#প্রিয়_তুই,০৭,০৮
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৭
-”আম্মু একগ্লাস পানি দাও।’
কথাটা বলে তিতাস বসল। ঘামে ভেজা শার্টের দু’টো বোতাম খুলে সোফায় মাথা হেলিয়ে দিলো। ক্লান্তিতে দেহখানা ভেঙে আসছে। রোজ কতশত রোগীরা বিদায় হচ্ছে, পরক্ষণে তিন গুন এসে জায়গা দখল করছে। দম ফেলাবারও উপায় নেই। হাও কাউ চেঁচামেচি তো আছেই।তাছাড়া আজকাল যেভাবে বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে, না এসেই বা উপায় কি! পন্ডিত কিছু
ব্যক্তিরা, একবেলা খাওয়া বন্ধ রাখবে তাও বাচ্চা উৎপাদন করা থামাবে না। তাদের যুক্তিও তৈরি করা আছে, খাওয়াবে তারা, পালবে তারা, ডাক্তারের কথায় কেন বাচ্চা নিবে না?
ডাক্তার কি একবেলা খেতে দিবে? নাকি ভিজিট ছাড়া রোগী দেখে দিবে? মূলত এদের বোঝানোই দায়। তাছাড়া হতভাগা
কিছু ডাক্তার তো আছেই সেবা প্রদান করতে। দিন রাত এক করে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে হাড় মাস ক্ষয় করতে। একদল মানুষ বলে, ‘আহা, ডাক্তারদের জীবন কতই না সুখের! শুধু টাকা আর টাকা। এদের টাকার রাখার অভাব নেই। ‘ অথচ কত ঠ্যা’লা’ সামলে ডাক্তার হয় এই কষ্ট চোখে পড়ে না। এই সমাজও তাই, সর্বদা চোখের সামনে যা আসে তাইই বিশ্বাস করে। আগে পিছে ভালো মন্দ কিছু থাকে ভেবেও দেখে না।
যেমন আজ বিকেলের ঘটনা, হসপিটালে এক মহিলার ছয় নাম্বার বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি করা হয়েছে। দু’জনে ভালো
আছেন। তবে উনার পূর্বের ছয়টা মেয়ে আছে, আর এবারও মেয়ে হয়েছে। মহিলার স্বামী তখন বিরস মুখে বসে ছিলেন। উনি আশা করেছিলেন ছেলে হবে, আশা ভঙ্গ হওয়াতে মুখ মলিন হয়ে আছে। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ থম মেরে বসে সদ্য জন্মানো মেয়েটিকে কোলে নিলেন, কপালে, গালে, আদর দিলেন। আলতো স্পর্শে নাক ছুঁয়ে হেসে বললেন,”পরেরবার তোমার ভাই হবে, তাই না মা?”
অর্থাৎ উনি নতুন উদ্যমে আবার বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। তিতাস তখন নাস্তা সারতে যাচ্ছিল। তার অভ্যাস, নতুন বাচ্চা কোলে নেওয়া পর বাবারা কিভাবে খুশি প্রকাশ করে, সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা। কেন জানি ভালো লাগে তার। মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য এটা।
এতদিনে ওর ভালো মন্দ সব রকমের অভিজ্ঞতায় হয়েছে। কাউকে বাচ্চা কোলে নিয়ে খুশিতে কাঁদতে দেখেছে। কাউকে হেলা করে দূরে সরিয়ে দিতে দেখেছে। এমনও দেখেছে, দুই মেয়ে হওয়াতে অন্যকে বাচ্চা দিয়ে দিতে। বিনিময়ে টাকা নিতে। কতটা পাষাণ, নির্দয় তারা! এসব চোখে দেখেও কিছু বলার থাকে না। কিন্তু আজকের ঘটনা দেখে সে লোকটার কাছে গিয়ে বলেছে,
-”ভাই, ট্রেনের বগির মতো একের পর এক বগি বানাতেই আছেন দেখছি। তবে দোয়া করি, আপনার উদ্দেশ্য যেন সফল হয়। পুরো দমে ষোলোটা বগি নিয়ে যেন একটা ট্রেন বানাতে পারেন। বউ মরলে মরুক, তাও উদ্দেশ্য ভুলবেন না, ঠিক আছে?’
