটার উপর থেকে নিজের বই খাতা নিয়েছিলে তবুও বলেনি সেটা তার নিজের৷ মাহির ও পরীক্ষা শেষ হলে মাহি আর আসেনি সাগরের কাছে৷ সাগরের ও আর ঘুরে ফিরে সময় কাটানোর সুযোগ ছিলো না। জব পেয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটে তার অফিসে। সন্ধ্যের পর বাকিটা সময় বাড়িতেই কাটায়৷ বিশেষ করে মা আর দাদুনীর সাথে। সৈকতের দূরে থাকা এ দু’জন মানুষকে সব চাইতে বেশি কষ্ট দেয়। তাই নিজেই চেষ্টা করে তাদের মুখে হাসির রেখা টানার। আর মাঝেমধ্যে চলে ছাঁদের কিনারায় বসে গান তবে এখন আর সেই গানে কোন সঙ্গী থাকে না। নিঃসঙ্গ সময়ে মনে মনে সেই অচেনা মেয়েটির খোঁজ করে সাগর। তাকে পাওয়া যায় না অথচ সেই নিঃসঙ্গতায় পাশের ছাঁদে ঠিকই থাকে অন্য একজন মানুষ । মুখ খোলে না এখন আর এই মেয়েটিও শুধু দূর থেকে দেখে তাকে৷ সাগর টের পায় মাহি অভিমান করে আছে। কেন এত অভিমান করে এই মেয়েটা? কোন প্রকার কমিটমেন্ট তো করে নি সে তবুও এত কিসের অধিকার বোধ মেয়েটার। আজও গিটারের তারে হাত রেখেছে সে মনে মনে গান খুঁজছে এই সময়ের জন্য এই অধিকার দেখিয়ে অভিমান করা মেয়েটার জন্য । আজ স্বপ্নকুমারী কে সে ভুলে থাকবে৷ ওপাশের ছাঁদে লুকিয়ে থাকা মেয়েটার জন্য আজ নিজের মনকে জোর করে দেখবে একটি বার।চোখ বুঁজে আঙ্গুল চালাল সাগর।

সে যে বসে আছে একা একা
রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে

সে যে চেয়ে আছে ভরা চোখে
জানালার ফাঁকে মেঘ ধরতে

তার গুনগুন মনের গান বাতাসে উড়ে
কান পাতো মনে পাবে শুনতে….(বাকিটা শুনে নিয়েন)

মৃদুমন্দ বাতাসে গানের সুরটা মাহিকে মাতাল করে দিচ্ছে৷ কারো কন্ঠস্বর ও যে এতোটা সম্মোহনী শক্তি রাখে জানা ছিলো না। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মেয়েটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে ছাঁদের রেলিং এর কাছে। ঠিক সেদিকে যেদিকটায় সাগর দাঁড়িয়ে গান গাইছিলো। মাহি যখন সম্মুখে এসে পড়ে তখনই সাগর চোখ খোলে, আঙ্গুল থেমে যায় থামে তার ঠোঁট ও। হঠাৎ সব থেমে যাওয়ায় হকচকিয়ে গেল মাহি।

–” লুকিয়ে লুকিয়ে গান শোনো প্রতিদিন?”

–” নাহ।”

–” মিথ্যে বলো কেন?”

–” আপনার সব কথা এত প্রশ্নবোধক হয় কেন?”

–” কথা ঘোরাচ্ছ কেন?”

–” আবারও প্রশ্ন!” অন্ধকারেই সাগরের মুখটাকে দেখার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে মাহিয়া। খুব কাছে দু’জন। পাশাপাশি দু’টো রেলিং এর দুরত্ব মাত্র । কতটুকু আর হবে দুটো ইটের প্রস্থ! দশ ইঞ্চি? এতটুকুই দুরত্ব মানুষ দু’টির। একজন অন্যজনের শরীরে ঘ্রাণ চাইলেই নিতে পারে। চাইলের পারে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে। মাহির অবাধ্য মন অন্তত একটিবার বেহায়া হয়ে সাগরের খোঁচা দাঁড়ি ভর্তি গালে হাত রাখতে।

–” ঘোর লাগা চোখে প্রতিদিন কি দেখো জানালায় দাঁড়িয়ে ? “সাগর আবারও প্রশ্ন করলো।

–” আমার ভুবন।”

–” ফিল্মি ডায়লগ শিখেছো বেশ।”

–” আপনিও তো ফিল্মের হিরো সেজে ঘুরেন তবে আমি ডায়লগ ঝারলে দোষ কি?”

