প্রিয়_তুই,১৭,১৮

0
255

#প্রিয়_তুই,১৭,১৮
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১৭

-” এসব ঘটনা আমি কার থেকে জেনেছি জানেন?”
-”নাহিদের থেকে।”
-”না।”
-”শাওন?”
-”উহুম, আপনার বাবার থেকে।”

একথা শুনে ভোর হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল। আর কিছু ভাবার অবকাশ পেলো না। সে যখনই যা ভাবে তখনই তার বিপরীতে কিছু ঘটে। ওর বাবা জানত মানে? জানলে তাকে জানায় কেন?একথা ভেবে সে দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। এই মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু শোনার অবস্থায় ওর নেই। এবার একটু দম নেওয়া দরকার। মস্তিষ্ক এত চাপ নিতে পারছে না।
ক্ষণে ক্ষণে প্রচন্ড মাথা ব্যথা অনুভুত উঠছে। রুদ্ধশ্বাস করা
এক একটা সত্য শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। দম আঁটকে বুকে কষ্টের ভিড় জমে গেছে।নেত্রজোড়াও খুব জ্বলছে। কিছুক্ষণ আগেও, বিলের ঠান্ডা বাতাস তার মনটা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন বিরক্ত লাগছে।ওর অবস্থা আন্দাজ করে তিতাস কিছু বলতে গেলে ওর ফোন বেজে উঠল। স্কিণে বড় বড় অক্ষরে ভেসে উঠল তার মায়ের নাম। তিতাস কলটা রিসিভ করতেই উনি জানালেন, এখন বাসায় ফিরতে হবে নয়তো রাত হয়ে যাবে। তাছাড়া পরশুদিন তার পরীক্ষা। এখন বইতে চোখ না বুলালেই নয়। এতো আর স্কুলের পরীক্ষা নয় যে, হেলা করে গুরুত্ব না দিলেও চলবে। এছাড়া, হসপিটালেও ওকে ঢু মেরে আসতে হবে। তারা যেখানেই থাকুক এক্ষুণি যেন নাহিদদের বাসায় যায়। সেখান থেকেই উনারা বাসার পথে রওনা দিবে।
তিতাস ‘আসছি’ বলে কল কেটে ভোরকে বলল,

-”যা জেনেছেন গিলে হজম করে ফেলুন। নিজেকে পুনরায় প্রস্তুত করুন আরো অনেক কিছু জানতে। আপনার আরো অনেক কিছু জানার বাকি। যদি দেখি, আজ একটুকু জেনে
মুচড়ে পড়েছেন, তবে পরবর্তীতে মাটিতে শুয়ে নাগিন ড্যান্স দিলেও আর কিচ্ছু জানাব। ফাস্ট এ্যান্ড লাস্ট বার জানিয়ে দিলাম।”

-”তুই কীভাবে মেনে নিয়েছিস, বলবি আমায়?”

-”যেভাবে সবাই মেনে নেয়।”

-”আমি যে পারছি না?”

-”ভোর আপনাকে আমি দুই মিনিট সময় দিলাম, নিজেকে সামলে নিন। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কে গেঁথে নিন, পিয়াস আপনার অতীত আর তিতাস বর্তমান এবং ভবিষ্যত। তাই অতীতের কারণে বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে ভুলেও পায়ে ঠেলবেন না। যদি পারেন শক্ত বাঁধনে আঁকড়ে ধরুন। আর হ্যাঁ এসব যেন ভুলেও আব্বু আম্মুর কানে না যায়। এবার উঠুন, যেতে হবে আমাদের।”

ভোর তবুও অনড় হয়ে বসে রইল। তা দেখে তিতাসই তাকে টেনে দাঁড় করাতে করাতে বলল,

-”ওরে বাবারে ওজন কত রে! বউ কোলে নেওয়ার শখ মিটে গেছে আমার।”