একথা শুনে লোকটা কথা মাথা নিচু করে ফেলেছে। ডাক্তার
জেনে কথা বাড়ায় নি। তবে তিতাসের করা অপমান ঠিকই বুঝেছে। তিতাস তার কাজ সেরে আজ তাড়াতাড়িই ফিরতে চেয়েছিল, হলো কই। রবিনের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়েছিল, তখন আবার রোগী আসল। রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সময় গড়িয়ে দেরিও হয়ে গেল। তবে আজ বাসার পরিবেশ
দেখে অবাক হলো। বিশেষ করে ড্রয়িংরুমের টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল চলছে না। তার মা ও চাচীকে আশেপাশেও দেখছে না। ভোরের রুমের দরজা বন্ধ। রোজাও সাড়াশব্দ নেই। সে পানি চায়ল তবুও কেউ আসল না। আশ্চর্য আজ হলো কি!
এমনিতেও বাসায় যুদ্ধ হওয়ার কথা। বাবা-মায়ের মধ্যে খুব ভালো মতো প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছে। সে আসার আগেই সব যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল নাকি? তাছাড়া বাবা কি বাসায় আছেন? নাকি উনাকে বের করে দেওয়া হয়েছে? ঠিকই আছে, বলবে আর প্রাক্তনের সঙ্গে কথা? বেশ হয়েছে। তার নামে বদনাম করা না, আর করবে? না এভাবে ঠিক জমছে না ব্যাপারটা, বাবা না খোঁচালে বসেও শান্তি পাচ্ছে না। তিতাস এবার তার বাবাকে কল দিলো কিন্তু উনি রিসিভ করলেন না। বরং কল কেটে দিলেন। তখন ভোর দরজা খুলে এসে তিতাসকে পানি দিলো। মুখ থমথমে। চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। তিতাস বিরক্ত হলো। মেয়েটা আবার কেঁদেছে। কান্না ছাড়া বোধহয় এর কাজ নেই। একে কিছু কাজ দিতে হবে কাল থেকে। যেন কান্নার সময়টুকু না পায়। যখন অতিরিক্ত কান্না পাবে তখন যেন তাকে বলে, ”একটু সময় দে তো তিতাস, আমার না খুব কান্না পাচ্ছে। একটু কেঁদেই বাকি কাজ গুলো করব।” এসব ভেবে সে মুখের পানি গিলতে যাবে তখন ভোর বলল,
-”এখন বিয়ে করবি আমায়?”
ভোরের এ কথা শুনে তিতাসের গলায় পানি আঁটকে কাঁশতে
শুরু করল। কাশির চোটে চোখে পানিও এসে গেল। তবুও কাশি থামল না। তারপর নাক চেপে ধরে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। ভোর তখনো ওর উত্তরের আশায় দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি তিতাসের দিকে নিবদ্ধ। তখন তিতাস নিজেকে সামলে বলল,
-” কি যেন বললেন?”
-”চল উঠ, কাজি ডাক, আমরা এই মুহূর্তে বিয়ে করব।”
-” মাথা ঠিক আছে?”
-”বিধবা মেয়েকে বিয়ে করতে এখন বুঝি বিবেকে বাঁধছে?”