–” একটা বছরের ও বেশি সময় হয়ে গেছে মাহিয়া। এতদিনে তোমার এ আবেগ কেটে যাওয়া উচিত ছিলো “।

–” উহুম, মোহ! মোহ হলে কেটে যেত ভালোবাসা কেটে যায় কিংবা কমে যায় না।”

–” তুমি আমার চেয়ে কম করে ও হলে ও বয়সে দশ বছরের ছোট হবে। সামলে নাও নিজেকে এখনও সময় আছে।”

–” সামলে কি করবো?”

— তুমি যে একটা বেয়াদব তা কি তুমি জানো?”

–” হুম, ঠিক দেড় বছর আগে কেউ আমায় বিড়বিড় করে বলেছিলো আমি নাকি বেয়াদব চরম বেয়াদব। আমার মনে আছে কথাটা এখন ও। ”

–” আর কি মনে আছে? ”

–” সব যা ওই ব্যক্তি সম্পর্কিত।”

–” ওভার কনফিডেন্স ভালো নয় ” বলতে বলতে সাগর গিটারটা রেলিং এ দাঁড় করালো।

–” সাগর শুনুন”!

মাহির এমন নাম ধরে ডাকায় চমকে গেল সাগর। এই বাচ্চা মেয়েটা তার নাম ধরে ডাকলো! সাহস দেখে হতভম্ব।

–” তুমি আমার নাম ধরে ডাকলে?”

–” নাহ, রাস্তার ওপাশে একটা ছেলে আছে। দেখেন দেখেন ওই যে তাকে নাম ধরে ডেকেছি।” মুখ টিপে হাসছে মাহি।

–” আচ্ছা শুনুন না যে জন্য ডেকেছি।”

–” বলো” গম্ভীর মুখে বলল সাগর।

–” আপনি কি করে জানলেন আমি জানালায় দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখি প্রতিদিন।”

–” রাক্ষুসে চোখে কাউকে গিলে খেলে সে টের পাবে না! আর জানালায় দাঁড়িয়ে দেখো আশেপাশের বাড়ির মানুষদের কি চোখ নেই তারা তো দেখে তোমার কান্ড”।

–” সত্যি” চমকালো ভীষণ রকম মাহি। সে জানালায় দাঁড়িয়ে সাগরের গেট থেকে বের হওয়া দেখে সকালে। কিন্তু সেটা আরো কেউ কি করে খেয়াল করতে পারে!

–” সাথী দেখেছিলো একদিন। তারপর নাকি পরপর কয়েকদিন দেখে বুঝতে পেরেছে”।

–” কি বুঝতে পেরেছে?” বেশ আগ্রহের সাথে এবারের প্রশ্নটা করলো মাহি।

–” এই যে তুমি চোরের মত আমাকে লক্ষ্য করো”।

–” ওহ, তবে তে ভালোই হলো একজন অন্তত আগেই জেনেছে বাকিরা ও জানবে ধীরে ধীরে “।

–” এ্যাই মেয়ে সব কিছু কি ফাজলামি মনে হয় তোমার! ভবিষ্যতে কি হবে সেই চিন্তা কি আছে তোমার?”

–” সে চিন্তা করার মত বোকা আমি নই যেখানে সবটা স্পষ্ট। ”

–” কি স্পষ্ট? ”

–” হয় আমি আর আপনি প্রেম করবো পরিবার মেনে নিলে সংসার হবে। আর না হয় আপনি আমাকে এভাবেই এভোয়েড করে অন্য কাউকে বিয়ে করবেন আমার ও অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর কোন এক বর্ষার রাতে আপনার কথা ভেবে কেঁদে কেটে এই পুরনো রাতটাকে মনে করবো। যে রাতে আপনি আর আমি দু’ছাদে দাঁড়িয়ে মনের কথা প্রকাশ করেছি। যে রাতে আপনি আমায় একটিবার যাচাই করতে আমার জন্য গান গেয়েছিলেন।”

চমকে গেল সাগর। কি বলছে মেয়েটা! মনের গহীনে উঁকি দিতে জানে নাকি সে?

