#প্রিয়_তুই,১৫,১৬
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১৫
-“ইয়েস, আই এম।”
তিতাসের শান্ত কন্ঠে বলা কথাটা শুনে ভোর আর নিজেকে সামলাতে পারল না। শরীর কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই বসে পড়ল। ওর মনে হচ্ছিল তিতাস মজা করছে। নয়তো জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকেছে। কিন্তু না সবটা সত্যি! সত্যি সত্যি সে মানুষ মেরেছে তাও নৃ/শং/স/ভাবে। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে,
নাহিদ এমন কিছুতে জড়িত যার জন্য তিতাস এই পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুবা সে বা এমন করতে যাবে? তিতাস প্রান্তবন্ত ও চঞ্চল হলেও বিবেকহীন নয়। একারণে অনেকের কাছেই প্রিয় ব্যক্তি সে। এখন খুঁজে বের করতে হবে, কেন এমনটা করেছে সে?ভোর ঠান্ডা মস্তিষ্কে কিছু ভেবে নাহিদদের বাসায় প্রবেশ করল। নাহিদের মা ছেলের খাঁ/টি/য়া/র পাশে বসে চিৎকার করে কাঁদছেন।কেউ যেন উনার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। সন্তানটা তার বাবা-মায়ের কলিজায় হয়।এজন্য বুঝি
সন্তানের কিছু হলে বাবা-মা এতটা ব্যথিত হয়, ছটফট করে।ভোর তার দৃষ্টি সরিয়ে নাহিদের লা/শে/র দিকে তাকাল। ওর র/ক্ত/শূন্য দেহখানা সাদা কাপড়ে মুড়ানো। সে পূর্বের নাহিদ নেই, তার নামকরণ হচ্ছে লা/শ নামে। ভোর এখানে আসার পরে কানাঘুষায় শুনেছে, “তার শরীরে কোনো আঘাত নেই। শুধু কলিজা বের করে নিয়েছে। না জানি কোন পাষাণ্ড এই কাজ করেছে।”
শুধুমাত্র ভোর জানে কে এই কাজটা করেছে। আর করে সে নিজেও দেখতে এসেছে। কতটা নির্দয় হলে কেউ এমন কাজ করতে পারে। তবে এর হিসাব তাকে দিতেই হবে। ভোর আর একটু এগিয়ে দেখে, পিয়াসের বাকি বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। প্রিয় বন্ধুর শোকে তারা কাতর। এখানে সবাই আছে শুধু পিয়াস আর নাহিদ অনুপস্থিত।ওরা আর ফিরবে না, আড্ডাও দিবে না। আর না হবে মজামাস্তির টূর। আর ভোর এদের সবাইকে চিনে, বিয়ের আসরে পিয়াস ওদের সবার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কত্ত মজা করেছিল সেদিন। ঠাট্টার ভিড়ে লজ্জায় গুটিয়েও ফেলেছিল নিজেকে। অথচ আজ সব এলোমেলো, অগোছালো।পিয়াস
নেই, তার সঙ্গে এখন স্বস্ত্বিও বিলীন। ওর বন্ধুদের মন ভালো নেই। আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাওয়ার অবস্থাও তার নেই। মূলত তিতাস সেই অবস্থায় রাখে নি। এসব ভেবে যখন বাইরের দিকে পা বাড়াবে তখন এক পুরুষালি কন্ঠে একজন বলে উঠল,
-”দাঁড়ান ভাবি। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।”
একথা শুনে ভোর পেছনে ফিরে দেখে পিয়াসের আরেক বন্ধু শাওন দাঁড়িয়ে। এখানে কেউ নেই। বাকিরা নিজ নিজ স্থানে বসে। তাই ভোর সালাম দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি বলবে বুঝতে পারছে না সে। শাওন তখন দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল,
-”তিতাসকে বোঝান ভাবি। ছেলেটা যা শুরু করেছে এমন চলতে থাকে আমিও তাকে বাঁচাতে পারব না। তিতাস রাগের বশে নাহিদকে এত নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে। কেউ জানুক বা না
জানুক আমি জানি, নাহিদ পিয়াসের সঙ্গে অন্যায় করেছে।
তার আবদার ছিল নোংরা মনমানসিকতার।তারমানে এই না তিতাস তাকে মেরে ফেলবে। পাপের আরো অনেক সমাধান
আছে। ছেলেটা জেদ ধরে ইচ্ছে করে ক্যারিয়ার নষ্ট করছে। স্বেচ্ছায় অ/প/রা/ধীর তকমা শরীরে লেপ্টাতে চাচ্ছে। এমন করলে কীভাবে হবে? সে না ভাবছে নিজের কথা আর তার বাবা-মায়ের। আপনার কথা নাহয় বাদই দিলাম। তিতাসের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত। প্লিজ তাকে বোঝান ভাবি।”
-”নাহিদ পিয়াসের সঙ্গে কি অন্যায় করেছে?”