-”কিছু হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”
-” জবাব দে, নয়তো আমাকে বাসায় যেতে দে।”
-”রাগ, জেদ, মানুষকে ক্ষতির মুখে ধাবিত করে। কি হয়েছে, আমাকে বলুন? আমি দেখছি ব্যাপারটা।”
ভোর জবাব না দিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। তার পিছু পিছু তিতাসও আসল। সদর দরজায় তালা, ভোর বের হতে না পেরে সমানে চেঁচাচ্ছে। দারোয়ান মুখ কাচুমাচু করে অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি বুঝছেন না এখন কী করবেন। তবে তিতাসকে দেখে একটু ভরসা পেলেন। যা করার তিতাস করুক। তখন তিতাস এসে বিনাবাক্য ভোরকে টেনে বাসার দিকে হাঁটা ধরল। ভোর কিছুতেই তার হাত ছুটাতে পারল না।
বরং শক্ত পুরুষালি হাতের চাপে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করল।
তিতাস তাকে সোজা ড্রয়িংরুমের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল। তারপর পুনরায় জানতে চায়ল এমন করার কারণ।
তখনো তিতাসের কন্ঠস্বর, শান্ত, স্থির। ভোর শক্ত মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে কষ্টে তার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু করছে। যেতে পারলে সকালেই চলে যেতো। তার এখানে আসার শখ মিটে গেছে। না আসলে এতকিছু হতো না, আর না তাকে এভাবে অপমান করার সাহস পেতো। বার বার তার ক্ষ’তে’ এভাবে খোঁচানোর মানেই হয় না। এমনিতেই তার ভেতরটা অদৃশ্য অনলে ঝ’ল’সা’নো’। তখন তিতাস তার মুখটা ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল,
-” রোমান্টিক মুভি টুভি দেখেছেন নাকি বিয়ে বিয়ে করছেন যে হঠাৎ?”
-”থাপ্পড় খেতে না চায়লে ফাজলামি বন্ধ রাখ।”
-”আরে বাবা, সমস্যা না বললে বুঝব কিভাবে?”
-”কি বলব হ্যাঁ, কি শুনবি তুই?”
-”আমার অনুপস্থিতিতে যা ঘটেছে তাই বলুন।”
-”তোর বোন সারা আমাকে কল করে বলেছে, আমি ন’ষ্টা’মি’ করতে এখানে এসেছি। পিয়াস আমার দেহের ক্ষু’ধা মেটাতে পারে নি, এজন্য ভুলিয়ে ভালিয়ে গোপনে তোকে পটিয়েছি!
তোর সংস্পর্শে দিন দিন সুন্দর হচ্ছি। শরীরের ভাঁজ দেখিয়ে
তোর মাথা ঘুরিয়েছি, তাই তুই আমাকে বিয়ে করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিস। না জানি তুই ছাড়া আরো কতজন ডাক্তারের সঙ্গে শু’য়ে’ছি। আর শুনবি, বলব?'”
তিতাস কানে কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে নিলো। তারপর আরাম করে পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল,
-”এমন কথা এতদিন যাবৎ অনেক শুনে এসেছেন। তাহলে আজ কেন এত সিরিয়াস হচ্ছেন? ”
-” কারণ আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না।”
-”আমি রাজি বিয়েতে তবে শর্ত আছে?”
-”এখানে শর্ত আসছে কেন?”
-”স্বার্থের কারণে শর্ত আছে।”