–” অত কেন ভাবছেন মশাই? আপনার মনের কথা আমার জানার কথা নয়। আজ আপনার গানে বিমোহিত হয়ে আমি যখন সামনে এলাম। তখন আপনার দৃষ্টি আমায় এই অন্ধকারে ও খুব করে দেখার চেষ্টা করছিলো৷ আমার মুখে আলো না পড়লেও ওই যে আলোখানি সেটা আপনার কপাল থেকে সরু নাকটা অব্ধি ঠিকই আলো দিচ্ছিলো। তাই চোখটা পড়তে সুবিধা হলো আমার। ” সাগরদের চিলেকোঠার দরজায় থাকা লাইটের আলোটার দিকে ইশারা করে বলল মাহি।

সাগরের কি হলো কে জানে আচমকা বাহু আঁকড়ে ধরলো মাহির। চোখ মুখ গম্ভীর বরাবরই তার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই মুখে আগুনের উত্তাপ ও আছে। খুব শক্ত করে ধরে আছে মাহিকে সে৷ যেন আর একটু জোর দিলেই হাড় মাংস সব এক হয়ে যাবে। মাহির চোখে চোখ রেখে বলল, ” কেন করছো পাগলামি। সইতে পারবে না শেষটা। দেড়টা বছরেও কি বুঝাতে পারি নি আমার থেকে দূরে থাকতে হবে তোমায়! আমি ভয়ংকর মাহিয়া। আমার জীবনে যে আসবে তার ধ্বংস অনিবার্য। তার নিজের বলতে কিচ্ছু থাকবে না শুধু থাকবো আমি আর আমার পরিবার “। আলো আঁধারে মিশে আছে সাগরের চোখ মুখ। মাহি ভয় পাচ্ছে , বাহুতে ব্যাথা ও পাচ্ছে অথচ মনের ভেতর খুশির ডঙ্কাপেটা হচ্ছে । সাগরের বলা উক্তিগুলো সেকেন্ডেই মাহি মিলিয়ে নিয়েছে অর্থসহ। সাগর তাকে আহ্বান করছে নিজের জীবনে সাথে সতর্কবার্তা ও দিচ্ছে। জবাব তৈরি মাহির।

–” ভয় দেখাচ্ছেন! আমি তো সর্বস্ব আপনার নামে এক্ষুনি করে দিতে রাজী। আপনি ভয়ংকর কতোটা আমিও দেখবো। ”

পরেরদিন সকালে সাগর ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসে। বাবা আর চাচু আগেই বসা ছিলো। এখন আর ছোট চাচুর দেখা পাওয়া যায় না। যখন থেকে ঘটিবাটি আলাদা তখন থেকেই তাদের সব দোতলায় শিফট হয়েছে। সাথী,যুথি ও নিচে তেমন একটা আসে না তাদের পড়ার ঘর ও এখন দোতলায়। সমুদ্র তো হোস্টেলে থাকে তাই বাড়িতে এখন বাচ্চা বলতে তিথি একাই। শৈবাল, সাথী,যুথি কে চাচী আজকাল কড়া শাষণে রেখেছে৷ তাদের চলাফেরায় চাচীর খুশি মত আধুনিকতার নামে কিছুটা উশৃংখলতা যুক্ত হয়েছে। দেড় বছর আগের বাড়ির চেহারা সাথে এখনকার বাড়ির কোন মিল নেই। সকাল আর রাতের খাবারে খেতে আসলেই মন খারাপ হয় সাগরের। বাবার দিকে তাকিয়ে চুপ থাকে সাগর। সাগর ভাবে বাবার দিকটা “কিইবা করার আছে আর যেখানে নিজের ছেলেই বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়েছে সেখানে তার ভাই কে কি বলা যায়।”