ভোর কোনো জবাব না নিয়ে গাড়ির কাছে হাঁটা ধরল। তখন তিতাস দৌড়ে গিয়ে পাশের সিটে বসে পড়ল। অর্থাৎ ড্রাইভ করতে পারবে না সে। ভোর এবারো কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ঘুরিয়ে নাহিদদের বাসার পথে রওনা হলো।
মাগরিবের আজান দিচ্ছে চারিদিকে।ধীরে ধীরে ঘন আঁধারে ডুবে যাচ্ছে ত্রিভুবন।গ্রামের রাস্তা বিধায় লাইট নেই। পথঘাট
ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির লাইটে যা দেখা যাচ্ছে। ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। ততক্ষণে আজান থেমে গেছে। তিতাস কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করে পেছনের সিটের দিকে হাত বাড়াল। শুকনো খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে গাইগুই করল কোনটা খাবে। সময় নিয়ে বেছে বেছে চিপস্, চানাচুর, আর ড্রিংকসের বোতল নিলো। বাকিগুলো সামনে দিকে ছুঁড়ে মারল। যেন ওগুলোকে পোকা বসেছে। তারপর কুরমুড় শব্দ করে মনের সুখে চিপস্ খেতে থাকল। দু’একটা নয় মুঠো ভর্তি করে চিপস্ মুখে দিয়ে চিবাচ্ছে সে। খুব ক্ষুধা লেগেছে তার। ওকে এভাবে খেতে দেখে ভোর একটা বক্স এগিয়ে দিলো। ঘ্রাণেই বোঝা যাচ্ছে বিরিয়ানি। চাচী তিতাস আর রোজার জন্য রেস্তোরা থেকে কিনে নিয়েছিলেন।কারণ
উনি অবগত, এরা দু’জন ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। তিতাস চিপসের প্যাকেট রেখে বিরিয়ানির খেতে লাগল। আর খেতে খেতে ভাবল পাশের জনকে বলা ভদ্রতার পরিচয়। তাই সে ভোরকে বলল,

-”ভদ্রতার ক্ষাতিরে দিচ্ছি। আপনিও ভদ্রতা রক্ষার্থে “না, না, খাব না, তুই খা” বলুন।”

ভোর খাবে না ভেবে তিতাস যেই হাত সরাতে যাবে ভোর ওর হাত ধরে ফেলল। গাড়িটা এক সাইডে রেখে তিতাসের থেকে কেড়ে হাফ খাবার খেয়ে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-”কেউ ভালোবেসে দিলে কীভাবে না করি, তুইই বল?”

-”আমি তো আপনাকে ভালোবেসে আমার আম্মুকে দাদীমা বানাতে চাই। তবে কী এই চাওয়ারও সম্মতি পাবো?”

ভোর মুখটা কুঁচকে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করল। তিতাস খেয়ে
তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আড়মোড়া ভাঙল। তার এখন ঘুম প্রচন্ড পাচ্ছে। পেট শান্তি তো পৃথিবী শান্তি। আর পৃথিবীর শান্তি তো
নিজেরও শান্তি। আর নিজের শান্তি ধরে রাখতে ওর ঘুমাতে হবে, শান্তির ঘুম। মনে মনে একথা ভেবে তিতাস বলল,

-”একটা আবদার করি, রাখবেন?”
-”শুনি।”
-”আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে, একটু ঘুমায়?”
-”তো ঘুমা, বলার কী আছে?”
-”তাহলে ধার দেন?”
-”কি?”
-”আপনার কাঁধ। কথা দিচ্ছি, জ্বালাব না শুধু মাথা রেখে ঘুমাব।”