-”আপনাদের বিয়ের দিন রা..!”
ঠিক তখন তিতাস দুই পকেটে হাত গুঁজে শাওনের মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি।
শাওন থেমে গেল। বাকি কথাটুকু শোনার জন্য ভোর উতলা হয়ে শাওনকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল,
-”বলুন ভাইয়া, প্লিজ বলুন, এত লুকোচুরি ভালো লাগছে না।
আমি নিজেও স্বস্তি পাচ্ছি না। আসলে বিয়ের দিন কি এমন ঘটেছিল? বলুন, আমি জানতে চাই?”
-”আসলে আপনাদের জন্য সাজানো ফুলের বিছানায়..,।”
তিতাস এবার শাওনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। অর্থাৎ না জানাতে। সেটা দেখে ভোর প্রচন্ড রেগে গেল। তিতাসকে সরিয়ে শাওনকে অনুরোধ করতে লাগল সত্যিটা জানানোর।
তখন জা/না/যা/র জন্য পুরুষদের একত্রিত হওয়ার তাড়া দিলেন, নাহিদের চাচা। একে একে অনেকেই এগিয়ে যাচ্ছেন ক/ব/র স্থানের দিকে। শাওন হতাশার শ্বাস ফেলে কথা না বাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করল। ভোরের হাকডাক শুনেও অগ্রাহ্য করল অতি সন্তর্পণে। বাসাভর্তি মানুষের কান্না রোলও বেড়ে গেল। সকল মায়া কাটিয়ে নাহিদকে নিয়ে যাওয়ার হলো ক/ব/র/স্থানের দারে। তিতাস ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে।
উনি এমনভাবে কাঁদছেন যেন পিয়াসের পরে আজ তিতাসই
মারা গেছে। অথচ জানতেও পারলেন না যার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন, উনার ছোট ছেলেটাই এসবের জন্য দায়ী।
যদিও উনার কান্নার কারণ আছে। হয়তো পুরনো তিক্ত ব্যথা জাগ্রত হয়েছে। কষ্টেরা দলবদ্ধ হয়ে বুকে চেপে বসেছে। উনি মা, এই দিন উনাকেও দেখতে হয়েছে, নীরবে সহ্য করে নিতে হয়েছে। আর মা হয়ে সন্তানের মৃ/ত মুখ দেখার কষ্ট পৃথিবীর সব কষ্টকে বোধহয় হার মানায়। যেটা উনি বেশ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। ধীরে ধীরে বাসা ফাঁকা হতে দেখে ভোর গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল, ওর দেখে তিতাসও বসল। তারপর দু’জনে গাড়ি নিয়ে ছুটল অজানা পথের বাঁকে। নীরবতাকে সঙ্গী করে মৌনতা চলল দু’জনের মাঝে। গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে দূরন্ত গতিতে চলছে তাদের শুভ্র রংয়ের গাড়িটি। ভোর খুব ভেবে চিন্তেই বেরিয়ে এসেছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, এটাই কী তার চেনা তিতাস? যাকে সে ইচ্ছে মতো পঁচাতো, রাগাত, হাসাত। আজ কেন তাকে এত অচেনা লাগছে? মনে হচ্ছে এ তিতাস অপরিচিত। যাকে সে কখনো চিনতো না, জানত না।
তিতাস পাশের সিটে বসে মনের সুখের শিষ বাজাচ্ছে। বউ ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা তার কাছে বেশ লাগছে।
কেমন বর বর অনুভূতি হচ্ছে তার। ভোর অনেক দূরে গিয়ে একটা বিলের পাশে গাড়িটা দাঁড় করাল। জায়গা খুব র্নিজন তবে বাতাস দেহ ও মন জুড়িয়ে দিচ্ছে। ভোর বেরিয়ে বিলের ধারে গিয়ে বসল। তিতাসও এসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ওর শরীর ঘেষে বসে মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল,
-”বাহ্, জায়গাটা দারুণ তো, প্রেম করার জন্য পার্ফেক্ট। এই আমরা এখানে প্রেম করতে এসেছি?”