–” আজকাল সালাম দেওয়া খুব একটা মনে থাকে না তোমার?” হঠাৎ পকেট থেকে একটা চেক বের করতে করতে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন শহিদুল ইসলাম।

–” দুঃখিত বাবা! আসসালামু আলাইকুম। ” সালাম দিয়েই মাথা নিচু করলো সাগর। চাচু আর বাবা দু’জনেই একসাথে সালামের জবাব দিলেন। ততক্ষণে তিথি এসে সালাম দিয়ে বাবা আর চাচুর মাঝে এক চেয়ারে বসে গেছে।

–” কথাটা ভাইয়া এখন বললে ভালো হয় না! এখনই সবাই এখানে আছে। ” কিছু একটা ইঙ্গিত করে বললেন সমুদ্রের বাবা জাহিদুল ইসলাম।

–” হ্যা জাহিদ, আমিও এখনই বলবো ভাবছি আর তুমি যেহেতু চাচ্ছো তুমি নিজে কিনতে যাবে না তাই বলি কি, সমুদ্র কে বলো আসতে দু’একদিনের জন্য । তারা দু’ভাই মিলে কিনবে”।

–” ঠিক আছে ভাইয়া”।

–” কি কিনবে বড় বাবা”?তিথি প্রশ্ন করলো সাগর ও করতো কিন্তু তার আর প্রয়োজন নেই।

–” ছোট আম্মা আপনার দাদুনীকে বলেন নাশতার জন্য আসতে। তখনই বলবো। ” বড়বাবার কথা শুনে তিথি আর এক সেকেন্ড ও দেরি করেনি৷ সাগর ও বেশ কৌতুহলী হয়ে বসে আছে। কি কেনার কথা বলছে বাবা আর চাচু মিলে।

খানিকক্ষণ পরে তিথি ফিরে এলো দাদুনীকে সাথে নিয়ে। টেবিলে ও নাশতা সাজানো হয়ে গেছে। সাগরের মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে কিন্তু তাহমিনা এখনও রান্নাঘরে দেখে সাগরের বাবা ডাকলেন তাহমিনাকে৷ সাগর বুঝতে পেরেছে বিশেষ কোন কথা হবে তাই বাবা সবাই কে একসাথে চাচ্ছেন। সবাই যখন একসাথে হলো তখন হাতের চেকটা শহিদুল ইসলাম মায়ের হাতে এগিয়ে দিলেন।

–” এইডা কি বড় আব্বা?”

–” এটা টাকার চেক আম্মা। আমাদের ব্যবসার গত পাঁচ মাসের লাভের টাকা আছে এখানে। এই কাগজটার মূল্য যত ওই সব টাকা আমাদের দুই ভাইয়ের ভাগের। পঞ্চাশ লাখ টাকার চেক। এখানে অনেক টাকা আছে আম্মা।” বলার সময় গলাটা যেন হালকা কাঁপছিলো সাগরের বাবার। পরিবারের সবাই শুনেই খুশিতে আত্মহারা। সকাল সকাল এত বড় একটা সুখবর এই আধ সুখী পরিবারের মানুষদের এক ঝলক সুখের ছোঁয়া দিয়ে গেল। ছোট ভাই রিয়াদুল ব্যবসা আলাদা করে নেওয়ার পর অনেকটা হোঁচট খেয়েছিলো এ দুই ভাই ব্যবসা জগতে। কাজের শক্তি থাকলে ও মনের শক্তি ঠিকঠাক ছিলো না তাদের । সাগরকে অনেক বলে কয়ে ও ব্যবসায় আনতে পারেনি তার বাবা। তবে ব্যবসার বাইরে সে বিভিন্ন ভাবে বাবা আর চাচার অনেক সহযোগিতা সে করে গেছে। প্রায় ছ’মাস আগে চট্টগ্রামের এক কোম্পানির সাথে নিজেদের কোম্পানির ডিলের ব্যাপারে কথা বলেছিলো। ব্যাপরটা ছিলো সম্পূর্ণ লুকায়িত কলেজের এক বন্ধুর বাবার কোম্পানির সাথে। সাগর শুধু পথ বের করেছিলো।সেই পথ অতিক্রম করেছিলো বাবা আর চাচু। আজ পরিবারের এত খুশি দেখে বহুদিন পর মনের ভেতর এক সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে । খুশিতেই সাগর প্লেট ভরে খাবার নিচ্ছে। আজ আর হালকা নাশতা করবে না সে৷ তার এই খাওয়ার মাঝেই ব্যাঘাত ঘটালো তিথি।