ভোরের জবাবের অপেক্ষায় না থেকে তিতাস ভোরের কাঁধে মাথা রাখল। পরক্ষনেই চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো। ভোর কিছু বলল না, সরালোও না। অতঃপর ভোরের কাঁধে মাথা রেখেই তিতাস ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের ঘোরে দু’একবার কাঁধে মুখ ঘষে আবার ঘুম। ভোর ওর কান্ড দেখে হাসল। জুনিয়র ছেলে বিয়ে করেছে। এসব জ্বালাতন তো সহ্য করতেই হবে!
বাচ্চা বর বলে কথা। এসব ভেবে মনে মনে হেসে তিতাসের চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। তিতাস ওর হাতটা টেনে বুঁকের বাঁ পাশে চেপে ধরে রাখল। খানিক্ষন পরে, নাহিদের বাসার উঠানে গাড়ি থামাল। ভিড় ভাট্টা নেই এখন। বাসাটা স্তব্ধ হয়ে আছে। কয়েকজন চেয়ার নিয়ে উঠানে বসে আছে। নাহিদের মৃ/ত্যু/র কথা শুনে সকালে যতটা খারাপ লাগছে, এখন ততটা লাগছে না। কেন জানি মন বলছে তিতাস ঠিক করেছে। বরং তিতাস না করলে সে নিজেই করত। নাহিদের মতো জ/ঘ/ন্য কীটের ম/রে যাওয়াই উত্তম। কারণ নাহিদ
শুধু তার শরীরে বিধবা তকমা লাগায় নি ,তার সন্মানেও হাত বাড়াতে চেয়েছিল। যে প্রিয় বন্ধুর বউয়ের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নি/ক্ষে/প করতে পারে। আর যায় হোক তাকে বিবেকবান মানুষ বলা চলে না। সে পশুর চেয়েও অধম। এসব ভেবে সে তিতাসের মুখপানে তাকাল। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে সে। অথচ রাগ মিটাতে সাং/ঘা/তি/ক কান্ড করে বসে আছে। যেটা বোঝার উপায় কারো নেই। তিতাসের মা এবং চাচী উঠানে দাঁড়িয়েই পিয়াসের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ওদেরকে বাসায় যাওয়ার দাওয়াত দিচ্ছিলেন। গাড়ি দেখে দ্রুত বিদায় নিয়ে
ভোরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। ভোর উনাদেরকে ইশারা করে গাড়িতে উঠতে বলল। তিতাসে ঘুমাতে দেখে উনারা নিঃশব্দে
তাই ই করলেন। ভোর গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে তখন শাওনের সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়ে গেল। শাওনের রাগান্বিত চাহনি।
ভোর গাড়ি ঘুরিয়ে শাওনের দিকে তাকিয়ে তিতাসের কপাল
বরাবর ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে হাসল। যেটা শাওন ছাড়া কারোর নজরে পড়ল না। তারপর গাড়ি চলল নির্দিষ্ট পথ ধরে। সময় গড়ালো, ঘন্টা পেরোলো। তিতাস তখনো গভীর ঘুমে মগ্ন।
রাতপ্রায় এগারোটার দিকে ওরা বাসায় পৌঁছাল। ধীরে সুস্থে নেমে বাকিরা চলেও গেল। তখন ভোর তিতাসকে ডাকল,

-”তিতাস, এই তিতাস, উঠ, চল রুমে গিয়ে ঘুমাবি।”

তিতাস গাইগুই করে হেলেদুলে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সে খাবে না তাও জানিয়ে দিলো। ভোর ফ্রেশ হয়ে খেয়ে শুতে এলো। প্রচন্ড ক্লান্ত সে। তাই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমে তলিয়েও গেল। পরক্ষণেই তিতাস উঠে ফোনটা নিয়ে বেলকণিতে চলে গেল। ওর ধারণাই সঠিক। সে ফোনে কিছু দেখে গম্ভীর হয়ে বেলকনিতেই রাত কাটিয়ে দিলো। পরদিন সকাল হলো। সময় মতো সকলেই একসঙ্গে খেতেও বসল। রোজা খাবে না বায়না ধরেছে এজন্য চাচী বকছেন। ভোর
অদূরে দাঁড়িয়ে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছে। তিতাসের মা সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন আর টুকটাক গল্প করছে। পাশে বসে তিতাসের বাবা খবরের কাগজে দৃশ্য বুলাচ্ছেন।
তখন তিতাস খাওয়ার মাঝেই চাচীর দিকে তাকিয়ে বলল,

-”কেবল এক বাচ্চার মা তুমি। চায়লে বিয়ে করে জীবন শুরু করতে পারো। এমন কিছু হলে আমাকে জানাও, আমি নিজ দায়িত্বে তোমার বিয়ে সম্পূর্ণ করব। তবুও পরকিয়াতে লিপ্ত হইও না চাচী মা। আমি চাচ্ছি না তুমি পুনরায় বিধবা হও।”

একথা শুনে চাচী হতভম্ব। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তখন তার দিকে। সকলে যে যার কাজ থামিয়ে হতবাক দাঁড়িয়ে আছে।
তখন তিতাস পানি খেয়ে পুনরায় বলল,

-”আসলে রুপে ফিরে এসো চাচী। তোমার জারিজুরি শেষ। ”