-” তোকে দশ মিনিট সময় দিলাম, এর মধ্যেই পুরো ঘটনাটা আমাকে বলবি। নয়তো আজ ভোরকে চিরতরে হারাবি।”
-”হারাতে দিলে তো হারাবেন, হা হা হা।”
পেজে ফলো করেন প্লিজ ??গল্পগুচ্ছ সমগ্র
-”আমার জীবন নিয়ে খেলার অধিকার তোর নেই। তাই ভেবে চিন্তে জবাব দে। এরপর হয়তো তোর সঙ্গে দেখাও হবে না কথা তো দূর।”
-”আপনার জীবন নিয়ে খেলছি না ভোর। আমি সবসময় আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছি, চাচ্ছি।”
ভোর এবার তিতাসের চোখে চোখ রেখে অতি শান্ত কন্ঠে বলেছিল,
-”এটাকে বাঁচানো বলে? কিভাবে বলে, তুই বোঝা আমাকে? বোঝা! একজন মরে গিয়ে আমাকে আধমরা করে গিয়েছে।পুনরায় বিয়ে করে তুই আমাকে একেবারেই মারতে চাচ্ছিস,
প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ সৃষ্টি করছিস। একটার পর একটা মিথ্যা সাজিয়ে বানোয়াট গল্প শুনাচ্ছিস। সংসার করবি না বলেই এমন রুপ দেখাচ্ছি? এখন ভালো লাগছেনা আমায়? নাকি বয়সে বড় বিধায় মহৎত্ব জাহির করা শেষে এখন ঘাড় থেকে নামাতে চাচ্ছিস? বল! জবাব দে!”
-”বা*, আবারো সেই একই কথা। বলেছি না এমন কথা না বলতে।”
তিতাসের জবাবে ভোর রেগে গেল। নিজেকে সামলে দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো। তার রাগের মাত্রা এখন অত্যাধিক। ঠিক মনিহারা ফণীর ন্যায় ফসফস করছে সে। যেন এক্ষুণি দংশন করল বলে। যেটা তিতাসকে খুব মজা দিচ্ছে। তিতাস এমন সিরিয়াস মুহূর্তে হেসে তার ফর্সা গালে চুমু আঁকল। তারপর ভোরের নাকটা আলতো করে টেনে বলল,
-”সিনিয়র বউদের এত রাগতে নেই। কেন জানেন? কারণ বউদের রাগ দেখে জুনিয়র বররা কাজের তাল হারায়।তারা বউয়ের প্রতি পুনরায় প্রেমে পড়ে, মুগ্ধ হয়। যেমন এই আমি পূর্বেও হয়েছি, এখনো হচ্ছি।”
-”আম্মুদের নিয়ে বাসায় ফিরে যাস। আমি আমার পথ বেঁছে নিলাম। বেশি অপেক্ষা করাব না যত দ্রুত সম্ভব তালাকনামা পাঠিয়ে দিবো।”
একথা বলে ভোর চলে যেতে উদ্যত হলো। তখন তিতাস ওর বাহু ধরে টেনে ঘুরিয়ে গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
-”এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভোর।”
-”বাড়াবাড়ি হচ্ছে না, হবে। ছাড় আমাকে, তোর সঙ্গে আমি সংসার করব না।”
-”সংসার করলেন কবে হুম? হুমকি ধামকি আর মেরেই তো দিন পার করলেন। না স্পর্শ করতে দিয়েছেন না কাছে টেনে নিয়েছেন। যা বললেন পুনরায় উচ্চারণ করলে কিন্তু খবর আছে।”
-”যা পারিস করে নে। এটাই ফাইনাল আমি সংসার করব না, মানে করব না।”
-”ভোর প্লিজ আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেন না, নয়তো এর ফল ভুগতে হবে বলে দিলাম।”
-”ভুগতে রাজি তবুও সত্যিতা বল। নয়তো আমি সত্যি সত্যি যা বলেছি তাই করব।”
তিতাস ভোরকে ছেড়ে মাথাটা নাড়িয়ে এদিক ওদিক ঘুরাল।
না, এই মেয়ে মেজাজ রাখতে দিচ্ছে না। সে রাগতে সামলে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,
-”মন চাচ্ছে ওই লোভনীয় ঠোঁটজোড়া কামড়ে খেয়ে ফেলি। যেন ফালতু কথাবার্তা বলতে না পারেন। খুব জানার ইচ্ছে তাই না? ওকে, তবে আমাকে রাগানোর জন্য শাস্তি পেতেই হবে, রাজি আপনি?”