-‘”তিতাস ভুলেও ভাবিস না আমি পানিতে পড়ে গেছি? আমি
মূল্যহীন। তুই ছাড়া আর ছেলে পাবো না, এ জীবনে আমার
বিয়ে হবে না, সংসার জুটবে না। এমন অবান্তর ভাবনা ভেবে বোকামি করিস না। এই ভোর তুচ্ছ নয়। চুপ থাকি বলে দূর্বল
ভাবিস না। মনেও করিস না, আমি জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া
নাবিক। আর নিজের মুখে বিয়ের কথা কেন বললাম, গিয়ে তোর মাকে জিজ্ঞাসা কর। শর্তের কথা বললি তো, যা বিয়ে বাদ। তুই আমি আর কেউই বিয়ের কথা মুখে আনব না। এই মুহূর্ত থেকে তোর পরিবারের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।
দারোয়ানকে বল যেতে দিতে, নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
ভোরের চোখ আর কন্ঠ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। মারাত্মক রেগে আছে সে। তিতাস হাসল। ভোরের এই রুপ তার কাছে অপরিচিত নয়। এর আগেও সে ভোরকে রাগতে দেখেছে।
এজন্য তেমন অবাক হলো না। তবে ভোরের চোখে চোখ রেখে খুব আদুরে কন্ঠে বলল,
-”এত রাগলে চলে? এমন রাগ সবার সামনে দেখাতে নেই।
এই রাগান্বিত রক্তিম মুখখানা দেখে কারো কারো হৃদয়ে সুর বেজে ওঠে। প্রেমেরা হইহই করে ওঠে। ভালোবাসারা দলবদ্ধ ভাবে এসে কড়া নাড়ে মনের কুঠুরিকে। বাধ্য করে প্রেমের জীবাণু শরীরে মাখতে। বুকপাঁজরে অঘোষিতভাবে রচিত করে প্রেম প্রেয়সীর নাম। তখন অবেলা প্রেমিক পুরুষটাও বোধ হারিয়ে ফেলে। চৈতন্য খুয়ে ফেলে বিবেক ও মস্তিষ্কের।
তখন অনিচ্ছায় পান করে প্রণয়ের সুধা।”
ভোর ভ্রু কুঁচকে পুরো কথাটা শুনে তিতাসের কলার ঝাঁকিয়ে বলল,
-”আমি তোর প্রণয়বাক্য শুনতে দাঁড়িয়ে নেই। দারোয়ানকে বল আমাকে যেতে দিতে। নয়তো আমি কিছু একটা করে ফেলব। লাস্ট বার বলছি, আমাকে যেতে দে।’
-”এসেছেন নিজের ইচ্ছায় তবে যাবেন আমার ইচ্ছায়। আর শর্ত মেনেই আপনি আমাকে বিয়ে করবেন। আমি নিজেই বাধ্য করব আপনাকে। এই কথার একচুলও পরিমান নড়চড় হবে না।”
এ কথা বলে তিতাস বাসার সবাইকে উচ্চশব্দে ডাকতে লাগল। ওর বাজখাঁই গলা শুনে সকলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসলেন। তারপর ড্রাইভারকে দিয়ে কাজি ডেকে এনে বিয়ে পড়ানো হলো। ততক্ষণে ভোরের বাবা-মা চলে এসেছিলেন।
তিতাস নিজে উনাদের তড়িঘড়ি আসার কথা জানিয়েছিল।
এ ব্যাপারে উনাদের দ্বি-মত নেই। তাই উনারা মেয়েকে রাজি হতে আশ্বাস দিলেন। তারপর সকলের উপস্থিতিতে দু’জনে বাঁধা পড়ল পবিত্র এক বন্ধনে। ভোর অবাধ্য অশ্রু ঝরিয়ে পুনরায় বিয়ে নামক শেকলে আঁটকে গেল। নতুন করে স্বামী নামক মানুষটা তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। তিক্তপূর্ণ
বিধবা তকমাকে উচ্ছেদ করে সধবা তকমা শরীরে লেপ্টে নিলো। সেই সঙ্গে, বয়সে ছোট একটা ছেলেকে বেছে নিলো জীবনসঙ্গী রুপে।
To be continue…..!!