তিতাসের এমন ব্যবহারে ওর বাবা রেগে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে
তার গালে থাপ্পড়ও বসিয়ে দিলেন। ফাজলামি ভালো তবে লিমিটের মধ্যে। কিন্তু তিতাস লিমিট ক্রস করে ফেলেছে।
উনি আরেক থাপ্পড় মারতে গেলে ভোর থামিয়ে দিয়ে টেনে দূরে নিয়ে গেল। থাপ্পড় খেয়েও তিতাসের মাঝে হেলদোল দেখা গেল না। সে চাচীর দিকেই তাকিয়ে আছে। এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে চাচীর মুখোমুখি হয়ে অকপটে বলে ফেলল,

-”শাওন ভালো ছেলে নয়। আমাকে হিট করতে তোমাকে সে বেছে নিয়েছে। তার সঙ্গে তোমার যায় না চাচী, একেবারেই যায় না।”

To be continue……..!!

#গল্পগুচ্ছ_সমগ্র
#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১৮

-”শাওন ভালো ছেলে নয়। আমাকে হিট করতে তোমাকে সে বেছে নিয়েছে। তার সঙ্গে তোমার যায় না চাচী, একেবারেই যায় না।”

তিতাসের কথা শুনে চাচী কাঁদতে লাগলেন। লজ্জা-জনক ব্যাপার হলেও তিতাসের নালিশ সত্য। সত্যিই উনি শাওনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। না চায়লেও শাওন উনার বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছে। তিক্ত একাকিত্ব কাটাতে শাওনই উনার একমাত্র সঙ্গী। যাকে মনের কথাগুলো বলে প্রশান্তি অনুভব করেন। কখনো মনেও হয় নি খারাপ সে। কত্ত সুন্দর করে সে গান গায়, কবিতা আবৃতি করে শোনায়। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো মনের। তাছাড়া রোজাকেও আদর করে, ভালোবাসে।উনাকে সর্বদা ভালো-মন্দ কাজে বুদ্ধি দেয়।উনি কখনো ভুল
সিদ্ধান্ত নিলে সঠিকটা যুক্তিসহ বুঝিয়ে বলে। এইতো যেমন,
সময়ের অপেক্ষা না করে যত দ্রুত সম্ভব উনার স্বামীর ভাগ নিজের নামে করে নিতে বলে। এভাবে রেখে তিতাসের বাবা ঠিকই নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। এতে উনার খুব ক্ষতি হচ্ছে, এটা বুঝতে হবে মাথায় রাখতে হবে। তাছাড়া রোজার কথাও ভাবতে হবে। মেয়েটা ভবিষ্যত অন্ধকার। তিতাসদের অর্থ সম্পদ ঢের আছে। তবুও তারা পিতৃছায়াহীন রোজার কথা ভাবে নি, ভবিষ্যতেও ভাববে না। যদি ভাবতই, অনেক আগেই তার নামে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দিতো। তাছাড়া উনি বিধবা, মাথার উপরে অভিভাবক নেই।আজ বাসার রেখেছে কাল তাড়িয়ে দিতে পারে। এ অর্থ-সম্পদই হবে উনার শক্তি।
তাই যা নেওয়ার এখনই নিয়ে নিতে হবে। যেন পরে ঝামেলা করতে না পারে। এছাড়া তিতাসের বাবা চোখ বুজলে তিতাস পাল্টি খেতে কতক্ষণ। সে তো মহা ধড়িবাজ ছেলে। এরচেয়ে এখনই ঝামেলামুক্ত হয়ে বসে থাকা ভালো। যাতে তিতাসের বাবা অথবা তিতাস কোনোভাবেই সুযোগ হাতাতে না পারে।
শাওন ভালো আর উনার কথা ভাবে বলেই তো এসব বুঝায়। নয়তো উনি নিজের কথা ভাবাও ছেড়ে দিয়েছিলেন! স্বামীর অবর্তমানে নিজেকে হেলা করতেন, অসহায় ভাবতেন।এখন
আর কোনো ভয়ও নেই। কারণ শাওন বলেছে, এ সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে অনেকেই ঝামেলা পাকাবে। বারবার তার নামে মন্দ কথা বলে মন ভাঙ্গানোর চেষ্টা করবে। হচ্ছেও তাই। শাওনের কথাটন সত্যি সত্যিই ফলে গেল। এই মুহূর্তেই তিতাস বলে ফেলল, সে ভালো ছেলে নয়। এসব ভেবে চাচী কান্না থামিয়ে গর্জে উঠে বললেন,