-”রাজি।”
এবার সে ভোরের চোখে চোখ রেখে আগুন ঝরা কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-”ওকে তবে তাই হোক। আমার মুখ খুলালেন তো ভুগতে তো হবেই। তাহলে মন, মস্তিক, কান, সজাগ রেখে শুনুন, বিয়ের দিন আপনার এবং ভাইয়ার জন্য ফুলে সাজানো রুমে ছোট ছোট আটটা ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। যাতে আপনাদের
অ/ন্ত/র/ঙ্গ মুহূর্তটা ক্যামেরায় ধারণ করা যায়। এখন কথা হচ্ছে, আপনারা সেদিনই ঘ/নি/ষ্ঠ হতেন এর গ্যারান্টি কী? ওর ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। জুসের বোতলে কড়া ডোজের মেডিসিন ব্যবহার করা হয়েছিল। যেটা রুমে ঢুকার আগেই আপনাদের খাওয়ানো হতো। দুঃভাগ্যবশত,সেটা আপনি বা ভাইয়া খাওয়ার আগে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমি খেয়েছি। নাচানাচি হইহই করে তৃষ্ণার্ত আমি বুঝিনি ওটা ছিলো কারো পাঁতা ফাঁদ। ঢকঢক করে পুরো বোতল খালি করে আবারো মত্ত হয়েছিলাম নাচানাচিতে। এর কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি আমার শরীরে নিষিদ্ধ অনুভূতির জানান দিচ্ছে। আর ধীরে ধীরে সেটা আমার কনট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারপর আমি যখন নিজে রুমে গিয়ে চোখ মুখে পানির ছিঁটা দিতে যায়, তখন শুনতে পায় কান্নার শব্দ। ততক্ষণে গান বাজনা থেমে নীরব চারিপাশ। ব্যাপারখানা খটকা লাগায় বেরিয়ে দেখি সবাই ভাইয়ার রুমে দৌড়ে যাচ্ছে, তাদের দেখে আমি
নিজেও গিয়েছিলাম। কে জানত, সেখানে আমার জীবনের সবচেয়ে চমকটা অপেক্ষা করছে। তারপর ডাক্তার পরীক্ষা করে জানাল, না ভাইয়া আর নেই। তখনো আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। আমার মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। আর না ভালো মন্দের বোধ আমার মধ্যে ছিল। তবে লজ্জাজনক ব্যাপার কি জানেন? সবাই যখন ভাইয়াকে নিয়ে ব্যস্ত তখন আমার সর্বাঙ্গে বইছিল কাম তাড়না। শরীর চাচ্ছিল কোনো এক নারীদেহ। নিজেকে তখন বড্ড পাগল পাগল লাগছিল আমার। হুশ ছিল না, সেই মুহূর্তে কি করা উচিত, কাকেই বা জানাব এই সমস্যার কথা। যাকে বয়ঃসন্ধির সমস্যাগুলোও শেয়ার করেছিলাম, তার নিথর দেহখানা পড়ে আছে চোখের সামনে। গোপন কথা জানানোর মানুষটাও যে আর নেই।”
চলবে…..!!