#গল্পগুচ্ছ_সমগ্র
#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৮
তিতাস যখন শুয়ে শুয়ে বিয়ের ভাবনায় বিভোর তখন ভোর তার রুমে আসল। বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে, তিতাসের মা ও চাচী কোনোভাবেই তাদের আলাদা রুমে থাকতে দিতে রাজি নন। তিতাসের মাও সহমত পোষণ করলেন উনাদের কথায়। তিনজন মায়ের যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে ভোর প্রায় বাধ্য হয়ে তিতাসের রুমে এসেছে। পরণে আছে লাল সুতি শাড়ি। সাজহীন সিগ্ধু মুখ। কান,গলা, আর হাতে বাসায় পরা স্বর্ণের কিছু সংখ্যক গয়না। আর চুলে অতি সাধারণ একটি খোঁপা।
দেখতে অপরুপা না লাগলেও মন্দ লাগছে না। অনেকদিন সে শাড়ি পরেছে, লাল শাড়ি। তিতাসের চাচী জোরপূর্বক এই শাড়িটি পরিয়ে বলেছেন,
-”দোয়া করি, আমাদের ছেলেটা যেন তোমার শাড়ির আঁচলে বাঁধা থাকে। তার সকল চাওয়া -পাওয়া যেন তোমাকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ হয়।”
ভোর একথা শুনে নত মস্তকে নীরবে কেঁদেছে। তিনজন মা তাকে অনেক কিছুই বলেছেন। আকার ইঙ্গিতে নানানভাবে বোঝাতে চেয়েছেন তিতাসকে মন থেকে গ্রহন করার জন্য।
তিতাস বয়সে ছোট হলেও তার স্বামী, জীবনসঙ্গী। সে যেন
তাকে তার প্রাপ্য সন্মানটুকু থেকে বঞ্চিত না করে। তিতাসকে যেন সামলে নেয়। ছেলেটা ভীষণ চঞ্চল হলেও খুব ভালো মনের। ভোর জবাবে শুধু সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়েছে। এ ছাড়া বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিল সে। তারপর তিতাসের চাচী নিজে এসে তিতাসের রুম অবধি তাকে দিয়ে গেছেন।
তখন থেকে সে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তবুও তিতাস তাকে খেয়াল করে নি। মহারাজ বিছানায় শুয়ে হাতজোড়া
টান টান করে রেখে মিটিমিটি হাসছে। যেন সিলিং ফ্যানকে অনুরোধ করছে, উপর থেকে বউ ফেলার জন্য। একটা বউ
টুপ করে তার বুকের উপর পড়বে আর সে জাপটে ধরে বুকে জড়িয়ে নিবে। ভোর নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো।
তারপর অবান্তর ভাবনা ছেড়ে শব্দ করে দরজায় বারি দিয়ে বলল,
-”ডাক্তার সাহেব আছেন?”
-”আরে সিনিয়র বউ আপনি? আসুন, আসুন, বসুন।”
-”আপনার এ্যামাজন জ’ঙ্গ’ল’ পরিদর্শন করতে আসলাম।”
-“দেখেই চলে যাবেন, থাকবেন না?”
-”থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু এখন মত বদলাতে বাধ্য হচ্ছি?”
-”ওমা বলে কি, কেন?”
-”তাহলে ঝটপট রুমটা গুছিয়ে ফেলুন, আমি বসছি।”
ভোরের কথা শুনে তিতাস মুখ কুঁচকে ফেলল। গুছানো রুম তার পছন্দ নয়। মনে হয়, রুম গুছালে প্রয়োজনীয় কিছু সে খুঁজে পায় না। এরচেয়ে হাতের কাছে এটা ওটা পড়ে থাকে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু বোধহয় তা আর হবে না। বিয়ে করেছে অর্থাৎ বউ এই রুমের অর্ধেক ভাগিদার। তাকে তার জিনিস বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। তাছাড়া অগোছালো রুমের দায়ে বউ চলে গেলে মান-সন্মান থাকবে না। এসব ভেবে সে রুম গুছানোর কাজে লেগে গেল। স্বেচ্ছায় জেনে শুনে বুঝে
সিনিয়র মেয়েকে বিয়ে করছে। এসব জ্বালাতন সহ্য করতেই হবে। কিছু বলতে গেলে উল্টে চড়থাপ্পড় খাওয়ার সম্ভবনাও নিশ্চিত। তিতাস হেলেদুলে নতুন বিছানার চাদর বের করল। তারপর সেটা উল্টে পাল্টে দেখে বলল,
-”আপনি সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে এক রুমে, এক বিছানায় থাকবেন? আমার না বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