–” ও বর মশাই তোমার ঘাড়ে কি হয়েছে?” তিথির কথা শুনে গলায় খাবার আটকে গেল সাগরের । আর সবার দৃষ্টি সাগরের ঘারের দিকে।

–” ওমা, হাচাই তো কি হইছে তর গর্দানে।”

–” আ আ আমার নখের আচর লেগেছে ঘুমের মধ্যে। ”

চলবে।

#শব্দহীন_বৃষ্টি
(১৮)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
আজ কোন ক্লাস নেই মাহির। তাই বেশ বেলায় করেই ঘুম থেকে উঠলো সে৷ আজ আর সাগরকে দেখার তাড়া ও নেই তার। ঘড়িতে সময় এগারোটা বত্রিশ। সাগরের অফিসের জন্য বের হওয়ার টাইম সাড়ে নয়টা। অফিস তো দূরে নয় মাহিয়ার পুরনো স্কুলের কাছেই আবার তার বর্তমান কলেজের কাছে। তাই ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে সাড়ে নয়টায় বের হয় বাড়ি থেকে। সাগর বুঝতে পারতো মাহির এই বের হওয়ার কারণ তাই যথেষ্ট এভোয়েড করে চলতো৷ মাহির আজ শরীরে আলস্য একটু বেশিই ভর করেছে নাকি অন্য কোন ব্যাপার কে জানে৷ একটু ও ইচ্ছে করছে না তার বিছানা ছাড়তে বরং ভালো লাগছে সাগরের জন্য করা পুরনো কিছু পাগলামির স্মৃতিচারণ করতে। সময়টা এস এস সি পরীক্ষার আগের সপ্তাহ। পড়ার টেবিলে তখন মাহি বকবক করছে আর সমুদ্র তার বকবকানিতে বিরক্ত হচ্ছে । একেকসময় একেক টপিক চলছে। শেষ চলছিলো নাম নিয়ে কথা। সাগর তখন কোন কাজে বাইরে ছিলো। মাহি বলল তার নাম খুব সুন্দর সবাই খুব পছন্দ করে। সমুদ্র বলল, ” তোমার নাম কমন একটা নাম আজকাল অনেকেই রাখে।”

–” আজাইরা কথা বলবা না একদম৷ ” রেগে গেল মাহি। তার নাম কমন হবে কেন আর যদি কমনই হতো তবে স্কুল জুড়ে মাত্র পাঁচটা মাহি কেন? তা আবার মাহি টুকুই মিলে ফুল নেম তো মাহিয়া কারো নেই৷ ওদেরটা মাহিনুর, মাহিনা, মাহিরা আরেকজন এর কি যেন সেটা মনে নেই এই মুহুর্তে । সমুদ্র মজা পাচ্ছে মাহিকে রাগাতে তাই আবার বলল তোমাদের ভাই বোনদের নাম ও তো মিল নেই।

–” মাহিয়া,মাহিম। কে বলেছে মিল নেই তোমাদের বুঝি মিল আছে?”

–” অবশ্যই আছে নিজেই দেখো মিলিয়ে সৈকত,সাগর,সমুদ্র, শৈবাল”। বুক ফুলিয়ে বলল সমুদ্র।