-”আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমিই নিবো। এখানে তোর কথা
কথা খাটবে না তিতাস। তাই আমার ভালো আমাকে বুঝতে দে।”

-“তা তো হবে না চাচী। আপনি আমার বাসাতে থেকে এসব রংঢং করে বেড়াবেন। আর আমি দিনকানার মতো বসে বসে দেখব? প্রতিদিন কেউ না কেউ আমাকে কল করে জানায়, তোমার চাচীকে এখানে দেখলাম, সেখানে দেখলাম, একটা ছেলের হাত ধরে যেতে দেখলাম, শাওনের সঙ্গে লাঞ্চ করতে দেখলাম। শপিংমলে তাদের একসঙ্গে দেখলাম। আপনার কী মনে হয়, এসব শুনে আমার আনন্দ লাগে, অফুরন্ত সুখে গদগদ করি? নাকি খুশির চোটে ধৈই ধৈই করে নাচি?”

-”এটা শুধু তোর বাসা না, এটা আমার স্বামীরও বাসা। আমি সেই অধিকারে এখানে থাকি। তাই যা বলবি, ভেবে বল।”

-”হা হা হা, সিরিয়াসলি? ”

তিতাসের বাবা এবার চাচী (শাহিনার) কথায় রেগে গেলেন। তার মানে তিতাসের কথায় সত্যি। অথচ উনি ছেলেকে মেরে থামাতে চায়ছিলেন। উনি এবার সরাসরি শাহিনাকে জিজ্ঞেস করলেন। এবং শাহিনা খোলস থেকে বেরিয়ে এসে জানাল, সবটা সত্যি। আর উনি শাওনকেই বিয়ে করবেন। এতে কার সন্মান আসল গেল উনার ভাবার বিষয় নয়। বরং রোজার বাবার ভাগে সম্পত্তি উনার চায় নয়তো কে/স ফাইল করতে বাধ্য হবেন। সহজ সরল শাহিনার অধঃপতন দেখে সকলেই হতবাক। তাছাড়া একেকটা ব্যাপারে গা গুলিতে আসছে যে, এত মানুষ থাকতে শাওনকে? দেশে কী আর ছেলে ছিল না?
হ্যাঁ, শাহিনা বয়সে শাওনের ছোটই হবে। তবুও পিয়াসের বন্ধু সে। এ সম্পর্কের কথা ভাবতে গেলেও তো বিবেক নড়ে উঠে।
আর শাহিনা গ্রামের সামান্য পড়াশোনা জানা মেয়ে। দেখতে শুনতে ভালো বিধায় তিতাসের দাদীর পুত্রবধূ করেছিলেন। শহুরে বাতাস গায়ে লাগিয়ে এখন শহুরে বেশভূষা চালচলনে
পরিবর্তন এসেছে। স্বামীর টাকার জোরে নিজেকে পরিবর্তন করেছেন শহুরে কায়দায়। তবে এক বাচ্চার মা হয়েও মাথায় কাঁচা বুদ্ধিই রয়ে গেছে। তাছাড়া, ভাইয়ের অবর্তমানে রোজা ও শাহিনার দায়িত্ব তিতাসের বাবা নিজে নিয়েছেন। রোজার চিকিৎসার জন্য বাইরের দেশে নিয়ে যাওয়ার কথাও চলছে।তাছাড়া উনি শাহিনাকে ভাইয়ের বউ বলে দেখেনও না। উনি সর্বদা নিজের ছোট বোনের মতো দেখেন, ভালোবাসেন। তুই করে সম্বোধনও করেন। অথচ এই শাহিনা এতটা পরিবর্তন!
উনি আর কিছু বলার ভাষা পেলো না। তবে তিতাস বলল,

-”আপনার নামে এক কড়িকানাও দেওয়া হবে না, মানে না। আমি দিতে দিবো না। রোজা আঠারো বছর হওয়ার আগে সে কোথাও যাচ্ছে না, যাবেও না। ঠিক আঠারো বছর পরেই ওকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া হবে। তারপর যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবে।”

-”এতগুলো বছর সম্পত্তি আত্মসাৎ করার ধান্দা?ভেবেছিস
কিছু বুঝি না আমি?