-”তোকে বিশ্বাস করতে কে বলেছে? চুপচাপ কাজ কর।”
-” ওকে। ‘
ভোর গালে দিয়ে বসে তিতাসের কাজ দেখে নিজেও কাজে হাত লাগাল। নয়তো সারারাত ওর এখানে বসে থাকতে হবে। তিতাস প্রায় আধা ঘন্টা লাগিয়ে কেবল বিছানার চাদরখানা
পরিবর্তন করল। বাকি রুমের কথা বাদই দিলাম। ভোরকেও হাত লাগাতে দেখে তিতাস মুখ টিপে হাসল। সে মূলত এমন কিছুই চাচ্ছিল। তারপর সে এদিক ওদিক হেঁটে কাজের ভাণ ধরে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে দৌড় দিলো। ভোর তার চালাকি বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। একে কিছু বলার চেয়ে কলা গাছকে বলা উত্তম। বেশ সময় নিয়ে ভোর
পরিপাটি করে রুমটা গুছিয়ে ফেলল। পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে, ওর ট্রলিটা এনে একে একে জিনিসগুলো বের করে সাজিয়ে রাখল। থাকতে যখন হবেই, পাকাপোক্তভাবে এগুলোর বন্দোবস্ত করাও শ্রেয়। তিতাস ফ্রেশ হয়ে এসে ওর মাথা মুছতে মুছতে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে গালভর্তি হাসল।
রুমটা যেন পুনরায় প্রাণ খুঁজে পেলো। বিয়ে পড়ানোর একটু পরেই সকলের সাথে পেটভর্তি করে খেয়েছিল সে। এজন্যই এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। পেটে ও মনে দু’টোতেই শান্তি বিরাজ করছে, এজন্য ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ আর পড়া হবে না, বিয়ের প্রথম রাত বলে কথা। ভোর গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা বই নিয়ে বিছানার কোণ ঘেষে শুয়ে পড়ল।
তখন তিতাস পানি খেয়ে বিছানায় বসে বলল,
-”আমার না খুব লজ্জা লাগছে?”
-”কেন?”
-“না মানে জীবনে প্রথমবার বউয়ের পাশে ঘুমাতে যাচ্ছি তাই আর কি।”
-”ঢং করা শেষ নাকি আরো করবি?”
-”আর একটু করি, ভালোই লাগছে।”
-”দূরে গিয়ে কর, তোর ঢং দেখার ইচ্ছে নেই আমার। আচ্ছা, রবিনকে ফোনে পাচ্ছি না কেন, কিছু জানিস তুই?”
-”হুম, সে একটু অসুস্থ তাই ছুটি দিয়েছি। একেবারে দুইমাস পর এসে দেখা করবে।”
একথা বলতে বলতে তিতাস শুয়ে পড়েছে। কারো মুখে কথা নেই। দু’জনেই নিশ্চুপ, নীরব। হয়তোবা যথাসাধ্য স্বাভাবিক থাকার প্রয়াস চালাচ্ছে। ভোরের দৃষ্টি জানালার দিকে আর তিতাসের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। চঞ্চল তিতাস এখন কেন জানি কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ভোরের দিকে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেল। তিতাস ধরা পড়ে বোকামার্কা হাসি দিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তখন ভোর অতি শান্ত কন্ঠে বলল,
-”তিতাস!”
-”হুম।’
-”পিয়াস কি সত্যিই সু/ই/সা/ই/ড করেছিল?”
-”না।”
-”তাহলে কে এমন করল? কিসের কারণে?’
-”আপনার কারণে।”
-”আমার!”
-‘হুম।”
ভোর বিষ্ময়ে আর কথা বাড়াতে পারল না। স্থির দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর নিজে উঠে বসে তিতাসকে টেনে উঠিয়ে ওর মুখোমুখি বসাল। তার মনে কৌতুহল কাজ করছে।অজানা কিছু প্রশ্নের উত্তর না জেনে নিজেকে দমাতে পারছে না। তিতাসের মুখে ফাজলামির রেশ নেই। অর্থাৎ সে মজা করছে না। ভোর এবার ধারালো দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল,
-”তুই কোনোভাবে জড়িত নয় তো?”
-”না।”
-”সত্যি বলছিস নাকি পরে অন্য রুপ বের হবে?”
-“দু’মুখো মানুষ আমি নই।”
-”আর একটা সত্যি কথা বলবি?”