–” এহ, সৈকত,সাগর,সমুদ্র, শৈবাল চার ভাই।মিল রেখেছে তবে বোন গুলোর নাম কেন শামুক,ঝিনুক,সাপ কেঁচো এগুলো রাখতে পারলো না?” বলেই ফিক করে হেঁসে ফেলল মাহি। একটিবার তাকিয়ে দেখছে না দু’চোড়া চক্ষু কেমন অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে তার দিকে৷ সাগর এসেছে সেদিকে খবরই ছিলো না তার। নাম নিয়ে ঠাট্টার শাস্তি হিসেবে অবশ্য টানা দুইঘন্টা পরিসংখ্যান আর ত্রিকোণমিতি করতে হয়েছে তার। পরেরদিন আবার মাহি ছাঁদে উঠে সাগরকে দেখেই নাম নিয়ে প্রশ্ন করেছে কার নাম কে রেখেছে। নাছোড়বান্দা মাহি সবটা না জেনে ছেড়ে দেবার পাত্রী ছিলো না।

মাহি প্রথমেই বলল, ” তোমার নাম সমুদ্র কে রেখেছিলো?”

–” আমার ফুপ্পি”।

–” সৈকত ভাইয়ার নাম কে রেখেছে? ”

–” সৈকত ভাইয়ার,সাগর ভাইয়ার আর আমার নাম রেখেছে আমাদের সোনালি ফুপ্পি। ফুপ্পির নাকি সমুদ্র সৈকত খুব আপন মনে হয়। সৈকত ভাইয়ার জন্মের সময় তো ফুপ্পির বিয়ে হয়নি। বাড়িতে একমাত্র মেয়ে ফুপ্পি তারওপর সবার আদুরে৷ তাই ফুপ্পির ইচ্ছেতে ভাইয়ার নাম সৈকত রাখা হয়৷ এরপর সাগর ভাইয়া হলো তখন ফু্পির নতুন বিয়ে হয়েছে তখনও ফুপ্পির ইচ্ছেতে ভাইয়ার নাম করণ। আমার বেলায় নাকি ফুপ্পি আর সাগর ভাইয়ার মধ্যে বেশ লড়াই হলো। ভাইয়া তখন নাকি দশ বছরের ছিলো তাই কেউ ভাইয়াকে পাত্তা দেয়নি ফুপ্পিরটাই রাখলো। সেই থেকে ভাইয়া জেদ ধরে বসেছিলো যদি কোন বোন হয় তবে ভাইয়া তাদের নাম রাখবে৷ ফুপ্পিকে আর বাড়িতেই আসতে দিবে না”। সমুদ্রের কথা শেষ হতেই হা হা করে হেঁসে উঠলো মাহিয়া। সমুদ্র আবার বলল, ” সাথী,যুথি,তিথি এমনকি শৈবালের নাম ও ভাইয়া রেখেছে।”

টানা পাঁচ মিনিট ধরে কলিংবেল বাজায় মাহি আর তার স্মৃতিচারণে মন রাখতে পারলো না। একরাশ মেজাজ খারাপ রেখে উঠতে হলো দরজা খুলতে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মা’কে কোথায় না পেয়ে নিজেই গিয়ে দরজা খুলল।

–” খালামনি”! দরজা খুলেই নিরবের মা’কে দেখে খুশিতে চিৎকার করলো মাহি । ততক্ষণে মাহির মা ও গোসল সেরে বেরিয়ে এসেছেন।

–” হ্যা, দেখলেই খালামনি। না দেখলে আর মনেই থাকে না মায়ের বোন একটা খালা ও আছে। ”

–” কেমন আছো আপা?”

–” ঢং করে আর জিজ্ঞেস করতে হবে না। ভালো আছি বলেই তো এসেছি “।

–” খালামনি ভাইয়া আসে নি?”

–” আসতেছে নিরব সাথে তোর খালু। ” শিউলির কথা শুনে অবাক হলো চামেলি আর মাহি। খালু মানুষটা খুবই ব্যবসায়িক সচরাচর তাকে কোথাও যেতে দেখা যায় না। এমনকি ছুটির দিনে ও নিজের ঘরের ভেতর অফিস খুলে বসেন। ওনি আসছেন এখানে! মাহি জিজ্ঞেস করলো, ” কিছু কি হয়েছে? খালু তো আসেন না কখনও৷ ”

–” হুম, একটু সবুর কর বাপ ছেলে দু’জনেই আসবে। মনজুর ভাই কে ও বলেছি ফোন করে বাসায় আসতে।”