#গল্পগুচ্ছ_সমগ্র
#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১৬
-“সবাই যখন ভাইয়াকে নিয়ে ব্যস্ত তখন আমার সর্বাঙ্গে বইছিল কাম তাড়না। শরীর চাচ্ছিল কোনো এক নারীদেহ। নিজেকে তখন পাগল পাগল লাগছিল আমার। হুশ ছিল না, সেই মুহূর্তে কি করা উচিত, কাকেই বা জানাব এই সমস্যার কথা। যার কাছে বয়ঃসন্ধির সমস্যা শেয়ার করেছিলাম, তার নিথর দেহখানা পড়ে আছে চোখের সামনে। গোপন কথা জানানোর মানুষটাও আর নেই।”
এইটুকু বলে তিতাস থামল। ঠোঁটের কোণে হাসি। অথচ এই মুহূর্তে তার অশ্রুসিদ্ধ চোখ থাকার কথা ছিল। ছেলেটা সত্যি খুব পাষাণ। ভোর নিশ্চুপ হয়ে বিলের টলমলে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। সে বাকিটুকু শোনার অপেক্ষায়। আজ সে সবটা জেনেই ক্ষান্ত হবে। তিতাসও আর সময় নিলো না, বলতে লাগল একের পর এক ঘটনা।
-”তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে গেলাম।সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিটের কাঁটা ঘন্টার ঘরে স্থির হলো। তবুও অনড় আমি। ঘন্টা পেরিয়ে যখন দেড় ঘন্টা কাটল তখন পুরো শরীর হাল ছাড়তে লাগল। ততক্ষণে শীতে কাঁপছিল আমার সর্বশরীর। মনোযোগ বিঘ্ন ঘটল আর
শরীর স্বাভাবিক হতে লাগল। কিন্তু জ্বরের হাত থেকে ছাড় পেলাম না। সেই মুহূর্তে জ্বর টরকে পাত্তা না দিয়ে ছুটেছিলাম ভাইয়ার রুমে। আপনি তখন স্থির হয়ে বসে ছিলেন। পরণে ছিল সাদা শাড়ি। আপনাকে ওভাবে খুব বাজে দেখায় ভোর।আমার ভালো লাগছিল না আপনাকে ওই পোশাকে দেখতে।
কষ্ট হচ্ছিল, চিৎকার করে কাঁদতেও ইচ্ছে হচ্ছিল। আপনার ভাগ্য দেখে আফসোসে পুড়ছিলাম আমি। কারণ আপনাকে ওভাবে কখনো দেখতে চাইনি এজন্য বোধহয়। আজকে এই
কথাটাও জেনে নিন, আমি মারা গেলেও আপনি সাদা শাড়ি পরবেন না। কখনো না, কোনোদিনও না। এটা আমার কড়া
আদেশ। অতঃপর আমি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ার ওই মুখপানে তাকিয়ে রইলাম। তখন ভাইয়ার গলায় কিছু আঁচড় দেখতে পেলাম। যেটা স্বাভাবিক ছিল না।পরক্ষণে ডান হাতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে সন্দেহ হলো। কারণ ভাইয়া বাম হাতেই সবকিছু করত। এমনকি সে লিখতেও বাম হাতে। যদিও ডান হাতে সমস্যা ছিল না। তবুও বাম হাতেই প্রায় কাজ করত, শুধু খাওয়া ব্যতীত। তাড়াহুড়ো করেও যদি আপেল কাটতে বলি, ভাইয়া বাম হাতেই কাটত। তাহলে হাত কা/টা/র সময় কেন ডান হাত ব্যবহার করল। বাম হাত দিয়ে তো আর বাম হাতকাটা সম্ভব নয়। তবুও সেই খটকা অপ্রকাশিত রাখলাম। টাকার জোরে ভাইয়ার পোষ্ট ম/র/র্টা/র্ম করাও আঁটকালাম।
না জানি আমার ভাইয়া কত কষ্টে মা/রা গেছে। এজন্য পোষ্ট ম/র/র্টা/ম করে তার কষ্ট বাড়াতে চাইছিলাম না।
এরপর একবুক কষ্ট চেপে ভাইয়াকে রেখে এলাম অন্ধকার কবরে। এরমধ্যেই কেউ ভাইয়ার রুমে তালা ঝুলিয়েছিলেন।
নয়তো ওই রুম যখন তখন কেউ না কেউ দেখতে যাচ্ছিল।
তখন আপনার বাবা আপনাকে নিয়ে যাওয়া প্রস্তাব দিলেন।
আপনিও বিধবা তকমা নিয়ে ভাইয়াকে দোষী বানিয়ে চলে গেলেন। বিয়ে বাড়িটা মৃত্যুপুরীর মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। বাবা আম্মুর সামনে কাঁদতে পারে না। এজন্য আমার রুমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। ভাইয়ার জন্য বুকফাঁটা কিছু কথা বলে বুকের ফাঁপড় কাটান। আম্মু রাত-দিন ভাইয়া ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদেন, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে বিলাপ করেন।
আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। কী করব, আমি যে কান্না করতে পারি না। সহজে কান্না আসে না আমার। এরপর দুই সপ্তাহ পর আমি ভাইয়ার রুমে ঢুকেছিলাম। চেনা রুম কেন জানি অচেনা লাগছিল। ভ্যাপসা গরম আর শুকনো ফুলের
গন্ধে দম আঁটকে আসছিল। দ্রুত জানালা খুলে পর্দা সরালে রুমে আলো বাতাস ঢুকল। তাৎক্ষণিক সকল আঁধার কেটে রুম আলোকে পরিপূর্ণ হলো। তখন হঠাৎ কিছুর সঙ্গে বেঁধে পড়ে গিয়ে দেওয়াল ধরে নিজেকে বাঁচায় আমি। দেওয়ালে রজনীগন্ধা আর একটা গোলাপ কস্রটেপ দিয়ে আঁটকানো ছিল। আমার হাতে লেগে সেটা খুলে যায় আর ছোট্ট একটা
ক্যামেরা মেঝেতে ছিঁটকে পড়ে। সেটা তুলে চেক করে এবার
আমার সন্দেহ প্রবল হয়। একে একে সময় নিয়ে পুরো রুম খুঁজতে থাকি। আর পেয়েও যায় আটটা ক্যামেরা। তারপর
সুযোগ বুঝে সেগুলোর খোঁজ করে দোকানের নাম জানতে পারি। যেখানে এই ধরনের ক্যামেরা বিক্রি হয়। যদিও প্রথমে দোকানদার কিছু জানাতে চাচ্ছিল না। পরে পুলিশের হুমকি দেওয়াতে কাস্টমারদের লিষ্ট দেখায়। সেখানে সুস্পষ্টভাবে ক্রেতা কবে কখন কোন তারিখে কোন ক্যামেরা কিনেছেন, তা লিখা আছে। আমি লিষ্ট চেক করে থমকে যায়, নাহিদের নামটা দেখে। অবুজ মন বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না। এজন্য পাশের নাম্বার তুলে ডায়াল করে দেখি এটা চেনা নাহিদ’ই।
সেই ভাইয়ার গায়ের হলুদের দিন রাতে ক্যামেরা নিয়েছিল। তারপর কৌশলে নাহিদকে ডেকে লোক লাগিয়ে কিডন্যাপ করি। টানা চারদিন অনাহারে রেখে পাঁচদিনের দিন মনের রাগ মেটাতে বেধড়ক মে/রে/ছি/লা/ম। এরপর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হয় নি,আপনাআপনি সবটা বলে দিয়েছে।
তবুও কেন জানি শান্তি হচ্ছিল না আমার। আমার ভাইয়ার সঙ্গে বেইমানি করেছে। তার বুকের কলিজা এত বড়! তাই কলিজাখানা বের করে মেপে ইঞ্চি ইঞ্চি করে কেটে দেখেছি।
ঠিক করেছি না, আপনিই বলুন?”
-”কেন এমন করেছে সে? আমি তার কি ক্ষতি করেছি?”
-”আপনি নয়, আপনার নারীদেহ তাকে আকৃষ্ট করেছে। তার বাসনা ছিল আপনার সঙ্গে লিপ্ত হওয়ার, ছুঁয়ে দেখার। সত্যি বলতে ভাইয়া আপনাকে ছুঁয়ে দেখবে এটা সে সহ্য’ই করতে পারছিল না। মনে মনে ঈর্ষায় ভেটে পড়েছিল। মূলত এজন্য ক্যামেরাগুলো লাগিয়েছিল। যেন আপনাদের বিশেষ মুহূর্ত গুলো ভিডিও করে ভাইরাল করে আপনাদের মানসন্মান নষ্ট করতে পারে। সকলের সামনে হাসির খোরাক বানাতে পারে।
সত্যি বলতে বন্ধুর নামে এরা এক একটা কালসাপ। যে মিষ্টি কথায় মধু বিলিয়ে ভেতর ভেতর ক্ষতির ফন্দি আঁটবে।আর
যেদিন আপনাকে বিয়ে করি সেদিন আমাকেও মেসেজ করে জানিয়েছিল, ‘পিয়াসকে স্পর্শ করার সুযোগ দেয় নি, তুইও সাহস করিস না তিতাস। ভোরের দেহ সর্বপ্রথম আমিই ছুঁয়ে
দেখব।”
আমার বিয়ে করা বউ আপনি। যাকে আমি সাহস করে ছুঁয়ে দেখতে পারি নি। ভুল বুঝবেন ভেবে জোর অবধিও করিনি।
যে নারী আমার জন্য বৈধ তবুও এখনো খারাপ নজরে দেখি নি। অথচ নাহিদ তার সম্পর্কে এসব বলছে। এরপরেও চুপ থাকব? চুপ থাকা মানায়? আমি বাবা এত ভালো ছেলে না। এজন্য তাকে কড়া ডোজের শাস্তি দিয়েছি।”
-”তাহলে এসব কথা শাওন জানল কীভাবে? তুই বলেছিস?”