-” মিথ্যা বলার প্রয়োজন দেখছি না, বলুন শুনি।”
-”পিয়াসের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে তুই কি আমাকে পছন্দ করতি? সত্যিটুকু বল, কারণ এর উপরে নির্ভর করবে তোর আর আমার সংসার।”
-”আপনি আমার ভালোলাগা ছিলেন ভালোবাসা নয়।”
-”আর এখন?”
জবাবে তিতাস মুচকি হাসল। সেই সঙ্গে হেসে উঠল তার পুরুষালি গম্ভীর নেত্রজোড়া। ভোর আর জোর করল না,সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তার মস্তিষ্কে একটা কথায় খেলে গেল, ‘এসবের পেছনে কোনোভাবে কি সে দায়ী।’ সঙ্গে সঙ্গেে তার চোখ থেকে গড়িয়ে গেল কয়েকফোঁটা অশ্রুকণা। সেই সঙ্গে পিয়াসের হাসোজ্জল মুখশ্রী ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। তিতাস ওপাশ ওপাশ করেও ঘুমাতে পারল না। সে ভোরকে একবার দেখে উঠে পড়তে বসল। অযথা সময় নষ্ট করার মানেই হয় না।ঠিক তখনই ওর কাছে হসপিটাল থেকে কল আসল। তাকে এই মুহূর্তে যেতে হবে। তিতাস তার কানে ফোন ধরা অবস্থা ভোরকে বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ভোর সাবধানে যেতে বলার আগেই সে দৃষ্টিতে বাইরে চলে গেছে।
রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আগমন হলো, তিতাস পিয়াসের কবরের পাশে গিয়ে বসল।ওর প্রিয় ভাইরুপী বন্ধু চিরনিদ্রায় শায়িত।তিতাস মাটিতে বসে শুকনো পাতা পরিষ্কার করে থম মেরে রইল। হঠাৎ তার স্মরণে আসল ভোরের কথা। মেয়েটা না জানি কি করছে এখন।তবে এখন অবধি ভোরকে একটা মিথ্যা কথাও বলে নি সে। আর বলবেও না। কারণ তার সঙ্গে ওর পবিত্র বন্ধনের পাকাপোক্ত সম্পর্ক। ভোরকে মিথ্যা বলে খুব সহজেই ধরা খাবে। তখন চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে না। ভোরও তার প্রতি বিশ্বাস হারাবে। এরচেয়ে সত্যি জেনে ভেঙে চুরে পুনরায় শক্ত হয়ে গড়ে উঠুক। সে দেখুক, আমাদের কাছের মানুষগুলোর মুখোশধারী রুপ। উপলব্ধিও করুক, একজন আর্দশ স্বামী কাকে বলে। তিতাস এসব ভেবে কবরের হাত বুলিয়ে মলিন হেসে বলল,
-”ভাইয়া, তোর বউকে আজ আমার বউ বানিয়ে নিয়েছি। তাছাড়া উপায় নেই রে। মেয়েটাকে ওরা বাঁচতে দিতো না।
ভোরের চারপাশে এমনভাবে জাল বিছানো ভোর কল্পনাও করতে পারবে না। মেয়েটা ভালো, সরল মনের। কিন্তু তার চারপাশে শত্রুর শেষ নেই। এমনকি আমাদের বিয়ে পড়িয়ে ওর বাবা- মা যাওয়ার পথে এক্সিডেন্ট করেছে, না করানো হয়েছে। একথা আমি এখনো জানাতে পারি নি ভাইয়া। খুব গোপনে মানুষ দিয়ে হসপিটালের সব সামলাচ্ছি। এই দেখ, আমার শরীরে ওর বাবা মায়ের রক্ত। উনারা বোধহয় বাঁচবে না রে ভাইয়া। উনাদের অবস্থা খুব খারাপ। তোকে তো আমি আগেই জানিয়েছিলাম, ভোর এখন লাল শাড়িকে ভয় পায়।
কারণ পূর্বে লাল শাড়ি পরা অবস্থাতেই তোকে হারিয়েছিল, এবার তার বাবা-মাকে। মেয়েটা হয়তো এবার সত্যি সত্যিই ধরে নিবে, সে অপয়া, অলক্ষী।”
To be continue………!!