আৎকে উঠলো চামেলি। মাহির বাবা অফিসে গেছে আটটায়। এরপর আর কথা হয় নি কোন ঘটনা থাকলে নিশ্চয়ই ওনি মাহিকে কিংবা তার মা’কে বলতো। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে শুধু শিউলি নিজেই কিছু খিচুড়ি পাকাচ্ছে। কথা বলতে বলতে মাহি খালাকে নিয়ে সোজা ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসালো।

–” খালামনি দু’মিনিট বসো আমি ব্রাশ করে আসছি নাশতা করবো একসাথে। ”

–” আচ্ছা যা তুই। এই চামেলি কি নাশতা বানিয়েছিস সকালে?”

মাহি দাত ব্রাশ করে আসার আগেই নিরব আর তার বাবা চলে এসেছে। সবাই নাশতার টেবিলেই জড়ো হলো৷ চামেলি ঝটপট কিছু নাশতার ব্যবস্থা করলো। কাল মাহিমের জন্য টিক্কা বানিয়েছিলো। কিছু টিক্কা ফ্রাই না করেই রেখে দিয়েছিলো। এখন সেগুলোও বের করলো। মাহি খালুকে দেখে সালাম দিলো। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে চেয়ার টেনে বসলো। নিরব তো মাহিকে দেখেই মাথায় চাটি মারলো।

–” কিরে তোর পড়ালেখা কেমন চলে?”

–” উফ ভাইয়া মেরেই বলতে হবে কথাটা! খালামনি কিছু বলবা ভাইয়াকে?” অনুযোগের স্বরে বলল মাহি।

–” নিরব একদম মারবি না আমার রাজকন্যাকে “।
কথার ফাঁকে কমবেশি সবাই খাচ্ছে কিছু না কিছু। মাহিও গরম গরম একটা টিক্কা মুখে পুরতেই ‘আহ্’ করে উঠলো। নিচের ঠোঁটের ভেতর দিকটা জ্বলে যাচ্ছে তার। টিক্কায় থাকা এক টুকরো মরিচ লেগেছে বোধ হয়।

–” কি হয়েছে তোর? টিক্কা তো তেমন ঝাল হয় নি।” চিন্তিত ভাবে বললেন শিউলি। উপস্থিত সবাই এখন মাহির দিকে তাকিয়ে আছে।

–” তোর ঠোঁট ফোলা কেন ওরকম? কেটে গেছে না’কি?” নিরব কথাটা বলতেই মাহির বুকের ভেতর প্রাণপাখিটা যেন আৎকে উঠলো। ভাইয়া কি তবে কিছু বুঝতে পারলো?

কাল রাতে-
সাগর কাল রাতে মাহির বাহু আঁকড়ে ধরার পর শুধু কথোপকথন নয় আর ও কিছু হয়েছিলো। মাহি উস্কে দিয়েছিলো কথায় কথায় সাগরকে। আর সাগর ও জেদে পড়ে কামড়ে ধরেছিলো মাহির ঠোঁট।

–” আমার জীবনে এসো না মাহিয়া৷”

–” আসবো আমি বারংবার জোর করে আসবো ঠিক ততোটা জোর করে যতোটা জোর করলে আপনার আমাকে ভালো না বাসার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ভালোবাসার অঙ্গীকারবদ্ধ হবে।”

–” আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো আর খুব শিগ্রই করবো। তোমার অধিকারবোধ ভেঙে চুরে গুঁড়িয়ে দিবো “।

–” খুন করে ফেলবো মিষ্টার সাগর আহমে…. ” আর কিছু বলার আগেই সাগর হিংস্র হায়েনার মত খাবলে ধরেছিলো মাহির ঠোঁট। দাঁত বসে গিয়েছে ঠোঁটের ভেতর ফুলে গেছে নিচের ঠোঁটটাই। মাহিও খামচে ধরেছিল সাগরের ঘাড়। নখের আঁচড়ে টেনে দিয়েছিলো এক লম্বা রেখা।

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। মন্তব্য তো কেউ ভুল করেও করেন না হাতে গোনা দু,তিনজন ছাড়া তাই আর লিখতেও ভালো লাগে না)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here