-“যা ভাববেন তাই। আর হ্যাঁ, আপনি প্রেম প্রীতি ছাড়তে না পারলে, বেরিয়ে যাবেন, সোজা হিসাব।”

শাহিনা রাগে দুঃখে আর কথা বলতে পারলেন না। হাতের বাটিটা টেবিলে ছুঁড়ে প্রস্থান করলেন। এর হেস্তোনেস্ত করেই ছাড়বেন তিনি। তিতাসের মা এতক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে সকলের কথা শুনছিলেন। এমন কিছুই আন্দাজ করেছিলেন তিনি। এর যথেষ্ট কারণও আছে। কারণ শাহিনা আজকাল ফোন ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। উঠতে গেলেও ফোন বসতে গেলেও।
আজ সকালেই ময়দা মাখা হাত নিয়েই ফোন টিপছিল আর হাসছিল। উনি জিজ্ঞাসা করাতে বললেন,”খালাতো বোনের সঙ্গে কথা বলছি।” কেউ তার খালাতো বোনের সঙ্গে সবর্ক্ষণ
ফিসফিস করে উনার জানা ছিল না।তাছাড়া উনি রোজারও ঠিকমতো খেয়াল করছেন না। বরং রোজা কিছু বললেই সে রেগে যাচ্ছে। রেগে কখনো দাঁত খিসমিস করেন তো কখনো দু’এক ঘা বসিয়ে দেন। মারের ভয়ে মেয়েটা পানি খাওয়ার কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে। গত পরশুদিন একা একা পোশাক পরিবর্তন করতে গিয়ে হুহুল চেয়ার থেকে পড়ে গেছে। মুখ থুবড়ে পড়াতে দাঁতে ঠোঁট কে/টে ফুলে লাল হয়ে আছে।কিছু খেতে পারছিল না, পরে উনি দুধ ভাত খাইয়েছেন। গতকাল, নাহিদের বাসায়ও এক থাপ্পড় বসিয়েছেন। কারণ তখন উনি
উঠানে দাঁড়িয়ে শাওনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। রোজা নাকি কিছু খাওয়ার আবদার করছিল। মেয়েটা ক্ষুধার চোটে জেদ করছিল খাবার এনে দেওয়ার। তাই রেগে মেরেছিলেন। পরে উনি দোকান খুঁজে কিছু খাইয়ে এনেছিলেন। এছাড়াও উনি আজকাল যখন তখন বাহানা দেখিয়ে বাইরে যান। কখনো বলেন জরুরি কাজ আছে, তো কখনো বলেন রোজার ওষুধ আনতে। কিছু বললে অগ্রাহ্য করেন। উনার এসব ভাবনার ছেদ ঘটল তিতাসের হংকারে। ছেলেটা প্রচন্ড রেগে আছে। তবে মুভভঙ্গি স্বাভাবিক। সে উনাদের দিকেই তাকিয়ে গর্জে উঠে বলল,

-”তোমাদের মেয়েকে বলবে বাড়াবাড়ি কম করতে। নয়তো ওকে মেরেই জে/লে যাবো আমি। তার বেহায়াপনা বরদাস্ত করা যাচ্ছে না। তোমার মেয়েই চাচীকে উস্কে দেয় এসবের জন্য। সে এটাই বোঝায়, যার যার জীবন তার তার মর্জি।” আর মর্জিমতো সব করা যায়, সব। প্রতিটা মেয়ের জীবনেই স্বাধীনতা প্রয়োজন। আর স্বাধীনভাবে পৃথিবী উপভোগ করা আবশ্যিক।ক দিনেরই বা পৃথিবী। তাই মর্জি মতো যখন সেটা ইচ্ছে তাই করুক। সত্যি বলতে, ওর ব্যাপারে কিছু বলতেও আমার ঘৃণা লাগে, রুচিতে বাঁধে। ওকে আমি মানুষই ভাবি না। তারপরেও আজ বলতে হচ্ছে, তাতে গা গুলিয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, তার জন্মের পর তাকে মে/রে ফেলোনি কেন, কেন মারো নি বলো! মারলে অন্তত আমরা দুইভাই বেঁচে যেতাম।
প্রতিনিয়ত একথা শুনতে হতো না,”এই পিয়াস তোর বোনের বাজেট কত? পারবে তো স্যাটিসফাইড করতে?” পরেরদিন অন্য কেউ আমাকে ডেকে বলত না, ” বোনকে বলে রেট কম করিয়ে দে। প্রয়োজনে তুই পাঁচশ রাখ।” জাস্ট একটাবার ভাবো তো, কোনো ভাইকে যখন বড় বোনের ব্যাপারে কেউ একথা বলে তখন তার কেমন লাগে? তার ভেতরটা কেমন হয়? আমার স্থানে এসে নিজেদের দাঁড় করাও তোমরা, শুধু একবার।”