-”খেয়ে আমার কাজ নেই। চোরকে আবার চুরির কথা বলা লাগে নাকি? সেই তো নাহিদকে ক্যামেরাগুলো নিয়ে আসতে পাঠিয়েছিল। এসবের পেছনে সেও যুক্ত।”
-”কিহ!”
-”আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এখনো অনেক কিছুই জানার বাকি। বিয়ের দিন আপনাকে নিচে রেখে ভাইয়া যখন উপরে গিয়েছিল। তখন নাহিদ ভাইয়ার রুমে ক্যামেরা লাগাচ্ছিল।বাকি বন্ধুরা ছাদে আড্ডা দিচ্ছিল। ওই মুহূর্তে কারোই রুমে আসার কথা ছিল না। কিন্তু ভাইয়া এসে দেখে ফেলায় নাহিদ ঘাবড়ে যায়। থতমত খেয়ে ভাইয়া কিছু বলার আগেই রুমের দরজা বাইরে থেকে আঁটকে দৌড়ে শাওনকে ডেকে আনে।
যদি ভাইয়া তখনো বুঝেছিল না নাহিদ কী করছিল। নাহিদই হঠাৎ ভাইয়াকে দেখে ভড়কে গিয়ে ক্যামেরাটা নিচে ফেলে দিয়েছিল। তখনই ভাইয়া ক্যামেরা দেখে রেগে যায়। বুঝতে পারে নাহিদের উদ্দেশ্য। পরে শাওন এসে এটা ওটা বোঝাতে থাকে, বলে এটা মজা ছিল। ওগুলো নাকি সব নষ্ট ক্যামেরা।
এমন নানান কথা বলে নিজেদের দোষ ঢাকতে চেষ্টাও করে।
কথা কাটাকাটিও হয় তাদের মধ্যে। একপর্যায়ে ভাইয়া রেগে দু’জনকেই মারতে থাকে।ওরাও রেগে ভাইয়ারকে বেঁধে বুকে ঘুষি মারতে থাকে। সেই সময় শাওনের ব্যাচলেটে ভাইয়ার গলায় আঁ/চ/ড় লাগে। র/ক্ত জমে কা/ল/শি/টে পড়ে যায়।
এরপর তারা ক্লো/রো/ফোর্ম ব্যবহার করে ভাইয়াকে অজ্ঞান করে শ্বা/স/রোধ করে মারে। কেউ যেন সন্দেহ না করে তাই বাম হাত কেটে দেয়। যেন সবাই ভাবে সে সুইসাইড করেছে।
পরে ভাইয়াকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে ডেকে আনে।”
এসব শুনে ভোর নীরবে কাঁদছে। টপটপ করে ঝরে যাচ্ছে ওর চোখের নোনাজল। ওকে কাঁদতে দেখে তিতাস হাসল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ভোরের দিকে। এই মেয়েটা সত্যি খুব আবেগী। ডাক্তারদের এত আবেগী হলে চলে! তিতাস ভোরের হাতটা টেনে নিজের আঙ্গুল গুঁজে দিলো, ভোরের আঙ্গুলের মাঝে। এতে ভোরের কান্না আরো বেগে গেল। সে ভাবতেও পারে নি এসবের পেছনে কলুষিত সত্য লুকায়িত।
অথচ এতদিন পিয়াসকে নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করেছিল।
এটাও ভেবেছিল, পিয়াস হয়তো কাউকে ভালোবাসে। বাসা থেকে মেনে নেয়নি বিধায় এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। তখন তিতাস নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” এসব ঘটনা আমি কার থেকে জেনেছি জানেন?”
-”নাহিদের থেকে।”
-”না।”
-”শাওন?”
-”উহুম, আপনার বাবার থেকে।”
To be continue……..!!