তিতাসের বাবা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। উনার অশ্রধারা গড়িয়ে শার্ট ভিজে গেছে। ছেলে কত সহজেই নিজের কথা বলে ফেলল। উনাকেও যে এসব নোংরা কথা শুনতে হয়, তা কি তিতাস জানে? গতমাসেই বিজনেস পার্টনার রাশেদ শেখ
প্রস্তাব রেখেছিলেন, সারাকে উনার কাছে পাঠাতে হবে।আর তাতে ডিল সাইন করবেন। যেটা দ্বারা উনার বিজনেস ফুলে ফেঁপে এক নাম্বার স্থানে জায়গা করে নিবে। কিন্তু উনি সেটা সরাসরি নাকচ করাতে আঠারো কোটি টাকা লস করেছেন।
যেটা এই মুহূর্তে বিজনেসের জন্য হুমকি স্বরুপ। আর একথা উনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। তিতাস আবার কিছু কথা বলতে গেলে ভোর তাকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। তিতার ওর হাত ছুটাতে গিয়েও মুখপানে তাকিয়ে থেমে গেল।এই একটা
জায়গায় সে রাগ দেখাতে পারে না, অভিমান করে থাকতেও পারে না। তখন ভোর তাকে বিছানায় বসিয়ে সামনে দাঁড়াল। চুলগুলো ঠিক করে থাপ্পড় খাওয়া গালে হাত বুলিয়ে নাকের ঘাম মুছে দিলো। তারপর তোয়ালে ভিজিয়ে তিতাসের বাম গালের উপর রাখল। তখন তিতাস ভ্রুজোড়া কুঁচকে বলল,

-”এভাবে ব্যথা যাবে না, হাজার দশেক চুমু দিন।”

-”কিহ্!”

-”আমি অল্পতেই সন্তুষ্ট তাই কম করে চাইলাম।”

-” শুনেছি কাটা দিয়ে নাকি কাটা তুলে হয়। তো থাপ্পড় দিয়ে থাপ্পড়ের ব্যথা উপশম করি?”

-”অবশ্যই কেন নয়! আমার গাল তো সরকারি। যখন যার ইচ্ছে দুপদাপ মেরে দিবেন। কিছুক্ষণ আগে বাবা মেরেছেন, এখন আপনি মারুন, তারপর পাবলিকের খেয়ে আসি। যত যায় হোক, সরকারি বলে কথা।”

-”থাক, পাবলিকের খেতে হবে না। তোর গালের প্রতি বাবা- মা আর আমার অধিকার আছে। তাই আমরাই এর ব্যবহার করব।”

একথা বলে ভোর মুচকি হাসল। তখন তিতাস তার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজল। অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে গেল ভোরের সর্বাঙ্গে। হাত পা অবশ হয়ে, বাকশূন্য সে। তখন তিতাস বলল,

-”ভোর আমি কখনো চাই না আমাদের মেয়ে হোক। আমি মন থেকে চাই, আমাদের ছেলে হোক ঠিক আমার ভাইয়ার মতো।”

-”আচ্ছা। ”

তিতাস সেভাবে থেকেই বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করল। ভোর বেশ কয়েকবার সরাতে গেলে শক্ত করে চেপে ধরল। ওভাবেই নীরাবতাকে সঙ্গী করে কাটিয়ে দিলো কিছু মুহূর্ত। তারপর তিতাসই আগে মুখ খুলল,

-”আজ আপনার আম্মুকে দেখতে যাবেন?”

-”না, তুই নিজ দায়িত্বে দাফন কার্য সম্পূর্ণ করেই ফেলেছিস। তবে আমি যেয়ে কী করব।”

-”আপনি জানতেন?”

-”হুম, আমি আসার পরদিনই আম্মু মারা গিয়েছিলেন।”

-”জানায় নি কেন জানতে চায়বেন না?”

-”না।”

-”তবুও বলি, আপনার বড় ভাই মিশান কসম দিয়েছিল যেন আপনাকে না জানায়। কারণ উনি চাচ্ছিলেন না উনার আম্মুকে আপনি দেখুন।”

To be continue……….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here